আমার গল্পের চরিত্র কিন্তু একই দেশের। তবে সুনিতার মত মাতাল দক্ষিণা হাওয়ার সাথে তার চলাফেরা কখনোই ছিল না। ছিল উত্তর-পূর্বের নদী বরাক, ইম্ফালের সাথে তার গভীর সংযোগ। বাড়ির পাশের লোকটাক লেকের শান্ত নীল জলের মত তার গতি। উচ্ছ্বাস নেই, মাদকতা আছে। সাদা মেঘের মত পেলব, ছুঁতে ইচ্ছে করে। সুনিতার মত অবশ্য তার চোখ গভীর কালো নয়, বরং কিছুটা ঘোলাটে বলা যেতে পারে। তবে সে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে এক মুহূর্ত ক্লান্তি আসেনি আমার। দৃষ্টি কাচের মত স্বচ্ছ। চোখে তাকিয়ে কথা বলতে পারত বিদ্যা। শান্ত শীতল, গভীর, ভয়ঙ্কর সে দৃষ্টি। হৃদয় পড়ে ফেলতে পারত। পারত ইয়া মোটা মোটা বই, জার্নাল এক নিমিষে পড়ে ফেলতে। শান্ত চোখ দুটিতে ভারী ফ্রেমের চশমা থাকার কথা ছিল, সৌভাগ্যবশত নেই। গোলগাল বিদ্যাকে দেখতে কেমন লাগত কে জানে।
ক্লাস রুমের বিরক্তিকর লেকচারগুলোতে ওকে মিস করতাম। থাকবে কি করে, আমি যখন মাস্টার্সের ক্লাস করি তখন ও পিএইচডি প্রপোজাল লিখে। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা চায়ের দোকানের মত একটা বিয়ারের দোকানে। বার নয়, গ্রোসারি স্টোর। কিন্তু বসে বিয়ার, এলকোহল খাওয়া যায় ভার্সিটির পাশে। প্রথম দেখায় তেমন আহামরি কিছু লাগেনি। আর দশটা সাধারন মেয়ের মতই। আস্তে আস্তে পরিচয় হলো। পাশ দিয়ে যাবার সময় তখন বুক ভরে চুলের ঘ্রান নিতে পারি। একদিন বলেই ফেললাম, চুলে শ্যাম্পু করোনি আজ। সেই ঠান্ডা শীতল দৃষ্টি ফেলে চোখে। আমি নিরুত্তাপ হয়ে বলি, চমৎকার ঘ্রান ছিল। বিদ্যা চোখ নামিয়ে নেয়। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু কি ভাবছিল ও? জানতে চাইনি কখনো। তারপর কথা হয়, একসাথে ভদকা-বিয়ার পেটে চালান করে হাঁটতে হাঁটতে ওকে বাসায় দিয়ে আসি। কখনো বা সিঁড়িতে বসে দুটো সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে মিলাই। রাতের অন্ধকারে ফুল দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ি। কখনো সকাল হত ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে। বিদ্যা তখন বলত, ঘুম পাচ্ছে। সারারাত কিভাবে কেটে যেত টের পাইনি।
একদিন লাইব্রেরিতে গান শুনছি হেডফোনে, “এই মেঘলা দিনে, একলা ঘরে থাকে না তো মন”, টেবিলে শুভ্র হাতের টোকা। কি গান শুনছো? বললাম লিঙ্ক পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেই যে শুরু, তারপর নিয়মিত আবদার, গান পাঠাতে হবে। আমি বলি, তুমি তো কিছু বুঝো না। সুর উপভোগ করার জন্য ভাষা জানার দরকার আছে কি? বিদ্যার সোজা সাপ্টা উত্তর। আবার প্রশ্নও। আমি ভাবি, আসলেই কি দরকার আছে? তারপর কথা হয়, আমরা গভীর রাতে ইউনিভার্সিটির রাস্তা ধরে হাঁটি। সিগারেট ফুঁকি। জীবন ও জীবন বোধের আলোচনা হয়। গান আসে, শিল্প আসে, সাহিত্য আসে, বিদ্যার রান্না করা খিচুড়ি আসে। সাথে ডিম ভাজি। অমৃতের মত সে খাবার দিয়ে উদরপূর্তি করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি প্রবাসে। বিদ্যা রান্না করতো চমৎকার। চোখ বন্ধ করে দশে বারো দিয়ে দেয়া যায়। কোন একদিন বিদ্যার সোনা বাঁধানো হাতের অমৃত খেয়ে ফিরছি। একা। মাথায় ঘুরছিলো, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে”। পাঠিয়ে দিলাম। সে আগেই শুনেছে, জানিয়ে দিলো। সাথে আরো কিছু গানের লিস্ট ও শুনিয়ে দিল। বাংলা গানের। সে নিজেই খুঁজে খুঁজে শুনেছে। আমার ভাঙা ইংরেজিতে কিছুটা অনুবাদ করিয়ে দিলাম। এরপর লালন এসেছে, হাছন রাজা এসেছে, শাহ আব্দুল করিম, বারী সিদ্দিকি, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন আহমেদ, তসলিমা নাসরিন, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, আহমদ ছফা, রবীন্দ্রনাথ, জসীম উদদীন, শামসুর রাহমান, জীবনানন্দ দাশ, হেলাল হাফিজ। পশ্চিম বঙ্গের বাংলা সাহিত্য এসেছে, সংগীত এসেছে, কবিতা এসেছে। শক্তি এসেছে, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ কেউ তো বাদ যায়নি। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন সব খোলা পাতার মত বিদ্যা পড়েছে। রোমাঞ্চ অনুভব করেছে।
ইম্ফালের সাথে নাড়ীছেড়া বিদ্যার শৈশব কৈশোর যৌবন কেটেছে দিল্লী, মুম্বাইয়ের ইট-পাথর-দেয়ালের জঞ্জালে। শহুরে প্রেম তাকে বড় নাড়া দেয়। ইম্ফাল, বরাক তীরের সাহিত্যের সাথে তার সম্পর্ক বড় ক্ষীণ। সমরেশের চাবাগানের শৈশব তাকে আলোড়িত করে তার শেষ বিশে। ২৩-২৪ এ পিএইচডি শুরু করা বিদ্যার তখন আফসোস, সে কেন বাংলা পড়তে জানে না। বোঝে না।
শেষ দিকে বিদ্যা আমাকে ফেসবুকে মেসেজ পাঠাতো গুগল ট্রান্সলেটরে ট্রান্সলেট করে। নতুন কোনো খবর আছে? তুমি যতক্ষণ না ফের, ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করব। ভুলে যাও সব! বিদায়। যেতে হবে।
পাদটীকাঃ লেখাটা রেজা শাওনের “গল্পটা ছিল অহংকারের” থেকে অনুপ্রাণিত। তবে কোনওভাবেই রেজা শাওনের লেখার কাছে যাবে না তা হলফ করে বলতে পারি। ওর লেখার সাবলীলতা আর কোথাও পেয়েছি কিনা, চিন্তা করতে হয়। ওর সাথে আমার তুই-তোকারি সম্পর্ক। একদিন ওকে বলেছিলাম, বই লিখে ফেল। ভয়ঙ্কর প্রজাতির অলস রেজা শাওন কথা দিতে দেরি করেনি, লিখতে হয়তো ভুলেই গেছে। গুণী ছোটভাই এখন সুনামগঞ্জের হাওড়ে ঘুরে বেড়ায়, প্রকৃতি বান্ধব পর্যটন নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। দূর্জনেরা অবশ্য এটাকে ব্যবসা বলে। যাই হোক, এখন সে বিশাল ব্যস্ত মানুষ। না হলে কি আর ২০১৮ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে বসে ২০১২ সালের লেখা পড়তে হয়?
খুব ভালো লাগলো। লেখাটা বোধ হয় আরো বড় হতে পারতো। ভূমিকাটা শেষে বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে আসতে পারতো কিংবা কারও মন্তব্যের জবাবে। :clap: :clap:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
বড় করার ইচ্ছা ছিল ভাই। মাঝপথে গতি হারিয়ে ফেলেছিলাম। বহুদিন না লেখার ফল।
এই অখাদ্য লেখা ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
চমৎকার লেখা... খুব ভাল লেগেছে পড়তে।
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই। 🙂
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
আর খানিকটা সম্পাদনা করতে হবে।
মাহমুদুল ভাই,
সালাম। লেখাটা কেবল জমে উঠেছে, তখনই শেষ করে দিলেন? অকাল প্রয়াণ হয়ে গেল না?
ভালো লাগল।
নতুন পূর্ণাঙ্গ গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
কৌশিক, সত্যি বলতে কি, লেখাটা অনেক বড় করার ইচ্ছা ছিল। লিখতে লিখতে হঠাৎ অন্য একটা কারণে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। আর লিখতে ইচ্ছে করছিলো না। তবে ভাবছি লিখবো। একটু বড় করে। অপেক্ষা করতে হবে। 😉
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 😀
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য