১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যখন খুনি চক্র সপরিবারে হত্যা করে তখন আমার বয়স মাত্র ১৪। অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি। একে তো ওই ঘটনার তাৎপর্য বোঝার বয়স তখন ছিল না; দ্বিতীয়ত, ক্যাডেট কলেজের মতো সেমি কারাগারে রাজনীতিটা একরকম নিষিদ্ধ বস্তু। মনে পড়ে, ক্লাস কক্ষে একজন শিক্ষক এসে আমাদের বঙ্গবন্ধু হত্যার তথ্যটি জানিয়েছিলেন। ব্যাস ওইটুকুই।
১৯৮১ সালে যখন চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানতে হত্যা করা হয়, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ি। মনে আছে কলা ভবনে ক্লাস করতে এসে দেখি সামরিক অভ্যূত্থানের খবর রটে গেছে। দ্রুতই বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁকা হয়ে যায়। জিয়ার হত্যাকারী সামরিক বাহিনীর একাংশ চট্টগ্রাম দখল করে রেখেছে। দুপুরেই চট্টগ্রামের বাসে উঠে পড়লাম। কোনো কারণ না, স্রেফ কৌতুহল চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দেখতে যাই। চট্টগ্রাম তখন বাংলাদেশের মধ্যেই এক বিচ্ছিন্ন অঞ্চল। ফেনি পার হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে যেতে দেখলাম। মহাসড়কে একের পর এক সেনা কনভয় চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছে। থমথমে অবস্থা। বাসে লোকজনের নানা মন্তব্য আলোচনা শুনতে শুনতে চট্টগ্রামে পৌছাই।
সার্কিট হাউস যেখানে জিয়া নিহত হয়েছেন তার আশপাশ দিয়ে ঘুরি, কিন্তু ভেতরে যেতে সাহস হয়না। কতইবা বয়স তখন? ১৯। একসময় জেনারেল মনজুর নিহত হন। অভ্যূত্থানকারী সেনাকর্মকর্তারা চট্টগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়, চট্টগ্রাম আবার কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আমিও ঢাকায় ফিরে আসি।
১৯৮২ সালে লে. জে. হোমো এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন দানা বাধে। ক্যাডেট কলেজের ছাত্র সত্ত্বেও সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে আমার কোনো মোহ ছিল না। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ কখনোই ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ-বাসদ ছাত্রলীগসহ আরো কিছু বাম সংগঠন নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে। ‘৮৩ সালে এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে নিহত হয় বেশ কয়েকজন। ওই আন্দোলনে শুরু থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে শরিক ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিস্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৮৪ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পূনর্মিলনী হচ্ছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলন করা তাজা টগবগে তরুণ আমরা। আগেই জানতাম পূনর্মিলনীর প্রধান অতিথি লে. জে. হোমো এরশাদ। আমরা এর প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু বড় ভাইরা সেটা মানেননি। পূনর্মিলনীতে গিয়ে আমরা এরকম কিছু তরুণ সিদ্ধান্ত নিলাম এরশাদকে কলেজে কালো পতাকা দেখানো হবে। আমাদের সঙ্গে যোগ দিল আরো বেশ কিছু ছাত্র। আমাদের এবং আগে-পরের কয়েক ব্যাচে সেসময় রাজনীতি সচেতন, ছাত্ররাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন করা নাঈম, শাহীন, হাসনাত ভাইসহ এরকম বেশ কয়েকজন এই দলে ছিলাম।
পূনর্মিলনীর আগের রাতে ফৌজদারহাট বাজার থেকে কালো কাপড় কিনে আনলাম আমরা। কেটে টুকরো টুকরো করে সেটা বিলি করলাম সবার মধ্যে। কিন্তু কালো কাপড় দেখে সিনিয়র ভাইদের মধ্যে বিশেষ করে যারা চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত ছিল তারা আতন্কিত হয়ে পড়েন। আমাদের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করে তারা কালো কাপড় দেখানোর কর্মসূচি বাতিলের চেষ্টা চালান। কিন্তু মধ্য ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী যুবকদের শান্ত করা সহজ কাজ ছিল না।
কলেজ ক্যাম্পাসে এরশাদ আসার আগেই সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সদস্যরা পুরো এলাকা ঘিরে ফেললো। বিক্ষোভকারী আমাদের আটকে রাখলো রবীন্দ্র হাউসে। প্যারেড গ্রাউন্ডে কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মার্চপাস্টে সালাম নিচ্ছেন গণধিকৃত এরশাদ, আমরা তখন রবীন্দ্র হাউসে বন্দি অবস্থায় শ্লোগান দিচ্ছিলাম আর সেখান থেকে কালো পতাকা দেখাচ্ছিলাম।
এরশাদ যতোক্ষণ কলেজে ছিলেন ততোক্ষণ আমাদের আটকে রাখা হলো। হোমো এরশাদ চলে যাওয়ার পরপরই আমরা পূণর্মিলনী বর্জন করে কলেজ থেকে রেরিয়ে আসি।
এখনো মাঝেমধ্যে ভাবি ওইসময় এতোটা সাহস আমরা পেয়েছিলাম কোথায়?
ক্যাডেটদের সাহস মনে হয় একটু বেশিই হয়।
ভাইয়া আপনি কি লেখা-লেখি পেশার সাথে জড়িত? আপনার ব্লগ গুলা অতি উচ্চ মান সম্পন্ন। অসাধারণ গতিময়।
আরো অনেক অনেক লেখা চাই।
ভাইয়া আপনি কি লেখা-লেখি পেশার সাথে জড়িত?
বাদশা ভাই (আইন্সটাইনকে)-জনাব,আপনি কি গুন ভাগ যোগ বিয়োগ পারেন?
আইনস্টাইন-জি মানে তা কিছুটা পারি... 😀
ধন্যবাদ ভাইয়া। হ্যা কিছুটা তাই।
লেখাটা আগেও পড়েছিলাম। তখনো ভাল লেগেছিল। এখনো লাগলো 🙂
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ তোমাদের।
আগের ক্যাডেট কলেজ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা করে। আর আপনার লেখাগুলো আনায়াসে সে অভাব পূরন করতে পারে। আরও লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
আপনার লেখাগুলো পড়তে খুব ভাল লাগছে। ক্যাডেট কলেজে রাজনীতি তো দূরের কথা সে বিষয়ে সচেতনতাও থাকে না। দেশ সম্পর্কে ক্যাডেটদের চিন্তাভাবনা কম থাকার কারণও বোধহয় এটাই। তা না হলে ক্যাডেট কলেজ থেকে এ পর্যন্ত যত ছেলেমেয়ে বেরিয়েছে সে তুলনায় রাজনীতি সচেতন নাগরিকের পরিমাণ এতো কম হতো না। রাজনীতি বলতে এখানে রাষ্ট্র বিষয়ক সব কিছুকেই বুঝিয়েছি।
বস, আপনার ডান পা'টা একটু আগাইয়া দেন...কিছু না, স্রেফ ধুলা নিমু....
নিজে না বলেই হয়ত সাহসী মানুষদের দেখলে খুব শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে...
কবে আমার এত সৎ সাহস হবে.........?????
বোকা ছেলে। সাহস সবারই থাকে। কম আর বেশি। সময়, সুযোগে সেটা প্রকাশ পায়। সত্যকে সত্য বললে, অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করলেই সাহসের কাজ হয়। সাহস আবার অনেক সময় বোকামি হতে পারে।
আমরা একটা সময় পেয়েছিলাম। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের। সম্ভবত সময়টা আমাদের সাহসী হতে সাহায্য করেছিল।
ভালো থেকো।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
৯৯৯ ভাই
আপনার থেকে ঠিক এমনই একটা লেখা পাবার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। পড়ে ভালো লাগলো।
খুবই ভাল লাগল লেখাটা পড়ে ভাইয়া............।।
ভাল লাগল খুব।
অসাধারণ লেখা। truly inspiring
আগেই একবার পড়েছিলাম, আজ আবার পড়লাম। অবিশ্বাস্য ঘটনা সানাউল্লাহ ভাই :boss: :boss: আপনাদের সাহসিকতায় মুগ্ধ এবং একই সাথে একজন ক্যাডেট, একজন ফৌজিয়ান হিসেবে গর্বিত বোধ করছি খুব।
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
ওই মিয়া লজ্জা দাও কেন? সাহস তো সময়, সুযোগের ব্যাপার। আমরা একটা সময় পেয়েছিলাম। তেমন সময় এলে তোমরাও সাহসী হয়ে উঠবে।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
সাহসী বড় ভাইদের :salute:
গব্বর সিং প্রশংসা করছে, আমি তো লজ্জায় লাল!!
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
জো ডর গায়া ,সামঝো ও মর গায়া 😀
এই লেখাটা আগে সামহোয়ার - এ পড়ছিলাম।
সানা ভাই, আপনাদের জন্য :salute:
প্রিয়তে নিয়ে নিলাম।
ধন্যবাদ ভাইয়া। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। ভালো থেকো।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
:salute:
এরশাদ ব্যাটা তো বহাল তবিয়তে আছে এখনতরি, প্রেসিডেন্ট হইবার চায়। কি তামাশা।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ওই ব্যাডারে দেখলে আমার এখনও বমি পায়।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
:boss: :boss: :boss: bolar vasha nai....