৫১ একরে সীমাবদ্ধ জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)

নবমে এসে লেখাপড়ায় একটু সিরিয়াস ভাব আসল। যাই লেখাপড়া হোক না কেন সবই হয় এসএসসি কে টার্গেট করে। এক বন্ধুর বড়ভাই রংপুর ক্যাডেট কলেজে ক্লাস টুয়েলভে ছিলেন। তিনিও চিঠিতে এসএসসি’র কথা গুরুত্ব সহকারে লিখেছিলেন। সায়েন্স আর আর্টস ভাগ হবে। সেটা নিয়ে মোল্লা স্যারের হুমকি ধামকিতে আমরা প্রথম কয়েকমাস বেশ তটস্থ ছিলাম। (জন্মলগ্ন থেকেই স্যার আর কলেজ যেন হরিহর আত্মা, আপন সহোদর। স্যারকে ছাড়া বরিশাল ক্যাডেট কলেজকে চিন্তাই করতে পারি না। স্যারকে নিয়ে আলাদা লেখার ইচ্ছা রইল।) কারা সায়েন্সে পড়বে, কারা হায়ার ম্যাথস পাবে না পাবে তার নিয়ন্তা হলেন মোল্লা স্যার। আমরা কয়েকটা ছোটখাট পরীক্ষা দিয়ে খানিকটা চড়াই উৎরাই পার হয়ে মোটামুটি থিতু হলাম।

এই সময়ে অনেকটাই ম্যাচিওরড আমরা। নিচে দুই দুইটা জুনিয়র ব্যাচ আছে – কম কথা নয়। খেলাধূলা থেকে শুরু করে পড়াশুনা সব কিছুতেই আমরা জুনিয়র ডিভিশনের হেড। যে কোন প্রতিযোগিতায়, বিশেষ করে যেখানে কম্বাইন্ড এফোর্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ সখোনে আমাদের বিফ্রিংটা হত একটু অন্যধাচের। ক্লাস সেভেন, এইটের জন্য যেখানে ভাষাটা আদেশের মতোন সেখানে আমাদের জন্য ভাষাটা পরামর্শের মতোন। বন্ধুরা কেউ কেউ বলেই বসত, “হুহ – এখন তেল দিচ্ছে”। তবে বলতে বাঁধা নেই বিজয় আসলে আনন্দটা হত দারুণ।

ক্যাডেট কলেজের অন্যতম একটা অনুষঙ্গ হাসপাতালের সাথে মিতালী পাতালাম এ সময়। মাম্পস্‌ নিয়ে সোজা আইসোলেশন ওয়ার্ডে চলে গেলাম। সেখানে দিন কাটে সকাল বিকাল দুটো করে পেনিসিলিন ইনজেকশন নিয়ে আর গুমোট ঘরে পূর্ণবেগে ঘোরা বাতাসবিহীন ফ্যানের নিচে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। হাশেম ভাই আর জলিল ভাই এর ইনজেকশন মায়া মমতাবিহীন। তার তুলনায় বিমলদা আর তাহমিনা সিস্টারের ইনজেকশন যথেষ্ট মানবিক। সেবার মাম্পস্‌ এমন মহামারী আকারে হয়েছিল যে আইসোলেশন ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান হয়নি। মাম্পস্‌ রোগীর প্রাচুর্যে সাধারণ ওয়ার্ড ভরে গিয়েছিল। আর সাধারণ জ্বর বা ব্যথা নিয়ে যারা ভর্তি ছিল তাদের ঠাঁই হয়েছিল সেই ছোট্ট ঘরটায় (তথাকথিত আইসোলেশন ওয়ার্ড)।

এরপরও বহুবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে। কখনও নিজের জন্য (ফুটবল খেলতে যেয়ে শাহাবের পায়ের লাথি লেগে কপালে স্টিচ দিতে হয়েছিল। যা দেখে আতাউর স্টাফ বলেছিলেন, তোমার বৌ এইটা খুব পছন্দ করবে – যদিও তার প্রমাণ এখনও আমার বৌ দেয়নি) আর কখনো বা অন্যকে নিয়ে (তৌহিদের কানে পোকা ঢুকে রাত দুপুরে সে যে কি বিভৎস অবস্থা তা আর বলার নয়)। এছাড়া সুস্থরা অসুস্থদের দেখতে যেত। কখনও বা বিনা অসুখে আরাম খুঁজতে যেত কেউ কেউ। টিভিতে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা চলাকালীন সময়ে এসব মৌসুমী রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেত।

দশমে আসতে আসতে লাইব্রেরির সাথে সখ্যতা বেড়েছে অনেক। সেই ক্লাস সেভেন থেকে সাপ্তাহিক একটা মাত্র লাইব্রেরি ক্লাসের জন্য হা করে বসে থাকতাম। বই ইস্যু করে বাকিটা সময় বইয়ের রাজ্যে ডানা মেলে দিতাম। কেন একাধিক বই ইস্যু করা যাবে না এই প্রশ্নটা বড় খোঁচাত মনের মধ্যে। এত অল্প জায়গায় বইয়ের এত বিশাল সংগ্রহ বোধ করি ১৩/ ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরের জন্য অভাবনীয়। কি নেই এখানে? দর্শন শাস্ত্রের মোটা মোটা বই দিন গুনছে কবে কোন ক্যাডেট তাকে বুকে তুলে নিবে – মায়া ভরে চোখ বুলাবে প্রতিটা পাতায়।

লাইব্রেরির ওআইসি পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন কেনা বইয়ের ধরণ ও পরিমাণে পরিবর্তন আসে। রফিক নওশাদ স্যার (বাংলা) যখন ওআইসি হলেন তখন একগাদা নতুন বই কেনা হল। আমাদের জন্য উন্মুক্ত হল এক বিশাল অজানা রাজ্য। ক্যাডেট কলেজে বসেই পরিচয় হল জুলভার্ণ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, জাফর ইকবাল, হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব গুহ সহ দেশী বিদেশী নানান লেখকের অনবদ্য সব লেখার সাথে।

একইসাথে পাল্লা দিয়ে বই পড়তাম বন্ধুরা। কি ক্লাস টাইম কি প্রেপ টাইম সব একাকার হয়ে যেত গল্পের বইয়ের নেশার কাছে। দুপুরের ঘুম হত তুচ্ছ আর রাতের লাইটস অফ হত অবজ্ঞার বিষয়। এ নিয়ে ধড়পাকড়ও কম হয়নি। মাঝে মাঝে বই পড়া নিয়ে স্যারদের তথা অথোরিটির নানান নকশা অসহ্য লাগত। অবশ্য হিতে বিপরীত একটা লাভও হত এতে। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ যেমন বেশি থাকে তেমনভাবে আমরা গল্পের বইতে আসক্ত হতাম। লাইব্রেরির বইয়ের পাশাপাশি আমাদের হাতেও ঘুরত অন্যান্য বই। বিশেষ করে সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, ওয়েস্টার্ণ ইত্যাদি।

লাইব্রেরি হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময় এমন অবস্থা হয়েছিল যে মোটামুটি সব বইয়ের লোকেশন আমি জানতাম। লাইব্রেরির সঠিক ব্যবহার করা এবং লাইব্ররিতে প্রচুর সময় কাটানোর জন্য লাইব্রেরিয়ানও আমাকে প্রচুর ছাড় দিতেন। যখন তখন মূল্যবান সব রেফারেন্স বই নিয়ে আসতে পারতাম। যেসব বই পত্রপত্রিকা অন্য কেউ ছুঁতে পারত না সেখানে আমার ছিল অবাধ বিচরণ।

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য সার্বিক পরিস্থিতি খানিকটা শিথিল থাকে। আর পড়ালেখার পাশাপাশি কেমন করে যেন এইসময় দুষ্টুমিটাও বেশ জমে ওঠে। একরাতে বন্ধুরা টুপটাপ করে ডাব পেড়ে ফেলল ৮৬ টা। এখন খাবার লোক নেই। একতলার একটা রুমের খাটের নিচে কম্বলে ঢেকে রাখা হয়েছে সব ডাব। শেষমেষ চুপিচুপি ডাব খাওয়ার আমন্ত্রণ পাঠানো হল সব হাউসে। এক এক এসে লোকজন ডাব খেয়ে যায় আর আয়োজকরা বালতিতে করে ডাবের খোসা ময়লা কাপড়ে ঢেকে নিয়ে যায় বাথরুমের দিকে (ভাবটা এমন যেন ভদ্র ক্যাডেট – কাপড় কাঁচতে যাচ্ছে)। সেখান থেকে সেগুলো বিচ্ছুরিত হয় দেয়ালের ওপাড়ে পুকুরের পানিতে। পরদিন সকালে পুকুরের পানিতে অসংখ্য ভাসমান ডাবের খোলস একটা দর্শনীয় বিষয় হয়েছিল।

হাউসের সামনে রাস্তায় শুরু হল ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট। রাস্তার পাশে তালগাছ আছে বলে নাম হলো “তালতলা ক্রিকেট” টূর্ণামেন্ট। পুরো ক্লাসকে (সবার অংশগ্রহণ ছিল এতে) সাতটা টিমে ভাগ করে রীতিমত ফিকশ্চার সার্কুলেট করে আয়োজন করা হয়েছিল সেই টুর্ণামেন্টের। টিমগুলোর নামকরণও হয়েছিল বাহারী – নরকোয়েস্ট, প্যানথার, ওভাকন ইত্যাদি। এর পাশাপাশি রুম ক্রিকেট তো মামুলি ব্যাপার। এমনও হয়েছে সারারাত ক্রিকেট খেলে সকালে প্রি-টেস্ট বা টেস্ট এক্সামে এ্যাটেন্ড করতে গেছে কেউ কেউ।

এসময় কাগজের উপদ্রব বেড়ে গেল মহামারী আকারে। কাগজের উপদ্রব বলছি এই কারণে যে আমাদের মধ্যে কাগজ সংক্রান্ত একটা কথা এভাবে প্রচলিত ছিল যে, “কলেজে কখনো কাগজ (সিগারেট) খাবে না, কাগজ (গুপ্ত প্রকাশনী আর কি!!) পড়বে না আর কাগজ (তাস) খেলবে না”। এরমধ্যে সেবা প্রকাশনীর অনুবাদ সিরিজের বদৌলতে হাতে পেলাম মারিও পুজোর লেখা বিশ্ববিখ্যাত থ্রিলার “গডফাদার” এর চারটা খন্ড। পড়লাম এবং ২২ জন ক্লাসমেটকে পড়ালাম। এও এক নেশা। সবগুলো চরিত্র মাথার মধ্যে এক বিশালত্ব নিয়ে এখনও বিরাজ করছে। বন্ধুদের কেউ কেউ গডফাদারের কার্যকলাপে উদ্ভুদ্ধ হয়ে ফাইজলামি করা শুরু করল – সবাই বুঝবে কে করেছে কিন্তু কোন প্রমাণ নেই। ক্লাসমেটরা তো বটেই কোন কোন সিনিয়রও এই গডফাদার এফেক্টের ভুক্তভোগী হয়েছেন।

[বরিশাল ক্যাডেট কলেজের মোট আয়তন ৫১ একর (মতান্তরে ৫০)। লেখাটি এর আগে একটা স্মরণীকাতে (২০০৬ এ) প্রকাশিত হয়েছিল। আবারও সেটা সবার সাথে শেয়ার করার সুযোগ হারাতে চাইলাম না। লেখাটির খানিকটা সংস্কার করে এখানে দেয়া হল। চলবে…]

১,৬০৪ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “৫১ একরে সীমাবদ্ধ জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)”

  1. ভাই, অসাধারণ একটা লেখা। লাল সালাম।
    অন্য সেকশনের সাথে লাইব্রেরীতে যাবার জন্য যে কতবার মাইর খাইছি ভিপির হাতে...

    ক্যাডেট কলেজের লাইব্রেরীটা না থাকলে একটা বিশাল জগৎ অচেনা থেকে যেত আমাদের।

    জবাব দিন
  2. মান্নান (১৯৯৩-১৯৯৯)

    কলেজ লাইব্রেরী.....এক অসাধারন আকর্ষন ........জুনিয়র অবস্থায় এক সময় খালি পত্রিকার পাতা উল্টাতাম।ধীরে ধীরে লাইব্রেরীর আসল ব্যবহার শিখলাম। মাঝে মাঝে সারারাত বই পড়ে সারাদিন ক্লাসে ঘুমিয়েছি । এখন ব্যস্ততার জন্য বই পড়া কমে গেছে কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে সারারাত কাটিয়ে দিই বই পড়ে। আর অফিস ফাঁকি দেই অসুস্থতার নাম করে ।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।