অক্টোবরের পাতা ঝরা রাত। পশ্চিম থেকে অ্যাড্রিয়াটিকের গা ছুঁয়ে আসা বাতাস হিম করে রেখেছে চারপাশ। খুব সজাগ হয়ে কান পাতলে বাতাসের ডাক শোনা যায়। বিমর্ষ এক হাহাকার জাগিয়ে সে বাতাস দিনারিক পর্বতমালার গা ঘেঁষে হারিয়ে যায়। নিস্তব্ধ চারপাশ। গাছের পাতাটি পড়লেও শোনা যায় এমন। মানুষ পৃথিবীতে আসার অনেক অনেক আগে, যখন মহীসঞ্চারণে প্যানেজিয়া ভেঙে সাত সাতটি আলাদা মহাদেশ হচ্ছিল, তখন কি পৃথিবী এমন ছিল? এমন শান্ত, অবিশ্রান্তভাবে নীরব আর নিশ্চুপ?
‘দিয়ান এল্ভির’ নামের মাঝবয়সী এক লোক সিগরেট ধরাবার জন্য চারপাশ হাঁতড়ে লাইটার খুঁজছে। খুব সাবধাণে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে পড়ে থাকা একজনের দিকে এগিয়ে যায় সে। অন্ধকারে মুখ চেনা যায় না। এ হয়তো ‘মিহাল’ হবে। মিহাল জোরান, দিয়ানের প্রতিবেশী। সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে আগে, সাইরেন বেজে ওঠার সাথে সাথে ওরা যখন শুনেছিল, ফ্রেঞ্চ শান্তিরক্ষীদের হটিয়ে দিয়ে সার্ব’রা আসছে; তখনই বেড়িয়ে পড়ে ওরা। ওরা অনেকেই। হয়তো সেব্রেনিতসার সবাই। এরপর শুধু দৌড়ে পালিয়েছে ওরা। পেছন থেকে বৃষ্টির মত গুলি হয়েছে। শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে ওদের আবার ঘুড়ে দাঁড়াতে হয়। রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকা সার্ব ট্যাংকগুলো একের পর এক নিশানা করছিল ওদের। দিয়ানের পাঁচ বছর বয়সী নীলচে চোখের মেয়েটা, যে কিনা পাহাড় থেকে নেমে আসা পরীদের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তো; ওর ঠিক পিঠের দিকটায় একঝাঁক গুলি এসে বিঁধে যায়। অনেকটা সময়, প্রায় অনেকটা সময় দিয়ান ওকে নিয়ে দৌড়েছে। পাগলের মত, উদাভ্রান্তের মত। তুষারঝড়ে দিক হারিয়ে বুনো হরিণের দল যেভাবে মরিয়া হয়ে আশ্রয় খোঁজে, ওরাও ঠিক সেভাবে আশ্রয় খুঁজেছিল। তারপর একটা সময় দিয়ান যখন বুঝেছে, চারপাশ থেকে ওদের লোকেরা সবাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে কোথায় যেন-তখন ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতে হয় তাঁকে। শিশিরের শব্দের মত অনুভূতির শেষ বিন্দুটুকুও ঝড়ে পড়ার শব্দ শুনেছিল সে। এরপর লালচে পাতার একটা সিলভার ফার গাছের নিচে গা এলিয়ে দিয়েছিল ও।
রাত প্রায় শেষ প্রহরে। আবছায়া কাটছে। ক্রমাগত ভারী হয়ে ওঠা চোখের পাতাজোড়া শিশিরের স্পর্শে সচকিত হয়। পকেট হাঁতড়ে শেষ সিগরেটটাকে আরেকবার ছুঁয়ে দেখে সে। একটা লাইটার খুব দরকার। খুব অল্প কিছু আগুন। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলেই সার্ব’রা তীব্র সব আলো নিয়ে লাশগুলোকে খুঁজতে আসবে। মৃতদের পরিসংখ্যান এখানে করা হয়, খুব যত্ন নিয়ে। হাতে সময় খুবই কম। খানিকটা মরিয়া হয়ে চারপাশের ঘুমিয়ে পড়া মানুষগুলোর পকেটে লাইটার খুঁজতে শুরু করে দিয়ান। ঘুমিয়ে পড়া মানুষগুলো ওদের নিশ্বাসের শব্দ হারিয়েছে অনেক আগেই। এমনই একজনের বুক পকেটে ধাতব একটা কিছুর স্পর্শে একটু কেঁপে ওঠে ও। রক্তে ভিজে যাওয়া আধ প্যাকেট সিগরেট, একটা লাইটার আরেকটা চিঠি।
অসম্ভব দ্রুততায় সিগরেট ধরিয়ে মানুষটার পাশে বসে পড়ে সে। বয়সে তরুণ একজন। কোঁকড়ানো কালো চুল এলোমেলো হয়ে কপালের উপর পড়া। আঁধার কেটে যাচ্ছে। আলো আঁধারির আবছায়াতে তরুণের বুক পকেটের রক্তে ভেজা চিঠিটি খুলে পড়তে শুরু করে দিয়ান। ঠিক চিঠি নয়, একে সুপারিশ পত্র বলাটাই বোধহয় বেশি যুক্তিযুক্ত হয়। কেউ একজন হাতে লিখেছে যে, এই লোকটিকে যেন কিছু শুকনো খাবার আর পানি দেওয়া হয়। গত কয়দিনের অবরোধ করে রাখা শহরে লোকটি পরিবার নিয়ে বড় বিপদে পড়ে গিয়েছে।
চারপাশে আলো ফুটছে। সেব্রেনিতসার দক্ষিণে পৃথিবীর ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলো অপেক্ষা করছে তাদের শান্তিরক্ষীদের নিয়ে। তাঁদের কাছে খাদ্য আর পানীয়ের অভাব নেই। আর শহরের উত্তর দিকে সার্ব’রা সকালের অপেক্ষায়। ঘুমিয়ে পড়া মানুষদের লুকিয়ে ফেলতে হবে খুব দ্রুত। আয়োজন চলছে। মাটি খুঁড়ে বড় বড় সব গর্ত তৈরি হয়। সকাল হচ্ছে। দিয়ানের হাতের সিগরেট প্রায় নিভে এসেছে। ক্লান্ত চোখজোড়া মুজে ফেলার ঠিক আগে আগে আকাশের দিকে তাকায় একবার ও। এরপর শান্ত হয়ে গাছের গুঁড়িতে গা এলিয়ে দেয় দিয়ান।
উপর থেকে করুণার মত বড় বড় ফোঁটার শিশির বিন্দু দিয়ানের হাতের চিঠির অক্ষরগুলোকে অস্পষ্ট করে দেয়। লাল আর কালো মিশে একাকার হয়। বিমর্ষ এক হাহাকার জাগিয়ে বাতাস দিনারিকের গা ঘেঁষে হারিয়ে যায়। নিস্তব্ধ চারপাশ। গাছের পাতাটি পড়লেও শোনা যায় এমন। মানুষ পৃথিবীতে আসার অনেক অনেক আগে, যখন মহীসঞ্চারণে প্যানেজিয়া ভেঙে সাত সাতটি আলাদা মহাদেশ হচ্ছিল, তখন কি পৃথিবী এমন ছিল? এমন শান্ত, অবিশ্রান্তভাবে নীরব আর নিশ্চুপ?
সকাল হচ্ছে। প্রথম সূর্যের উদ্ভাসিত আলোর উপস্থিতিকে অস্বীকার করে, বাতাস ঘুমন্ত মানুষগুলোর এলোমেলো চুলে ঢেউ খেলে যায়। আর গোলার্ধ জুড়ে বাঘবন্দী খেলায় হেরে যাওয়া মানুষের দল শুধু পড়ে থাকে- ছায়া হয়ে।
১ম 😀
লেখা অসাধারণ হইছে। 🙂
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
দিবস বরাবারই ধন্যবাদ পেয়ে যাও। এবার দিলাম না আর। ভালো থেকো।
বেশ ভাল লাগল লেখা 🙂 । দুটো লাইন কোট করিঃ
লাইনদুটো মন ছুয়ে গেল। :clap: :clap: :clap:
সন্ধি ভ্রাতা কেমন আছেন? মেলাদিন আলাপ নাই।
অনেক ধন্যবাদ।
সিদ্দিক বরাবরের মতোই অসাধারন লেখা। আর তোর লেখার টপিক গুলোও অসাধারন।
যদিও তুই সাধারন টপিক গুলোকেই অসাধারন বানাতে পারিস 😛
আমি সাধারনত সিসিবি শুধু পড়েই যাই, লগ ইন করা হয় না। তোর এখানে কমেন্ট করার জন্যই লগ ইন করলাম।
আমার কাছে একদম শেষ প্যারাটা ভালো লেগেছে।
এটাই মনে হয় চিরন্তন সত্য।
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
মাহমুদুল ভ্রাতা আপনি লোকটা খুব ইন্সপায়ারিং। ঋণী হয়ে যাচ্ছি। জুনে দেশে এসে আপনাকে খাওয়াবো। ঋণ শোধ হোক। 😀 😀
তোর মতলব ভালো না। সরাসরি বললেই পারিস, ট্রিট নিব 😛
চলে আয়।
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
অনেকটা নো ম্যানস ল্যান্ড এর শুরুর সাথে মিল রয়েছে।পড়ে অসম্ভব ভাল লাগল । :clap: :clap: :clap:
রাকিব ভ্রাতা গল্পে সিগরটের ভাবনাটা 'নো ম্যানস ল্যান্ড' বইটা থেকেই মাথায় চলে এসেছে। বই( মুভি) টা ভাল লেগেছে। তবে সাব টাইটেল ছাড়া দেখায় কিছু কথা বুঝি নি, এই এক সমস্যা।
ধন্যবাদ নিয়েন ভাই। ভাল থাকবেন।
শাওন, তুমি একজন গল্পবহনকারী মানুষ। আমার ধারণা, তুমি দৃশ্যকে গল্পে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখ।
সামীউর ভ্রাতা অনেক ধন্যবাদ। মেলাদিন দেশ ও দশ নিয়ে আমাদের আলাপ হয় না। দোয়া করি, যাতে খুব শীঘ্রই আবার দেখা হয়।
ভাল থাকবেন। অনেক ধন্যবাদ।
শাওন ভাই অসাধারন লেখা :boss: :boss: :boss:
এত সুন্দর ক্যাম্নে লিখেন ::salute::
"আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"
অনেক ধন্যবাদ ছোট ভাই। ভাল থাকিস।
ঠাশ বুননে লেখা গল্প তোমার! প্যানজিয়া হয়ত ভেঙেছে নিঃশব্দেই, একটু একটু করে, হাজার বছরে! মানুষও তাই বুঝি, বুকের জমিন ভাঙে, ধ্বসে পরে প্রতিদিনই, জানেনা কেউই! তবুও আশাবাদী মানুষের গল্পের জন্য অপেক্ষা করি!
তোমাকে অভিনন্দন চমৎকার একটি লেখার জন্য!
আপু অনুপ্রাণিত হলাম। ধন্যবাদ।
ভালোই লিখেছ, রেজা............।।
🙂
চমৎকার রেজা। সত্যিই চমৎকার।
আপু কেমন আছেন? অনেক ধন্যবাদ।
সাহস করে এই গল্পটা শেষ করতে পারি না কেন?
কতবার ঢুঁ মারলাম।
অতি ভালো হয়েছে।
খালেক