৫১ একরে সীমাবদ্ধ জীবন (প্রথম পর্ব)

২১ মে ১৯৯২ সাল।

প্রতি বছর নিজের জন্মদিন যতটা না খেয়াল থাকে তার চাইতে বেশি খেয়াল থাকে এই দিনটির কথা । কেননা ২১ মে ১৯৯২ এ পা রেখেছিলাম বরিশাল ক্যাডেট কলেজের বুকে। দুরু দুরু বুকে এক নব্য কিশোরের চোখ দিয়ে দেখছিলাম আমাকে গ্রহণ করার যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা। সেটার শেষ পর্যায়ে দেখেছিলাম আমাকে একা রেখে অশ্রুসজল চোখে বাবা-মা, আত্মীয়দের চলে যাওয়া। একইভাবে আরও ৫৪ জন ছেলে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল সেদিন। পরস্পর পরস্পরকে চিনি না, জানি না – তবে অনুভূতি অনুভব করতে এতটুকু ভুল হয়নি। এভাবেই শুরু হল আমার “৫১ একরে সীমাবদ্ধ জীবন”। শুরু হল আমার জীবনের অবিস্মরণীয় ছয়টি বছরের অধ্যায় – বোধ করি সবচাইতে প্রভাবশালী অধ্যায়।

ক্লাস সেভেনটা কেমন ছিল? তখনকার যে স্মৃতির কথা মনে পড়ে তা লিখে প্রকাশ করার সাধ্য সত্যিই নেই। দুপুরের দেড় ঘন্টা সময়ে পুরো হাউস যখন ঘুমে নিস্তব্ধ তখন শের ই বাংলা হাউসের ২০৮ নং রুমের জানালার পাশে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসতাম। একাকীত্ব কাকে বলে শিখতে শুরু করলাম। মা’র কথা মনে পড়ে, বাবার কথা – বোনদের চেহারাও ভেসে উঠে চোখের পাতায়। গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকে কান্না। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়তে চায়। ঢোক গেলার মতো কান্না গিলে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করি।

বিভিন্ন ধরনের কায়দা কানুন শিখতে থাকি। রুম লিডার থেকে শুরু করে সবাই ধরে ধরে শেখায়। অভ্যস্ত হতে থাকি কাঁটা চামচ, টেবিল চামচ আর ছুরি সহযোগে খাওয়াতে, ডোরাকাটা গলাবন্ধনীতে, খাকি ড্রেসের সাথে অবন্ধুসুলভ বেল্টে, স্টাফদের হাঁকডাকে…….এবং আরও অনেক কিছুতে। ক্যাডেট কলেজের ফ্রিকোয়েন্সিতে নিয়ে আসার জন্য প্রাথমিক ধাপ হিসেবে নভিসেস প্যারেড এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়েছে। প্রথম প্রথম সামরিক কায়দা কানুন মেনে পিটি, গেমস ইত্যাদি করে লেখাপড়া করতে যেয়ে লাড্ডু খেয়েছে কম বেশি সবাই। তবে সেটা পরবর্তীতে আর সমস্যা হিসেবে থাকেনি।

প্রথমেই বন্ধুত্ব হল একই হাউসের পাশাপাশি রুমের কয়েকজনের সাথে। এর ভিত্তি ছিল গল্পের বই। আমরা সবাই গল্পের বই পড়তে পছন্দ করতাম। তারপর সেই বন্ধুত্বের পরিধি বাড়তে থাকল নিজ হাউস ছাড়িয়ে অন্য হাউসে। তবে সবসময় যে ব্যাপারটা মসৃনভাবে চলেছে তা নয়। ফর্ম লিডার হয়ে ক্লাসে ডানপিটে, হৈচৈরত ক্লাসমেটদের নাম ব্ল্যাকবোর্ডে তুলতেই শুরু হল সমস্যা। খেলাম এক রামধাক্কা। বুঝলাম এতদিন পর্যন্ত ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে যেভাবে ডিল করে এসেছি এখানে সেভাবে চলবে না। যথারীতি অভিযোজিত হয়ে গেলাম। কাকে কিভাবে বাগে আনতে হবে, কার সাথে কিভাবে ডিল করতে হবে শিখে গেলাম। পরবর্তীতে কোনদিন ক্লাসমেটদের সাথে এরকম সমস্যা হয়নি বরং সবকাজে তাদের সহযোগিতার বাড়ানো হাতই পেয়েছি।

তখন সবকিছুরই তীব্রতা ছিল খুব বেশি। প্রথম প্যারেন্টস ডে, প্রথম ছুটিতে যাওয়া, প্রথম ছুটি শেষ করে ফেরত আসা – একইরকম প্রতিক্রিয়া। ছুটি শেষে কলেজে ফেরত আসার শেষ ১০/১২ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে গেলেই পেটের মধ্যে কেমন যেন একটা চাপ ধরা শিরশিরে অনুভূতি টের পাওয়া যেত (এই একটা ব্যাপার কেন যেন কলেজের শেষ ছুটি কাটানো পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল)। কেন জানি না তখনও ভালোবাসাটা জমে উঠেনি। ক্যাডেট কলেজ প্রসঙ্গে কথা উঠলে অন্যদের নিরুৎসাহিত করতাম। বলতাম, ধুর ওটা একটা জায়গা হল? কিন্তু মনোভাবটা কবে থেকে যে পাল্টি খেল তা আর মনে নেই। ক্যাডেট কলেজকে ভালোবাসলাম – ভালোবাসলাম এর প্রতিটা ইঞ্চিকে, এর প্রতিটা মানুষকে, এখানে সংঘটিত প্রতিটা কার্যক্রমকে। এখন তো ক্যাডেট কলেজ এক ঘোরের সৃষ্টি করে। যারা ক্যাডেট কলেজে ছয়টা বছর কাটায়নি মনে হয় তাদের জীবন অনেকটাই বৃথা।

অষ্টমে এসে দায়িত্ব নেয়া শিখলাম। পরবর্তী ব্যাচের দুইজনের রুমলিডার হয়ে গেলাম। নিজেরা যা শিখেছি তা এখানে প্রয়োগ করতে যেয়ে অথোরিটির ধমকসহ মধ্যম মানের কড়কানি খেলাম। মাঝেমধ্যে মোটিভেশন প্যারেড চলতো (কখনো কখনো সেটা পাঙ্গা প্যারেডে রুপান্তরিত হত)। বেশ ধাক্কা খেতে খেতে পথ পার হতে হয়েছে।

বিকেলে খেলার মাঠে ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারতাম না। কি খেলব তাই জানিনা। আমার খেলাপাগলা ক্লাসমেটদের রীতিমত হিংসা হত। সেরকম সময়ে বন্ধুদের কে যেন আমাকে ফুটবল মাঠের ব্যাকে দাড় করিয়ে দিয়ে বলল, “তোর কোন কাজ নেই – খালি ওদিক থেকে এদিকে বল আসলে দাবায়ে কিক করে ওদিকে ফেরত পাঠাবি”। যাই হোক, সূত্র অনুযায়ী কাজ – বল এদিকে আসে আর আমার পায়ের ব্যকরণবিহীন কিক খেয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে যায়। আস্তে আস্তে দক্ষতা বাড়তে থাকল। আমি মোটামুটি একটা স্থায়ী আসন পেয়ে গেলাম। শেষের দিকের একটা সময় ছিল যখন ফর্ম “এ”-“বি” খেলা হলে অবলীলায় বেস্ট ইলেভেন এ চান্স পেয়ে যেতাম।

জীবনের প্রথম স্টেজ কম্পিটিশনে জড়িয়ে পড়লাম (বাধ্য হলাম আর কি)। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, তাও আবার ইংরেজিতে! আমাকে পুরো স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়ে প্রাকটিস করিয়ে আরাফাত ভাই (১৯৮৯-১৯৯৪) যেভাবে প্রস্তুত করিয়েছিলেন, তাতে অন্য যে কেউ হলে অনেক ভালো ফল আসত। আমার গলা কাঁপল, কান গরম হয়ে গেল, হৃৎপিন্ড পাগলা ঘোড়ার মতোন ছুটল, পা শরীরের ভর ধরে রাখতে আপত্তি জানাতে থাকল – যথারীতি ছয়জনের ভিতর ষষ্ঠ হয়ে ফেরত আসলাম। আমার জন্য মঞ্চ প্রতিযোগিতা কখনোই ফেভার করেনি। এরপর আরও দুবার যোগ দিয়ে দুবারই ষষ্ঠ হয়ে ফেরত এসেছি। একবার তো একটা এক্সট্রা ড্রিলও ম্যানেজ করে ফেলেছিলাম (আমার ইডি ক্যারিয়ারের সেখানেই শুরু)। স্টেজ কম্পিটিশনে ইডি ম্যানেজ করার আর কোন গল্প আমার আমার জানা নেই।

[বরিশাল ক্যাডেট কলেজের মোট আয়তন ৫১ একর (মতান্তরে ৫০)। লেখাটি এর আগে একটা স্মরণীকাতে (২০০৬ এ) প্রকাশিত হয়েছিল। আবারও সেটা সবার সাথে শেয়ার করার সুযোগ হারাতে চাইলাম না। লেখাটির খানিকটা সংস্কার করে এখানে দেয়া হল। চলবে…]

২,৯৯৪ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “৫১ একরে সীমাবদ্ধ জীবন (প্রথম পর্ব)”

  1. মান্নান (১৯৯৩-১৯৯৯)

    এতদিন ভেবেছি পেটের ভিতর শিরশিরে অনুভূতি খালি আমারই হত । লজ্জায় কাউকে বলিনি । আজ বুঝলাম ক্যাডেটমাত্রই এই অনুভূতির সাথে পরিচিত।

    আরো লেখা চাই..........।

    জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)

    পেটের গুড়গুড়ানিটা তো এতদিন ভাবতাম শুধু আমার নিজের সম্পত্তি! যদিও এমন সম্পত্তি থাকার চে না থাকাই ভালো...
    ক্লাস টুয়েলভ এর লাস্ট ছুটি পর্যন্ত একবারের জন্যও আমার এই গুড়গুড়ানি থামেনাই 🙁


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  3. বাসা থেকে যাওয়ার পথে "ঝিনাইদহ-৩ কি মি" লিখার ঠিক পরেই ছিল আমাদের কলেজ গেট।সেখানটায় এলেই পেট এর সেই গুড়্গুড়ানি...সায়েম ভাই,এত জীবন্ত ভাবে কিভাবে তুলে ধরলেন!!!!

    জবাব দিন
  4. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    ভাইরে,
    চাপা যেই শিরশিরে অনুভূতি কাজ করত সেটা কি খালি ছুটি শেষে কলেজে ঢুকছি বলেই?
    আরও কত অনুষঙ্গ আছে এর সাথে!!
    লিখতে যেয়ে কী-বোর্ডে ওঠা ঝড় আর থামাতে পারলাম না..............


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  5. ইফতেখার (১৯৮৪-১৯৯০)

    ভালো হয়েছে। ভালো থেকো।

    আর, গুড়গুড়ানিটা ক্যাডেটদের কৈডেটিক সূত্রে পাওয়া আরেকটা সম্পত্তি বলেই মনে হয়। একযুগ আগে আমাদেরও হতো, আর চলবে ক্যাডেট পরম্পরায়।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।