মেজর শাহনেওয়াজ স্মরণে……

মেজর শাহনেওয়াজ স্মরণে……

উনি রংপুর ক্যাডেট কলেজের ফার্স্ট ব্যাচের ক্যাডেট। আমার ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার অনেক প্রেরণার মাঝে একজন। উনার ডাক নাম ছিল পিকো। ছোটবেলা থেকে সবসময় উনাকে পিকো ভাইয়া বলে ডাকতাম। অনেক বড় হওয়ার পরেও পিকো ভাইয়া বলেই নাম জানতাম, শাহনেওয়াজ নামটা মনে আসত না কখনো।

পিকো ভাইয়া আর্মির সিনিয়র মেজরদের ভেতর একজন। রিটায়ারমেন্টের খুব বেশি বাকি ছিল না, বড়জোড় ১ বা ২ বছর ছিল হয়ত। শেষ রক্ষাটুকু আর হল না।

যখন অনেক ছোট ছিলাম, উনাদের বাসায় যেতাম যখন, দেয়ালে ঝুলানো ছবিগুলো খুব দেখতাম। ক্যাডেট কলেজের ইউনিফর্ম পরা ছবি, আর্মির ইউনিফর্ম পরা ছবি……নিজের অজান্তেই কেমন যেন বুকটা গর্বে ভরে যেত। অনেক অনেকদিন আগে উনার তখন একটা মোটর সাইকেল ছিল। যখন বাসায় আসতেন, আমাদের ভাই বোন গুলিকে পেছনে নিয়ে মাঝে মাঝে কিছুদূর ঘুরিয়ে নিয়ে আসতেন, আমরা শৈশবের উত্তেজনায় লাফাতাম।

কোন ঘটনা ঘটলেই সেখানে ভারতের সংযুক্তি টেনে আনতেন। মতের সাথে মত মিলত না। পছন্দ না হলেও, মনে মনে চেপে যেতাম। নিজের মত ধারণা গুলোকে নিজের ভেতরেই রেখে মনে মনে হাসতাম; ভুলেও কখনো তর্ক তুলিনি, মনে হত তর্ক তুললে অসম্মান করা হবে।

খুব শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া ছিল উনার ভেতর, যারা কথা বলেছে তারা জানে। প্রচন্ড ভরাট গলা, যখনই কথা বলতেন অসম্ভব কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলতেন। ন্যাচারাল লীডার কথাটা বোধকরি উনাদের মত মানুষদের জন্যই জন্ম নেয়া। আমার বাবা মা কোন অনুষ্ঠান এরেঞ্জ করার দরকার পরলে অনেক সময়ই উনার কাছে গিয়েছে। উনাকে কোন দায়িত্ব দিলে আমরা সবাই চোখ বুজে নির্ভর করতে পারতাম। আর কিছু ভাবা লাগত না।

আমি ইংল্যান্ডে আসার আগের রাতেও ভাইয়া বাসায় এসেছিলেন আমাদের। আমাকে বসিয়ে একগাদা মানুষের ফোন নাম্বার লিখিয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডের, ফ্রান্সের……বিদেশ বিভুইয়ে যদি কোন বিপদে পড়ি………

ভাইয়ার ফ্যামিলি ক্যান্টনমেন্টে থাকে। একদম ছোট ছেলেটা ওহী, এবার ক্লাস ফাইভে উঠল। ভয়ংকর দস্যি আর ছটফটে। ক্লাস থ্রিতেই সে ইয়াহুতে একাউন্ট খুলে আমাকে মেসেঞ্জারে এড ট্যাড করে বসে আছে! মাথার চুল গুলো একদম খাড়া খাড়া। আমার বোনের বিয়েতে গেল সেই খাড়া চুলগুলো সব স্পাইক করে, আরো খাড়া করে। সে কি আমাদের হাসাহাসি! সেটা দেখে ও আবার লজ্জা পায়। সবাই বলে ভাইয়া নাকি ছোট বেলায় ঠিক এরকমই দুষ্টু ছিল। সেই ওহীর ২৫ তারিখ বিডিআরে থাকার কথা ছিল। ২৪ তারিখ ওর কি মনে হল, বাসা থেকে ক্লাসে যাবে পরদিন। রাতের বেলা ভাইয়া ওকে বিডিআর থেকে বাসায় পাঠিয়ে দেন।

মেয়ে ঐষী এইচএসসি দিয়েছে কিছু দিন আগে। ভাই রাব্বি ভাইয়া পাবনা ক্যাডেট কলেজের ’৯৮ এইচএসসি ব্যাচের, এনথ্রোপোলজিতে মাস্টার্স করার জন্যে কানাডায়। আমার সাথে প্রায় একই সময়ে দেশের বাইরে আসে। গতকয়টা দিন ফোন, মেসেঞ্জার, ইন্টারেনেটের সামনে বিহ্বল হয়ে বসে ছিল একটু খবরের আশায়……যদি লাশ পাওয়া যায়, যদি লুকিয়ে থাকা কোন গ্রুপের সাথে বেড়িয়ে আসেন ভাইয়া……আজ সকালের ফ্লাইটে রওনা হয়ে গেল ঢাকার দিকে। আরেক ভাই, রাজ ভাইয়া বিডিআরের গেটে গেটে ঘুরেছেন……যদি কিছু শোনা যায়……প্রতিটা লাশের খবরে গিয়ে গিয়ে দেখে এসেছেন উনার ভাইয়েরটা কিনা……কেউ কিছু জানে কিনা……। ভাবীর সাথে কোন কথা হয়নি……ফোন দেবার সাহসই হয় নি……। দেশ থেকে আমার বড় বোনের সাথে কথা হয়। বলে, ‘ভাই, ১৬৫ জন অফিসারের ভিতর ১০০ জনের উপরেই যদি মেরে ফেলে, পিকো ভাইয়া কি আর বেঁচে আছে!!’ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, আমি চুপ করে থাকি।

সেই ছোট্ট ওহী শুনলাম আজ সবচেয়ে শক্ত আছে। ঘটনার শুরু থেকেই নাকি ও মেনে নিয়েছে ওর আব্বু আর ফিরে নাও আসতে পারে। আর সবার সাথে বিডিআর গেটে গিয়ে অপেক্ষাও করেছে আশায় আশায়। এতটুকু একটা বাচ্চার ভেতরে খোদা কিভাবে এত শক্তি দিয়েছেন ভাবলে অবাক লাগে! আমার ভেতরেও একটু শক্তি দাও খোদা……আমার যে চোখ ভিজে যায় বারবার!! আমি যে আর লিখতে পারি না……

বোনের এসএমএস আসে ঢাকা থেকে। লাশ পাওয়া গেছে। আক্রোশ, ক্ষোভ, বিচার, দাবী দাওয়া, শাস্তি, ঘৃণা- কিছুই আর মাথায় থাকে না। শুধু একবুক অসহায় হাহাকার, গলায় আটকে থাকা একদলা কষ্ট, ভিজে যাওয়া চোখ আর ভেতরটাকে কুকড়ে কুকড়ে খাওয়া এক নিঃশব্দ চিৎকার ভেতরটাকে হু হু করে কাঁদায়……

সেই ভারী গলায় আর কখনো শোনা হবে না, ‘কি রে, খালু বাসায়?’

একুশের মত পঁচিশে ফেব্রুয়ারিটাও আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো থাকল………

৪,৩৩১ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “মেজর শাহনেওয়াজ স্মরণে……”

  1. তৌফিক

    রাব্বি ভাই ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে জানিয়েছিলেন যদি কোন খবর পাই যেন জানাই। প্রথম আলোতে উনার লাশ পাওয়ার খবর দেখে সাহস হয়নি তোকে বা রাব্বি ভাইকে জানাই। ঐ খবর আনকনফার্মড হওয়ার পর আশায় বুক বেধেঁছিলাম। নিখোঁজ হওয়া এই মানুষগুলোকে আবার ফিরে পাবো হয়তো। ফিরে পাবার আশা ফিকে হয়ে আসছে যতই সময় গড়াচ্ছে। আজ একটার পর একটা মৃত্যুসংবাদ আসছে।

    শুধু একটাই চাওয়া পরম করুণাময়ের কাছে, আমাদের চেতনায় যেন তাঁরা বেঁচে থাকেন, আমাদের বিবেকবোধে যেন তাঁরা সবসময় অন ডিউটি থাকেন।

    বিদেশে একা একা থাকিস, শক্ত থাকিস একটু।

    জবাব দিন
  2. এহসান (৮৯-৯৫)

    আশিক প্রতিটা ঘটনা পড়ি আর কাঁদি। ঠিক করি আর পড়বো না। কিন্তু প্রতি ৫ মিনিট পর পর ব্লগে আসি।

    কালকে থেকে লাশ পাবার ঘটনা গুলোকে ভালো খবর মনে হচ্ছিল। অন্তঃত খবরতো পেলাম। আজকে সব বিভৎস লাশ গুলো দেখে কান্না থামছে না।

    জানিনা আর কি লিখবো... আর কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা।

    জবাব দিন
  3. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    শুধু একটাই চাওয়া পরম করুণাময়ের কাছে, আমাদের চেতনায় যেন তাঁরা বেঁচে থাকেন, আমাদের বিবেকবোধে যেন তাঁরা সবসময় অন ডিউটি থাকেন।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    শাহনেওয়াজ ভাইকে চিনতাম ১৯৯৯ থেকে। এরপর উনি শাহবাগে বিআইআইএসএস এ ডিরেক্টর হয়ে আসলে মাঝে মাঝেই যেতাম তার অফিসে রকা'র বিষয়ে কথা বলতে। ২০০২ সালে আমাদের রি-ইউনিয়নে উনার প্রাণবন্ত উপস্থিতি কখনোই ভুলবো না।

    ভাবতেই পারছি না এই মানুষটা কুকুর-বিড়ালের চেয়েও খারাপ ভাবে বিদায় নিলেন আমাদের ছেড়ে...... এরপরও কিভাবে নিজেকে মানুষ দাবী করি?......

    .........।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  5. আশিক (১৯৯৬-২০০২)

    বাসা থেকে একটা এসএমএস আসলো। তাতে বড়বোন লিখেছে রাজ ভাইয়া আর ছোট খালু (পিকো ভাইয়া বড় খালুর ছেলে) গিয়ে লাশ সনাক্ত করে এসেছেন।

    ছোট খালু ফিরে এসে বলেছেন লাশ দেখে যা মনে হয়েছে, হাত বেঁধে গুলি করে মেরেছে......তারপর শরীরে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে......

    জবাব দিন
  6. জ়ে এম সারোয়ার মুজিব ( এডিসন) (১৯৭৯-১৯৮৫)

    পিকু ভাই ছিল আমাদের প্রথম কলেজ প্রিফেক্ট। তার খোজ চলছিলো গত দুইদিন রোকাতে। আজ জানতে পারলাম উনার সংবাদ। উনার সাথে দুবছর কলেজে ছিলাম ৭ম আর ৮ম। আমকে উনি এডিসন বলেই ডাকতো। আমি উনার কাছে অনেক শাস্তি খেয়েছি। খুব বোকামি করতাম বলে, উনি আমার সাথে কত যে ফান করতো তার ইয়াত্তা নাই। আর এখন উনার জন্য কান্না থামাতে পারছিনা।এইতো মিশনে আসার আগেও ভাবির সাথে ঢাকা ট্রাস্ট ব্যঙ্কে দেখা হলো। আল্লাহ উনাকে শিন্তিতে রাখুন। আমিন।

    জবাব দিন
  7. হিল্লোল (৯২-৯৮)

    আমার চখের সামনে এখন ভাসচে মেজর শাহনেওয়াজ এর মুখ। উনার ছোট ভাই রাব্বি আমার ক্লাসমেট। উনার অনেক গল্প ছুনেসি রাব্বির কাসে থেকে কিনতু এখন সুধুই স্রিতি । বুক ফেটে কান্না আসছে। রাব্বির সাথে নেট এ কথা হয়েছে ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে। রাতের মধ্যে বুঝতে পেরেছি উনি নেই। রাব্বিকে আমি মিথ্যে বলেছি। রাব্বি এখন কানাডা থেকে দেশের পথে। পিক ভাইএর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। হিল্লল ।

    জবাব দিন
  8. Shah naoaz vaier choto vai rabbi amar class mate. Ami tar ruher magfera kamona kori. Ar rabbi tui shokto thak dosto. nahole tor vabir ar bachader ke shantona dibe.Dosto ekta kotha na bole parchina amra shobchey beiman jati. desher shobcheye golden manushder marte amader hat ektuo kaplona.Er bichar jai hok khotipuron konodin hobe na. am Allahr kase er bicher chai.nishchoi Allah toder er bodla dibe. allahr kase tor vaier jonno doa kor. Ar shober kase ei request ei best soldier der jonno doa korben.

    জবাব দিন
  9. আলম (৯৭--০৩)
    লাশ পাওয়া গেছে। আক্রোশ, ক্ষোভ, বিচার, দাবী দাওয়া, শাস্তি, ঘৃণা- কিছুই আর মাথায় থাকে না। শুধু একবুক অসহায় হাহাকার, গলায় আটকে থাকা একদলা কষ্ট, ভিজে যাওয়া চোখ আর ভেতরটাকে কুকড়ে কুকড়ে খাওয়া এক নিঃশব্দ চিৎকার ভেতরটাকে হু হু করে কাঁদায়……

    আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।

    জবাব দিন
  10. আশিকের লেখাটা পড়েই চোখের কি জানি হলো, অবিরত জল ঝরছে-- হয়ত নতুন কোন অসুখ। কিস্তু গলা থেকেও তো কেমন যেন বোবা শব্দ বের হয়ে আসছে। বুঝলাম নিজের অজান্তেই কাঁদছি। কিন্তু পিকো ভাইয়াকে তো আমি চিনি না, দেখিওনি কোনদিন। অথচ অফিসে সব্বার সামনে বসেই সজোরে কাঁদছি। ব্যাপার কি? সবাই হতচকিত। আমিও বুঝছি ব্যাপারটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। 'কঠিন হৃদয়' বলে পরিচিত আমার চোখেও শেষে কিনা জল! অথচ করার কিই বা আছে বোবা কান্না ছাড়া। কচি শিশু 'ওহী' অর্থাৎ "প্রকাশিত বাণী" কি শেষমেষ প্রকাশিত হবে? না কি্‌ আর সব ফুল-'কলি'র না বলা কথার মত ঝরে যাবে? মনটা কেমন পাগল পাগল লাগে? কোথায় গেলে পাব এসব আপাত সহজ অথচ নিদারুন কঠিন সেই প্রশ্নের জবাব। অক্ষমতার বেদনা তাইতো অশ্রু হয়েই হয়তোবা ঝরে পড়ে। কিন্তু হৃদয়ের ক্ষত তাতে কি শুকায়? চিৎকার করে সকলকে জানিয়ে কাঁদার সাহসও যে আমার নেই। ধিক্- ব্যর্থ এ জন্ম আমার।

    আশিককে ধন্যবাদ, অন্তত ক'ফোঁটা অশ্রু ফেলার সুযোগ করে দেবার জন্য। আর ওহী, ঐশী, ভাবীর জন্য কিছুই বলার নেই-- কারন পৃথিবীর এমন কোন ভাষা নেই যা দিয়ে তাদের স্বান্তনা দেয়া যায়। শুধু পিকো ভাইয়ার জন্য জন্য প্রান ভরা দোয়া আল্লাহ্ তাকে বেহেশতের অন্যতম মর্যাদার আসনে চির প্রতিষ্ঠিত করুন।

    : জামান (বকক ৩/১০১)

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।