হুমায়ুন আজাদ – একজন অলৌকিক স্রষ্টা

Humayun-azad

হুমায়ুন আজাদকে কি আমি কখনো স্পর্শ করেছি?
মানে হ্যান্ডশেক বা পা বা সেই অর্থে?
মনে পড়ে না।
ফুলার রোডে, কলা ভবনে, ভার্সিটির পথে, বই মেলায় তাকে অনেক অনেক দেখেছি। সালাম দিয়েছি। মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখেছি।
হেঁটে যায় এক মহাজীবন।
সালামের উত্তর তিনি কোনদিন দিয়েছেন মনে পড়ে না। তবে চোখ তুলে কখনো তাকাতেন, কখনো না।
হেঁটে যায় এক অহঙ্কারি পুরুষ।

মাহমুদুল হাসান এর পোষ্টটির কারণে ২০০৪ এর সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো।
বীরপূজা, ব্যক্তিপূজা কোনদিন করি নি। কোন পীর ধরি নি কোনদিন। নবীগিরিত্বেও বিশ্বাস নেই।
তবু ক্যান জানি হুমায়ুন আজাদকে ভক্তি করতে কোনদিন বাধা আসেনি মন থেকে।

কারণটি কি?
এই ভ্রষ্ট,নষ্ট ব-দ্বীপে তিনি সত্য বলার সাহস দেখিয়েছেন বলে?
অসাধারণ সাহসী ছিলেন বলে?

হুমায়ুন আজাদ খুব সম্ভবত যাদুকর ছিলেন।
পাঞ্জাবী নামক আজকের বাঙালির প্রিয় পোষাক নিয়ে কটু কথা বলায় আজ আর আমি পাঞ্জাবী পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য্বোধ করিনা। অথচ একসময় আমার অনেক অনেক পাঞ্জাবী ছিলো, হরেক রঙের পাঞ্জাবী ছিলো।

হুমায়ুন আজাদের প্রথম যেই বইটি আমি পড়ি তা হচ্ছে প্রবচনগুচ্ছ। তখন কলেজে দশম বা একাদশে ছিলাম। আমার ভাবনার জগতে একটা আলোড়ন ঘটে যায়। লেখক এইসব কি বলছেন? কেনো বলছেন? কিভাবে বলছেন? কি বোধ তাকে তাড়িত করছে?

উদা ১ – পুঁজিবাদের আল্লার নাম টাকা, মসজিদের নাম ব্যাংক। (প্রবচন নম্বর ২)
উদা ২ – সুন্দর মনের থেকে সুন্দর শরীর অনেক আকর্ষণীয়। কিন্তু ভন্ডরা বলেন উল্টো কথা। (প্রবচন নম্বর ৩)
উদা ৩ – হিন্দুরা মূর্তিপূজারী; মুসলমানেরা ভাবমূর্তিপূজারী। মূর্তিপূজা নির্বুদ্ধিতা আর ভাবমূর্তিপূজা ভয়াবহ। (প্রবচন নম্বর ৪)
উদা ৪ – আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, এখন আসে বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে। (প্রবচন নম্বর ১০)
উদা ৫ – আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল, অসৌন্দর্য শ্লীল। রূপসীর একটু একটু নগ্নবাহু দেখে ওরা হৈ চৈ করে, কিন্তু পথে পথে ভিখিরিনিদের উলঙ্গ দেহ দেখে ওরা একটুও বিচলিত হয় না। (প্রবচন নম্বর ১৪)

আনন্দের বিষয় হচ্ছে চাইলে লেখকের ২০০ টি প্রবচনের প্রতিটিই উদৃত করা যায়। আমি এর আগে এমনকি আজো এতো শক্তিশালী কথাসমূহ দুই মলাটের মধ্যে একসাথে দেখিনি।

হুমায়ুন আজাদ যেনো আমার মনের কথাগুলো বলে যেতে থাকেন একের পর এক; আবার একই সাথে একের পর এক ভেঙ্গে ফেলতে থাকেন আমার বিশ্বাস সমূহ-অপবিশ্বাস সমূহ।

এর মধ্যে হুমায়ুন আজাদের নারী বিষয়ক শ্রেষ্ঠ রচনা নারী নিষিদ্ধ হয়। মৌলবাদীদের খুশি করতে নিষিদ্ধ করা হয় বাঙলা ভাষায় নারী বিষয়ক শ্রেষ্ঠ রচনাটিকে। বইটির আলোচনা শুনছিলাম চারদিকে। এক বন্ধুর বাসায় বইটিকে পেয়েও যায়। কিছু পৃষ্ঠা পড়েও ফেলি। কিন্তু পুরো বইটি পড়ার সৌভাগ্য হয় না।

এরপর হাতে আসে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। লেখা পড়তে পড়তে আমি চমৎকৃত এবং চমৎকৃত হতে থাকি।
এও কি উপন্যাস?
একেই কি উপন্যাস বলে?
তবে কি পড়ে এসেছি এতোদিন?
এবং এই বিশ্বাস আসে মনে, হ্যা এটাই উপন্যাস।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল প্রকৃতই আমাকে এক ভিন্ন সাগরে ভাসিয়ে চলে। আমার বোধে আঘাতের পর আঘাত আসতে থাকে। কখনো আনন্দের, কখনো ব্যাথার।

এরপর পড়ি সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে। একের পর এক লাইন পড়তে পড়তে আমি ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাই। একের পর এক লাইন পড়তে পড়তে আমি গড়ে উঠতে থাকি।
এর মধ্যে নারী চলে আসে হাতে। এবার পুরোটা পড়ি। আমি কেঁপে-কেঁপে উঠি।

এরপর পড়ি অলৌকিক ইষ্টিমার। এরপর আর থামিনি।

০১ 

“সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে “-হুমায়ুন আজাদ
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ;— চ’লে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ সভ্যতা— সমস্ত দলিল—
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চ’লে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ নির্জন প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।

আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুল
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চ’লে যাবে সেই সব উপকথা : সৌন্দর্য-প্রতিভা—
মেধা;— এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বাধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।

আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের ঠোঁট
গদ্যপদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্কস-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মতো আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক—
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।

০২ 

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় – হুমায়ুন আজাদ

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?
তেমন যোগ্য সমাধি কই ?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !
তাইতো রাখি না এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।

০৩

ব্যাধিকে রূপান্তরিত করছি মুক্তোয় – হুমায়ুন আজাদ

একপাশে শূন্যতার খোলা, অন্যপাশে মৃত্যুর ঢাকনা,
প’ড়ে আছে কালো জলে নিরর্থক ঝিনুক।
অন্ধ ঝিনুকের মধ্যে অনিচ্ছায় ঢুকে গেছি রক্তমাংসময়
আপাদমস্তক বন্দী ব্যাধিবীজ। তাৎপর্য নেই কোন দিকে-
না জলে না দেয়ালে-তাৎপর্যহীন অভ্যন্তরে ক্রমশ উঠছি বেড়ে
শোণিতপ্লাবিত ব্যাধি। কখনো হল্লা ক’রে হাঙ্গরকুমীরসহ
ঠেলে আসে হলদে পুঁজ, ছুটে আসে মরা রক্তের তুফান।
আকষ্মিক অগ্নি ঢেলে ধেয়ে আসে কালো বজ্রপাত।
যেহেতু কিছুই নেই করণীয় ব্যাধিরূপে বেড়ে ওঠা ছাড়া,
নিজেকে-ব্যাধিকে-যাদুরসায়নে রূপান্তরিত করছি শিল্পে-
একরত্তি নিটোল মুক্তোয়!

০৪ 

আমার কুঁড়েঘরে – হুমায়ুন আজাদ

আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আর দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক

আমার গ্রহ জুড়ে বিশাল মরুভূমি
সবুজ পাতা নেই সোনালি লতা নেই শিশির কণা নেই
ঘাসের শিখা নেই জলের রেখা নেই
আমার মরুভূর গোপন কোনো কোণে একটু নীল হয়ে
বাতাসে কেঁপে কেঁপে একটি শীষ আজ উঠুক

আমার গাছে গাছে আজ একটি কুঁড়ি নেই
একটি পাতা নেই শুকনো ডালে ডালে বায়ুর ঘষা লেগে
আগুন জ্ব’লে ওঠে তীব্র লেলিহান
বাকল ছিঁড়েফেড়ে দুপুর ভেঙেচুরে আকাশ লাল ক’রে
আমার গাছে আজ একটা ছোট ফুল ফুটুক

আমার এ-আকাশ ছড়িয়ে আছে ওই
পাতটিনের মতো ধাতুর চোখ জ্বলে প্রখর জ্বালাময়
সে-তাপে গ’লে পড়ে আমার দশদিক
জল ও বায়ুহীন আমার আকাশের অদেখা দূর কোণে
বৃষ্টিসকাতর একটু মেঘ আজ জমুক

আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক।

০৫

ফুলেরা জানতো যদি – হুমায়ুন আজাদ

মুলঃ হেনরিক হাইনে

ফুলেরা জানতো যদি আমার হৃদয়
ক্ষতবিক্ষত কতোখানি,
অঝোরে ঝরতো তাদের চোখের জল
আমার কষ্ট আপন কষ্ট মানি ।

নাইটিংগেল আর শ্যামারা জানতো যদি
আমার কষ্ট কতোখানি-কতোদুর,
তাহলে তাদের গলায় উঠতো বেজে
আরো ব হু বেশী আনন্দদায়ক সুর ।

সোনালী তারারা দেখতো কখনো যদি
আমার কষ্টের অশ্রুজলের দাগ,
তাহলে তাদের স্থান থেকে নেমে এসে
জানাতো আমাকে সান্ত্বনা ও অনুরাগ ।

তবে তারা কেউ বুঝতে পারেনা তা-
একজন,শুধু একজন,জানে আমার কষ্ট কতো;
আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছে যে
ভাংগার জন্য-বারবার অবিরত ।

০৬ 

ভালো থেকো- হুমায়ুন আজাদ

ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।

ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।

০৭ 

বাঙলাদেশের কথা (আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম)

যখন আমরা বসি মুখোমুখি, আমাদের দশটি আঙুল হৃৎপিন্ডের মতো কাঁপতে থাকে
দশটি আঙুলে, আমাদের ঠোঁটের গোলাপ ভিজে ওঠে আরক্ত শিশিরে,
যখন আমরা আশ্চর্য আঙুলে জ্বলি, যখন আমরাই পরষ্পরের স্বাধীন স্বদেশ,
তখন ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না;
আমি তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।
তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, – তার অনেক কারণ রয়েছে ।

তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ
মাইলের কথা: তার রাজনীতি
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলী
জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন
করে আমাকে পীড়ন কোরো না

তার ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমনীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,
কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো  আমার কাছে জানতে চেয়ো না;
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, তার অনেক কারণ রয়েছে।

০৮ 

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,
আমার বিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।
তারা আমাকে তাদের মতো করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো করে হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো করে পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মতো করে চুল আঁচড়াতে,
তারা আমার মুখে গুজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।
তারা আমাকে বাধ্য করেছিল তাদের মতো করে বাঁচতে।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,
আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,
আমি উচ্চারন করতে চেয়েছিলাম আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।
আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।
আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মৌলিক খাদ্য,
আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।
আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ তখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আপন সুরে,
ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলা-পড়া সুর।
আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মতো ময়লা-ধরা স্বপ্ন দেখতে।
আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়াতে।
আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।
আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে ওদের মতো করেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।
ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে বলতো সাফল্য,
ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবত গৌরব,
ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,
ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলংকার।
আমি মাংসের টুকরা থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি নতজানু হওয়ার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি পিঠ কুঁজের বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পড়েছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসেনি।
ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোনো অভাব ছিলো না,
ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,
ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো চাষ করেছিলাম ব’লে
আমার জমিতে শস্য জন্মে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে
আমার ভবিষ্যতের বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।
তখনো আমার দিঘির জন্য পানি উৎসারণের সময় আসে নি।
তখনো আমার জমির জন্য নতুন ফসলের সময় আসে নি।
তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার সবকিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।
ওরা যে-তরুণীকে জরিয়ে ধরতে চেয়েছে তাকে ধরেছে দস্যুর মতো।
আমার তরুণীকে আমি জরিয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।
ওরা যে-নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।
আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।
চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।
আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে পথে চলতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিলো, তা নিবেদন করতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিলো, তা শুনতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম
অন্যদের সময়ে।

০৯

আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে

আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট  কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।

১০ 

আমাদের মা – হুমায়ুন আজাদ

আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।

১১

গোলামের গর্ভধারিণী – হুমায়ুন আজাদ

আপনাকে দেখিনি আমি; তবে আপনি
আমার অচেনা
নন পুরোপুরি, কারণ বাঙলার
মায়েদের আমি
মোটামুটি চিনি, জানি। হয়তো
গরিব পিতার ঘরে
বেড়ে উঠেছেন দুঃক্ষিণী
বালিকারূপে ধীরেধীরে;
দুঃক্ষের সংসারে কুমড়ো ফুলের
মতো ফুটেছেন
ঢলঢল, এবং সন্ত্রস্ত ক’রে
তুলেছেন মাতা
ও পিতাকে। গরিবের ঘরে ফুল
ভয়েরই কারণ।
তারপর একদিন ভাঙা পালকিতে চেপে
দিয়েছেন
পাড়ি, আর এসে উঠেছেন আরেক গরিব
ঘরে;
স্বামীর আদর হয়তো ভাগ্যে
জুটেছে কখনো, তবে
অনাদর জুটেছে অনেক। দারিদ্র্য,
পীড়ন, খণ্ড
প্রেম, ঘৃণা, মধ্যযুগীয়
স্বামীর জন্যে প্রথাসিদ্ধ
ভক্তিতে আপনার কেটেছে জীবন।
বঙ্গীয় নারীর
আবেগে আপনিও চেয়েছেন বুক জুড়ে
পুত্রকন্যা,
আপনার মরদ বছরে একটা নতুন
ঢাকাই
শাড়ি দিতে না পারলেও বছরে বছরে
উপহার
দিয়েছেন আপনাকে একের পর এক
কৃশকায়
রুগ্ন সন্তান, এবং তাতেই আপনার
শুষ্ক বুক
ভাসিয়ে জেগেছে তিতাসের তীব্র
জলের উচ্ছ্বাস।
চাঁদের সৌন্দর্য নয়, আমি জানি
আপনাকে মুগ্ধ
আলোড়িত বিহ্বল করেছে সন্তানের
স্নিগ্ধ মুখ,
আর দেহের জ্যোৎস্না। আপনিও
চেয়েছেন জানি
আপনার পুত্র হবে সৎ, প্রকৃত
মানুষ। তাকে
দারিদ্র্যের কঠোর কামড় টলাবে
না সততার
পথ থেকে, তার মেরুদণ্ড হবে দৃঢ়,
পীড়নে বা
প্রলোভনে সে কখনো বুটদের সেজদা
করবে না।
আপনার উচ্চাভিলাষ থাকার তো কথা
নয়, আপনি
আনন্দিত হতেন খুবই আপনার পুত্র
যদি হতো
সৎ কৃষিজীবী, মেরুদণ্ডসম্পন্ন
শ্রমিক, কিংবা
তিতাসের অপরাজেয় ধীবর। আপনি
উপযুক্ত
শিক্ষা দিতে পারেন নি
সন্তানকে;- এই পুঁজিবাদী
ব্যবস্থায় এটাই তো স্বাভাবিক,
এখানে মোহর
ছাড়া কিছুই মেলে না, শিক্ষাও
জোটে না। তবে এতে
আপনার কোনো ক্ষতি নেই জানি;
কারণ আপনি
পুত্রের জন্যে কোনো রাজপদ, বা ও
রকম কিছুই
চান নি, কেবল চেয়েছেন আপনার
পুত্র হোক
সৎ, মেরুদণ্ডী, প্রকৃত মানুষ।
আপনার সমস্ত
পবিত্র প্রার্থনা ব্যর্থ ক’রে
বিশশতকের এই
এলোমেলো অন্ধকারে আপনার পুত্র
কী হয়েছে
আপনি কি তা জানেন তা, হে অদেখা
দরিদ্র জননী?
কেনো আপনি পুত্রকে
পাঠিয়েছিলেন মুঘলদের
এই ক্ষয়িষ্ণু শহরে, যেখানে
কৃষক এসে লিপ্ত
হয় পতিতার দালালিতে, মাঠের
রাখাল তার
নদী আর মাঠ হ’য়ে ওঠে হাবশি
গোলাম?
আপনি কি জানেন, মাতা, আপনার
পুত্র শহরের
অন্যতম প্রসিদ্ধ গোলাম আজ?
আপনি এখন
তাকে চিনতেও ব্যর্থ হবেন,
আপনার পুত্রের দিকে
তাকালে এখন কোনো মস্তক পড়ে না
চোখে, শুধু
একটা বিশাল কুঁজ চোখে পড়ে।
দশকে দশকে
যতো স্বঘোষিত প্রভু দেখা
দিয়েছেন মুঘলদের
এ-নষ্ট শহরে, আপনার পুত্র তাদের
প্রত্যেকের
পদতলে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে
পৃষ্ঠদেশ জুড়ে
জন্মিয়েছে কুঁজ আর কুঁজ; আজ তার
পৃষ্ঠদেশ
একগুচ্ছ কুঁজের সমষ্টি;-
মরুভূমিতে কিম্ভুত
বহুকুঁজ উটের মতোই এখন দেখায়
তাকে।
সে এখন শহরের বিখ্যাত গোলাম
মজলিশের
বিখ্যাত সদস্য, গোলামিতে সে ও
তার ইয়ারেরা
এতোই দক্ষ যে প্রাচীন,
ঐতিহাসিক গোলামদের
গৌরব হরণ ক’রে তারা আজ মশহুর
গোলাম
পৃথিবীর। এখন সে মাথা তার
তুলতে পারে না,
এমনকি ভুলেও গেছে যে একদা তারও
একটি
মাথা ছিলো, এখন সে বহুশীর্ষ
কুঁজটিকেই মাথা
ব’লে ভাবে। খাদ্যগ্রহণের পর
স্বাভাবিক পদ্ধতিও
বিস্মৃত হয়েছে সে, প্রভুদের
পাদুকার তলে
প’ড়ে থাকা অন্ন চেটে খাওয়া ছাড়া
আর কিছুতেই
পরিতৃপ্তি পায় না আপনার পুত্র,
একদা আপনার
স্তন থেকে মধুদুগ্ধ শুষে নিয়ে
জীবন ধারণ
করতো যে বালক বয়সে। এখন সে
শত্রু পাখি
ও নদীর, শত্রু মানুষের, এমন কি
সে আপনার
স্তন্যেরও শত্রু। তার জন্য
দুঃক্ষ করি না, কতোই
তো গোলাম দেখলাম এ-বদ্বীপে
শতকে শতকে।
কিন্তু আপনার জন্যে, হে গরিব
কৃষক-কন্যা, দুঃক্ষী
মাতা, গরিব-গৃহিণী, আপনার জন্যে
বড় বেশি
দুঃখ পাই;- আপনার পুত্রের
গোলামির বার্তা আজ
রাষ্ট্র দিকে দিকে, নিশ্চয়ই তা
পৌঁছে গেছে তিতাসের
জলের গভীরে আর কুমড়োর খেতে,
লাউয়ের
মাঁচায়, পাখির বাসা আর চাষীদের
উঠানের কোণে।
তিতাসের জল আপনাকে দেখলে ছলছল
ক’রে
ওঠে, ‘ওই দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে’; মাঠে
পাখি ডেকে ওঠে, ‘দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে’;
আপনার পালিত বেড়াল দুধের বাটি
থেকে
দু-চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘গোলামের
গর্ভধারিণীর
হাতের দুগ্ধ রোচে না আমার জিভে’,
প্রতিবেশী
পুরুষ-নারীরা অঙ্গুলি সংকেত
ক’রে কলকণ্ঠে
বলে, ‘দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে।’ এমন কি
প্রার্থনার সময়ও আপনি হয়তো বা
শুনতে পান
‘গোলামের গর্ভধারিণী, ধারিণী’
স্বর ঘিরে ফেলছে
চারদিক থেকে। আপনি যখন অন্তিম
বিশ্রাম
নেবেন মাটির তলে তখনো হয়তো
মাটি ফুঁড়ে
মাথা তুলবে ঘাসফুল, বাতাসের
কানে কানে ব’লে
যাবে, ‘এখানে ঘুমিয়ে আছেন এক
গর্ভধারিণী
গোলামের।’ ভিজে উঠবে মাটি
ঠাণ্ডা কোমল অশ্রুতে।
কী দোষ আপনার? মা কি কখনোও জানে
দশমাস
ধ’রে যাকে সে ধারণ করছে সে মানুষ
না গোলাম?

১২

কখনো আমি – হুমায়ুন আজাদ

কখনো আমি স্বপ্ন দেখি যদি
স্বপ্ন দেখবো একটি বিশাল নদী।
নদীর ওপর আকাশ ঘন নীল
নীলের ভেতর উড়ছে গাঙচিল।
আকাশ ছুঁয়ে উঠছে কেবল ঢেউ
আমি ছাড়া চারদিকে নেই কেউ।

কখনো আমি কাউকে যদি ডাকি
ডাকবো একটি কোমল সুদূর পাখি।
পাখির ডানায় আঁকা বনের ছবি
চোখের তারায় জ্বলে ভোরের রবি।
আকাশ কাঁপে পাখির গলার সুরে
বৃষ্টি নামে সব পৃথিবী জুড়ে।

 ১৩ 

গরীবের সৌন্দর্য – হুমায়ুন আজাদ 

গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।
গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।
গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।
গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।
গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।
যখন গরিবেরা মাটি কাটে ইট ভাঙে খড় ঘাঁটে গাড়ি ঠেলে পিচ ঢালে তখন তাদের
সারা দেহে ঘাম জবজব করে, তখন তাদের খুব নোংরা আর কুৎসিত দেখায়।
গরিবদের খাওয়ার ভঙ্গি শিম্পাঞ্জির ভঙ্গির চেয়েও খারাপ।
অশ্লীল হাঁ ক’রে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠো ভ’রে সব কিছু গিলে ফেলে তারা।
থুতু ফেলার সময় গরিবেরা এমনভাবে মুখ বিকৃত করে
যেনো মুখে সাতদিন ধ’রে পচছিলো একটা নোংরা ইঁদুর।
গরিবদের ঘুমোনোর ভঙ্গি খুবই বিশ্রী।
গরিবেরা হাসতে গিয়ে হাসিটাকেই মাটি ক’রে ফেলে।
গান গাওয়ার সময়ও গরিবদের একটুও সুন্দর দেখায় না।
গরিবেরা চুমো খেতেই জানে না, এমনকি শিশুদের চুমো খাওয়ার সময়ও
থকথকে থুতুতে তারা নোংরা করে দেয় ঠোঁট নাক গাল।
গরিবদের আলিঙ্গন খুবই বেঢপ।
গরিবদের সঙ্গমও অত্যন্ত নোংরা, মনে হয় নোংরা মেঝের ওপর
সাংঘাতিকভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে দু’টি উলঙ্গ অশ্লীল জন্তু।
গরিবদের চুলে উকুন আর জট ছাড়া কোনো সৌন্দর্য নেই।
গরিবদের বগলের তলে থকথকে ময়লা আর বিচ্ছিরি লোম সব জড়াজড়ি করে।
গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই,
চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়।
মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে
বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়।
অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।

শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়

 ১৪ 

বাঙলা ভাষা – হুমায়ুন আজাদ

শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি-আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী-
একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আমাদের ঘিরে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার।
তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়-
হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে-শোভায়।

লকলকে চাবুকের আক্রোশ আর অজগরের মতো অন্ধ শেকলের
মুখোমুখি আমরা তুলে ধরি আমাদের উদ্ধত দর্পিত সৌন্দর্য:
আদিম ঝরনার মতো অজস্র ধারায় ফিনকি দেয়া টকটকে লাল রক্ত,
চাবুকের থাবায় সুর্যের টুকরোর মতো ছেঁড়া মাংস
আর আকাশের দিকে হাতুড়ির মতো উদ্যত মুষ্টি।

শাঁইশাঁই চাবুকে আমার মিশ্র মাংসপেশি পাথরের চেয়ে শক্ত হয়ে ওঠে
তুমি হয়ে ওঠো তপ্ত কাঞ্চনের চেয়েও সুন্দর।
সভ্যতার সমস্ত শিল্পকলার চেয়ে রহস্যময় তোমার দু-চোখ
যেখানে তাকাও সেখানেই ফুটে ওঠে কুমুদকহ্লার
হরিণের দ্রুত ধাবমান গতির চেয়ে সুন্দর ওই ভ্রূযুগল
তোমার পিঠে চাবুকের দাগ চুনির জড়োয়ার চেয়েও দামি আর রঙিন
তোমার দুই স্তন ঘিরে ঘাতকের কামড়ের দাগ মুক্তোমালার চেয়েও ঝলোমলো
তোমার ‘অ, আ’ –চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর

তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চন্ডীদাস
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম

শাঁইশাঁই চাবুকের আক্রোশে যখন তুমি আর আমি
আকাশের দিকে ছুঁড়ি আমাদের উদ্ধত সুন্দর বাহু, রক্তাক্ত আঙুল,
তখনি সৃষ্টি হয় নাচের নতুন মুদ্রা;
ফিনকি দেয়া লাল রক্ত সমস্ত শরীরে মেখে যখন আমরা গড়িয়ে পড়ি
ধূসর মাটিতে এবং আবার দাঁড়াই পৃথিবীর সমস্ত চাবুকের মুখোমুখি,
তখনি জন্ম নেয় অভাবিত সৌন্দর্যমন্ডিত বিশুদ্ধ নাচ;
এবং যখন শেকলের পর শেকল চুরমার ক’রে ঝনঝন ক’রে বেজে উঠি
আমরা দুজন, তখনি প্রথম জন্মে গভীর-ব্যাপক-শিল্পসম্মত ঐকতান-
আমাদের আদিগন্ত আর্তনাদ বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের
একমাত্র গান।

১৫

সিংহ গাধা ও অন্যান্য – হুমায়ুন আজাদ 

১.
মানুষ সিংহের প্রশংসা করে,
তবে গাধাকেই আসলে পছন্দ করে।
আমার প্রতিভাকে প্রশংসা করলেও
ওই পুঁজিপতি গাধাটাকেই
আসলে পছন্দ কর তুমি।

২.
তোমাকে নিয়ে এতোগুলো কবিতা লিখেছি।
তার গোটাচারি শিল্পোত্তীর্ণ
আর অন্তত একটি কালোত্তীর্ণ।
এতেই সবাই বুঝবে তোমাকে আমি পাই নি কখনো।

৩.
প্রাক্তন দ্রোহীরা যখন অর্ঘ্য পায়
তাদের কবরে যখন স্মৃতিস্তম্ভ মাথা তোলে
নতুন বিদ্রোহীরা কারাগারে ঢোকে
আর ফাঁসিকাঠে ঝোলে।

৪.
মেয়ে, তোমার সুন্দর মনের থেকে
অনেক আকর্ষণীয়
তোমার সুন্দর শরীর।

৫.
যখন তোমার রিকশা উড়ে আসে
সামনের দিক থেকে প্রজাপতির মতো
তখন পেছন দিক থেকে দানবের মতো ছুটে আসে
একটা লকলকে জিভের ট্রাক
প্রজাপতি আর দানবের মধ্যে আমি পিষ্ঠ চিরকাল।

১৬  

আমাকে ছেড়ে যাবার পর – হুমায়ুন আজাদ

আমাকে ছেড়ে যাবার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো ।
তোমার খবরের জন্যে যে আমি খুব ব্যাকুল এমনটি নয় ।
তবে ঢাকা খুবই ছোট্ট শহর, কারো কষ্টের কথা এখানে চাপা থাকে না ।

শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাবার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো ।
প্রত্যেক রাতে সেই ঘটনার পর নাকি আমাকে মনে পড়ে তোমার ।পড়বেই তো,
পৃথিবীতে সেই ঘটনা তুমি আমি মিলেই তো প্রথম সৃষ্টি করেছিলাম ।
যে গাধাটার হাত ধরে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে-
সে নাকি এখনো তোমার একটি ভয়ঙ্কর তিলের খবর পায়নি।
ঐ ভিসুভিয়াস থেকে কতটা লাভা ওঠে তা তো আমিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম ।
তুমি কি জানো না গাধারা কখনো অগ্নিগিরিতে চড়ে না ।
তোমার কানের লতিতে কতটা বিদ্যুৎ আছে তা কি তুমি জানতে? আমিই তো প্রথম জানিয়েছিলাম
ঐ বিদ্যুতে দপ করে জ্বলে ঊঠতে পারে মধ্যরাত ।
তুমি কি জানো না, গাধারা বিদ্যুৎ সম্পর্কে কোন খবরই রাখে না ?

আমাকে ছেড়ে যাবার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো ।
যে গাধাটার সাথে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে
সে নাকি ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শয্যাকক্ষে কোন শারীরিক তাপের প্রয়োজন পড়েনা ।
আমি জানি তোমার কতটা দরকার শারীরিক তাপ । গাধারা জানে না ।
আমিই তো খুঁজে বের করেছিলাম তোমার দুই বাহুমূলে লুকিয়ে আছে দুইটি ভয়ঙ্কর ত্রিভুজ ।
সে খবর পায়নি গাধাটা । গাধারা চিরকালই শারীরিক ও সব রকম জ্যামিতিতে খুব মূর্খ হয়ে থাকে।
তোমার গাধাটা আবার একটু রাবীন্দ্রিক । তুমি যেখানে নিজের জমিতে
চাষার অক্লান্ত নিরলস চাষ মই পছন্দ করো, সে নাকি আধ মিনিটের বেশি
চষতে পারে না।
গাধাটা জানে না চাষ আর গীতবিতানের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য।

তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে?
ভেবেছিলে গাড়ি আর পাঁচতলা ভবন থাকলে
ওষ্ঠ থাকে ,
আলিঙনের জন্যে বাহু থাকে ।
আর রাত্রিকে মুখর করার জন্যে সেই অনবদ্য অর্গান ।

শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাবার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো ।
আমি কিন্তু কষ্টে নেই –
শুধু তোমার মুখের ছায়া কেঁপে উঠলে বুক জুড়ে, রাতটা জেগেই কাটাই ।

সম্ভবত বিশটির মতো সিগারেট বেশি খাই।

১৭ 
আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।

আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।

না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।

তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।

শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।

হুমায়ুন আজাদ (২৮শে এপ্রিল, ১৯৪৭ (১৪ই বৈশাখ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ)- ১১ই আগস্ট, ২০০৪) একজন বাংলাদেশী ভাষাবিজ্ঞানী, কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, কিশোর সাহিত্যিক এবং কলাম প্রাবন্ধিক। ধর্ম, প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, নারীবাদিতা, রাজনৈতিক বক্তব্য এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য তিনি ১৯৮০’র দশক থেকে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০ টি’র বেশী। হুমায়ুন আজাদের ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তার রচিত কিশোরসাহিত্য আব্বুকে মনে পড়ে (১৯৮৯) জাপানি ভাষায় অনুদিত হয় ২০০৩ সাল। তিনি ১৯৯২ সালে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ নারী রচনা করে গোটা দেশে সাড়া তুলেন যা ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলো। এ গ্রন্থ তাঁর বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্য এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্যে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।

হুমায়ুন আজাদের কিছু রচনার লিষ্টি –

কবিতা
*. অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩)
*. জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০)
*. সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫)
*. যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল (১৯৮৭)
*. আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০)
*. হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩)
*. আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৯৪)
*. কাফনে মোড়া অশ্রু বিন্দু (১৯৯৮)
*. কাব্য সংগ্রহ (১৯৯৮)
*. পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)

উপন্যাস
*. ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল (১৯৯৪)
*. সব কিছু ভেঙে পড়ে (১৯৯৫)
*. মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ (১৯৯৬)
*. যাদুকরের মৃত্যু (১৯৯৬)
*. শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার (১৯৯৭)
*. রাজনীতিবিদগণ (১৯৯৮)
*. কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ (১৯৯৯)
*. নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু (২০০০)
*. ফালি ফালি ক’রে কাটা চাঁদ (২০০১)
*. শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা (২০০২)
*. ১০,০০০, এবং আরো একটি ধর্ষণ (২০০৩)
*. একটি খুনের স্বপ্ন (২০০৪)
*. পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪)

প্রবন্ধ
*. শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্যপ্রবন্ধ (১৯৮৮)
*. ভাষা-আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি (১৯৯০)
*. নারী (১৯৯২)
*. প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে (১৯৯২)
*. নিবিড় নীলিমা (১৯৯২)
*. মাতাল তরণী (১৯৯২)
*. নরকে অনন্ত ঋতু (১৯৯২)
*. জলপাই রঙের অন্ধকার (১৯৯২)
*. রবীন্দ্র প্রবন্ধ/রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা (১৯৯৩)
*. শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৯৩)
*. সীমাবদ্ধতার সূত্র (১৯৯৩)
*. আধার ও আধেয় (১৯৯৩)
*. আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭)
*. পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা (১৯৯৭)
*. মহাবিশ্ব (২০০০)
*. দ্বিতীয় লিঙ্গ (মূল : সিমোন দ্য বোভোয়ার) (২০০১)
*. আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম (২০০৩)
*. ধর্মানভূতির উপকথা ও অন্যান্য (২০০৪)

পৃথিবীতে যতোদিন অন্তত একজনও প্রথাবিরোধী মানুষ থাকবে, ততো দিন পৃথিবী মানুষের। (প্রবচন নম্বর ২০০)

২৫ টি মন্তব্য : “হুমায়ুন আজাদ – একজন অলৌকিক স্রষ্টা”

  1. নাফিস (২০০৪-১০)

    হুমায়ুন আজাদের মর্ম এখনো বেশির ভাগ মানুষই বুঝতে পারে নাই.. উনার লেখা প্রতিটা লাইন ই কোট করার মতন.. সব যে পড়ে ফেলেছি তা না, তবে যতগুলো লেখা পড়েছি একদম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিলাম।

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে তাঁর নারী বইটি নিষিদ্ধ হয়। খবরটি আমি শুনি শাহবাগে, আজিজ মার্কেটের দোতলার ’প্রকাশক’ নামের কক্ষটিতে, যেখানে প্রায়ই আমরা আড্ডা দিতাম। উল্লেখ্য, প্রকাশক ছিল ব্রাত্য রাইসু, লীসা অতন্দ্রিলা, শাহ্‌রীয়ার রাসেল ও শহীদুল ইসলাম টিটুর যৌথ মালিকানার বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান! যদিও এটি বিজ্ঞাপনের ব্যবসার কোনো কাজেই আসেনি। শেষ পর্যন্ত কক্ষটি আড্ডাস্থল হিসাবে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। পরে জানতে পারি, ভাড়ার টাকা পরিশোধ না করতে করতে দেড় দুই বছরে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাঁড়ায় ছফা ভাই তা মিটিয়ে দিয়ে আসবাবপত্র সহ সেই কক্ষে বসতে শুরু করেন। এর আগে তিনি পাশের আরেকটি কক্ষে মাদুরের উপরে টেবিল এবং মুখোমুখি দুটি চেয়ার নিয়ে বসতেন। টেবিলের উপরে সব সময়ে একটি অ্যাসট্রে থাকত।

    প্রকাশক-এ প্রায়ই সাজ্জাদ ভাই, রাইসু, রাজু আলাউদ্দিনসহ অনেকের সঙ্গে আড্ডা হতো, কথা হতো। সেখানে কারও সঙ্গে দেখা না-হলে পাশের ছফা ভাইয়ের সেই রুমটিতে উঁকি দিতাম। দেখে ছফা ভাই ডাকতেন। কোনও-কোনও সন্ধ্যায় দেখতাম, সেই রুমে তাঁর মুখোমুখি বা টেবিলের পাশের চেয়ারটায় বসে আছেন সমুদ্র গুপ্ত, নয়তো জাহিদ হায়দার। তো, কার কাছ থেকে নারী নিষিদ্ধ হওয়ার খবরটা শুনি, আমার মনে নেই। তা না-থাকলেও, ছফা ভাইয়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখি, তাঁর টেবিল ঘিরে চার-পাঁচজন লোক, তিনি বেশ উত্তেজিত; ‘এখানে বই যারা বিক্রি করে সবাইকে আমার সাথে দেখা করতে বলো। যাও।’ কাকে যে বলছেন তা বুঝতে পারছিলাম না। দেখতে পাচ্ছিলাম, তিনি দাঁড়িয়ে চিৎকার করছেন, ‘লুৎফর (লুৎফর রহমান: বইয়ের দোকান ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সন্দেশ-এর স্বত্বাধিকারী) কোথায়, ওকে আমার এখানে নিয়া স।’ পেছন ফিরে দেখলাম খাটো, গোঁফঅলা, সাদার উপর কালো চেক শার্ট-পরা একটা ছেলে; শোনামাত্র সে দ্রুত স্থানত্যাগ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছ’সাতজন লোক সেখানে হাজির। তবে আগে এলেন লুৎফর। তাঁকে ছফা ভাই বললেন, ‘নারী বিক্রি বন্ধ করবে না।’ তিনি বললেন, ‘পুলিশে ধইরা নিয়া গ্যালে আমারে কি আপনি ছুটাইয়া আনতে পারবেন?’ ছফা ভাই অন্যদেরকেও নারী বিক্রি চালিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু লুৎফরের কথার সূত্র ধরে কেউ রাজি হলেন না। ছফা ভাই রেগে গেলেন। বললেন, ‘তোমরা আমার কথা বুঝতেই পার নাই। এইটা একটা প্রতিবাদ। বই ব্যাচাটাই বুজলা। যাও, সব বই আমার এখানে পাঠাইয়া দাও। আমি আহমদ ছফা আজিজ মার্কেটের সামনের ফুটপাতে প্রকাশ্যে নারী বেচব। প্রতিবাদ আমি করবই। কারণ, এই নিষিদ্ধ আমি মানি না।’
    তারা সেখান থেকে বের হলেন; কিন্তু বইটির একটা কপিও এল না। ততক্ষণে রুমটায় ২০-২৫ জন লোক, ছোটখাটো একটা সমাবেশ। মাদুরে বসেছেন সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যে আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গণিকে সঙ্গে নিয়ে হুমায়ুন আজাদ এলেন। কেডস খুলে তিনিও বসলেন। এর সামান্য আগে এক জার্মান ভদ্রলোক এসে ছফা ভাইয়ের পাশে বসেছেন। হুমায়ুন আজাদ জানালেন, তিনি ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সঙ্গে এ-নিয়ে কথা বলেছেন। বললেন, ‘বিএনপি-জামাত সরকার বেশি দিন বইটিকে নিষিদ্ধ রাখতে পারবে না।’ ছফা ভাই জার্মান ভদ্রলোকের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর বই যে সরকার নিষিদ্ধ করেছে, তা তাঁকে জানালেন। হুমায়ুন আজাদ ইংরেজিতে তাঁকে বললেন যে, বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার আছে, কিন্তু গণতন্ত্র নেই। কারণ এখানে বাকস্বাধীনতা নেই। ছফা ভাই এর সমর্থনে উদাহরণ দিতে গিয়ে তসলিমা নাসরিনের কথা বললেন। শুনে হুমায়ুন আজাদ বিরক্তি নিয়ে তাকালেন তাঁর দিকে। বললেন, ‘তসলিমার নাম উচ্চারণ করতে হবে, এমন কিছু এখানে আমি দেখছি না।’
    রাত ন’টার দিকে হুমায়ুন আজাদ চলে গেলে ছফা ভাই বললেন, ‘দেখছ, ও এতগুলা লোকের সামনে কী করল! বাইরের লোকের সামনে তসলিমারে নিয়া এইটা বলা ঠিক হইছে? ভদ্রলোক বাংলা জানলে ইজ্জত বলে কিছু থাকতো?’ আরও বললেন, ‘ওর এখনও বুদ্ধিসুদ্ধি হল না। আরে, এত সোজা, জামাত-বিএনপির হাত থেকে মুক্তি এত সহজ! উন্মাদ! বোকা লেখক! ওর আরও বিপদ আছে।’
    - চঞ্চল আশরাফের জবানিতে


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারালে খুব উৎসব হয়েছিল। যারা পাকিস্তানের সমর্থক তারা একে পাতানো খেলা মনে করে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। বাকিদের জন্যে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মতোই। এই আনন্দে নির্মলেন্দু গুণ থেকে শুরু করে সবাই মেতেছিলেন তখন। তো, হুমায়ুন আজাদ কেমন আনন্দিত তা জানার চেষ্টা করতেই তিনি বললেন, ‘খেলাটি আমার পছন্দ নয়।’

    ‘কেন?’

    ‘এটা তো পাকিস্তানের প্রিয় খেলা।’

    ‘অন্য দেশগুলিও তো খেলে।’

    ‘সেটা সেই সব দেশের ব্যাপার।’

    ‘তা হলে?’

    ‘বাংলাদেশের এই খেলা বর্জন করা উচিত। খেললেও পাকিস্তানের সঙ্গে নয়। বাঙালির উচিত নয় ওদের সঙ্গে কোনও খেলায় অংশ নেয়া। শুধু খেলা কেন, ওদের সঙ্গে বাঙালির কোনও সম্পর্ক রাখা উচিত নয়।’

    ‘কিন্তু অনেকেই বলে, খেলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই।’

    ‘এটা পাকিস্তানপন্থিরা বলে। নির্বোধরা তা মেনে নেয়। একটা দেশ যখন আরেকটা দেশের সঙ্গে খেলে, রাজনীতি অবশ্যই থাকে। তারা তো নিজেদের পতাকা নিয়ে যায়।’

    ‘পাকিস্তানকে হারানোর পর সবাই ফূর্তি করছে। আপনার কি একটুও ভালো লাগছে না?’

    ‘যারা ফূর্তি করছে, তারা কি জানে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে আরও খেলতে হবে? আমি তো ওই চাঁদতারা পতাকার পাশে আমাদের পতাকা দেখতেই চাই না।’
    - চঞ্চল আশরাফের জবানিতে


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    উনার লেখা গুলার পিডিএফ পাইসিলাম একটা সাইটে। নামাইসিলামও। সাম্প্রতিক নাজমুলের পোস্টের প্রেক্ষিতে ডিলিট করে দিসি। দেশে গিয়ে কিনে পড়তে হবে। আমার এক চাচার উনার সাথে বেশ উঠাবসা ছিল। চাচার কাছে গল্প শুনেছি প্রচুর। দেখি উনার কাছেও ধরণা দিতে হবে! 🙂


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      হুমায়ুন আজাদ স্যার আর দূর্গাদাস স্যারের তীব্র আপত্তির কারণে টিচারদের ডিসের লাইনে পি টিভি আর ইন্ডাস ভিশন বন্ধ ছিলো।

      আমার এক ফ্রেন্ডের বাবা আবার সিনিওর টিচার ছিলো, ওর কারণে জানতে পারছিলাম এই ব্যাপারটা।
      যদিও সে খুব নাখোশ ছিলো এই ব্যাপারে। ওর মা পাকিস্থানী ছিলো আর উর্দু সে মিস করতো। আমারে উর্দু শিখানোর অনেক ট্রাই সে নিছিলো। পারে নাই।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
  5. তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

    হুমায়ুন আজাদের কবিতা,প্রবন্ধ,ভাষা নিয়ে অসামান্য কাজসমূহ,উনার সত্যকথন(কিছু প্রবচন বাদে),উনার স্রোতের বিপরীতে চলার সাহস অতুলনীয়।

    উপন্যাস লেখার সময় কেন যে উনি এত ভালগার হয়েছিলেন তা আমার গার্হস্থ্য এবং লঘিষ্ঠ বোধে আসে না।
    তবে এই ভূ-খন্ডে মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকবেন এটা নিশ্চিত।
    আমূল পরিবর্তন পিয়াসী উল্টোস্রোতের স্রষ্টারা সবসময়েই রাষ্ট্র সন্ত্রাস কিম্বা শ্রেণী সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন।ইতিহাস সাক্ষী।
    রাজীবকে ধন্যবাদ এতোগুলো সুন্দর সুন্দর কবিতা একসাথে পড়বার সুযোগ করে দেবার জন্য । আহা ! হুমায়ুন আজাদের কবিতা !!! (সম্পাদিত)


    আমি চোখ মেললুম আকাশে
    জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      ধন্যবাদ আপা।
      কারো মতের সাথে তো পুরোটা মেলে না আপা।
      যেমন আমি আবুল বাশারের লেখা খুব পছন্দ করি। হুমায়ুন আজাদ তার যথেচ্ছ সমালোচনা করেছেন।
      অবশ্য এটাও সত্য আবুল বাশারকে হাই লাইট করার পেছনে দাদাদের ব্যাবসায়িক বুদ্ধিও রয়েছে।

      হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ভালগার এটা আমার কখনোই মনে হয় নাই।
      আমার কাছে বরং অনেক বেশি পরিণত মনে হইছে।
      ৫৬ হাজারের নগ্নতা, সব কিছু ভেঙ্গে পড়ের বিবাহিত জীবনের কথা, নিজের সাথে নিজের জীবনের মধু তে নিজকে জানা এইসব আমার কাছে অভিনব মনে হইছে।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      তারপর ধরেন আপা, কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ আধুনিক কবি এবং সমাজের দন্দ্ব,
      ফালি ফালি করে কাটা চাদ আধুনিক মেয়ের সমস্যা নিয়ে।

      হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস আমার কাছে অনেক বেশি পরিণত অনেক সাহসী আর সত্য মনে হয়।

      পাক সার সাদ বাদ এ মৌলবাদের যে রূপ আমরা দেখি তা অবিশ্বাস্য মনে হলেও ভংকরভাবে সত্য। এবং পুরা উপন্যাস টি শেষে এসে আলো তে উদ্ভাসিত হয়েছে। মানুষের জয় হয়েছে।

      আবার ৫৬ হাজারে ফেরত যাই।
      উপন্যাসটি শুরু হয়েছে একটা কবিতা দিয়ে। কবিতার ভাষা বুঝিয়ে দেয় এই উপন্যাস কাদের জন্য।
      এরপর স্ত্রী যখন তাকে জানায় তখন সে-রাশেদ-নায়ক স্বগোতোক্তি করে যে ভাষায় তা স্পষ্ট বলে দেয় সামরিক শাসনের প্রতি তার ঘৃণার কথা। সামরিক শাসন দেশে কি নিয়ে আসে সেই কথা।

      আমার কাছে মনে হয় হুমায়ুন আজাদের উ প ন্যা স আমাদের কে তথাকথিত নেকুপুষু-আহলাদী উপন্যাস পাঠ করা থেকে মুক্তি দিয়েছে।

      এমন না যে আগে থেকেই যারা লিখছেন তারা খারাপ বা অপাঠ্য লিখছেন।
      শওকত আলী, আখ্তারুজ্জামান ইলিয়াস (মাত্র ২টি উপন্যাস), সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ সহ আরো অনেকে অনেক ভালো উপন্যাস লিখেছেন।
      ইচ্ছা করে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আবু ইসহাক এদের নাম আনলাম না আর।

      সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার হুমায়ুন আজাদ একটি নতুন পাঠক শ্রেণী তৈরি করেছে। যেই পাঠকশ্রেণী সমাজে ছিলো, যারা মাসুদ রানার চাইতে আরেকটু সিরিয়াস, হুমায়ুন আহমেদের তরলতার চাইতে আরেকটু সিরিয়াস কিছু খুঁজছিলো।

      আর অশ্লীলতার ২ টা উদা দেই। ইলিয়াসের খোয়াবনামায় বৃদ্ধ নায়কের- মূলচরিতের সন্তান তার সৎ মায়ের সাথে সঙ্গম করে সেটাকে কি বলবেন?
      অরুন্ধতির গড অফ স্মল থিং এ নায়িকার দুই সন্তান একে অন্যের সাথে মিলিত হয় সেটাকে কি বলবেন।

      আবার রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবির কথা ভাবেন। বৌ বদল হয়ে গেলো। জানলো কিন্তু অনেক পরে। এর মাঝে স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ক কোথায়? সেখানে যৌনতা আসা কি খুব স্বাভাবিক ছিলো না!


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
  6. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    'নারী' পড়েছিলাম ক্লাস টেনে কি নাইনে থাকতে কলেজে। তারপর পড়ি 'শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার'। এরপর খন্ডিত ভাবে দুই এক লাইন পড়লেও সেভাবে আমার চিন্তাকে আলোড়িত করতে পারেনি।

    আমার চিন্তা চেতনায় সজোড়ে লাথি মারে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ'। তারপর গোগ্রাসে গিলেছি তার বেশিরভাগ উপন্যাস আর প্রবন্ধ। পঠিত গুলো আবার পড়েছি। কবিতা সেভাবে পড়িনি।

    ব্যক্তিগতভাবে কেনা সবচেয়ে বেশি বই ছিল হুমায়ুন আজাদের। কিন্তু রাখতে পারিনি। যে যে নিয়েছে একটাও ফেরত দেয়নি 🙁

    স্যারের একটা কথায় আমি সব সময় আতঙ্কিত থাকি, 'মোল্লারা পবিত্র ধর্মকেই নষ্ট ক’রে ফেলেছে; ওরা হাতে রাষ্ট্র পেলে তাকে জাহান্নাম ক’রে তুলবে '। ফুলার রোডে কাপল রা বসে থাকতে পারবে না, সৌদি আরবের মত ধার্মিক পুলিশ ঘুরবে রাস্তায়, গান গাবে না, গিটার নিয়ে হেটে যাবে না তরুনরা, পহেলা বৈশাখে কোন বাচ্চা বাশিও বাজাতে পারবে না, রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ হবে। উফ আর চিন্তা করতে পারছি না। এই ভয়ঙ্কর চিত্রটা খুব ভালো ভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন স্যার।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
  7. সুন্দর লেখা, সেসঙ্গে মন্তব্যগুলোও! বেশ কিছু প্রিয় উক্তির সমাহার। হুমায়ুন আজাদ ভক্তের জন্য উপযুক্ত উপস্থাপন। আমি একটু নেতিবাচক প্রসঙ্গে কিছূ জানতে চাই, কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় কিনা। অবশ্যই হুমায়ুন আজাদ বা ভক্তকে আহত করার উদ্দেশ্য নাই।

    যা জানতে চাই:
    ১ম: আমার অবিশ্বাস কি আসলে বাট্র্রান্ড রাসেলের হোয়াই আই অ্যাম নট এ ক্রিশ্চিয়ান এর ভাবানুবাদ?
    ২য়: নারী বইয়ের ১ম সংস্করণে কি বিদেশী লেখকদের লেখা থেকে নেয়া অংশের স্পষ্ট স্বীকৃতি ছিল? বর্তমান সংস্করণে কি আছে? [এ প্রসঙ্গে বলা যায়, হুমায়ুন আজাদ নারী বইয়ের ভূমিকায় নারী লেখকেদের বড় হিসেবে তুলে ধরার পাশাপাশি এই অভিযোগ করেন যে, ইংরেজ কবি কোলরিজ তার কুবলা খান কবিতাটি আসলে আফিমের ঘোরে স্বপ্নপ্রাপ্ত কবিতা না, বরং সেসময়ের এক নারী কবির কবিতার চুরি। আর তাই এমন লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কাছে অন্যের লেখা থেকে ভাবনা ও তথ্য ধার করা বা ভাবান্তর করার স্বীকৃতি অবশ্যপ্রাপ্য। তিনি নারী বইটিতে (১ম সংস্করণে বা পরবর্তীতে তা ঠিক ঠিক করেছেন কিনা তা কি কারো দেখা আছে?)]
    ৩য়: তাঁর সমালোচকরা দাবি করেন যে, ভাষাত্বত্তের উপর লেখা তাঁর একটি বই বিদেশী বইয়ের অনুবাদ হওয়ায় কিন্তু নিজ নামে বাজারে আসায় বাংলা একাডেমী তা বাজার থেকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়। আমি এর সত্যতা জানি না।

    আমার প্রশ্ন তিনটির আবেগ নিরপেক্ষ উত্তর পেলে খুব উপকৃত হবো।
    আপনাকে (বা যে কোনো উত্তরদাতাকে) অগ্রিম ধন্যবাদ 🙂

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      ধন্যবাদ।
      ০১। বার্টান্ড রাসেল এর ঐ বইটির কথা শুনেছি। পড়া হয় নাই।
      তবে ভাবের মিল তো হতেই পারে।
      জীবনানন্দ তার বনলতা সেনের কোথাও কি টু হেলেন এর কথা বলেছেন?
      Edgar Allan Poe
      To Helen

      Helen, thy beauty is to me
      Like those Nicean barks of yore
      That gently, o'er a perfumed sea,
      The weary, way-worn wanderer bore
      To his own native shore.

      On desperate seas long wont to roam,
      Thy hyacinth hair, thy classic face,
      Thy Naiad airs have brought me home
      To the glory that was Greece,
      And the grandeur that was Rome.

      Lo, in yon brilliant window-niche
      How statue-like I see thee stand,
      The agate lamp within thy hand,
      Ah! Psyche, from the regions which
      Are Holy Land!

      বনলতা সেন

      -জীবনানন্দ দাশ

      হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
      সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
      অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে
      সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
      আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
      আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

      চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
      মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
      হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
      সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
      তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‌‌‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
      পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

      সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
      সন্ধা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
      পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
      তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
      সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
      থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

      এমনকি তিনি নিজে এর ইংরেজিতে অনুবাদ ও করেছিলেন।

      আমার কাছে হুমায়ুন আজাদের আমার অবিশ্বাস একটি স্বয়ং সম্পুর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সংকলন মনে হইছে।
      তবে যদি এটা অনুবাদ ই হতো তবে তিনি অবশ্যই উল্লেখ করতেন। কারণ দ্বিতীয় লিঙ্গ তো অনুবাদ। আর তা বেশ বড় করেই বলা আছে।

      ০২। খুব সম্ভবত নারীর ১ম সংস্করণে র শেষে তালিকা ছিলো। এখন ও আছে।
      চেক করে দেখলাম।
      অনেকে মনে করেন শেক্সপিয়ারের লেখাগুলো আসলে ফ্রান্সিস বেকন এর। কারণ শেক্সপিয়ার এর শিক্ষাগত যোগ্যতা তত বেশি ছিলো না।

      ০৩। জানি না কোন বই। তবে হুমায়ুন আজাদ এর বাক্যতত্বটি ঢা বি তে পাঠ্য ছিলো।
      বাঙলা একাডেমি থেকে হুমায়ুন আজাদ এর আরো কিছু বই ছিলো।
      হুমায়ুন আজাদ লেখা চুরি করবেন এটা ভাবা যায় না।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      খুব সম্ভবত বাঙলা ভাষার শত্রু মিত্র প্রবন্ধ গ্রন্থটি বাঙ্লা একাডেমি থেকে প্রকাশ হয়েছিলো। আমার কাছে এক কপি ছিলো।
      পরে এটা আগামী থেকে ছাপা হয়।
      আর হুমায়ুন আজাদ তো পরে আগামী ছাড়া আর কোথাও লেখা দেননি।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।