আলোর জাফরি

গ্লাসের পানি একটু একটু কাঁপছে। কেঁপেই যাচ্ছে।
ইতু দু’হাতে শক্ত করে ধরেও থামাতে পারছে না।এক ঢোক খেয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখে পাশে।
এই আতাগাছের ছায়া টুকু বাদ দিলে সারা বাড়ি ঝকঝক করছে রোদে আর সেই বিহানবেলা থেকে ছুটতে শুরু করা মায়ের যত্নে।
পিড়িতে জুবুথুবু ইতু হাটুতে থুতনি ঠেকায় সাবধানে, অনুভব করে নাসিমা বেগমের ব্যাস্ততা।
উঠান জুড়ে কত কি যে শুকাতে দেয়া!মুড়ির ধান,আতপ চাল,কুমড়ার বড়ি,ট্যাংরা চান্দার শুটকি,ইতুর বিছানা বালিশ,আধভেজা পাতার রাশ,ধঞ্চে কাঠি আরো কত কি !

দড়িতে কাপড় মেলতে এসে নাসিমা রাগতে গিয়েও থেমে গেল।
-স্যান্ডেল পায়ে দে ইতু।
ইসসস !সবেমাত্র পা টা মাটিতে ঠেকিয়েছিল।সাবধানে আবার স্যান্ডেলে পা গলিয়ে নেয় ।

হান্টার এক কাকের পিছে ঘেউ করে উঠল।হান্টার হল ইতুদের পোষা কুকুর। নাসিমা কিছু শুকাতে দিলে ওই পাহারা দেয়।
-ইতু … এদিকে আয়।সাগুটা খায়া যা।
উঠতে গিয়ে পা টলে গেল ।আজ জ্বর নেই।কিন্ত বেশ কদিন ধরেই ভুগছে ইতু।জ্বর বেশ দুর্বল করে দিয়েছে ওকে।

রান্নাঘরে অর্ধেকটা মাচান করে শুকনো লাকড়ি রাখা। এক পাশে দুটো মাটির চুলা।একটায় ভাত ফুটছে।আরেকটা থেকে সাগু নামিয়ে কড়াই বসায় নাসিমা।কাঁসার বাটিতে সাগু ঢেলে মেয়েকে বাড়িয়ে দেয়।দুধ-চিনি দেয়া।নাসিমার মুখ ভীষণ গম্ভীর।বাটিতে ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে মায়ের দিকে তাকায় ইতু।মাকে অনেক ভয় তার।
ইতুর আব্বা অসুস্থ।প্রায় বছর হতে চলল।আব্বার মাথায় গোলমাল।পাবনায় হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা চলছে।
নাসিমার হাতে কোন টাকা নাই।মেয়েটা এত জ্বরে ভুগল।হোমিওপ্যাথি চলছে।কিচ্ছু খেতে পারেনা।কাল বায়না ধরেছিল,চানাচুর খাবে।অন্য কথা বলে ভুলিয়েছিল ওকে।
মনটা বুঝি ছোটই হয়ে গেছে নাসিমার।নইলে ছোট খাট তুচ্ছ বিষয়েও আজকাল সে কষ্ট পায় কেন!জা মুনিরা সকালে ছেলেকে আপেল কেটে খাওয়াল।ইতুর কথা একবারও বলল না।মুনিরার প্রবাসী স্বামী টাকা পাঠায়।ওর হাতে টাকা থাকে।এই যৌথ পরিবারে ওর দামই আলাদা। আস্তে আস্তে ,যেন মেয়ে টের না পায়,দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল নাসিমা।
-আব্বাকে দেখতে যাবি !
-কিহ !!
ইতুর বিশ্বাসই হতে চায়না।এর আগে মা একবারও ওকে নিয়ে যায়নি।প্রতিবার ওকে রেখে মা যখন আব্বাকে দেখতে যায় ইতু কান্না গিলতে গিলতে গলা ব্যাথা করে ফেলে।চুপ করে বাড়ির পিছন পুকুরপাড়ে বসে থাকে। ইতুর পৃথিবী ওর আব্বা।কতদিন যে দেখে না ও আব্বাকে।
-কবে যাব?
-দেখি।
নাসিমা চুলায় জ্বাল ঠেলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।চুলার পাশে আনাজের ঝুড়ি।মসলাপাতির কৌটার তাক।কড়াইয়ে তেল গরম হয়ে গেছে।পেয়াজ ছেড়ে দেয় তাতে।শব্দ ওঠে। নাসিমার আরেকটি দীর্ঘশ্বাসের শব্দ চাপা পড়ে যায়।মসলা কষিয়ে মুরগির টুকরোগুলো ছেড়ে দেয় ।ভাতের মাড় গালে।এক ফাঁকে  মাড়টুকু  দিয়ে আসে গরুর চারিতে।একটু নুন মিশিয়ে দেয়।দুধেল গাই বড় আহ্লাদ নিয়ে মুখ ডুবায়।
রোদ যখন ইতুদের উঠান ছেড়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়ায় ঠিক তখন নাসিমা তার ভেজা চুল এলিয়ে দেয় তাতে।তার আগে তো দম ফেলারই সময় নেই।শ্বশুর-শাশুড়ি,দেবর-জা,ননদ নিয়ে বিরাট সংসার।কাজ কি একটা! ছোট ননদের বিয়ে।বড় ননদ তার বর বাচ্চা নিয়ে চলে এসেছে।বাড়ি গমগম করছে।
আজ নাসিমার মনও কেমন একটা আশা আশংকার মাঝামাঝি  দুলছে।সকালে শ্বশুর পাবনায় গেছেন।এবার ওকে নেননি।গতবার ইতুর আব্বাকে অনেক ভাল দেখে এসেছে।এবার যদি…
সন্ধ্যায় ইতুর আবার জ্বর এসেছে।মা,চাচী সবাই বিয়ের জন্য পিঠা বানাচ্ছে দাদির ঘরে। হ্যারিকেনের আলোয় মেয়েরা এটা ওটা বলছে,হাসাহাসি করছে আবার হাত চালিয়ে কাজও করে যাচ্ছে।আর উঠানের এ পাশে ইতুদের ঘরে ওর পাশে শুতে রশিদা ফুপুকে পাঠানো হয়েছে। ইতুর ঘুম আসছে না।চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় মনে হল মা ফিরল।দরজা বন্ধ করার শব্দ।রশিদা ফুপু এবার মেঝেতে শুয়ে পড়বে।
কিন্তু অচেনা তামাক গন্ধ!মা তো নয় ! কে তবে !
মনে হল রশিদা ফুপু কারো হাত থেকে বাঁচবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে।ইতুর ভীষণ ভয় হচ্ছে।নিজেকে কাঁথার আরো গভীরে ডুবিয়ে অচেতন করে দিতে গিয়ে টের পায় ঝটাপটির মাঝেই রশিদা উঠে দরজা খুলে ফেলে কাতর গলায় বলছে-আপনের পায়ে পড়ি দুলাভাই…
ইতু ঘুম আর অচৈতন্যের এক বিচিত্র অবস্থায় ডুবে যেতে যেতে হৈ চৈ এর শব্দ পায়। চেপে চোখের পাতা বন্ধ করে ও।
*********************************

বেড়ার অজস্র ফুটো দিয়ে আলোর জাফরি ইতুর মুখে পড়তে ওর ঘুম ভাঙে। আলো ফুটে যাওয়া মানে নাসিমার দিন শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই।ওকে একা রেখে মা ব্যাস্ত হয়ে গেছে প্রতিদিনের মতই। পাশ ফিরতে গিয়ে টের পায় পাশে কেউ একজন।ধাক্কা  দেবার আগে  … নাক টেনে শ্বাস নেয় ইতু।এটা কার গায়ের সৌরভ!! দম বন্ধ করে রাখে।আল্লাহ এটা যেন স্বপ্ন না হয়।
আস্তে আস্তে চোখ খুলে ও। মুখের ওপর কে ঝুকে আছে!ইতুর গলা বন্ধ হয়ে আসে। একটা অস্ফুট চিৎকার ছিটকে পড়ে শুধু……..আব্বা !!
জামিলকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে কাল দাদাভাইয়ের অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল।
জ্বরো তাপে ছোট হয়ে যাওয়া ইতুকে বুকে চেপে ধরে জামিল।
-আম্মি ,আমার আম্মি !! অনেক বড় হয়ে গেছেন!
উঠানে তখন অন্য ব্যাপার। ইতুর বড় ফুপু  চলে যাচ্ছে।ব্যাগ ট্যাগ গুছানো শেষ।ফুপাজান কি নিয়ে যেন গোস্বা হয়েছে।উঠানে বিরক্ত মুখে পায়চারি করছে সে।
দাদাভাই চেয়ারে উদ্বিগ্ন মুখে বসে ।
-বাপজান,আমি অনেক শরমিন্দা।এই বাড়িতে আপনার যত্ন হয় নাই ঠিকমত।
-না না ঐ সব কথা থাক।
-কাইল রাইতে আপনেরে বালিশ কাঁথা ঠিকমতন দেয়া হয় নাই।
-হুহ
-আপনেরে নিজে গিয়া আপনের ছোট শ্যালিকা রশিদার কাছে চাইতে হইছে।
-এই বিষয়ে আর কুনো কথা কইয়েন না।
-আমি খুবি দুঃখিত। আপনে অন্তত বিয়া পর্যন্ত যদি দয়া কইরা থাইকা যান।
-নাহ,সম্ভব না।
কথাবার্তা চলতেই থাকে।

ইঁদারায় বালতি ফেলে পানি ওঠায় রশিদা।
-মুখ ধুয়া নে ইতু।
রশিদার মুখ থমথমে।
-আচ্ছা ফুপু ,তুমি এত সুন্দর কেন !
ইতুর আহ্লাদি কথায় কোন ভাবান্তর হয়না তার।ইঁদারা ঘিরে গোল করে পাকা করা।সেখানে ঝকঝক করছে সকালের রোদ।
রশিদার ফোলা ফোলা চোখেমুখে সে আলো আরো সুন্দর লাগছে।
ইঁদারার পাশে বসেই টের পায় ইতু।বড় ফুপা চলে যাবার মত পাল্টেছে।আব্বার সাথে কথা বলছে এখন।
-আম্মিজান… জামিলের ডাক ভেসে আসে।
-আসি আব্বা।
হিম ঠান্ডা পানিতে ইতু তাড়াতাড়ি ধুয়ে ফেলতে থাকে গতরাতের সব স্মৃতি।

৩১ টি মন্তব্য : “আলোর জাফরি”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ব্লগে স্বাগতম আপা।
    :clap: :clap: :clap:

    নামটা পড়েই কমেন্ট করতে আসলাম।
    আলোর জাফরি নামটা পড়েই মনে হলো কাজ করা রাজবাড়ির বারান্দা। তার ফাক দিয়ে আলো আসছে।
    :boss:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভাগ্যিস সূর্য্য ধনী-গরীব ভেদে আলো দেয় না।
    আর তাই ভাংগা বেড়া দিয়েও আলোর জাফরি আসে।

    অনেক্দিন পর একটা চমৎকার গল্প পড়লাম।
    চমৎকার শব্দটাও কম হয়ে যায়।

    মুশায়রায় বসে জওকের শায়ের শুনে বা গালিবের তেড়িয়া শায়েরি জওয়াব শুনে বাহাদুর শাহ যেমন তারিফ করতেন তেমনি তারিফ পাবার যোগ্য এই গল্পটা।

    এক ফোটা বাড়িয়ে বলছি না।
    অনেকদিন পর কোন গল্প পড়ে সব চরিত্রগুলোকে চোখের সামনে নড়াচড়া করতে দেখ্লাম।
    গরুটাকে দেখ্লাম, হানটারকে দেখ্লাম।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    ব্লগে স্বাগতম আপা। কড়া একটা গল্প পড়লাম, পূর্ন ছোট গল্প। আশা করি নিয়মিত লিখবেন অবশ্যই।


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
  4. সিরাজ(১৯৯১-১৯৯৭)

    ব্লগে স্বাগতম। লেখা নিয়মিত চালিয়ে যান।আশাকরি সিসিবি ব্লগ লেখার অভাবে খালি থাকবে না।


    যুক্তি,সঠিক তথ্য,কমন সেন্স এবং প্রমাণের উপর বিশ্বাস রাখি

    জবাব দিন
  5. তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

    রাজীব,
    ব্লগে প্রথম লিখলাম।
    তোমার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ !
    খুব সুন্দর করে বললে !
    আমি প্রাণিত !


    আমি চোখ মেললুম আকাশে
    জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে

    জবাব দিন
  6. আপা - অনেক অনেক অভিনন্দন!
    আমি ভেবে পাই না, চিনি না - জানি না - একটা মানুষকে ফেসবুকে দেখে মনে হলো, তার লেখার হাত আছে।
    আর আজকে দেখেন, কতজনের কত প্রশংসা।
    প্রথম লেখাতেই বাজিমাত!
    লিখতে থাকেন, পড়তে থাকবো, কথা দিলাম।

    জবাব দিন
  7. সামিউল(২০০৪-১০)

    খুব ভাল লাগলো আপা। পড়তে পড়তেই শেষ হঠাৎ। এই না হলে ছোট গল্প!
    চালিয়ে যান। আরও লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। :boss:


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।