মুক্তিযুদ্ধে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের বীর যোদ্ধারা

[লেখাটির একটি ভূমিকা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইদানিংকালের পড়াশুনায় আমি ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য বদিউল আলমের চরিত্রে আকৃষ্ট হই। একাধিক বই ও সাক্ষাৎকারে তার অবদানের কথা জেনে ফকক’র প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসাবে গর্ব বোধ করি। বদি ভাইকে নিয়ে একটা লেখার তাড়নাও অনুভব করছিলাম গত এক বছর ধরে। এবার ডিসেম্বরে ফৌজদারহাটের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে একটা “মেমোয়ার” সম্পাদনার দায়িত্ব আকষ্মিকভাবেই কাঁধে চাপে। অফিসের কাজের চাপে একটু চিন্তিতই ছিলাম এর ভবিষ্যত নিয়ে। কিন্তু বেশ কয়েকজনের সহায়তায় উৎসবের আগেই এটি প্রকাশ করা গেছে। লেখা সংগ্রহের ব্যাপারে প্রাথমিক এক বৈঠকে মাজেদ ভাই (ওফা কেন্দ্রীয় পর্ষদের মহাসচিব) জানালেন সায়ীদ ভাই মুক্তিযুদ্ধে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের অবদান নিয়ে একটি লেখা দেবেন। সেই থেকে আমি মাজেদ ভাইয়ের পেছনে লেগে ছিলাম লেখাটির জন্য। সায়ীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার এ বিষয়ে একবারও কথা হয়নি। যথাসময়ে লেখাটি পেলাম। পুস্তিকাটির প্রথম লেখা হিসাবে এটি ছাপাও হলো। এক পর্যায়ে মনে হলো এটা সিসিবির সদস্যদের সঙ্গে এটি ভাগাভাগি করে নেওয়া প্রয়োজন। লেখকের অনুমতি ছাড়াই প্রথম দফায় কিছুটা এবং সিসিবিতে দেয়ার আগে দ্বিতীয় দফায় আরো কিছু সম্পাদনা করেছি। শিরোনামটিও বদলে দিয়েছি। আর পুস্তিকায় ছাপা হওয়া এই লেখাটিও ছবি আকারে এখানে জুড়ে দিলাম।

মুক্তিযুদ্ধে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ৮ জন শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আরো অনেকে। তাদের বীরত্বগাঁথা নতুন প্রজন্ম জানে না। এই শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আর অসীম সাহসী অবদানে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে ফৌজদারহাট ছিল অবরুদ্ধ। সেই সময়ের শিক্ষক ও ক্যাডেটদের কাছ থেকে কিছু কাহিনী শুনে শিহরিত হয়েছি। এখন মনে হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ হওয়া দরকার। ফৌজদারহাটের কিছু সাবেক শিক্ষার্থীকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে পেলে ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধে ফৌজদারহাটের অবদান ও কলেজের সেই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে একটা ভালো গবেষণা হতে পারে। লাগুক সময়। আমি এই চেষ্টাটা করে যাবো।]

FCC at Liberation War 1 মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সায়ীদ আহমেদের প্রকাশিত লেখার প্রথম দুই পৃষ্ঠা

FCC at Liberation War 2 মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সায়ীদ আহমেদের প্রকাশিত লেখার শেষ দুই পৃষ্ঠা

মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্যপূরণের অনন্য দৃষ্টান্ত ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ
মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সায়ীদ আহমেদ, বীরপ্রতিক, এডব্লিউসি, পিএসসি

পূর্ব-পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) প্রথম ক্যাডেট কলেজের নাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ। ১৯৫৮ সালের ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে স্থাপিত এ কলেজটির নাম শুরুতে ছিল দি ইস্ট-পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর উন্নত নৈতিকতা; স্থির, কৌশলী ও শক্ত মানসিক শক্তির অধিকারী; লক্ষ্যে অবিচল; শারীরিকভাবে সমর্থ; নেতৃত্বগুণসম্পন্ন; প্রশাসনকে গতিশীল করতে সক্ষম- দেশে এমন তরুণ নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর শিক্ষার্থী ক্যাডেটরা দেশে বিভিন্নক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সমাজে ইতিবাচক অবদান রেখেছেন। এখনও রাখছেন। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ছাত্রআন্দোলন, গণঅভ্যূত্থান এবং ‘৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে এ কলেজের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে এ কলেজের অনেক প্রাক্তন ক্যাডেট ‘নিয়মিত বাহিনী’তে থেকে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। এর বাইরেও অনেকেই স্বতস্ফূর্তভাবে কখনও সম্মুখ সমরে, কখনও মুক্তিযোদ্ধা দলের সহযোগী হিসেবে, কখনও সংগঠক হিসেবে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। এদের অনেকেই তাদের মূল্যবান জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, সর্বস্ব ও স্বজন হারিয়েছেন। এ নিবন্ধে এমনি কয়েকজনের কথা এবং তাঁদের বীরত্বগাঁথা উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে।

Shahid Badiul Alam,BB

শহীদ বদিউল আলম, বীরবিক্রম
সপ্তম ব্যাচের (ক্যাডেট নম্বর ১৬৪) ছাত্র ছিলেন বদিউল আলম। ঢাকার ৫৭, মনিপুরি পাড়ার বাসিন্দা আব্দুল বারী ও রওশন আরা বেগম এর বড় ছেলে ছিলেন তিনি। গল্পের বই পড়ার প্রচন্ড নেশা ছিলো তার। এমনকি পরীক্ষার দিনেও তাকে গল্পের বই পড়তে দেখেছি। এই নেশা অবশ্য পরীক্ষায় তার ভাল ফল অর্জনে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার নম্বরসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কলা বিভাগের মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বদিউল আলম ‘বদি’ নামেই পরিচিত ছিলেন। অবশ্য এ পরিচিতি পূর্ব-পাকিস্তানের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কনভেনশন মুসলিম লীগের অনুসারী ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ)-এর সাথে তাঁর জড়িয়ে পড়ার কারণে। মুক্তিসংগ্রাম শুরুর সাথে সাথেই দেশমায়ের প্রয়োজনে রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলে তিনি ২৮ মার্চ তার নিজ এলাকা ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে চলে যান। উদ্দেশ্য ছিলো- সেখানকার ডাকাতদের সংগঠিত করে তাদের অস্ত্র ও কৌশল ব্যবহার করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। ওই সময়ে গফরগাঁও থানা (যা তার নিজের বাড়ির এলাকা) ‘ডাকাতদের এলাকা’ বলে সাধারণ মানুষের মুখে কুখ্যাত ছিলো।

গফরগাঁওয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সাথে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিনজন ছাত্র মাসুদ ওমর, শহীদুল্লাহ খান বাদল ও আসফাকুস সামাদ (১ম বাংলাদেশ ওয়্যারকোর্সের অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেছিলেন এবং রংপুর জেলার জয়মনিরহাট স্থানে সম্মূখ সমরে ২২ নভেম্বর ১৯৭১ তিনি শাহাদাত বরণ করেন)। বদি ছাড়া বাকিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এবং বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের কথা ভাবতেন।

গফরগাঁও পৌঁছার পর তারা শুনতে পান, ২য় ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে কিশোরগঞ্জ গিয়ে অবস্থান করছে। এ খবর শুনে তারাও কিশোরগঞ্জে চলে যান। সেখানে ২য় ইস্ট-বেঙ্গলের কাছ থেকে চারজনের জন্য চারটি পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল, ৪০ রাউন্ড গুলি ও ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করে পহেলা এপ্রিলেই তারা ঢাকার আর কে মিশন রোডে আসফাকুস সামাদের বাসায় এসে উঠেন। পরে অস্ত্রগুলো তোষকে মুড়ে তাদের ছাত্রবন্ধু তওহিদ সামাদের (চালক) গাড়িতে করে ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডে আরেক বন্ধু ওয়াসেফ-এর বাসায় নিয়ে যান এবং সবার অগোচরে ওই বাসার পেছনে মাটির নিচে অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখেন।

ঢাকা তখন পাক হানাদার বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থায় পাকবাহিনীর জোর টহল, নিরাপত্তা চৌকি ও অতিতৎপর গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে টিকাটুলি থেকে এরকম বড় আকারের এতোগুলো অস্ত্র ধানমন্ডিতে স্থানান্তর সত্যিই ভীষণ দুঃসাহসের কাজ ছিলো। এখন ঠান্ডা মাথায় দেখতে গেলে ভাবি, ওই সময়ে এ কাজটি অনেকটাই নির্বুদ্ধিতার প্রমাণও। তবে একমাত্র মুক্তিপাগল বাংলার দামাল ছেলে বলেই এমন দুঃসাধ্য কাজ তাদের করা সম্ভব হয়েছিল।

বদিউল আলম ও তার সহযোদ্ধাদের এমন দুঃসাহসিকতা এটি একটি সামান্য উদাহরণ মাত্র। এর পরে ঢাকায় বিভিন্ন জটিল, ভয়াবহ, কৌশলী ও দুঃসাহসিক যেসব অপারেশনে বদিউল আলম অংশ নেন তা ছিল একইসাথে বিষ্ময় ও গর্বের। এসব অপারেশনে শুধু পাক-হানাদাররা পর্যুদস্ত ও পরাস্তই হয়নি, মুক্তিপাগল জনতা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা- সবাইকে দেশ মায়ের জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিতে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে। তার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মুখ থেকে শোনা যায়, ‘দেশের জন্য তার কিছু একটা করতে হবে’-এমন চেতনা ও তাড়না তাকে যুদ্ধে অংশ নিতে প্রেরণা যোগায়।

বদিউল আলম ঢাকা শহর ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি দুর্ধষ অপারেশনে অংশ নেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো : ৮ আগস্ট ফার্মগেটে পাক বাহিনীর চেকপোস্ট অপারেশন, ১১ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো, ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের অনেকগুলো পতাকা উড়ানো, ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন, ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। এসব অভিযান এখনও তাদের দুর্ধর্ষতা ও দুঃসাহসিকতার উদাহরণ। এসব অপারেশন মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের প্রামাণিক ও সঠিক বার্তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

এ অপারেশনগুলোতে হাবিবুল আলম বীরপ্রতিক, মোফাজ্জেল হোসেন মায়া বীরবিক্রম, গাজী গোলাম দস্তগীর বীরপ্রতিক, কাজী কামাল উদ্দিন বীরবিক্রম, কামরুল হক (স্বপন) বীরবিক্রম (ফৌজিয়ান), আলম, জিয়া, এএফএম হারিস (ফৌজিয়ান), ইশরাক আহমেদ (ফৌজিয়ান), আজাদ, জুয়েল, রুমি বীরবিক্রম, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, মাহফুজ সাদেক (চুল্লু), সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরী, মোক্তার, বাকী বীরপ্রতিক, তৈয়ব আলী বীরপ্রতিক প্রমূখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এদের মধ্যে বদির পাশাপাশি আজাদ, জুয়েল, রুমি, আলতাফ মাহমুদ আগস্টের একেবারে শেষ সময়ে পাক-বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদত বরণ করেন।

অনন্য এক মা
মধ্য এপ্রিলে আলী আনোয়ারসহ (হেলাল, ফকক ৮ম ব্যাচ) বদিউল আলম কিশোরগঞ্জে তার (বদি) আত্মীয়ের বাড়ি তারাইল থানার জাওয়ার গ্রামে দু’তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। এ সময়েও অদম্য বদিউল ও হেলাল থেমে থাকেননি। সেখানে স্থানীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশনে তারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন এবং রাজাকারদের নিরস্ত্র করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল তারাইল থানা অপারেশন ও অস্ত্র লুট করা। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র শক্তি বাড়ে এবং তারা মানসিকভাবেও ভীষণ অনুপ্রাণিত হন।

এর পরে তারা দুজনে ঢাকার উদ্দেশ্যে বদিউলের নানার বাড়ি পাকুন্দিয়ায় গেলে হেলালকে বদিউলের মা বলেন, ‘তোরা অসংঘবদ্ধ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে যা করছিস এতে একদিন যেখানে সেখানে ঠিকানাবিহীনভাবে তোদের মৃতদেহ পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তোরা যা, যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা কর। এভাবে মোকাবিলা করতে গিয়ে আমার ছেলে যদি মারাও যায়, মা হিসেবে আমি গর্ববোধ করবো।’ এর পরে হেলাল ও বদিউল গফরগাঁও হয়ে ঢাকায় চলে আসেন।

ঢাকায় এসে হেলাল তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। তিনি বদিউল আলমকেও ভারতে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু বদি কোনোভাবেই ভারতে যাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছিলেন না। কেননা, তাতে তার সে সময়কার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা ছিল।

ধানমন্ডির ৭ নম্বর সড়কের পার্কে ২৭ জুলাই বদিউল ও কামরুল হক (স্বপন)-এর সাথে হেলালের দেখা হয়। তখনও বদিউল জানায়, সে কোনোভাবেই ভারতে যেতে রাজি নয়। সে ঢাকায় থেকেই যুদ্ধ করবে। এরপর হেলাল তার মা ও বোনদের নিয়ে মেঘালয়ের তুরা নামক স্থানে চলে যান। সেখানে মা ও অন্যদের রেখে হেলাল যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য যান। প্রশিক্ষণ শেষ করে যুদ্ধে যাবার সময় তিনি মায়ের কাছে গিয়ে দেখেন, এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চিন্তায় তার মায়ের সব চুল সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলেকে যুদ্ধে যেতে বাধা না দিয়ে বরং উৎসাহই দিয়েছিলেন মা।

বদিউল আলমের মা’ও নিশ্চয়ই ছেলের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু আর কোনোদিন বদিউল আলম মায়ের কাছে ফিরতে পারেননি। ছেলে জীবিত না মৃত সে খবরটিও তাঁর জানা হয়নি। জীবনের শেষদিন অবধি ছেলে বদির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।

চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন বদি
মায়ের আদেশ মেনে বদিউল আলম ‘ক্র্যাকপ্লাটুনে’র সদস্য হিসেবে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের এলাকায় একের পর এক দুর্ধর্ষ ও দুঃসাহসিক সফল অপারেশন পরিচালনা করছিলেন।

২৯ আগস্ট ধানমন্ডিতে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিন সাহেবের বাসায় তাঁর ছেলে ফরিদ (এনএসএফ কর্মী), জাফর আহমেদ ও পারভেজ হাসানদের সাথে যথারীতি তাশ খেলছিলেন বদিউল। এখানে বুন্ধুদের সাথে প্রায়শই তিনি তাশ খেলার আড্ডায় বসতেন। তারা যখন খেলায় মত্ত, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাক-বাহিনীর একটি দল হঠাৎ করেই বাড়ি ঘেরাও করে। বদিউল জানালা টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি। পাক-হায়েনারা সেখান থেকে শুধু বদিউলকেই ধরে নিয়ে যায়। এরপরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

শহীদ মুফতি মোহাম্মদ কাসেদ
মেধাবী ক্যাডেট (ফকক ৮ম ব্যাচ: ক্যাডেট নং : ২৮৫) মুফতি মোহাম্মদ কাসেদ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটারমার্কসসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি একজন ভাল দাবাড়ু ছিলেন। পূর্ব-পাকিস্তানে দাবায় তার র‌্যাঙ্কিং ছিল দুই। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, একই সময়ে তিনি অনেকের সাথে দাবা খেলতে পারতেন। একবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছয় জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে একা প্রতিযোগিতায় খেলে তিনি তাদের হারিয়ে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ড. মোতাহার হোসেন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর এমিরেটাস আব্দুর রাজ্জাক প্রায়ই তার সাথে দাবা খেলতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান তিতুমীর হলে মুফতির কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হতেন। এভাবে তাঁরা দাবা খেলার অনুশীলনে সহায়তার সাথে সাথে মুফতিকে উৎসাহ জোগাতেন। তার স্মরণে বুয়েটে এখনও প্রতিবছর আয়োজিত হয়ে আসছে ‘মুফতি মোহাম্মদ কাসেদ দাবা প্রতিযোগিতা’।

‘৬৯-এর ছাত্র ও গণআন্দোলনে তিনি থাকতেন মিছিলের সামনে। ১৯৭১ সালে ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধ করতে তিনি ময়মনসিংহ শহরের তারপাড়া নওমহলসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার উৎসাহী কিছু ছাত্র-যুবকদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। এপ্রিলের প্রথম দিকেই মুফতির নেতৃত্বে দলটি সফলভাবে ময়মনসিংহ পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে বেশকিছু অস্ত্রও সংগ্রহ করে।

ময়মনসিংহের কাওরাইদ স্টেশন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অস্থায়ী ক্যাম্প গঠনের খবর পেয়ে মুফতির দলটি ১৫ জুন রাতে ওই ক্যাম্পের উপর হামলার পরিকল্পনা নেয়। হামলার আকষ্মিকতায় হতচকিত পাকহানাদার বাহিনীর (বাজাউর স্কাউট ও ই.প.সি.এ.ফ.) সদস্যরা পালানোর চেষ্টা করলে মুফতি গুলি করতে করতে তাদের তাড়া করেন। একপর্যায়ে পাল্টা গোলাগুলির মুখে মুফতির পায়ে গুলি লাগে, তিনি মাটিতে পড়ে যান। তার দলটির যথেষ্ট প্রশিক্ষণ ছিল না, তাদের কাছে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গুলি ও সরঞ্জামাদি ছিল না এবং মুফতি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ায় বিচলিত হয়ে পড়েন তার দলের অনভিজ্ঞ আনাড়ি যোদ্ধারা। তাকে সেখানে ফেলে রেখেই দলের অন্যরা কোনোমতে সেখান থেকে সরে আসেন। হানাদার হায়নারা আহত মুফতিকে ধরে নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করেন। এ নির্যাতনে ওই রাতেই তিনি শাহাদৎ বরণ করেন।

সন্তানের মরদেহের সামনে নির্বাক বাবা
মুফতির বাবা মোহাম্মদ ওয়াহেদ, ময়মনসিংহ মিউনিসিপালিটিতে সচিব পদে কর্মরত ছিলেন। ছেলের এ ত্যাগকে তিনি স্বাগতই জানালেন। পরদিন সকালে সনাক্ত করার জন্য মিউনিসিপ্যালিটির সামনে আনা হয়েছিল মুফতির লাশ। সেখানে মুফতির বাবাকে পাকবাহিনীর অধিনায়ক রূঢ়স্বরে জিজ্ঞেস করেছিল ‘এই গাদ্দারকে চেন?’ ক্ষতবিক্ষত অবস্থাতেও ছেলেকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির শঙ্কায়, মুক্তিকামী মুফতির দলের সদস্যদের নামপ্রকাশ হবার ভয় আর যুদ্ধে শত্রুকে সাহায্য না করার প্রত্যয়ে তিনি নির্বাক হয়ে ছিলেন। এই ক্ষত ও যাতনা নিয়েই তিনিও পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

প্রতিবছর ১৫ জুন এলে এবং সময় পেলে এখনও আমরা বন্ধুরা তার বাসায় যাই। মুফতির পরিবারের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর চেষ্টা করি। স্বাধীনতার কিছুদিন পড়ে এমনি একদিন তার বাসায় গেলে আমরা দেখি, মুফতির বাবা মোটা লেন্সের চশমা পড়ে ইজিচেয়ারে আধাশোয়া অবস্থায় ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বইটি পড়ছেন। আমাদের স্বাগত জানাবার সময় জড়িয়ে ধরে কান্নায় কন্ঠরোধ অবস্থায় বলেছিলেন, ‘বাবা, দেশ তো স্বাধীন হলো কিন্তু মধ্যরাত যে এখনও ফুরাচ্ছে না’।

নিয়মিত বাহিনীতে যারা সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন
বদিউল আলম কিংবা মুফতি মোহাম্মদ কাসেদের মতো দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সম্মূখ সমরেই হোক বা যুদ্ধে সহায়ক হিসেবে বিশেষ দৃষ্টান্তমূলক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল এ কলেজের অনেক সাবেক ক্যাডেট। সবার বীরত্বগাঁথা কথা আজ আমাদের জানা নেই। হয়তো এর অনেকটাই আমরা সঠিকভাবে জানতে পারবও না কখনও। তাদের সবাইকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সালাম জানাই।

ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেটদের মধ্যে শহীদ হয়েছেন: শহীদ মেজর মোঃ আব্দুল খালেক (ব্যাচ-০১, কুমিল্লা সেনানিবাসে যুদ্ধের শুরুতে শহীদ হন), শহীদ ক্যাপ্টেন একেএম নুরুল আফসার, (ব্যাচ-০২, মে মাসে রংপুর সেনানিবাসে শাহাদৎ বরণ করেন), শহীদ ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন (ব্যাচ-০৩, কর্ণফুলী পেপার মিলে কর্মরত অবস্থায় ডিসেম্বর মাসে শাহাদৎ বরণ করেন), সেকেন্ড লেফটেনেন্ট মোঃ আনোয়ার হোসেন বীরউত্তম (ব্যাচ-০৭, যশোর সেনানিবাস থেকে ১ম ইস্ট-বেঙ্গল বিদ্রোহ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রিয়ার গার্ড অধিনায়ক হিসেবে বীরোচিতভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদৎ বরণ করেন), শহীদ বদিউল আলম বীরবিক্রম (ব্যাচ-০৭, ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে আগস্ট মাসে শাহাদৎ বরণ করেন), শহীদ ক্যাপ্টেন মোঃ শামসুল হুদা (ব্যাচ-০৭, যুদ্ধক্ষেত্রে রহস্যজনক মৃত্যু), শহীদ মুফতি মোহাম্মদ কাসেদ (ব্যাচ-০৮, ১৫ জুন ময়মনসিংহের কাওরাইদ রেল স্টেশনের কাছে সম্মূখ যুদ্ধে আহত অবস্থায় ধরা পড়ে হানাদার বাহিনীর নিযর্যাতনে শহীদ), শহীদ লেফটেনেন্ট রফিক আহমেদ সরকার (ব্যাচ-১০, রংপুর সেনানিবাসে যুদ্ধের শুরুতে বিদ্রোহের সময় শাহাদৎ বরণ করেন)।

‘নিয়মিত বাহিনী’তে থেকে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অবদান রাখেন : এম আব্দুর রব (ব্যাচ-০২), কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ (ব্যাচ-০২, সচিব পদে অবসর নেন। তিনি যুদ্ধকালীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের গুরু দায়িত্ব পালন করেন), ক্যাপ্টেন আবু তাহের সালাহউদ্দিন (ব্যাচ-০৪, লে. কর্নেল পদে অবসর নেন), এম মুজিবুর রহমান (ব্যাচ-০৪), ক্যাপ্টেন আবু সালেহ মো. নাসিম বীরবিক্রম (ব্যাচ-০৫, সেনাপ্রধান ও লেফটেনেন্ট জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত), জিসি এম রওশন ইয়াজদানী (ব্যাচ-০৬, ক্যাপ্টেন হিসেবে বহিস্কার ও রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার ঘটনায় ফাঁসিতে মৃত্যু), ক্যাপ্টেন এম আশরাফ হোসাইন (ব্যাচ-০৬, মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত), কামরুল হক স্বপন বীরবিক্রম (ব্যাচ-০৭), সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সায়ীদ আহমেদ বীরপ্রতিক (ব্যাচ-০৮, মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত, এই নিবন্ধের লেখক), কিউএম আলী আনোয়ার (ব্যাচ-০৮), ফ্লাইং অফিসার এসএম ইকবাল রশিদ (ব্যাচ-০৮, ফ্লাইট লেফটেনেন্ট অবসরপ্রাপ্ত), লেফটেনেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতিক (ব্যাচ-০৯, মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত), সৈয়দ আব্দুর রশিদ (ব্যাচ-০৯), লেফটেনেন্ট মীর মোখলেসুর রহমান (ব্যাচ-০৯, লেফটেনেন্ট কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত), মো. আজাদুল ইসলাম (ব্যাচ-১০), সেকেন্ড লেফটেনেন্ট কায়সার এম. হামিদুল হক (ব্যাচ-১০), জিসি হুমায়ৃন কবীর বীরপ্রতিক (ব্যাচ-১০, ক্যাপ্টেন অবসরপ্রাপ্ত), লে, ইমামুজ্জামান চৌধুরী বীরবিক্রম (ব্যাচ-১০, মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত), সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হাসমি মোস্তাফা কামাল (ব্যাচ-১০, ক্যাপ্টেন অবসরপ্রাপ্ত), ইশরাক আহমেদ (ব্যাচ-১০), লেফটেনেন্ট কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতিক (ব্যাচ-১০, লেফটেনেন্ট কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত), লেফটেনেন্ট সৈয়দ মুনিবুর রহমান (ব্যাচ-১১, মেজর অবসরপ্রাপ্ত), সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সৈয়দ মিজানুর রহমান (ব্যাচ-১১, মেজর অবসরপ্রাপ্ত), সেকেন্ড লেফটেনেন্ট দীদার আতওয়ার হোসাইন (ব্যাচ-১১, মেজর অবসরপ্রাপ্ত), সেকেন্ড লেফটেনেন্ট শাহরিয়ার হুদা (ব্যাচ-১১, ক্যাপ্টেন), এএফএমএ হারিস (ব্যাচ-১১), আবদুর রহিম (ব্যাচ-১২, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত), আহসান আজিজ (ব্যাচ-১২), মো. ইব্রাহিম আদেল খান (ব্যাচ-১২) এবং বেলাল উদ্দিন (ব্যাচ-১৩)।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ক্যাডেটরা যে অবদান রেখেছে তা একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। আজও বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন এ কলেজে শিক্ষাসমাপনকারী ক্যাডেটরা। এ জয়যাত্রা আরও সমুন্নত হোক।

মুক্তিযুদ্ধে চার ক্যাডেট কলেজের শহীদ বীর যোদ্ধারা
FCC & CC MARTYRS of '71 OK

সৌজন্য : “ফিফটি ইয়ারস অব ক্যাডেট কলেজ এডুকেশন : ফিফটি ইয়ারস অব ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ”; ফৌজদারহাটের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত; ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯

৪৪ টি মন্তব্য : “মুক্তিযুদ্ধে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের বীর যোদ্ধারা”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    অসাধারণ!
    একজন ফৌজিয়ান একজন ক্যাডেট হিসেবে গর্ব হচ্ছে।
    উনাদের সহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের আবারো স্যালুট :salute:

    লাবলু ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটি শেয়ার করার জন্য সিসিবিতে।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
    • সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

      বদি ভাইয়ের চরিত্রটা অসাধারণ। স্বাধীনতার আগে ছাত্র সংগঠন এনএসএফ মানে রীতিমতো মাস্তানদের দল। মোনায়েম খানের সমর্থক। বিশ্ববিদ্যালয়ে আতংক ছড়াতো। সেই এনএসএফের বদি ভাই যখন ২৬ মার্চের পর চীনাপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শহীদুল্লাহ খান বাদলদের (রাশেদ খান মেননের ছোটভাই, নিউ এজ পত্রিকার উদ্যোক্তা) সঙ্গে যোগ দিতে এলেন; সবাই প্রথমে সন্দেহ করেছিল। বদি ভাই নিজের হাত কেটে রক্ত দিয়ে সম্পর্ক করে বলেছিলেন, "ইউ আর ব্লাড ব্রাদার্স.........."


      "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

      জবাব দিন
      • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

        সানা ভাই,
        আমার যতদূর মনে পড়ে হুমায়ুন আহমেদের 'আগুনের পরশমনি' বই এবং চলচ্চিত্র দুটোর নায়ক ক্র্যাক প্লাটুনের অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলমের চরিত্রটি আমাদের এই বদি ভাইয়ের আদলে গড়া হয়েছে।তিনি যেসব অপারেশন করেছেন তার কয়েকটি(চেক পোস্ট ও পাওয়ার স্টেশন আক্রমণ) সিনেমাতে বর্ণিত হয়েছে।

        ক্যাডেট হিসেবে আবারো গর্ববোধ করছি...

        জবাব দিন
          • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

            কি অদ্ভুত ব্যাপার তাইনা?একজন মানুষ দেশের স্বার্থে তার নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনা পুরোপুরি ত্যাগ করে হাত মেলাচ্ছে প্রতিদ্বন্দীদের সাথে,কোনরকম আনুষ্ঠানিক মিলিটারি ট্রেনিং ছাড়াই খোদ রাজধানিতে একের পর এক গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে কাঁপন ধরাচ্ছে একটি নির্মম,খুনে পেশাদার সেনাবাহিনীর বুকে-মাতৃভূমির জন্যে সর্বস্ব ত্যাগ করছে...

            আমার প্রায়ই মনে হয় যে ক্যাডেট কলেজ আমাদেরকে জিবনের প্রয়োজনীয় সব শিক্ষাই দিয়েছে- আজ নিশ্চিত হলাম যে জীবনে চলার পথে যদি একেবারে নিজেদের ঐতিহ্যে বড় হওয়া কোন রোল মডেল বেছে নিতে হয় ,বদি ভাইয়ের মধ্য দিয়ে অসাধারণ ভাবে সাধারণ সেরকম একজনও আমি পেয়ে গেলাম!

            জবাব দিন
              • সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

                মাসরুফ, আমার ধারণা বদি ভাইয়ের রাজনৈতিক চেতনা পাকিস্তানপন্থি ছিলনা। এনএসএফের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন ফৌজিয়ান নাজিম কামরান চৌধুরী। উনি ডাকসুর ভিপিও হয়েছিলেন। নাজিম ভাই পরে সম্ভবত ১৯৬৯ সালের দিকে এনএসএফ ছেড়ে দেন। তিনি অবশ্য একবার বিএনপি থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত দুটি সাধারণ নির্বাচনের আগে তার অসাধারণ বিশ্লেষণ সবার নজর কেড়েছিল। ২০০১ সালে ও ২০০৬ সালে তিনি কিছু জরিপ করে বলেছিলেন যথাক্রমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জিতবে। সেখানে তিনি ভোটের ধরণ, সম্ভাব্য চারদলীয় জোট ও মহাজোট হলে ভোটে কি প্রভাব পড়বে তা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন।

                সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতিতে জড়িত ছিল। এমন কি এনএসএফেও তারা ছিল। সম্ভবত ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্রলীগে ক্যাডেটরা নেতৃত্বে সুবিধা করতে পারছিলেন না। এ কারণে তারা এনএসএফকে বেছে নিয়েছিলেন। তবে এটা আমার ধারণা। বাস্তব সত্যটা নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। নাজিম কামরান চৌধুরীর সঙ্গে একবার বসলে বিষয়টি পরিস্কার হওয়া যাবে। আমারও জানার আগ্রহ, কেন সেই সময় ক্যাডেটরা এনএসএফ করতো?


                "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

                জবাব দিন
  2. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    অনেক ধন্যবাদ লাভলু, সাঈদের লেখাটি এখানে প্রকাশ করার জন্যে। এই লেখাতে উল্লেখিত প্রায় সব ফৌজিয়ানকে তাদের ১২ - ১৮ বছরের চেহারায় চোখ বন্ধ করেও চোখের সামনে দেখতে পারছি - ডাইনিং রুমে, খেলার মাঠে অথবা এ্যাসেমব্লী হলের লাইনে।

    ফৌজিয়ান ছাড়াও মাসুদ ওমর, বাদল, চুল্লু সবাই এক সময়ের কাছের মানুষ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ জটিল। একই বাড়ীতে বাবা শান্তি কমিটির সদস্য এবং ছেলে মুক্তি যোদ্ধা এমন উদাহরন আছে। এখন সময় এসেছে, মুক্তি যুদ্ধের চাক্ষুস সাক্ষী আমাদের এই প্রজন্ম পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে, আমাদের উত্তরসূরীরা যেন মুক্তি যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।

    জবাব দিন
    • সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

      সে জন্যই ই-লাইব্রেরি হচ্ছে সাইফ ভাই। আর ফৌজদারহাটের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা গবেষণা ধরণের কাজ করার ইচ্ছে আছে। এই পর্যন্ত একজন স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। দেখি আর কেউ রাজি হয় কিনা। অন্ততঃ ৫/৬ জনের একটা দল হলে আশা করি একটা ভালো কাজ করা যাবে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৩৮ বছর আগে। তখন যে ১৪ বছরের বালক যুদ্ধে গিয়েছিল তার বয়সও এখন ৫২। তবে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে। অর্ধেক যোদ্ধাও বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ। তাই যা করার এখনই শুরু করতে হবে।

      আমি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে আপনার মতো আশাবাদী। ওরা শেষ পর্যন্ত দেশটাকে গুছিয়ে ফেলবে। আর ১০/১৫টা বছর হয়তো লাগবে। লাগুক।


      "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

      জবাব দিন
    • রায়হান রশিদ (৮৬ - ৯০)
      এখন সময় এসেছে, মুক্তি যুদ্ধের চাক্ষুস সাক্ষী আমাদের এই প্রজন্ম পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে, আমাদের উত্তরসূরীরা যেন মুক্তি যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।

      প্রিয় সাইফ ভাই,
      একদম আমাদের সবার মনের কথা। আপনার সাথে পুরোপুরি একমত যে এই প্রজন্মের মানুষগুলোর সাথে হারিয়ে যাবে আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে উজ্জ্বল অধ্যায়ের গল্পকে হার মানানো গল্পগুলো। অন্য আর দশটা জরুরী কাজের পাশাপাশি এই কাজেও আসলেই সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন আমাদের সবার। এই সুযোগে আবারও আপনাকে WCSF এর Collective Memory Project এর প্রস্তাবটা সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে রাখছি। আপনার হয়তো মনে আছে, বেশ কিছু দিন আগে এই বিষয়টি নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা হয়েছিল, আপনার একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখাকে কেন্দ্র করে।

      জবাব দিন
  3. রাব্বী (৯২-৯৮)

    এনএসএফ - সম্পর্কে খুব বেশি ভাল কিছু শুনিনি সানাভাই। তারা নাকি পকেটে সাপ নিয়ে ঘুরতো, সারাক্ষন হুমকি-ধামকি দিতো। আবার এটাও শুনেছি, বাংলাদেশ পরবর্তীকালে তারাই বরং অন্যদের চেয়ে ভাল কাজ করেছে - এটা অবশ্য ষাটের দশকের ছাত্রইউনিয়ন নেত্রীর মুখেই শোনা। নাজিম কামরান চৌধুরী এনএসএফ করতেন জানতাম, কিন্তু শহীদ বদিউল আলম যে ফৌজিয়ান ছিলেন এবং এনএসএফ করতেন এটা জানতাম না। শুধু তার দুঃসাহসী গেরিলা পরিচয় জানতাম। গর্ব ও শ্রদ্ধা জানিয়ে গেলাম।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
  4. রায়হান রশিদ (৮৬ - ৯০)

    সানা ভাইয়ের প্রতি স্যালুট দারুণ এই লেখাটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। এমন উদাহরণ সামনে থাকতে উদ্দীপনার জন্য আমাদের আর অন্য কোথাও যাবার দরকার পড়বে না মনে হয়।

    এনএসএফ এর ব্যাপারটাও আরেকটু জানতে হবে। তখনকার সেই আগুন ঝরা সময়েও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রশাসনের লেজুড় এমন প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনের সাথে কেন কোনো বুদ্ধিমান দেশপ্রেমী ছাত্র যুক্ত হবে সেটা খুঁজে বের করা দরকার। অনেকেই মনে করেন পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদ ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাসের চর্চা এনে একে কলুষিত করার যে পদ্ধতি বেছে নেয়, সেটার ঐতিহাসিক inspiration এই এনএসএফ থেকে নেয়া।

    পূনশ্চ: শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর "একাত্তরের দিনগুলি" বইতে আরও তথ্য পাওয়া যাবে। বইটার একটা ইংরেজী অনুবাদও হয়েছে বলে জানি।

    জবাব দিন
  5. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    :salute: :salute: :salute: :salute:

    শহীদ ক্যাপ্টেন একেএম নুরুল আফসার, (ব্যাচ-০২, মে মাসে রংপুর সেনানিবাসে শাহাদৎ বরণ করেন)

    শহীদ ক্যাপ্টেন একেএম নুরুল আফসার'কে নিয়ে ছোট্ট করে একটা লেখা দেয়ার ইচ্ছা রইল।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  6. ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

    অসাধারণ লেখা সানাউল্লাহ ভাই। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। যারা সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহন করে গাজী হয়েছেন তাদের স্যলুট।
    যারা সেদিন নিজের দেশ ও জাতির সাথে বেঈমানী করে দখলদারদের সহযোগিতা করেছিল তাদের প্রতি ছুড়ে দিচ্ছি একরাশ ঘৃণা।

    বদি ভাই, মুফতি কাসেদ ভাই ও আনোয়ার ভাইয়ের কথা স্যারদের মুখে শুনেছিলাম। বাকীদের কথা আজ শুনলাম। আপনাকে ধন্যবাদ।

    জবাব দিন
  7. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)
    সেকেন্ড লেফটেনেন্ট মোঃ আনোয়ার হোসেন বীরউত্তম (ব্যাচ-০৭, যশোর সেনানিবাস থেকে ১ম ইস্ট-বেঙ্গল বিদ্রোহ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রিয়ার গার্ড অধিনায়ক হিসেবে বীরোচিতভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদৎ বরণ করেন)

    ইনি আমার সেকেন্ড কাজিন হন। উনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। এই যেমন অন্য সৈন্যদের জীবন রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন। পুরোপুরি যুদ্ধারত অবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেন। একজন আদর্শ সৈনিকের জীবন। উনার নামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শহীদ আনোয়ার নামে একটি স্কুল আছে। ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার আগে আমি ঐ স্কুলে পড়তাম।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।