বাঁচুক সবাই মানুষ হয়ে

সদরঘাট,ঢাকা

সকালে ঘুম থেকে জেগেই কোন কাজ না করার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলল মহসিন। আশে পাশে কেউ নেই,আগোছালো কাঁথা,বালিশ স্তূপ হয়ে রয়েছে। মহসিনের পাশে যারা ঘুমায় তারা বেশিরভাগই রিক্সা চালায়,সাত সকালে উঠেই কাজে চলে যায়। ঢাকা শহরে মনে হয় কম খরচে এর থেকে ভালো ঘুমানোর ব্যবস্থা আর নেই। বুড়িগঙ্গা নদীর উপর কাঠের লম্বা ঘর,উপরে টিনের চালা,রাত প্রতি ২০ টাকা,কাঁথা বালিশ বিছানোই থাকে,টাকা দিয়ে ঢুকে শুয়ে পড়লেই হয়। তবে মালিক গত মাসে বলে গিয়েছে আগামী মাস থেকে ৩০ টাকা রেট। আপাতত এ নিয়ে ভাবছে না মহসিন।

মোট তিন রকমের কাজ করে মহসিন,সপ্তাহে তিন দিন ময়লার গাড়ি নিয়ে ময়লা সংগ্রহ করে বাড়ি বাড়ি,বাকি তিন দিন ভ্যানে সবজি বিক্রেতা কমলের সাথে সবজি বিক্রি করে,আর বাকি একদিন কিছুই করে না,ঘুরে বেড়ায়। ইচ্ছে হলে রাতে রাতে স্বর্ণকারদের দোকানের পাশের ড্রেন থেকে ময়লা তুলে এনে পানিতে পরিষ্কার করে। মাঝে মাঝে সেই ময়লার মাঝেও মেলে এক দুই দানা সোনা, দিনে সেই একদানা সোনা আবার স্বর্ণকারদের কাছেই বিক্রি করে। তবে রাতে সোনার দানা পাবার সম্ভবনা খুব কম থাকে,কারন দোকানের ময়লা ফেলা হয় বিকেলে,সন্ধ্যার পর ময়লা ফেললে নাকি অমঙ্গল হয় ব্যবসার। যেদিন এক দুই দানা সোনা মেলে সেদিন একটু ভালো যায় মহসিনের,২০০-৩০০ কাঁচা টাকা আসে পকেটে,সেই সব দিন গুলোতে সিনেমা দেখতে যায় মহসিন,সন্ধ্যার শো। সিনেমা দেখে বের হয়ে একটা কুলফি মালাইও খায়। মালাই চাটতে চাটতে লোকাল বাসে করে ফিরে আসে বুড়িগঙ্গার পাড়ে।

তবে কয়লা দিয়ে ভালো ছবি আঁকতে পারে মহসিন,খয়েরি রঙের কাগজের উপর একবার একটা ছবি একেছিল সে,প্রিয় নায়িকা শাবনুরের ছবি। সেই ছবি লুকিয়ে রেখেছিল বেগুনের ঝুড়ির নীচে। বেগুন কিনতে এসে এক রমণী সেই ছবি দেখে ফেলে,বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে হয় মহসিনের যে ছবিটি তারই আঁকা

আসমানী- এই ছেলে,এই ছবি তুমি এঁকেছ?
মহসিন- জি আফা।
– তুমি সবসময় ছবি আঁক?
– জি না আফা।
– একটা ছবি দিলে দেখে আঁকতে পারবে?
– কার ছবি আফা?
– আমার একজন প্রিয় মানুষের।
– পারমু আফা।

আসমানী তাকে সুদর্শন এক রমনের ছবি ধরিয়ে দিল। সাথে দিল ৩৫০ টাকা। ছবি আঁকতে হবে কাপড়ের উপর,যেই সেই কাপড় না,মোটা কাপড়ের উপরে। এই ছবি প্রিয় মানুষকে উপহার দেবে আসমানী। মোটা কাপড় কিনে বুড়িগঙ্গার সেই চালা ঘরে ছবি আঁকতে বসেছিল মহসিন। রাতে তাকে ঘিরে ভিড় জমে গিয়েছিল,একজন এক কাপ চাও এনে দিয়েছিল,কয়েকজন বিড়ি নিয়ে বসে গিয়েছিল গল্প করতে, একজন বলেছিল একটা ন্যাংটা মেয়ের ছবি আঁকতে,বাকিরা তাতে সায়ও দিয়েছিল।

তিনদিন পর ছবি নিয়ে গিয়েছিল মহসিন। ছবি আর কাপড় কেনার পর বাকি ৯০ টাকা ফেরত দিয়েছিল আসমানীকে। আসমানী মিষ্টি হেসে তাকে আরো ২০০ টাকা ধরিয়ে দিয়েছে উপহার হিসাবে। সেদিন শাকিব খান-অপু বিশ্বাস এর একটা ছবি দেখেছিল মহসিন,ছবির পর এক হোটেলে ঢুকেছিল নান রুটি আর সবজি খেতে,হোটেল থেকে বের করে দিয়েছিল মহসিনকে,ময়লা কাপড়ে নাকি এসব জায়গায় ঢোকা যায়না।

পড়াশুনা করতে পারেনি সেই অর্থে মহসিন, সিডরে সব ভেসে যাবার পর ভাগ্য ফেরানোর লক্ষ্য নিয়ে ঢাকায় এসেছিল,ভাগ্য তো ফেরেনি,বেড়েছে দুর্দশা,কখনও এক পেট খেয়েছিল,কখনও আধাপেটা,পার্কে ঘুমিয়েছে,রেল স্টেশনে,হিরোইন খোর সন্দেহে একবার জেলেও ছিল একরাত। জীবন যেখানে যেমন। তবে আক্ষেপ নেই মহসিনের। সবাই যদি গাড়ি ঘোড়া চড়তে শুরু করে,সবাই যদি শিক্ষিত হয়ে যায়,সবাই যদি ভদ্দরলোক হয়ে যায় তখন তো আর দুনিয়া চলবে না। তাছাড়া সবাই ভদ্দরলোক নাকি,ভদ্দরলোক নামী বহু খারাপ মানুষও আছে,শার্ট প্যান্ট পরা অনেকেই তো সদরঘাট আসে হেরোইন কিনতে,কত বিবাহিত ভদ্দরলোকের আছে আলু-পিয়াজের দোষ। এর থেকে মহসিনের ময়লা মাখানো জীবনটা বহু ভালো আছে। ময়লার মধ্যে থেকেও,ময়লা ঘেটেও মনটা রেখেছে পরিষ্কার। আলু-পিয়াজের দোষও নেই,নেই কোন মাদকাসক্তি।

শার্ট চাপিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এল মহসিন। রাস্তার কলের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিল,বড় রাস্তায় উঠে বাম দিকের বাড়িতে একটা প্লাকার্ড দেখতে পেল মহসিন,সেখানে লেখা “ আজ শুভর জন্মদিন” নিজের জন্মদিন কবে মনে করতে পারলো না মহসিন,স্কুলে ভর্তি হবার সময় মাস্টার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল “ মহসিনের জন্ম তারিখ কবে?”
মা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন “ মাস্টার সাব,তারিখ তো মনে নাই,তয় তালের সময় হইছিল মহসিন”
মাস্টার বাধ্য হয়ে মনমতো একটা জন্মতারিখ বসিয়ে দিয়েছিলেন। ঝামেলার কথা হোল সেই মনগড়া তারিখটাও মহসিনের মনে নেই। হুট করে আরো একটা সিধান্ত নিয়ে নিল মহসিন,আজই তার জন্মদিন। আজই সে পালন করবে জন্মদিন।

মোড়ের হোটেলে ঢুকেই,সুপ,পরাটা আর চায়ের অর্ডার করল মহসিন,জন্মদিনে ভালো মন্দ না খেলে উপরঅলাও রাগ করবেন। খাওয়া শেষ করে পাশের স্টেশনারী দোকানে ঢুকলো
– ভাই কেক আছে?
– কেমন কেক?
– গায়ে মেখে গোসল করার কেক
– ফাইজলামী করিস?
– তাইলে কেক আবার কেমন হয়? খাওয়ারই তো হয় নাকি?
-কয় পিস?
– এক পিস
– ১০ টাকা দে।

কেক মুখে দিয়ে নিজের জন্মদিন পালন করল মহসিন,বিচ্ছিরি কেক,সস্তার তিন অবস্থা,চিনি আর ডালডা, দুনিয়াটা ভেজালে ভরে গেল ভাবতে ভাবতে কেক ছুঁড়ে ফেলে দেয় মহসিন। জন্মদিনে যদি একটুকরো কেকই না খাওয়া গেল।

একটা ফোন ফ্লেক্সীলোড এর দোকানে ঢোকে মহসিন,কাউকে ফোন করে জেনে নিতে হবে কোথায় আছে ভালো কেক,একপিস কেক না খেলেই নয়।
ফোন সামনে নিয়ে বসে আছে এক তালপাতার সেপাই,এর মধ্যে আবার সে খানদাণী গোফ রেখেছে,দেখেই হাসি পেয়ে গেল মহসিনের।
– একটা ফোন করবার চাই।
– কাকে?
– আপনার বউরে
– বেয়াদ্দপের বাচ্চা,থাপড়াইয়া কানসা লাল করে দিমু।
– আপনেই তো জিজ্ঞাসা করলেন,আপনার কি দরকার আমি কারে ফোন করি? কথা কমু পয়সা দিমু।
– নে ফকিরনীর বাচ্চা

মোবাইলটা বেশ বাহারী। উপরে আবার প্লাসটিকের কাভার লাগানো। কাভারটা এই মোটা, যেন মোবাইলের গায়েও রাশিয়ার বরফ ঠাণ্ডা লাগে। মোবাইলের গায়ে আবার শেকল বাধা,শেকলের আরেক মাথা বাধা দোকানদারের টেবিলের সাথে। কিন্তু এখন ঝামেলা হোল,কারো মোবাইল নাম্বারই সে জানে না। কাকে ফোন করবে সে মহসিন? মনে পড়ল আসমানী তাকে একটা কাগজে করে নাম্বার দিয়েছিল,মানিব্যাগ হাতড়ে কাগজটা বের করল,নাম্বার লিখে ফোন করল
– হ্যালো
– হ্যালো আফা সালাম
– কে বলছেন?
– আফা আমি মহসিন
– সবজি মহসিন?
– জি আফা
-কেমন আছো? কোথা থেকে ফোন করেছ?
– আফা সদর ঘাট, আমি এইখানেই থাকি।
– আমাদের এখানে কবে আসবে সবজি বেচতে?
– পরশু,আফা আজকে আমার জন্মদিন,এক পিস কেক খাইতে ইচ্ছে করতেছে,কম দামে কই পামু?
– ওমা,তাই নাকি? তুমি চলে এসো আমাদের এলাকায়,এখানে এসে ফোন দাও,আমি নিয়ে যাবো তোমাকে দোকানে,আজকে আমি তোমাকে খাওয়াবো।
– না থাক,আফা,ঝামেলা করনের দরকার নাই,আমি খুজে নিবনে। আপনি খালি বলেন
– আরে ধুর চলে আসো। আমি বলেছি না আসতে।
– আচ্ছা ঠিকাছে আফা
– কিন্তু কিভাবে আসবে? আজকে তো হরতাল।
– কি যে বলেন আফা,এইডা কোন ঘটনা? আমি একটা ব্যবস্থা করে চলে আসবো।
– আচ্ছা তাহলে।

ফোনের বিল মিটিয়ে বের হয়ে আসে মহসিন,একটা রিক্সা করে লালবাগ এর মোড়ে এসে নামলো। এখান থেকে অন্য রিক্সা নিতে হবে,রাস্তা ঘাট একদম ফাঁকা, রিক্সা ছাড়া আর কোন যানবাহন নেই। হাঁটতে হাঁটতে রিক্সা খোজার সিধান্ত নেয় মহসিন।

সামনে মিছিল দেখা যাচ্ছে, রাস্তার একদম পাশ ঘেঁটে হাটতে থাকে মহসিন,মিছিলের ক্যাচালে পড়বার কোন ইচ্ছা তার নাই, বিপরীত দিকে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েছে,মিছিলের মধ্যে বিদ্রোহের দানা গুটি বাধলো,উৎসাহী কয়েকজন পিছনে টায়ারে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়েছে,একদম বলা নেই কওয়া নেই কয়েকজন ইট ছুড়তে লাগলো,পুলিশ প্রথমে কাদুনে গ্যাসের শেল ছুড়ল,শেল ফাটলো মহসিনের ঠিক পাশে,প্রচণ্ড ধোয়াতে চোখ জ্বলতে লাগলো মহসিনের,এর পর রাবার বুলেট,ছিঁড়ে যেতে চাইল মহসিনের পা, ঝাপসা ধোঁয়াতে কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারল না মহসিন,তবে অনুভব করল গরম পানির স্রোত বইছে পা থেকে নীচে।

শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো মহসিনের,কিন্তু না এখানেই যদি থেমে যায় মহসিন,হাজারো পায়ের নীচে চাপা পরে মৃত্যু হবে মহসিনের। আহত পা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেল মহসিন,সেখানে দুটো দোকান দেখা যাচ্ছে। দুটো দোকানের ফাঁকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল মহসিন। একটু জিরিয়ে নিয়ে সামনে বাড়তে হবে,ধরা পরা যাবে না পুলিশের হাতে,ধরা পড়লে জেলে চালান করে দেবে,বলবে এরাই মিছিল থেকে বোমা ফাটিয়েছে।
সব কিছু ভেঙে পড়তে থাকে মহসিনের,চোখের সামনে ভেসে ওঠে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া সিডর এর পানির তোড়,কানে আসতে থাকে আসমানী এর গলা, নাহ জ্ঞান হারানো চলবে না,কিছুতেই না।

এই বাংলাদেশে মহসিনদের কেউ উদ্ধার করে না,কেউ চিকিৎসা করায় না,কেউ বিশ্বাস করে না। মহসিনদের দল নেই,জাত নেই,পাত নেই তবু মহসিনেরা জেলে চালান হয় স্রোতের মতো,মহসিনদের উদ্ধার করার কেউ নেই।
মহসিনদের উকিল নেই,ক্ষমতা নেই,গদিতে বসার আকাঙ্খা নেই,পয়সা নেই,পয়সার কামনা নেই তবু কেন যেন এই বাংলাদেশে মহসিনেরা ভোগে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ,উলুখাগড়ার প্রানান্ত।

শার্ট ছিঁড়ে পা বেঁধে ফেলে মহসিন,এইতো একটু ভালো লাগছে তার। সামনের দিকে এগিয়ে চলে মহসিন। কে জানে তার মতো আরো কত মহসিন চলছে হাতড়ে হাতড়ে,বেঁচে থাকতে,একটু ভালো থাকতে,ভাগ্য ফেরাতে।

(লেখাটি র‍্যাবের অত্যাচারে নির্মমভাবে পা হারানো লিমনকে উৎসর্গ করছি,লিমনের মতো কেউ অমানবতার ছাপ না বয়ে চলুক। সবাই বাঁচুক মানুষ হয়ে, মানুষের মতো। )

২,৫৯০ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “বাঁচুক সবাই মানুষ হয়ে”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    :clap: :clap: :clap: :teacup:
    খুবই ভালো হইছে।
    সাধু সাধু।
    লিমন রে নিয়া আমিও মর্মাহত।
    বিশেষ বাহিনী কি কইতে চাইতেছে তাই বুঝি না।
    ওইদিন এক বন্ধু কইলো, লিমন নাকি সন্ত্রাসী।
    দিনে দিনে অবস্থা যা হইতেছে তাতে মনে হয়
    আমিও সন্ত্রাসী। :ahem:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    খুব ভাল লাগল। আমার খুব কাছের এক বন্ধু কিছু দিন আগে মতিঝিল এলাকায় পরীক্ষা শেষে বাসায় ফেরার পথে মিছিল আর পুলিশের মাঝে পড়ে দুই দিন শ্রীঘরে কাটিয়ে আসল। পরে আবশ্য ছাড়া পেয়েছে। হামীম তোমার লেখা পড়ে মনে হল আসলেই আমারা ঠিক ই বন্ধুকে জামিনে ছাড়িয়ে এনেছি কিন্তু লিমন দের কে ছাড়াবে??????


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
  3. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    লেখকের সার্থকতা গল্প ফুটিয়ে তোলার মাঝে। আর পাঠকের সার্থকতা সেই গল্পের মাঝে ডুবে যাবার মাঝে। মহসিনের থাকার ঘর, স্বর্ণকারের দোকানের পেছনের ড্রেন, পাড়ার মোরের হোটেল, ফ্লেক্সির দোকান, ফেরীকরে বেচা সবজীর টুকরীর নিচে কয়লা দিয়ে আঁকা শাবনূরের ছবি, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট, গলগলিয়ে ঝরতে থাকা রক্ত সবকিছুর মাঝেই ঘুরে এলাম।

    এজন্য ধন্যবাদ! :hatsoff: :hatsoff:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।