আবারো লিখতে বসা।গভীর বোধ আবেগ আর অনুভূতি যখন একই ধারায় এসে মিলিত হয় তখন আমার ভেতরে প্রচন্ড লেখালেখির চাপ জাগে।কোন ভাবেই নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারিনা।ইদানিং খুব বেশি স্মৃতি কাতরতায় ভুগছি।জীবনের গভীর শূন্যতায় প্রিয় মুখখুলো যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন ফেরারী অশ্রুর শেষ বিন্দুটিও বেদনা জাগিয়ে যায়।
সপ্তম শ্রেনীর কোন এক দুঃসহ রাতের কথা।প্রচন্ড ক্ষিদে আর তৃষ্ণায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছি।একশো তিন ডিগ্রী জ্বরে বারো বছরের একটি ছেলে নাকাল হয়ে পরে আছে।নিজেকে হঠাত্ করে খুব অসহায় মনে হল।ছোট বেলার কথা মনে পরে গেল।জ্বর হলে মা সাড়ারাত মাথার কাছে বসে থাকতেন।ভাত খেতে পারতামনা বলে আউশ চালের ঝাউ রেঁধে দিতেন।ক্যাডেট কলেজের নিয়মতান্ত্রিক জীবনে গভীর ভাবে অনুভব করলাম মায়ের শুন্যতা।কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে বিছানা থেকে উঠলাম।রাতে ডিনারের জন্য ক্যাডেট কলেজের গতানুগতিক ম্যানু।হঠাত্ করে অনুভব করলাম চোখের পাতা অকারনে ভিজে যাচ্ছে।খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিছানায় শুতে যাচ্ছি এমন সময় কে যেন ডাকলো।এই ক্যাডেট খাবেননা?
পেছনে তাকিয়ে দেখি ডাইনিং হলের বাটলার নাসির ভাই।আমি কিছুটা ভয় জড়ানো কন্ঠে বললাম খেতে ভালো লাগছেনা।মুখ তেতো হয়ে গেছে।প্লিজ নাসির ভাই আপনি কাউকে বলবেননা।ক্লাস সেভেনের বয়সটা এমন ছিল যে হাউস বেয়ারাকে দেখলেও ভয় লাগতো।নাসির ভাই গম্ভীর গলায় বললেন ‘এখানে যদি আপনি না খান তবে কেউ জোরাজুরি করবেনা। তবে শরীরের দুর্বলতা কাটাতে খেতে হবে। আমি নাসির ভাইয়ের দিকে তাকালাম। মোটামুটি বয়স্ক লোক। চেহারায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। আমি বললাম নাসির ভাই কলেজের খাবার ভালো লাগেনা। আগে জ্বর হল আম্মা আউশ চাল দিয়ে পায়েশ কিংবা ঝাউ রেধেঁ দিতেন। কথাটা বলার পরে হঠাত্ লক্ষ করলাম চোখ থেকে টপাটপ পানি পড়ছে।
পরের দিনের কথা।জ্বর তখনো একশ এর ঘরে।হাসপাতালের বিছানায় উপুর হয়ে আছি।হঠাত্ দেখি নাসির ভাই।আমাকে বললেন একটু বাইরে শুনে যানতো।বাইরে গেলাম।নাসির ভাই তার সাদা ইউনিফর্ম এর ভেতর থেকে কি যেন বের করলেন।আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন এই বাটিটা নিয়ে ভেতরে যান।তাড়াতাড়ি করুন।কেউ দেখে ফেললে বিপদ।
বাটিটা নিয়ে হাসপাতালের ডাইনিংয়ে গেলাম।আনন্দে চোখে পানি চলে আসল।দেখি বাটির একপাশে পায়েশ তার ওপড় কয়েকটা পিঠা।গোগ্রাসে খেয়ে ফেললাম।ভাবলাম এই জিনিসটা আমার জন্যে আনতে তাকে কতটা মেহনত করতে হয়েছে।
পরের বছরের কথা।আমি তখন ক্লাস এইটে।মোটামুটি একটু ভাব নিয়ে চলতে শুরু করেছি।টেবিলে কারনে আকারনে জুনিয়রের ফল্ট ধরি।একদিন ব্রেক ফাস্টের কথা।দিনটি ছিল শনিবার।চিরাচরিয়ত নিয়ম অনুযায়ী ম্যানু ছিল ব্রেড বাটার জেলি।ক্যাডেট দের কাছে একপ্রকার অখাদ্য।ইতোমধ্যে সিনিয়রদের কিছু অভিনব পন্থাও আয়ত্ত করে ফেলেছি।তখন নিয়ম ছিল কেউ খাবার নষ্ট করলে তার নাম নোট হত।এবং যথার্থ জরিমানা এবং পানিশমেন্ট খেতে হত।সিনিয়ররা তাই ব্রেড পকেটে নিয়ে একাডেমির টয়লেটে ফেলে দিতেন।আমিও মোটামুটি তাই করতাম।কিন্তু সমস্যা হল সেদিন কী মনে করে adjutant স্যার এলেন।আমার প্লেটের ওপর তখন একটা ব্রেড।বাকী দুটো পকেটে।স্যার ডাইনিংয়ে ঢুকে সরাসরি আমাদের টেবিলের দিকে আসা শুরু করলেন।খাওয়া তখনো শুরু হয়নি।স্যার এসে আমাকে বললেন ‘হোয়ার ইজ ইউর ব্রেড?
আমার মুখখানা শুকিয়ে গেল।কাঁচুমাচুঁ করে বললাম ‘শর্ট স্যার. . .
স্যার কিছু না বলে মেস ও আই সি কে বললেন ‘কল বাটলার. . . .
নাসির ভাই দৌড়ে এলেন।আমার প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ওর ব্রেড কোথায়?ক্যাডেট কলেজে ঘাস কাটতে এসেছো?স্যার নাসির ভাইর কলার ধরে ধাক্কা দিলেন।অসহায় নাসির ভাই শুধু মাথা নিচু করে বললেন ‘সরি স্যার. . . . .
এরপর নাসির ভাইকে প্রায়ই এড়িয়ে চলতাম।ভীষন ছোট মনে হত নিজেকে।এক ধরনের লজ্জাবোধ থেকে জন্ম নিল তার প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধা।এর দু বছর পরের কথা।এস এস সি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।প্রথম দিন।কলেজের ট্রেডিশান অনুযায়ী সব স্যারদের কাছে বললাম।সবাই যখন পরীক্ষার হলে ঢুকবে আমি তখন দেখলাম দূরে নাসির ভাই দাঁড়িয়ে আছে।একবার ভাবলাম তার কাছে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করি।বয়সে যদিও সে আমার বাবার বয়সী।কিন্তু দ্বিধা সংশয় আর সামাজিক সংকীর্নতাকে এড়াতে পারলাম না।তার সাথে চোখাচুখি হলে চোখ নামিয়ে ফেললাম।
এস এস সি ভ্যাকেশনের মাঝামাঝি সময় প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পরলাম।আবার সেই জ্বর একশোর ঘরে।বিছানায় বসে সেদিন গভীর ভাবে মনে পরল সপ্তম শ্রেনীর কথা।সাথে নাসির ভাইয়ের মুখটি।কিছুদিন পর এস এস সির রেজাল্ট দিল।গোল্ডেন এ প্লাস পেলাম।ভাবলাম এবার কলেজে গিয়ে নাসির ভাইয়ের পা ছুঁয়ে সালাম করবো।
ক্লাস ইলেভেন হিসেবে কলেজে যোগদান করলাম জুনের পনের তারিখ।কলেজে ঢুকে বেশ আনন্দ নিয়ে ডাইনিংয়ে গেলাম নাসির ভাই এর সাথে দেখা করতে।পথে হক ভাইকে বললাম নাসির ভাইকে কোথায় পাবো?
হক ভাই অবাক বিষ্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘কেন তুমি জানোনা নাসির ভাইতো গত মাসে ক্যান্সারে মারা গেছেন?
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।হাউসে এসে খুব কাঁদলাম।খুব।আমার কান্না দেখে আমার সবচেয়ে পুরনো রুমমেট তানভীর বলল ধূর বোকা। ইলেভেনে এসে কেউ ক্লাস সেভেনের মত কাঁদে. . . . . . .
কিছু লেখা পড়বার পর থম মেরে বসে থাকতে হয়, কিছু বলবার থাকে না। ভালো থাকুন নাসির ভাই, এটুকুই কামনা।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
রাকিব ভাই অসেশ ভালবাশা..................।
প্রতিটি কলেজের বাটলার, বেয়ারা, বয়, পিওন এবং গার্ডরা ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সবাই ক্যাডেটদের ভীষণ ভালোবাসেন। তাদের সঙ্গে দারুণ একটা সখ্য গড়ে ওঠে।
জুনিয়র রাব্বী, লেখাটা ভালো হয়েছে। নাসির ভাইয়ের জন্য ভালোবাসা, শ্রদ্ধা।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
🙂
তোমার লেখা পড়ে আমার চোখেও পানি এসে গেল। ক্যাডেট কলেজে আমাদের বেড়ে ওঠায় স্যারদের পাশাপাশি বেয়ারা, বয়, পিওন এবং গার্ডদেরও অবদান আছে। ক্যাডেট কলেজের পরিবেশটা সুন্দর, চমৎকার একটা পারিবারিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। নাসির ভাইয়ের জন্য ভালোবাসা।
ঐ মিয়া তুমি খালি মন খারাপ করা পোস্ট দাও। তবে বেশ ভালো লিখতে পারো।
আমি ঠিক নাসিরভাই-এর কথা মনে করতে পারছি না। স্মৃতিশক্তি বড়ই দুব্বল। নাসির ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
🙂 🙂
অবাক করলি মহিউদ্দিন। আমার তো এখনো সবার কথা খেয়াল আছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
এ লেখাটা যেদিন পোস্ট করেছিলে সেদিনই পড়েছিলাম, কিন্তু কেন জানি কিছু বলে উঠতে পারিনি সেই মুহুর্তে। আসলে বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলামনা।
আমাদের সময়েও হাউসে নাসির ভাই নামে একজন বেয়ারা ছিলেন, ফাস্টবোলার এ্যামব্রোসের সাথে প্রচুর মিল ছিলো চেহারায়। আমাদের এত স্নেহ করতেন, দুষ্টামি করলে মাঝে মাঝে প্রচণ্ড বকাঝকাও করতেন, অথচ আমরা কেউ মাইন্ড করতামনা। উনি এ্যাপয়েন্টমেন্টধারীদেরকেও পাত্তা দিতেননা, গণহারে বকতেন। কোনদিন হাউস অথোরিটিকে লাগাননি ক্যাডেটদের নামে। আমাদের বেড়ে ওঠার পেছনে এঁদের অবদান কত, অথচ সেভাবে মূল্যায়ন তো করলামনা।
কিছুদিন আগে নুরুল হক স্যার (এফসিসি তে পেয়েছিলাম, এখানকার অনেকেই চিনবেন স্যারকে)-এর ফেসবুক পেজে দেখলাম মেস বেয়ারাদের ছবি দিয়েছেন, তাঁদের কথা বলেছেন। এত ভালো লাগলো।
তোমার লেখায় এঁদের সস্নেহে ক্যাডেটদের আগলে রাখার কাহিনীটি হৃদয় ছুঁয়ে গেলো।
:thumbup:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
🙂 🙂
আমাদের সময় মেসের সবাই খুব ভাল ছিল।
একমাত্র সাদা আলম ঝামেলা করত।
পরে তারেও টাইট দেওয়া হয়।
সবার কথাই মনে পড়ে।
কবে যে রি ইউনিয়নে কলেজে যাবো?
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
কোন ছাগল তখন তোদের অ্যাডজুটান্ট ছিলো?
নাজমুল বর্ণিত সেই খাটাশটা কি?
আমাদের সময়ে তো ভালো ব্রেড দিতো।
যদিও ৯০-৯১ ে অত ভালো ছিলো না।
আমি তো ব্রেক ফাস্টে ১০ টা ব্রেড খাইতাম।
আমার ৪টা। আর আমাদের ক্লাসের অন্য হাউসের দুইজন ব্রেড খাইতে পারতো না। ওরা নিজেরা ১টা কইরা খাইয়া আমারে ৩+৩ দিয়া দিতো। আমি বেয়ারারে দিয়া বড় কেটলি চা আইনা নিতাম। আর কাপে ধাইলা রুটি ভিজাইয়া ভিজাইয়া খাইতাম।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
নুরুল আলম স্যার ছিলেন
নাসির ভাইয়ের মৃত্যুটি আসলেই অনেক কষ্টদায়ক ছিল। তবে ভালো লেগেছিলো যে উনি যখন অসুস্থ্য ছিলেন, তখন কলেজের অনেক এক্স-ক্যাডেট-ই ওনার পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন।
ওনার মৃত্যুর পর ওনার ছেলের চাকুরীর জন্য চেষ্টা করেছিলাম পাবনা ক্যাডেট কলেজে, কিন্তু পারিনি। যাহোক, অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে সিলেট ক্যাডেট কলেজে ছেলেটির চাকুরী হয়েছে।
রাব্বী, তোমার লেখাটি পড়ে চোখ দু'টি ভিজে গেছে। নাসির ভাইকে ভীষন মনে পড়ছে। ওনার সাথে আমার বেশ কিছু ঘটনার স্মৃতি আছে।
আল্লাহ এই ভালো মানুষটিকে জান্নাতবাসী করুক।
ভাইয়া ধন্নবাদ......।