৭১ এর জেনোসাইড (নিক্সন-কিসিঞ্জার)

বটমলেস বাকেট অর্থাৎ তলাবিহীন ঝুড়ি খ্যাত হেনরি কিসিঞ্জারের সেই বিখ্যাত উক্তি কম বেশি আমরা সবাই শুনেছি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুদের কথা(তালিকা দেবার প্রয়োজন বোধ করছি না) আমরা সব সময় হৃদয়ে রাখবো। কিন্তু একজন বিদেশী যুদ্ধাপরাধীর কথা না বলে আর পারছি না, মানবতা পায়ে ঠেলার মতো উপমা শুনেছি,হেনরি কিসিঞ্জারের কথা জেনে উদাহরণ জানার বিলাসিতাও হয়েছে।

ব্যবচ্ছেদ করলে একটা সহজ সমীকরণে আসা যায় খুব সহজে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো ছিল,ভারত,তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ব্রিটেন। আর ঘোরতর বিরোধী ছিল যুক্তরাষ্ট্র,চীন এবং সৌদি আরব। ইতিহাস এবং দলিল এদের প্রমাণ দেবে।

আমেরিকার কেন্দ্রীয় প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই পাকিস্তানের সপক্ষে তার নীতি ঘোষণা করে। তারা গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। তারা দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা অগণতান্ত্রিক শক্তির সপক্ষে। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড এম. নিক্সন এবং হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন নিক্সনের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি, যিনি তখন আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রেসিডেন্টের একান্ত সহকারী।

এই নিক্সন-কিসিঞ্জার নিয়ন্ত্রিত মার্কিন নীতিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা পাকিস্তানের এমন একটি অত্যাচারী সরকারের সপক্ষে দাঁড়াল যে সরকার তার পূর্বাঞ্চলের নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের পক্ষে নিক্সন-কিসিঞ্জারের প্রকাশ্য সমর্থন কিংবা পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়া নীতি অনুসরণ নিছক পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা ছিল না। তখনকার মার্কিন প্রশাসনের নীতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়, যা ঐ ঝুঁকে পড়ার সীমা ছাড়িয়ে যায়। বলা যায়, প্রায় অনেকটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তথা পাকিস্তানের সপক্ষে আমেরিকার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কিংবা মদদদান। আমেরিকা ঐ অবস্থান গ্রহণ করার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে পাকিস্তানকে সামরিক ও নৈতিক সমর্থন জানায়।

পাকিস্তানের পক্ষে নিক্সন প্রশাসনের ঝুঁকে পড়ার নীতির এক বলিষ্ঠ প্রয়োগকারী ব্যক্তি হচ্ছেন- হেনরি কিসিঞ্জার, যিনি তখন বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী ও পারদর্শী। কিসিঞ্জার তাঁর নিজের উচ্চতর ক্ষমতা ও যোগ্যতার অধিকারী হয়ে এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সমীকরণের বলে তিনি এমনই একজন শক্তিশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন যার ফলে তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি প্রণয়নের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আবির্ভূত হন।

নিক্সন-কিসিঞ্জার ছিলেন একাত্তর সালের বাংলাদেশ বিষয়ে আমেরিকার নীতি নির্ধারণে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত দুজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁরা গোপনে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যুদ্ধের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারাই ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর আমেরিকার সপ্তম নৌ-বহর বঙ্গোপসাগরে মোতায়েনের নির্দেশ দেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে সর্বোচ্চ ভীতিপ্রদান এবং পূর্ববাংলা থেকে সরে আসতে পাকিস্তান যেন কিছু সময় পায়।

এ ছাড়াও ব্লাড টেলিগ্রাম এর কথা বলতে হয়। আর্চার কেন্ট ব্লাড একজন মার্কিন নাগরিক যিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেমে মার্কিন কনসাল জেনারেল হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন দিয়েছলেন। নিক্সন-কিসিঞ্জারের পাকিস্তানপন্থী অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তাকেঁ “বাংলাদেশের যুদ্ধবিবেক” হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সর্বপ্রথম তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে, পূর্ব পাকিস্তানস্থ মার্কিন দূতাবাসে পলিটিক্যাল কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়ে। আর্চার ব্লাড তাঁর দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ বইয়ের সূচনায় লেখেন, ‘একাত্তর নিয়ে লিখতে বসে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। কারণ আমার বহু বন্ধুর মুখ ভেসে উঠছে, যারা শহীদ হয়েছে।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা শুরু করে। ৬ এপ্রিল ১৯৭১ ঐতিহাসিক মার্কিন দূতাবাস থেকে একটি তারবার্তা পাঠানো হয়েছিল ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে। ঢাকায় কর্মরত মার্কিন কর্মকর্তারা ২৫ শে মার্চের ‘কলঙ্কিত রাতের’ গণহত্যা এবং সে বিষয়ে নিক্সন-কিসিঞ্জারের অন্ধ ইয়াহিয়া-ঘেঁষা নীতির প্রতিবাদ জানাতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন।

তাঁরা খুব ভেবেচিন্তে একটি তারবার্তা লিখেছিলেন যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন ব্লাড ও তাঁর ২০ জন সমর্থক সহকর্মী। তাঁরা তাতে ঢাকায় ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত নীরবতার নিন্দা করেছিলেন। ব্লাড তাতে কেবল স্বাক্ষরই দেন নি, বাড়তি এক ব্যক্তিগত নোটও লিখেছিলেন। এতে তিনি রিখেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে সংগ্রাম চলছে, তার সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিণতি হলো বাঙালিদের বিজয় এবং এর পরিণতিতে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।“ এই ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ বস্তুত তখনকার নিক্সন-কিসিঞ্জারের দুর্গে বোমা ফেলেছিল। ‘’দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’’ নামীয় গ্রন্থের লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স মতে ‘মার্কিন ইতিহাসে ব্লাড টেলিগ্রামের কোনো তুলনা নেই।’ কিসিঞ্জার এ জন্য ব্লাডকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন।

ক্রিস্টফার হিচেন্স তার দি ট্রায়াল অফ হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ের একটি পর্বে বাংলাদেশ,৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিবর্তী কিসিঞ্জারের ভূমিকা সম্পর্কে লেখেন।
আর একটি কথা না বললেই নয়,কিসিঞ্জার শুধু বাংলাদেশ জেনোসাইড নয়, পৃথিবীর আরও বেশ কয়েকটি দেশের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে তার যোগ থাকার বিষয় নিশ্চিত করা হয়।

হিচেন্স এর বইটির যে পর্বে বাংলাদেশ কথা ও কিসিঞ্জারের কথা উল্লেখ রয়েছে সে পর্বটি অনুবাদ করছি।
অনুচ্ছেদ- বাংলাদেশ

পৃষ্ঠা-৪৪

১৯৭১ সাল গণহত্যা শব্দটি বিশ্বের দরবারে খুব পরিচিত করে তোলে!! ততকালীন সময়ে পাকিস্তানের ‘বাঙ্গালী’ জনগোষ্ঠির, তথা বাংলাদেশীদের পক্ষে ইউনাইটেড স্টেট কনসিউলেট তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি বার্তা পাঠায়। বার্তাটি পাঠানো হয় ৬ এপ্রিল ১৯৭১, যেখানে প্রধান স্বাক্ষরকারী ছিলেন তৎকালীন ঢাকার কনাস্যিউল জেনারেল আর্চার ব্লাড। অন্য অর্থে এটাকে হয়ত ব্লাড টেলিগ্রামও বলা যেতে পারে! মার্গেন্থাসের বিবরনী থেকে ভিন্ন এই বার্তাটি সরাসরি ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়, যেখানে গনহত্যার বিষদ বর্ণনার চেয়ে গণহত্যা সম্পর্কে আমেরিকার সরকারের ভূমিকা নিয়ে বেশি সমালোচনা করা হয়। এর মূল বক্তব্য ছিলঃ
‘আমাদের সরকার গণতন্ত্র বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সরকার সাধারণ জনগনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিম পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রন করতে , এমনকি বিশ্বের দরবারে তাদের আসল রূপ প্রকাশেও তারা সক্ষম হয়নি যা কিনা অন্যান্য দেশের সাথে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের সাক্ষী আমাদের সরকার, আর হাস্যকরভাবে ঠিক একই সময় তারা গনতনত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠায়, যেখানে পূর্ব পাকিস্থানের প্রবল জনপ্রিয় এবং সংখ্যা গরিষ্ঠ ভাবে বিজয়ী নেতাকে আটকের প্রতিবাদ করা হয়। সেই সাথে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধের আহবানও জানান হয়……… কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা নিরব দর্শকের ভূমিকা নেই- এমনকি মানবিক দিক থেকেও। এটি একটি দেশের অভ্যন্তরীন বিষয় বলে আমরা স্রেফ মুখ বুজে রইলাম যা একসময় গনহত্যায় রূপ নিল! সাধারন আমেরিকানরা এখন এর প্রতিবাদ করছে, সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে আমরাও সরকারের এই নিরবতাকে সমর্থন করি না, বরং আশা করছি সরকার এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রেখে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।‘
এই বার্তাটিতে তৎকালীন বাংলাদেশে বসবাসরত বিশ জন আমেরিকান কূটনৈতিকের সাক্ষর করেন, পরবর্তীতে স্টেট ডিপার্টমেন্টে আসার পর আরো নয় জন কর্মকর্তা এতে একাত্নতা প্রকাশ করে সাক্ষর করেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আমাদের স্বাধিনতার স্বপক্ষে এটাই সবচেয়ে জননন্দিত এবং শক্তিশালী বক্তব্য ছিল।
২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তৎকালীন রাজধানী ঢাকা আক্রমন করে,এবং শেখ মুজিবর রহমান কে অপহরন করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুজিব অনুসারি এবং সাধারন জনতাকে লক্ষ্যহীন করা। সমস্ত বিদেশী মিডিয়াকে ঢাকা থেকে জোর পূর্বক বের করে দেয়া হয়,ততকালীন ম্যাসাকারের সরাসরি প্রমান পাওয়া যাবে,মার্কিন রেডিও থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারকৃত বার্তা সমুহে। আর্চার ব্লাড নিজে সরাসরি একটি বার্তা তখন কিসিঞ্জারের অধিকৃত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে পাঠান।
সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা তখন সাধারন মানুষের বাড়িতে আগুন দেয়া শুরু করে,এবং মানুষগুলোকে গুলি করে হত্যা করে।( এই বন্দুকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক এসিসটান্ট প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত ছিল)
এই সময় লন্ডন টাইমস এবং সানডে টাইমস যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে,এন্থনি মাসকারহেনাস এর সেই প্রতিবেদন গুলো তারা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য প্রচার করে কালো রাতের মুখোশ উম্মোচন করে। খুন,ধর্ষণ,এবং সাধারন মানুষের উপর অত্যাচারের সেই রিপোর্টগুলো মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। শিশু ও নারী হত্যা করে সেনাবাহিনী তখন সাধারন মানুষকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
প্রথম ৩ দিনে ১০ হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা যায়,পরের কয়েকদিনের হিসাবে যা মিলিওন এর হিসাবে গিয়ে ঠেকে।
সকল হিন্দু ধর্মালম্বী জনগন তখন বাস করছিলেন একটি নারকীয় পৃথিবীতে।
প্রায় ১০ মিলিওন উদ্বাস্তু মানুষ তখন ভারত সীমানা পথে যাত্রা শুরু করে।
পুরো জেনসাইড কে তিনটি পয়েন্টে বর্ণনা করা যায়
১) সাধারন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জটিলতার অবতারনা।
২) পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে একটি আগ্রাসি সিধান্তের উদাহরন।
৩) সল্প সময়ের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক ক্রাইসীস সৃষ্টি।
নিউ দিল্লিতে অবস্থান রত তৎকালীন মার্কিন কূটনিতিক কেনেথ কেটিং বাংলাদেশের সাধারন মানুষের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি ছিলেন সাবেক নিউ ইয়র্ক সিনেটর, তিনি ২৯ মার্চ মার্কিন প্রশাসনকে বলেন “ “promptly, publicly, and prominently deplore this brutality” এছাড়াও তিনি এই বর্বর অপারেশন অবিলম্বে বন্ধ করতে প্রশাসনকে সতর্ক করে দেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন “ “prior to inevitable and imminent emergence of horrible truths.”

নিক্সন ও কিসিঞ্জার এই বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেন,আর্চার ব্লাডকে তার পদ ঠেকে অব্যাহতি দেয়া হয়,আর কেটিং কে বলা হয় যাতে তিনি তার ভারত ঘেঁষা আচরন শুধরে নেন। তাকে সরাসরি বলা হয় “taken over by the Indians.”

এপ্রিল মাসের শেষ দিকে,ঠিক যখন গনহত্যার হার সব ঠেকে উচু,হেনরি কিসিঞ্জার ইয়াহিয়া খানকে একটি বার্তা পাঠান,যেখানে কিসিঞ্জার ইয়াহিয়াকে তার সময়োপযোগী সাহসী সিধান্ত ও কূটনীতির ভূয়সী প্রশংসা করেন।

নিক্সন- কিসিঞ্জারের এই পাকিস্তান প্রশাসন ঘেঁষা মনোভাব,ও সেনাবাহিনীর যুদ্ধ অপরাধ সমর্থনের কারণ খুজতে গেলে আরও একটি বিষয় উঠে আসে।
কেন নিক্সন- কিসিঞ্জার জেনারেল ইয়াহিয়াকে সমর্থন জানিয়েছিল?
এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টেবিল টেনিস দলকে চীনের বেইজিং এ একটি ট্যুরনামেন্ট খেলতে আমন্ত্রন জানানো হয়,মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করা হয় পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূতকে। এবং সেই রাষ্ট্রদূত টেবিল টেনিস খেলার আমন্ত্রন পত্রের সাথে চীন প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য একটি নৌ বহর পাঠানোর সুপারিশ নিয়ে আসেন। নিক্সন- কিসিঞ্জার আন্তর্জাতিক রাজনীতির দখল নিতে মিত্র পক্ষের সমর্থন পাবার নিমিত্তে,লাখ লাখ মৃত্যুগামী জনগণকে জেনে শুনে আগুনে ফেলেছেন,নীরবে সমর্থন দিয়ে গেছেন সেই সেনাবাহিনীর অপারেশনকে। কি নির্মম,বর্বর ক্ষমতালোভী দুজন রাজনীতিবিদ।

পৃষ্ঠা – ৫০

যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে তার বিতর্কিত ভুমিকা নিয়ে কিসিঞ্জারকে সাংবাদিকদের বেশকিছু বিব্রতকর এবং বিদ্রুপাত্মক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল,যা তার আনন্দঘন চীন ভ্রমনের অনেকটাই ম্লান করে দেয়।তিনি বাংলাদেশের জনগণ এবং নেতাদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন,এবং শেখ মুজিবকে তিনি(তার তৎকালীন সহকারী রজার মরিস এর ভাষ্যমতে) Salvador Allende এর সাথে তুলনা করেন।

১৯৭৩ সালে কিসিঞ্জার সেক্রেটারি অব স্টেট হওয়া মাত্রই,গনহত্যার প্রতিবাদে যোগদানকারী প্রত্যেকেই তার তীব্র রোষের সম্মুখীন হয়।

১৯৭৪ এর নভেম্বরে কিসিঞ্জার একটি সংক্ষিপ্ত এবং দায়সারা উপমহাদেশ সফরকালে বাংলাদেশে আটঘন্টার একটি যাত্রাবিরতি নেন,এবং তিন মিনিটের একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন। সেখানে ১৯৭১ সালে বঙ্গোপসাগরে তিনি কেন নৌ-বহর পাঠিয়েছিলেন জানতে চাওয়া হলে,তিনি উত্তর দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন।তার ফিরে যাবার তিন সপ্তাহের মধ্যে, এখন আমরা জানি,ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একাংশ বাংলাদেশি সামরিক কর্মকর্তাদের একটি দলের সাথে গোপন সাক্ষাৎ শুরু করে,যারা মুজিবের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল। ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট,মুজিব এবং তার পরিবারের ৪০ জন সদস্য একটি সামরিক হামলায় নিহত হন।এর কয়েকমাস পরে,তার কিছু নিকটতম রাজনৈতিক সহকর্মীদেরও কারাবন্দী অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

( লেখাটি পূর্বে মুক্তমনায় প্রকাশিত এবং বইয়ের চুম্বক অংশগুলো নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পেজে একটি পোস্ট প্রকাশিত)

৩৮,০৬৬ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “৭১ এর জেনোসাইড (নিক্সন-কিসিঞ্জার)”

  1. রেজা শাওন (০১-০৭)

    লেখাটা পড়েই বোঝা যায়, অনেক পরিশ্রম আছে এই লেখাটার পেছনে।

    সাধুবাদ নিও হামিম। আর চমৎকার এই কাজগুলো চালু রেখো।

    কিসিঞ্জার স্লা টা একটা হ্রামি ছিল।
    জবাব দিন
    • মানুষ এতো নিষ্ঠুর হতে পারে? এই দুইটা চশমখোর এর কারণে ততকালিন পাকিস্তান সরকার অনেক বড় সাহস পেয়েছিল যার কারণে বাংলাদেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে যা আজও অপূরণীয়। যারা এই ধরণের ন্যাক্কারজনক কাজে নিয়োজিত হয় তারা মানব জাতির কলঙ্ক।
      ### সব দিক বিবেচনায় লেখাটা অনেক অর্থপূর্ণ হয়েছে। অনেক কিছু জানলাম যা অজানা ছিল। ধন্যবাদ এত সুন্দর লেখাল জন্য।

      জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    চমৎকার কাজ । অনেক কিছুই জানা ছিল না। জানা হয়ে গেলো।
    কিসিঞ্জারের নামটা এখনও আমাদের মানুষের কথার মাঝে ঢুকে আছে। কোন ধূর্ত কিংবা ধান্ধাবাজি চিন্তাকে এখনও অনেকেই কিসিঞ্জারি বুদ্ধি বলে হেনরি কিসিঞ্জারকে রেখে্ দিয়েছে একজন ধিকৃত চরিত্র হিসাবে।

    চমৎকার পোস্টের জন্য অভিনন্দন।

    ভালো থেকো।

    জবাব দিন
  3. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    হামীম, :clap: :clap: :clap:
    ভাল লাগল পড়ে। অনেক কিছু জানলাম। যদিও কিছুদিন আগে আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের অবদান নিয়ে একটা লিখতে যেয়ে একবার এই বিষয়টা নিয়ে লিখবো ভেবেছিলাম কিন্তু কামটা তুমি করলে বলে থাঙ্কু।এমনিতেই ক্যাডেট মানুষ সুযোগ পেলেই ফাঁকি মারতে পছন্দ করি। হাতের কাছেই ফলপেলে কোন শালায় খাটে। আবারও বলি দারুণ লেখা।


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।