কোথায় লুকাবো….. আমি

সাধারণত নতুন কারোর সাথে পরিচয়ে- আমি হাতটা বাড়িয়ে দেই নিজের নামটা বলার বা পরিচয় দেয়ার জন্য কিন্তু যার মাধ্যমে বা যে ব্যক্তি/বন্ধু আমাকে নিয়ে এসেছে তারা পরিচয় করিয়ে দেয়-
: আমার বন্ধু …………। ওই যে বিডিআর বিদ্রোহতে অল্প কয়েকজন …… বেঁচে গিয়েছিল তাদের মধ্যে ও একজন
মেজাজটা খারাপ কার উপর করব। কতবার বলেছি আমি আমার পরিচয়ের সাথে এই বিশেষ তকমা ব্যবহার না করতে। কাকে বুঝাব আমি যে, নিজেকে নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই, পরিচয় পর্বের এই বিশেষ তকমা হতে। কিন্তু কেন জানি না যত দিন যাচ্ছে ততই যেন মানুষের কাছে আমার নিজের পরিচয়ের একটা অংশ হয়ে উঠছে “এই বিশেষ ব্যাপারটা” । বেশ কিছুদিন যাবত নতুন কোন জায়গাতে কোন বন্ধুর সাথে গেলেই চিরাচরিত আমি “এই বিশেষ” কথা গুলোর মুখোমুখি হচ্ছি।
আর যারা জানে যে আমি এই বিশেষণের তকমার বিষয়টা পছন্দ করি না। তখন দেখি কথার মাঝে কোন এক সময় নতুন পরিচিত হতে আসার কাছে কানে কানে এমন ভাবে বলছে যেন আমি না শুনি বা বুঝি। কিন্তু তাদের চোখ ও মুখের অভিব্যক্তি বলে দেয় কি বিষয়ে কথা বলছে।
আমার “এই বিশেষ” পরিচয় সম্পর্কে উন্মোচন করার কি কারণ হতে পারে? হয়ত এই সকল বন্ধুদের কাছে গর্ব(??) করার বিষয় আমার এক বন্ধু জীবিত আছে, না কি আমি কতটুকু কাছের বন্ধু তা নতুন মানুষদের বোঝানো? না কি এই দেখ একজন জলজ্যান্ত ঘটনার লোক এনেছি বলে নিজেকে জাহির করা? আমি প্রায় সময় কম বেশি সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছি- কেন এই বিশেষ ঘটনা আর আমার পরিচয় এক সাথে করে? কিন্তু কোন সদুত্তর মেলেনি। আমি এই ধরনের পরিচয়ে নিজেকে সংকীর্ণ, লজ্জাবোধ এবং নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। সেই সাথে নতুন পরিচিতদের মুখ ও চোখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি অবলোকন করার চেষ্টা করি।
কোথাও কোথাও দেখেছি যেন করুণার দৃষ্টি না কি সহানুভূতির দৃষ্টি? এই করুণা বা সহানুভূতি দৃষ্টির মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য আছে কি? আমার ঠিক জানা নাই তবে আমার কাছে এই দুই দৃষ্টি একই রকম মনে হয়।
কোথাও কোথাও এমন ভাবে দেখে যেন চিড়িয়াখানা হতে নতুন কোন চিড়িয়া আনা হয়েছে?
আবার কোথাও কোথাও এমন ভাবে বড় বড় চোখ করে তাকায় যেন আমি কি ভাবে কেমন করে নতুন জীবন পেলাম?–আমার মুখ হতে যেন সিনেমার বাকি অংশটুকু শোনার অপেক্ষায়।
কোথাও কোথাও হাসি তামাশার ছলে আমার মাথায় বা হাত নিয়ে নিজেদের মাথা বা হাত ঘষে এই ভেবে যেন তারাও আমার মত এই রকম ভাগ্যবান কিংবা নিজেরা দীর্ঘায়ু হতে পারে।
একজন মানুষ যে কোন কাজে বা কোন কিছুর জন্য নতুন জায়গা বা মানুষদের সাথে পরিচিত হতে আসে। কিন্তু সব থেকে অসহ্য ও বাজে লাগে যখন তাদের সব কথা বার্তা শুরু- ওই সময় কেন্দ্রিক আর সেই সাথে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। যেন এই দেশে বা বিশ্বে আমার এই বিষয়ে ছাড়া আর কারোর কোন কাজ বা কথা বার্তা নাই। অনেক সময় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছ থেকে শুনি আর মুখটা না পেরে হাসিহাসি করে রাখি। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ শুধু বন্ধুর দিকে থাকিয়ে চুপচাপ থাকা। কত সময় আর এই ধরনের যত সব আজগুবি,হাবিজাবি কথা বার্তা শুনতে ভালো লাগে। এক সময় মুখ খারাপ করে বলেই উঠি ” ভাই/তোদের কি এই বিষয় ছাড়া আর কোন কিছুই নাই। আমাকে দেখলেই আর সেই সাথে এই বিশেষ ধরনের পরিচয় পেলেই সবার মধ্যে কি সুড়সুড় করে উঠে এই একটা বিষয়ে কথা বলতে।”
প্রতিটা মানুষ চায় তার নিজস্ব সত্তা নিয়ে বাঁচতে কিন্তু আমাদের সমাজ বা আশে পাশের মানুষ চাইলেও তা বুঝে না, নাকি না বুঝে পরিচয়ের এই নিজস্ব সত্তার থেকেও মুখরোচক সত্তাকে প্রাধান্য দেয় আর আসল সত্তাকে গ্রহণ করতে পারে না। আমার একটা নাম আছে,,আমার একটা পদবী আছে, আমার ফ্যামিলির হেরিটেজ আছে, আমার জন্মস্থান বা বর্তমান বসবাস আছে, আমার পড়াশুনা আছে এমন অনেক কিছুই আছে তা নিয়ে পরিচয় না করিয়ে যে অংশটুকু আমার নিজস্ব, অতীব নিজের যা আমি প্রতিটি সময়, ক্ষণ হতে দূরে রাখতে চায়। এমন কি আমি সর্বদা প্রার্থনা করি আমার জীবনের সকল ধরনের চলাফেরা ছাড়াও অনেক কিছুই সময়ের সাথে সাথে আমি ভুলে যাই এমনিতেই “এই বিশেষ স্মৃতি”। কিন্তু মনের চাওয়া আর বাস্তবতার মাঝে অনেক ফারাক। আর তাই সেটা প্রায় আমাকে বিভিন্ন পরিবেশে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মারফতে তা খুঁচে বের করে মনে করিয়ে দেই এই বেঁচে থাকা আর না থাকার মাঝে “জিন্দা-লাশ” হয়ে থাকার পার্থক্য।
কখনও কি এই সকল মানুষজন বোঝার চেষ্টাও করে না। আমিও একজন রক্তে মাংসে গড়া মানুষ আর দশ জনের মত।
“এই বিশেষ” পরিচয়ে যে, আমার ভিতরে ভিতরে তখন যে রক্ত ক্ষরণ চলে তা কেউ দেখতে পাই না। আমার হৃদয়ের মাঝে যে বোবা কান্নার অনুরণনের উত্তাল ঢেউ উঠে তা কেউ দেখতে পায় না। আমার কষ্টের আস্ফালনের ঝড়ে বেড়ে যায় শ্বাস প্রশ্বাস, অক্সিজেনের অভাবে বোধ হয়ে বেড়ে যাই আমার বুকের উঠা নামা তাও কেউ দেখতে পায় না।
আমার ব্যর্থতা, আমি পারিনি আমার এই স্মৃতিকে সাদা কাফনের কাপড় পড়িয়ে চির নিদ্রায় শুয়াতে,
আমি মনে করেছি এই সব ভুলে যাব সময়ের সাথে সাথে কিন্তু এই পরিচয় পর্ব কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন মানুষের ফোন করে শুকরিয়া আদায় করে আবার সেই সাথে কেউ কেউ যখন বলে
Hello Dear! How long you wanted to be raped! Have some fresh air!!
চুপচাপ শুনি আর বলি “এই জন্মই আমার আজন্ম পাপ” ফোনের দুই প্রান্ত হতে দুজনে হেসে থেমে যাই কিন্তু আমি থেকে যাই আজন্ম পাপের ব্যবচ্ছেদ করতে। সেই সাথে সাথে পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া যেন চেপে ধরে এই পাথর সম স্মৃতিকে নতুন করে লেপাই করে আমার সম্মুখে তুলে ধরতে। আর আমি একা সবার অলক্ষ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদি বুকের কষ্টটাকে কিছুটা লাঘব করতে।
আমি পার্থিব আর অপার্থিব জীবনের মোহে বাঁধা পরে আছি কোন আঁধার সীমান্তে, শত চেষ্টা করেও পারি নাই এই অজানা সীমান্ত ভেঙ্গে নিজেকে অন্য কোথাও লুকাতে। কতবার নিজেকে নিজে চেষ্টা করছি “ডুব” দিতে বা লুকাতে।
কোথায় লুকবো বা ডুব দিব আমি?
আমাকে কেউ কি দিতে পারবে এমন কোন জায়গার সন্ধান?
যে জায়গা গেলে আমাকে আর “এই বিশেষ” পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে না। উৎসুক লোকদের চোখে দেখব না করুণা বা সহানুভূতি। আমাকে হতে হবে না বিভিন্ন প্রশ্নে জর্জরিত। আমি নিশ্চিন্ত মনে পারব ঘুমাতে। হঠাৎ ঘুমের মাঝে কোন ভয়ংকর স্বপ্ন করবে না তাড়া আমাকে। ঘুমের মাঝে কিংবা একা একা শুয়ে ভিজবে না মাথার বালিশ। কানের ভিতর ভো ভো করে বাজবে না ওই সকল নিষ্পাপ বাচ্চা আর বয়স্ক মানুষদের আহাজারি। বিকট টায়ার ফাটার বা অন্য কোন শব্দে বুকের মাঝে ধড়ফড় করবে না গ্রেনেড বা গুলির আওয়াজ মনে করে। এমন কোন জায়গা কি আছে?

একই পথের সহযোদ্ধা হয়ে চলেছি অনেক পথ কিন্তু এই সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে সব ধরনের আশা আর আলোর পথ চেয়ে থেকে থেকে যে নিষ্ফল আবেদন পেয়েছি আর দেখছি। সে কথা ভুলে গিয়ে আমি নিজে পারফিউম, বাহারি লেবাস, চোখে রঙ্গিন চশমা লাগিয়ে, আর কথায় ঠাট-বাট নিয়ে চেয়েছি ফেলে আসা সাথীদের সাথে চলতে। কিন্তু তবুও পারিনি সেই ক্ষতকে হৃদয় হতে তাড়াতে। সেই আমি আজ কেন অন্য কারোর জন্য আর আশায় বুক না বেধে নিজেই নিজে খুঁজে বের করি আমার লুকানোর বা ডুব দেয়ার জায়গা।

আমি জানি, আমি পেয়েছি আমার লুকানোর একমাত্র জায়গার সন্ধান-
শুভ্র সাদা কাপড়ে শায়িত সাড়ে তিন হাত নির্জন মাটির ঘর।
আমার লুকানোর একমাত্র জায়গা। আর তখনি থেমে যাবে সব ধরনের বিশেষণে ভরা আমার এই বিশেষ পরিচয়ের সত্তা।
আর আমি ফিরে পাব অনেক আকাঙ্ক্ষিত নিজ পরিচয়ে পরিচিত সত্তা!!!

তারিখ-২৪ শে ফেব্রু.-১৭

৫,৬১২ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “কোথায় লুকাবো….. আমি”

  1. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    মোকা, বন্ধু তোর উপলব্ধিগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেস্টা করলাম। তোর অনুভূতিগুলো সবাই শ্রদ্ধার সাথে মনে প্রানে গ্রহন করুক সেই কামনায়। ভাল থাকিস।

    জবাব দিন
  2. আমাদের সমাজের নিয়মটাই হলো.. রক্তাত্ত কোনকিছু কে খুঁচিয়ে আরো রক্তাত্ত করা... প্রিয়জন কারো মৃত্যু হলে আমরা যখন নিরবে নিভৃতে তাকে নিয়ে থাকতে চাই.. ঠিক সেই মুহুর্তে সবাই এসে নাকি কান্না শুরু করবে, ইনিয়ে বিনিয়ে বলা শুরু করবে নানা কথা... তখন শোক ক্ষোভ এ পরিনত হয়ে যায়। কষ্ট পেও না.. তুমি আমাদের সেই মোকাররম যে আমি ইউনিভার্সিটি লাইফে তোমাদের ভাবী হবার আগে আমাকে মাধবীলতা বলে ডাকতে... ভাল থেকো...

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    বাঙাল কথা বেশি বলা জাতি।
    কিন্তু কাজের কথা খুবই কম বলতে পারে।
    আবার বেশ অনুসন্ধিৎসু জাতি ও বটে।
    এরা আবার খোঁচাইয়া খোচাইয়া কথা বের করতেও পটু।
    আপনার সাথে এতো বছরের পরিচয় কিন্তু কখনোই বিডিয়ার বিদ্রোহ সম্পর্কে জানতে চাই নাই।
    যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আপনি হয়েছিলেন সেটা আপনার মুখ থেকে আমার শুনতেই হবে এমন কোন কথা নেই। যখন আপনি মনে কপ্রবেন সময় হয়েছে, এই বিষয়ে বলার কিছু আছে তখনি শুনবো।

    আমার কাছে বিষয়টি অনেক টা এরকম যে সন্তান তার পরিবার কে হত্যা করলো। ভাগ্যক্রমে বেচে গেলো যে পিতা তার কাছে জানতে চাইছি সন্তান ক্যানো এমন করলো।

    পরে কমেন্টে আরো বিস্তারিত আমার কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. শাহ্জাহান কামাল অনি (১৯৮৫-১৯৯১)

    খুবই মন খারাপ করা একটা লেখা দোস্ত। আমাদের দেশের মানুষের অন্যের ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে নাড়াচাড়া করতে বেশ ভালো লাগে... এদেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত, নারী পুরুষ, বড় ছোট নির্বিশেষে কারোই ‘সিভিক সেন্স’ বলে কিছু নাই। ‘টু রেসপেক্ট আদার’স ইমোশন’ এদেশে কখনোই চর্চিত হব বলে মনে হয় না।

    ভালো লিখেছিস বন্ধু।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।