শুভ জন্মদিন কবি

কবিতা কি?
কবি কে?
নির্মলেন্দু গুণ

সেই সুদূর শৈশব থেকে শুরু করে আজ অবধি যাদের কবিতার আবেদন আজো ম্লান হয়ে যায়নি আমার কাছে তাদের অন্যতম নির্মলেন্দু গুণ।
আজ প্রিয় কবির জন্মদিন। শুভ জন্মদিন কবিকে।
কবির পুরো নাম নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী। ১৯৪৫ সালের ২১ শে জুন তারিখে  কাশবন, বারহাট্টা, নেত্রকোণায় সুখেন্দু প্রকাশ গুণ এর ঔরসে বিনাপানির গর্ভে কবির জন্ম হয়।

১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার আরেক প্রিয় কবি আবুল হাসান এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় রাজা যায় রাজা আসে শিরোনামে। গ্রন্থটিতে তিনি নির্মলেন্দু গুণকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেন। নিচে তুলে দিচ্ছি।

অসভ্য দর্শন – আবুল হাসান 
নির্মলেন্দু গুণকে 

দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙ্গছে তাও রাজনীতি,

দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার তাও রাজনীতি,

গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি! 

মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি! 

বোন তার বেণী খুলছে, যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত কোরে
বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে – তাও রাজনীতি 

তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি পুনরায় 
মারামারি যুদ্ধ আর অত্যাচার, হত্যার আগ্রাসী খুন মানুষের 
ছড়ানো বীর্যের ব্যথা, বিষন্ন মিথুন 
মহিলার রক্তের ভিতরে ভ্রুণ, সমস্যার ছদ্মবেশে আবার আগুন 
                                       উর্বর হচ্ছে, রাজনীতি, তাও রাজনীতি! 

আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি 
জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরছি রাজনীতি, তাও রাজনীতি আর 

বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁ, খাঁ, খল,
তীব্র এক বেদেনীর সাপ খেলা দেখছি আমি; রাজনীতি তাও কি
                                                                      রাজনীতি?  

নির্মলেন্দু গুণ আর হুমায়ুন আজাদ বন্ধু ছিলেন। এক আড্ডায় হুমায়ুন আজাদ নির্মলেন্দু গুণকে নিয়ে নিচের কাহিনীটি বলেন।
এবার শিশিটি উপুড় ক’রে (এক পেগের মতো হবে) কিছুক্ষণের জন্যে ধরলেন নিজের (হুমায়ুন আজাদ)  হাঁ-করা মুখে। তারপর বললেন যে, এখনই তিনি উঠবেন না, শিভাস রিগ্যাল তাঁকে নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে করিয়েছে। সেটা বলার এখনই যথার্থ সময়। ঘটনাটি এই: একবার শিভাস রিগ্যালের একটা বোতল নিয়ে নির্মলেন্দু গুণ আর হুমায়ুন আজাদ খুব বিপদে পড়েন। কোথায় বসে খাওয়া যায়, জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। তৃতীয় কাউকে তাঁরা আশা করছিলেন না, কারণ তাতে ভাগ কমে যাবে। হুমায়ুন আজাদের বাসায় মদ্যপান ছিল বারণ। শেষে নির্মলেন্দু গুণ এমন একটা জায়গা নির্বাচন করলেন, যেখানে যেতে হলে ডাস্টবিন পার-হওয়া বাধ্যতামূলক। নাক-চেপে রাখা সার্বক্ষণিক কর্তব্য। হুমায়ুন আজাদ আপত্তি করলে নির্মলেন্দু গুণ তাঁকে বলেন, ‘নেশা ও নিদ্রা নাসিকার ক্ষমতানাশক। দুই পেগেই জগতের সমূহ গন্ধ বিলীন হওয়ার কথা।’ বোতলটি যখন বের করা হয় বড় একটা ঠোঙা থেকে, তখন হুমায়ুন আজাদ বলে ওঠেন, ‘এ-যে আবর্জনার পাশে অপ্সরা!’ – (চঞ্চল আশরাফের লেখা থেকে)

কবির কয়েকটি কবিতা 

যুদ্ধ 

যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা, 
যুদ্ধ মানেই
আমার প্রতি তোমার অবহেলা। 

আগ্নেয়াস্ত্র 

পুলিশ স্টেশনে ভিড়, আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের
সন্দিগ্ধ সৈনিক। কামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের 
শটগান, রাইফেল, পিস্তল এবং কার্তুজ, যেন দরগার 
স্বীকৃত মানৎ ; টেবিলে ফুলের মতো মস্তানের হাত। 

আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি 
কোমল বিদ্রোহী, প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে, 
অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্মক 
একটি আগ্নেয়াস্ত্র, আমি জমা দিই নি। 

শহীদ 

তুমি এখন শুয়ে আছ মুষ্টিবদ্ধ দু’হাতে ঘুম। 
পথের মধ্যে উবু হয়ে তুমি রখন স্বপ্নরত, 
মধ্যরাতে আকাশভরা তারার মেলায় স্বপ্নবিভোর, 
বুকে তোমার এফোঁড়-ওফোঁড় অনেক ছিদ্র, 
স্বাধীনতার অনেক আলোর আসা যাওয়া। 
তুমি এখন শুয়ে আছো ঘাসের মধ্যে টকটকে ফুল। 

পৃথিবীকে বালিশ ভেবে বাংলাদেশের সবটা মাটি 
আঁকড়ে আছো, তোমার বিশাল বুকের নিচে এতটুকু 
কাঁপছে না আর, এক বছরের শিশুর মতো থমকে আছে। 

তোমার বুকে দুটো সূর্য, চোখের মধ্যে অনেক নদী, 
চুলের মধ্যে আগুনরঙা শীত সকালের হু হু বাতাস। 
মাটির মধ্যে মাথা রেখে তুমি এখন শুয়ে আছো, 
তোমাকে আর শহীদ ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যায় না। 

উল্লেখযোগ্য স্মৃতি

আমার ভালোবাসা কিংবা প্রেম-সংক্রান্ত
কোনো স্মৃতি নেই, যাকে ঠিক ভালোবাসা
কিংবা প্রেম বলা যায়।

একদিন টুকুদি নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে
বলেছিলঃ ‘তোর বউ তোকে খুব ভালোবাসবে দেখিস্।’
সে-ই আমার প্রেম, সেই আমার সর্বপ্রথম কল্পনায়
রমণীর ভালোবাসা পাওয়া, হঠাৎ যৌবন-ছোঁয়া
কিশোরের প্রথম প্রণয়। আর কোন স্মৃতি নেই।

একদিন নখ কাটতে কাটতে আঙুল কেটে গেলে
প্রেমের শিশির হয়ে রক্ত ঝরেছিল,
ডেটলে রক্তাক্ত ক্ষত ধুয়ে মুছে দিয়ে পূরবী বলেছিল,
‘আমি তার চিরকালের শক্র।’
আমি আজো শক্র-মিত্র তফাৎ বুঝি না।
নিজেরই শক্র হয়ে আমি আজো অপেক্ষমাণ,
ঘুরেফিরে স্মৃতির সমুখে এসে দাঁড়াই।

আমার এ ছাড়া ভালোবাসা কিংবা প্রেমের কাছাকাছি
আর কোন স্মৃতি নেই, সে-ই আমার প্রেম,
অদ্যবধি সেই আমার পুণ্য ভালোবাসা!

আমার একাকী যাত্রা, জীবনের নিঃসঙ্গতা বুঝে
সদ্যবিবাহিতা আমারই সহোদরা
সিঁথিতে রঙিন চাঁদ মেখে নিয়ে একদিন
শিয়রের কাছে বসেছিলঃ ‘চল্ ক’দিন আমার বাড়ি,
সমুদ্রের হাওয়ায় কাঁটাবি।’

আমি জানি আজো সেই সমুদ্রের হাওয়া,
আজো সেই আকমাত্র ভালোবাসা স্মৃতি,
আজো সেই মুহুর্তের প্রেম।

আমার ভালোবাসা কিংবা প্রেম-সংক্রান্ত
আর কোন স্মৃতি নেই।

আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও 

তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।

এই নাও আমার যৌতুক, এক-বুক রক্তের প্রতিজ্ঞা।
ধুয়েছি অস্থির আত্মা শ্রাবণের জলে, আমিও প্লাবন হব,
শুধু চন্দনচর্চিত হাত একবার বোলাও কপালে।
আমি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড়াবো গাণ্ডীব,
তোমার পায়ের কাছে নামাবো পাহাড়।
আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।

পায়ের আঙুল হয়ে সারাক্ষণ লেগে আছি পায়ে,
চন্দনের ঘ্রাণ হয়ে বেঁচে আছি কাঠের ভিতরে?
আমার কিসের ভয় ?

কবরের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই কবর,
শহীদের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই শহীদ,
আমার আঙুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে
জনতার হাতে হাতে গিয়েছে ছড়িয়ে।
আমার কিসের ভয় ?

তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও ।

এই দেখো অন্তরাত্মা মৃত্যুর গর্বে ভরপুর,
ভোরের শেফালি হয়ে পড়ে আছে ঘাসে।
আকন্দ-ধুন্দুল নয়, রফিক-সালাম-বরকত-আমি;
আমারই আত্মার প্রতিভাসে এই দেখো আগ্নেয়াস্ত্র,
কোমরে কার্তুজ, অস্থি ও মজ্জার মধ্যে আমার বিদ্রোহ,
উদ্ধত কপাল জুড়ে যুদ্ধের এ-রক্তজয়টিকা।

আমার কিসের ভয় ?
তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।

 

গতবছর লেখা কবিকে নিয়ে।

প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ।

৩৩ টি মন্তব্য : “শুভ জন্মদিন কবি”

  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    আমাদের কলেজ লাইব্রেরীতে গুনের একটা বই ছিল, চৈত্রের ভালো বাসা, তখন বয়স কম, সব কিছুতে লজ্জা পেতাম:
    গতকাল বড় ছেলেমানুষ বেলা ছিল
    শরৗরে শরৗর ঢালা
    ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিলো
    ঊদাসৗন গাছপালা

    এই কটি লাইন পড়েই গুন সাহেবকে দুষ্টু কবি ভেবে বসলাম, হুলিয়া পড়ে একেবারে ভক্ত হয়ে গেলাম.

    তোমার প্রেজেন্টেশন ভালো লেগেছে


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    তাঁর লেখায় আশ্চর্য রকমের এক অভিব্যাক্তি ফুটে ওঠে বারবার ।
    নিজের অবাক বিষন্ন বিস্তারে বোনা জীবনের মাঝখানে বসে অনায়াসে বলে গেছে জীবনের জয়গানের সব আশ্চর্য পংক্তিঃ
    "
    দুঃখকে স্বীকার করো না, –সর্বনাশ হয়ে যাবে ।
    দুঃখ করো না, বাঁচো, প্রাণ ভ’রে বাঁচো ।
    বাঁচার আনন্দে বাঁচো । বাঁচো, বাঁচো এবং বাঁচো ।
    জানি মাঝে-মাঝেই তোমার দিকে হাত বাড়ায় দুঃখ,
    তার কালো লোমশ হাত প্রায়ই তোমার বুক ভেদ করে
    চলে যেতে চায়, তা যাক, তোমার বক্ষ যদি দুঃখের
    নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়; যদি গলগল করে রক্ত ঝরে,
    তবু দুঃখের হাতকে তুমি প্রশ্রয় দিও না মুহূর্তের তরে ।
    তার সাথে করমর্দন করো না, তাকে প্রত্যাখান করো ।
    "

    তাঁর কথা মনে হলেই প্রথম যে কটা কবিতার লাইন মনের মধ্যে গুঙুণ করে আপনা আপনি তার মধ্যে "হুলিয়া" অন্যতম ।
    কবিতায় এমন সাবলীল গল্প বলার অনবদ্য প্রয়াস খুব সচরাচর আমরা দেখি না ।
    "
    আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
    আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
    শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।
    আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
    একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে৷
    কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,
    ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে
    আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম, একজন মহকুমা স্টেশনে উঠেই
    আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল, একজন পেছন থেকে
    কাঁধে হাত রেখে চিত্কার করে উঠেছিল;- আমি সবাইকে
    মানুষের সমিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি৷
    কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা
    তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, মুখোমুখি বসে দূর থেকে
    বারবার চেয়ে দেখলেন-, কিন্তু চিনতে পারলেন না৷
    বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,
    অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও
    রফিজ আমাকে চিনলো না৷
    দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি৷
    সেই একই ভাঙাপথ, একই কালোমাটির আল ধরে
    গ্রামে ফেরা, আমি কতদিন পর গ্রামে ফিরছি৷
    আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
    আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
    শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া৷
    অনেক বদলে গেছে বাড়িটা,
    টিনের চাল থেকে শুরু করে পুকুরের জল,
    ফুলের বাগান থেকে শুরু করে গরুর গোয়াল;
    চিহ্নমাত্র শৈশবের স্মৃতি যেন নেই কোনখানে৷
    পড়ার ঘরের বারান্দায় নুয়ে-পড়া বেলিফুলের গাছ থেকে
    একটি লাউডুগী উত্তপ্ত দুপুরকে তার লক্লকে জিভ দেখালো৷
    স্বতঃস্ফূর্ত মুখের দাড়ির মতো বাড়িটির চতুর্দিকে ঘাস, জঙ্গল,
    গর্ত, আগাছার গাঢ় বন গড়ে উঠেছে অনায়াসে; যেন সবখানেই
    সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি৷
    একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়,
    আমাকে দেখেই পালালো একজন, একজন গন্ধ শুঁকে নিয়ে
    আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো- যেন পুলিশ-সমেত চেকার
    তেজগাঁয় আমাকে চিনতে চেষ্টা করেছিল৷
    হাঁটতে- হাঁটতে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম,
    অশোক গাছ, বাষট্টির ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া অশোক,
    একসময়ে কী ভীষন ছায়া দিতো এই গাছটা;
    অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারতো এর ছায়ায়৷
    আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত
    এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম৷
    সেই বাসন্তী, আহা, সেই বাসন্তী এখন বিহারে,
    ডাকাত স্বামীর ঘরে চার- সন্তানের জননী হয়েছে৷
    পুকুরের জলে শব্দ উঠলো মাছের, আবার জিভ দেখালো সাপ,
    শান্ত-স্থির-বোকা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে
    একটি এরোপ্লেন তখন উড়ে গেলো পশ্চিমে – -৷
    আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে
    ডাকলুম,— “মা’৷
    বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
    বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,
    মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো৷
    বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
    চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
    কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;
    সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
    একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম৷
    মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে
    লুকিয়ে রেখে অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে
    পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন; আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম,
    দেখলুম দু’ঘরের মাঝামাঝি যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল,
    সেখানে লেনিন, বাবার জমা- খরচের পাশে কার্ল মার্কস;
    আলমিরার একটি ভাঙ্গা- কাচের অভাব পূরণ করছে
    ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি৷
    "

    আর কি রকম অনবদ্য সরল ভাষায় বলে গেছেন সমুদ্র সমান গভীর কথকতা । তার উতকৃষ্ট উদাহরন "মানুষ" কবিতাটি ।
    "
    আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
    হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
    মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়।

    আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
    গাছের মত দাঁড়িয়ে থাকি।
    সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
    অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না।
    কী করে তাও বেঁচে আছি আমার মতো। অবাক লাগে।

    আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো।
    বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
    রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
    পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো।

    আমি হয়ত মানুষ নই,
    মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন?
    মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
    নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
    নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে।

    মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো,
    চোখের মধ্যে অভিমানের রাগ থাকতো,
    বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
    ভালবাসার লোক থাকতো,
    হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো।

    আমি হয়তো মানুষ নই,
    মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
    আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
    বেঁচে-থাকাটা আর হতো না।

    মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়;
    অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
    অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি।
    "

    অতো অতো কবিতা তাঁর । বলে তো শেষ হবে না ।

    তোমার স্মরণ ও শ্রদ্ধার প্রয়াসটি মনকাড়া । তার জন্য অগণন সাধুবাদ ।

    জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    অনেক ছোট থাকতেই তাঁর কবিতার সাথে পরিচয় হয়েছিল কারন তাঁর লিখা একটা বই ছিল বাসায়।
    নাম: "প্রেমাংশুর রক্ত চাই"।
    কলেজে থাকা কালে তাঁর উলটোরথ কবিতার শেষ পংক্তিটি নিয়ে অনেক কৌতুক করতাম আমরা...
    "চাবী দিয়ে তালা খোলা দেখিয়েছি,
    তালা দিয়ে খোলো দেখি চাবী" - বা এজাতিয় কিছু একটা...

    ক্লাস টুয়েলভে থাকা কালে আইসিসিএলএম-এ অডিশন দিতে মুখস্ত করেছিলাম "আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও"।
    কিন্তু অডিশনের দিন ভুলে গিয়েছিলাম কয়েক জায়গায়। হয়তো সেজন্য অথবা হয়তো আরও ভাল আবৃত্তি শিল্পী থাকায় সুযোগ পাই নাই তা করার।
    তবে বত্রিশ বছর পর ক্যাডেট কলেজ ক্লাবে এটা আবার মুখস্ত করে পারফর্ম করি গত ফেব্রুয়ারি তে।
    এবার আর ভুলি নাই একটুও...

    বরং আমার মুখস্ত করা শুনে শুনে আমার পঞ্চবর্ষিয়া কন্যা আদৃতা কিভাবে যেন সবার অগোচরে মুখস্ত করে ফেলে গোটা কবিতাটা।

    গত এপ্রিলে ক্লাবে অনুষ্ঠিত শিশুদের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় এই কবিতা আবৃত্তি করে সে প্রথম স্থান অধিকার করে।

    কবির জন্ম দিনে আমার কনিষ্ঠা কন্যার এই আবৃত্তিটি উৎসর্গ করছি.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      কবিতা যে ক্যানো মুখস্থ করতে হবে বা করে আবৃত্তি করতে হবে এইটা বুঝি না।
      ভাতিজির আবৃত্তি দারুণ হইছে।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
      • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)
        কবিতা যে ক্যানো মুখস্থ করতে হবে বা করে আবৃত্তি করতে হবে এইটা বুঝি না।

        অযাচিতে তোমার প্রশ্নটার একটা জবাব দিচ্ছি। তুমি ভাই মনে কিছু করো না।
        আমার মতে কবিতা শুধু অক্ষরে অক্ষরে মুখস্থ করেই নয়, যতিচিহ্নসহ মুখস্থ করে আবৃত্তি করতে হবে। সৈয়দ শামসুল হক আমাদের প্রবীণ কবিদের একজন। তাঁর কাব্য অনুধাবনের ক্ষমতা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু 'বনলতা সেন'-এর প্রথম কয়েকটি পংক্তি পড়ে তিনিও যে মারাত্নক বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন, সেটি বোঝা গেছে তাঁর 'জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন : কিমিয়ার সন্ধানে' লেখাটি পড়ে।

        হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
        সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
        অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
        সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
        আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
        আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

        এই হচ্ছে প্রথম কয়েকটি পংক্তি। সৈয়দ হক লিখেছেন-

        কবিতাটি যখন আমরা শুনি, অথবা মনে মনে আওড়াই, তখন কি একবারও আমাদের মনে হয়- হাঁটিতেছি কথাটা সমুদ্রের সঙ্গে কীই না অসঙ্গত! হাজার বছর ধরে আমি জল ভ্রমিতেছি পৃথিবীর বুকে- কেন নয়? কেন হলো 'হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে' যখন তার পরেপরেই আসছে সমুদ্রের কথা? জল ভ্রমিতেছি, জল ভাঙিতেছি- এমন লেখাটাই তো 'স্বাভাবিক' ছিলো! কবি তা লেখেন নি, আর আমরাও অবলীলায় ওই গৃহস্থ-সুলভ সদযুক্তি ও স্বাভাবিকতাটি উপেক্ষা করে অগ্রসর হই। কবিতার কিমিয়া এভাবেই আমাদের গার্হস্থ্য অভ্যস্ত মনটিকে নাড়িয়ে দেয়, ভেঙে দেয় আমাদের সকল 'স্বাভাবিকতা', শব্দের সকল প্রত্যাশিততা, এবং অনুভবের নীলিমায়।

        শেষের কথাটি খুব সত্যি বলেছেন তিনি। কবিতার রসায়ন আমাদের গার্হস্থ্য অভ্যস্ত মনটিকে নাড়িয়ে দেয়, ভেঙে দেয় আমাদের সকল 'স্বাভাবিকতা'। কিন্তু কবিতাটি বুঝতে ভুলও করেছেন তিনি। কেন পথ হাঁটিতেছি, কেন জল ভ্রমিতেছি নয়- এইসব প্রশ্ন ওই না বোঝার ফল। কিন্তু ভুলটা কোথায়? ভুলটা হচ্ছে পড়ার ধরনে। তিনি কবিতার প্রথম দুই লাইন পড়েছেন এভাবে-

        হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
        সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

        ফলে তার মনে হয়েছে যে, কবি সাগরেও হাঁটার কথা বলছেন!

        আসলে পড়তে হবে এভাবে-

        হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
        সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
        অনেক ঘুরেছি আমি;

        পড়ার সময় প্রথম লাইনটি ‌'পথে' পর্যন্তই, কিন্তু দ্বিতীয় লাইনটি শেষ হবে তৃতীয় লাইনের মাঝামাঝিতে, অর্থাৎ 'অনেক ঘুরেছি আমি' পর্যন্ত। অর্থাৎ পথে তিনি হাঁটেনই, আর সাগরে ঘুরেন!

        একটি কবিতার ভুল পাঠ একজন প্রবীণ কবিকেও কিভাবে বিভ্রান্তিতে ফেলে এটি তার প্রমাণ দেয়। যাহোক, সৈয়দ হকের প্রসঙ্গ টানা হয়েছে তাঁকে অসম্মান করার উদ্দেশ্যে নয়, একটি উদাহরণ হিসেবে। আবৃত্তিকারের জন্য বিষয়টা আরো ব্যাপক আকার ধারণ করে। কারণ ভুলপাঠে তিনিই শুধু বিভ্রান্ত হন না, অডিটরিয়াম উপচে পড়া শ্রোতাদেরও বিভ্রান্ত করেন। 🙂 (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)


        দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

        জবাব দিন
  4. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    এই একই দিনে আর এক প্রিয় কবি এবং তারও চেয়ে প্রিয় সখ্যের প্রয়াণ দিবস ।

    ভালো আছি ভালো থেকোর সেই শক্তিমান মানুষের মানচিত্রের কবি নিশ্চয়ই ভালো আছেন ।

    " ...
    এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি।
    শুন্যতার দিকে চোখ, শুন্যতা চোখের ভেতরও–
    এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি।
    বিলুপ্ত বনস্পতির ছায়া, বিলুপ্ত হরিণ।
    মৌসুমী পাখির ঝাঁক পালকের অন্তরালে
    তুষারের গহন সৌরভ ব’য়ে আর আনে না এখন।"

    অথবা মনে করা যায় ...

    "কথা ছিলো রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত,
    রাখালেরা পুনর্বার বাঁশিতে আঙুল রেখে
    রাখালিয়া বাজাবে বিশদ।
    কথা ছিলো বৃক্ষের সমাজে কেউ কাঠের বিপনি খুলে বোসবে না,
    চিত্রর তরুন হরিনেরা সহসাই হয়ে উঠবে না
    রপ্তানিযোগ্য চামড়ার প্যাকেট।

    কথা ছিলো , শিশু হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্পদের নাম।
    নদীর চুলের রেখা ধ‌‌রে হেঁটে হেঁটে যাবে এক মগ্ন ভগীরথ,
    কথা ছিলো, কথা ছিলো আঙুর ছোঁবো না কোনোদিন।"

    null

    তোমাকে স্মরণ । তোমাকে শ্রদ্ধা । তোমাকে ভালোবাসা সেই উত্তাল সখ্যতার, শহর ছেনে বেড়ানোর । ভালো থেকো রুদ্র তোমার অমলিন হাসির মতোন প্রাণবান ভালো ।

    জবাব দিন
  5. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    বাহ, মনকাড়া পোষ্ট! সেইসাথে উপরি পাওনা, গেলবার এবার মিলিয়ে কবির লেখা অনেকগুলো কবিতা। গুণের কাব্যভাবনার ক্রমবিবর্তনের একটা আবহ পেলে ভালো হত, তবে না হলেও এবেলায় পুষিয়ে গেছে। অনেক ধন্যবাদ, রাজীব তোমাকে!


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
  6. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন একটা কাজ করেছেন রাজীব ভাই। গুণ এর কবিতা যৎসামান্য যা পড়েছি বেশ ভাল লেগেছে।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  7. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    নির্মলেন্দু গুণ আমার প্রিয় কবিদের একজন। তাঁর 'নির্বাচিতা' বইটি নিয়ে ঘোরলাগা দিন কেটেছে অনেক।
    অবশ্য কবির সাম্প্রতিক লেখা আমাকে আর টানেনা। অসামান্য কিছু কবিতার জনক হিসেবে গুণ আমাদের সাহিত্যে অক্ষয় হয়ে থাকবেন।
    এই পোস্টের জন্যে ধন্যবাদ রাজীব!
    কিছু স্মরণযোগ্য কবিতা একসঙ্গে পাওয়া গেল।
    পেলাম কিছু দুর্দান্ত আলোচনা।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।