জাল পরা বাসন্তী

“আফতাব ভাইও মারা গেলেন। নৃশংস খুন। ইত্তেফাকে থাকতে পুরোটা সময় সময় আমি আফতাব ভাইকে পেয়েছিলাম। এখনো কানে বাজে আফতাব ভাইয়ের ডাক-‘মাসুম, ভাইয়া’।
কিছুদিন আগেই মারা গেলেন ইত্তেফাকের শফিকুল কবির ভাই। তিনি তাঁর একটা বই শুরুই করেছিলেন আমার নাম দিয়ে। কবির ভাইয়ের শেষ জীবনটাও কষ্টে কেটেছে।
কাকতালীয় হয়তো, তাও বলি। সেই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জাল পরা বাসন্তীর বিখ্যাত ও অতি আলোচিত ছবিটি তুলেছিলেন আফতাব ভাই আর সংগের রিপোর্টার ছিলেন কবির ভাই।” – শওকত হোসেন মাসুম

মাছধরার জাল পড়া সেই বাসন্তী পাশে তার বোন দূর্গতী

মাছধরার জাল পড়া সেই বাসন্তী পাশে তার বোন দূর্গতী

সেই ছবি তোলার প্রত্যক্ষদর্শী হলেন, রাজো বালা।তিনি সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলেন। প্রকৃত দৃশ্য বর্ণনা করতে চান না। এখনো ভয় পান। তার মতে,

এসব বললে ক্ষতি হতে পারে। যা হবার তা তো হয়েই গেছে বলে আর লাভ কি। পরে অনেক আলাপ-আলোচনার পর রাজো বালা বর্ণনা করেন সেই দৃশ্য। ছলছল চোখে আনমনা হয়ে কথা বলেন তিনি। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, ৭৪-এ যখন বাসন্তী-দুর্গাতিদের ছবি তোলা হয়, তখন ছিল বর্ষাকাল। চারদিকে পানি আর পানি। এমনকি প্রেক্ষাপটে তিনজন লোক আসেন বাসন্তীদের বাড়িতে। এদের মধ্যে একজন ছিল তৎকালীন স্থানীয় রিলিফ চেয়ারম্যান তার নাম আনছার। অপর দুজনকে রাজো বালা চিনতে পারেনি। বাসন্তী-দুর্গতিদেরকে একটি কলা গাছের ভেলায় করে বাড়ি থেকে বের করা হয়। আর অন্য একটি ভেলায় রেখে তাদের ছবি নেয়া হয়। এ সময় পাশের একটি পাট ক্ষেতে ছিলেন রাজো বালা। ছবি তোলার আগে আগন্তুকরা বাসন্তীদের মুখে কাঁচা পাটের ডগা দিয়ে বলে এগুলো খেতে থাকো। এর বেশি আর কিছু জানাতে পারেননি রাজো বালা। বাসন্তীর কাকা বুদুরাম দাসের কাছে সেই ছবি তোলার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কাঁচুমাচু করেন। এক পর্যায়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বর্ণনা করেন সেই ছবি তোলার নেপথ্য কাহিনী। শেষ পর্যায়ে তিনি ঐ ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং প্রতিকার চান।’

“সঠিক ভাবে দিন-তারিখ মনে নেই। একদিন বাসন্তী ও তাঁর কাকাতো বোন দুর্গাতিসহ পরিবারের আরও কয়েকজন মিলে ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধের ওপর বসেছিলেন। তখন দুপুর গড়িয়েছে। এমন সময় ইউপি চেয়ারম্যান আনসার আলি বেপারি(এক সময়ের মুসলিম লীগ ও পরে আওয়ামীলীগের মাঠ পর্যায়ের নেতা) কয়েকজন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ একজন সাংবাদিককে (আফতাব আহমেদ, আলোকচিত্রি, দৈনিক ইত্তেফাক) নিয়ে আসেন মাঝি পাড়ায়। তারা বাসন্তী ও দুর্গাতির ছবি তুলতে চান। এ সময় তারা বাঁধের ওপর মাঝিদের রোদে শুকোতে দেয়া জাল তুলে এনে তা বাসন্তীর ছেঁড়া শাড়ির ওপর পরিয়ে ছবি (১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় এই ছবি দু’টি ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। সুত্রঃ ‘চিলমারীর এক যুগ’ – মোনাজাত উদ্দিন) তোলেন। বুদুরাম এভাবে ছবি তুলতে আপত্তি জানিয়ে নিষেধ করেছিলেন। তবুও তারা শোনেননি। এ প্রসঙ্গে বুদুরাম দাশ তার ভাষায় জানায়, ‘চেয়ারম্যান সাব ছেঁড়া হউক  আর ফারা হউক  একনাতো শাড়ি আছে উয়ার উপরত ফির জাল খান ক্যা পরান, ইয়ার মানে কি? (চেয়ারম্যান সাহেব। ছেঁড়া হোক একটা শাড়ি তো আছে, তার ওপর জাল কেন পরান; এর কারণ কি? তখন সাইবদের মইদ্যে একজন কয় ইয়ার পরোত আরো কত কিছু হইবে….’’ তখন একজন সাহেব জানায় এরপর আরো অনেক কিছু হবে…..)।

তবে সেই ছবি তোলার সঙ্গে চেয়ারম্যান আনসার আলি বেপারি ছাড়া আর যারা ছিলেন বুদুরাম দাশ তাদের পরিচয় জানাতে পারেননি। তবে তাঁরা কেউই স্থানীয় ছিলেন না। সেই সময় বাসন্তী কিশোরী। একই সঙ্গে অপুষ্টির শিকার তার কাকাতো বোন দুর্গতি নামে অপর এক প্রতিবেশী কিশোরীর জীর্ণ বস্ত্র শীর্ণ দেহের একটি ছবিও তোলা হয়েছিল। সেই ছবি ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের ট্রাজেডি হিসেবে দেশে-বিদেশে কাঁপন জাগিয়েছিল। শোনা গেছে দুর্গতি পরিবার-পরিজনসহ দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী ভারতে চলে গেছে সেই থেকে তার আর কোনো খোঁজ নেই। (এস এ রিয়াদের ব্লগ ) উনি আবার তথ্য নিয়েছেন এখান থেকে

মঙ্গার আলেখ্য – মাহবুব রহমান
চিলমারীর এক যুগ – মোনাজাত উদ্দিন
পথ থেকে পথে – মোনাজাত উদ্দিন
আনিস রায়হান’র ব্লগ

পরবর্তীতে বাসন্তীর সাথে দেখা করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সাক্ষাৎকার বলতে যা বোঝায় তা কখনোই নেয়া হয়ে ওঠে নি। কারণ বাসন্তী আজন্ম বোবা বা বাক প্রতিবন্ধী।

২০১১ সালে বাসন্তী

২০১১ সালে বাসন্তী

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বাসন্তীর ছবি সম্পর্কে তিনি বলেন,

‘ওই ছবিটি প্রকাশের আগে থেকেই দেশের তৎকালীন অবস্থা নিয়ে জনগণ বিচলিত ছিলেন। দুর্ভিক্ষ সৃষ্ট পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বঙ্গবন্ধু সরকার তখন প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। এরকম একটা সময়ে বাসন্তীর ছবিটি ছাপা হয়। এবং ছবিটি জনমনে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মানুষের ভাবনা ছিল, এত কষ্ট করে দেশ স্বাধীন হল। অথচ স্বাধীন দেশে একটি যুবতী মেয়ের পরার মতো কাপড় নেই। এমনটা কেন হবে। পরবর্তীতে জানা যায় ছবিটি সাজানো ছিল। এবং এ থেকে মানুষ আসল সত্য জানতে পারে। একটা সরকারের বিরোধী পক্ষ থাকবে। এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে ওই আলোকচিত্রি যে কাজটি করেছিলেন তা সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালার মধ্যে পড়ে না। এটা অন্যায়।’’

প্রথম যখন বাসন্তীর ছবি আমি দেখি আমার খুব খারাপ লেগেছে। সেই ছবিটা অবশ্য আরেকটি ছবি ছিলো যা কিনা উপরের ১ম ছবির সাথে দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিলো। ওটা বাসন্তীর সিঙ্গেল ছবি ছিলো। (যদি কারো সংগ্রহে থাকে তবে জানালে বাধিত থাকবো।) কিন্তু অনাহারে মৃত, প্রায় মৃত হাড় জিরজিরে শিশু, মায়ের শুকনা স্তন, মানুষের বোবা, নিথর দৃষ্টির চাইতে বেশি আহত করে নি। পরে আমি যখনই সেই ছবিটা নিয়ে ভেবেছি তখনই আমার একটা খুব সহজ কথা মনে হয়েছে,

“একটা শাড়ির চাইতে একটা মাছ ধরার জালের দাম বেশি।”  

আজকেই বিখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের লেখাটি পড়লাম। ভাবলাম সেখান থেকে কিছু অংশ শেয়ার করি।

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষঃ বাসন্তীর জাল পরা জাল ছবিঃ আলোকচিত্রি আফতাবের অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং একটি অপ্রীতিকর স্মৃতি 
লুৎফর রহমান রিটন 

১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো। কেউ কেউ বলেন শেখ মুজিবকে বিপদে ফেলতে শক্তিশালী একটি চক্র সেই দুর্ভিক্ষকে সৃষ্টি করেছিলো। মানবসৃষ্ট সেই দুর্ভিক্ষের ভয়াল ছোবল সবচে বেশি দৃশ্যমান ছিলো উত্তরবঙ্গে। সেই দুর্ভিক্ষ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে থাকা সরকার। (সচেতন নাগরিকমাত্রই জানেন প্রকৃতি এবং লোভী রাজনীতিবিদদের অমানবিক লুটেরা রাজনীতির কারণে প্রতিবছর ‘বার্ষিক মঙ্গার মৃত্যু উৎসব’ হতো উত্তরবঙ্গে। সাম্প্রতিককালে সেই মঙ্গা ঠেকানো গেছে বহুলাংশে।) কিন্তু চুয়াত্তরের প্রেক্ষাপট ছিলো ভিন্ন। শেখ মুজিবের দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য শত্রুরা তাঁকে রাষ্ট্রপরিচালনায় ব্যর্থ প্রমাণ করতে আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছিলো। সেই ষড়যন্ত্রে শামিল ছিলো তৎকালীন হাইয়েস্ট সার্কুলেটেড পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ও। মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’র মতো ইত্তেফাকও দুর্ভিক্ষের সন্ধানে বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে রিপোর্টার শফিকুল কবির এবং ফটোগ্রাফার আফতাব আহমেদকে পাঠিয়েছিলো রংপুরের কুড়িগ্রামে। আগে থেকেই সবকিছু নির্ধারিত ছিলো। বিশেষ একটি নৌকায় বিশেষ একজনের পথ প্রদর্শন বা গাইডেন্সে বিশেষ একটি অঞ্চলে গিয়ে একটি হতদরিদ্র পরিবারের অনাহারী মেয়ে বাসন্তীকে নগদ পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে রাজি করানো হয় একটি ফটোসেশনে। দরিদ্র্ বাসন্তী চকচকে পঞ্চাশ টাকার নোটটি পাবে যদি একটি ছেঁড়া জাল সে পরিধান করে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যে। সেই সময়, ১৯৭৪ সালে, হতদরিদ্র বাসন্তীর কাছে পঞ্চাশটি টাকা রীতিমতো স্বপ্নের ব্যাপার। বাসন্তী রাজি হয়েছিলো। শফিকুল পঞ্চাশ টাকার নোটটি বাসন্তীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। গাইড-এর দূতিয়ালীতে সংগৃহিত ছেঁড়া জালটি গায়ে জড়িয়ে কলার থোড় সংগ্রহ করছে অনাহারী বাসন্তী। তার পাশে দুর্গতি নামের ছিন্ন পোশাকের আরেকটি মেয়ে। আফতাবের ক্যামেরা সেই পূর্বপরিকল্পিত সাজানো ছবিটি ধারণ করেছিলো। রংপুর মিশন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন ইত্তেফাকের রিপোর্টার সফিকুল আর ফটোগ্রাফার আফতাব। আফতাবের তোলা ভুয়া সেই ছবিগুলোর একটি ছাপা হয়েছিলো ইত্তেফাকের প্রথম পাতায়। আমেরিকার বিশ্বস্ত অনুচর আনোয়ার হোসেন মঞ্জুআর ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনরা সেটা ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় লীড ফটো হিশেবে ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী শেখ মুজিবকে চরম ব্যর্থ একজন শাসক হিশেবে প্রমাণ করে মুজিবকে উৎখাত কিংবা হত্যার প্রেক্ষাপট নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো ছবিটি। এর এক বছরের মাথায় ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছিলো নৃশংসভাবে, সপরিবারে।

১৯৯৬ সালের একটা ঘটনার বিবরণ দেন রিটন,

“ধানমণ্ডি ছয় নম্বরে আওয়ামী ফাউন্ডেশনে তখন মাঝে মধ্যেই জরুরি সভায় মিলিত হতাম আমরা, সাংস্কৃতিক অঙ্গণের কতিপয় যোদ্ধা। আমাদের সেই সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় কবি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল, ভাষাসৈনিক গাজিউল হক, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত থাকতেন নিয়মিত। আমাদের সেই সভায় আওয়ামী লীগের মুরুব্বী প্রতিনিধি হিশেবে অধ্যাপক কামারুজ্জামান থাকতেন। জননেত্রী শেখ হাসিনাও এসেছিলেন একদিন। আমাদের সেই সভায় পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ বাড়ছিলো। এক বিকেলে সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী এলেন আফতাব আহমেদকে বগলদাবা করে। এসে যথারীতি বসে পড়লেন আমাদের গোল টেবিল বৈঠকের দুটো চেয়ারে, আমার ঠিক বিপরীত দিকে। আমি নড়েচড়ে উঠলাম। অনুচ্চ কণ্ঠে বললাম—

” আমাদের সভায় গোলাম আযমের নাগরিকত্বের দাবিতে বিবৃতি দেয়া সাংবাদিক কেনো? বাসন্তীর জাল পরা জাল ছবির সেই ফটোগ্রাফার কেনো? কে ওদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন?” 

আমাকে থামানোর চেষ্টা করলেন কামারুজ্জামান। আমি থামছি না। এরপর আমাকে থামাতে চাইলেন গাজিউল হক। আমি থামছি না। বরং আমার কণ্ঠস্বর আরো উচ্চকিত হয়ে উঠছে। এতোক্ষণ আমার প্রতিবাদ শুনতে পাচ্ছিলেন আমার আশপাশের চারপাঁচজন। আমি উচ্চস্বরে একই বাক্য রিপিট করলে সবাই সেটা শুনতে পেলেন। শুনতে পেলেন ওরা দুজনও। কামারুজ্জামান ভাই এবং গাজি ভাইয়ের ইশারায় মুকুল ভাই(এম আর আখতার মুকুল)আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন পাশের একটা ছোট্ট কক্ষে যেখানে কম্পিউটারে কাজ করেন এডভোকেট আবদুল মান্নান(পরবর্তীতে পূর্তপ্রতিমন্ত্রী) এবং নকীবরা। সেই রুমে দরোজা বন্ধ করে মুকুল ভাই আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন—

“তুমি তো মিয়া বোমা ফাটাইয়া দিছো আইজকা। আফতাবরে আনছে ক্যাডা দেহো নাই? অরে আনছে ইকবাল সোবহান। সাম্বাদিকগো ন্যাতা। ইকবাল সোবহানরে বাইর করন যাইবো না আর আফতাবরে বাইর কইরা দিলে তো সাম্বাদিক ন্যাতারে অপমান করা অয়। তুমি তো হালায় বুঝো ছবই। ক্যালা খামাখা দিগদারি করতাছো!” 

যুক্তিতে আমি খুব সহজেই ঘায়েল করে ফেললাম মুকুল ভাইকে। মুকুল ভাই আমার লজিক গুলো মেনে নিয়েই বললেন–

“যেইডা বুঝানের হেইডা তো মিয়া তুমি বুঝাইয়াই দিছো। এলায় চুপ থাকো। মেসেজ যেইটা দেওনের তুমি অইটা অগো দুইজনরেই দিয়া দিছো। আন্দোলনের স্বার্থে তুমি এলায় খামোশ থাকবা। এইডা গাজি ভাই আর কামারুজ্জামানের পক্ষ থিকা তোমার কাছে আমার রিকোয়েস্ট। হ্যারা কেউ তোমারে সাইজ করতে পারবো না বইলাই আমারে দায়িত্ব দিছে তোমারে ঠান্ডা করনের। আন্দোলনের স্বার্থে তুমি চাইপা যাও, ঠিকাছে?” 

বলতে বলতে মুকুল ভাই আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। আমাকে সঙ্গে করে মুকুল ভাই ফিরে এলেন সভাকক্ষে। বিব্রতকর একটা পরিস্থিতির ভেতর সভা চললো।

রিটনের জবানিতে এর আগে ১৯৯১ সালে আফতাব আহমেদ এর সাথে ১ম দেখা হবার কথা বলেন,

১৯৯১ সালে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার গ্রীণরোড কার্যালয়ে এক দুপুরে এসেছিলেন তিনি। আমি তখন পত্রিকাটার ফিচার এডিটর। সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার টেবিলে এসেছিলেন তিনি অনেক আগ্রহ নিয়ে। আমি তাঁকে চা অফার করেছিলাম ঠিকই কিন্তু তাঁর প্রতি আমার ক্ষোভের কথাটাও জানিয়েছিলাম অকপটে। বলেছিলাম—

“জাতির জনক বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার প্রেক্ষাপট বা পটভূমি নির্মাণে আপনিও তো একজন কুশীলব ছিলেন!”

চায়ে চুমুক দিতে দিতে বেশ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তিনি আমাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ছবিটা সাজানো ছিলো সত্যি কিন্তু ওটার পেছনে এতোবড় একটা ষড়যন্ত্র আছে তা তিনি জানতেন না।
তাঁর জবাবটিকে নাকচ করে দিয়ে আমি বলেছিলাম—

“পলিটিক্যালি মোটিভেটেড বলেই ইত্তেফাক আপনাদের দুজনকে কুখ্যাত সেই এসাইনমেন্টের জন্যে নির্বাচন করেছিলো। যে কোনো কারণেই হোক—আপনারা শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের প্রবল বিরোধী ছিলেন। তাছাড়া আপনি রংপুরের সন্তান। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা এবং পথঘাট আপনার চেনাজানা।”

জবাবে আফতাব আহমেদ বলেছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু কিংবা আওয়ামী লীগের বিরোধী কেউ নন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বহু ছবি তুলেছেন। ৬৯-৭০-৭১ সালের বহু ঐতিহাসিক ছবি তার তোলা। সেসব ছবিতে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ আছেন।
এ বিষয়ে তাঁর কোনো অনুশোচনা আছে কীনা জিজ্ঞেস করলে নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়েছিলেন তিনি।

বাংলাবাজার পত্রিকা অফিসে আফতাব ভাই আমাকে সত্য বলেননি। বাস্তবে তিনি বঙ্গবন্ধুএবং আওয়ামী লীগের বিরোধী শিবিরের বিশ্বস্ত লোক ছিলেন। আমরা স্মরণে আনতে পারি— ১৯৯৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়া ফটোসাংবাদিকদের কোনো একটি অনুষ্ঠানে চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষের বিশেষ করে বাসন্তীর মর্মষ্পর্শী ছবিটি তোলার কারণে আলোকচিত্রি আফতাব আহমেদকে পুরস্কার দেবার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবং সেই ঘোষণার পর ইত্তেফাকে বিবৃতি দিয়ে আফতাব আহমেদ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন খালেদা জিয়ার প্রতি। এবং আমরা আরো স্মরণে আনতে পারি যে—২০০৬ সালে একুশে পদক পেয়েছিলেন তিনি। আর সেই পুরস্কারটি দিয়েছিলো বিএনপি-জামাত জোট সরকার।

একুশে পদক ২০০৬

 

২০০৬ সালে আরেকটি ঘটনায় আফতাব আহমেদের রাজনৈতিক চরিত্রটি আরো ষ্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। সেই বছর ইসলামিক ছাত্র শিবিরের একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে বিশেষ পদক প্রদান করা হয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর হাত থেকে পদকটি গ্রহণ করেছিলেন হাস্যোজ্জ্বল আফতাব আহমেদ।

1546313_10152142313159414_534860533_n

(ছবিটি অমি রহমান পিয়ালের সৌজন্যে প্রাপ্ত)

শেষ কথাঃ তবে কি ৭৪ সালে কোন দূর্ভিক্ষ হয় নি দেশে?
অবশ্যই হয়েছে।

জন পিলগার কে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু

জন পিলগার কে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধুর নিজের সাক্ষাৎকার দেখুন এই লিঙ্কে ক্লিক করে।

আর আংরেজিতে একথা আছে না

TRUTH PREVAIL.

সেটাই।

২৪ টি মন্তব্য : “জাল পরা বাসন্তী”

  1. তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

    তথ্যবহুল লেখা।
    তবে হত্যার বিচার হোক।
    ৭৫ এ আরো অনেকেরই অবস্থান নিয়ে কথা বলা যায়।(চামড়া দিয়ে ডুগডুগি...!)
    সেগুলো কালেক্ট করতে পার কিনা দেখো তো রাজীব। (সম্পাদিত)


    আমি চোখ মেললুম আকাশে
    জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে

    জবাব দিন
  2. সৌরভ(০৬-১২)

    অনেক জানার দরকার। অনেক।৭১ দেখি নি।তাই পড়তে চাই,, শুনতে চাই।
    যাতে দিকভ্রান্তরা আমাদের ভুল দিকে নেবার আগে একটু হলেও জোর গলায় বলতে পারি।


    মুক্তি হোক আলোয় আলোয়...

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      কথা ঠিক।
      জানার আছে অনেক কিছুই।
      এবং জানতে হবে।
      এর কোন বিকল্প নাই।
      এবং একটু মাথ খাটিয়ে। কারণ প্রত্যেকেই নিজের নিজের ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে দিতে পাগলপারা আর সেটা সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই।

      ঐদিন রাতেই এক ছোটভাই মেসেজ দিলো ফেবু ইনবক্সে যে সাঈদি ৭১ এ কি কি করেছে তার কোন বিবরণ আমার কাছে আছে নাকি?
      ধরে নিছ্ছি ঐ ছেলের উদ্দেশ্য সৎ। সে আসলেই জানতে চায়।

      কথা হচ্ছে তাইলে সে কি এতোদিন ঘুমাইছে। রাত দেড়টা দুইটায় এই ধরণের মেসেজ পাইলে মেজাজ খুব খারাপ হয়। তাও এইসব মেটেরিয়াল তার নিজের জন্য না দরকার আরেকজনকে জানাবার জন্য।
      সেই আরেকজন আইদার তার প্রেমিকা বা জানি দোস্ত।
      এখন কথা হচ্ছে কেনো এক্জনকে সাঈদীর কুকর্ম সম্পর্কে বুঝাতে হবে?
      তার মানে সাঈদী তার কাছে মহান লোক।
      যেই লোকের সেক্স টেপ বের হবার পরেও পাবলিক তার জন্য পাগল থাকে, চঁাদে তারে দেখে সেই লোকদের সাথে আর যাই হোক যুক্তি চলে না।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।