১৫ ই আগষ্ট ১৯৭৫ – প্রেক্ষাপট

হাতে লিখতে সময় লাগবে তাই বইটি সরাসরি তুলে দিলাম। লেখক লে কর্নেল (অবঃ) এম এ হামিদ, পিএসসি। বই- তিনটি সেনা অভ্যুথ্বান ও কিছু না বলা কথা। বইটি শিখা প্রকাশনি থেকে প্রকাশ করা হয়েছিলো। প্রথম প্রকাশকাল ১৯৯৩।

 

a b c d e
0 1 2 3 4 5 6 7

 

উপরে ১৯৭৫ এর ১৫ ই আগষ্টের আগ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করা হয়েছে।
কমেন্ট সেকশনে এ বিষয়ে আরো আলোচনা হবে আশা করি। আমার নিজের কাছে যেসব পয়েন্ট গুরুত্ব্পূর্ণ মনে হয়েছে তা চিহ্নিত করে দিলাম।
লেখকের হেল কমান্ডো নামে অনবদ্য একটি বই আছে। আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন। আমি সেবা এর টা পড়েছিলাম।

 

 

বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে

সৈয়দ শামসুল হক

এই পৃথিবীতে আর আকাশ দেখিনি আমি এতো_ অবনত_
ঘুমন্ত শিশুর মুখে যেন চুমো খাবে পিতা নামিয়েছে_ মুখ;
প্রান্তর এতোটা বড় যেন মাতৃশরীরের ঘ্রাণলাগা শাড়ি;
আদিকবি পয়ারের মতো অন্তমিল নদী এতো শান্তস্বর;
এতোই সজল মাটি কৃষকের পিঠ যেন ঘামে ভিজে আছে;

যদিও বৃষ্টির কাল নয় তবু গাছ এতো ধোয়ানো সবুজ;
দেখিনি এমন করে পাখিদের কাছে ব্যর্থ ব্যাধের ধনুক_
মানুষের কাঁধটিকে বৃক্ষ জেনে বসে তারা এতো স্বাভাবিক;
এ কেমন?_ এমনও কি ভিটে হয় কারো এই পৃথিবীতে যার
বাড়ির গভীরে আছে সকলের বাড়িঘর এতোখানি নিয়ে;
এভাবে ওলান থেকে অবিরল দুধ ঝরে পড়ে যায়_ এতো
শব্দ কোন গ্রামে আমি কোন বিবরণের আর কখনো পাইনি;
কোথাও দেখিনি আর একটি পল্লীতে এতো অপেক্ষায় আছে
রাখালের মতো তার গ্রীবা তুলে মানুষের স্বপ্নের সময়।
এখানে এসেছি যেন পথই টেনে নিয়ে এলো এই পল্লীটিতে।
সকল পথের পথ পল্লীটির দিকে অবিরাম ঘুরে গেছে_
গিয়েছিল_ একদা যখন এই পল্লীটির কালো মাটি থেকে
একটি নতুন শিশু উঠে এসেছিল, আর এই পল্লীটিরই
পাশ দিয়ে মাটির দুধের মতো বহে যাওয়া নদীটিতে নেয়ে
ক্রমে বড় হয়েছিল আর চেতনার কামারশালায় বসে
মানুষের হাতুড়ি নেহাই লোহা প্রযুক্তির পাঠ নিয়েছিল,
সকল পল্লীকে তার আপনার পল্লী করেছিল। সেই তাঁরই
টগবগে দীর্ঘদেহ ছিল, মানুষ দেখেছে_ দেখেছিল তাঁকে_
বাংলার বদ্বীপব্যাপী কংকালের মিছিলের পুরোভাগে, তাঁকে
দেখেছিল চৈত্রের অগি্নতে তারা, আষাঢ়ের বর্ষণের কালে,
মাঘের শীতার্ত রাতে এবং ফাল্গুন ফুল যখন ঝরেছে,
যখন শুকিয়ে গেছে পদ্মা, আর যখন সে বিশাল হয়েছে;
যখন ষাঁড়ের ক্ষুর দেবে গেছে আর মাটি রক্তে ভিজে গেছে,
যখন সময়, আর ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি শুরু হয়ে গেছে
এখানে এসেছি যেন পথই টেনে নিয়ে এলো এই পল্লীটিতে।
টেনে নেবে পথ; যদিও অনেকে আজ পথটিকে ভুলে গেছে,
যদিও এইতো দেখি, কন্টিকারী ফেলে ফেলে পথটিকে কেউ
পথিকের জন্যে বড় দুর্গম করেছে এবং যদিও জানি
কেউ কেউ আমাদের পথের সম্বল সব খাদ্যপাত্রগুলো
মলভাণ্ডরূপে আজ ব্যবহার করে; বিষ্ঠায় পতিত হবে
অচিরে তারাই; আমি করতল থেকে খুঁটে খাবো; সঙ্গ দেবে
আমাদেরই পথের কবিতা; আমাদের প্রধান কবিকে যারা
একদিন হত্যা করে তাঁর জন্মপল্লীটিতে মাটিচাপা দেয়_
কতটুকু জানে তারা, কত ব্যর্থ? জেগে ছিল তাঁর দুটি হাত,
মাটি গভীর থেকে আজো সেই হাত_ পুরানোকথার মতো_
স্মৃতির ভেতর থেকে উচ্চারণমালা, নদীর গভীর থেকে
নৌকোর গলুই, পথিকের পদতল কাঁটায় রক্তাক্ত যদি,
সেই রক্ত শোধ হোক তাঁর কাছে ঋণ; মানব প্রসিদ্ধ কৃষি
খুব ধীরে কাজ করছে; পাখিরা নির্ভয়; আর আমিও পৌছেছি;
আমারই ভেতর-শস্য-টেনে নিয়ে এলো আজ আমারই বাড়িতে।

১৫ই আগষ্ট এর পটভূমি নিয়ে তথ্যচিত্র। (সৌজন্যেঃ সুলতান মির্জা)

 

২০ টি মন্তব্য : “১৫ ই আগষ্ট ১৯৭৫ – প্রেক্ষাপট”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    ১) রিলিফের গম, কম্বল চুরিকে তিরষ্কার করে বঙ্গবন্ধুর একটা ভাষণ শুনেছিলাম অনেক আগে। যেটা ভাবাচ্ছে সেটা হলো স্বাধীনতা পরবর্তী এই চুরি, আত্মসাৎ, লুটতরাজের মহোৎসবের শুরুটা কোথায়, কিভাবে সেটা নিয়ে কোন লেখা কি আছে? কেউ কি চিহ্নিত করতে পেরেছে?

    ২) চারপাশে নির্ভর করার মত লোকের সংখ্যা কমে আসছিলো উনার। শুধু মন্ত্রিসভা বা সচিবালয় দিয়ে কাজ চলে না, দেশ চালাতে অপরেটপর, কিংবা স্ট্রিট লেভেল ব্যুরোক্র্যাট লাগে এটা এখানে স্পষ্ট।

    ৩) "বড় বেশী আত্মবিশ্বাসী ছিলেন উনি" - এই কথাটা আমিও বলতাম। এখন সেটাকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করি। মানুষের বিলিফ সিস্টেম, ভ্যালুজ, এটিটিউড ইত্যাদি গড়ে উঠার পেছনে ডিরেক্ট এক্সপিরিয়েন্সের খুব বড় একটা ভূমিকা আছে, এবং উনার কথায় সেটা স্পষ্ট উঠে এসেছে। যেই মানুষটা এক দেশের সৃষ্টির মূল কারিগর তার মুখে, "....মারতে হলে আমাকে রাস্তাঘাটেও মারতে পারে। তবে কোন বাঙালী আমাকে মারতে পারে না।" এই কথাটুকু আপনাদের অনেকের কাছে (এমনকি লেখকের কাছেও) প্রবল/অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস লাগলেও আমি বলবো এটা উনার সংগ্রামী ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের সমষ্টিগত ফলাফল।

    ৪) ডিজিএফআই ব্যস্ত ছিল সর্বহারাদের নিয়ে এবং ভেতর থেকে কোন কিছু দানা বাঁধতে পারে সেটা ধরতে ব্যর্থ হওয়াটা ক্লাসিক কেইস অফ ইন্টেলিজেন্স ফেইলিউর হলেও দুটো বিষয় খেয়াল রাখা জরুরী।
    ক) সদ্য স্বাধীন দেশের আন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা সংস্থা ছিল ডিজিএফআই। এফবিআই, সিএইএ, কেজিবিদের মত এই মাঠের মহারথীরা কেটে যাওয়া ঘুড়ির মত গোঁত্তা খেয়ে পার করেছে যুগের পর যুগ তারপরে লক্ষ্য স্থির করে সামনে আগানোর শুরু করেছে। ১৯৭৫ এর ডিজিএফআই ও ২০১৩ এর ডিজিএফআই এর মাঝেই আকাশপাতাল ফারাক। কাজ কর্ম গোছানো।

    খ) নতুন কোন সংস্থা মোটামুটি দাঁড়াবার আগ পর্যন্ত বাহ্যিক শক্তি বা নিয়ন্ত্রক দ্বারা প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা সবসময়ই থেকে যায়। সেক্ষেত্রে ডিজিএফআইয়ের অপারেটররা (মাঠ কর্মী) কতটুকু ও কার প্রতি অনুগত ছিল সেটা জানার উপায় নাই।

    খারাপ লাগে। নিজেকে সবসময় গালি দেই যেই কারণে। আমরা জাতি হিসেবে লজ্জাশরম বিহীন, পশুবৃত্তি সম্পন্ন। সবাই সবার তালগাছ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। শেখ সাহেব ছিলেন ক্রস ফায়ারে।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      সহমত।
      তবে চুরির ব্যাপারে বলবো আমরা জাতিগত ভাবে চোর জাতি, দুর্নীতি গ্রস্থ জাতি ।
      এই যে পদ্মা সেতু.।
      আরে বাবা এই দেশে একটা সাকো বা অগভীর নলকূপ বসানোতে ঘুষ চলে- না!
      তাইলে?
      ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা রিলিফের গম চুরি করেন না!

      কোন এক এসি ল্যান্ডের অফিস বসে সন্ধ্যার সময়। টাকা পয়সা লেনদেন হয় তখন।

      বুয়েটে পড়তে থাকা পোলাপাইন একেক্জন সত্যের জন্য জান লড়াইয়া দেয়। চাকুরিতে গিয়া ঘুষ খায়।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)
        বুয়েটে পড়তে থাকা পোলাপাইন একেক্জন সত্যের জন্য জান লড়াইয়া দেয়। চাকুরিতে গিয়া ঘুষ খায়।

        ভালো একটা বিষয় খেয়াল করেছেন। শুধু বুয়েট না, যেকোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক কালের সত্যভাষী, সত্যরক্ষাকারী টাইপের ছাত্রগুলো সরকারী চাকুরীতে গিয়েই পল্টি নেয়। "সরকারী চাকুরী -- সিস্টেমের দোষ" বলে যে এক চমৎকার সোজা সাপ্টা প্যাথলজিকাল ব্যাখ্যা আমরা দেই আমার কেন জানি মনে হয় আরো কিছু আছে।


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
        • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

          মোকাব্বির বুয়েটিয়ান বলে বুঝাতে চাইছি তাদের প্রতিষ্ঠানে উল্টা হয় না।
          ঢাবিতে পয়সা নিয়া বা দিয়া অনেক সময় অনেক কিছু হইছে বলে শোনা যায়।

          এখানে বুয়াটিয়ান বলতে সততার একটা সিম্বল বুঝাতে চাইছি।

          আমার ভাগ্যএক্ষেত্রে ভালো যে আমি সায়েন্সের না। না হইলে কেউ আইসা আবার বলতো, হে, হে আপনি বুয়েটে চান্স পান নাই।

          মাহমুদ মিয়া বুয়েটের প্রডাক্ট।
          সিরাজ সিকদার ও বুয়েটের প্রডাক্ট।
          এমনি এই দুইটা উদাহরণ দিলাম।
          উদ্দেশ্য্মূলক কিছু না।


          এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

          জবাব দিন
          • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

            ভাই বুয়েট নিয়া কথা বলতে ভয় লাগে। বাঙলাদেশের পেডাগগিক জিসাস কিনা, তাই pH নিউট্রাল করার চেষ্টা করলাম। আমি তো সায়েন্সের। এইচএসসিতে এমন ডলা খাইসি যে বুয়েটে এপ্লাই করার রিক‌োয়ারমেন্টই পূরণ হয় নাই! 🙂


            \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
            অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

            জবাব দিন
  2. দিবস (২০০২-২০০৮)

    কর্নেল জামিলের লেখা ১টা বই আছে, মধ্য অগাস্ট এবং রক্তাক্ত ৭৫ টাইপ একটা নাম। বইটার সফট কপি পাইলে একটু আওয়াজ দিয়েন রাজীব ভাই। আর এই বইটা অনেক সুন্দর একটা বই। তবে এখানে আমার মনে হইছে, লেখক খালেদ মোশাররফ সম্পর্কে একটু পক্ষপাত করছে। খালেদকে তার প্রাপ্যটুকু দেয় নাই মনে হইছে। তবে এই বইএ ঐ সময় নিয়ে কাজ করবার মত অনেকগুলা ক্ল্যু আছে বইলা আমার মনে হইছে।


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎকার ও মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য পর্ব ০১


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎকার ও মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য পর্ব ০২


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  5. সিকদার তাহের আহমদ

    হেল কমান্ডো লিখেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর আনোয়ার হোসেন।
    ‘কর্নেল’ তাহের স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিলেন [দেখুন “ক্রাচের কর্নেল”, লেখক: শাহাদুজ্জামান]।

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      অসংখ্য ধন্যবাদ তাহের ভাই হেল কমান্ডোর লেখক বিষয়ক ভুল সংশোধন করে দেবার জন্য।

      কিন্তু কর্ণেল তাহের নিজে থেকে রেজিগনেশন দিলেও মনে হয় এর পিছনে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ র অভিপ্রায় ছিলো।
      শফিউল্লাহ র জবানীতে এরকম আছে যে, তাহের তার সাথে দেখা করে বলেন, স্যার আপনি তো সেনাবাহিনীকে সার্ভ করলেন ই । এখন রিটায়ার করে জিয়া কে সেনাপ্রধান হবার সুযোগ দিন। শফিউল্লাহ তাহের কে ধমক দেন এবং বলেন যে তুমি রিজাইন করো।

      আমার মনে হয় এটা হবার সম্ভাবনা আছে।
      তাহের সরল মনের এক দেশপ্রেমিক। সরল ভাবেই তিনি চিন্তা করতেন। জিয়া তার সরলতার সুযোগ নিয়েছে মাত্র। এছাড়া জিয়া পাকিস্থান সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স রিলেটেড ছিলেন। তবে জিয়া আর্থিক ভাবে সৎ ছিলেন। খুব সম্ভবত জিয়ার এই দিকটাই তাহের কে আকর্ষণ করেছিলো।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
  6. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড: সেই রাতের ঘটনা

    সুমন মাহবুব

    পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোররাত। ধানমণ্ডির বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে যান।

    যে ঘরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, তার বাইরের বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন মো. সেলিম (আব্দুল) ও আব্দুর রহমান শেখ (রমা)।

    ওপর থেকেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, “সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতিকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা।” পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে মহিতুল গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে চেষ্টা করতে থাকেন।

    ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করা মাত্রই বাড়িটি লক্ষ্য করে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়।

    একটু পরেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ঘুম থেকে ওঠে গৃহকর্মী আব্দুল আর রমা। বেগম মুজিবের কথায় রমা নিচে নেমে প্রধান ফটকের বাইরে এসে দেখেন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগুচ্ছে।

    রমা বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখেন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন।

    দোতলায় গিয়ে দেখেন, বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। রমা আর দোতলায় দাঁড়িয়ে না থেকে তিন তলায় চলে যান এবং বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে তোলেন। ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পড়ে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল আসেন দোতলায়।

    রমা দোতালায় শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে তোলেন। জামা-কাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে যান।

    ওদিকে গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি ...”। বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি।

    একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। কাচের এক টুকরায় মহিতুলের ডান হাতের কনুই জখম হয়। ওই জানালা দিয়ে গুলি আসতেই থাকে। বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন এবং মহিতুলের হাত ধরে কাছে টেনে শুইয়ে দেন।

    এর মধ্যেই গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, “এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছো ?” এ কথা বলেই বঙ্গবন্ধু ওপরে চলে যান।

    বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, “আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।” এ সময় শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নুরুল ইসলাম খান।

    ঠিক তখনই মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে। গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডস্ আপ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে যান নুরুল ইসলাম খান।

    কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, “আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনি ওদেরকে বলেন।” মহিতুল ঘাতকদের বলেন, “উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।”

    এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে লক্ষ করে বজলুল হুদা তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল। এর মধ্যে একটা গুলি মহিতুলের হাঁটুতে আরেকটা নুরুল ইসলামের পায়ে লাগে।

    এ অবস্থাতেই মহিতুলকে টেনে নুরুল ইসলাম তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তারা দেখেন, পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্য দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। অস্ত্রটা তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে ওই ঘরে ঢুকে বজলুল হুদা সবাইকে বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোর আদেশ দেয়।

    নিচে কী হচ্ছে তার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি দোতলায় তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে পান। তিনি তাকে বলেন, “জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।”

    তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, “সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।"

    জবাবে সফিউল্লাহ বলেন, “আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অফ দ্য হাউজ?”

    এদিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল জামিল তার ব্যক্তিগত লাল রঙের গাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশে রওনা হন। সঙ্গে ছিলেন নিজের গাড়িচালক আয়েনউদ্দিন মোল্লা। কিন্তু, পথেই সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। পালিয়ে বেঁচে যান আয়েনউদ্দিন।

    বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে মহিতুল, নুরুল ইসলাম, আব্দুল মতিন, পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যসহ অন্য সদস্যদের সারি করে দাঁড় করানো হয়। এর মধ্যে ঘাতকদের একজন পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যকে গুলি করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পড়ে যান।

    এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে ওপরে চলে যায়। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন।

    বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসলেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?”

    বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছে মহিউদ্দিন ঘাবড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি- বেয়াদবি করছিস কেন?” এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে।

    বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে। নিথর দেহটা সিঁড়ির মধ্যে পড়ে থাকে। সারা সিঁড়ি ভেসে যায় রক্তে।

    বঙ্গবন্ধুর পেছন পেছন রমাও যাচ্ছিলো। কিন্তু, ঘাতকরা তাকে ঘরের মধ্যে চলে যেতে বলে। এর মধ্যে দোতলায় শেখ রেহানার ঘরে থাকা তার চাচা শেখ নাসের ওই কক্ষে যায়। তার হাতে গুলি লাগার ক্ষত ছিলো। রমাই প্রথম বেগম মুজিবকে জানায়, বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা হয়েছে।

    এ সময় ওই ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, শেখ নাসের ও রমা। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিচে নেমে এসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

    এরপর পরই মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন তাদের সৈন্যসহ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসে। আজিজ পাশা তার সৈন্যদের নিয়ে দোতলায় চলে যায়। তারা বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা দরজায় গুলি করে। তখন বেগম মুজিব দরজা খুলে দেয় এবং ঘরের মধ্যে যারা আছে তাদের না মারার জন্য অনুরোধ করেন।

    ঘাতকরা বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে আসতে থাকে।

    সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই বেগম মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং চিৎকার দিয়ে বলেন, “আমি যাবো না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।”

    বেগম মুজিব নিচে নামতে অস্বীকৃতি জানান। ঘাতকরা শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যায়। আর, বেগম মুজিবকে তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বেগম মুজিবসহ বঙ্গবন্ধুর ঘরে আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন।

    বেগম মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায় পড়ে থাকে। বাঁ’দিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে গুলি লাগে। আর রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে যায় সুলতানা কামালের মুখ।

    শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদেরকে সবাইকে সঙ্গে লাইনে দাঁড় করানো হয়। এ সময় শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি তো রাজনীতি করি না। কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই।” ঘাতকরা একে অপরকে বলে, “শেখ মুজিব বেটার দ্যান শেখ নাসের।”

    এরপর তারা শেখ নাসেরকে বলে, “ঠিক আছে। আপনাকে কিছু বলবো না। আপনি ওই ঘরে গিয়ে বসেন।” এই বলে তাকে অফিসের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে নিয়ে গুলি করে। এরপর শেখ নাসের ‘পানি পানি’ বলে গোঙাতে থাকেন। তখন শেখ নাসেরের ওপর আরেকবার গুলিবর্ষণ করা হয়।

    লাইনে দাঁড়িয়ে শেখ রাসেল প্রথমে রমাকে ও পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?”

    মহিতুল জবাব দেয়, “না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।” এ সময় শেখ রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা মহিতুলের কাছ থেকে জোর করে তাকে দোতলায় নিয়ে যেতে বলে।

    আজিজ পাশার কথা মতো এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। রাসেলের চোখ বের হয়ে যায়। আর মাথার পেছনের অংশ থেতলে যায়। রাসেলের দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে।

    পুরো ঘরের মেঝেতে মোটা রক্তের আস্তর পড়ে গিয়েছিলো। এর মাঝেই ঘাতকের দল লুটপাট চালায়।

    বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দু'মেয়ে ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ও ছোট মেয়ে শেখ রেহানা সেদিন ছিলেন বেলজিয়ামে। শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন জার্মানি ছিলেন, সেখানেই বোনের কাছে গিয়েছিলেন রেহানা।

    ঘাতকদের প্রস্তুতি

    ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের যানবাহনগুলো সচল হয়ে ওঠে। ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণে অবস্থিত ইউনিট থেকে ১০৫এমএম কামানগুলোকে ভারি ট্রাক দিয়ে টেনে নির্মাণাধীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় নিয়মিত নৈশ প্রশিক্ষণের জন্য।

    রাত ১০টার দিকে সেনানিবাসের উত্তর প্রান্ত থেকে বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো ইউনিট থেকে বেরিয়ে পড়ে। এয়ারপোর্টে ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক একত্রিত হয়।

    রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রাশেদ প্রমুখ সেখানে জড়ো হয় ।

    ১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে মেজর ফারুক অফিসারদের নির্দেশ দেয় বিমান বন্দরের কাছে হেড কোয়ার্টারে স্কোয়াড্রন অফিসে মিলিত হতে। অফিসারদের আপারেশনের পরিকল্পনা জানায় মেজর ফারুক।

    সে-ই ছিলো এই অপারেশনের দায়িত্বে। প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর বাড়ি সরাসরি আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ওই বাড়িকে ঘিরে দু’টো বৃত্ত তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। আরো সিদ্ধান্ত হয়, ভেতরের বৃত্তের সদস্যরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করবে। বাইরে থেকে রক্ষীবাহিনী বা ভেতর থেকে সেনাবাহিনীর কোনো আক্রমণ এলে তা ঠেকানোর দায়িত্বে দেওয়া হয় বাইরের বৃত্তের সদস্যদের।

    এর দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর নূর ও মেজর হুদাকে। সিদ্ধান্ত হয়- তারা ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোড, সোবাহানবাগ মসজিদ এবং ৩২ নম্বর ব্রিজে রোড ব্লক করবে। প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর বাসা আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ধানমণ্ডিতেই শেখ ফজলুল হক মণি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণেরও সিদ্ধান্ত হয়।

    ডালিমকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণের সময় উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করেন মেজর ফারুক। কিন্তু, পূর্ব সম্পর্কের অজুহাতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণে উপস্থিত না থেকে স্বেচ্ছায় সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব নেয় ডালিম।

    ভারী মেশিনগান সংযোজিত দ্রুতগতির একটি জিপে রওনা দেয় ডালিম। সঙ্গে এক প্লাটুন ল্যান্সারসহ একটি বড় ট্রাক।

    শেখ মণির বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয় রিসালদার মোসলেমউদ্দিনকে। তার সঙ্গে দেওয়া হয় দু’প্লাটুন সৈন্য।

    এক কোম্পানি সেনাসহ রেডিও স্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউমার্কেট এলাকার দায়িত্বে থাকে মেজর শাহরিয়ার। একই সঙ্গে ওই গ্র“পকে বিডিআর থেকে কোনো ধরনের আক্রমণ হলে প্রতিহত করার দায়িত্বও দেওয়া হয়।

    ২৮ টি গোলাবিহীন ট্যাংক নিয়ে শের-ই বাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করার দায়িত্ব নেন মেজর ফারুক নিজে। তবে ট্যাংকের মেশিনগানগুলোয় প্রচুর গুলি ছিলো।

    মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের জন্য ১২টি ট্রাকে সাড়ে তিনশ’ সাধারণ সৈনিককে তৈরি করা হয়।

    মেজর রশিদের সরাসরি কোনো আক্রমণের দায়িত্ব ছিলো না। তার দায়িত্ব ছিলো হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমন্বয় করা।

    তার নেতৃত্বে থাকা ১৮টি কামান গোলা ভর্তি করে যুদ্ধাবস্থায় তৈরি রাখা হয়। কামানগুলো রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং বঙ্গবন্ধুর বাসা লক্ষ করে তাক করা হয়। একটি মাত্র ১০৫ এমএম হাউইটজার কামান রাখা হয় আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিনের অধীনে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে লেকের পাড়ে।

    দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর সবাইকে তাজা বুলেট ইস্যু করা হয়। ঘাতকের দল বিমানবন্দর এলাকা থেকে ভোররাত ৪ টার দিকে ধানমণ্ডির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। ফারুকের নেতৃত্বে ২৮ টি ট্যাংক বিমানবন্দর সড়কে বনানীর এম.পি. চেকপোস্ট দিয়ে সেনানিবাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর মধ্যে ফজরের আজান পড়ে যায়।

    ফারুক তার ট্যাংক নিয়ে ৪৬ ব্রিগেড ইউনিটের লাইনের একেবারে ভেতর দিয়ে বাইপাস সড়ক ধরে সেনাসিবাসের প্রধান সড়কে চলে আসে। ঢাকা সেনানিবাসে সে সময়ে বিমানবাহিনীর যে হেলিপ্যাড ছিলো, তার ঠিক উল্টো দিকের একটি গেট দিয়ে ফারুক তার ট্যাংক নিয়ে বিমানবন্দরের (পুরনো বিমানবন্দর) ভেতর ঢুকে পড়ে। এ সময় ফারুককে অনুসরণ করছিলো মাত্র দু’টি ট্যাংক। বাকি ট্যাংকগুলো পথ হারিয়ে জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে ফার্মগেটের দিকে এগুতে থাকে।

    ফারুক এয়ারপোর্টের পশ্চিম দিকের দেয়াল ভেঙে রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সামনে উপস্থিত হয়।

    রাত সোয়া ৫ টার দিকে মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের নেতৃত্বে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাসা আক্রান্ত হয়।

    শেখ মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা করে ঘাতকরা। প্রাণে বেঁচে যান শেখ মণির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।

    ডালিমের নেতৃত্বে হত্যা করা হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বেবী, ১২ বছরের ছেলে আরিফ, চার বছরের নাতি বাবু (আবুল হাসনাত আবদুল্লার ছেলে), ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে আবদুল নইম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমুর খালাতো ভাই), তিন অতিথি এবং চার জন গৃহকর্মীকে।

    দাফন

    পরের দিন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার আব্দুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর লাশ ছাড়া ১৫ আগস্টে নিহতদের লাশ দাফন করেন। আব্দুল হামিদ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে কফিনে নিহতদের লাশ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে শেখ মণি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের সদস্যদের লাশ সংগ্রহ করে বনানী গোরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করেন।

    বনানী কবরস্থানে সারিবদ্ধ কবরের মধ্যে প্রথমটি বেগম মুজিবের, দ্বিতীয়টি শেখ নাসেরের, এরপর শেখ কামাল, সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, শেখ রাসেল, ১৩ নম্বরটি শেখ মণির, ১৪ নম্বরটি আরজু মণির, ১৭ নম্বরটি সেরনিয়াবাতের আর বাকি কবরগুলো সেদিন এই তিন বাড়িতে যারা মারা গেয়েছিলেন তাদের। ১৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গীপাড়ায়। সেখানে তাকে দাফন করা হয় তার বাবার কবরের পাশে। সেনাবাহিনীর ওই হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লে. শমশের আলী।

    সূত্র: বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দেওয়া এ এফ এম মহিতুল ইসলাম, আব্দুর রহমান শেখ (রমা), মো. সেলিম (আব্দুল), অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার মো. কুদ্দুস শিকদার, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল হামিদ, সাবেক সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ, আয়েনউদ্দিন মোল্লা (সোবহানবাগে নিহত বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনের গাড়িচালক) এর সাক্ষ্য এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল হামিদের বই ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।