বেদনার সব কথা মানুষ বলে না!
– আহসান কবির (১/১৭; বিসিসি)
প্রিয় মাহবুব
তুই পড়বিনা জানি,তবু এই চিঠিখানা পাঠিয়ে দিলাম!
ফেসবুক আর এসএমএসের যুগে আজকাল আর কেউ চিঠি লেখে নারে মাহবুব। তুই না ফেরার দেশে চলে যাবার মাসে(২৮ ফেব্রুয়ারি,২০০৯) আকাশের ঠিকানায় তোকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলাম। শপথ নিয়ে বলেছিলাম,মাহবুব তুই বিশ্বাস কর,আমি আর কখনো পিলখানা যাব না। ঠিক এক বছর পর তোকে আরো একটা চিঠি লিখেছিলাম। তুই পড়বিনা,উত্তর মিলবে না,নিশ্চিত ভাবেই জানি! তবু শেষ(সম্ভবত,কারণ এর বেশি আর কিছুই আমি করতে পারছি না) চিঠিটা পাঠাচ্ছি। আমি আমার কথা রেখেছি। আমি আর কখনো পিলখানাতে যাই নি মাহবুব।
তুই না ফেরার দেশে চলে যাবার পর সাড়ে চার বছরের বেশি সময় পার করেছে বাংলাদেশ। ঘটনা বহুল এই দীর্ঘ সময়ে বিডিআর সদস্যদের নির্মমতায়(যারা বলে বিডিআর বিদ্রোহ,তাদের সামনে পেলে একহাত দেখে নিতাম) যেমন নিহত হয়েছিল তুই সহ চুয়াত্তর জন, এই দীর্ঘ সময়ে যেমন মারা গিয়েছেন প্রবীন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান,তেমনি ভাবে মারা গিয়েছে তোর মত একই সময়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া মেজর হুমায়ুন কবীর পাবলোর ছেলে ঋত্বিক,মারা গেছে তোর একমাত্র মেয়ে ফাইজাও। পাবলো,যে কিনা মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে পড়তো,সুন্দর ছবি আকতো বলে যার শিক্ষক বাবা তার নাম রেখেছিলেন পাবলো(পাবলো পিকাসো কখনো জানবেন না,কী সীমাহীন নির্মমতায় তার এক অনুসারীকে হত্যা করা হয়েছিল) সেই পাবলোর ছেলেটা(ঋত্বিক) জন্মেছিল চির অসুস্থ হয়ে। তোর সাথে পাবলোর এইটুকুই মিল,তোর মেয়ে ফাইজাও জন্মেছিল চির অসুস্থ হয়ে। ঋত্বিকের মতো ফাইজা মারা গেছে জেনেও গত সাড়ে চার বছরে তোর পরিচিত অনেককে,বরিশাল ক্যাডেট কলেজের তোর ক্লাশমেটদের সবার কাছে জানতে চেয়েছি,কেমন আছে ফাইজা! বেদনার সব কথা মানুষ বলে না মাহবুব। সব বেদনার কথা জানতে চাওয়াটাও বোধ করি ঠিক না!
গত সাড়ে চার বছরে আমরা আরো “না মানুষ”হয়েছি মাহবুব। রাজনীতি,প্রাপ্তি আর ক্ষমতার লোভে আমরা আর মানুষ থাকছিনা, ক্রমশঃ আওয়ামী লীগ আর বিএনপিতে বিভাজিত হচ্ছি! এই বিভাজনের মধ্যে পড়েছে তুই সহ চুয়াত্তর জন মানুষের হত্যাকান্ড। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর এত অফিসার নিহত হন নি! শুরু থেকেই এটা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়! দলবাজির স্বার্থে যা যা প্রচার করা হয় তা এমন
এক. বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মনোবল ধ্বংস এবং সেনাবাহিনীকে হতোদ্যম করার জন্য মেধাবী অফিসারদের একসাথে জড়ো করা হয় বিডিআরে পোস্টিং দেয়ার নামে। এরপর তাদের হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ড ঘটেছে সরকারের প্ররোচনায়। এরসাথে শেখ হাসিনা,ফজলে নুর তাপস,জাহাঙ্গীর কবীর নানক,মির্জা আজম সহ সাবেক সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদ এবং আরো কয়েকজন সেনা অফিসারকে দায়ী করা হয়। এ রকম প্রচারনামূলক মিথ্যে প্রপাগান্ডা শুরু থেকে ছড়ানো হয়েছে,এখনও বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইনে কোন না কোনভাবে এমন প্রচারনা চলছে। সেনাবাহিনীর ভেতরেও এমন প্রচারনা চালানো হয়েছে। ফজলে নুর তাপসকে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে এবং যারা অভিযুক্ত হয়েছিলেন তারা সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার।
দুই. আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি সরকার কখনোই এমন ষড়যন্ত্রের সাথে থাকতে পারে না। আসলে বিডিআর হত্যাকান্ডের নামে শেখ হাসিনাকে হত্যা ও সরকার ফেলে দেবার ষড়যন্ত্র ছিল এটি যা আওয়ামী লীগ মহান আল্লাহ তায়ালার ইশারায় অত্যন্ত বিচক্ষনতার সাথে মোকাবেলা করেছে।
তিন. বিডিআর হত্যাকান্ডকে অনেকেই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সাথে তুলনা করেছিলেন এবং এই হত্যাকান্ডের প্রথম দিন (২৫ ফেব্রুয়ারি,২০০৯) এক রকম মিডিয়া ক্যু হয়েছিল। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো এমন খবর প্রচার করেছিল যার সারমর্ম হচ্ছে বিডিআর সৈনিকদের প্রতি সীমাহীন অত্যাচার করা হয়েছিল যার পরিনতি এই হত্যাকান্ড। সৈনিকদের কথিত বিদ্রোহটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে সেনা অফিসারদের নামে কলঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল। ঠিক পরদিনই গা বাচাতে মিডিয়া তাদের চরিত্র পাল্টে ফেলে এবং একসাথে এত অফিসারকে মেরে ফেলার ব্যাপারটাকে সামনে নিয়ে আসে।
চার. মাহবুব তুই নিজে এসেছিলি মিশন থেকে। পচিশ ফেব্রুয়ারি তোর বিডিআরে জয়েন করার কথা ছিল। বিডিআরের নতুন পোশাকটা পড়ে তুই অপেক্ষা করছিলি। দরবার শেষ হবার পর নিয়ম অনুযায়ী কমান্ডিং অফিসারের কাছে রিপোর্ট করে বিডিআরে তোর যাত্রা শুরু করার কথা। সেই তোকে ষোল রাউন্ড বুলেটে বিদ্ধ করার আগে কারো বুক কাপলো না? মাহবুব কী দোষ ছিল তোর? ঠিক একই ভাবে অফিসারদের স্ত্রী কিংবা ছেলে মেয়েদের কী দোষ ছিল? যে দোযখ তাদের জীবনে সেদিন নেমে এসেছিলো,আমৃত্যূ সেটা দুঃস্বপ্ন হয়ে তাদের তাড়িয়ে বেড়াবে।
কিন্তু এই মানুষগুলো যারা সে সময়ে পিলখানায় উপস্থিত ছিলেন, বিডিআর হত্যাকান্ড নিয়ে যে মামলা হয়েছিল(যার রায়ও হয়েছে)সেই মামলার সাক্ষী হিসেবে কী তাদের ডাকা হয়েছিল? তারা কী স্বাক্ষী দিতে গিয়েছিলেন নাকি এটাকে এক ধরনের হ্যারেসমেন্ট মনে করে তারা সাক্ষ্যই দিতে যান নি? মাহবুব এই ঘটনা ঘটে যাবার আগে ও পরে আরো বহু প্রশ্নের উদয় হয়েছিল। মামলার রায় হয়েছে,রায়ে একশ বায়ান্ন জনের ফাঁসি হয়েছে কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর কী পেয়েছি আমরা? অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি তবু প্রশ্নগুলো তোর কাছেই পাঠিয়ে দিচ্ছি
এক. বিডিআর জওয়ানদের অনেকে জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন তারা নিজেরা মিটিং করতেন। এরপর তাদের দাবী দাওয়া গুলো তারা জনপ্রতিনিধিদের জানানোর পরিকল্পনা করেন ২০০৮ এর নভেম্বর ডিসেম্বরে। তখন সারাদেশ নির্বাচনী জোয়ারে মাতাল। তখন তারা আওয়ামী লীগ নেতা ফজলে নুর তাপস ও নাসির উদ্দীন পিন্টুর সাথে যোগাযোগ করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ল্যান্ড স্লাইড বিজয় হলে তারা আবারো ফজলে নুর তাপসের সাথে যোগাযোগ করেন। তাপসের বক্তব্য ছিল এটা তার দেখার ব্যাপার নয়। এরপর তারা শেখ সেলিম ও প্রতিরক্ষা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।
বিডিআর ষড়যন্ত্রকারীদের এই যোগাযোগ নিয়ে তখন কেউ মাথা ঘামান নি কেন? যাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল তাদের কেউ কি তখন গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা সরকারকে অবহিত করতে পারতেন না?
দুই. বিডিআর ষড়যন্ত্রকারীদের একেবারে ‘কোর’ গ্রুপের সদস্যরা তাদের দাবী দাওয়া নিয়ে লিফলেট বের করেছিল যা ছড়িয়ে দেয়া হয় পিলখানায়। মেজর জেনারেল শাকিল সহ অনেক অফিসাররা এই লিফলেটের ব্যাপারে জানতেন। তারা কি উপর মহলে জানিয়েছিলেন? গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কী সবসময় ঘুমিয়েই থাকে? জেনারেল শাকিল পাল্টা লিফলেট ছাপিয়ে সেটা বিলি করতে চেয়েছিলেন সেটা করেন নি কেন?
তিন. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমনের তারিখ প্রথমে ১৩, পরে ১৮ এবং সবশেষে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এ নির্ধারন করা হয়। কেন তারিখ বদল করা হয়েছিল? বিডিআর সৈনিকদের এই যে ষড়যন্ত্র ভাব সেটা কী প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছিল? এই ‘ষড়যন্ত্র উন্মুখ’ পরিস্থিতিতে কেন তাকে বিডিআর সদর দফতরে আমন্ত্রন জানানো হয়? কেন একজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা,যিনি ডিজিএফআই থেকে আনসারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন,কেন তিনি ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সশস্ত্র অবস্থায় সেখানে গিয়েছিলেন?
চার. সাধারণত. একজন সেনা অফিসার ‘কোথ (যেখানে অস্ত্র থাকে) পাহাড়ার জন্য কোথে অবস্থান নেন না। তখনই এর প্রয়োজন পরে যখন কোন বিশেষ পরিস্থিতির তৈরী হয়। যেমন ১৯৯৬ সালের মে মাসে যখন জেনারেল নাসিম কে সেনাপ্রধানের পদ থেকে বহিস্কার করেন সে সময়কার রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস, যখন ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক নেমেছিল, সেই পরিস্থিতিতে অফিসারদের কোথ পাহাড়ায় সরাসরি নিযুক্ত করা হয়েছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে এই দায়িত্বে ছিলেন মেজর মোকাররম। বিডিআর হত্যাকান্ডের সময় মোকাররম প্রাণে বেঁচে যান। ২৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে এই দায়িত্বে ছিলেন মেজর আব্দুস সালাম খান। পরদিন দরবার শুরু হবার আগেই অর্থাৎ ৮:৩০ মিনিটের দিকে মেজর সালামকে বেঁধে ফেলে অস্ত্র ও গুলি লুট করে সৈনিকরা। সম্ভবত: মেজর সালাম কে তখনই হত্যা করা হয়। এই খবর টি কী দরবারে উপস্থিত কেউ জানতে পেরেছিলেন?
পাঁচ. ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এ দরবার হলে হত্যাকান্ড শুরু হবার পর বিডিআর ষড়যন্ত্রকারীরা ৫৭ জন অফিসার ও ২ জন সৈনিকের মধ্যে প্রথম দফায় কয়জন কে হত্যা করা করেছিল? ক’জন কে মারা হয় পরে? এদের কে কী বাঁচানো যেত না? কেন কোন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি বা নেয়া যায় নি?
ছয়. সকাল ১০.৩০ মিনিটের ভেতর বিডিআর পাঁচ নম্বর গেটের সামনে উপস্থিত হয়েছিল র্যাব। যদি আর্মি বা র্যাবের ক্র্যাকডাউন হতো তাহলে কী ঘটতো? হাজারো লোক মারা যেত নাকি সর্বকম লোক ক্ষয়ে আরো কিছু প্রাণ বাঁচানো যেত? এই বিতর্ক কী কখনো শেষ হবে না?
সাত. পরিবার পরিজনদের কী ২৪ ফেব্রুয়ারিই সরিয়ে দিয়েছিল বিডিআর সৈনিকরা? যদি সত্যি হয় তাহলে এটি কী কারো চোখেই পড়েনি?
আট. বিডিআর সৈনিকদের একটি দল ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। কতোজন অফিসার কে তারা মেরে এসেছে সে কথা কী তখন জানতে চাওয়া হয়েছিল? ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে যখন প্রথম অস্ত্র সমর্পন করে সৈনিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে, তখনও তিনি কী জানতে চাইতে পারতেন না? এরপর তিনি কিছু অফিসারদের পরিবার কে উদ্ধার করে আনেন। সবাইকে তখন উদ্ধার করার স্টেপ নেন নি কেন? সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করা, আবার ক্ষমাপ্রাপ্তদের বিচারের সম্মুখীন করা কি দ্বিমুখী নীতি না?
নয়. রায় ঘোষনার আগেই অর্থাৎ বিচার চলাকালীন সময়ে ৬৯ জন বিডিআর সৈনিক মারা গেছেন। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। কোন কিছু লুকোনোর জন্য কী এদের মেরে ফেলা হলো?
দশ. বিদ্রোহ,বিষ্ফোরক, হত্যা, নিপীড়ন ও লুটের মামলা হয়েছিল এবং সাধারণ আইনে বিচার হয়েছে। বিচারে সাক্ষী একটা ভাইটাল ব্যাপার। অনেকেই বলেছেন সাক্ষী দেওয়াটাকে এক ধরনের হ্যারেসমেন্ট হিসেবে দেখছেন নিহত অফিসারদের আত্মীয় স্বজন। অনেকেই সাক্ষী দেন নি। সাবেক স্বরাষ্টমন্ত্রী সাহারা খাতুন,পুলিশের আইজি ও মন্ত্রীরা সাক্ষী দিয়েছেন। সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ কিংবা উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা কিন্তু সাক্ষ্য দেন নি। কেন?
এগার. পচিশ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই বাঁচার জন্য অনেকে বিভিন্ন জায়গায় রিং করেছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরাও এখানে সেখানে মোবাইল থেকে রিং করেছিল? মোবাইল কল লিস্ট ও কথোপকথন কী রেকর্ড করা হয়েছিল?
বার. বিডিআর হত্যাকান্ডের পর প্রধানমন্ত্রী যখন শোকে মুহ্যমান সেনা অফিসারদের সাথে সেনাকুঞ্জে কথা বলতে যান তখন কেউ কেউ হয়ত প্রধানমন্ত্রীর সাথে অফিসার সুলভ ব্যবহার করেন নি। কোন কোন অফিসারকে কী শুধুমাত্র এই কারণেই চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল? যদি তেমনটি ঘটে থাকে তাহলে মোট কতজন অফিসার চাকরি হারিয়েছিলেন?
তের. পিলখানা হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া ও রায় সম্পর্কে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নাভি পিল্লাই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। এই হত্যাকান্ডে আটশ ছিচল্লিশ জনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিচারে একশ বায়ান্ন জনের ফাঁসি,একশ একষট্টি জনের যাবজ্জীবন,দশ বছরের কারাদন্ড সহ দুই শ ছাপ্পান্ন জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। দুইশ সাতাত্তর জনকে খালাস দেয়া হলেও তারা মুক্তি পান নি। এদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে বিষ্ফোরক মামলা রয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন,
“একসঙ্গে এত লোকের বিচার অবশ্যই একটি জটিল ব্যাপার। তার ওপর এর সঙ্গে জড়িত আছে বিরাট এক আবেগ। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর বিরুদ্ধে এ হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে । এসব কারণে বিচার-প্রক্রিয়ায় কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকতে পারে। সেই ত্রুটি থাকলে নিরপরাধ ব্যক্তি যেমন শাস্তি পেতে পারেন, তেমনি উচ্চ আদালতে আপিল করে প্রকৃত অপরাধীও ছাড়া পেতে পারেন। তিনি আরো বলেন, বিচার চলাকালে মানবাধিকার কমিশনের কাছেও পদ্ধতিগত ত্রুটির কিছু অভিযোগ অনেকবার এসেছে। কিন্তু কমিশন এসব অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নিরুপণ করেননি। তবে অভিযোগগুলো থেকে মনে হয়, হয়তো বিচারকাজে কিছুটা তাড়াহুড়ো করা হয়ছে। সে কারণে অনেকে আত্মপক্ষ সর্মথনের যথাযথ সুযোগ না-ও পেতে পারেন।”
চৌদ্দ. অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপপরিচালক পলি ট্রুসকট বলেন,
“রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিফলিত হয়নি। এ রায় বাস্তবায়িত হলে তা হবে আরও ১৫২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা।”
ট্রুসকট আরো বলেন,
“২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির ওই দুই দিনের ঘটনা নিঃসন্দেহে র্মমান্তিক। এতে বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এটি বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের র্কতৃপক্ষ ওই ঘটনার একটি সুষ্ঠু বিচার চায়। কিন্তু এতগুলো মানুষের মৃত্যুদণ্ড শুধু দুর্ভোগই বাড়াবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রায়টি হয়েছে নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”
পনের. আর্ন্তজাতিক সংবাদ মাধ্যম সিএনএন এর ব্লগে জনৈক বিশ্লেষক লিখেছেন,পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ষড়যন্ত্র করে বিডিআর হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন। সাবেক বিডিআর মহাপরিচালক ফজলুর রহমানকেও সাকা চৌধুরী নাকি কয়েক কোটি টাকা দেন এবং তিনিও নাকি ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন! ফজলুর রহমান নাকি কয়েকজন বিডিআর সদস্যকে লাখ টাকা করে দিয়েছিলেন এই হত্যাকান্ড ঘটানোর জন্য!
মাহবুব কার কথা বিশ্বাস করি বল? এছাড়া হাইকোর্ট কিংবা সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার রায় কী বহাল থাকবে? অন্যদিকে সারা পৃথিবী কী এই রায় নিয়ে সমালোচনা মুখরই থেকে যাবে? কেউ কেউ কী এমন করে বলবে যে এই রায়ে সেনাবাহিনী খুশি সুতরাং আর কোন অসুবিধে নেই! বিএনপি তথা বিরোধী দল রায় নিয়ে কোন মন্তব্য করে নি। পুরো ঘটনার চেয়ে বিএনপির কাছে কী নাসিরউদ্দীন পিন্টুই বড় হয়ে গেল? রাজনৈতিক হয়রানির জন্য পিন্টুকে এই শাস্তি দেয়া হয়েছে,ব্যস এতটুকুই কী সব? নাকি খালেদা জিয়াকে ঘরছাড়া করে সেখানে যে সেনা অফিসারদের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে,সেখানে নিহতদের স্বজনকে অ্যাপার্টমেন্ট দেয়াটাই অনেক কিছু? মাহবুব তুই বল এই প্রশ্নের উত্তর কী কখনো মিলবে? নাকি এটাই বড় সত্য যে বেদনার সব কথা মানুষ বলে না?
নাকি হেলাল হাফিজের সেই মনকাড়া লাইনটাই সত্য? গিয়ে থাকলে আমার গেছে কার কী তাতে? ডাউন সিনড্রোম বেবি হিসেবে ফাইজার জন্ম,তোর মৃত্যুর পরে ফাইজারও চলে যাওয়া, তোর বউ এর দুঃখ আর তোকে হারানোর যে বেদনা তোর স্কুল শিক্ষিকা মা পেয়েছেন, আমরা কখনো তা স্পর্শ করতে পারব না। ক্যাডেট কলেজের সবগুলো অনুষ্ঠানের আনন্দ আয়োজন জীবনের নিয়মেই চলবে,তবু তোর কথা আমাদের ঠিকই মনে পড়বে! আমরা কখনোই হয়ত আসল সত্য জানবো না কেন এই হত্যাকান্ড ঘটেছিল! সেটা কী দেশী ও আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্রের মিশেল নাকি মাথা গরম কিছু অশ্লীল সৈনিকদের মুহুর্তের অসাবধানতা?
মাহবুব আমরা হয়ত অনেক কিছুই জানি না। জানি না বিচারের রায়ে তুই খুশি হয়েছিস কিনা। তুই যেখানে আছিস সেখানে কী বৃষ্টি নামে? রঙধনু ওঠে? কেউ বাংলায় কথা বলে? দুঃখ পেলে ফাইজা কী তোর বুকে মাথা রেখে কান্না করে? কেউ আমার মত চিঠি লেখে?
তুই পড়বিনা জানি,তবু এই চিঠিখানা পাঠিয়ে দিলাম!
ইতি
আহসান কবির
(মাহবুব ছিল বরিশাল ক্যাডেট কলেজের ফোর্থ ব্যাচের ক্যাডেট। ১৯৮৭ সালে সে এইচএসসি পাশ করেছিল। পরের বছর সে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। সর্বশেষ সমরাস্ত্র কারখানায় পোস্টিং ছিল মাহবুবের। সেখান থেকে সে ফরেন মিশনে যায় এবং ২০০৯ সালের শুরুতেই ফিরে আসে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সে বিডিআরে যোগদান করতে যেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নিহত হয়)
পাদটীকাঃ (লেখাটা একটি সাপ্তাহিকে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল)
সূত্রঃ ছবিগুলো মেজর মাহবুব আওয়ার প্রাইড পেইজ থেকে নেয়া হয়েছে।
উপরের প্রথম ছবিগুলোয় বিভিন্ন সময়ে মাহবুব ভাইএর ছবি।
শেষ ছবিগুলোর প্রথমে মাহবুব ভাইএর কবর সাভারে তার বাড়িতে, মাহবুব ভাই এর পকেটে পাওয়া কিছু স্মৃতি, হাতঘড়ি, মাহবুব ভাইএর গাড়িটি বিডিআর সদস্যরা পুড়িয়ে দেয়।
আমারা টুয়েলভ ফিল্ড রেজিমেন্টে একসাথে ছিলাম কিছুকাল। তখনই ঘনিষ্টতা হয় মাহবুবের সাথে।
পরেও যখনই দেখা হয়েছে, দীর্ঘ্যক্ষন আলাপচারিতা হতো।
অজ্ঞাত এক কারনে চমৎকার এক কেমিস্ট্রি ছিল মাহবুবের সাথে। এরকম হয় কারো কারো সাথে।
পিলখানায় আসার পরেও দেখা ও কথা হয়েছে।
ছ'বছর হলো মাহবুব নাই, কিন্তু আমরা আছি - কিভাবে সম্ভব?
পিলখানা ঘটনা নিয়ে কোন লিখা পড়া তো দুরের কথা, খুলিও না। এটা খুললাম মাহবুবের ছবি দেখে। এখন মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকবে দীর্ঘক্ষন।
পিলখানা ঘটনার কথা মনে এলেই নিজের সাতান্ন বার সাতান্ন রকমের মৃত্যর অভিজ্ঞতা ভেসে ওঠে চোখে, মনে।
তাই আমি পিলখানা ঘটনা নিয়ে লিখা কোন কিছু পড়তে পারি না।
এই লিখাটা পড়তে না পারায় আমি ক্ষমাপ্রার্থি।
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
🙁
::salute::
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ