# এই লেখাটি বাংলাদেশ হতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী সকল “ব্লু হেলমেটধারী”দের জন্য উৎসর্গকৃত যাঁরা শান্তির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের ঝুঁকি নিয়ে জাতিসংঘের পক্ষে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন।
-
২২ মে ২০……
৮। জুবা এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছি…মনের মাঝে গান বাজছে… “যখন সময় থমকে দাঁড়ায়…” এই দেশে আর যাই হোক, সময়ের কোন অভাব নেই মনে হচ্ছে। একজন করে আসছে…আমাদের কাগজপত্র দেখছে…তারপর অ-নে-ক-ক্ষ-ণ অপেক্ষার পরে আরেকজন আসছে। আবার তাদের একেকজনের কি তেজ!! এমনিতে তো আর বলে না… “ঢাল নেই, তলোয়ার নেই…নিধিরাম সর্দার”!! তবুও মনে হচ্ছে, কেবলমাত্র বাংলাদেশী বলেই আমাদের ইমিগ্রেশনের সময়ে তেমন বেশী ঝামেলায় পড়তে হয়নি। মুভকনের লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মেসবাহ্ জানালো…বাংলাদেশী কন্টিনজেন্ট এবং স্টাফ অফিসার/ এমএলও-দের সাথে না কি মোটামুটি সাউথ সুদানিজ সবারই খুব ভাল সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে। দু’একজন তো “বন্দু টুমি বাল আচো” পর্যন্ত বললো!!
৯। থাকার বন্দোবস্তের বিষয়ে আমরা আগেই নিজেদের মাঝে ঠিক করে নিয়েছিলাম… “যার যার তার তার…আব্দুস সাত্তার”!! এটি আমাদের এবার একসাথে মিশনে আসা সব এমএলওদের মাঝে বহুল প্রচারিত স্লোগান… যার মানে হলো- থাকার জন্য ট্রানজিট ক্যাম্প কিংবা খোলা ময়দান…যেটাই হোক না কেন… নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। আর, খাওয়ার হ্যাপা তো আছেই!!! আমার আগেই এখানে মিশনে আসা স্টাফ অফিসার…(নেভীর কমান্ডার মেহেদী স্যার) অবশ্য ব্যানএফএমইউ এর বর্তমান কন্টিনজেন্ট কমান্ডার-এর সাথে আমার ব্যাপারে আগেই কথা বলে রেখেছিলেন…আমি নিজেও স্যারকে ফোন করেছিলাম। আর, আমার কোর্সমেট তো আছেই! ফলে, অন্যত্র বদলী না হওয়া কিংবা এখানে বদলী হলেও নিজের রুম না পাওয়া পর্যন্ত থাকা এবং খাওয়ার বিষয়টা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেল। স্যারদের কাছে এই বিষয়টা আপাতঃদৃষ্টে খুব সামান্য একটা উপকার মনে হলেও আমার জন্য এটা যে কত বড় একটা সাহায্য…সেটা বুঝিয়ে বলা যাবে না… ইনশাআল্লাহ্ অন্য কোন কিছু দিয়ে পুষিয়ে দিতে হবে আর কি!!
১০। এখানকার (ব্যানএফএমইউ-এর) অন্য অফিসার/ স্টাফরা দেখি সাহায্য করার দিক দিয়ে আরেক কাঠি সরেস!! আমার জন্য এক সিনিয়র জেসিও একটা চিরকুট নিয়ে আসলেন…ব্যাখ্যা করে জানালেন…এটা ইন্টারনেটের প্যাকেজ। এই কন্টিনজেন্ট-এ ইন্টারনেট লাইন আছে…ওয়াই-ফাই পাসওয়ার্ড সম্বলিত… আমাকে সেখান থেকে ৬ জিবি-এর একটা ইন্টারনেট প্যাকেজ দিয়ে দেয়া হলো…এবং এটাই না কি রেওয়াজ!! আলহামদুলিল্লাহ্!!
১১। এই মিশনে মনে হয় আমার ওজন লিমিটের মধ্যে চলে আসবে…এমনিতে আমি আবার একটু “ইয়ে”… মানে, “কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত” ওজনধারীদের দলভুক্ত। কেবলমাত্র ডিমভাজি-আলুভর্তা-ডাল খেয়েও একটা মানুষ কিভাবে নিজের ওজন ধাঁইধাঁই করে বাড়িয়ে নিতে পারে…আমি সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারি! তবে, শুনেছি…সাউথ সুদানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাবার দাবারের বেশ টানাটানি। কাজেই, এটাই আমার ওজন কন্ট্রোলে আনার সুবর্ণ সুযোগ!! রোজা রাখলে আমার শরীরের তেমন ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়না… যতটা মনের সংযম হয়। এখন রোজার মাস চলছে বিধায় বুঝতে পারছি…রোজা রাখলে শারিরীকভাবে আমার তেমন কোন সমস্যা হবে না। যদি এখানকার বিরান অঞ্চলে বদলী হয়…আর খাওয়া-দাওয়ার সাপ্লাই চেইন এলোমেলো হয়ে যায়, তাহলে রোজা রাখা শুরু করবো নাকি?? কি বলে ফ্রান্স??
২৭-২৯ মে ২০……১২। আনমিস (ইউনাইটেড নেশনস মিশন ইন সাউথ সুদান)-এর ট্রেনিং শুরু হয়েছে…দুনিয়ার সব ট্রেনিং-ই কি এইরকম একঘেঁয়ে হয়? তাও ভাল, বাংলাদেশের ইলিয়াস ভাই আছেন…মাঝে মাঝে বাংলায় কথা বলা যায়!! মুকিত আর ফয়সাল অন্য কন্টিনজেন্টে থাকে বলে অফিস টাইমের পরে তেমন যোগাযোগ করা হয় না। অবশ্য এখনও আরেক আতংকের বিষয় বাকী রয়ে গিয়েছে…ড্রাইভিং টেস্ট!!
১৩। “ধ্যাত্তেরিকা”!! মনটা ভীষণ খারাপ… ড্রাইভিং টেস্টে ডাব্বা মেরেছি। সামান্য একটা ড্রাইভিং টেস্ট পাশ করতে পারলাম না… এটা কোন কথা হলো!! অবশ্য নিজেকে পুরোপুরি দোষও দিতে পারছি না…দেশে প্রাকটিস করেছি প্রাইভেট কার আর টয়োটা ফোর সিটেড জীপ দিয়ে…এখানে পরীক্ষা হলো নিসান পাজেরো উইথ লেফ্টহ্যান্ড ড্রাইভ দিয়ে!! তারপরেও সবকিছু মোটামুটি ভালই চলছিলো…কেবল টার্ণ করে থামার সময়ে হঠাৎ করে দেখি স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে…তাই ক্লাচটা একটু বেশী চেপে ধরেছিলাম। ফলাফল…গাড়ি জুড়ে গোঁ গোঁ শব্দ…সামনে দিয়ে ধোঁয়া উঠে গেল প্রায়!! পুরাই ইজ্জতের ফালুদা বনে গেলো!! আরে ব্যাটা, স্টার্ট বন্ধ হওয়ার আর সময় পাইলি না!! আমাদের লটের মুকিত “হারামীটা”-ই কেবল পাশ করেছে। কিন্তু তাই বলে…আমি কেন ফেইল করবো?? এতোদিন গাড়ি চালালাম তাহলে কি জন্যে? তাছাড়া…আমি ফেইল করেছি…মানে যদি শুধু আমি হইতাম তাহলে তো কথা ছিল না…এখন আমার সাথে ব্যানএফএমইউ/ বাংলাদেশ নৌবাহিনী/ বাংলাদেশ সবার ইজ্জত জড়িয়ে গেলো!!! দাঁড়া……প্রয়োজনে কালকে আবার পরীক্ষা দেবো!!
১৪। ব্যানএফএমইউ-এর ওরা তো আর জানতো না…যে আমি “হাবলূ” ড্রাইভিং টেস্টে “ডাব্বা” মেরেছি!! জুনিয়র অফিসারগুলা দেখি আমার কাছ থেকে খাওয়া পাওয়ার আশায় ঘুরঘুর করছে…ডেকে মঞ্জুরের মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম… “ইনশাআল্লাহ্ পাশ করে নেই, গরু ফেলে দেবো রে!!” এই দেশে যে কোন বড় খুশীতে আক্ষরিক অর্থেই গরু ফেলে দেয়া যায়- মানে গরু জবাই করা যায়…দাম অত্যন্ত কম!!
১৫। ব্যানএফএমইউ-এর সবাই অবশ্য আমাকে বেশ কয়েকদিন প্রাকটিস করে…তারপর আবার ড্রাইভিং টেস্টে অ্যাটেন্ড করতে উপদেশ দিলেন। কারণ, এবার ফেইল করলে মিশনের এরা লম্বা সময় নিয়ে আমাকে সিরিয়ালে ফেলে রাখবে। তাছাড়া, ভাল জায়গায় বদলীর সম্ভাবনাও কমে যাবে। আর, তিনবার ড্রাইভিং টেস্টে ডাব্বা মারলে তো দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার রিস্ক আছেই!! এমনিতেই আমি সেকেন্ড মিশনে “এমএলও” হিসাবে সিলেক্ট হওয়ায় দেশে অনেকেই আমার উপরে নাখোশ…এখন যদি ড্রাইভিং টেস্ট-এ ফেল করে ফেরত যাই…তাহলে নৌবাহিনীতে আমার নামটাই না আবার “ফেল্টুস ড্রাইভার” হয়ে যায়!!
চলমান
## বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রয়াত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোহাম্মদ আশরাফ সিদ্দিকী-এর স্মরণে যিনি সাউথ সুদানে মিলিটারী লিয়াঁজো অফিসার (এমএলও) হিসাবে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত থাকাকালীন পেট্রোলরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
### বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রয়াত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোহাম্মদ আশরাফ সিদ্দিকী সাউথ সুদানে মিলিটারী লিয়াঁজো অফিসার (এমএলও) হিসাবে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত থাকাকালীন পেট্রোলরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার (২৭ জুন ২০১৮, সময়-আনুমানিক সকাল ১০৪৫ ঘটিকা) সময়ে লেখক সাউথ সুদানস্থঃ জুবায় “ব্যানএফএমইউ” কন্টিনজেন্ট-এর সদস্য হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।