মঙ্গলালোকে ফিরে দেখা

অটোয়া। ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯, রাত। ২১৯ বেল স্ট্রীটের একটা ঘেঁটো অ্যাপার্টমেন্ট। বৈচিত্র্যহীন একঘেয়ে জীবন। পড়া আর অ্যাসাইনমেন্ট করা; আমার শীতকালীন সেমিস্টার তখন মাঝামাঝি। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ঘর আলো-আঁধারী খেলছে। মূলতঃ ল্যাপিতে একটু পর পর ফেইসবুক, ইয়াহু আর জিমেইলে উঁকি মারছি আর এরিক ক্ল্যাপটন গাইছে ‘টিয়ারস ইন হ্যাভেন’ পড়ার ব্যাকগ্রাউন্ডে। পড়ার কথা সাবা মাহমুদের “পলিটিকস্ অব পায়িটি”। ২৬শে ফেব্রুয়ারি প্রফেসর রাদারফোর্ডের থিওরী-২ ক্লাসের রিডিং। দারুণ বই, কিন্তু আমার পড়ায় কোন মন নেই। কিসের কি, পড়াশুনায় মন নেই, একদম ত্যক্ত বিরক্ত। আগের সপ্তাহে আমার ক্লাস ফ্যাসিলিটেশন ছিল, ওটা ভালোভাবে পার করায় আরো আলগা একটা ভাব কাজ করছে। আর একটা দিনতো এখনো হাতে আছেই। ‘লাস্ট মিনিট পারসন’ হিসেবে খুব একোটা ভালো না হওয়া সত্ত্বেও, আমি সবকিছু শেষ সময়ের জন্য ঠেলতে থাকি।

রাত সাড়ে এগারোটায় চোখ আটকে গেল ফেইসবুকে, আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু ঢাকার পপুলেশন কাউন্সিলের তিশার আপডেট, “তাসনিমা কিবরিয়া ইজ ওয়ারিড এ্যাবাউট দ্য বিডিআর টারমোয়েল”। প্রথম্বার দেখে মাথায় ঢোকেনি। এক সেকেন্ডের কম সময়ে আবার মাথায় ক্লিক করলো ব্যাপারটা; আরে পিকো ভাইয়ার তো মাস দুয়েক হলো বিডিআর পিলখানায় পোষ্টিং। যাই হোক, আমি ভেবে নিলাম হয়তো বর্ডার এলাকায় কিছু হয়েছে। সাথে সাথে ফেইসবুকে অনলাইন হলাম। তিশাকে অনলাইন দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “বিডিআরে কি হয়েছে?” স্পষ্ট কিছু জানে না, পিলখানায় ভীষণ গোলাগুলি-গন্ডগোল সকাল থেকে। “পিকো ভাইয়ার তো এখন পিলখানায় পোষ্টিং, তুমি এই নাম্বারে রাজ ভাইয়াকে ফোন দাও তো।” তিশার কাছ থেকে যা জানতে পারলাম, সবাই এখন আমার বড় ভাইয়ের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসায়, এখনো কেউ তার সাথে কথা বলতে পারেনি, ভাবি ব্যাংক থেকে বাসায় এখন, অনেক লোকজনের কথাবার্তা বাসায়, সবাই ভাইয়ার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। তার ফোনের অপেক্ষায় আছে।

অটোয়ায় আমার ঠিক ছয় মাস তখন। বাসায় ল্যান্ডফোন নেই। বাকি দুই রুমমেটের সেলুলোর ফোন। আমার ক্যালকেশিয়ান রুমমেট পলাশ শুনে বললো, “সব দোষ ম্যারিকার; ওরাই সব করাচ্ছে, দেখলিনা, মুম্বাইতে কি হলো; তারপর পাকিস্থানে শ্রীলংকান টিমটা কেমন নাস্তানাবুদ হলো, এখন আবার বাংলাদেশ”। একটু পর ও ঘুমিয়ে পড়লো। আরেকজন তখনো ল্যাব থেকে বাসায় ফিরেনি।আমি সাধারণত ঢাকায় কথা বলতে আমার ইউনিভার্সিটির অফিসরুমে যে ফোন বরাদ্দ আছে, ওটা দিয়েই কাজ চালাতাম। একবার সেল নিতে গিয়েছিলাম, ক্রেডিট হিস্ট্রি নেই বলে সিস্টেম নাকি অ্যালাউ করেনি, আমিও আর ওপথে হাটতে যায়নি। সেদিন আবার আমার ফোন কার্ডও ফুরিয়ে গেছে। নেটই একমাত্র ভরসা। আরো স্পষ্ট করে বললে, জিমেইল চ্যাট, ইয়াহু মেসেঞ্জার, ফেইসবুক, বিডিনিউজ২৪.কম, প্রথম আলো অনলাইন, আর সিএনএন-আইবিএন লাইভ স্ট্রিমিং। বুঝলাম পরিস্থিতি বেশ ভয়াবহ। পরিচিত অনেকের ফেইসবুক স্ট্যাটাস বলে দিচ্ছে আরো জটিল হচ্ছে।

সিএনএন-আইবিএন বললো, তারা জানতে পেরেছে, বিডিআর মহাপরিচালকসহ বেশ ক’জন অফিসার মারা পড়েছে এই বিদ্রোহে। ঘন্টাখানেক পর, মেসেঞ্জারে বলে দিল্লী থেকে হিল্লোলকে দিয়ে বাসায় আবার ফোন দেয়ালাম, এখনো কেউ কিছু জানে না। বিবিসির একটি ক্লিপিং দেখলাম, ধানমন্ডির এক বাসিন্দার টেলিফোন ইন্টারভিউ, ভদ্রলোক বেশ আতঙ্কিত হয়ে বলছেন সেদিনের কথা। আমার কলেজের আর্মি বন্ধুদের কেউ তখন অনলাইন নেই। অন্যরা কেউ আশ্বস্ত হবার মতো কোন খবর দিতে পারছে না। আমার আরেক রুমমেট স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর ঢাকায় ফোন করলাম, মাত্র দুপুর গড়িয়েছে। কেউ তেমন কিছু বলতে পারলো না। সবাই অপেক্ষা করছে। কিন্তু সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এমনি করে, ঢাকা তখন সন্ধ্যার পথে আর অটোয়া সকালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। খারাপ আশংকা এবার সত্যি মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ভাইয়ার কোন খোঁজ নেই, দেশে কি হচ্ছে কারো কোন স্পষ্ট ধারণা নেই।একবার ভাবলাম, ভাইয়ার কথা লিখে ফেইসবুকে আপডেট দেই, সাথে সাথেই মনে হলো তাতে কাজের চাইতে বিপদ বাড়বে, লোকজনের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বিরক্ত ও ক্লান্ত হতে হবে। ঠিক করলাম যে, যারা মূলতঃ নির্ভরযোগ্য খবর দিতে পারবে, তাদেরকেই জানাবো।

সকাল হতে শুরু করেছে, বাইরে তুষার পড়ছে। এমন সময় এম,আই,এস,টি’র মনিরুল অনলাইনে এলো। ও আমার ঢাকার বাসার ফোন নম্বর নিলো, কিন্তু পরিস্থিতি অভিন্ন। আশংকা বাড়ছে। টেনশন হচ্ছে। সত্যি কি খারাপ কিছু হলো নাকি? ভাইয়া ঠিক আছে তো? আমার ঘেঁটো অ্যাপার্টমেন্টে বসে কিছুই করার নেই, অনলাইনে চেয়ে থাকা ছাড়া। সঙ্গ দেবারও কেউ নেই সেই তুষারশুভ্র ভোরে। ফেইসবুকের স্ট্যাটাস চোখের সামনে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মতো দুই শিবিরে ভাগ হতে শুরু করেছে। পরিচিত কারো কারো স্ট্যাটাস থ্রেডে তর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ন্যায়-অন্যায়, জওয়ান-অফিসার, বিডিআর-আর্মি; নির্যাতন, শোষণ, সমঅধিকার, মানবাধিকার, জামায়াত, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, প্রোলেতারিয়েত-পুঁজিপতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সমরনীতি, গভীর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভারত-পাকিস্থান, বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে শুরু করে এমন কোন বিষয় নেই যা বাদ পড়েছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ বিচলিত, কেউ আতংকিত, কেউবা খুশি, কেউ দুঃখিত, কেউ নিরুত্তাপ। কিন্তু পিলখানার ঐ কয়েকশ একর জায়গায় কি ঘটছে, তা কেউ ঠিকমতো জানে না।

মনিরুলকে একটু পরপর জিজ্ঞেস করছি, কোন আপডেট আছে কি না; এক পর্যায়ে ও আমাকে বললো, “তোর মানসিক অবস্থা কেমন?” বললাম, “আমি শক্ত আছি, কোন খবর থাকলে বল।” বললো, “আমি এখনো নিশ্চিত না, কিন্তু পরিস্থিতি যতটা জানতে পেরেছি তাতে কিছু না আশা করাই ভালো, ভাইয়া ফিরে আসলে সেটা হবে মিরাকল।” “ঠিক আছে। সঠিক কোন খবর থাকলে জানাস।” এরকম একটা খবর দশ হাজার মাইল দূরে শুনে আমার আর কীই বা করার থাকতে পারে? কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে বসে থাকলাম। কি করা উচিৎ ভাবার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। রুমমেটরা উঠলে বাসায় ফোন করতে হবে।

আমার ক্যালকেশিয়ান রুমমেট পলাশ উঠে বললো, “কিরে ঘুমাসনি? কোন খবর পেলি?” বললাম, “না।” ও পরিস্থিতি কিছুটা আন্দাজ করে বললো, “চিন্তা করিস না, আশা করি ভালো খবর পাবি”। তারপর বললো, “তোর প্রয়োজন হলে আমার ফোনটা ব্যবহার কর।” ওর ফোনে একটা আইএসডি কল কন্ট্রাক্ট সেট করা ছিল। কিযে কাজে লাগলো ওর ফোনটা, সেই মুহূর্তে সেটা শুধু আমিই জানি। বাসায় কল করলাম, পরিস্থিতি এখনো একই। সবকিছু স্থবির। খবর যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দুঃশ্চিন্তা বরং বাড়ছে। আমার মেজভাই রাজ বললো, ওর খুব অসহায় লাগছে। কি করবে বুঝতে পারছে না, কারণ ও একদম একা। আমার বোন তখন গিয়েছে সিঙ্গাপুর। আমার ফ্যামিলির শক্ত কেউ কাছে নেই। আমি বললাম, আম্মাকে যশোর থেকে ঢাকা আনিয়ে নাও কাল সকালের ফ্লাইটে। রাজ ভাইয়া বললো, আমরা তো এখনো কিছু নিশ্চিত না। বললাম, সেটা ভেবে বলছি না, আম্মার এখন তোমাদের সাথে থাকা প্রয়োজন। রাজ ভাইয়া বুঝলো; বললো, ব্যবস্থা করছি।

আমি ভাবতে বসলাম, আমার এখন কি করা উচিত, সাবা মাহমুদ পড়বো, নাকি আন্ডারগ্রাড টিএ’র মিডটার্মের খাতা কাটবো। প্রথমে সাবা মাহমুদ, তারপর খাতাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে বুঝলাম কোনটাই হচ্ছে না। আমার রুমমেটরা স্কুলের দিকে বের হলে, আমাকেও বললো যে বাসায় বসে না থেকে ওদের সাথে যেতে। আমি বাসায় থেকে গেলাম। পলাশ ওর ফোনটা আমাকে দিয়ে গেল, তারপর ২৮ তারিখ সকাল পর্যন্ত ফোনটা আমার কাছেই ছিল। ওরা গেলে পরে আমি আবার ল্যাপটপের সামনে বসলাম, কোন খবর পাওয়া যায় কী না সেই আশায়। বেলা বারোটার পর থেকে আর দেশে ফোন করছি না। সারাদিনের ধকলে ওরা হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আমারও আর শরীর টানছিল না, দুপুর দেড়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত একটু ঘুমিয়ে নিলাম। এরপর যে সমস্যায় পড়লাম, নিউজ সাইটগুলো থেকে আর তেমন আপডেট পাচ্ছি না, কোন কোনটায় ঢোকাই যাচ্ছে না, সবাই হয়তো চেষ্টা করছে তাই। আমার মেজ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রাখছি। ভাইয়া শুধু বলে, এখনো জানতে পারিনি, আশা রাখো।

ঠিক করলাম, প্রফেসরকে জানিয়ে রাখি বিষয়টা। একটা ইমেইল দিলাম সব জানিয়ে, বাংলাদেশে এই দুরাবস্থা আর আমার ভাই রয়েছে, তাই আমার ইমিডিয়েট ফ্যামিলি এইভাবে অ্যাফেক্টেড। আশা করছি সন্ধ্যার পর হয়তো কোন খবর পাবো। দুই মিনিট পর প্রফেসর উত্তর দিলো, “তুমি আপসেট হয়ে পড়ো না, তোমার এই সংবাদে আমি দুঃখিত। এবং আশা করছি ভালো কোন সংবাদ পাবে। আগামীকাল ক্লাসের ক্রিটিক্যল রেসপন্স যদি তুমি পরে জমা দিতে চাও, তাহলে সেটা করতে পারো। আর আমি তোমার দেশের এই ঘটনার সংবাদ অনুসরণ করবো। তোমার ফ্যামিলির ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক।” ২৬শে ফেব্রুয়ারির ক্লাসের ক্লাস ফ্যাসিলিটেটর দু’জন; চেস মরিসন এবং টিফনি। বিকেলের দিকে টিফনি আমাকে জিমেইলে টোকা দিলো, সব ভালো তো? তুমি তো একটানা অনলাইন। বললাম, আমি ভালো, কিন্তু ঘটনা হলো ‘এই’। শুনে প্রায় আঁতকে উঠলো, নিজেই নিউজ ঘাঁটাঘাঁটি করে বললো, পরিস্থিতিতো সাংঘাতিক খারাপ। বললাম, হ্যাঁ, সেজন্য আমি কোনকিছুতে মনযোগ দিতে পারছি না। বললো, তুমি বরং একটু বিশ্রাম নাও আর তোমার ফ্যামিলির কথা ভাবো। একটুপর চেস আমাকে জিমেইলে টোকা দিল, “আমি খুব দুঃখিত, আমি টিফনির কাছ থেকে এইমাত্র জানলাম যে তোমার ভাই হস্টেজ হয়ে আছেন। আমি তোমাকে মানসিক শক্তি পাঠাচ্ছি, তুমি শক্ত থাকো। পাশাপাশি, তোমার ভাই ভালোভাবে মুক্তি পাক। তোমার কোন সাহায্য লাগলে বলতে দ্বিধা করো না।” কথা শেষ করে আমি আবার খবরে চোখ রাখলাম, বেশকিছু মৃতদেহ নর্দমা দিয়ে হাজারীবাগের স্যুয়ারেজ লাইন হয়ে বের হয়ে এসেছে, সেসব ছবি খুব খেয়াল করে দেখলাম। না, আমার ভাইয়া সেখানে নেই। আমার শরীর তখন কাঁপছে, সকালে নাস্তা করিনি, দুপুরেও খাইনি। ফ্রিজ খুলে, খাবার নিয়ে, গরম করে একটু খেলাম। এক গ্লাস দুধ গেলাম, এরপর গরম কফিতে চুমুক দেবার পর যেন আবার একটু শক্তি ফিরে পেলাম।

দেশে তখন দ্বিপ্রহর। ঢাকা ক্লান্ত কিংবা দ্ধিধান্বিত হয়ে পড়েছে নগর নাটকের গোলাগুলি, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা আর কিছু সংখ্যক মিডিয়ার বিভ্রান্তিকর তথ্য ও মতামত প্রচারে। আমার চোখ সেঁটে আছে ল্যাপির মনিটরটায়। মাঝে মাঝে একঘেঁয়েমিতে বৈচিত্র্য আনতে একটু বাইরে তাকিয়ে তুষার পড়া দেখি। আবার খবরে চোখ পড়ে, সাহারা খাতুন পুলিশের আইজিসহ ভেতরে ঢুকেছেন, সৈনিকরা আত্মসমর্পণ করবে। তখনো জানি না, বন্ধুপ্রতীম মাজহার বিডিআরে ছিল, আর আইজি নূর মুহাম্মদ তারই শ্বশুর। আবার একটু আশায় বুক বাঁধি, ভাইয়া বেঁচে আছে এবং বেরিয়ে আসার সু্যোগ পাবে। একটু পরপর টিফনি জিজ্ঞেস করে, কোন খবর পেলে? তোমার দেশের নির্ভরযোগ্য ইংরেজি সংবাদপত্রের নাম দাও আমাকে। একটু পর আবার ফিরে এসে বলে, “হোলি ক্রাপ! আমি ভাবতেও পারছি না, আমার বন্ধুর ভাই এইরকম পরিস্থিতিতে। তুমি চার্চে যাবে? তোমার ভালো লাগতে পারে। আমি নিজে নিধর্মী, কিন্তু আমার ফ্যামিলি বৌদ্ধ, দেখো সংকটের সময় চার্চে গেলে আমার মন ভালো হয়ে যায়।” আমি ছোট করে ধন্যবাদ জানিয়ে না করলাম। একটু ভেবে, আবার বললো, “আমি অটোয়ার সব থেকে বড় মসজিদটা চিনি, তুমি চাইলে আমি এখনই তোমাকে রাইড দিতে পারি।” আমার একই উত্তর শুনে বললো, “তুমি সাহস রেখো, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি যেকোন সময় নিঃসঙ্কোচে ‘বাজ’ দিও।”

মনিরুল জেগে আছে। রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। এম,আই,এস,টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটের সাথে মিশে গিয়ে এক সৈনিকের অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করেছে কখন ভিতরে যাবার অনুমতি আসবে। ওরা স্টুডেন্ট অফিসাররা অনেকেই এটা করেছিল। এখন সবাই এম,আই,এস,টিতে নজরবন্দী আছে। ও বারবার আমার কাছে ‘স্যরি’ বললো। মইন ইউ এবং অন্য সিনিয়র অফিসারদের প্রতি ওদের সবার ক্রোধ ফেটে পড়ছে। আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অগ্রজ, পরে শিক্ষক, তানিয়া আপু লন্ডন থেকে আমাকে অনলাইন দেখে বললেন, ওনাদের অনেক নিকটজন আটকা পড়ে আছেন পিলখানায়। মারাও গেছেন। আরো যা যা খবর শুনেছেন সব জানালেন। আমি তাকে ভাইয়ার কথা জানালাম। ইনি জিজ্ঞেস করলেন, খালা (আম্মা) কোথায়? সাথে কে আছেন? আম্মা একা আছেন শুনে বললেন, তাড়াতাড়ি উনার কাছে কাউকে পাঠাও। জানালাম, সকাল হলে ঢাকায় রওনা হবেন। তারপর বললেন, তোমার ভাইয়ের খোঁজ চলছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথায়? উনি লিংক দিলেন, সেটা ছিল ক্যাডেট কলেজ ব্লগ। আমি সচল বা সামুর লেখা মাঝে মাঝে পড়লেও সিসিবির কথা তখনো জানি না। লাইভ ব্লগিং কি তাও জানি না। দেখলাম সেখানে তৌফিক, আশিক এরা সবাই আছে। পরিস্থিতির আপডেট দেয়া হচ্ছে। ব্লগ রিপোর্টি-এর কথা আগে পড়েছি, কিন্তু সেটা কেমন ধারণা ছিল না।

তৌফিককে ফেইসবুকে মেসেজ দিলাম, ভাইয়ার কোন খোঁজ পেলে যেন আমাকে জানায়। আমার খালাতো ভাই আশিককে অনলাইন পেলাম। খালাতো বোন মিম আপু বগুড়াতে অনলাইন আছেন সার্বক্ষনিক। আরেক বোন মুমু ফোন দিল শিকাগো থেকে। আমার একটা নির্ভরযোগ্য নেটওয়ার্ক তৈরি হলো, কিন্তু হয়ে কি লাভ, পরিস্থিতি আসলে অবনতির দিকে যাচ্ছে। আমার ভেতরে অনেকদিন একটা আক্ষেপ কাজ করতো যে, সিসিবির সন্ধান করলাম আমার জীবনের গভীর সংকটময় একটা সময়ে, জীবনের সব থেকে মূল্যবান যে দু’একজন মানুষ থাকে- তাদের একজনকে হারানোর ভিতর দিয়ে।

সন্ধ্যায় আমার রুমমেটরা একটু তাড়াতাড়ি করে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরলো। ওদেরও মুখ থমথমে, আমার চোখে চোখ রাখে না। মাহবুব ভাই দেশের সরকারের নামে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন, “কিসের সাধারণ ক্ষমা এত বড় একটা অপরাধের!” সে নিজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার কারণে তার ভাষায় মন্দের ভালো নীলদলের সমর্থক ছিলো। কিন্তু সেও সরকারের গুষ্ঠি উদ্ধার করতে লাগলো, বললো – সেনাবাহিনী তো মনে হয় অনেক সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু সেসব কথা আমার কোন উপকারে আসছিল না। তাও মন দিয়ে শুনছিলাম, দুয়েক জায়গায় নিজের মতামত জানাচ্ছিলাম। ফেইসবুকে লোকজনের উলটাপালটা আপডেট দেখে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। নানা রকম অনুমিত তত্ত্বের ছড়াছড়ি এবং তাতে ব্যক্তিগত আক্রমন এবং পালটা আক্রমনে থ্রেডগুলো ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিদেশে অধ্যয়নরত এক বন্ধু দেশের এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন, কোন এক অজানা কারণে তাকে ভাইয়ের কথা প্রথমে বলতে ইচ্ছে করেনি। যদিও তার ঢাকার মিডিয়ার নানা মানুষের সাথে খুব সখ্যতা। নানা সময়ে নানা উদ্ভট সব তথ্যের যোগান দিচ্ছিলো, তখন অবশ্য সেগুলো মন দিয়ে শুনছিলাম পরিস্থিতির আকস্মিকতায়। একসময় সে জানালো, “আর্মিরা যে কোন সময়ে শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলতে পারে, এনিয়ে সে খুব চিন্তিত, শংকিত। কারণ শেখ হাসিনার কিছু হলে সে মেনে নিতে পারবে না, এটা পুরোপুরি জামায়াতের নীল নকশা।” এবার জানাতে বাধ্য হলাম, “শেখ হাসিনার বা খালেদা জিয়ার কি হতে পারে তা আমাকে মোটেও স্পর্শ করতে পারছে না, আমার ভাইয়ের ২৪ ঘন্টা হতে চললো কোন খোঁজই নেই, সেটাই একমাত্র পৃথিবী ওলোটপালোট করা বিষয় আমার জন্য।” তার সাথে কথোপকথনের ইতি টানলাম, সেও বুঝলো এসব কথা শোনার মতো মানসিকতা বা ধৈর্য্য কোনটাই আমার তখন নেই।

সন্ধ্যা একটু জেঁকে বসার পর পিন্টু ভাইয়ের ফোন। কিছুদিন হলো দেশ থেকে ফিরেছেন। আমার বড় বোন উনার হাতে কিছু জিনিস দিয়ে দিয়েছেন আমার জন্য, সেগুলো দিতে চান। উনি ইউনিভার্সিটি থেকে ড্রপ আউট হয়েছিলেন, অল্প বয়সে পরিবারের দায়িত্ব নিরে হয়েছিল বলে। কিন্তু ছাত্র শুনলেই অসম্ভব স্নেহ করেন। অটোয়ায় যে মানুষগুলো আমার বিপদে আপদে এগিয়ে এসেছেন, উনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। দেশে কী হয়েছে উনি জানেন না। ভীষণভাবে কাজের মধ্যে ডুবে ছিলেন। সব শুনে একটু বকাবকি করলেন উনাকে কেন জানাইনি। বললেন, পাঁচ মিনিটের ভেতরে উনি নিচে আসছেন, আমাকে বাসা থেকে নামতে বললেন। তারপর উনার বাসায় নিয়ে গেলেন সব কাজ ফেলে। আমাকে সময় দিলেন, থাকতে বললেন, কিন্তু আমি নিজের বাসায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। খালাতো বোন উর্মি আপু নর্থ ক্যারোলিনা থেকে ফোন দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে কাঁদতে শুরু করলেন। আসলে আমার নিজের ফোন না থাকায় কেউ আমার সাথে কথা বলতে পারছিল না। বাসায় ফিরে একটু পরপর আশিক, মিম আপু, তানিয়া আপু আর মনিরুলের সাথে অনলাইনে- কোন খবর আছে আর?- জাতীয় কথা হচ্ছে। আমি তখনো ঢাকায় বড় ভাবীর সাথে কথা বলিনি, আম্মাকে ফোন করে কেটে দিয়েছি- কি বলবো? কি বলার থাকতে পারে? সে উত্তর আমার জানা ছিল না। খালাতো বোন মুমু ফেইসবুকে জানালো, যদি কোন খবর জানতে পারি, যত রাতই হোক যেন জানাই।

দেশের টানটান উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আসছে। প্রথম ধাক্কা পার হয়ে গিয়েছে। এখন সবাই জানে যে ভিতরের পরিস্থিতি ভয়াবহ। সাহারা খাতুনের সাথে কিছু পরিবার বের হলো। সেখানেও ভাইয়া নেই। এমনিতেও আর খুব বেশি আশা করছি না। মনিরুলের কাছ থেকে পরিস্থিতির একটা মোটামুটি ধারণা আগেই পাওয়া হয়ে গিয়েছে- দরবারে যারা ছিলেন, তাদের কারোরই বেঁচে আসার সম্ভাবনা খুব কম। ডিজি বিডিআর পরিবারসহ নিহত হয়েছেন। অফিসারদের স্ত্রী-সন্তানদের নিপীড়ন করা হয়েছে। তারা অনেকেই বন্দী আছেন। সাধারণ পথিক নিহত হয়েছে। ভিতরের অনেক জায়গায় আগুন জ্বালানো হয়েছে। অনেকে ধারণা করছে, কিছু ডেডবডি পোড়ানো হয়ে থাকতে পারে। সরকারের এলোমেলো সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্তহীনতা। আর্মি, র‌্যাব ও পুলিশ পিলখানা ঘিরে আছে (পরে বুঝলাম, সবই বজ্র আঁটুনির আলগা ফাঁস, কারণ হাজারীবাগ ফাঁকা ছিল)। কিছু মানুষ তামাশা দেখছে। কিছু মানুষজন নিকটজনের খোঁজ পাবার অপেক্ষায়। অনেক মানুষ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও তর্কে মেতে আছে। এই হলো সামগ্রিক চিত্র। আমি দশ হাজার মাইল দূরে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনেই চলছি। আমার চোখে একটানা কোন ঘুম নেই, খাচ্ছি না, ল্যাপির সামনে থেকে নড়ছি না। তবু আমার আকুল মনে এতটুকু ক্লান্তি নেই।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও থেকে বন্ধু আনিস ফোন দিল, আমার খোঁজ জানতে। কোথাও থেকে জেনেছে ভাইয়ার কথা। অনেকক্ষণ কথা হলো, অনেক সাহস দিল। অনলাইন টিভির কিছু লিংক দিল, আমি সেখান থেকে বাংলাভিশন আর এনটিভির আপডেট দেখা শুরু করলাম। ততক্ষণে, টকশো নিয়ে যেসব নাটক মঞ্চায়িত হয়েছিল সেগুলো শেষ। অটোয়ার এসে প্রথম যে পরিবারের সাথে পরিচয় হয়েছিলো, তারমধ্যে এসসিসি’র নাসিম ভাইয়ের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রথম থেকেই, তাকেও জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম। ঢাকায় মূলতঃ আমার মেজ ভাই রাজ ও তার স্ত্রীর সাথে কথা বলেছিলাম। ভাবলাম, সাহস করে সবার সাথে কথা বলতে হবে। আম্মা, ভাবী আর বড় ভাইয়ের ছেলে ওহীর সাথে কথা বললাম।

আম্মা জিজ্ঞেস করলো, পিকো বেঁচে আছে তো? মনে সংশয় থাকলেও বললাম, নিশ্চয়ই আছে, ভাইয়া নিশ্চিত ফিরে আসবে। ভাবী বললো, কিছুই বুঝতে পারছিনা, আমার খুব ভয় লাগছে। মিথ্যে করে বললাম, ভয় নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কিছু বলার খুঁজেও পাচ্ছিলাম না তখন। ওহীকে শুধু বললাম, মনে সাহস রাখো। একেকবার শুনি, আর্মি নাকি এ্যাকশনে যাবে, আবার শুনি রাজনৈতিক সমাধান করা হচ্ছে। আমি তখন সিসিবির পাতায় চোখ রাখছি। সামিয়ার বাবা বিগ্রেডিয়ার জাকিরের খোঁজ চলছে, আরো অনেক ক্যাডেট কলেজের এক্স-ক্যাডেট অফিসারদের। ভাইয়া বেঁচে আছে কিনা তা নিয়ে গভীর একটা শংকার মধ্যে সময় কাটছে। মনিরুল মাঝে মাঝে রেসপন্ড করছে না। রাগ করেই বললাম, তুই কি বিরক্ত হচ্ছিস নাকি? তখন ও বললো, নারে, তোকে তো কোন খবর দিতে পারছিনা। এইখানে একরকম বন্দী অবস্হায় নিজের চুল ছিঁড়তেছি, কিছু করতে পারতেছিনা। তবে, তোর প্রায়োরিটি এখন সবার থেকে বেশি, দোস্ত। বিষয়টা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। আমার তবু কেন যেন মনে হতে লাগলো যে, সবাই হয়তো আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে। তাই আমার ছোট খালাকে ফোন করলাম। কিন্তু লাইন পেলাম না। তারপর তানিয়া আপুকে ফোন নম্বর দিয়ে ফোন দিতে বললাম, আমার ছোট খালার বাসায় খবর নেবার জন্য। খালাতো বোন মিম আপুকেও নানাভাবে জিজ্ঞেস করতে থাকলাম।

রাজভাইয়াকে ফোন করে বললাম যে, তোমার কি মনে হয় যে আমার চলে আসা উচিত? ভাইয়া বললো, এখন কিভাবে আসবা? আগে দেখো কি হয়? আশিক, মিমআপু আর আমার প্রতিনিয়ত অনলাইনে কথা হচ্ছে। আমরা তখন এমন একটা সময়ে পৌঁছে গেছি, কেউ কাউকে সরাসরি না বললেও মনের খারাপ আশংকাটাই বেশি করে কাজ করছে। খুব বেশি কথা হচ্ছেনা- খবর পাইছো কোন? এছাড়া যেন আর বলার কিছু নেই। আশিক আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “ঢাকা যাবার কথা কিছু ভাবছো?” বললাম- “এখনো ঠিক করিনি। আমার রুমমেটরা বলছে, যদি খারাপ কিছু হয়ও, তুই দেশে গিয়েতো কোন লাভ হবেনা। সেমিষ্টারের এখন মাঝামঝি তুই এখন যাস না। বরং সামারে চলে যাবি।” … আমি শুনছি; হ্যাঁ বা না- কোনটাই বলছিনা। একটু পর আশিকের ইমেইল পেলাম। ওর ক্রেডিটকার্ডের নম্বর, পাসওয়ার্ডসহ যাবতীয় তথ্য, আমি যেন দেশে যেতে চাইলে পয়সার কথা চিন্তা করে দ্বিধা না করি। কিছুক্ষন নিশ্চুপ বসে থাকলাম।

সন্ধায় আমার রুমমেট মাহবুব ভাই জানালো, উনি নাসিম ভাইকে জানিয়েছেন। নাসিম ভাই ওনার স্ত্রী সিলভিয়া আপাসহ আসছেন। নাসিমভাই আসবে তাতে অসুবিধা নেই, কিন্তু ওনার স্ত্রী আসবেন, শুনে আমার কলকাতার রুমমেট ঘর গোঁছাতে লেগে গেল। আমি ওকে না করে বললাম, যেমন আছে তেমনই থাকুক। নাসিমভাই এলেন, এসে সব শুনলেন, উনি আসলে আগে জানতেন না যে ভাইয়া পিলখানায় বদলি হয়েছেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। উনিও সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষনার উপর কড়া সমালোচনা করলেন। সিলভিয়া আপাও চমৎকার মানুষ, আমাকে খুব স্নেহ করেন। আমি অটোয়াতে এসে প্রথম ওনাদের বাসায় আশ্রয় পেয়েছিলাম। সেটা অবশ্য দৈবক্রম ছিল, ক্যাডেট কলেজ সূত্রে নয়। ওনাদের বাসায় গিয়ে থাকতে বললেন। কিন্তু আমার আসলে একা থাকাটাই কেন জানি বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছিল। হয়তো ল্যাপিটা ছেড়ে উঠতে চাচ্ছিলাম না, সেকারণেও হতে পারে। ওনারা বলে গেলেন, যেকোন সাহায্য লাগলে যেন বলতে দ্বিধা না করি। সব শুনলাম, আর বললাম, “হ্যাঁ, জানাবো”। কিন্তু আমার মন আসলে তখন ভীষণ অস্হির। নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া হচ্ছে, ঠিক কোন মুহুর্তে আমার ঢাকায় যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। উর্মিআপু আর মুমু ফোন করে আগেই বলেছিল, যাবার ব্যাপারে সাহায্য লাগলে যেন ওদের বলি। কিন্তু ভাইয়া আর নেই এরকম ভেবে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে তখনো মন সায় পাচ্ছিল না। এখনো তো সব আশা শেষ হয়ে যায়নি। কারণ কোন নিশ্চিত কোন খবর পাইনি।

শেষরাতে রাজভাইয়াকে ফোন দিলাম। আমি চলে আসি- কি বলো? বলে, না, এসো না, ভাইয়া যদি বেঁচে না থাকে, ডেডবডি আমরা নাও পেতে পারি। আর তোমার আসতে তো অনেক সময় লাগবে। আমরা যদি ভাইয়াকে পাইও তোমার জন্য রাখতে পারবো না। রাজ ভাইয়া পিলখানার গেটে গেটে ঘুরছে। সাথে আছে ‌ওহী (বড় ভাইয়ের ছেলে)। আবার একটু পর ফোন দেই, তোমরা এখন কোথায়? বলে, মিডফোর্ড যাচ্ছি, ওখানে কিছু ডেডবডি যাচ্ছে। আবার ফোন দেই, কোথায়? উত্তর, ডিএমসি। এখনো পাইনি। আবার ফোন দেই, বার বার ফোন দেই। রাজ ভাইয়া পিলখানা, মিডফোর্ড আর ডিএমসিতে চরকির মতো ঘুরছে, ভাইয়ার ডেডবডির সন্ধানে। আস্তে আস্তে ওর সাথে আরো মানুষ স্বেচ্ছায় যুক্ত হয়েছে, মূলতঃ আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনেরা। আমার চাচাতো বোনের জামাই জেসিসির সাইফকে ফোন দেই, বলি কোন খবর পেলে যেন সাথে সাথে জানায়। সাইফ আর্মিতে তখন ক্যাপ্টেন, ইউনিফর্ম পরে গিয়েছে। জানতে পারলে সাথে সাথে মিম আপুর মাধ্যমে আমাকে জানাবে। একজনের সাথে ভাইয়ার চেহারার এবং শরীরের মিল পাওয়া গিয়েছে। আমরা নিশ্চিত খবরের জন্য অপেক্ষা করি। না, উনি আরেকজন শহীদ অফিসার, আমরা হাঁফ ছাড়ি একটুর জন্য। কিন্তু তাতে আশার সঞ্চার হয়না। আশংকা; শেষ পর্যন্ত যদি ডেডবডি পাওয়া না যায়!

ফোন করে ভাবীর সাথে কথা বলতে চাই, ভাবী হ্যালো বলেই ভেউ ভেউ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে, “আমার সব শেষ হয়ে গেল, তোমার ভাইয়া হয়তো আর নেই।” আমি শুধু বলতে পারি কোনরকমে, “শক্ত হোন।” তারপর আর কিছু বলতে পারিনা। আমার দুচোখ গড়িয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে থাকে। আমি কোন শব্দ করিনা। ফোনটা ধরে থাকি শুধু। একসময় ফোনে এশীকে (বড় ভাইয়ের মেয়ে) চাই। এশী শুধু বলে, চাচা। আমি কিছু বলতে পারিনা। আমিও নিঃশব্দ থেকে ডুকরে করে কেঁদে উঠি। এশী আমাকে উল্টো স্বান্তনা দেয়। ফোন হাত ঘুরে আমার মেজ খালার কাছে যায়, আমার কান্না থামে না। খালা শুধু বলেন, “বাপ, একটু শক্ত থাক, তুইতো একা আছিস। আমি সবাইকে দেখে রাখবো।” আমি শুনি, মন শান্ত হয়না। একসময় কিছু একটা বলে ফোন রেখে দেই।

ভোররাত, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পাকিংয়ে আলো জ্বলছে। বরফ জমে আছে এখানে সেখানে। রাস্তার বাতির আলোয় সেই বরফকে হলুদ দেখায়। আমি তাকিয়ে থাকি আর কেঁদে চলি একা। অনেকক্ষন। মনে হয় যেন পৃথিবী থেমে আছে। কতক্ষন জানিনা। দুইদিন উদ্ভ্রান্তের মতো ল্যাপির সামনে বসে থাকা, জমাট বাঁধা কষ্ট, হাহাকার সব এক হয়ে যায় শুভ্র দ্বিপ্রহরে। একসময় খেয়াল করি, সকাল হয় ধীরে ধীরে। পানি খাই, কফি বানাই, কফির মগ নিয়ে আবার ল্যাপির সামনে বসি। এখনো ভাইয়াকে পাওয়া যায়নি। আমরা আর একরকম মিরাকল ছাড়া ভাইয়ার বেঁচে ফেরার আশা করছি না। নতুন আশংকা যুক্ত হয়েছে, ডেডবডি নাও পেতে পারি। আমি ভাইয়া সাথে শেষ কবে কথা হলো মনে করার চেষ্টা করি। আরো নানা কিছু ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমি দেশে যাবো। আমি আবার রাজ ভাইয়াকে ফোন দেই; শুধু জিজ্ঞেস করি, “ভাইয়ার কি বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনা আর আছে?” ও বলে, “মনে হয় না।” আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। ইউনিভার্সিটিকে জানাতে হবে, এইখানটায় এসে দ্বিধা কাজ করে যে নিশ্চিত না হয়ে কিভাবে জানাই।

যাবার ব্যাপারে আমার রুমমেটদের তখন কিছু জানাই না। পলাশের সাথে বাসা থেকে একসাথে বের হই। বারবার আমাকে দেশে যেতে বারণ করে। ডিপার্টমেন্টে এসে পওলাকে (গ্রাজুয়েট এ্যামিনিট্রেটর) খুঁজি। অফিস বন্ধ। অফিস এ্যাসিসট্যান্ট ডায়ানাকে জিগেস করি পওলার কথা; ওর আজ শরীর খারাপ ছিল, তাই হোমওয়ার্ক নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছে। আমার চেহারা তখন কেমন ছিল, কোন ধারনা নেই এখন। কিন্তু চোখ বড় বড় করে ডায়ানা ওর ডেক্স থেকে উঠে এসে পানির বোতল বাড়িয়ে বলে, “পানি খাও। তোমার কি হয়েছে?” বললাম সব। ওর চোখ দেখলাম টলটল করছে। তারপর সেখান থেকে গেলাম আমার এ্যাডভাইজারের রুমে। সে চেয়ার থেকে উঠে এসে আমাকে বসালো, তারপর বললো, “পরিস্থিতিটা আমাকে একটু বলো, মানে তোমার ফ্যামিলি কেমন আছে?” শুনে বললো, “তুমি চাইলে লিভ নিয়ে দেশে চলে যেতে পারো আর যদি মনে করো থাকবে, তাহলে এক সপ্তাহের ছুটি নেবার পরামর্শ দেবো আমি বা আরো কিছুদিন। যদি পারো তাহলে দেশে গিয়ে ওখান থেকে আমার কোর্স শেষ করতে পারবে। অন্য কোর্স টিচাররাও আমি বিশ্বাস করি তোমাকে সাহায্য করবে।” এ্যাডভাইজার তার বাসার ফোন নম্বর দিয়ে বললো, “তুমি যেকোন সময় আমাকে ফোন করতে পারো প্রয়োজন হলে।” তার রুম থেকে বের হয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছি। গ্রাজুয়েট কোঅর্ডিনেটর প্রফেসর জেন আমাকে যেতে দেখে বললো, “তোমার কি একটু আমার রুমে আসার সময় হবে?” আমাকে সোজা প্রশ্ন, “আমরা তোমার দেশের পরিস্থিতি জানি, তোমার ভাইয়ের কথাও আমি ডায়ানার কাছ থেকে নিশ্চিত হলাম। এখন তুমি কি করবে?” আমি বললাম, “আমি যেতে চাই, কিন্তু আমি আরেকটু সময় নিয়ে নিশ্চিত হতে চাই।” জেন বললো, “আমি তোমার পেপার ওয়ার্কগুলো রেডি করে ফেলি, সাথে তোমার জন্য একটা ইমাজেন্সি বার্জারির অনুমোদন দিতে ডিনকে বলছি।” আমার চারপাশে তখন আমার সহপাঠী আর দু’তিনজন প্রফ। সবাই এক এক করে সমবেদনা জানাচ্ছে। সহপাঠী শ্যান্টেল এবং প্রফেসর লুইস আমাকে তাদের টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললো, “তোমার জন্য ২৪ ঘন্টা ফোন খোলা থাকলো, তোমার খারাপ লাগলেই ফোন করবে, যতো রাতই হোক।” আমি সব শুনছি, অবাক হয়ে দেখছি, মানুষের সংকটময় সময়ে অল্প পরিচিত এই ভিনদেশি মানুষগুলো কত আপন করে সহমর্মীতার হাত বাড়ায়।

ডিপার্টমেন্টে সেদিন ‘ওয়ার্ক ইন প্রগেস গ্রাজুয়েট কনফারেন্স’ চলছে। আমি আমার অফিস রুমে চলে গেলাম নেটে বসবো বলে। কিছুক্ষন পর প্রফেসর জেন বেশকিছু কাগজপত্র নিয়ে এসে বললো, তুমি শুধু সিগনেচার করো, আমি সব পূরণ করে ফেলব। শ্যান্টেল পাশে বসে থাকলো, চোখে চোখ পড়তে বললো, “আমি সাউথ আফ্রিকায় বর্ণবাদী দাঙ্গায় আমার মাকে হারিয়েছি, তাই আমি বুঝতে পারি এই অনুভূতি কেমন। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কিছু খেয়েছো?” বললাম, “বাসায় ফিরে খাবো।” শ্যান্টেল কনফারেন্সের ফুড স্টেশন থেকে অন্তত ২দিন খাওয়া যাবে এই পরিমান খাবার প্যাক করে আর একটা প্লেটে আলাদা করে খাবার আনলো আমার জন্য। আমার তখন খাওয়া হলো না, তাই ও সব আমার ব্যাকপ্যাকে ভরে দিল।

আমার বন্ধু এ্যারুনা বিকালের সেশনে পেপার প্রেজেনটেশেন ছিল, তাই মাত্র ডিপার্টমেন্টে এলো এবং আগের দিন ক্লাস মিস দিয়েছে তাই আমার খবর জানেনা। আমাকে দেখেই, ‘ড্যুউড’ বলে জোরে ডেকে উঠলো। আমার সংক্ষিপ্ত প্রতিউত্তরে এবং চেহারা দেখে বললো, কি হয়েছে? সব শুনলো, কিছুক্ষন চুপ মেরে বসে থাকলো। তারপর বললো, “তুমি অবশ্যই বাংলাদেশ যাচ্ছো।” আমি বললাম, “জেন আমার ছুটি এবং যাবার খরচ ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে।” এ্যারুনা বললো, “না, জেন পারুক আর নাই পারুক তুমি অবশ্যই যাবে। এবং আমি জেনের কাছে যাচ্ছি, না ফেরা পর্যন্ত কোথাও যাবেনা।” দেশ থেকে এখন পরিচিতরা ফোন করছে। একের পর এক ফোন আসছে – আমার কথা বলার ইচ্ছে নেই একদম, তাও তাদের কথা শুনতে হচ্ছে। কারণ কোনটা দরকারী আর কোনটা অদরকারী ফোন, না ধরা পর্যন্ত বুঝতে পারছিলামনা। সমবেদনাও আসলে খুব বেশী নেওয়া যায় না হয়তো।

এ্যারুনা ফিরে বললো, “তুমি যাচ্ছো কনফার্ম, আমার জেনের সাথে কথা হয়েছে। আমি পেপার প্রেজেন্ট করে আসি, এইটুকু সময় তুমি এখানে বসে থাকো।” একটু পর এসে বললো, “চলো ক্যারিম (এ্যারুনার বয়ফ্রেন্ড) নিচে গাড়ীতে অপেক্ষা করছে, তোমার প্লেনের টিকেট আনতে যাবো।” নাসিম ভাইকে বলে তার কিছুক্ষন আগে একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে টিকেট ম্যানেজ করে রাখতে বলেছিলাম। আমরা বিলিংসব্রিজের সেই এজেন্টের কাছে চলে গেলাম। এ্যারুনা টিকেটের দাম দিয়ে দিল। ওকে বলে রাখলাম, “ট্রাভেল বার্জারির টাকা তুমি এনক্যাশ করে নিও।” বললো, “ওসব নিয়ে তোমাকে এখন ভাবতে হবেনা। আমার পর্যাপ্ত টাকা আছে।” ওরা আমাকে রাইড দিল বাসা পর্যন্ত।

বাসায় যখন ফিরলাম তখন রাত প্রায় নটা বাজে। তখন একদিকে টেলিফোন আর একদিকে বাংলাদেশী লোকজন আমার সাথে দেখা করতে আসতে শুরু করলো। সবার হয়তো সবই জানা তবু আমার প্রত্যেককেই কি ঘটেছে সব বলতে হচ্ছিল। এবং সেইসাথে প্রশ্ন- এটা কেন হলো, কারা করলো? কিন্তু সেই উত্তর তো আমার জানা নেই। যে যার যার মতো ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। এবং আমি খুব মন দিয়ে শুনছি এমন একটা ভাব করে থাকলাম। আমি আবার হয়তো বিশদিন পর আসবো, কিন্তু কিছু গোছগাছ তো আছে। সেগুলো করার সুযোগ পাচ্ছিনা। এমন সময় খেয়াল হলো, ঢাকায় তো জানাতে হবে যে আমি কাল সকালে রওনা হচ্ছি। তাড়াতাড়ি আশিক এবং আমার ঢাকার দুই খালাতো ভাইয়ের কাছে ফ্লাইট আইটেরিনারি জানিয়ে ইমেইল করে দিলাম। যাতে কেউ অন্তত নিতে আসে এয়ারপোর্টে, কারণ ঢাকাতে ল্যান্ডিং ভোর চারটায়। নাসিমভাই-সিলভিয়া আপা আমার জন্য রান্না করে নিয়ে আসলেন, সেই সুবাদে আমার রুমমেটরা একটু ভাল খেতে পারলো। আমি কোনরকম কিছুটা মুখে দিলাম।

ঠিক হলো, পিন্টু ভাই ভোরে অটোয়ার এয়ারপোর্টে ড্রপ করবেন। উনি খুব সংকোচের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, ওনার ভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিন্যান্সের শিক্ষকের জন্য আমি একটা ল্যাপটপ নিতে পারবো কিনা যদি কিছু মনে না করি। বললাম, আমি খালি স্যুটকেস নিয়ে যাচ্ছি, ল্যাপটপ যেহেতু নন-ট্যাক্সএবল (সেটাই জানতাম) তাই আমার কোন অসুবিধা নাই। পিন্টু ভাই ভোররাতে আসলেন। আমি আর ঢাকায় যোগাযোগ করছিলাম না। বাসা থেকে বের হলাম, ব্রনসন এভিনি্উ হয়ে এয়ারপোর্ট যাচ্ছি, সেইসময় ঢাকায় বাসায় জানাতে চাইলাম যে আমি আসছি। মেজভাবী ফোন ধরলো, বললাম – “আমি আসছি।” ভাবী বললো, “ভাইয়ার ডেডবডি সনাক্ত করা গিয়েছে।” পিন্টু ভাই শুনে “ইন্না ইল্লা হে অইন্নালিল্লাহে রাজেউন” বললেন। আমি ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। হয়তো রাস্তা দেখছিলাম, শুভ্র অটোয়ার প্রভাত হওয়া দেখছিলাম কিংবা কিছুই দেখছিলাম না। ব্যথার অনুভূতির রঙ নীল নাকি কালো হয় সেই বোধ তখন শূন্য ছিল।

বাইরের তাপমাত্রা তখন ছিল মাইনাস ২৮ ডিগ্রি সে:। অটোয়া থেকে টরোন্টোর পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, সেখান থেকে কানেকটিং লন্ডন ফ্লাইট। আমি একরকম কিছুই বুঝতে পারিনি কখন হিথ্রোতে এসে পৌছাই, কেবিন ক্রু এসে ডেকে তোলে। আমি তখন ক্লান্ত-শ্রান্ত। হিথ্রোতে নেমে বুঝতে পারছি আমি দেশে যাচ্ছি। ভাইয়া তখন অন্য পৃথিবীতে, ততক্ষনে নিশ্চয়ই দাফন হয়ে গিয়েছে। সব অনুভূতি পিছনে ফেলে আমি তখন গালফের কানেক্টিং নিতে দৌড়াচ্ছি, একটা গেট দিয়ে ঢোকার সময় দুজন লম্বামতো ইউনিফর্ম পরা কৃষ্ণাঙ্গ পাসপোর্ট চেক করে বললো, “ব্যাংলাডেশ, ব্রাদারস কিলিং ব্রাদারস।” শুধু শুনলাম, তারপর অনুভব করলাম আমার চামড়া গন্ডারের চেয়েও মোটা; তাতে অপমান, দুঃখ, কষ্ট কিছুই স্পর্শ করেনা। পরবর্তী গন্তব্য আবুধাবী, পাশের সহযাত্রী বিক্রাম ছুটি কাটাতে তার দেশ ভারতে ফিরছে। তার মন খুব প্রফুল্ল, কারণ তিন বছর পর দেশে ফিরছে, সেই নিজে থেকে কথা শুরু করলো। আমার দেশ বাংলাদেশ শুনেই বলে উঠলো, “ওহ গশ… তোমার বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর হত্যাকান্ড চলছে।” নিঁচু গলায় বললাম, “জানি।” বিক্রাম জিগেস করলো, “ছুটি কাটাতে যাচ্ছো?” বললাম, “সেরকমই।” বললো, “খুব সাবধানে থেকো।”

আবুধাবি থেকে ঢাকার কানেক্টিং মাত্র একঘন্টা সময় তাই নেমেই দৌড় লাগালাম। পাশের ছিটে কেরানীগঞ্জের এক ছেলে, নামটি মনে নেই। দুবাই থেকে ছুটিতে দেশে যাচ্ছে, আগেরবার বাহরাইনে ছিল সেবার সুবিধা হয়নি। এখন ভাল আছে। অনেক প্রশ্ন তার, কোন দেশ খেকে আসলাম… কানাডায় কাজের সুবিধা কেমন… মাসে বেতন কত পাই… ইত্যাদি। সেই ছেলেসহ তার সব বন্ধুদের ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “দেশে কি হয়েছে জানে কিনা?” বললো, “আর্মিদের মধ্যে গন্ডগোল, সমস্যা নাই; কিন্তু এয়ারপোর্ট দিয়ে বের হতে কোন অসুবিধা হবে কিনা?” বললাম, “নাহ, গন্ডগোল শেষ।” জিয়া বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশন সেরে কাস্টমস দিয়ে বের হবো, এমন সময় নিয়ম মাফিক আটকালো, অপরাধ হলো – কানাডা থেকে আসছি আমার স্যুটকেস খালি কেন? ব্যাকপ্যাকে রাখা দুটো ল্যাপটপ স্কানিংএ ধরা পড়েনি। তারপর ব্যাকপ্যাক খুলে যেন দুইটা লোভনীয় ‘বাঘের ছানা’ একসাথে দেখতে পেল। বললো, “দুইটা ল্যাপটপ!? কাগজ কই?” বললাম, “কাগজ তো নেই, একটা আমার নিজের, আরেকটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষকের, তার ভাই আমার কাছে দিয়েছে পৌছে দিতে।” বললো, “হবেনা, স্যারের সাথে দেখা করেন।” তাদের স্যারের কাছে গিয়ে বললাম, “দেখুন, আমি কানাডাতে পড়ছি, বিডিআরের হত্যাকান্ডে আমার বড় ভাই মারা গেছেন। নতুন ল্যাপটপটা এক বন্ধুর অনুরোধে তার ভাইয়ের জন্য বয়ে এনেছি।” ল্যাপটপটা নাড়াচাড়া করে দেখতে লাগলো। বললো, “ট্যাক্স সহ আনডিক্লেয়ার্ড হিসেবে আনার জন্য জরিমানা দিতে হবে।” বললাম, দিব। তিনি লেখা শুরু করলেন, তিন হাজারের কিছু বেশি টাকার পরিমানে। কিন্তু আমার পকেটে তখন টাকা বা ইউএস ডলার কিছুই নেই, আছে শুধু কানাডিয়ান ডলার। শুনে বললো, “বাসা কোথায়?” বললাম, “গ্যারিসন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।” বললো, “এখন কেউরে দিয়ে টাকা আনাইতে পারবেন?” বললাম, “দাড়ান, দেখি কেউ নিতে এসেছে কিনা দেখে আসি।”

এমন সময় আমার বড় বোন আমাকে গ্রীলের ওপাশ দিয়ে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি আপুকে দেখে সব রেখে আগে ওর কাছে গেলাম। তারপর বললাম, সেখানকার ঘটনাটা, আমার বোন কাস্টমসের সেই লোকদেরকে বললো, “প্লিজ, অনেক হয়েছে, আপনারা কি মানুষ না অমানুষ? দরকার হলে ওটা রেখে দেন।” কাছেই এনএসআই/ডিজিএফআইয়ের একজন লোক ওয়াকিটকি হাতে পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করছিলেন। আমার কাছে এসে বললেন, “আপনার ভাইয়ের নাম কি?” বললাম, “মেজর শাহনেওয়াজ।” লোকটা শক্তভাবে কাস্টমসের লোকগুলোকে বললো, “ছেড়ে দেন।” কাষ্টমসের লোকগুলো বলতে লাগলো, “মানবিক গ্রাউন্ড, কিছু তো আর করতে পারিনা, আর এইভাবে কখনো আনবেন না।”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে এলাম। নিজেকে তখন খুব অসহায় আর নির্বোধের মতো লাগছিল। আমার বোন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। এয়ারপোর্টের অপেক্ষমান অসংখ্য মানুষ তা দেথছে। কি করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম যেন, তারপর বোনকে ধরে বললাম, “ভাইয়ার কি দাফন হয়ে গেছে?” আপু বললো, “গতকাল হবার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। আজ সকালে পুরানো এয়ারপোর্টে জানাজা হবে, তারপর।” জিগেস করলাম, “দাফন কোথায় হবে?” ও বললো, “বনানী সামরিক কবরস্হানে।” তারপর ওকে শক্ত করে ধরে বললাম, “চল, বাসায় যাই।”

সবাই বিধ্বস্ত। আমি কারো দিকে তাকাতে পারছি না। আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাইয়াকে কোথায় রাখা হয়েছে?” বললো, “সিএমএইচ-এর মরচুয়ারিতে।” কফিনে তখন জাতীয় পতাকা লাগানো হয়ে গিয়েছে। কফিন আর খোলা হবেনা। ভাইয়ার সেই পঁচন ধরে ফুলে ওঠা আর চামড়া উঠে যাওয়া মুখ দেখার কোন ইচ্ছে আমার ছিলনা। আমি ভাইয়ার কফিনটা ছোঁয়া মাত্র, পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট পাথরের মতো বুকে চেপে বসলো। গভীর এক শূন্যতা, আমার পিকো ভাইয়া আমার সামনে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত একটি লাশ! সেই কর্পুর আর চা পাতার মিলিত গন্ধের সাথে গলিত লাশের গন্ধ আমি এখনো অনুভব করি। আমি লাশ ঘরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। আমার বোন এসে আমাকে বের করে নিয়ে এলো। বাসায় ফিরে দেখি ভাবী, আম্মা সবাই সাদা কাপড় পরেছে জানাজায় যাবে তাই। এরপর আমি আর অবিরত ঝরতে থাকা চোখের জল লুকানোর কোন চেষ্টা করিনি …

[লেখালেখি আমার তেমন সহজাত না। মূলতঃ আমার বড় ভাই মেজর হোসেন সোহেল শাহনেওয়াজ (পিকো) যিনি গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকান্ডে শহীদ হন, একবছর পর তাকে স্মরণ করতে এই স্মৃতিচারণ। তিনি রংপুর ক্যাডেট কলেজের প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট এবং প্রথম কলেজ প্রিফেক্ট ছিলেন। আর সিসিবির চাওয়ালা-খ্যাত রকিব অনেকদিন ধরে খোঁচাচ্ছিল আমি যেন সিসিবি’র জন্য কিছু লিখি, তাই এই লেখা। লেখাটির অর্ধেক আমি বিজয়ে লিখেছিলাম, রকিব মিডটার্মের মধ্যে সেগুলো ইউনিকোডে আবার টাইপ করে দিয়েছে। সেজন্য রকিবকে নিরন্তর ধন্যবাদ।]

৩৬ টি মন্তব্য : “মঙ্গলালোকে ফিরে দেখা”

  1. রকিব (০১-০৭)

    লেখাটা প্রথম যখন পড়েছি; অনেকবার আমাকে থমকে যেতে হয়েছে। ঝাপসা চোখ বারকয়েক হাতের তেলোয় মুছে নিয়ে আবার পড়া শুরু করেছি।
    দোয়া করি, পিকো ভাইয়াকে আল্লাহ উনাকে শান্তিতে রাখুক। আমরা জেগে আছি ভাইয়া; জেগে আছি।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    হাজার মাইল দূরে থেকে এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাবার পর সেটার এমনভাবে প্রকাশ আগে কখনো পড়িনি-প্রার্থনা করি পড়তেও যেন না হয়।লেখাটিকে অসাধারণ বললেও কম বলা হবে।মনে হচ্ছে এক বছর আগের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছি...

    বিডিয়ার গেটের সেই মেজর ভুলতে পারেন,আরবদেশের বাঙ্গালি সেই সেনা অধিনায়ক সেদিন পার্টির আদেশ দিতে পারেন,ভুলতে পারে ইন্টেলেকচুয়াল মাস্টারবেশনে রত টক শো এর শত শত তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষেরা ভুলিনি।
    ভুলিনি বলেই নাম না জানা পথচারির পরম মমতায় নিভে যাওয়া মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যায়, যাদেরকে আমরা "ইয়ো" বলে জানি সেই ইংলিশ মিডিয়ামের আধোবাংলা-আধো ইংরেজি বলা ছেলেমেয়েরাও কালো পোশাকে আমাদের সাথে এসে সামিল হয়।

    জেগে আছি,আমরা জেগে আছি!

    জবাব দিন
  3. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    আমার এখানে এখন মধ্য রাত। অনেকক্ষণ ধরে থেমে থেমে তোমার লেখাটি পড়লাম। চেষ্টা করেও চোখ ঝাপসা হওয়া ঠেকাতে পারলামনা। এই মুহুর্তে আমার তোমাকে বলার কিছু নেই।

    জবাব দিন
  4. আছিব (২০০০-২০০৬)

    ভাইয়া,খুব যত্নে লিখেছেন স্মৃতিচারণখানি।জানি,কতটূকু কষ্ট আর বেদনা বুকে নিয়ে থাকলে এক বছর আগে ঘটা এই নির্মম ঘটনা এত বিস্তারিত লিখতে পারেন।
    খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম আর অনুভব করতে চেষ্টা করছিলাম আপনার কষ্টটুকু।জানি,ধারেকাছেও যেতে পারিনি,পারবও না কোনদিন।
    আপনার সংকটময় মুহূর্তে বিদেশীরা যে সহমর্মিতা দেখিয়েছে,তাতে আমি সত্যি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত না হয়ে পারলাম না।দুঃখের বিষয়,ওই একই সময়ে আমরা বাঙ্গালীরাই ঘাতকদের আশ্রয় দিয়েছি!!! ধিক্কার জানাই নিজেদের,কি আর বলব!

    দুজন লম্বামতো ইউনিফর্ম পরা কৃষ্ণাঙ্গ পাসপোর্ট চেক করে বললো, ব্যাংলাডেশ, ব্যাদারস কিলিং ব্রাদারস।

    আমার মনে হল,আমার গালে কেউ একটা চড় মারল,কিন্তু আমার কিছুই করার নেই!!!
    ভাই,দয়া করে লিখতে থাকুন।আপনার লেখা আরো পড়তে চাই।

    এতটা মন খারাপ হল যে কোন ইমো দিতে পারছি না।পুরোটা কাহিনী চোখের সামনে ভাসছে শুধু।

    জবাব দিন
  5. বিডিআর এর এই ঘটনা যখনই মনে হয়...... তীব্র কষ্টে চোখ ভিজে যায়... ঝরতেই থাকে অশ্রু... এই লেখা পড়ে আবার ...

    নিজেকে খুব অপরাধী লাগে... অসহায় লাগে... কী করতে পারি!!??
    আল্লাহ আমাদের ছেড়ে দূরে চলে যাওয়া মানুষগুলোকে শান্তিতে রাখুন...

    জবাব দিন
  6. মোকাররম আহমেদ (৮৫-৯১)

    আমি মিরাকলে বেচে ফেরা এক মানুষ.তোমার লেখা পরে আমি অনেক সময় ধরে কাঁদলাম.তোমার মত একই অবস্তা ছিলো আমার বাবা,মা,ভাই,বোন যারা বিদেশ ও দেশ এ সিলো. বড় কষ্ট নিয়া এই বাচা. প্রতি নিঅত নিজের সাথে যুদ্দ করা.

    জবাব দিন
  7. তানভীর (০২-০৮)

    আমি আমার চোখের জল আটকাতে পারলাম না.অসাধারণ লেখা .আমরা এই হত্তাজগ্গের বিচার আজ ও পেলাম না .এরকম অবস্তাহর মধ্যে যেন আর কোনো ভাই কে না যেতে হয় সেই পার্থনায় করি .ভাই হারানোর বেথা শুধু যে হারিয়েছে সেই যানে.

    জবাব দিন
  8. সকাল থেকে বেশ কয়েকবার এসে ঘুরে গেছি,কিন্তু কিছুই লিখতে পারছিনা।
    কি বলা যায়,কি বলার থাকতে পারে?কষ্ট তো আর লেখা যায় না।
    উনার আত্মা শান্তি পাক।

    জবাব দিন
  9. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসলেও শাহনেওয়াজ ভাই স্মৃতিতে অমলিন, বিশেষ করে BIISS আর ROCA-য় তার সাথে কাটানো কয়েকটা দিনের কয়েকটা ঘন্টা...... তাকে সহোদর বড় ভাই ছাড়া আর কিছু কখনই মনে হয়নি।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  10. মেলিতা

    ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়লাম। একবারে পড়ার মত মানসিক শক্তি পেলাম না।পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়ে কোন লেখায় আমি কখনো মন্তব্য করি না। কারন স্বজনদের স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা আমি জানি না। আমি আপনার লেখা পড়বার সময় আপনার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভয়ঙ্কর শুন্যতা অনুভব করছিলাম(যা কিনা আপনার, আপনার পরিবারের কষ্টের কোটি ভাগের একভাগ ও না) তাইপ্রথমবার পড়ার সময় দ্রুত এই পৃষ্ঠা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। আপনাকে কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই। শুধু বলি কোন উপকারে লাগলে ছোটবোনকে জানাবেন।

    জবাব দিন
  11. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    জানিনা কাপুরুষের মত আর কত কাঁদব...
    আল্লাহ এই জাতিকে কবে সভ্যতার আলোয় আলোকিত করবেন?
    ভাইরে, তোমার লেখাটি পড়ে বুকের কষ্টগুলো আরো বেড়ে গেল...ভীষণ জ্বালা করছে চোখ দুটো...কি-বোর্ডটাও ঝাপসা হয়ে আসছে...কি লিখা উচিত বুঝে উঠতে পারছিনা...
    আমাদের ক্ষমা করোনা ভাই...আমরা তোমার পিকু ভাইকে বাঁচাতে পারিনি...আমাদের ক্ষমা করোনা...

    জবাব দিন
    • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

      যখন শুনি যে র‌্যাব থেকে আগত দুর্ধর্ষ কর্নেল গুলজার স্যার বার বার ফোনে বলছেন-স্যার,ডজনখানেক ট্রুপ্স পাঠান-আমি সব সমাধান করে ফেলছি-আর এই প্রতীক্ষায় থেকে থেকে তিনি কোন সাড়া পাচ্ছেন না;আরো যখন শুনি ডেকচির ভেতরে লুকানো অফিসারকে বের করে হত্যা করছে বিডিয়ার সেনারা-আমি খালি ভাবি,আমি তো কেউ না তারপরেও আমার এরকম লাগছে,যাঁদের স্বজন হারিয়ে গেল তাদের না জানি কিরকম লাগছে!

      স্রষ্টায় আমার বিশ্বাস নেই-কাজেই কাউকে যে অভিযোগ জানাব তার পথও বন্ধ।অক্ষম আক্রোশে চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে...

      জবাব দিন
  12. জিহাদ (৯৯-০৫)

    এই লেখাটায় এসে বার বার ফিরে গেছি। কোন মন্তব্য করা হয়নি।

    মাথার মধ্যে কেন যেন দ্য লাস্ট সামুরাই এ সামুরাই মাস্টার এর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে টম ক্রুজ এর বলা একটা ডায়লগ ঘুরছে শুধু -
    I won't tell you how he died. i will tell you how he lived.


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  13. রাব্বী (৯২-৯৮)

    যারা লেখাটি পড়লেন এবং ভাবনা জানিয়ে গেলেন তাদের সকলের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। সকল শহীদ বেঁচে থাকুক শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে আমাদের স্মৃতিতে।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
  14. কি লিখব তা্‌ বুঝতে পারছিনা…
    আমাদের স্মৃতিতে সকল শহীদেরা বেঁচে থাকুক শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে,সব শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।আল্লাহ সবাইকে শান্তিতে রাখুক,সবাইকে বেহেস্ত নাসিব করুক…

    জবাব দিন
  15. হিল্লোল (৯২-৯৮)

    দোস্ত কি বলব? পিকো ভাই ছিল পিসিসি ১৫ তম ব্যচএর আদরশ ।।।। আর এখন আমাদের দেশের গরব ।।।। আল্লাহ উনার আত্মাকে শান্তিতে রাখুক।।।।আমীণ হিল্লোল।।।।

    জবাব দিন
  16. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    লেখাটি পোস্ট করার পর থেকেই এসে এসে দেখে যাচ্ছি। একদম প্রথমে ভেবেছিলাম রাব্বীরে চাইপা ধরবো এই কচুপাতা নাম পাল্টানোর জন্য। কিন্তু একটু পড়ার পর লেখাটা একেবারে শেষ করার সাহস আর পাইনি।
    এরপর একদিন পুরোটা একেবারে পড়ার পর থম মেরে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। কেন যেন মনে হচ্ছিলো পিকো ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট ভাইটার হাজার মাইল দূরে বসে প্রচন্ড অস্থিরতা আর ছটফটানোটা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি। আর এর সাথে সেদিনের নির্মম ঘটনা প্রবাহের দমবন্ধ করা সময়টা যেন আবার ফিরে এসে চেপেধরেছিলো।

    পিকো ভাই সহ সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং স্রষ্টার নিকট তাঁদের জন্য প্রার্থনা।

    দোস্ত, ভালো থাকিস।

    অসাধারণ লেখার হাত তোর। কচুপাতার আড়াল থেকে রাব্বীকেই চাইবো লেখালেখি নিয়ে সিসিবিতে নিয়মিত।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  17. নাফিজ (০৩-০৯)

    ভোরবেলা লেখাটা পড়ে থমকে গেলাম...
    শহীদের পরিবারের কষ্টকে অনুভব করা বাকিদের পক্ষে সম্ভব না, নাহলে প্রার্থনা করতাম অন্তত একবারের জন্য যাতে কষ্টটার স্বরুপ বাংলাদেশের মানুষগুলো অনুভব পারে, আমরা যাতে অনুভব করতে পারি- কিছু মানুষের কত চড়া দামের বিনিময়ে আমাদের এই ভালোভাবে বেঁচে থাকা ।

    শাহনেওয়াজ ভাইয়ের জন্য শ্রদ্ধা...


    আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।