ভূমিকা
এই লেখাটি প্রকাশের ব্যাপারে আমার মনের দ্বন্দ এখনও ঘোঁচেনি। স্বাধীনতার পর প্রায় দীর্ঘ ৪০ বছর পার হতে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের মনের গভীরে যে দীর্ঘ ক্ষত তা কি এখনও শুকিয়েছে ? নতুন প্রজন্ম যে আবেগ ভরা স্বাপ্নীল চোখে স্বাধীনতার সংগ্রামী সেনানীদের দেখে – তাদের মনে কি এই লেখা কোন ভুল ধারণার সৃষ্টি করবে? সেটা তো আমার কাম্য না। কিন্তু আমি নিজের চোখে যা দেখেছি, সেটাও তো মিথ্যা না। সর্বমোট ১০৮ জন নির্দোষ নারী, পুরুষ ও শিশুকে যে প্রতিহিংসার কারনে অকালে হত্যা করা হয়েছিল, সেই সত্যের সাথে যদি এত দিন পরে আমরা মুখোমুখি দাঁড়াতে না পারি তা হলে কি আমরা কখনও স্বাধীন জাতি হিসাবে বড় হতে পারবো? মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন ’সবাই যদি চোখের বদলে চোখ নেওয়া শুরু করে তাহলে সবাই এক দিন অন্ধ হয়ে যাবে।’
তাই আমি অন্ধ হবার আগে জোড় গলায় বলতে চাই – অন্যায় সব সময়ই অন্যায়, তার পিছনে যতই যুক্তি থাক। স্বাধীনতার যুদ্ধে আমার দুই চাচাকে আমি হারিয়েছি। তাদের এক জনকে পাকিস্তানী মিলিটারীরা ধরে নিয়ে অন্যদের সাথে নদীর ধারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল এবং অপর চাচাকে স্থানীয় বিহারীরা তাকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আমার চাচাদের মৃত্যু যেমন অন্যায় ছিল, তেমনি অন্যায় ছিল আমার দেখা এই সব নিরীহ মানুষের মৃত্যু। তবু যদি এই লেখা কারও মনে আঘাত সৃষ্টি করে – তবে আমি আগে থেকে নিঃস্বর্ত ক্ষমা চাইছি তার কাছে।
আমি আমার স্ত্রী পিংকুকে ডেকে বললাম – আমরা বারান্দায় বসেই যুদ্ধ দেখতে পারবো। তবে আমি কখনো ভাবিনি যে আমার কথা এভাবে ফলে যাবে। দিনটি ছিলো ২৭-শে মার্চ, ১৯৭১।
আমি তখন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ইস্পাহানী জুট মিলে কাজ করছি। আমাদের ৩-তলার কোয়াটার থেকে পরিস্কার দেখা যেতো কর্ণফুলী নদীর উপরে কালুরঘাট ব্রিজ। শহর থেকে চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশের সাথে যোগাযোগের এক মাত্র রাস্তাটি ছিলো এই ব্রিজের উপর। আমি জানতাম যে সমগ্র জেলা দখলে রাখার জন্যে এই ব্রিজটির গুরুত্ব অনেক। সাধারণ সময়ে এই মিলটি দিবা-রাত্রি ৩ শিফটে ২৪ ঘন্টা একটানা চলতো। আমি তখন নতুন প্রকৌশলী হিসাবে সবে এই মিলে চাকরী পেয়ে মিলের উইভিং সেকশানে যোগ দিয়েছি। সবে বিয়ে করেছি তখন মাত্র মাস খানেক আগে। এটা ছিল আমাদের জীবনের সেরা সময় – তবে খুব ক্ষণস্থায়ী ।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি ছাত্র রাজনীতির সাথে বেশ জড়িত ছিলাম। ১৯৬৯-এর আইয়ুব বিরোধী গণ অভ্যুত্থানের সময় সক্রিয় অংশ গ্রহন করেছিলাম। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের EPSU (Menon) -গ্রুপের তখন আমি সভাপতি। কিন্তু বিয়ের পরবর্তী এক মাস কোন খবরের কাগজ পড়ার মত সময় ছিল না আমার। ফলে ঐ সময় বাইরে কি হচেছ সে বিষয়ে কিছুই খোঁজ রাখতাম না। পয়লা মার্চ বিকেলে যখন চট্টগ্রামের এস, পি শামসুল হক সাহেবের বাসায় বেড়াতে গেলাম তখন দেখলাম তারা বেশ চিন্তাক্লিষ্ট। সেই দিনই ইয়াহিয়া খান আসন্ন জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করেছে। সবাই যেন প্রত্যাশা করছে কোন কিছুর আগমনের।
৭ই মার্চের মুজিবের রেকর্ড করা ভাষণ রেডিওতে শুনলাম। ভাষণ শেষ করলেন ’জয় বাংলা’ এবং ’পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে [এটা আমার নিজের কানে শোনা, তবে রেডিওতে তার ভাষণের শেষে এটা আগের কোন ভাষণ থেকে এনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে কিনা, তা সঠিক বলতে পারব না]। ২১শে মার্চ ভুট্টো এল ঢাকাতে – প্রায় প্রত্যেক দিন মিটিং মিছিল সমানে হয়ে চলেছে ঢাকাতে। কিন্তু আমরা তখন আমাদের নিজেদের ছোট দুনিয়াতে ব্যস্ত।
২৩ শে মার্চ পাকিস্তান দিবস পালন করার বদলে সবাই বাড়ীতে সবুজ, লাল, হলুদ বাংলাদেশের পতাকা উড়াল [বর্তমান বাংলাদেশের পতাকার লাল সর্যের মধ্যে তখন হলুদ রঙের পূর্ব-বাংলার একটা ম্যাপ ছিল]। আমি ও পিংকু ঠিক করলাম এই দিনে পতেঙ্গা এয়ার পোর্টে যেতে। পথে এক দোকান থেকে ছোট একটা পতাকা কিনে গাড়ীর এন্টেনাতে ঝুলিয়ে দিলাম। পিংকু ক্রু-মেসে যেতে চাইল। আমাদের অনেক স্মৃতি বিজড়িত স্থান এটি। এখানেই আমি তাকে প্রথম বিয়ের প্রস্তাব করি। অসহযোগ আন্দোলনের জন্যে তখন স্বাভাবিক বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে ছিল এবং পাকিস্তান মিলিটারীর দখলে ছিল এয়ারপোর্ট। আমরা এ সবের কিছুই জানতাম না। চার পাশে কি হচ্ছে তারও খুব একটা খবর রাখতাম না। ক্রু-মেসের সামনে গাড়ী থামাতেই পিংকু তার বহু পরিচিত ঘরের মধ্যে সোজা ঢুকে যেয়ে সেখানকার রেকর্ড-চেন্জারে তার প্রিয় কিছু হিন্দী গান চড়িয়ে দিল। ক্রু-মেস তখন এক আর্মি মেজরের দখলে। তার ব্যাটম্যান [ব্যাক্তিগত অর্ডারলী] আমাদের এত স্বাচ্ছন্দ ব্যবহার এবং এই স্থান সম্পর্কে জ্ঞান দেখে আমাদেরকে আর কিছু বলতে সাহস পেল না। আমরা তখনও গান শুনছি যখন মেজর সেখানে ফিরল। আমি তাকে বললাম আমার স্ত্রীর পছন্দের গানগুলি শুনতে আমরা এখানে এসেছি। মেজর ভদ্রতা করে আমাদেরকে চা খেতে বললেন। যেহেতু আমাদের গান শোনা ততক্ষণে শেষ হয়েছে, আমরা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসলাম।
ফেরার পথে ইস্টার্ন রিফাইনারীতে থামলাম আমার বন্ধু মতিনের সাথে দেখা করার জন্যে। সে খুবই অবাক হল যখন শুনলো যে আমরা এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। সে জানালো যে বেশ কিছুদিন ধরে কাউকেই এয়াপোর্টে যেতে দেওয়া হচ্ছেনা। সে যখন আমাদের গাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা দেখলো আর জানলো যে আমরা সেই পতাকা নিয়েই এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম – চমকে উঠলো সে। বুঝলাম যে আমাদের বোল্ডনেস দেখে আর্মি মেজর সম্পূর্ণ কনফিউজড হয়ে গিয়েছিল এবং আমাদের সাথে কি করবে বুঝে উঠতে পারেনি। মতিন তখনি আমাদেরকে খুব সাবধানে ঘরে ফিরে যেতে বলল। সে আরও জানালো যে পরিস্থিতি মোটেই ভাল না। ইংরেজীতে একটা কথা আছে – “Where angles fear, fools dare” – বুঝলাম আমরাই হচ্ছি সেই ’ফুলস’।
২৭ শে মার্চ বিকেলে রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ করে শুনলাম কোন এক মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করে নিজেকে অস্থায়ী সরকার প্রধান ঘোষনা করছে। তার ঘোষনা ছিল ইংরেজীতে এবং উচ্চারণ ছিলো অনেকটা অবাঙ্গালীদের মতো। ঘোষনা খুব পরিস্কার শুনতে পেলাম যেহেতু কালুরঘাটের রেডিও ষ্টেশন আমাদের বাসা থেকে মাত্র চার মাইল দুরত্ত্বের মধ্যে ছিল। সাধারন ঢাকা ও চট্টগ্রাম রেডিও ষ্টেশন তখন বন্ধ ছিল এবং আমি রেডিওর নব ঘুরিয়ে যে কোন ষ্টেশন ধরে খবর শোনার চেষ্টা করছিলাম – তখনই শুনলাম জিয়ার এই ঘোষনা। আমি খুব উৎফুল্ল হলাম এই ঘোষনা শুনে এবং পিংকুকে আমার এই উত্তেজনার অংশিদার করে নিলাম। তখনি আমি তাকে বলেছিলাম যে – আমরা বারান্দায় বসে যুদ্ধ দেখতে পারবো।
এর পর থেকে সব সময় রেডিও অন করে রাখতাম বিভিন্ন খবর শোনার জন্যে। ৩০ শে মার্চ বিকালে দেখলাম দুটি এয়ার ফোর্সের প্লেন ডাইভ মেরে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। পরে দেখলাম বিমানের আক্রমনে কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্তব্ধ হয়ে গেল।
কালুরঘাটের বিশাল এই মিলে ৮০০০-এর বেশী শ্রমিক কাজ করতো। সব সময় আওয়াজ আসতো এই মিল থেকে – উইভিংয়ের শাটল, ঘুরন্ত চাঁকা, মালামাল নামানো ওঠানো, লোকজনের কথা ও চিংকারে গমগম করতো সারাটা সময়। কিন্তু গত ক’দিন ধরে এই মিল ছিলো নিস্তব্ধ । মিলের প্রায় সমস্ত শ্রমিক মিল ছেড়ে চলে গেছে। গত দু’দিন ধরে চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানী মিলিটারীর দখলে। কিন্তু আমাদের মিল তখন ৮-ম ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী বাঙ্গালী সেনাদের দখলে।
এই বিশাল মিলে তখন শুধু ৩ জন অফিসার স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারছিলো – মিস্টার কার্টহিল, মিলের স্কটিশ জেনারেল ম্যানেজার, মিস্টার কাদের – যার স্ত্রী তখন ময়মনসিংহে তার বাবার বাড়ীতে সন্তান প্রসবের জন্যে ছিলেন ও তিনি মিলে একা ছিলেন এবং সস্ত্রীক আমি। আরও কিছু অবিবাহীত বাঙালী অফিসার ব্যাচেলার মেসে থাকতো – তারা সবাই তখন মিল ছেড়ে চলে গেছে। আমার স্ত্রী এবং আমিই ছিলাম কনিষ্টতম আমাদের আফিসার্স কোয়াটারে। পিংকুর বয়স তখন ২১ আর আমার ২৪। সব অবাঙ্গালী অফিসার ও তাদের পরিবার তখন এক রকম গৃহবন্ধী এবং অন্য বাঙ্গালী অফিসার ও স্টাফ মিল কম্পাউন্ড ছেড়ে চলে গেছে।
আগের রাতে আমার এক সহকর্মী আমাদেরকে দেখতে এলেন। আমার মটর সাইকেল তিনিই কিনেছিলেন এবং তিনি মিলের শ্রমিক সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি আমাদেরকে অনতিবিলম্বে মিল ছেড়ে চলে যেতে বললেন।
– কিন্তু কোথায় যাবো ? – আমি তাকে প্রশ্ন করলাম।
– যেখানে পারেন যান। শুধু এখানে থাকবেন না। এটা আর নিরাপদ জায়গা না – বললেন তিনি।
আমি জানতাম যে চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানী মিলিটারীর দখলে। ওখানে আমার কিছু বন্ধু ছিলো, কিন্তু শহরে যাওয়াটা নিরাপদ হতো না। আমি ঠিক করলাম বরং এখানেই অপেক্ষা করে দেখি। তাছাড়া মাসের শেষ তখন, হাতেও তেমন কিছু টাকা নেই। ব্যাংকে আমার যা টাকা ছিলো তার প্রায় সবটায় কিছুদিন আগে তুলেছিলাম আমাদের প্রথম গাড়ী কেনার জন্যে। কাল রংয়ের ট্রাম্প হেরাল্ড গাড়ীটা তখন আমার মালিকানায় মিলের কমন গ্যারাজে – তবে মালিকানা বদলের কাগজ পত্র তখনো সংগ্রহ করা হয়নি।
এর আগের দিন একটি দুঃখ জনক ঘটনা ঘটে গেল। কর্ণফুলী নদী দিয়ে উজানে যাচ্ছিল একটি নৌকা । শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ’ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার’ ডাকের আহ্বানে সারা দিয়ে মিলের কিছু শ্রমিক-কর্মচারী ততক্ষণে এই মিলে এক প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করেছে। মিলের সিকিউরিটির হাত থেকে সমস্ত বন্দুক ও রাইফেল তারা দখল করে নিয়েছে। তারা সক্রিয় ভাবে নদীর পার পাহারা দিচ্ছিল। ছাউনি দিয়ে ঢাকা নৌকা উজানে যাচ্ছে দেখে তারা নৌকাকে তীরে ভিড়াতে আদেশ দিল। তারা যখন দেখলো যে তাদের কথা মত নৌকা থামল না তখন তারা নৌকার উদ্দেশে গুলি করা শুরু করল। এর ফলে নৌকাটি উল্টে গেল নদীতে। পরে পড়ন্ত বিকেলে দুটি ছোট শিশুর লাশ ভেসে উঠল নদীতে।
৩১ শে মার্চ সকাল থেকে থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা গেল। কি হচ্ছে দেখার জন্যে আমি বেরিয়ে আসলাম। যখন ব্যাচেলার অফিসার্সদের মেসে গেলাম তখন এক যুবক অফিসারকে দেখলাম। তাকে আমি অবাঙ্গালী বলে জানতাম, তবে সে বাংলাও বলতে পারত। সে জানাল যে অন্য সব অবাঙ্গালী অফিসারদের সাথে তাকেও মিলিটারীরা মেস থেকে নিয়ে লাইনে দাঁড় করায় গুলি করে মারার জন্যে। তবে সে মিলিটারী অফিসারকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে সে বাঙ্গালী এবং তখন তারা তাকে ছেড়ে দেয়। আমাদের সাথে কথা বলার সময় সে তখনও কাঁপছিল। এত ফ্যাকাশে মুখ লোক আমি আগে কখন দেখিনি। সে অন্যদের একটু হাসি দেবার চেষ্টা করল এবং বাংলাতে কথা বলে যেতে লাগল, তবে কেউ যে তার কথা খুব একটা শুনছে মনে হল না।
মিলের অবাঙ্গালী এ্যাডমিন্সিট্রাটিভ ম্যানেজার সারওয়ার্দী সাহেব এক শ্রমিক নেতাকে এক লাখ টাকার বিনিময়ে এই আশ্বাস পেয়েছিলেন যে তার এবং তার পরিবারের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু সকালে মিলিটারীরা তাকে অন্যদের সাথে ধরে নিয়ে গুলি করে মারে। সেখানে সেই শ্রমিক নেতাও ছিল। মারা যাবার আগে ম্যানেজার সেই নেতাকে বার বার আকুতি জানিয়েছে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করতে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
এ সব শুনে আমি আমাদের কোয়ার্টারে ফিরে এসে পিংকুকে বললাম এই মিল কম্পাউন্ড ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়াই আমাদের জন্যে ভাল হবে। সেও রাজী হল আমার কথায়। আমি তাকে বললাম একটি সুটকেসে দরকারী কিছু জিনিসপত্র ভরে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিতে। আমি আবার নীচে নেমে দেখলাম আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনেই জেনারেল ম্যানেজার কার্টহিল এবং কাদের সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। কার্টহিলকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। মনে হল তার নিজের উপরও যেন তার আর কোন নিয়ন্ত্রন নেই। সে অসহায়ের মত আমাদের কাছে সান্তনা ও সাপোর্ট চাচ্ছিলো। আমি তাকে আমাদের সাথে দুপুরের খাবারের জন্যে বললাম। আমাদের বাবুর্চী আলী আকবর আমার চা বাগানে কাজ করার সময় থেকেই আমার সাথে আছে। আমি তাকে আগের থেকে কেনা তিনটি মুরগীই জবাই করে রান্না করতে বললাম।
হাকিম সাহেব ছিলেন মিলের একজন সহকারী স্টোর কিপার। তিনি এবং তার পরিবার আমাদের সামনের বিল্ডিংয়ের নীচের তলার কোয়ার্টারে থাকতেন। তার একটি সুন্দরী দেখতে মেয়ে ছিল, যাকে দেখতে আমার ভালই লাগতো – তখনও আমার বিয়ে হয়নি। হাকিম সাহেবের এক প্রতিবন্ধী ছেলেও ছিল যে ঠিক মত হাঁটতে পারতো না। আমি দেখতাম পরিবারের সবাই মিলে হাত ধরাধরি করে ওই ছেলেকে হাঁটাতে শেখাচ্ছে। এই অসুবিধা সত্বেও তাদেরকে একটি সুখী পরিবার মনে হত আমার। যখনই তাদের কারও সাথে কোথাও দেখা হতো, তারাই আগে “সালাম আলাইকুম” বলে সম্ভাষন জানাতো।
আমি তখনও নীচে রাস্তার উপর কার্টহিল ও কাদেরের সাথে দাঁড়িয়ে, যখন দেখলাম ৬-৮ জনের এক মিলিটারী প্লাটুন কয়েক জন অবাঙ্গালী অফিসার ও কর্মচারীকে ঘেরাও করে আমাদের দিকে হাটিয়ে নিয়ে আসছে। হাকিম সাহেব সহ প্রায় এক ডজন লোক ছিল সেই দলে। হাকিম সাহেব খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতেন। শুনেছিলাম কাজ করার সময় এক বেল পাট তার পায়ের উপর এসে পড়ে তাকে এই ভাবে খোঁড়া করে ফেলে। হাকিম সাহেব আমার সামনে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং তার দুই হাত আমার দিকে প্রসারিত করে দিলেন। তিনি আমার দুই হাত তার হাতের মধ্যে ধরে নীচু গলায় উর্দ্দুতে বললেন “যদি কখনো না জেনে আপনাকে কোন আঘাত দিয়ে থাকি, আমাকে মাপ করে দেবেন।” আমি কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু মুখ থেকে কিছুই বের হলো না। তিনি আমাকে ওই কথা গুলি কেন বললেন – তাও আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আমি উপরে উঠে এসে পিংকুকে বললাম আর দেরী করা ঠিক হবে না। আমরা তখনই ঐ স্থান ত্যাগ করতে মনস্থির করলাম। পিংকু একটার বদলে দুটো সুটকেস গুছিয়েছিল এবং তার বিয়ের সমস্ত গহনাও সেই ভাবে দুটো সুটকেসে ভরেছিল। আমি তাকে একটা সুটকেস সেখানে ফেলে রেখে আসতে বললাম। আমাদের সংসারের বাকী সব কিছুও পরে রইল সেখানে – রান্না-না-করা তিনটি জবাই করা মুরগীর সাথে।
প্রথমে মিলিটারীরা চেষ্টা করেছিল যেন আমরা না যাই। তারা বলেছিল যে তারা সেখানে একটি বড় কামান বসাবে এবং আমাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করবে। বড় কামান বসালে যে এটা শত্রুর আক্রমনের আরও লক্ষবস্তু হবে সেটা আমি বুঝতাম। তাই আমি একটু মিথ্যা করে বললাম যে আমার স্ত্রী খুবই ভয় পেয়ে গেছে এবং খুব কাঁদছে তাই আমাদের জন্যে মিল ত্যাগ করাই শ্রেয় হবে। আমার কম বয়সের স্ত্রীকে কাঁদ-কাঁদ চেহারায় দেখে বিশ্বাস করল তারা এবং তখন একটি গাড়ী নিয়ে এসে আমাদেরকে তাতে উঠতে বললো। এক জন মিলিটারী সৈনিক গাড়ীর স্টিয়ারিং ধরলো এবং আর একজন রাইফেল নিয়ে তার পাশে বসলো। আলী আকবর সামনে তাদের সাথে বসলো আর পিছনে পিংকু আর আমি।
আমরা যখন কোম্পানির গ্যারেজের কাছে আসলাম, তখন দেখলাম ১০-১২ জন লোক দেওয়ালের কাছে রাস্তায় পড়ে আছে। মাত্র দশ পনেরো মিনিট আগে গুলি বিদ্ধ হয়েছে তারা। তাদের শরীর থেকে তখনও রক্ত বেয়ে পড়ছে রাস্তায় । বুলেটের আঘাতে কয়েক জনের শরীর যেন দেওয়ালের সাথে গেঁথে গেছে।
হাকিম সাহেবকে দেখলাম – দুই চোখ খোলা – যেন সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার শরীর দেয়ালের সাথে ভর দিয়ে আধা-শোয়া অবস্থায় বসা – যেন বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি। তার সাদা সার্ট থেকে তখনও রক্ত বেয়ে পড়ছে। পিংকু ভয় এবং শক পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো। আমি দুই হাত দিয়ে তার চোখ ঢেকে রাখলাম। যখন গাড়ী মিলের গেটের বাইরে এল তখন হাত সড়ালাম তার চোখ থেকে। কিন্তু আমার কানে আমি তখনও শুনতে থাকলাম হাকিম সাহেবের কন্ঠ – “যদি কখনো না জেনে আপনাকে কোন আঘাত দিয়ে থাকি, আমাকে মাপ করে দেবেন।”
প্রথম 🙂 এই ব্লগে এটাও আমার প্রথম কমেন্ট। কাছাকাছি টাইমজোনে থাকার সুবিধা টা নিচ্ছি।
ধন্যবাদ হাফিজ তোমার প্রথম কমেন্ট করার জন্যে। কোথায় থাক তুমি? (সম্পাদিত)
আপনার আর আমার টাইম জোন এক জায়গায় হওয়াতে এই মূল্যবান পোস্টটিতে প্রথম কমেন্ট করার সূযোগটা ছারলাম না।
এভাবেই তো লিখবেন আপনারা - একদম যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন ঠিক সেভাবে। মুক্তিযুদ্ধের উপর এরকম ব্যক্তিগত অনূভূতির লেখা চোখের সামনে সে দৃশ্যটাকে তুলে ধরে। একেবারে হৃদয়োতসর্গিত লেখা না হলে শব্দ দিয়ে এভাবে ছবি আঁকা যায় না।
জাহানারা ঈমামের "একাত্তুরের দিনগুলি" তাই এতো মন ছুঁয়ে যায়। এসব লেখকদের কোন নির্দিষ্ট আবেগ বা দলের কাছে দায়বদ্ধতা নেই।
এ বিষয়ের উপর আপনার পুরো অভিজ্ঞতা শুনতে ইচ্ছে করছে।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
ধন্যবাদ শান্তা তোমার মন্তব্যের জন্যে। গতকাল শাহরিয়ার কবিরের সাথে কথা হচ্ছিল এই সব ব্যাপারে। ১৯৭১-এর অনেক ঘটনা আছে যেগুলি সহজে সাদা-কাল ভাবে ভাগ করা যায়না। একই বাড়ীতে বাবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আর ছেলে মুক্তি যোদ্ধা এমন ঘটনা জানি।
জাহানারা ঈমাম লেখিকা ছাড়াও রুমির মা - এ রকম হাজার মা আছে বাংলাদেশে। আমি কখনো চাই না তারা আমার লেখা ভুল বুঝে আঘাত পাক। দুঃখটা যে মানুষের একান্তই ব্যাক্তিগত আনুভুতি।
http://arts.bdnews24.com/?p=2769
ধন্যবাদ লিঙ্ক দেবার জন্যে। আর কেঊ কি জিয়ার এই কথিত বক্তবের সাক্ষী আছে?
"ইনশাল্লাহ দু’এক দিনের মধ্যে আমরা পাঞ্জাবিদের খতম করে দেবো। আর উর্দু ভাষায় যারা কথা বলে তারা সব আমাদের দুশমন। তাদেরকে শেষ করে দেন।"
একটা যুদ্ধ মানে তো অনেক অনেক অন্যায়ের সূচনা, সুযোগ, উদাহরণ। আমাদের কিছু সত্য জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
ঠিক বলেছ ফখরুল। একটু হিসাব করে দেখতো বর্তমান বাংলাদেশের সাকসেসফুল ব্যাবসায়ী, শিল্পপতীরা কে কি করছিলেন মুক্তি যুদ্ধের সময়।
অসাধারণ লাগলো। বেশি ভাল লেগেছে নিরপেক্ষ এবং ব্যক্তিগত কথ্যরীতি, যেন জার্নাল পড়লাম। একাত্তরের দিনগুলি আপনার চোখে দেখতে চাই।
আমার বন্ধুয়া বিহনে
ধন্যবাদ তোমার মন্তব্যের জন্যে। আসলে তোমাদের প্রজন্মের এই সত্য সন্ধানী মনের পরিচয় পেয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে আমি এখন যতেষ্ট আশাবাদী। জাতিগত ভাবে আমরা সব সময় বেশী ইমোশনাল। আমাদের নেতা-নেত্রীকে বেশি বেশি স্তুতি করে আমরাই তাদের সর্বনাশ করি। আসলে এটা ঠিক যে - "A nation gets the leader it deserves"
চমৎকার একটা লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। তখন পুরো কমেন্ট শেষ না করেই উঠতে হলো। আমি থাকি ওন্টারিও, কানাডাতে, আপনার ফেইসবুক লিস্টে আমাকে পাবেন Abdullah Hafiz নামে। 🙂
যাইহোক, আপনার অভিজ্ঞতার মতো আরো কিছু ঘটনা আমি আগে শুনেছিলাম। আসলে অস্ত্র হাতে মানুষের কোন বোধ শক্তি কাজ করেনা, তা সে যে উদ্দেশ্যই নিক কেন। আপনার এই অভিজ্ঞতাতেও এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। লেখায় একটা তথ্য ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারলাম, আর তা হলো ৭ই মার্চের ভাষনে বঙ্গবন্ধু ’পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলাটা। উনার সম্পর্কে সামান্য যা কিছু পড়েছি কিংবা সমসাময়িক কারো কাছ থেকে যা শুনেছি, তাতে উনাকে মহাত্মা গান্ধী, জর্জ ওয়াশিংটন কিংবা মুস্তফা কামালদের কাতারে ফেলতে পারিনা। ঠিক বুঝতে পারিনা, আমার কোথাও কোন ভুল হচ্ছে কিনা। (সম্পাদিত)
ধন্যবাদ হাফিজ। তুমি যা জানো তা অন্যদের সাথে শেয়ার করো।
"উনার সম্পর্কে সামান্য যা কিছু পড়েছি কিংবা সমসাময়িক কারো কাছ থেকে যা শুনেছি, তাতে উনাকে মহাত্মা গান্ধী, জর্জ ওয়াশিংটন কিংবা মুস্তফা কামালদের কাতারে ফেলতে পারিনা।"
আমিও পারিনাঃ
১. মহাত্না গান্ধী স্বাধীনতা ঘোষণা করেননাই, স্বরাজ স্বায়ত্তশাসনের সমার্থক, স্বাধীনতা-র নয়।
২. জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন সমরনেতা, প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৭৮৯-১৭৯৭। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষনা হয় ১৭৭৬ এ। তাঁকে কমান্ডার ইন চীফ ঘোষনা করা হয় ১৭৭৫ এ। 'ফাদার অফ দ্য কান্ট্রি' বলা হয় আমারিকার পুনর্গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখার জন্য। তাঁর জীবনীতে আমি কোথাও যুদ্ধ পুর্ববর্তী রাজনৈতিক ভূমিকা খুঁজে পাইনি। কর্মজীবন শুরু করেছিলান সার্ভেয়র হিসেবে, পরে মিলিশিয়া ট্রেনিং নিয়েছিলেন।
৩. কামাল পাশা, আধুনিক তুরস্কের জনক ছিলেন একজন দক্ষ সামরিক কর্মকর্তা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয় হলেও তিনি ছিলেন ঐ অঞ্চলের একমাত্র অপরাজিত কমান্ডার। ১৯২৩ এ তুরস্ক স্বাধীনতা ঘোষনা করে। ১৯৩৮ পর্যন্ত কামাল পাশা প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৩০ এর আগ পর্যন্ত সেখানে কেবলমাত্র একটাই রাজনৈতিক দল ছিলো। তিনি বিভিন্ন ভাবে রাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করেছিলেন, খালিফাত, গণতন্ত্র, উদারনীতি, একদল, বহুদল এরকম বেশ কিছু ফরম্যাটের সরকার যাচাই করে তুরস্কের জন্য যেটা উপযোগী সেটাই গ্রহণ করেছিলেন। দেশ পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য পেয়েছিলেন ১৫ বছর সময়।
- এবার অন্য একটা কথা, পুরো ব্লগ পড়েও আমি কিন্তু তোমার এই মন্তব্যের সাথে ব্লগের সম্পর্ক খুঁজে পেলামনা। ১৯৭১ নিয়ে কথা বলতে হলেই আমাদের বঙ্গবন্ধুর দোষ-গুন নিয়ে কথা বলতে হবে?
- ৭ই মার্চ এর প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে আমি শেষ কথাটার ব্যাপারে দ্বিমত শুনেছি। যারা রেডিও তে শুনেছেন তারা 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' শুনেছেন কিন্তু যারা রেসকোর্সে ছিলেন তারা শুনেননাই। এই অংশ টেপের সংযোজন কিনা এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। ব্লগার নিজেই যেখানে সন্দিহান সেখানে তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে? অনিশ্চিত/সন্দেহজনক তথ্য থেকে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রথমবার দেখলাম।
- 'সামান্য যা কিছু পড়েছো আর সমসাময়িকদের কাছে যা শুনেছো'; আরেকটু বেশী পড়লে ভালো হত। আর সমসাময়িকদের ব্যপারে আমি সবসময় জেনে নেই মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা কি করেছিলেন। আমার খুব কাছের কিছু মানুষ থেকে সেই সময়ের গল্পগুলো শুনি, এবং এখন আমি বিশ্বাস করি ব্যক্তি শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত নিরপেক্ষ তথ্য আমরা কখনোই পাবোনা, যার কারণে নির্মোহ দৃষ্টিতে তাঁকে দেখার আশা আর করিনা।
অটঃ আচ্ছা তুমি কি নজরুল হাউসে ছিলে? ক্যামন আছ? কোথায় আছ? কি করছো?
'৭১ নিয়ে নিরপেক্ষ বিশ্লেষন করা দরকার। কিন্তু সময় মনে হয় এখনো আসেনি। মনে হয় বলছি কারন, ৭১ নিয়ে নিরপেক্ষ বিশ্লেষন যারা করতে পারে তারা এখনো এই কাজে হাত দেয়নি।
যুদ্ধ সবসময় কুৎসিত আর বীভৎষ একটা জিনিস। যুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাস মানেই বিজয়ীর "মহান বিজয় গাথা"।
আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, বাংলার গ্রামে যত মত্তব্বর বা মোড়ল শ্রেনীর লোক ছিলেন তারা সবাই শান্তি-কমিটির লোক, হয়ত ব্যতিক্রম পাওয়া যাবে দুই-একটা। এরা সবাই কি রাজনৈতিক কারনে শান্তিবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন? গ্রামের, পরিবারের, সাধারন মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে কেউ কি শান্তিবাহিনীতে যাননি? পাক-হানাদার বাহিনীর হাত থেকে গ্রাম কে রক্ষা করার পরে, মুক্তিবাহিনী এসে "শান্তি-কমিটির লোক" বলে তাকে মেরে ফেলেছে, এই রকম ঘটনা কি নেই এক্টাও?
পাকিস্থান বাহিনীর নির্মমতার কথা আমরা জানি, সেই বাহিনীতে কি কোন একজন মানুষও ছিল না, যারা এই নির্মমতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিল? আমার কাছে এটা অসম্ভব বলে মনে হয়, একটা জাতির সবাই এইভাবে পিশাচ হতে পারে নাকি?
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন বাহিনী যেভাবে দেশকে স্বাধীন করলো, তারা সবাই তো দেশের জন্যই যুদ্ধ করলো, নাকি অন্য উদ্দেশ্য ছিল তাদের? রাজনৈতিক? তবে এত বিভেদ কেন তাদের মধ্যে? মুজিব বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, সেনাবাহিনী, কাদেরীয়া বাহিনী? এরা একজন আরেকজনের পিছনে লাগলো কেন?
মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষন এখনো আমরা করতে পারিনি। এর রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্তিক বিশ্লেষন করা দরকার। আর এটা করতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। মানে আমরাই। কারন বাকীরা সবাই দেখি স্বার্থের কাছে দায়বদ্ধ।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ খুবই সুন্দর বলেছ -
আমার কাছে এটা অসম্ভব বলে মনে হয়, একটা জাতির সবাই এইভাবে পিশাচ হতে পারে নাকি
পাকিস্তানিদের না দেখলে এই জিনিসটা আমিও বিশ্বাস করতামনা।
ধন্যবাদ ভাইয়া অনেক গুল তথ্য জানানোর জন্য।আমাদের যাদের তখন জন্ম হইনি তাদের তো এসব লেখা পুঁজি করেই মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে হবে।
দেয়া - ধন্যবাদ তোমার মন্তব্যের জন্যে। মুশকিল হল যে সত্য অনেক সময়ই কারো না কারোর জন্যে অপ্রিয় হবে। দেশের বাইরে বাস না করলে, আমাকেও হয়তো দশবার চিন্তা করতে হতো এভাবে লেখার আগে।
সাইফ ভাই,
জাফর ইকবাল স্যারের একটা কথা আমার মনে হয় এখানে প্রযোজ্য-যুদ্ধ মানুষের ভিতর থেকে দেশপ্রেম,আত্মত্যাগ ইত্যাদি মহৎ গুণ বের করে আনে,কিন্তু সেই সাথে যে ভয়াবহ দানবকেও ডেকে আনে সেটাও অস্বীকার করা যাবেনা।অবাঙ্গালি অফিসার বলেই তাদেরকে হত্যা করতে হবে এই কথা যদি একজন মুক্তিযোদ্ধাও বলে থাকেন তবুও আমি মনে করি এটি মানবতাবিরোধী অপরাধ।যুদ্ধকালীন সময়ের অজুহাত দিয়ে এটাকে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বৈধ বলে মেনে নিতে আমি রাজি নই।যদি আমরা দোষী-নির্দোষ নির্বিচারে এরকম হত্যাকে সমর্থন করি তাহলে আমার মনে হয় পাকি পশুদের বর্বরতাকে ঘৃণা করার নৈতিক অধিকার কিছুটা হলেও আমরা হারাই।জার্মান অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নাজী বর্বরতা চাক্ষুস করা বাধ্যতামূলক-যাতে তারা পূর্বপুরুষের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে।বর্বর পাকিস্তানিরা তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে কি না নেবে সেটা তাদের উপরই ছেড়ে দেই,যেসব ভুল আমরা করেছি সেগুলো স্বীকার করলে মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা ছোট হয়ে যাবনা।
ইতিহাসের সঠিক বিশ্লেষণ শুরু হয় অনেক পরে, এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও সত্যি।
আর যেকোনো ঘটনাই একটু দূর থেকে দেখলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা সহ দেখা সম্ভব।
নিজের জীবন থেকে জানি আশেপাশে যখন একসাথে অনেক কিছু ঘটতে থাকে অনেকদিন পরে সেটা মনে করতে গেলে কিছু বিস্মৃতি (বিভ্রান্তি বলছিনা) তৈরী হয়। ২০০২ এ বুয়েটে যখন সনি মারা যায় তারপর আমরা কয়েকবন্ধু পুরোটা সময় একসাথে ছিলাম। পরে যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে যাই তখন দেখি একজনের সাথে আরেকজনের বর্ণনা মেলেনা, অথচ পাশাপাশি আমরা সেই সময়টা কাটিয়েছি।
এটা ছাড়াও মানুষের আবেগ তাঁর স্মৃতিকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে, যেটা 'হলে ভালো হতো' অনেক সময় সেটাকেই আমরা 'হয়েছে' বলে ধরে নেই।
শহীদ ভাই, আপনার লেখাটা খুবই চমৎকার লাগলো, এটা একটা প্রয়োজনীয় লেখা। আপনি এটা নিয়ে সিরিজ করলে অনেক ভালো হয়। অপেক্ষায় থাকলাম...
অটঃ যতদূর মনে পড়ে ইস্পাহানী জুট মিল এখন খুলশী থেকে কর্ণেলহাট যাওয়ার রাস্তায়, এটাও কি আপনার সময় ছিলো?
রেশাদ তুমি ঠিকই বলেছ "এটা ছাড়াও মানুষের আবেগ তাঁর স্মৃতিকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে, যেটা ‘হলে ভালো হতো’ অনেক সময় সেটাকেই আমরা ‘হয়েছে’ বলে ধরে নেই।"
আমাদের স্বাধীনতার পিছনে সমস্ত জাতি এক হয়ে গিয়েছিল। ১০ই জানুয়ারীতে শেখ মুজিব যখন দেশে ফিরলেন তখন তার পিছনে যে জন সমার্থন ছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম নেতার ভাগ্যে জুটেছে। পরবর্তী ইতিহাস দুর্ভাগ্যজনক এবং ক্রমশ বিকৃত হয়ে চলেছে।
তাই আমি মনে করি আমাদের প্রজন্ম পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে যত দূর সম্ভব 'সত্যি' ইতিহাস সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা করা উচিত।
তুমি ঠিক ধরেছ আমি যেখানে কাজ করতাম তার আসল নাম 'Chittagong Jute Manufacturing Co. Ltd.' এবং এটি কালুরঘাট ব্রিজের কাছে। এটার মালিক ছিল 'ইসকি ইস্পাহানী' এবং ঐ পরিবারের আর একটি মিলের নাম ছিল সম্ভবত 'ইস্পাহানী জুট স্পিনার্স'।
একদম জীবন থেকে বলা কথাগুলো জানলে মনে হয়,আসলেই বাস্তব অতি কঠিন এবং ইতিহাস অনেক জটিল।
মুক্তিযুদ্ধ,অন্যান্য যুদ্ধ-বিগ্রহ কিংবা বিডিআর গণহত্যা এসব দেখে আমার সবসময় মনে হচ্ছে,অস্ত্র-ক্ষমতা এসব জিনিস আসলে মানুষকে মানুষ থাকতে দেয় না,অস্ত্র হাতে পেলে সাধারণ বিবেক-বুদ্ধিটুকুও লোপ পেয়ে যায় মনে হয়!
কি যে ভালো লাগল ভাই লেখাটা,মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার আরও অভিজ্ঞতা জানতে চাই,সবার অভিজ্ঞতাই জানতে ইচ্ছা করে,বিজয়গাঁথার চেয়ে রুঢ় বাস্তবতা জানাটাই মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ।
এটা ব্লগে আমার ১০০০-তম কমেন্ট। অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও ব্লগের মোস্ট সিনিওর ভাই(আমি তাই জানি ক্ষুদ্র জ্ঞানে) এর এই অভাবনীয় লেখাতে হাজারপূরণ করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
আর ভাই,আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,আমার বাবা-মাকে ভালোবাসার জন্য উপদেশ দিয়ে যে ইমেইলটি পাঠিয়েছিলেন তার জন্য। এতটাই অবাক হয়েছিলাম এবং আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম যে তাৎক্ষণিকভাবে বুঝিনি শুধু ধন্যবাদ জানিয়ে রিপ্লাই দিলেই আমার ভালো লাগাটা প্রকাশ করতে পারব কিনা।মেইলবক্স ক্লিন করতে গিয়ে আপনার মেইলটাও না বুঝে ''ডেলিট অল'' করে ফেলেছিলাম,সেই আফসোস অনেকদিন ছিল।আজকে লজ্জিত হয়েও না বলে থাকতে পারলাম না,আপনি আমার ইমেইল এড্রেস পেলেন কিভাবে বুঝিনি,কিন্তু আপনারটা খুঁজেও পেলাম না।পেলে অবশ্যই আপনাকে ইমেইল করতাম।
ভাই,আপনি অনেক মহান,আপনার মত হতে পারব না,ধারেকাছেও পৌঁছতে পারব না,শুধু দোয়া করবেন যেন স্বচ্ছ বিবেক-বুদ্ধি নিয়ে সুখীভাবে বেঁচে থাকতে পারি প্রিয় মানুষগুলোর সাথে।
ভালো থাকবেন,শরীরের প্রতি যত্ন নিয়েন ভাই,ভাবীকেও সালাম রইল 🙂
আছিব
তোমার ১০০০-তম কমেন্টের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমার ই-মেইল ঠিকানা হচ্ছে - saif_shahid@yahoo.com
ভাইয়া,
লেখাটা প্রকৃত অর্থেই ভিন্ন জানালা (এবং অবশ্যই ভিন্ন চোখ) দিয়ে দেখা। ভালো লাগল আপনার সাহসিকতা। :boss:
- আমি সাধারণতঃ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোন পোষ্টে কমেন্ট করিনা। কারণ, ওগুলোর বেশিরভাগই ভরা থাকে ঘৃণা আর হিংসায়, সে-ও আবার প্রায়শঃই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে ছাপিয়ে পুরো পাকিস্তানেরই বিরুদ্ধে! কিন্তু আমি সংগত কারণেই বিশ্বাস করি যে, পুরো একটা দেশ, একটা জাতি কখনো খুনী হতে পারেনা (পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে বাংলাদেশীদের মাঝে অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এটাই প্রমাণ করে)।
- 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' বিকাশের নামে নতুন প্রজন্মের মনে-মননে এই যে একতা দেশ+জাতির প্রতি হিংসার বীজ বপন হয়ে চলেছে, এর থেকে কখনোই ভালো ফল আসবে না। কারণ, হিংসা শুধুই হিংসাত্মক ভবিষ্যত নিয়ে আসে।
অপেক্ষায় আছি সেই সময়ের জন্য যখন জেনে-না-জেনে শেখ মুজিবকে 'হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংগালী' বানানোর প্রবণতা থামবে, যখন আওয়ামী লীগে নাম লিখিয়েই মুক্তিযোদ্ধা (বা এর পক্ষশক্তি) হওয়া যাবে না, আর আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে গেলেই রাজাকার (বা যুদ্ধবিরোধী) হওয়ার আশংকা কেটে যাবে। তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকাবো, পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ,
চোখ আর মন খোলা রাখো - তোমার প্রশ্নের ঊত্তর নিজে থেকেই পাবে। ধন্যবাদ তোমার মন্তব্যর জন্যে।
আমার জন্ম ১৯৭৬-এ। এখন যেন আমাদের ইতিহাস প্রতিনিয়ত পরবর্তন এবং পরিমার্জনের একটা বিষয়ে পরিনত হয়েছে। শহীদ ভাইয়ের চখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাকে অন্যদের মতই বেশ কষ্ট দিচ্ছে।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
অনেক কিছু জানতে পারলাম ভাইয়া। :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:
মুক্তিযুদ্ধ এত সুন্দর একটা লেখা দেবার জন্য আপনাকে :salute: :salute: :salute:
:thumbup: :thumbup: :thumbup:
অনেক সুন্দর লেখা ভাইয়া
অনেক জীবন্ত মনে হলো আমার...
অনেক কিছু দেখলাম সত্যিই ভিন্ন জানালা দিয়ে
অনেক যত্ন নিয়ে লেখা.ভাল্লাগছে :clap: :clap:
আপনার লেখা সব কাজ ফেলে পড়ি। কারণ সেই সময়টা চিন্তার। সেখানে নতুন নতুন ভাবনা যোগ হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দলবাজির সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হলো নতুন প্রজন্ম (আমরা এবং আমাদের পরের সকল) সঠিক ইতিহাসটা জানছে না। নিজেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে এই হীনকাজটা করছে রাজনীতিবিদ-তাদের সমর্থকেরা (এর মধ্যে বিভিন্ন ঘরানার পেশাদার লেখকও রয়েছেন)। এই প্রচারগুলো মিডিয়ায় এতো বেশি ভার্সনে চালু যে আমাদের অনেকের মাঝেই বিরক্তি ধরে গেছে। তবু এদের ভ্রান্তির মাঝ থেকে আপনাদের মতো বর্ণনাও পড়ি। সেখানে যুদ্ধটাই কুৎসিত, মহান না। এই যুদ্ধ বাঁধানো বাহিনীটা নরপশু, কিন্তু কেউ কেউ হয়তো "মানুষ" ছিলেন। সেই নরপশুদের পাশাপাশি "মানুষ"গুলোর কথাও শুনতে চাই।
মহত্ত্ব আসলে খুব অকার্যকর প্রপঞ্চ। কোন কাজে লাগে না, অলঙ্কারিক। সবাইকে তার কাজ দিয়েই বিচার করা উচিত।
চট্টগ্রামের ঘটনা নিয়ে আরো লিখুন, বিশেষ করে এপ্রিলের শুরু ঘটনা নিয়ে। আগ্রহ নিয়ে পড়বো। 🙂
শুধু একটাই প্রশ্ন থাকবে আপনার কাছে ... পরের পর্ব কবে পাবো ???
এক কথায় অসাধারণ লাগল লেখাটা। আমাদের প্রজন্মের কাছে এ ধরণের লেখার মূল্য অনেক বেশি, কারণ আমরা সে সময়টাকে দেখিনি, আপনাদের লেখা দিয়েই আমাদের দেখতে হয় সেই সময়টাকে।
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম ভাইয়া।
সাইফ ভাই, ধন্যবাদ লেখাটা দেওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। আপনার মূল লেখাটা আরো বিশদ ছিল। আরো ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা ছিল তাতে। বাস্তব আসলেও কঠিন। বিজয়ে যেমন বীরত্ব থাকে, তেমনি তাতে থাকে অনেক নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা। কঠিন এসব সত্য জয়ের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হলে, সব সব জানতে হবে। নিজেদের কোনো কাপুরুষতাও আড়াল করা যাবে না। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য আমার ভালোবাসা সব ভালো-মন্দ মিলিয়েই। এইটা মেনে নিতে পারলে, আমরা সত্যের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি সঞ্চার করতে পারবো। নির্মোহ দৃষ্টিতে সব দেখতে পারবো।
দেশপ্রেম শব্দটার ব্যবহার নিয়ে আমার মধ্যে ভীষণ দ্বন্দ্ব কাজ করে। এর অর্থ এটা নয় যে, দেশের জন্য আমার ভালোবাসা নেই। বরং সেই ভালোবাসা সুতীব্র। কিন্তু সাংবাদিক হিসাবে আমি যখন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্বের কথা লিখি, সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা লিখি, উলফাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার তথ্য প্রকাশ করি তখন বলা হয় আমি দেশপ্রেমিক নই। আমি অন্য দেশের স্বার্থ রক্ষা করছি। তাই আমি বলি, সাংবাদিকের কোনো দেশপ্রেম থাকা উচিত নয়। দেশপ্রেম তাকে অন্ধ করে ফেলতে পারে। করেও। এ নিয়ে আলাদা একটা লেখার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। আশা করি কোনোদিন লিখে ফেলবো।
অবশ্য এসব সত্য, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের ৯ মাসের জঘন্য অপকর্মকে আড়াল করে না বা তার সমর্থন জোগায় না। আবার অনেক পাকিস্তানি যে বাঙালিদের পক্ষে দাড়িয়েছিল সেই বাস্তবতার স্বীকৃতিও আমাদের দিতে হবে।
মনে পড়লো, কয়েকদিন আগে মেজর জেনারেল (অবঃ) খলিলুর রহমানের লেখা বইতে পড়লাম, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন মেধাবী ব্রিগেডিযার নিয়াজীর নৃশংসতার বিরোধীতা করায় তাকে পশ্চিমে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার চাকরি জীবনও শেষ হয়ে যায়। অথচ তাকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত সেনাপ্রধান ভাবা হতো।
গত ২৬ মার্চ প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে প্রকাশিত পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক হামিদ মির-এর লেখাটা যারা পড়েননি তাদের জন্য এখানে লিংক দিলাম।
আপনার একাত্তরের অভিজ্ঞতার পুরোটা লিখুন। ভাবীসহ আপনি এরপর কোথায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, কি করেছিলেন, সেসব তো আপনার ব্লগে আছে। আপনার লেখার প্রতি মুগ্ধতা জানিয়ে গেলান এবং পুরো অভিজ্ঞতা সিসিবিতে পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম। ভাবীকে শুভেচ্ছা জানাবেন। ছেলের জন্য আদর।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
তুমি লিখেছ "কিন্তু সাংবাদিক হিসাবে আমি যখন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্বের কথা লিখি, সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা লিখি, উলফাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার তথ্য প্রকাশ করি তখন বলা হয় আমি দেশপ্রেমিক নই। আমি অন্য দেশের স্বার্থ রক্ষা করছি। তাই আমি বলি, সাংবাদিকের কোনো দেশপ্রেম থাকা উচিত নয়।" তোমার এই কথাগুলিতে সংগত কারণে অভিমানের সুর আছে।
সত্যিকারের 'প্রেমিক' শুধু স্তুতি করে না, তার ভালবাসার ভুল-ত্রুটি শুধরাতেও সাহায্য করে। ইরাক যুদ্ধের শুরুতে ফ্রান্স আমেরিকার একটু সমালোচনা করেছিল, ফলে অনেক 'অতি দেশ-প্রেমী আমেরিকান' ফরাসী পানীয় বর্জন করেছিল ফ্রেন্স-ফ্রাইকে 'ফ্রিডম-ফ্রাই' বলা শুরু করেছিল। আজ প্রায় ৮ বছর পর আমেরিকার এই অর্থনৈতিক দুর্দিনে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যাবে সত্যিকারের আমেরিকা প্রেম কে দেখিয়েছিল।
তুমি খেয়াল করে দেখ আমাদের অতীত ও বর্তমান সব নেতা-নেত্রী এই সব 'অতি দেশ-প্রেমীদের' কারনে ডুবেছে বা ডুবতে বসেছে।
সত্য কথা বলা ও সত্যনিষ্ট সংবাদের কোনো পরিপুরক নেই। আজ হোক বা কাল হোক - সত্যের জয় হবেই।
সাইফ ভাই, না, সত্যি বলছি কোনো অভিমান থেকে এটা লিখিনি। আমি ব্যক্তি মানুষ হিসাবে দেশকে ভীষণ ভালোবাসি। লাল-সবুজের পতাকা আমার রক্তে নাচন ধরায়। ক্রিকেট খেলায় দেশের দল হারবে জেনেও কোন একটা অলৌকিক (যদিও এতে কোনোই বিশ্বাস নেই) আশায় আর সবার মতো বুক বেঁধে থাকি।
কিন্তু সাংবাদিক হিসাবে আমাকে হতে হয় নিস্পৃহ, নির্মোহ, কোনো ধরণের পক্ষপাতের উর্ধ্বে। একজন জামাতির দেশপ্রেম, বিএনপির দেশপ্রেম আর আওয়ামী লীগের দেশপ্রেম এক নয়। আবার সরকারের দেশপ্রেম, বিরোধী দলের দেশপ্রেমও ভিন্ন। ভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে দেশের ন্যায্য স্বার্থের বিষয় এলে অবশ্যই আমাকে দেশের পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। কিন্তু আমার শরীরে যদি ঘা থাকে, যেটা সংক্রমণের বিপদ আছে; সেখানে সেই ঘা'টা উম্মোচন করাই সাংবাদিকের কাজ।
বেশ কিছুদিন আগে ভারতের এক সাংবাদিকের একটা লেখা পড়েছিলাম, সেদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের সাংবাদিকদের যেসব ব্রিফ করে বিশেষ করে পররাষ্ট্র বিষয়ে তা সরকারের মতো করে প্রকাশ না করলে ওই সাংবাদিককে মন্ত্রণালয়ে "পারসন নন গ্রাটা" করে। বিটের সাংবাদিক তার খবরের জায়গায় প্রবেশাধিকার না পেলে কাজ করবে কিভাবে? এ কারণেই সম্ভবত দেখা যায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বা অন্য কোনো দেশের কোনো বিরোধের ইস্যুতে তাদের সব মিডিয়া এক সুরে "কা.... কা" করতে থাকে।
এখন এ কারণে অনেকে বলতে পারে ভারতের সাংবাদিকরা যদি অন্ধের মতো তাদের সরকারের অন্যায় নীতিকেও সমর্থন দেয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকদেরও কি সেটা করা উচিত না? আমি বলবো না। আমি যা মিথ্যা, যা অন্যায়- তা আমার সরকার বা কোনো দল বা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গেলেও তার পক্ষে দাঁড়াবো না। মিথ্যা লিখবো না। একে দেশপ্রেম বললে দেশপ্রেম, দেশদ্রোহিতা বললে সেই অভিযোগ নিয়ে, ঝুঁকি নিয়ে হলেও সত্যই প্রকাশ করবো।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
সরি ভাইয়া, নিতান্তই অবুঝ ম্যাংগো পিপল হিসেবে আমার ধারনা ভিন্ন। তীব্র প্রতিযোগীতার এই যুগে দেশের জন্য স্বার্থপর না হয়ে শুধু সৎ মানসিকতা দিয়ে মনে হয় কাজ হবে না।
@ রেশাদ ভাইঃ জ্বী ভাই, আমি নজরুল হাউসে ছিলাম। বুয়েটেও আপনার সাথে দেখা হয়েছিল অনেকবার, যদিও অতটা ফ্রিকুয়েন্ট না। কেননা, এমনিতেই সিভিল বিল্ডিং এর পোলাপানদের সাথে ই.এম.ই বিল্ডিং এর পোলাপানদের কম interaction হতো। আমি এখন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও-তে পি.এইচ.ডি করছি। আপনাদের ব্যাচের হাবিব ভাইয়ের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল গত কয়েক মাসে।
যাইহোক; আসলে রেশাদ ভাই, আমি নিজ়েও আমার কনফিউশন গুলো দুর করতে চাই; সময় করে একদিন সব কিছুই লিখব, যাতে আপনাদের কারোনা কারো কাছে উত্তর গুলো পেতে পারি। এখন কিছুটা ব্যস্ত। তারমধ্যে বাংলা লেখায় এখনো অতটা অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। 'ক' লিখতে 'কী-বোর্ড' ভাঙ্গার যোগার।
পড়ছি
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম ভাইয়া।
সব সত্যই জানতে চাই। সত্য, সেটা যত কঠিনই হোক না কেন।
না জানলে সিদ্ধান্ত নেব কেমন করে।
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
আবশ্যই সত্য জানতে চাইবে, প্রতিশোধ কামনায় নয় - যেন এ ভুল আমরা আর না করি।
যুদ্ধাপরাধ আমাদের পক্ষ থেকেও হয়েছে, এটা আমি অনেকের মুখ থেকে শুনেছি। সেই অনেকের মধ্যে রাজাকার ঘরানার কেউ ছিল না। ঘটনার নিস্পৃহ বর্ণনা। এই যুদ্ধাপরাধগুলোর বিরুদ্ধে কি করা যায় সেটা জানি না। তবে বিজয়ী পক্ষ হিসাবে আমরা আমাদের পাওনা বুঝে নেই, তারপর ন্যায়-অন্যায় নিয়ে ভাবা যাবে- এই হলো আমার ব্যক্তিগত দর্শন।
শহীদ ভাইকে ধন্যবাদ তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করার জন্য।
৩৯ বছরেও কি আমাদের পাওনা বুঝে পেয়েছি?
ভাইয়া, এধরনের একটা জিনিস লেখার ইচ্ছা মনে অনেকদিন ধরেই ছিল। কিন্তু ছোট তাই অনেকে হয়তো বলবে যুদ্ধ দেখনি তাই হয়তো মনে এত আবেগ, তাই লেখাটা কখনো লেখা হয় নাই। কাহিনীটা সংক্ষেপে বলি।
গত ঈদে বাসার সবার সাথে বাড়ি গেলাম। ঠাকুরগাঁও শহরটা খুব ছোট। একাত্তর এ এখানে ঠিক কেমন যুদ্ধ হয়েছিল আমার জানানাই। একদিন আব্বুর সাথে আমরা গ্রামে রিকশা নিয়ে ঘুরছিলাম। তখন আব্বু বিভিন্ন এলাকা এবং তার ছোট বেলার কথা আমাদের বলছিল। তখন কিছু বাড়ির দিকে আব্বু আঙ্গুল তুলে বললো এখানে তার এক খুব ক্লোজ বন্ধু থাকতো। আমি বললাম তারা এখন কোথায়?? তখন আব্বু বললো স্বাধিনতার পরপর এই গ্রামের সবাই কে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি প্রথমে খুব সাধারন ভাবেই মন খারাপ করলাম।তারপর একটা কথা আমার খুব কানে বাজলো...স্বাধীনতার পর
আব্বু একটু চুপ করে থেকে বর্ননা দিল কিভাবে স্বাধিনতার পর ঠাকুরগাঁও শহরের নারগুন গ্রামে কয়েকশ মানুষকে ট্রাকে ভরে বদ্ধভূমিতে নিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। কারন তাদের পরিচয় ছিল তারা বিহারী। হঠাৎ করে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমরা বাঙ্গালীরা যেই গনহত্যার শিকার।তা আমরা কিভাবে আবার আরেক জাতির সাথে করতে পারলাম?? আব্বু বলল যুদ্ধ ছিলতো তখন মানুষের মাথা ঠিক ছিল না। হয়তো ঠিক, হয়তো যুদ্ধ মানুষ কে বদলে দেয় অনেক। হয়তো ত্রিশ লাখ শহীদ এর কাছে এটা কিছুই না। আমি যুদ্ধ দেখিনাই। তাই হয়তো আমার কাছে এটা অপরাধ।
আমি পাকিস্তানী আমলে দু'বার তোমাদের ঠাকুরগাঁও গিয়েছি। ছোট কিন্তু খুব সুন্দর শহর। ডঃ ইঊসুফ (মারা গেছেন দু'বছর হল) আমার দুলাভাই ছিলেন। তোমার আব্বা হয়তো চিনবেন। আমি জানতাম না এই গণহত্যার কথা।
তোমাদের সবাইকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাদের বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভী মন্তব্যের জন্যে। সবাই ভাল থাকো এই কামনা করি।
শুভেচ্ছান্তে
তোমাদের সাইফ ভাই
অনেক স্মৃতি বিজড়িত আর আবেগঘন একটি লেখা শহিদ ভাই। ভাল লাগলো পড়ে।
ধন্যবাদ আবিদ।
আপনার সত্য প্রকাশ অন্যরকম সুন্দর মনে হল | আরো জানতে ইচ্ছা করে, জাতিগত বিদ্দেষ আর যুদ্ধে কত সাধারণ মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায় নতুবা জীবন সব ছন্দই হারিয়ে ফেলে |