লাল সবুজের দেশে

মফস্বলের একটি প্রাইমারি স্কুল। সামনের বিশাল সবুজ মাঠটায় শিশুদের একত্রিত করা হয়েছে একটা দায়িত্ব দেয়ার জন্য। দায়িত্বটা খুব সাধারণ। জাতীয় পতাকাটা ধুয়ে ইস্ত্রি করে আনতে হবে। কারণ পরশু বিজয় দিবস। উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সামনে সেটার উত্তোলন হবে। সে উপলক্ষ্যে স্কুল ধোয়া-মোছার জন্য আগামীকাল ছুটি। বাচ্চাদের জোরালো করতালী তাই হেডমাস্টারের পুরো বক্তব্যকে আরো অর্থবহ করে তোলে।

এদের মধ্যে পদ্ম ও শাপলা যমজ ভাইবোন। দু’জন একই ক্লাসে পড়ে। যেহেতু তারা দু’জন একই বাড়িতে থাকে কাজেই তাদের উপরই কাজের দায়িত্বটা চাপিয়ে দেয়া হয়।

আনন্দিত চিত্তে পতাকা নিয়ে বিকেলে বাড়ি ফেরে তারা। বইখাতা রেখে কলতলায় ডিটার্জেন্ট সাবানে পতাকাটা ভিজিয়ে রেখে এক দৌড়ে খেলতে চলে যায়। উদ্দেশ্য খেলাশেষে গোসলের সময় যত্ন নিয়ে এটা ধুযে ফেলবে ওরা। কিন্তু বিধি বাম। ঠিক যেই মুহূর্তে ওরা খেলছিল, এবং পদ্ম প্রায় গোল দিতে গিয়েও এক হাতের জন্য মিস করল, ঠিক তখন ওদের টেইলার চাচি হাড়িপাতিল ধুতে এসে সাধারণ কাপড় ভেবে পতাকা দিয়েই সেসব পরিস্কার করে। সন্ধ্যায় ওরা এসে আর খুঁজে পায় না ওটা। খুঁজে খুঁজে পুরো বাড়ি মাথায় তোলে। চাচি জানতে পেরে লজ্জায় আর কথাই বলে না। অবশেষে পাওয়া যায়, ছাঁইগাদার মধ্যে। সে রাতেই ওরা পতাকাটি ধুয়ে দেয়। কারণ রাতভর শুকালে পরদিন ইস্ত্রি করা যাবে। ধোয়া শেষে তারা তাদের বাবার টেম্পুর পেছনে খোলা জায়গায় শুকাতে দেয়।কারণ টেম্পুটা রাস্তার লাগোয়া জায়গায় রাখা এবং সেখানে প্রচুর বাতাস খেলে।

পরদিন সকালে একটু দেরীতেই ঘুম ভাঙ্গে তাদের। রাতে পতাকা থেকে কালীঝুলি তুলতে পরিশ্রম তো আর কম হয়নি! দাঁত মাজার আগেই দৌড়ে যায় পতাকার খোঁজে। রাতারাতি শুকিয়ে গেলে বেঁচে যায় ওরা। কিন্তু কোথায় টেম্পু! বাবা ততক্ষণে বেরিয়ে গেছেন। কি আর করা। ওরাও ছুট..মুখ টুখ না ধুয়েই। দৌড়…দৌড়। টেম্পু স্ট্যান্ড।কিন্তু আজকেই বাবা তার বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত রিজার্ভ ভাড়ার পার্টি পেয়েছেন। কাজেই কখন ফেরেন ঠিক বলা যায় না। আশা নিরাশায় দোদুল্যমান মন তাদের ফিরতে চায় না, তবু ঘরে ফিরে তারা। দুপুরে বড় একটা ইলিশ মাছ নিয়ে হাসি মুখে ফিরে আসেন বাবা। ছেলে মেয়ে দুটিকে এত বড় ইলিশ দেখিয়ে চমক দিতে চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু বিষণ্ন শিশু দুটির সেদিকে খুব বেশি মনোযোগ নেই। বাবার মুখ দেখামাত্র তারা দৌড়ে যায় টেম্পুর কাছে।এবং গিয়েই আরো মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ টেম্পুর পেছনে পতাকাটা নেই। একরাশ হতাশা নিয়ে যখন তারা ফিরে আসতে চায় তখনই শাপলার চোখ যায় সিটের তলায়। দলামোচা হয়ে লালসবুজ রঙের একটা কাপড় পড়ে আছে সেখানে। বড় অযত্নে। রিজার্ভ পার্টি নিশ্চয়ই সিট-টিট মুছেছে এটা দিয়েই। সিটের তলা থেকে তারা উদ্ধার করে নিয়ে আসে পতাকাটা। আবার ধুয়ে শুকাতে দেয়।এবার বেশ সাবধানে কাজ করে তারা। একতলা বাড়ির উঁচু ছাদটায় আরো অনেক কাপড় রোদে দেয়া। টুলের উপর মোড়া তুলে সেখানেই শুকাতে দেয় ওরা।আজ বিকেলেও পদ্ম গোল না পেলেও সেরা খেলাটা সেই খেলে।
কিন্তু ঝামেলা এখানেই শেষ হয় না।
এবার শুকাতে দেয়া অন্যান্য কাপড়ের সাথে এক চোর সেটা চুরি করে নিয়ে যায়।বাড়িতে হুলস্থুল লেগে যায়।একসাথে এত কাপড় চুরি গেলে সেটাই তো স্বাভাবিক। ওদের জামা কাপড়ও চুরি গ্যাছে।তারমধ্যে পদ্মর লাল জামাটাও ছিলো। মা তাই খুবই বিষন্ন।সবকিছু জানা স্বত্ত্বেও যখন পদ্ম তার মাকে বলে, মা পতাকাটা? মা তখন সত্যিই অবাক হন।

ওরা আবার বের হয় পতাকার সন্ধানে। খুঁজতে থাকে চোর কোন পথে পালাতে পারে। কিছু পরে খুঁজেও পায় পায়ের ছাপ। বাড়ির পেছনের খাল পার হয়ে এগিয়ে গ্যাছে চোর। আগু পিছু চিন্তা না করেই খালে ঝাপ দেয় তারা। কিন্তু পদ্ম সাঁতার জানলেও শাপলা জানে না। পদ্ম খাল পার হয়ে দেখে শাপলা ডুবে যাচ্ছে খালের মাঝখানে। আবার ঝাপ দেয় সে। কোনমতে টেনে তোলে তাকে বাড়ির পেছনটায়। তারপর আবার খাল পার হয়ে খুঁজতে থাকে চোরের কাদামাখা পদচিহ্ণ। অন্য পাড়ে তার অপেক্ষায় পহর গুণে শাপলা, গোধুলীস্নাত দারুণ অন্ধকারে। ভেজা শরীরে ঘরে ফিরলে গোমর ফাস হওয়ার ভয় আছে তার। ভাগ্যিস পদ্মকে বেশিদূর যেতে হয় নি। ফালতু কাপড় হিসেবে চোর এটিকে ফেলে যায়। গোপনে, অন্ধকারে আবার তারা পতাকাটা ধুয়ে, শুকাতে দেয়..তাদের মশারীর উপর। শীতের রাত তবু ফ্যান ছেড়ে ঘুমুতে বাধ্য হয় তারা।

পরদিন।
বিজয় দিবসে, সকালে তারা লাল সবুজের স্কুল ড্রেস পরে পতাকা নিয়ে বের হয়। কিন্তু একটু পরই শাপলা খেয়াল করে পতাকাটির লাল আর সবুজ দুই অংশ ছিড়ে গ্যাছে। রাতের অন্ধকারে সেটি টের পাওয়া যায়নি। এখন উপায়?একটু পরেই তো পতাকা উত্তোলন ?

তবুও পতাকা উত্তোলনের ঠিক আগ মুহূর্তে তারা পতাকা নিয়ে পৌঁছায়। পতাকা তোলা হয়।
অবাক কান্ড!
সেখানে কিন্তু ছিড়ে যাওয়ার কোন চি‎‎হ্নই নেই। কেবল মেয়েটির সবুজ স্কার্টটা একটু খাটো। আর ছেলেটির লাল জামার বুক পকেটটি নেই।

[গল্পটি পূর্বে অন্য ব্লগে প্রকাশিত, তবে এখন ঈষৎ বর্ধিত এবং ইেন্দানেশিয়ার ছবি `দ্যা ফ্ল্যাগ’ অবলম্বনে লেখা(আমার দেখা অন্যতম সেরা একটি ছবি) শুভ বিজয়]

৬,২৮৪ বার দেখা হয়েছে

৬২ টি মন্তব্য : “লাল সবুজের দেশে”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    ঘষামাজা ভালোই করছিস। আগেতো দুর্দান্ত লেগেছিলোই, এখন সেটি মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো আরো অনেক অনেক বেশি।

    গল্পকার টিটো রক্স :clap:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    টিটো ভাই ড়কস। বউ কথা কও পড়ে সেই যে মুগ্ধতা জন্মেছে, এখনো বের হতে পারিনি। অসাধারণ একটা গল্প।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. ভাই, পুরা কোপানি হইছে। :duel: :duel: :duel:
    আফসোস, এই রকম আইডিয়া ক্যান আমার মাথায় আসল না :(( :(( :((
    মাথা বাড়ি দিয়া দেখি কিছু বাইর হয় কি না :bash: :bash: :bash:

    ভাই, আপনের লগে দেখা হইলে একবার কপালে কপাল ঘষতে চাই। :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:

    জবাব দিন
  4. নাজমুল (০২-০৮)

    ভাই, পুরা কোপানি হইছে।
    আফসোস, এই রকম আইডিয়া ক্যান আমার মাথায় আসল না
    মাথা বাড়ি দিয়া দেখি কিছু বাইর হয় কি না

    ভাই, আপনের লগে দেখা হইলে একবার কপালে কপাল ঘষতে চাই।
    :boss:

    জবাব দিন
  5. জুলহাস (৮৮-৯৪)

    টিটো......
    সামনাসামনি দেখা হইলে তোরে এইবার সালাম করুম ভাবতাছি...
    তুই বরং আমার থেকে দূরে থাকিস্‌...
    তোর এইসব হিংসাত্বক লেখা দেখলে...আপনাআপনি খুশীর কান্না চলে আসে...
    বাংলা মায়ের সকল (সু)সন্তানদের...(অবশ্যই রাজাকারদের ছাড়া... )... :salute: :salute: :salute: :salute: :salute:


    Proud to be an ex-cadet..... once a cadet, always a cadet

    জবাব দিন
  6. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    ভাই, পুরা কোপানি হইছে।
    আফসোস, এই রকম আইডিয়া ক্যান আমার মাথায় আসল না
    মাথা বাড়ি দিয়া দেখি কিছু বাইর হয় কি না

    ভাই, আপনের লগে দেখা হইলে একবার কপালে কপাল ঘষতে চাই।

    জবাব দিন
  7. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    T2 ভাইরাস সবার মধ্যে তো ভাললাগার ফ্লু ছড়িয়ে দিলে। কতদিন ভূগতে হয় কে জানে?
    বিলিয়ার্ড বোর্ডের মধ্যে লাল বলের পতাকার ছবিটাও অসাধারন।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।