আর্টসফিকশন

বিকেলের প্রেপ।

কোয়াইট আওয়ারের ঘুমটা আসতে আসতে বড় দেরী করেছিল বলেই হয়ত মেজাজটা চড়েই ছিল। হাউজ বেয়ারা আউয়াল ভাইয়ের উপর দিয়ে তাই ছোট্ট একটা ঝড়ও বইয়ে দিয়ে এসেছি। আজ বই নিয়ে বসার প্রশ্নই ওঠে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে একাডেমিক ব্লকের বারান্দায় দাঁড়িয়েই মনটা ভাল হয়ে গেল। বাসন্তি শাড়ী পরে একাডেমিক ব্লকের সামনের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে একটা গাঁদা ফুল ছিড়ে খোঁপায় গুজলেন তিনি। শুরু হল আমার বুক ধড়ফড় আর শূণ্যতা’র অনুভূতি। অপার্থিব কিছু সৌন্দর্য আছে যা একা দেখে তৃপ্ত হওয়া যায় না, জামাতের সাথে দেখতে হয়। তাই আমি আযান দিলাম, আহ্বান করলাম সবাইকে সৌন্দর্য্যের পূজায় সামিল হবার জন্য। ব্লকের বারান্দায় তখন ত্রিশ অধিক মাথা আরাধনায় ব্যস্ত। তিনি চোখ তুললেন। ভাললাগার বিমুগ্ধতায় তখন আমার সংবেদনশীলতা শূণ্যের কোঠায়। সবাই বসে পরলেও আমার এক মাথা, দুই চোখ আড়াল খোঁজেনি। তিনি আমায় নীচে ডাকলেন। এক দৌড়ে নীচে …… ‘কি হচ্ছিল’ প্রশ্নের উত্তরে কিই বা বলার আছে আমার? শুধু বললাম ‘পরে কোন এক দিন বলব, আজ হ্মমা করে দিন’ …… এতোটাই লাজুক শোনাচ্ছিল নিজেকে … তিনিও হয়ত কিছু একটা বুঝতে পারলেন। তাই আর ঘাটালেননা।

তিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। খাতা কাটার মৌসুমে তিনি ক্লাসে সেলফ ষ্টাডি দিয়ে আমাকে লাইব্রেরীতে নিয়ে যেতেন। তিনি খাতা কাটতেন, আমি যোগ করে দিতাম। সেই যোগে ভুলভাল হোত বিস্তর। মনের সাথে গণিতের চীরস্থায়ী শত্রুতা।

‘মলয় চাকী’ নামক গাণিতিকের লিখা ত্রিকোণমিতি নোট বই হুবুহু কপি করেছি মাত্র দু’রাতে। আর কোন বিষয়ের নোট খাতা ছিল না আমার, শূধুই ত্রিকোণমিতি। সন্ধ্যার প্রেপে তিনি দায়িত্বরত থাকলেই সেই নোট খাতা নিয়ে যেতাম তাঁর কাছে, ভুলভাল গুলো ঠিকঠাক করে নিতে। কোনো এক জ্যোৎস্না রাতে ‘চাঁদটা দেখেছ, এমন চাঁদ দেখলে ভাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে না তোমার’ শুনে সত্যিই ভাল হয়ে যেতে চেয়েছিলাম।

আমাদের পাস আউটের আগ দিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ক্যাডেট কলেজে আর না। তাঁর বিদায়ী নৈশভোজে আমি পেটপুরে খেয়েছিলাম, অন্তর খাঁ খাঁ করলে নাকি মানুষ ক্ষূধার্ত হয়ে ওঠে। নৈশভোজ শেষে তিনি হাউসের সামনে এসে আমাকে ডাকলেন, জিজ্ঞাসা করলেন সেইদিনের কথা। বিকেলের প্রেপ, পরে কোন একদিন বলব বলে আমার চলে আসা। আমি কল্পনাও করিনি তিনি সে প্রশ্নের উত্তর আবার কোন একদিন সত্যিই জানতে চাইবেন। ‘বাসন্তী শাড়ীতে সেদিন বিকেলে আপনাকে যে কি অসহ্য সুন্দর দেখাচ্ছিল’ … বলার পর অনেকক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন তিনি।

১৫,৭১৩ বার দেখা হয়েছে

১১১ টি মন্তব্য : “আর্টসফিকশন”

  1. এটা এখন পর্যন্ত তাইফুর ভাইয়ের সেরা লেখা। :boss: :boss:
    একই সঙ্গে মন ভালো এবং খারাপ করে দেয়া লেখা।
    এক কথায় অসাধারন। :gulli:

    তাইফুর ভাই, ঠিক এইরকম আরো চাই। :gulli2:

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    লেখাটা পড়েই বুকের মধ্যে মোচড় মেড়ে উঠল...আহা!!!
    আচ্ছা নেক্সট জ্যোৎস্না কবে?
    ঠিক করছি অই রাতের চাঁদ দেখে পুরোপুরি ভাল হয়ে যাব... O:-)

    তাইফুর ভাই :salute:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. হাসনাইন (৯৯-০৫)
    ‘বাসন্তী শাড়ীতে সেদিন বিকেলে আপনাকে যে কি সুন্দর দেখাচ্ছিল’ … বলার পর অনেকক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন তিনি।

    - তাইফুর ভাই সিরুম...সিরুম হয়েছে। :dreamy:
    আমাদেরও এরুম ছিল... স্টিল... স্টিল অনেকে ফোন করে। 😛
    তয় ভাই উনি কিন্তু ভুলবো না আপনারে। 😀

    জবাব দিন
  4. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    আমি আগেই কইছিলাম, তাইফুর মামার স্টক এবং লেখা দুইটাই সেইরকম।
    মামা, এই সেমি প্লাটোনিক ইমোশনাল লেখাটাও পুরা সেইরকম লাগছে :boss: :boss:
    যাহোক, কতা অচ্চে গিয়া কতা তা না, মেইন কতা অইলো তুই বস্ :salute: :salute:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
    • তাইফুর (৯২-৯৮)

      ফুয়াদ মিয়া, চুন্নু'রা ব্লগে খুব একটা আসে না, কলেজের স্মৃতি হাতরায়া মরে তোমার আমার মত লু**'রাই। যাও মরটিন নিয়া আস। বারবার যাওয়ার দরকার নাই, পুরা প্যাকেট নিয়া আস।


      পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
      মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

      জবাব দিন
  5. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    অপার্থিব কিছু সৌন্দর্য আছে যা একা দেখে তৃপ্ত হওয়া যায় না।

    ভাললাগার বিমুগ্ধতায় তখন আমার সংবেদনশীলতা শূণ্যের কোঠায়।

    মনের সাথে গণিতের চীরস্থায়ী শত্রুতা।

    'চাঁদটা দেখেছ, এমন চাঁদ দেখলে ভাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে না তোমার’...

    অন্তর খাঁ খাঁ করলে নাকি মানুষ ক্ষূধার্ত হয়ে উঠে।

    'বাসন্তী শাড়ীতে সেদিন বিকেলে আপনাকে যে কি সুন্দর দেখাচ্ছিল’ …

    তাইফুর মাম্মা,
    পুরো গল্পটা কমেন্ট বক্সে নিয়ে এসে তারপর বিশেষ বিশেষ অংশ বাছাই করতে হল।
    অসাধারণ বললেও কম বলা হয়।
    এরকম অনেক দিন পড়িনি।
    খুব ভাল্লাগছে।
    :boss: :boss: :boss: :boss:

    সোজা প্রিয় পোস্টে ....।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  6. ইফতেখার (৯৫-০১)

    ভাই, উনি তো সবার ই মন কেরে নিসিলেন। উকি ঝুকি মারার জন্য রিসালাত রে কি চরান টাই না চরাইসেন।

    লালের নিচে কাল অন্ত্ররবাশ ... কিই না বা উনি দেখাইসেন ।

    চলে যাওয়ার অনেক দিন পর উনার ছবি ছাপ্সিলো ইত্তেফাক এ ... দেখসিলেন নাকি ?

    জবাব দিন
  7. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    অনেকের প্রিয় পোষ্টে এই লেখাটা দেখে পড়তে আসলাম। বুঝলামই না আমি এই লেখা পড়িনাই কেন। তাইফুর ভাই অসাধারণ। কিন্তু আপনি ভাই বহুত ফাঁকিবাজ অনেক কম লেখেন। খালি কমেন্ট করলে কি হবে? কমেন্ট শিল্পী জুনাভাই ই তো এখন লেখা শুরু করেছে আর আপনি... লেখা চাই ভাইয়া।

    জবাব দিন
  8. নাজমুল (০২-০৮)

    অনেকের প্রিয় পোষ্টে এই লেখাটা দেখে পড়তে আসলাম। বুঝলামই না আমি এই লেখা পড়িনাই কেন। তাইফুর ভাই অসাধারণ। কিন্তু আপনি ভাই বহুত ফাঁকিবাজ অনেক কম লেখেন। খালি কমেন্ট করলে কি হবে? কমেন্ট শিল্পী জুনাভাই ই তো এখন লেখা শুরু করেছে আর আপনি… লেখা চাই ভাইয়া। 😀

    জবাব দিন
  9. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    দেরীতে পড়লাম রে।
    মাইন্ড করিস না।
    এতে করে এর উজ্জ্বলতা কমেনি এক ছটাকও।

    খুব সুন্দর হয়েছে।
    আশা করি জ্বর সেরেছে - জন্ম দিনের শুভেচ্ছা নিস।
    ঈদের আগে তোকে টিভিতে দেখলাম - এখনো এত রোগা কেন রে। নে - নড়ে চড়ে ওঠ - এবার তোর ওভার ওয়েট হওয়ার সময়।
    সুখে থাক - তার চেয়েও বেশী শান্তিতে থাক ভাইডি।
    :hug:


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন
  10. বারবার এসে পড়ে যাই এই লেখাটা...

    কোনো এক জ্যোৎস্না রাতে ‘চাঁদটা দেখেছ, এমন চাঁদ দেখলে ভাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে না তোমার’ শুনে সত্যিই ভাল হয়ে যেতে চেয়েছিলাম।

    এই কথাটা কয়দিন আগেই কে যেন আমারে কইছিল :((

    জবাব দিন
  11. তৌফিক (৯৬-০২)

    লেখাটা বহুতবার পড়েছি, কিন্তু কমেন্টানো হয় নাই। যে লেখায় ৩২ টা পাঁচ তারা পড়ে, সেইটাতে কমেন্টানোও ভাগ্যের ব্যাপার। আমার বউ মাত্র পড়ে জিগায়, ম্যাডামডা ক্যাডায়? আমি কইছি তাইফুর ভাইরে জিগাও। তারপরে কয়, ম্যাডামের ছবি দেখতাম মঞ্চায়। আমি কইছি, তাইফুর ভাইয়ের পারমিশন ছাড়া হইব না। 😀

    জবাব দিন
  12. কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

    পুরান কত কথা আবার মনে পরে গেল.......... 🙁 🙁


    যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
    জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
    - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

    জবাব দিন
  13. গত বছর, প্রথম আলোর রস+আলো তে মেইল দেই। ক্যাডেটদের সেই গল্পগুলো রস+আলোর কোন সংষ্করণে ছাপা হয়েছিল তা জানার জন্য। সিমু নাসের ভাই মেইলের রিপলেদিলেন। সাথে সিসিসি এর ই-বুক "পরানের গহীন ভেতর" এর ডাউনলোড লিংক। আপনার লেখাটা এতই অসাধারণ, যে আমি ভুলতে পারছি না। আজকে হঠাৎ ইচ্ছা হল আপনাকে খুজে বেড় করি। বেশি কষ্ট করতে হল না, পেয়ে গেলাম। অসম্ভব সুন্দর একটি ব্লগ... এত সুন্দর কিভাবে লিখলেন?? আমারও এরকম লিখতে ইচ্ছে হয়। দোআ করবেন।

    ‘মলয় চাকী’ নামক গাণিতিকের লিখা ত্রিকোণমিতি নোট বই হুবুহু কপি করেছি মাত্র দু’রাতে। আর কোন বিষয়ের নোট খাতা ছিল না আমার, শূধুই ত্রিকোণমিতি।

    কোনো এক জ্যোৎস্না রাতে ‘চাঁদটা দেখেছ, এমন চাঁদ দেখলে ভাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে না তোমার’ শুনে সত্যিই ভাল হয়ে যেতে চেয়েছিলাম।

    বিকেলের প্রেপ, পরে কোন একদিন বলব বলে আমার চলে আসা।

    আমার পছন্দের ৩টি উদ্ধৃতি আপনার লেখা থেকে...

    মুনাদিল শাফাত
    বিবিএ, প্রথম বর্ষ
    বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।