যখনই আমি কোন কাজ করি আমার মেয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে আমার সব কাজ দেখে। রান্নার বেলায়ও এর ব্যাতিক্রম না- যদিও আমার মায়ের এতে প্রচন্ড আপত্তি, মেয়ে কে নাকি আমি ঘরকন্নায় পারদর্শী করার ট্রেইনিং দিচ্ছি- এই মেয়ের আর পড়াশুনা হয়েছে আর কি! আমি আমার মাকে বোঝাতে ব্যর্থ হই যে আশপাশের সবকিছুর মধ্যেই শিক্ষনীয় কিছু না কিছু আছেই। রান্নাঘর থেকে একটা শিশু শাক-সবজি, ফলমূল, স্বাদ, রসায়ন, পুষ্টিজ্ঞ্যান, রঙ, পরিমাপ, সংখ্যা ইত্যাদির প্রাথমিক জ্ঞ্যান পেতে পারে। আমার মা একবার গুরু গুরু বিজলীর চমকের সাথে বৃষ্টি দেখিয়ে আমার মেয়েকে বলেছিল, “দেখছ, তুমি এতো দুষ্টুমী করছ দেখে আকাশ রেগে গেছে…” আমার তিন বছর বয়সী মেয়ে তখন তার নানীর মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল এই বলে, “কেন, নানু, তুমি জান না, কিভাবে মেঘের সাথে মেঘের ধাক্কা লেগে মারামারি করে বিজলী চমকায়? আর কিভাবে সূর্য্যের আগুনে গরম হয়ে পুকুরের পানিগুলো ধোয়া হয়ে আকাশে উড়ে জমে জমে মোটা হয়ে হয়ে ধাপ্পাস করে পরে গিয়ে বৃষ্টি হয়ে যায়!” আমার মা সেইবার আমার উপর খুব ক্ষেপে গিয়েছিল, “নে তোর জ্ঞ্যানী মেয়েকে তুই-ই সামলা।” খুব সাধারন উপায়ে আমি তাকে চুলায় ফুতন্ত পানির উপর ঢাকনা দিয়ে বাস্প জমিয়ে ফোটা ফোটা পানি ঝরে পরা দেখিয়ে বৃষ্টি কি করে হয় তা বুঝিয়েছিলাম। সে যে ভীষন আনন্দ পেয়েছিল ব্যাপারটাতে, তা তার চকচকে চোখ দু’টো দেখে খুব বুঝেছিলাম। এর পর বৃষ্টি হলেই সে সবাইকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতো।
এরকম কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি আমার এই ছোট্ট মেয়েটাকে অনেক রকমের জ্ঞ্যান দিয়ে ফেলেছি, অনেক জটিল জটিল সব বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা দিয়ে দিয়েছি তার বোঝার সামর্থ্যের মধ্যে। এই করে করে আমার নিজের মধ্যে বেশ একটা কনফিডেন্স এসে গিয়েছিল যে আমি তাকে মোটামোটি সব বিষয়ে বুঝিয়ে ফেলতে পারব। সেদিন যখন ম্যাকারনী চীজ রান্না করার জন্য ম্যাকারনীগুলো সিদ্ধ করছিলাম, বলক দিয়ে যখন পানিটা ফুলে ফেপে উঠছিল, আমার মেয়ে বার বার কেন যেন ব্যাপারটা একটু ভয়ের চোখে দেখছিল। ওর ভয়টা কাটাতে আমার মাথায় বুদ্ধি এলো ব্যাপারটা সহজ করে ওকে বুঝিয়ে দেই।
আমিঃ মা, পানির মধ্যে অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চা আছে, এদের নাম হল এ্যাটম…এদের খালি চোখে দেখা যায় না…।
মারজুঃ এতো ছোত বেইবী?
আমিঃ হুম মা, অনে…ক ছোট। তোমরা স্কুলে যখন ছোট ছেলেমেয়েরা থাক, অনেক গরম পরলে কি কর? দৌড় দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাও না?
মারজুঃ গরম লাগলে বাইরে বেরিয়ে যেতে চাই, মা।
আমিঃ ঠিক সেই রকম, এই পানির ছোট ছোট বাচ্চাগুলো অখন চুলার আগুনের গরম পায়, তখন ছূটাছুটি করতে থাকে বেরিয়ে আসার জন্য…
এমন পর্যায়ে আমার মেয়ে দুঃখ পাওয়া গলায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললঃ
মা, উফফফফ…এই বাচ্চাগুলোকে তারতারি ঠান্ডায় নিয়ে আস, কেন গরম দিচ্ছ? ওদের কষ্ট হচ্ছে তো…
………………………………………………
এই পর্যায়ে আমি অনুধাবন করলাম, আমি আসলে বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলছিলাম। আমার বলার ভঙ্গী, আমার উদাহরনটা একেবারেই এ্যাপ্রপ্রিয়েট ছিল না। শিশুদের ধারন ক্ষমতা অনেক বেশি- তবে শিশুরা অনেক বেশী সেনসেটিভ, অনেক বেশী কোমল। তারা খুব অল্পতেই অনেক বেশী আবেগপ্রবন হয়ে যায়। এই কারণেই শিশুদেরকে কড়া বা নির্দয় বা নিষ্ঠুর কিছু বলা বা দেখানো ঠিক না। ওরা এতোটাই নরম হৃদয়ের অধিকারী যে খুব সামান্য কাঠিন্যও ওদের মনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। একাধিক গবেষনায় দেখা গেছে এ ধরনের কাঠিন্য অনেকক্ষেত্রে শিশুদের মনে এতোটাই প্রভাব বিস্তার করে যা পরবর্তীতে তাদের মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত পর্যন্ত করতে পারে।
…………………………………………………………
আমার উপরের পরিস্থিতির সর্বশেষ আপডেটঃ
এর পর থেকে আমার মেয়ে পানি খেতে গেলে বলে,
“মা, পানির এ্যাটম বাচ্চাগুলো কি আমার পেটের ভিতর চলে যাচ্ছে?”
চুলায় যেকোন কিছু বলক উঠলেই চেচামেচি শুরু করে দেয়,
“এ্যাটম বাচ্চাগুলার গরম লাগছে, এ্যাটম বাচ্চাগুলোর গরম লাগছে …”
এই যন্ত্রনার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি তাকে শেষটায় বুঝিয়ে বললাম,
“এ্যাটম বাচ্চাগুলোর গরম না লাগলে ওরা তো বড় হয়না, আর বড় না হলে খাবারও রান্নাও হয়না…আর এ্যাটম গুলো তো মানুষের মত না, মা। ওরা হচ্ছে বলের মত!”
এই বলাতে দয়াময়ী মাদার টেরিজা ক্ষ্যান্ত হলেন!!
:clap:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ধইন্যা পাতা, রাজীব ভাই।
You cannot hangout with negative people and expect a positive life.
ভাগ্নি মাশাল্লাহ ব্যাপক ইন্টিলিজেণ্ট...শুভ কামনা রইলো...
শাওন, দোয়া কোরো। তবে ইন্টেলিজেন্স ব্যাপারটা সবার মধ্যেই আছে...একেকজনের আগ্রহ একেক দিকে। আর এখানেই কাজ করার প্রয়োজন শিক্ষকদের, যা তারা বেশীরভাগ সময়ই করতে ব্যর্থ হন। যদি আগ্রহ অনুযায়ী বাচ্চাগুলোকে শিখানোর কাজটা করা যেত, বাচ্চাগুলোর লার্নিংটা অনেক সহজ আর আনন্দঘন হয়ে উঠতে পারতো। আমাদের নামী দামী স্কুলের নামকরা শিক্ষকেরা "টিচিং" এর উপর যতখানি জোড় দেন, শিক্ষার্থীদের "লার্নিং" এর উপর তার কিছুটাও যদি এফোর্ট দিতেন...শিশুদের জন্য পড়ালেখা অনেকটাই সহজ হয়ে যেত।
You cannot hangout with negative people and expect a positive life.
রাইট... :boss:
গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষন আপু... ভবিষ্যতে কাজে দিবে 😛
অফটপিকঃ অনেকদিন আপনাকে এ পাড়ায় দেখি না যে :-/
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আকাশ, আশা করি সেই ভবিষ্যত খুব বেশী দূরে না... 😀
You cannot hangout with negative people and expect a positive life.
:shy:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
:khekz:
তোমার মেয়ে অনেক বড় হোক!
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
খুব দারুণ লিখেছেন আপু । আশা করি ভবিষ্যতে কাজে দিবে । 😀
এখনও তাহলে আফনের বুইড়াকালীন লেহাপড়া শ্যাষ হয় নাই... :(( :((
-আলীম হায়দার.1312.
"আমিঃ মা, পানির মধ্যে অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চা আছে, এদের নাম হল এ্যাটম…এদের খালি চোখে দেখা যায় না…।" - যখন এই লাইনটা পড়লাম, বিশ্বাস করুন জিতু আপু, আমিও ভাবছিলাম, এ আপনি কি করলেন! অমন করে বললেন!
তবে হ্যাঁ বিষয়টি যে ভুল ছিলো সেটা সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। শিশুকে জ্ঞান দেওয়া বিষয়ে আসলেই সাবধানতা/সচেতনতা দরকার। এই বিষয়ে আমারো কিছু কথা ছিলো এখানে "আপনার শিশুকে বেশি জ্ঞান দেবেন না"।