দুষ্মন্তপুরান-৩

রাজা চৌকীতে হেলান দিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। তাহার সম্মুখেই রাজপরিচারিকা উবু হইয়া ঘর ঝাড়ু দিতেছিল। বেটি বড়ই বেশরম,অর্ন্তবাস বলিয়া যে একটা জিনিষ আছে বোধহয় জানেই না। রাজা নিবিষ্ট মনে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করিতেছিলেন। এমন সময় দুম করে দরজা খুলিয়া প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রবেশ।
রাজা যারপরনাই বিরক্ত হইয়া কহিলেন, মন্ত্রী,বলি বোধবুদ্ধি সব সরবতের সহিত গুলিয়া খাইয়া ফেলিয়াছ নাকি? তোমাকে না বলিয়াছি, দেখা করিবার পূর্বে একটা মিস কল দিবে,নিদেন পক্ষে একটা টেক্সট।
মন্ত্রী চারিদিক চোখ বুলিয়া পরিবেশ সম্পর্কে ধারনা করিলেন,অতঃপর রাজাকে কহিলেন, রাজামশাই,এই রোজা রমজানের মাসে ভর দুপুরে এসব চোখের জেনা না করিয়া বরং দু’রাকাত নামায পড়িলেও তো পারেন।
রাজার মেজাজ সপ্তমে চড়িল। কহিলেন, মন্ত্রী,তোমাকে বেতন দিয়া রাখিয়াছি কি আমাকে ধর্ম দীক্ষা দিবার নিমিত্ত? যা বলিতে আসিয়াছিলা বলিয়া ফেল।
মন্ত্রী কহিল, দুর্নীতি,ঘোর দুর্নীতি। রাজকোষাগারের টাকায় মহেঞ্জোদারো রাজ্য হইতে পাঁচখানা ঘোড়া কিনা হইয়াছিল। ঘোড়াগুলা বড়ই মনোহর। লম্বা চওড়া,তাগড়া। একটানা দু’দিন দু’রাত ছুটতে পারে। কেশর জানি পারস্যের মখমলকেও হার মানায়।
রাজা কহিলেন, বুঝিয়াছি। আগে বল।
মন্ত্রী বলিতে লাগিলেন, ঘোড়াগুলান বন্দরে খালাস করিতে গিয়াছিলাম, ওম্নি সেনাপতি আসিয়া একখানা ঘোড়া লইয়া হাঁটা দিলেন। আমি যেই মানা করতে গেলুম, ওম্নি তরবারীখানা দেখাইয়া কহিলেন, বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা গম্ভীরভাবে কহিলেন, হুম।
মন্ত্রী বলিয়া চলিলেন, বাকি চারটা লইয়া ফিরিতেছিলাম, হঠাৎ রাস্তায় সমরমন্ত্রী আসিয়া বহর থামাইলেন, আর একটা ঘোড়ায় চড়িয়া হাঁটা দিলেন। আমি যেই থামাতে গেলুম, ওম্নি খঞ্জর বাহির কইয়া কহিলেন, বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা দাঁড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিলেন,হুম।
মন্ত্রী কহিলেন, প্রাসাদের ফটকে রাজখাজাঞ্চী আমাদের পথরোধ করিলেন,একটা ঘোড়া বাছিয়া লইলেন,উহায় চড়িয়া প্রস্থান করিলেন। আমি কহিলাম,ওটা তো রাজদরবারের সম্পত্তি। তিনি একটা বল্লম বাগাইয়া কহিলেন, বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা চৌকি হইতে উঠিয়া কহিলেন,হুম।
মন্ত্রী বলিলেন,ঘোড়াগুলি আস্তাবলে ঢুকাইতে যাইব, এমন সময় রাজ দরবারের ভাঁড় আসিয়া আরেকটা ঘোড়ায় লাগাম পরাইতে লাগিল। যেই আমি বাধা দিলাম,ওম্নি একটা ছুরি বাগাইয়া ধরিয়া কহিলেন,বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা একখানা কদলি ছিলিতে ছিলিতে কহিলেন,হুম।
মন্ত্রী কাতরাইয়া উঠিলেন, রাজামশাই,জলদি কিছু করুন। এরকম দিনে দূপুরে ছিনতাইয়ের সমুচিত শাস্তি দিন। এরা বড্ড বাড় বাড়িয়াছে। আজ ঘোড়া চুরি করিয়াছে, কাল রাজকোষ থেকে সোনাদানা চুরি করিবে। রাজ্যের মানসম্মান এরা ডুবাইবে। প্রজারা শুনলে ছিছি করিবে। আশেপাশের রাজ্যে মুখ দেখাবার জো থাকিবে না।
রাজা কহিলেন, ঘোড়াগুলির দাম কত পড়েছে?
মন্ত্রী কহিলেন, তা প্রায় আড়াই কোটি স্বর্নমুদ্রা।
রাজা কহিলেন, বলত মন্ত্রী, রাজকোষের টাকা কোত্থেকে আসে?
মন্ত্রী বলিলেন, কেন, করের টাকা থেকে।
রাজা কহিলেন, বলত মন্ত্রী, কর কারা দেয়?
মন্ত্রী কহিলেন, কেন, প্রজারা?
রাজা কহিলেন, তাহলে এইবার বল, তুমি আমি কি প্রজা?
মন্ত্রী একটু চিন্তায় পড়িয়া গেলেন, কহিলেন, ডেফিনিশন অনুযায়ী তো আমরা ঠিক প্রজা না।
রাজা কহিলেন, তাহা হইলে তোমার এতো মাথা ব্যথা কেন হে?
মন্ত্রী মাথা চুল্কাইয়া কহিল, কিন্তু ডেমোক্রেসি বলিয়াও তো একটা ব্যাপার আছে।
রাজা বিরক্ত হইয়া কহিলেন, আরে ডেমোক্রেসির মায়েরে বাপ। ডেমোক্রেসি গুলাইয়া কি ইসবগুলের ভুষি বানাইয়া খাইবা? দিনরাত জনগনের জন্য বেগার খাটিতেছি, জনগনের কি কোনো রেস্পন্সিবিলিটি নাই আমাদিগের প্রতি? না হয় দু’তিনটা ঘোড়াই রাজন্যবর্গ লইয়াছে,তাহার জন্য কি চেঁচিয়ে রাজ্যের সকলের কান ভারী করিতে হইবে? আমার বুদ্ধি শুনো, বাকি ঘোড়াটি তুমি মারিয়া দাও। তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্রের ঘোড়া চড়িবার অনেক শখ, তাহার মনষ্কামনা পূর্ণ কর। আর যদি বেশি চিল্লাবাল্লা কর, তাইলে পশ্চাদ্দেশে লাত্থি মারিয়া রাজসভা হইতে ভাগাইয়া দেব।
মন্ত্রী বাকরুদ্ধ হইয়া রাজার কথা শুনিতেছিলেন, রাজার কথা শেষ হইলে আপন মনেই বিড়বিড় করিলেন, পাপ হইতেছে, ঘোর পাপ।
মন্ত্রীর কথা রাজার কানে পৌছুল। তিনি রেগে বোম হইয়া এক লম্ফে মন্ত্রীর সামনে দন্ডায়মান হইলেন, তারপর হাতের কদলি মন্ত্রীর দিকে বাগাইয়া বলিলেন,বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।

৪,১৯৯ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “দুষ্মন্তপুরান-৩”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।