তোমরা ভ্যাকেশন কাটাতে যাও ব্যাংকক, পাতায়া, মানালী, কাঠমুন্ডু, মরিশাশ, বালি আর ফিরে এসে ফেইজবুকে ছবি ভরে দিয়ে আমাদের বুকের হাহাকার বাড়াও! টাকা খরচ করে, ভিসার ঝামেলা মাথায় নিয়ে, বিমানবালার হাতের ফ্রি খাবার খেয়ে, শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল হোটেলের নরম বিছানায় গা না এলালে ঠিক যেন ভ্যাকেশনটাকে জাতে তোলা যায় না। আজকাল ফেবু কবিদের ভীড়ে আমরা এককালের কাগজ আর কালি খরচ করে গড়ে ওঠা কবিদের কথা মনেই রাখি না। ভুলে গেছ, কবি কি বলে গিয়েছিলেন?
“দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু,
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া;
একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু।”
বাংলাদেশের কোনকাঞ্চিতে ঘুপটি মেরে যে কত নৈস্বর্গীক খনি অবহেলা আর অনাবিষ্কৃত অবস্থায় এতীম বাচ্চার মত পড়ে আছে ভাবতে অবাক লাগে। আমি নিশ্চিত, আমার ফেবু বন্ধু তালিকায় হাতে গোনা দশ জনও পাওয়া যাবে না যারা যাদুতে সম্মোহন করা মোহনীয় রূপের অধিকারী এই “যাদুকাটা নদী”র অবস্থান তো দুরের কথা, নাম জানে। দুষ্টু ব্রিটিশের দল হাতে মদের পেয়ালা নিয়ে এই বিস্তীর্ণ ভূখন্ডের মানচিত্রে পেন্সিলের কার্বনের নিষ্ঠুর আচড়ে দেশগুলোরে কিম্ভুত একেকটা আকৃতি দিয়ে রেখেছে! ব্যাপারটা অদ্ভুত না? কিভাবে কিভাবে যেন একেবারে কানের পাশ দিয়ে গুলি চলে যাওয়ার মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত প্রায় ৯৮% স্থানগুলোই গিয়ে পড়ল নেক্সট-ডোর নেইবার ভারতের পাতে! এরকমই একটা কোনায় পড়ে থাকা এই অপূর্ব নদীটা কিভাবে যেন আমার হতভাগা দেশের মানচিত্রের ভিতর পড়ে গেছে। ভারতের ব্যাড়ার ভিতর পড়া নীল নীল পাহাড়রগুলো যেখানে দীগন্তের রেখাকে আটকে দাম্ভিক রাজবাড়ির প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে, তার ঠিক নীচেই সোনালী বালূর বিস্তীর্ণ তটরেখা পেড়িয়ে হঠাত গা এলিয়ে নবাবী কায়দায় আয়েশী ভঙ্গীতে শুয়ে আছে নীল স্বচ্ছ পানীর অসম্ভব রূপবতী এই নদী, যাদুকাটা। আমীর খানের “3 Idiots” মুভীটির শেষ দৃশ্য দেখে যাদের ভারতের “লাতাক” এ যাবার জন্য মন কেদে উঠেছিল, তারা একবার নিজের দেশের টাকা দেশে রেখে অর্থনিতীর মারপ্যাচের কথা না ভাবলেও একবার নিজের পকেটের কথা আর ভারতীয় দূতাবাসে ভোর পাঁচটা থেকে অনিশ্চয়তার লাইনে দাড়ানোর কথাটা ভেবে দেখতে পারেন। এর চাইতে দেশটাকেই একটু আদর সোহাগ ভরে নেড়েচেড়ে দেখুন না! মরমীকবি হাসনরাজার দেশ সুনামজঞ্জে এরকম ছড়িয়ে আছে দেখার মত অনেক কিছু। সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট সুনামগঞ্জের “টাঙ্গুয়ার হাওর” এখন অনেক পর্যটকের জন্যই দর্শনীয় স্থান। শান্ত স্বচ্ছ সমুদ্রের রূপ নিজের দেহে ধারণ করা এই হাওর আকাশের সাথে গা মিলিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে অকুতোভয়ে। আর মাঝে মাঝে জেগে থাকা শাখা প্রশাখা বিস্তৃত গাছগুলো বিলাশবহুল রিজোর্টের মত বিনামূল্যে অতিথি পাখিদের সেবা দিতে প্রস্তুত। আগে থেকে ঠিকমত ভ্রমন-পরিকল্পনা করে নিলে একই সাথে হাসনরাজার যাদুধরে রাখা দুর্মূল্য সব সংগ্রহ, টেকির ঘাটে এককালের লাফার্জ-সুরমা সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর খননকৃত কোয়েরী তে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি ঘন নীল টলটলে পানির হ্রদ, যাদুকাটা নদী, নদী পেড়িয়ে বারেক্য টিলার উপর বাংলাদেশ-ভারতের সীমানা, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ অনেক দর্শনীয় স্থানই ছুয়ে আসতে পারবেন।
সাথে যদি মাসউদুল হক (ককক ১৯৮৭-১৯৯২) এর লেখা পুরুষ্কারপ্রাপ্ত বই “দীর্ঘশ্বাসেরা হাওরের জলে ভাসে” বইটা পড়ে ফেলতে পারেন তাইলে তো আর কথাই নাই, বইএর পাতায় পাতায় দেয়া অপূর্ব বর্ননায় ফুটিয়ে তোলা টাঙ্গুয়ার হাওর আর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর বর্ননা আর সেই নৈস্বর্গিক মাধূর্য্যমন্ডিত অঞ্চলের প্রবলভাবে লড়াই করে বেচে থাকা জনজীবনের একটা চিত্র নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হাতছাড়া করা উচিট না।
সুনামগঞ্জ শহর থেকে ২০ কি.মি. দূরে অবস্থিত যাদুকাটা নদী। সাহেববাজার ঘাট যেয়ে নৌকায় সুরমা নদী পার হয়ে মণিপুরি ঘাট যেতে হবে। তারপর ভাড়া করা মোটরবাইকে যাদুকাটা নদীর তীর। নৌকায় নদী পার হয়ে বারেকটিলায় যেতে পারেন। টিলার ওপর থেকে নিচে নদী দেখা যায় বহুদূর পর্যন্ত। এ পথে এগিয়ে বিশেষ “বার্কি নৌকা”য় করে ঘুড়ে আসতে পারেন টাঙ্গুয়ার হওরে। একটু সকাল সকাল রওনা হলে দিনের আলোতেই আবার শহরে ফিরে যেতে পারবেন। আর রাতে থাকতে চাইলে, আগে থেকে ব্যাবস্থা করে টেকিরঘাটে সরকারী রেস্ট হাউজে ব্যবস্থা করে নিতে হবে।
তো দেরী কেন, “চলনা ঘুড়ে আসি অজানাতে, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে…” মোবাইল ফোনে হেডফোন লাগিয়ে পিঠে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে আরামদায়ক পোশাক আর পায়ে কেডস গলিয়ে নেমে পড়ুন আবিষ্কারের নেশায়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
ছবি কৃতজ্ঞতায়ঃ আমার ছোট ভাই রাইয়ান রহমান ও তার বন্ধু আমীর সাদ মোহাম্মহ হুসাইন
রসদ সৌজন্যেঃ শাফায়েত উল্লাহ্, সহকারী জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ
সার্বিক তত্বাবধানঃ মোঃ মাসুদুল হক, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এবং লেখক- “দীর্ঘস্বাসেরা হাওরের জলে ভাসে”
প্রথমেই চিত্র সমৃদ্ধ সুন্দর পোষ্টিতে আমা রভালো লাগা জানিয়ে রাখলাম।
বাংলাদেশের কোনকাঞ্চিতে ঘুপটি মেরে যে কত নৈস্বর্গীক খনি অবহেলা আর অনাবিষ্কৃত অবস্থায় এতীম বাচ্চার মত পড়ে আছে ভাবতে অবাক লাগে। আমি নিশ্চিত, আমার ফেবু বন্ধু তালিকায় হাতে গোনা দশ জনও পাওয়া যাবে না যারা যাদুতে সম্মোহন করা মোহনীয় রূপের অধিকারী এই “যাদুকাটা নদী”র অবস্থান তো দুরের কথা, নাম জানে আপনার সাথে সহমত। আমি নিজেই তাদের ভিতরের একজন।
সময় সুযোগ পেলে এইসব যায়গাগুলো থেকে ঘুরে আসবার ইচ্ছেটা রইলো।
অনেক শুভকামনা রইলো।
নিজের মনের আনন্দে লিখালিখি করি।
চমৎকার।
মাসউদুল ভাইকে বলেছিলাম এখানে লিখতে।
তুমিও পারলে বইলো। (সম্পাদিত)
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
সুনামগঞ্জে আড়াইবছর ছিলাম। যাদুকাটার নামও শুনিনি :((
ছবিআলার প্রতি কৃতজ্ঞতা :hatsoff:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
:boss: :boss: :boss:
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
just wonderful!!!
Very interesting info.... Thnx a lot for sharing :thumbup: (সম্পাদিত)
মানুষ এমনতয়, একবার পাইবার পর
নিতান্তই মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর.........
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া....ঠাকুর সাহেব এই কবিতা যথার্থ কারণেই লিখেছেন। বাঙলাদেশ পোর্টালের জেলা ভিত্তিক সাইট গুলোতে গিয়ে জেলা ভিত্তিক অফিশিয়াল দর্শনীয় স্থানের তালিকা দেখলে মাথা ঘুরাবে। এতকিছু কোথা থেকে?
চমৎকার লিখেছেন। চমৎকার ভ্রমন ব্লগ। লিস্টি করে রাখলাম। সমগ্র বাঙলাদেশ ৬৪ কাপ চা (আমার এক পাগলাটে বন্ধুর প্রজেক্ট) এর প্রজেক্টের খাতায় লিখে রাখলাম।
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
চমৎকার সুন্দর!
:clap: :clap: :clap:
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
ওয়েলকাম ব্যাক আপু, ভাবলাম ভুলেই গিয়েছিলেন 😛
সিলেট অঞ্চলে দেখার মত এত্ত এত্ত জায়গা আছে, দুবার ঘুরেও সব জায়গা দেখা হয়ে ওঠেনি। ভবিষ্যত চ্রমন তালিকায় নতুন আরো একটা জায়গা যোগ হলো।
দারুন ভ্রমন ব্লগ, আর চাই 🙂
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
এত সুন্দর আর পরিপূর্ণ একটা ব্লগ লেখার জন্যে অভিনন্দন জিতু!
হাসনরাজার দেশ বলে কথা --- আমার সীমাহীন দুর্বলতা থাকবেই।
লেখা তো পড়লাম, যাই এবার বানান ভুল ধরে আসি এক এক করে। 😀 😀 😀
সিলেট শহর, জাফলং আর শ্রীপুরে আমার চমৎকার কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে কুড়ি প্লাস বছর আগে। 🙂
চমৎকার লেখা, জিতু!
নাটকিয় শুরুটা "তোমরা ভ্যাকেশন কাটাতে যাও ব্যাংকক, পাতায়া, মানালী, কাঠমুন্ডু, মরিশাশ, বালি...... " - দেখে যতটা চমকৃত হয়েছি, যাবার বর্ননা "...ভাড়া করা মোটরবাইকে যাদুকাটা নদীর তীর..." কিংবা থাকবার বর্ননা "...আগে থেকে ব্যবস্থা করে টেকিরঘাটে সরকারী রেস্ট হাউজে ব্যবস্থা করে নিতে হবে..." - দেখে সেটা আর সেইভাবে টিকে থাকেনি।
দারা-পরিবার নিয়ে "ভাড়া করা বাইকে" কিভাবে ভ্যাকেশন পালন ও ঘোরাঘুরি করা যাবে, ভাল বোধগাম্য হচ্ছে না।
আর সরকারি লোক না হলে " সরকারী রেস্ট হাউজে"-র ব্যবস্থা করাটা যে আমজনতার (পড়ুন বেসরকারি লোক। সরকারিদের কাছে ওরা তো আমজনতাই, তাই না?) জন্য কি তা ভুক্তভোগি মাত্রই জানেন।
যাহোক, তথ্যগুলো ইউজফুল তা অনস্বীকার্য তবে তা সবার জন্য নয়। মনে রাখা দরকার, টুরিজমেরও প্রকারভেদ আছে। যেমন:
- এডুকেশনাল টুরিজম
- রিলিজিয়াস টুরিজম
- হেলথ-কেয়ার টুরিজম
- স্পোর্টস টুরিজম
- রিক্রয়েশনাল টুরিজম
- এডভেঞ্চার টুরিজম
- (প্রকাশ অযোগ্য) টুরিজম ইত্যাদি ইত্যাদি......
যাদুকাটা ভ্রমনে উপরের অনেকগুলো টুরিজমের বিশেষ করে এডভেঞ্চার টুরিজমের লক্ষ অর্জন সম্ভব হলেও রিক্রয়েশনাল টুরিজমটা কিভাবে যে হবে, বুঝতে পারছি না মোটেও।
তারপরেও তথ্যবহুল লিখাটা উপহার দেয়ায় অনেক অনেক ধন্যবাদ। (সম্পাদিত)
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
উইশ লিস্টে আরেকটি বুলেট পয়েন্ট ঢুকে পড়লো... চমৎকার :clap:
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য