সিসিবি’র প্রথম গেটটুগেদারে কামরুলতপু ভাইয়ের আবদার ছিল এরকমঃ তুমি সবাইকে উৎসর্গ করে এটা-সেটা লিখছো, আমার জন্যে কবে লিখবা? সেদিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ওনার নাম করে এই লেখাটা প্রকাশ করার। এটা গল্পাকারে হলেও মূলতঃ আমার ব্যক্তিগত কাহিনী, কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশ হয়েছিল। এখন সেটা দেখে দেখে টাইপ করতে হলো, আর সেকারণেই তপু ভাইকে ওয়েট করতে হলো এতগুলো দিন!
১…
আজ বিকেলে কলেজ থেকে বাসায় এসেছে কথন। সিলেট ক্যাডেট কলেজে নবম শ্রেণীতে পড়ে সে। দু’মাস পর বাবা-মায়ের সাথে দেখা। গত মাসে প্যারেন্টস ডে ছিল, কিন্তু কেউ যায়নি সেদিন। ত্রিতল বাসার সামনে এসে কথন যখন কলিংবেল বাজিয়েছে, কেমন কেমন যেন লাগলো তার। আম্মু এগিয়ে এসে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। কথন কাপড় ছেড়ে গোসল সেরে আসল। ছোটবোন ফাতেমা ওকে কাপড়-চোপড় এগিয়ে দিচ্ছে। সে দেখল, ড্রয়িংরুমে জায়নামাযে বসে মা হাত তুলে কাঁদছেন! স্রষ্টার দুয়ারে প্রার্থনারত হস্তদ্বয় কিসের যেন কামনায় ব্যকুল হয়ে আছে। মায়ের মুনাজাত দেখে কষ্ট হয় কথনের। দীর্ঘ দু’মাস পর মাকে দেখল ও। কলেজে বন্ধুদের সাথে দিনগুলো কেটে যায়… মনেই পড়ে না যে, একজন সহৃদয় মহিলা ওর সুন্দর ভবিষ্যতের কামনায় উন্মুখ হয়ে আছেন! কলেজে একজন ম্যাডামকে খুব ভাল লাগে ওর, ইতিহাস পড়ান। ম্যাডামের সাথে কথন তার বড় বোনের মিল খুঁজে পায় অনেক। সাথে সাথে কথনের মনে পড়ে বড়াপার কথা, আপার হার্টের অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। সিএমএইচে ভর্তি হয়ে আছে হয়তো, নইলে যে আপাকে দেখা যাচ্ছেনা বাসার কোথাও! নাকি আপা নতুন বাসায় উঠেছে দুলাভাইয়ের সঙ্গে?
কলেজে ঝর্ণা ম্যাডামকে দেখলেই ওর মনে পড়তো একটি পরিচিত মুখ- সে ওর বড় আপা, আদরিনী সোহাগিনী ‘বড়াপা’। কথন শিগগির আপার কাছে যাবে, ম্যাডামের কতো কথা আপার জন্য জমে আছে!
২…
বড়াপার রুমটায় গেল কথন। আশ্চর্য, সবকিছু আগের মতোই সাজানো পরিপাটি। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চুল আঁচড়াচ্ছে কথন। ওয়ার্ড্রোবের উপর কতো কিছু রাখা, এগুলোর মালিক বড়াপা। ক্রিম, বডি লোশন, লিপ লাইনার, তেল, ক্যাসেট, থ্রি-ওয়ে মিরর, কয়েকটা বই। চিরুনিটা বড়াপার পার্সোনাল, ও কাউকেই এটা ধরতেই দেয়না, দুলাভাইকেও না।
৩…
সোফায় বসে ছেলের পরীক্ষার খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন কথনের আম্মু। হঠাৎ কথন ছোটবোন ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া, বড়াপা কইরে?” ফাতেমা নিশ্চুপ। প্রতিবারই ছুটিতে এসে সে বাসার সব ঘটনাগুলো জানতে পারে ফাতেমার কাছ থেকে। কিন্তু আজ ফাতেমা নির্বাক কেন? বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠল কথনের। সে আবার প্রশ্ন করল, “ফাতু, বড়াপা কই?” ফাতেমা এবার নিচের দিকে চেয়ে পেপারে মুখ লুকাল। কী মনে করে তৃতীয়বার আর প্রশ্ন করেনা সে।
৪…
মাগরিব নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়েছে কথন। বড় ভাইয়া লিখন আগেই বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন পেছন আব্বুও বেরোলেন। আব্বু ইশারায় লিখন ভাইয়াকে কী যেন বললেন। লিখন এগিয়ে এসে কথনের ডানহাতের একটি আঙ্গুল মুঠিতে চেপে হাঁটতে লাগল। না, ওরা বাসায় ফিরছে না, ওরা যাচ্ছে বিপরীতদিকে। লিখন ভাইয়া বললো, “চল, বড়াপার বাসাটা দেখে আসি।” কথন এতোক্ষনে সব বুঝতে পারল, সে তার সেই প্রশ্নটার উত্তর পেয়েছে। দুলাভাই আপাকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠেছেন! আচ্ছা, তাহলে ফাতেমা তখন একথা বলেনি কেন? কথনের সন্দেহ ভাঙ্গেনা। ও ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে, “আমি যে বাসায় দেখলাম, বড়াপার আগের ঘরে ওর সবকিছু পড়ে আছে? ব্রাশ, বই, চিরুনি- সব! নতুন বাসা তাহলে কি দিয়ে ভরল?…” লিখন ভাইয়া নিরুত্তর। লিখনকে চুপ থাকতে দেখে আবারও কলজেটা মোচড় দিয়ে উঠল কথনের। পরক্ষণে মনকে বোঝাতে চাইল সে, বড়াপা তো নতুন বাসায় উঠেছে। নতুন বিয়ে, নতুন সংসার। হয়তো নতুন বাসায় যাবার সময় আত্মীয়রা ওদেরকে খাট, আলমারি, টিভি- এসব দিয়েই দিয়েছে।
৫…
অনেকখানি পথ চলে এসেছে ওরা। কথন পেছনে তাকিয়ে দেখলো, বাবাও আসছেন। উত্তেজিত সে, ওর আর দেরিতে সইছেনা। লিখন ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো সে, “ভাইয়া, বড়াপার বাসা আর কতদূর?” লিখন আশ্বস্ত করলো, প্রায় পৌঁছে গেছে তারা। পুনরায় প্রশ্ন কথনেরঃ বড়াপার বাসায় কি তোমাদের প্রায়ই যাওয়া হয়? আই মিন, সপ্তায় একদিন? লিখনের ছোট্ট জবাবঃ হ্যাঁ, যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি অবশ্য কালকে যেতে পারিনি, অফিসের কাজের চাপ।..
কথাগুলো বলতে বলতে ঢোক গিললো লিখন। কোনোকিছু চাপা দিতে হচ্ছে ভেবে লজ্জিত হলো সে। কথন যেন সবই বুঝতে পারছে! ওর ভেতর একধরনের ভূতুড়ে মানসিকতা কাজ করছে। কল্পনার ডানায় সে এঁকে চলেছে বড়াপার বাসার আল্পনা। ফুলের বাগানে ঘেরা, পাখ-পাখালির কলকাকলিমুখর ছোট্ট বাসায় ঘুমিয়ে থাকে বড়াপা। কথন গিয়ে ঘুম ভাঙ্গাবে আপার। আপা চোখ খুলেই ওকে দেখে লাফিয়ে উঠবে, জড়িয়ে ধরে বলবে, “কথন, কেমন আছ ভাইয়া?” সে চোখ-মুখ শুকিয়ে অভিমানের অভিনয় করে বলবে, “ওহ্, আর আদর দেখাতে হবেনা। তুমি আমাদের ছেড়ে এই বাসায় চলে আসলে কেন?…” বলতে বলতে রাগ ভুলে যাবে কথন। মিষ্টি করে বলবে, “আপা, জান, ঝর্ণা ম্যাডাম না……। জান, ম্যাডামকে দেখলেই তোমার কথা মনে হয়। ইস্, তুমিতো মাত্র মাস্টার্স পড়। কেন তুমি আমাদের ম্যাডাম হওনা? তাহলে কলেজে কতো আদর পেতাম!…” কথনের বাকভান্ডার ফুরোয় না। ও বলতেই থাকে। বড়াপা ওদেরকে বসিয়ে রেখে কিচেনে যায়, চা করে আনে, কী মিষ্টি চা!
৬…
আজ সারাটি দিন একটু পরপর টানা বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যার পর এখন যদিও বৃষ্টিটা বলতে গেলে থেমেই আছে, তবুও বিজলি চমকাচ্ছে অহরহ। বৃষ্টির কারণেই বোধহয় কারেন্টও আড়ি নিয়েছে এলাকাবাসীর সাথে। অন্ধকার রাস্তায় বিজলি চমকানোর আলো দিয়ে পথ চিনে এগুচ্ছে ওরা। কথন, লিখন ভাইয়া আর ওদের আব্বু। সোজা রাস্তায় হেঁটে এসে ডানে মোড় নিল ওরা, একটা চিকন গলি, গলির উভয়পাশে বিল্ডিং বাসা পরপর। গলিতে ঢুকতে গিয়েই আত্মাটা বিষিয়ে উঠল কথনের। এখানে প্রথম যেই বিরাট খালি জায়গাটা, ওটা একটা পতিত জমির মতো। অন্ধকারে যতটুকু টের পেল কথন, জায়গাটার চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রায় পাঁচ কাঠা হবে, খালি জমি।
ওরা দুজনে দেয়ালটার পাশাপাশি চলে এসেছে। কথন জোর করে নিজেকে সামনের বিল্ডিংগুলোর দিকে নিয়ে যেতে চাইল। ওর মনে হল, এদিকেই একটি বাসায় ঘুমিয়ে আছে ওর বড়াপা। এক্ষুণি আপার বাসায় পৌঁছবে কথন। ঘুম থেকে জাগাবে আপাকে। এই আপা, তুমি এত আলসে কেন, শুধু ঘুমোও।… এমন সময় লিখন ভাইয়া আস্তে আস্তে কথনের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। কথন আরও এগুতে যাচ্ছিল, কিন্তু লিখন আর এগুনোর সুযোগ দিলনা। কথনের কেন যেন মনে হল, সে আজ জীবনের এক পরম সত্যের সম্মুখীন হতে চলেছে।
লিখন ঠান্ডা-কোমল স্বরে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, “কথন, জান, বড়াপা না এমন জায়গায় বাসা কোরে ফেলেছে যেখানে অন্য কেউ যেতে পারেনা। বড়াপাও আর কোনদিন আসতে পারবেনা আমাদের বাসায়!…” কথনের বুকটা কে যেন চেপে ধরেছে। এতক্ষণ এমনই অজানা আশংকা হচ্ছিলো ওর। ঠিক সেসময় গগনবিদারী গর্জনে বিজলি চমকালো আকাশে, দূরে কোথাও বাজ পড়েছে হয়তো। আজ কথনের ‘না, আমি বিশ্বাস করিনা’ বলে বসে পড়তে ইচ্ছা হলোনা। ও এখন অতিবাস্তব নিয়তির চিরন্তন বেড়াজালে বন্দী।
৭…
বিজলির আলোতে সমস্ত কবরস্থানটা একবার আলোকিত হয়ে উঠল। এখানেই বড়াপার চিরস্থায়ী ‘বাসা’।
ততক্ষনে কথনের আব্বু সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন, “কথনকে বলা হয়েছে, লিখন?” হ্যাঁ; লিখনের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
আব্বু বলতে থাকলেনঃ কথন, গত শুক্রবারের আগের শুক্রবার জুম্মা নামাযে জানাযা পড়িয়ে তোমার বড়াপাকে এখানে সমাহিত করা হয়। তার আগেরদিন অপারেশনের সময় সে মারা যায়।… ঐ যে নারকেলের ডালটা দিয়ে ঢেকে রাখা কবরটি, ওখানেই শুয়ে আছে সে।… এখন কিছু দোয়া-দরুদ কর।
লিখন ভাইয়া আয়াতুল কুরসী পড়ছে, আব্বুও যেন কী পড়ছেন। কথনের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সে বিড়বিড় করে উঠল আপন মনে… বড়াপা, তুমি তো জাননা, ঝর্ণা ম্যাডাম তোমার জন্য কতো সুন্দর একটা পার্কার পেন পাঠিয়েছে, আর দিয়েছে একটা ছোট্ট চিঠি… ইস্, তোমাকে আমি চিঠিটা কিভাবে পড়ে শোনাবো!… বড়াপা, তুমি আমাকে ফেলে চলেই গেলে? আজ বিকেলে মাকে দেখেছি তোমার জন্য কাঁদছে।… তোমাকে ছাড়া আমার ছুটি কাটবে কি করে? ঝর্ণা ম্যাডামকে দেখলে আবার মনে পড়বে তোমার কথা। কেন আপা, তুমি কেন চলে গেলে?
গাছের পাতায় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির ঝরঝর শব্দে আড়মোড়া ভাঙ্গে কথনের। ও আরেকবার দেখে নেয় বড়াপার কবরটি। এরপর ওরা হাঁটতে থাকে বাসার দিকে। লিখন ভাইয়া গুনগুন গান ধরে,
“পৃথিবীতো দুদিনেরই বাসা, দুদিনেই ভেঙ্গে ফেলা ঘর,
ভালবাসা- মিছে মায়ার বালুচর।”
😛
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
অসাধারণ
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
সমস্যা কী?? সবারই কি মন খারাপ নাকি?
অসাধারণ লাগলো। আর কী বলবো? তেমন কিছু বলা যাচ্ছে না।
লেখাটা কি সাইজে একটু বড় হয়ে গেসে?!!
ধৈর্য্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদঃ
আহসান আকাশ ভাই
ও আমিন ভাইকে।
ভাইয়া এটা কি সত্য ঘটনা? মনটা আবার খারাপ করে দিলেন।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
হ্যাঁ, পুরোপুরি সত্য ঘটনা, শুধু কথনের জায়গায় আমাকে পড়তে হবে।
গল্পটা অসাধারণ :boss:
কিন্তূ কেন জেন মন খারাপ লাগলো 🙁
আমারটা কই?
লেখাটা খুবই ভালো হইছে।
আমি দুদিন বাসায় ছিলাম না। এই লেখাটা পড়া হয়নি। আজকে বাসায় এসে দেখলাম।
ধন্যবাদ আলম।
লেখা পড়ে চোখে পানি আসল। কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না।
এই লেখাটা পড়ে আরেকজনকে কাঁদতে দেখসিলাম, আমার ভাইয়া। (এই গল্পের লিখন ভাইয়া)
আপনিতো কল্পনায় আপুদের মিস্ করেন, আর আমি বাস্তবেই মিস্ করি।
তোমার জন্য খারাপ লাগছে । কিছু বলার নেই।
এই লেখাটা পড়ে আমার চোখ ভিজে গেছে...
খারাপ লাগছে খুব...
আমার ঠিক এরকম একটা বড় আপা আছে। কিন্তু সে বেঁচে আছে...
ভাল লেখা...দারুণ !!
হিংসিত হলাম আপনার উপর। বড় আপাকে আল্লাহ অনেক অনেক দিন রাখুক আপনাকে আদর করার জন্য।
কাম্রুল কারে আপনি কইরা কইলিরে?
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
কামরুল :bash: :bash:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
এহহেরে মিস্টেক হইয়া গেল। আমি কি দেখলাম তাইলে। নাহ বয়স হইছে।
আমিও কাম্রুল ভাইয়ের "আপনি" ডাক শুনপোওওওও
:(( :(( :((
ভাই....পড়তে পড়তে চোখটা ভিজে গেল.......অদ্ভুত অনুভূতি......