“Cadet no-1976, Fall Out….”
আমার ছয় বছরের ক্যাডেট জীবনে শুনতে চাওয়া সবচেয়ে প্রিয় এবং আকাঙ্ক্ষিত শব্দগুলোর মধ্যে এটি লিস্টির একেবারে উপরের দিকেই লটকে থাকবে।
আমি ছেলে হিসেবে খুব বেশি সাহসী নই।অতি নিরীহ জীব। কারো সাতেও নাই,পাঁচেও নাই।আর সব ডেয়ারিং ক্লাসমেট এর মত বেসম্ভব মাইর কিংবা পানিশমেন্ট খেয়ে কিছুই হয়নাই এমন ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারিনাই কোনদিন।জানালার পাশের বেড পাওয়ার সৌভাগ্য আমার জুনিয়র ক্লাস থেকেই বাড়াবাড়ি রকমের ছিল।সেই অনুযায়ী আমার সিনিয়রদের ডাকাডাকি শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যাবার কথা।কিন্তু কোন কারণে তা’ হয়নি।কিছু কিছু মানুষের কিছু কিছু ব্যাপার বোধহয় কখনো বদলায় না। আমার যেমন কোন সিনিয়র ডাকলে কিংবা সারি থেকে ফল আউট হতে বললে বুকের মদ্ধে একেবারে ধ্বক করে উঠতো… পুরা জুনিয়র টাইমে এই ব্যাপারটার কখনো ব্যতিক্রম হয়নি … কেবল একটা সময় ছাড়া…
জুনিয়র ক্লাসে থাকতে ইভনিং প্রেপ,প্রেয়ার টাইম অথবা অন্য কোন সময়ে সিনিয়র প্রিফেক্টদের কেউ যখন একগাদা চিঠি হাতে নিয়ে ফলইনে আসতো মনটা চঞ্চল হয়ে উঠতো।আশায় থাকতাম কখন আমার ক্যাডেট নং টা ডাকবে… কখন ফল আউট হতে বলবে… আশা পূরণ হলে মনটা অসম্ভব খুশি হয়ে উঠতো… না হলে লুক ডাউন করা মাথাটা বেদনায় আরেকটু নুয়ে পড়তো।
চিঠি জিনিসটার সাথে আমার পরিচয় এবং পরিণয় অনেক ছোট বেলা থেকেই।জীবনে লেখা ফার্স্ট চিঠিটা ছিল আমার ক্লাসের এক মেয়ের কথা ভেবে লেখা একটা কাল্পনিক প্রেম পত্র।ভাগ্য খুব বেশি সুপ্রসন্ন ছিলনা সেবার।আম্মা কেমনে জানি দেখে ফেলল।চেইন অব কমান্ড এর মধ্যে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেটার শেষ ঠিকানা হলো আব্বার হাতে।অতঃপর ভরা মজলিসে সেটা পঠিত হল এবং রুমের সবকটা চোখ আমার দিকে চেয়ে চেয়ে মিটি মিটি হাসতে লাগল।তখন অনেক ছোট ছিলাম।কিন্তু লজ্জাটা মোটেও কম পাইনি।
সেই থেকে শুরু… ক্যাডেট কলেজে এসে আরম্ভ হল চিঠি লেখার সেকেন্ড ইনিংস।ক্লাস সেভেনে কাউকে বলে দিতে হতোনা… বাসার সবার কথা মনে করে ফি সপ্তায় গন্ডায় গন্ডায় চিঠি দিতাম।সেই চিঠিগুলোতে বৈচিত্র থাকতো কম।পুরো চিঠি জুড়ে শুধু “কেমন আছো,ভাল আছি” টাইপের গৎ বাধা কিছু বাক্য।সাথে মিশে থাকতো বাসার জন্য মন খারাপ করে রুমের এককোণায় বসে থাকা ছোট্ট ছেলেটির দীর্ঘশ্বাস…সেটা চিঠির কোথাও লেখা না থাকলেও বুঝে নিতে তেমন কষ্ট হতোনা।
একটু একটু করে সিনিয়র হবার পর ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম… অভ্যস্ত হলাম বাসার কথা ভুলে বাসা থেকে অনেক দূরে ৩০০ মানুষের একান্নবর্তী নতুন একটা পরিবার এর একজন হিসেবে নিজেকে ভাবতে। তারপরও চিঠির যাওয়া আসা থামেনি।বৃহস্পতিবার এলেই রাইটিং প্যাডে মায়ের মুখটা ভেসে উঠতো।কখন যেন হাতে উঠে আসতো কলমটা…
আমি না হয় চিঠি লিখতে পছন্দ করি।কিন্তু সবার ব্যাপারতো সেরকম না।ক্লাস নাইনে থাকতে নিয়ম করা হল প্রতি সপ্তাহে বাসায় চিঠি দিতেই হবে।বেশির ভাগ পোলাপান এরই মেজাজ খারাপ।নিজে থেকে লিখার কথা আলাদা।কিন্তু চাপিয়ে দেয়া হলেই একটা রোখ চেপে যায়।তবে এর জন্য প্রতিকারও বের হল অচিরেইঃ
১।পরের টার্ম থেকে কেউ কেউ একটা চিঠি লিখে তার অনেকগুলো ফটোকপি করিয়ে নিয়ে আসলো।প্রতি সপ্তাহে খামে ভরে সেখান থেকে একটা করে পোস্ট করে দিত।স্যারও খুলে খুলে সব চিঠি দেখতোনা।এত চিঠি পড়ার সময় কোথায়?
২।এটাই সবচেয়ে সহজ এবং জনপ্রিয় পন্থা ।নিচতলা থেকে একটা জুনিয়ররে শুধু ডেকে আনার মামলা।তারপর কষ্ট করে মুখ খুলে অর্ডার করলেই হল।কিছুক্ষণ পরেই রেডিমেড চিঠি সহ জুনিয়র হাজির!
ক্লাস এইটে উঠে আমার নতুন পেনফ্রেন্ড হল।চিঠির ওপাশের মানুষের কথা ভেবে মনে মনে রোমাঞ্চিত হই।কিন্তু কলেজ অথরিটির কাছে অইসব রোমাঞ্চ টোমাঞ্চের কোন বেইল নাই।নিউটনের থার্ড ল এবং “একটা ছেলের কাছে একটা মেয়ের চিঠি মানেই নিষিদ্ধ প্রেমের বাকবাকুম সূচনা”- দুটো থিওরীই মাথামোটা অথরিটির কাছে সমান পরিমাণে সত্যি কথা।কাজেই আমাকে নতুন ফিকির খুঁজতে হলো…
পরের চিঠিতেই তাকে পই পই করে বলে দেই চিঠির শেষে কিংবা খামের উপরে যেন ভুলেও নিজের নাম না লিখে।কিন্তু কীসের কি।সাহিত্যের বিচারে নারী জাতি অতুলনীয়া হলে কি হবে।বুদ্ধির বিচারে তারা কিসের সাথে তুলনীয় সেটা চারপাশ হাতড়ালেও পাওয়া যায়না।তবে হাউস বেয়ারা আমাকে খুব সহজেই হাতড়ে খুঁজে পেল। ক্লাস এইটের কোন এক কোয়াইট আওয়ারে মনির ভাই এর বাজখাই হাক রুমে আছড়ে পড়লো… “১৯৭৬ কে?? জলদি দৌড়ান… হাউস অফিসে শরিফ উদ্দিন স্যার ডাকসে…” ডাকাডাকির কথা শুনে বুকটা তাৎক্ষণিক ভাবে ধ্বক করে উঠলো।
গিয়ে দেখি স্যারের সামনে চিঠি।প্রাপকের ঠিকানায় আমার ক্যাডেট নং জ্বলজ্বল করছে। আর প্রেরকের ঠিকানায় তার নাম, কলম এর মোটামুটি সব কালি ঘষে ঘষে বোল্ড করে লেখা।ঠিক মত দুইবার তাকালে কানা মানুষও অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারবে।এত করে বললাম…আর বেটি নাম লেখার আর জায়গা পাইলোনা… ভুল জায়গায় দেয়া অতীত পরামর্শের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস আর নিকট ভবিষ্যতে নিজের পরিণতির কথা ভেবে মনে মনে ঢোক গিলি।
সবেতো ক্লাস এইটে।এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করার বিদ্যা তখনো ঠিকমত রপ্ত হয়নি।পরের কয়েকমিনিট হজম করতে তাই কষ্ট হল।বেশি কষ্ট হল চোখের সামনে চিঠিটা কুটি কুটি করে ফেলার দৃশ্যটা দেখতে।আহারে… চিঠিতে না জানি কত মধু মধু কথা লিখা ছিল…
আমার সাথে ক্লাস নাইনের তারিকুল ভাইও ছিল তখন।তারও একই কেস… তবে প্রেরকটা তার কি হত সেটা কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।
মেয়েটা আমাকে এরপর আর কোনদিন চিঠি দেয়নি … পরের চিঠিতে মনে হয় একটু বেশিই বকাঝকা করে ফেলেছিলাম…
এরপর বেশ কিছুদিন চুপচাপ।পেনফ্রেন্ডশীপের চিন্তা মাথা থেকে হাওয়া।সপ্তাহ শেষে লক্ষী ছেলের মত শুধু বাসার ঠিকানায় কলম ধরি।কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরেকটা পেনফ্রেন্ডশীপ ক্যামনে ক্যামনে জানি হয়েই গেল…
ক্লাস নাইনের কথা।বাসায় গিয়ে দেখি আমার নামে সাদা খামের চিঠি।ওটা দেখে আগের সব ভুলে গেলাম।এইবার আরো মনযোগ দিয়ে চিঠি পাঠানোর কলাকৌশল শিখানো শুরু করলাম।মেয়ে বুদ্ধিমতী।অল্পতেই বুঝে গেল সব।কিন্তু বিপদ হল অন্যখানে…
ওর কিঞ্চিৎ বড়সড় চিঠি পাঠানোর প্রতিভা খুব অল্পদিনেই টের পেলাম।মাঝে মাঝে কিছু চিঠি পেতাম যেগুলো রাফখাতা ছিড়ে ক্লাস টাইমে বসে বসে লেখা।সবচেয়ে ছোট চিঠিটাও দৈর্ঘ্যে প্রস্থে তিন চার পাতায় গিয়ে ঠেকে।বড় চিঠি পেয়ে আমি খুশিই হই। আবার ডরও লাগে।
প্রথম ধরা খেলাম মতিয়ার স্যারের কাছে।জুনিয়র টীচার।তারমধ্যে ভার্সিটিতে আমার মামাতো ভাইএর ক্লাসমেট ছিল।প্রথম ধাক্কা তাই মাথার কয়েক হাত উপর দিয়ে গেল।শুধু ফার্স্ট প্রেপ টাইমে চুপচাপ কানে কানে বলে গেলেন- “মেয়েটাকে বইলো যেন একটু ছোট করে চিঠি লিখে।ওরও তো পড়াশুনা আছে নাকি!!”আমাদের সম্পর্কে স্যার কি ভেবেছিলেন জানিনা।আমিও বেশি কিছু বুঝানোর চেষ্টা করিনাই।শুধু সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ি…সেবারের চিঠিটা ছিল মোটে বারো পাতার (পৃষ্ঠা নয়)…
দ্বিতীয়বারের ধরা আমিরুল ইসলাম স্যারের কাছে।ফ্রেন্ডশীপ ডে তে কার্ড এল।দুপুর বেলায় লাঞ্চের পর হাউস অফিসে ঢু মারতে গিয়ে দেখি ও পাঠিয়েছে।ব্যাপক বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে তখনি মেরে দিলাম ওখান থেকে।বুদ্ধির গলদটা বুঝলাম রাতে স্যার ডেকে পাঠানোর পর।আনার সময় বেশি উত্তেজনায় খেয়াল করিনি চিঠিটা রেজিস্ট্রি করা ছিল…
কিছু আগডুম বাগডুম বুঝিয়ে আর একটা বন্ড লিখে সে যাত্রায় রক্ষা পেলাম যার মর্মার্থ করলে দাঁড়ায়- কান ধরলাম,জীবনে এমন মারাত্নক ভুল দ্বিতীয়বার আর করবোনা।
তৃতীয়বারেও সেই আমীরুল ইসলাম স্যার।দ্বিতীয় ঘটনার পর থেকেই স্যারকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম।কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়,সেখানে রাত হয়।কোন এক রাতের বেলাতেই আমীরুল ইসলাম স্যার হাউস অফিসে আবার ডেকে পাঠালেন।গিয়ে দেখি প্রথম বারের মত করেই টেবিলের ওপর একটা চিঠি পড়ে আছে।আমিও প্রথম বারের অভিজ্ঞতা দ্বিতীয়বার চেখে দেখবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।কিন্তু এবারের মোটিভেশনটা এলো অন্য এঙ্গেলে।স্যার আমাকে পার্সোনালি কিছু কথা বলার জন্য হাউস অফিসের বাইরে নিয়ে গেলেন।এরপর শুরু হল নাতি দীর্ঘ বক্তৃতা।যার টপিক সোজা বাংলা করলে দাঁড়ায়ঃ “প্রেম করার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কুফল।” স্যার মোটামুটি ধরেই নিয়েছেন আমাদের মধ্যে “সেই রকম” সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু হতেই পারেনা।আমিও কিছু বলিনা।চুপচাপ লেকচার শুনি।ততদিন কলেজে থেকে একটা জিনিস শিখে গিয়েছি- মৌনতাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।স্যারদের সাথে যত বেশি তেড়িবেড়ি,তত বেশি ঝামেলা।
কলেজ পর্ব শেষ করে চলে আসার সাথে সাথে চিঠি লেখার অভ্যেসটাও পেছনে ফেলে এসেছি।এখন আর সেরকম করে চিঠি লেখা হয়না।দরকারও পড়েনা।ইমেইলের hi, hello আর tc এর আড়ালে চিরচেনা ঘিয়ে রঙের এনভেলপগুলো সেই কবেই চাপা পড়ে গিয়েছে।
তবুও এখনো মিস করি… চিঠি লেখা… চিঠি পাওয়া…… আর……
Cadet no-1976,Fall Out!!
dosto..tor kahini pore amar r ak kahinir kotha mone pore gelo...lekhar motive paisi..heheheh 😀
সু- পাঠ্য
আমার লাইফে পড়া বেস্ট ব্লগ। You rock, yo...
tui mone hoy amar ta chara jibone r karo blog poros nai... 😀
khub valo likhso choto vai....tomra je akta joss kaj korteso ejonno thanks..tomar intake koto...purono onek kotha mone korai dila...office er fake fake tomader lekha portesi...nyway keep up the good work all the best...btw ami hossain from sh 32nd batch..tomader keu australia te ase naki??
আদনান ভাই, আপনারে চিনতে পারসি। আপনের নেম প্লেট হারাইয়া গেলে আমগো ব্যাচ এর হোসেন এর কাছ থাইকা নিয়া যাইতেন 😀
আমাদের এই ব্লগ ভাল লাগতেসে জেনে অনেক ধন্যবাদ ভাই। নিজেদের মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা পাইতে যে কি ভাল লাগে বুঝাইতে পারমুনা।আমি ঠিক বুঝে পাইনা যে মানুষগুলা এত পাঙ্গাইসে,বকা দিসে তাদেরকে কেন এত মিস করি।
কলেজকে যেমন মিস করি,কলেজের জুনিয়র,সিনিয়র সবাইরেই মিস করি।কোথাও কারো ভাল শুনে ছেলেমানুষের মত সবাইকে বলে বেড়াই...দ্যাখ এইটা আমার কলেজের সিনিয়র।সে আমারে একদিন পাঙ্গা দিসিল... এই টাইপ 😀
ভাই ভাল থাকবেন।আমাদের সাব্বির (FH) এডিলেডে আসে।
are joss ore bolish jogajog korte...isshh 3 weeks agei ami adelaide e silam office er kaje...nameplate er kotha to monei silo na...haha..akhon vable moja lage...ki korish tui...valo thakish..
ক্যামনে যোগাযোগ করতে বলবো??
আমি IUT তে আছি, নামে মাত্র।পড়াশুনা কিছু করিনা 😀 মেকানিক্যাল পড়তেসি।
amar email address dekhai na naki??nyways amar cell number hoilo +61412516086...
ok. oi mail id e die dibo. r num tao.
…সেটা চিঠির কোথাও লেখা না থাকলেও বুঝে নিতে তেমন কষ্ট হতোনা।...
অসম্ভব সুন্দর লিখসো। genious.
"
একমত।
জিহাদ, ই-বুক না কী যানি পাবলিশ হইতাসে, সেখানে তোমার এই লেখাটা দিতে পার।
😮 😮 😮
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
সুন্দর লিখা
চিঠি পাইতে মঞ্চায়...
:thumbup: :thumbup:
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..