তাই স্বপ্ন দেখব বলে…

পরীক্ষার শেষ হবার সাথে সাথেই বুয়েট একেবারে মৃতবৎ হয়ে গেল। ক্যাম্পাসে মানুষজন দেখা যায় না, হলগুলোতেও পোলাপানদের কিচির মিচির কম। টানা ছাপান্ন দিন একটানা ফাইট দিয়ে সবাই ক্লান্ত। মাথা থেকে সব কিছু ঝেড়ে ফেলার জন্য কেউ বেড়াতে গেলো…কেউ বা গেল ঘুমাতে নিজের আপন বাসায়। আমার কোনটাই করা হবে না।

ডিপার্টমেন্টাই এমন। শুধু মাত্র পরীক্ষা চলাকালীন সময়েই একটু শান্তি। তখন কোন জমা থাকেনা। শান্তি মতো রাতগুলো ঘুমিয়ে কাটানো যায়। এই জন্যই কিনা বস্তুটা শেষ হবার সাথে সাথেই স্যাররা ঘাড়ে চাপিয়ে দেন আন্দামান থেকে আমদানী করা তিন তিনটা বুলডোজারের সমান কাজের বোঝা। সবাই যখন ঘুমাতে ঘুমাতে মেরুদন্ড ব্যাকা করে দিচ্ছে তখন জমার কাজে আমাদের দিশেহারা অবস্থা…

গত দুইদিন ধরে আমরা আছি ইকবালে স্যারের ধানমন্ডি অফিসে। এখানেই দিন-রাত পার করছি। গতকালকে ডিজাইনটা প্রায় শেষ করে আনা হয়েছিল। কিন্তু শেষ সময়ে এসে সেটা স্যারের পছন্দ হলো না। তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন…কিচ্ছু হয়নাই এটা। সব কয়টা গাধা। সব কয়টা গাধা। তারপর সব ভেঙ্গে চুড়ে আবার কাজ শুরু হলো। ইমতিয়াজ ভাইয়ের সাথে সবসময় একটা ল্যাপটপ থাকে। সেখানে একটার পর একটা হিন্দী গান বাজছে। আমরা মাথা নাড়ি আর কাজ করি। ভাগ্যিস হিন্দী গান নামক একটা জিনিস এই দুনিয়াতে আছে। না থাকলে আমরা কাজ করতাম কিভাবে…

রাত পার হয়ে ভোর। কাজের সাথে সাথে আমার তেলও তখন শেষ। দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরানো মাত্রই ক্ষুদায় পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। খেতে হলে এখন বাইরে যেতে হবে…অবশ্য কিছু পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। স্বাতীর পাশে গিয়ে বললাম, চল বাইরে গিয়ে ভোর হওয়া দেখি।

ও তখন চোখ বুঝে পড়ে রয়েছে। সেই অবস্থাতেই মুখটা পেত্মীর মতো করে বলল, দূরে গিয়া মর…

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে নাকি একলা চলতে হয়…আমি একাই বের হলাম। সবে মাত্র আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। রাস্তায় পা দেয়া মাত্রই ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগলো। মনে হলো কোন তাড়া নেই…নেই কোন গন্তব্য। শুধু ধীরে ধীরে এলোমেলো পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া। এক সময় টের পেলাম আমি একা না…পাশে দিয়ে স্বাতীও হাটঁছে…

: কিরে পেত্নী তোর না ঘুম পাইছে? এখানে কি…ভিতরে গিয়া ঘুমা…
: আমার ঘুম পাইলে তোর কি? আমি ভোর হওয়া দেখুম…
: খুব ভালো..চল রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটি।

কুয়াশা মাখা নির্জন নিস্তব্ধ পথ। বাস গাড়ি নেই বললেই চলে। আশে পাশের বড় বড় বাড়ি-ঘর গুলো ঘুমিয়ে আছে চোখ বুজে। দোকান-পাট সব বন্ধ। এই রাস্তায় আমরা শ’য়ে শ’য়ে গাড়ি দেখতেই বেশী অভ্যস্ত। আজ এই মুহূর্তটাতে সব কিছুই তাই চোখে লাগে। মনে হলো প্রলয়ের পর আমরা বেঁচে থাকা দুইজন মানুষ। আমাদের কোথাও যাওয়ার নেই…কিচ্ছু করার নেই…

এমন দারুন সময়ে মনটা আবেগে পরিপূর্ণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। পাশের জনকে কোমল গলায় বললাম…দোস্ত, বেঁচে থাকাটা খুব দারুন…তাই না? কত সুখ…
আমার সব কথাই ওর কাছে বাংলা সিনেমার নায়কের মতো লাগে। এই বারেরটাও লাগলো…চোখ মুখ ভেটকিয়ে জবাব দিলো…
মোটেও না। এভাবে পেইন চলতে থাকলে আমি দুই দিনের মধ্যেই সুইসাইড খাবো নিশ্চিত।
গতরাতে স্যারের ডিজাইন সম্পর্কিত গালাগালির চলাকালীন সময়ে আমার নিজেরও মনে হচ্ছিল…কি হবে এই জীবন রেখে। সুইসাইড খাওয়াটাই উত্তম…মরে যেয়ে মানুষ কি হয় জানিনা। কিন্তু কোনভাবে যদি ভূত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সত্য হয় তাহলে অন্তত স্যারের ঘাড়টা মটকাই দেয়া যাবে।

কিন্তু এখনকার অবস্থা ভিন্ন। আমার মন আবেগে আরও দ্রবীভূত হতে থাকে। আমি বাংলা সিনেমার নায়ক থেকে উর্ত্তীন্ন হয়ে যাই হিন্দী সিনেমার নায়কে। মৃদু স্বরে স্বাতীকে বলি…
: তুই আমার হাতটা ধরে হাঁটবি…
: ওই আমি তোর হাত ধরবো কেন? তোর না ইয়ে আছে। ইয়ে ছাড়া আর কারও হাত ধরে হাঁটা যায়না…

কিন্তু সেই মৃদু মন্দ ভোরের বাতাসের কারণেই কিংবা অন্যকিছুর কারণে, একসময় তার হাতটা আমার হাতে এসে পড়ে। আমরা সামনের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের হাতদুটো খাপে খাপে মেলানোর চেষ্টা করি…

: আচ্ছা স্বাতী, চল আমরা দুইজন দূরে কোথাও চলে যাই। কি হবে এতো পড়ালেখা করে? আমরা গাঁধা…সারাজীবন গাঁধাই থেকে যাবো। তারচেয়ে চল পাহাড়ের দিকে চলে যাই। দুই জন দুই পাহাড়ে বাসা বানাবো…সিটিসেল জুম দিয়ে দিন রাত চ্যাটাবো…মাঝে মাঝে দেখা হবে…তুই আমাকে তোর বাড়িতে দাওয়াত দিবি…আমি দিবো তোকে…
: ইশ!! সখ কতো। তোরে পাহাড়ে বাড়ি বানাইতে দিলে তো…
: আমাকে দিবে না তো কাকে দিবে? তোর মতো গান্ধাকে?
: খুব ভালো। খালি তোরে বানাইতে দিলে আমি সেই বাসায় যেয়ে বিছানায় পানি ঢেলে আসবো। তোর ঘুম হারাম হয়ে যাবে…
: আমি তাহলে তোর বিছানায় কাঁঠাল লেপ্টে দিয়ে আসবো…সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবি বিছানার সাথে আটকাই আসিস…

এই ধরণের অর্থহীন সংলাপের সাথে সাথে সময় গড়াতে থাকে। পাশের কোন একটা বাড়ির ছাদ থেকে হঠাৎ করে সূর্যটাও উঁকি মারে। দ্রবীভূত অবস্থা হতে আমরা জাতে ফিরে আসি। একটা দোকান থেকে শুকনা পাউরুটি কিনে সেটা চাবাতে চাবাতে স্যারের অফিসের দিকে আবার হাঁটা দেই। এখনও কিছু কাজ বাকি পড়ে আছে…

মনে রাখবেনঃ- এইটা শুধুই গল্প

৫,৩৫৯ বার দেখা হয়েছে

৬৩ টি মন্তব্য : “তাই স্বপ্ন দেখব বলে…”

  1. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    যদি সিরিজ গল্প হয় তাহলে মেয়েটাকে অন্য কারো প্রেমে ফেলে দাও। তখন ছেলেটাকে অবজার্ভ করাটা interesting হবে। টপিকের বাইরে আক্তা প্রশ্ন, interesting, এই বাক্যে, উপযুক্ত অর্থ কি হবে ??

    জবাব দিন
  2. রাশেদ (৯৯-০৫)

    ০১।
    এই গল্প টা আগেই পড়ছিলাম তাও আবার পড়লাম। কিন্তু পড়ে আমার মনে যে প্রশ্ন জাগল তা হইল যে বুয়েটে কি খালি স্বাতী নামের মেয়েরা পড়ে :-B (তানভীর ভাইয়ের গল্প দ্রষ্টব্য)

    ০২।
    আগে বলা হয় নায় কিন্তু এইবার বলি তোর গল্পের হাতও ভাল :thumbup:

    ০৩।
    নিচে এইটা কে খালি গল্প বলার নিদারুন চেষ্টা খালি মনে সন্দেহ জাগায় 😉

    আফটপিকঃ দোস্ত এই দুনিয়ায় মাইয়া জাতি কখন হাত ধরল না রে 🙁 তাও মনে দুঃখ নাই কারন আমরা না পারি আমাদের দোস্ত রায়হান তো পারছে 😀


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ওই, কলেজের ট্যাগ লাগা তাড়াতাড়ি...

    লেখা ভাল হয়েছে...
    খালেক


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. রাব্বি (১৯৯৮-২০০৪)

    আচ্ছা স্বাতী, চল আমরা দুইজন দূরে কোথাও চলে যাই। কি হবে এতো পড়ালেখা করে? আমরা গাঁধা…সারাজীবন গাঁধাই থেকে যাবো। তারচেয়ে চল পাহাড়ের দিকে চলে যাই। দুই জন দুই পাহাড়ে বাসা বানাবো…সিটিসেল জুম দিয়ে দিন রাত চ্যাটাবো…মাঝে মাঝে দেখা হবে…তুই আমাকে তোর বাড়িতে দাওয়াত দিবি…আমি দিবো তোকে…

    এত জায়গা রাইখা পাহাড়ে কেন ?? :dreamy:

    জবাব দিন
  5. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    শার্লী,

    চেক কইরা দ্যাহ ত বাংলাদেশের মুসলিম/হিন্দু পারিবারিক আইনে রায়হানের কেসটা......অকালে আবার ছুডুভাইটা না আবার জেলের ঘানি টানে। 😛


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  6. আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

    আরাম করে কমেন্টাইতে পারতেসিনা; আজ ভোরে গাড়ির দরজায় বাম হাত চাপা খায়া আঙ্গুল থ্যাৎলায়-ভচকায় গেসে :(( ... তোমাদের ইউসুফ ভাই-রে ফালায় দিসি এক্সট্রা পেইন-এ 😕

    জবাব দিন
  7. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    গল্পটা আগেও পড়সিলাম...অদ্ভুত ভাল লাগসিলো...
    আর এইবার যেহেতু জাইনা পড়লাম যে এইটা আমাদের রায়হানের গল্প, তাই আরো বেশি ভালো লাগলো :boss:


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।