যার যায়, সেই বোঝে…!!!

[ কোন ক্ষোভের বশে লেখা নয়, কারো বিবেককে জাগাবার জন্যও এটি নয়…কারো মতবাদ-ধারণাকে আমূল বদলে দেবার প্রচেষ্টা তো অবশ্যই নয়…এটি গল্পচ্ছলে বলা একটি রূঢ় বাস্তবতা!! ]

মফস্বল শহর। দুপুর গড়িয়ে মাত্র বিকেল হওয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ৮/১০ জনের একদল কিশোর ক্রিকেট খেলার জন্য বের হয়ে পড়েছে। এদের সবার বয়স ১২ থেকে ১৬ এর মধ্যে। সবার সামনে যাকে দেখা যাচ্ছে বল হাতে, ওর নাম বাবলু। বল এবং ব্যাট ওর হবার কারণে সবাই ওকে দলনেতা হিসেবে দেখে…তাছাড়া ক্রিকেটও খুব ভাল খেলে। এরপর যে আছে তার নাম শামীম। ওর বাবা কাঠের ব্যবসায়ী। স্বাভাবিকভাবেই স্ট্যাম্পের মালিক সে। এই জন্য দলে ওর অবস্থানও বেশ ভাল। আর ভাল অবস্থানে থাকার মধ্যে রয়েছে সুমন, ওদের মধ্যে সবচেয়ে সুঠাম দেহের অধিকারী এবং মারামারিতেও ভীষণ পটু। এছাড়া যারা রয়েছে যেমন- রাজীব, সুমিত, ওয়াসিম, কালাম, শিপন…এরা সবাই দলের সাধারণ সদস্য। আজ সরকারী ছুটি থাকার কারণে ওরা এত তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হতে পেরেছে। অন্য দিন স্কুল থেকে ফিরে, খাওয়া-দাওয়া করে, বিশ্রাম নিয়ে বের হতে হতে বিকেল হয়ে যায়।

খেলার মাঠের আগে একটি পাকা রাস্তা পড়ে। কিশোর দলটি পাকা রাস্তার কাছাকাছি গিয়ে দেখে বেশ কিছু মানুষের ভীড়। কাছে গিয়ে জানল, কালাম চাচার মুদির দোকানে কোন এক মাইক্রোবাস ধাক্কা দিয়ে বেশ খানিকটা ভেঙ্গে ফেলেছে, দোকানের জিনিসপত্র চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। চাচা মনে হয় বাড়িতে খেতে গিয়েছিলেন, তাই ওনার কোন ক্ষতি হয় নি। কিন্তু দোকানের অবস্থা খারাপ। কিশোর দলটি ভীড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। কালাম চাচা বোধহয় এখনো খবর পান নি, তাকে কোথাও দেখা গেল না…বাবলু পায়ের কাছে লজেন্সের বয়াম পড়ে থাকতে দেখে একটা লজেন্স মুখে পুড়ে মজা দেখতে লাগল। মাইক্রোবাসটি ধাক্কা মেরেই পালিয়েছে, কেউ দেখেনি কে বা কারা ছিল তাতে…

দোকান ঘিরে যে জটলা হয়েছে, সেখানে বিভিন্ন কিসিমের মানুষে সমাগত হয়েছে। যে যার মতন কথা বলে যাচ্ছে, সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, করনীয় জানাচ্ছে…
মোল্লা পাড়ার ইঞ্জিনীয়ার চাচা, যিনি রোড্‌স এন্ড হাইওয়ে’তে কাজ করেন…তিনি বললেন,
-‘রাস্তা নির্মানে কোন ত্রুটি আছে মনে হচ্ছে। না হলে রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে গাড়ি উঠে যাবে…ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। আমি কালই অফিসে গিয়ে খোঁজ নেব, কারা এই রাস্তা তৈরি করেছে…কোন দূর্নীতি হয়েছে কিনা সেটা জানাও খুব জরুরী…’

আরেক ইঞ্জিনীয়ার চাচা যিনি কুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ে এসেছেন-তিনি বলে উঠলেন,
– ‘রাস্তার সমস্যা আর কতই বা মারাত্মক হবে! আমার মনে সমস্যা ছিল গাড়ির ইঞ্জিনে…ড্রাইভার ব্রেক ফেইল করে রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে উঠে গিয়েছিল। এসব ঝামেলার মূল কারণ গাড়ির বিভিন্ন ত্রুটিপূর্ণ পার্ট্‌স। আজকাল ইঞ্জিনসহ সবকিছুর বেশির ভাগ পার্ট্‌সই হচ্ছে নিম্ন মানের, চীনের তৈরি…’

ওনাকে থামিয়ে দিয়ে মিশুর আব্বা মোখলেস চাচা যিনি কিনা একজন উকিল বললেন,
-‘আরে মিয়া থামেন তো!! এখন কারণের চেয়ে ফলাফলের উপর আমাদের বেশি জোর দিতে হবে। এই ঘটনাটি হচ্ছে ‘হিট এন্ড রান কেস’। তবে সমস্যা হচ্ছে ভিক্টিম একটি দোকান, সাথে কোন মানুষ হলে খুব ভাল হত…সবচেয়ে ভাল হত কেউ আহত হলে…কেসটা এমন সুন্দর করে সাজানো যেত…’
ভীড়ের মধ্য থেকে সুমন ফট করে বলে উঠল,
– ‘চাচা, এখন কারো হাত ভেঙ্গে দিয়ে মামলা দিলে কেমন হয়???’
তিনি কিছুক্ষণ সুমনের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন ও ফাজলামি করল কিনা। কিন্তু সুমন তো সেই ছেলে যে উলটা পালটা প্রশ্ন করে স্কুলের কুখ্যাত ইসলামিয়াত স্যারকে নিয়মিত জ্বালায়। চোখমুখে ব্যাপক জানার আগ্রহ ফুটিয়ে তুলে ও মোখলেস চাচার দিকে তাকিয়ে রইল। উনি কি বুঝলেন কে জানে, তবে মুখে বললেন,
-‘তাইলে তো খুবই ভাল হয়!! কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে। দোকানের বেশ কিছু অংশ আছে ফুটপাথের উপরে। সেক্ষেত্র এই মামলায় জিতলেও অন্য মামলায় ফেঁসে যাবার সম্ভাবনা আছে। কারন নাগরিক অধিকার আইন, উনিশ শো…’

ছেলেরা আর কিছু শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে অন্য দিকে নজর দিলো। পিছনে এক লোককে দেখা গেল ক্যামেরা হাতে পটাপট ছবি তুলছেন। ওরা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
– ‘আপনি এত ছবি তুলছেন, কাহিনী কি???’
-‘সেটা যদি তোমরা বুঝতে তাহলে তোমাদের হাতে ব্যাট-বল থাকত না…ক্যামেরা থাকত। এইখানে ভাঙ্গা দোকান, পড়ে থাকা বা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র, লোকজনের ভীড়- সব মিলিয়ে যে ফ্রেমটা তৈরি হয়েছে, যেটা বোঝার ক্ষমতা তোমাদের নেই…সেটাকে আমি ক্যামেরায় বন্দী করে নিলাম…!!!’
বাবলু লোকটার কথা কিছু না বুঝলেও এটা বুঝল, ওর পক্ষে এত কঠিন কঠিন জিনিস বোঝা সম্ভব না…!!!

ঐ দিকে দেখা যাচ্ছে সমাজসেবী খ্যাত আনিস ভাই খুব চিল্লা-পাল্লা করছেন,
-‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি??? রাস্তার মাইক্রো দোকানের উপর উঠে আসল!!! কখনো কি দেখেছেন, ফুটপাথের কোন দোকান রাস্তায় উঠে কোন গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছে??? কেন আমাদের সমাজে এত বৈষম্য??? কবে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে???’

‘বাপরে বাপ!!! ব্যাটা এত কথা বলতে পারে’ ভাবতে ভাবতে ছেলেরা এবার মনোযোগ দিল চারুকলার ইউনুস ভাইএর দিকে। উনি রাস্তার ওপারে ইজেল বসিয়ে ছবি আঁকা শুরু করে দিয়েছেন। রাস্তা পাড় হয়ে সুমন ইউনুস ভাইএর কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
– ‘ভাইয়া, কিসের ছবি আঁক???’
– ‘অপেক্ষা!!!’
– ‘অপেক্ষা??? মানে কি? কিসের অপেক্ষা???’
– ‘ঐ যে দেখ, সবাই দাঁড়িয়ে আছে…কথা বলছে…আসলে সবাই কালাম চাচা আসার অপেক্ষা করছে। এত বড় একটা ক্ষতি দেখে উনি কি করেন, তা দেখার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। আমি সেই প্রেক্ষাপটে ছবিটা আঁকছি…’
– ‘ভাইয়া, তোমাদের মতন শিল্পী যারা, তাদের বেশিরভাগ কথাই আমি বুঝি না…কি যে তোমরা বল না!!! যাই, তুমি ছবি আঁকতে থাক…’

রাজীবের বড় ভাই সজীব আবার গান গায়, লেখে…ওকে দেখা গেল সুর করে গুনগুন করছে,
‘রাস্তার ধারের ঐ দোকানে
ধাক্কা দিল মাইক্রো বাসে
কালাম ভাই কাঁদে…
দোকান ভেঙ্গে গেছে…
ও আমার কালাম ভাই…
কালাম ভাই…কালাম ভাই…কালাম ভাই…

রাজীব ফোঁড়ন কেটে বলল,
-‘কিন্তু উনি তো তোমার চাচা হন, ভাই-ভাই করলে হবে??? আর তোমার অন্য সব গানের মতন এটাও ‘আগে কোথাও শুনেছি’ টাইপ…!!’
-‘গানের মধ্যে কোন স্বজনপ্রীতি করা যায় না…এসব তুই বুঝবি না…যা ভাগ।’

এমন সময় দেখা গেল কিছু রাজনৈতিক লোকজন চলে এসেছে। ঐ লোকটাকে ভাল করেই সবাই চেনে, গত বার জিতলেও এবার হেরে গিয়ে চুপ মেরে গেছে। ওর পরিচয় এখন বিরোধী দলের লোক। এসেই শুরু করে দিলেন,
– ‘বর্তমান সরকার কিভাবে দেশ চালাচ্ছে তার প্রমান আজকের এই ঘটনা। মানুষের কোন নিরাপত্তা নেই। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। আসুন আমরা সবাই মিলে এই অত্যাচারী সরকারকে প্রতিহত করি।’
মুরুব্বী বলে খ্যাত সোবহান দাদু এত কিছু শুনে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
-‘রুস্তম তুমি এখন যাও। পরে এসে এসব কথা বলিও। আমরা এখানে যারা আছে, তাদেরকে ঘটনাটা সামলাতে দাও…’

মুখ বেজার করে রুস্তম চলে যেতেই আনিস ভাই, সরকারী দলের পাতি নেতা বলে উঠলেন,
-‘দাদু, খুব ভাল কাজ করেছেন। সামান্য ঘটনাকে পুঁজি করে একটি বিশেষ মহল সবসময় চায় দেশকে অস্থিতিশীল করে…’
-‘আনিস, তুমিও যাও!!!’ – দাদু তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ধমকে উঠলেন।

মূল জটলা থেকে একটু দূরে একটা দলকে দেখা গেল নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাদের কথা শুনে মনে হল এই ঘটনায় তারা বরং খুশি। কারণ এদেরকে কালাম চাচা কখনো বাকিতে কোন জিনিসপত্র দিত না। কিছু মানুষ যে কত নীচ হতে পারে, এসব দেখে বাবলু অবাক হয়ে গেল…!!!

এমন সময় হঠাৎ হাউমাউ কান্না শোনা গেল। সবাই বুঝলো কালাম চাচা খবর পেয়ে চলে এসেছেন।
-‘আমার কি হবে গো??? এখন আমার সংসার চলবে কি করে??? আল্লাহ্‌ আমাকে বাঁচাও…’-এই সব শুনতেই ছেলেপেলেরা বুঝে ফেলল ঘটনার মজা যা ছিল তা শেষ। এখন আর দেখার কিছু নেই।
বাবলু সবাইকে ডেকে বলল,
-‘এই চল সবাই, এখানে থেকে আর কাজ নেই। এর চেয়ে ক্রিকেট খেলি বরং। এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে…’

ছেলেরা যেতে যেতে দেখল লোকজনের ভীড়ও অনেক পাতলা হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র তারাই আছেন, যারা কালাম চাচার শুভাকাংখী। সবাই মিলে তাকে স্বান্ত্বনা দিচ্ছেন, আশ্বাস দিচ্ছেন। আর সবার মাঝে থেকে একা কান্না করে চলেছেন কেবল কালাম চাচা…!!!

৩,১৩৮ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “যার যায়, সেই বোঝে…!!!”

  1. আশিক (১৯৯৬-২০০২)

    ভাইয়া, এতসব কিছুর মধ্যেও এই প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলাম না!!

    রাজীবের বড় ভাই সজীব আবার গান গায়, লেখে…ওকে দেখা গেল সুর করে গুনগুন করছে,
    ‘রাস্তার ধারের ঐ দোকানে
    ধাক্কা দিল মাইক্রো বাসে
    কালাম ভাই কাঁদে…
    দোকান ভেঙ্গে গেছে…
    ও আমার কালাম ভাই…
    কালাম ভাই…কালাম ভাই…কালাম ভাই…

    এরকম করে মিলাইলেন কেমনে!!!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।