ইথার সুন্দরী

ইথার সুন্দরী,
গত রাতের স্বপ্নগুলি ছিল অনেকটা স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার মতো। বেশ অনেক গুলি ছোট ছোট স্বপ্ন দেখলাম। আশ্চর্য হলাম এটা ভেবে যে কোনো স্বপ্নেই আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম না। আমার এই জীবনের পাওয়া না-পাওয়া আর চাওয়া না-চাওয়া মানুষগুলিকে ঘিরে ছিল আমার এই সিরিজ স্বপ্ন। প্রথম যে স্বপ্নটা দেখলাম তা ছিল আমার জীবনের প্রথম ভালবাসার মানবীকে নিয়ে, যাকে কখোনোই জানানো হয়নি আমার মনের কথা। দৃশ্যটা ছিল এমন যে, সে আমার সাথে সোসাল মেডিয়াতে চ্যাট করছে। জায়গাটা আমার কাছে অপরিচিত লাগছিল। হয়ত তার বর্তমানের কোন জায়গা হয়ে থাকবে। বারান্দা বা ছাদ জাতীয় একটা জায়গায় আরাম চেয়ারে সে বসে আছে। সদ্য স্নাত ভেঁজা চুলগুলো খোলা। আগের মত দীঘল চুল আর তার নেই। একটা নীল তাঁতের শাড়ী পরে তাকে বেশ প্রফুল্ল লাগছিলো। পাশের টেবিলে রাখা স্মার্ট ফোন নিয়ে লিখতে শুরু করলো:

“এইযে কবি! কেমন আছেন?”
“আমি ভাল। তুমি কেমন আছো?”
“আমিতো ভালই আছি। ঘর-সংসার, বাচ্চা, জামাই-এই নিয়ে ভালই কেঁটে যাচ্ছে। আর গত একমাস ধরে আপনার সাথে যোগাযোগ রেখে, প্রতিদিন আপনার পোস্ট-এ কবিতা পরে বেশ ভাল আছি। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?”
“করো”
“এত বছর পরে আমাকে কেন খুঁজে বের করলেন?”
“ভাবলাম মনের কথাটা তোমাকে জানাই। তোমার জানা উচিত যে তুমিই ছিলে আমার প্রথম ভালবাসা। যার ভাবনায় ভাবনায় আমি কাব্যের ছন্দ পেয়েছি, পেয়েছি গানের সুর”
“ইস্, মিথ্যুক কোথাকার!”
“আমি মিথ্যা কথা বলি না।”
“তাহলে তখন বলেন নি কেনো?”
“ভয়! যদি তুমি ফিরিয়ে দাও?”
“ইস্, ঢং! এইযে এখন এতকিছু লিখেন, তখন দু’লাইন লিখে আমাকে দেন নি কেনো?”
“তোমাকে জীবন থেকে হারাবার পরেইতো শব্দের জগতে পা রাখলাম। যাবতীয় সব প্রেমের লেখায় তোমাকে নিয়ে ভাসলাম অনন্ত আকাশে,,,,”
এর মধ্যে একটা ফোন আসলো তার। স্ক্রিনে লেখা উঠল ‘হাসবেন্ড’। সে আমাকে লিখলো:
“পরে কথা হবে,,,,,,”

স্বপ্নটা এখানেই শেষ হলো।আমার ঘুম টুটে গেলো। আমি উঠে বসে পরলাম। পাশে আমার বউ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আমি উঠে বারান্দায় চলে আসলাম। ঘড়িতে দেখলাম ১টা২১মি বাঁজে।একটা সিগারেট জ্বালালাম। চিন্তা করলাম হঠাৎ কেন আমি তাকে স্বপ্ন দেখলাম? এমনতো নয় যে হালে আমি তাকে নিয়ে ভেবেছি অথবা তাকে নিয়ে লিখেছি। গত চার মাসে আমি শুধু একজনকে নিয়েই ভেবেছি এবং তাকে নিয়েই লিখেছি। সিগারেট শেষ করে আবার বিছানায় আসলাম। চোঁখ বুঁজে ঠাঁই নিলাম বালিশের নরোম আলিঙ্গনে। পাশ বালিশ জড়িয়ে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ডুব দিলাম নিদ্রার মহাসাগরে। কতক্ষন ঘুমিয়েছি বলতে পারবো না। হঠাৎ স্বপ্নের দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো অন্য এক মানবীর প্রতিচ্ছবি। সে ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রেমিকা, যার সাথে আমার সম্পর্ক হয়েছিল, মেলামেশা হয়েছিল প্রেমিক প্রেমিকার মতন।অনেক স্মৃতি আছে তাকে নিয়ে।
মনে হলো সে ভিডিও চ্যাটে আমার সাথেই কথা বলছে। আমাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শোনা যাচ্ছে। ইউরোপের কোনো একটা শহরের কান্ট্রি সাইডের বাংলো টাইপের বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ড বাগানে বসে আছে সে। পরণে জিন্স-টি সার্ট। বাগানে অচেনা সব বিদেশী ফুল। সে বলল:
“তোমাকে এত বুড়া লাগছে কেনো? চুলে রং করতে পারো না? বউ করে দেয় না বুঝি?”
“না না। করে দেয়। কিছুদিন যাবত আমারই ভাল লাগছিলো না।তাই কালার করিনি।”
“তুমিতো নিজেকে অনেক মেন্টেইন করো মনে হয়। জিম টিম করো বুঝি?”
“তেমন কিছুনা। আমার জামাই চায় আমি ফিট ফাট থাকি। তাই আরকি”
“ওহ্”
“আমিতো অনেক দিন আগে তোমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। এতদিন পরে একসেপ্ট করলে যে। আমিতো ভেবেছিলাম আমাকে তুমি ভুলেই গেছো!”
“জীবনে প্রথম নারী, প্রথম হাত ধরাধরি, প্রথম আলিঙ্গন, প্রথম চুমো-কেউ কি ভুলতে পারে? যদি সেটা নাই পারে তাহলে তোমাকে কেমন করে ভুলে যাই?”
“জানো, আমাকে নিয়ে লেখা তোমার গানগুলি এখনো শুনি, আমার জামাইতো তোমার লেখার বিরাট ভক্ত। সে বলে যে, তোমাকে সামনে পেলে সে নাকি তোমার হাতে চুমো খাবে”
“সে, মানে তোমার জামাই কি আমাদের রিলেশনের কথা জানে?”
“না না। কিছু জানে না। শুধু জানে আমরা অনেক আগে একই মহল্লায় থাকতাম। প্রতিবেশী”
“ওহ্, ভালো।”
“আমার নাম্বারটা রেখে দাও। ভাইবারে এড করে নিও। +৪৪ ১২৩৪ ৫৬৭xxx”
এর মধ্যে পরীর মত একটা কন্যা শিশু এসে “মা মা” বলে চিৎকার করতে শুরু করলো।

আমার স্বপ্নটা ভেঙে গেলো। আমি কিছুক্ষন চুপ করে শুয়ে থাকলাম। দেয়াল ঘড়িতে দেখলাম ২টা২১মি বাঁজে। আই প্যাডটা টেনে নিয়ে চেক করলাম তুমি অনলাইন আছো কিনা? যদিও তুমি এত রাত জাগো না, তবুও অবাধ্য হিয়া বারণ মানে না। আজকে মাত্র এক মিনিট কথা হয়েছিলো। বলেছিলে কোনো একটা কারণে মন খারাপ ছিল। কিন্তু জানা হলো না কারণটা আমি কল করেছিলাম। ফোনটা বন্ধ পেয়েছি। আজকে মনটাও কেমন জানি আউলা বাউলা লাগছে। লিখতেও ইচ্ছা করছে না। আবার বারান্দায় এলাম। বুদ্ধির গোড়াতে কিছু ধোঁয়া ঢাললাম। কি জানি কি হচ্ছে, সিগারেটও ভাল লাগছে না। বেস্ট অফ ইয়ানী ছাড়লাম। ভলিউমটা কম করে দিলাম। মানে মিউজিকটা ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে শুয়ে পরলাম। চোঁখ বুঁজতেই তোমার ১০০টা ছবি স্লাইড সো হয়ে ভাসতে লাগলো বন্ধ চোঁখের পাতায়, হিয়ার দক্ষিন পাশে, মগজের বাম কিনারায়।
স্বপ্নটা শুরু হলো পূর্নিমা চাঁদ দেখে। সেখান থেকে সোজা তোমার বারান্দায়। বারান্দাটা খালি। দরজাটা খোলা। বাতাসে পর্দা উড়ছে। হঠাৎ তুমি এগিয়ে এলে। তাকালে চাঁদের দিকে। জোৎস্নায় প্লাবিত হলো উত্তরা এলাকাটা। নরোম আলোতে তোমাকে রূপকথার পরীর মত মনে হচ্ছিল।
আমি যেন ভেসে ভেসে তোমার মগজে প্রবেশ করলাম। শুনতে পেলাম তোমার আত্মকথন। বুঝতে পারলাম তুমি আমার সাথেই মনে মনে কথা বলছো। বাতাসে লুটিয়ে যাচ্ছে তোমার চুল। পায়জামা আর মেকি হাতার টি সার্ট পরে আছো তুমি। চাঁদের এই কোমল আলোতেও তোমার ডান হাতের তিলটা দেখা যাচ্ছে। গলার কাছের তিলটাও কিন্তু আবছা দেখা যাচ্ছে। তুমি বললে:

“নিছক কবি! আপনি আমাকে ইথার সুন্দরী নাম দিলেন কেন?”
“আমাদের কথোপকথন ইথার তরঙ্গে ভেসে ভেসে আসেতো তাই!”
“জানেন, আজকে আমার মনটা অনেক খারাপ। আমি ব্যাক্তিগত জীবনে খুব চুপচাপ আর গম্ভীর থাকিতো তাই আমার কোনো ভাল বন্ধু হয় না। অনেকে আবার আমাকে দেমাগী মনে করে। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন আমার মধ্যে বিন্দু মাত্র অহংকার কাজ করে না। আমি সুন্দরী এটা আমি ভালই বুঝি। এই সৌন্দর্য আল্লাহর দেয়া। এটা নিয়ে আমি কেন অহংকার করবো বলুন।”
“আমার কাছেতো তোমাকে সেরকম মনে হয়নি। খুব শান্ত একটা মানুষ মনে হয়েছে। আমার প্রথম প্রেমিকার সাথে তোমার অনেক মিল আছে। কিন্তু সেকারণে নয়, তোমার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য আমাকে পুলকিত করেছে। সাইবার জগতের সবচাইতে প্রয়োজনীয় মানুষটি হলে তুমি। তোমার প্রোফাইল থেকে সব ছবি নামিয়ে ফেললাম আমি। দেখতে শুরু করলাম নতুন এক পৃথিবীকে।”
“জানেন, আমাকে নিয়ে লেখাগুলি আমি মন দিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে বিশ্বাস হতে চায় না যে এগুলো কেউ আমাকে নিয়ে লিখতে পারে!”
“গত চারমাসে আমি যতগুলি প্রেমের কবিতা লিখেছি, সারা জীবনেও এত প্রেমের লেখা লিখিনি”
“আচ্ছা, আপনি এত সুন্দর করে লেখেন কি করে?”
“জানি না তো”
বাতাসে তোমার চুল এসে পরলো মুখের ওপর। তুমি ডান হাত দিয়ে চুল সরানোর কাজটি করলে। আমার চোঁখটা আঁটকে গেলো হলুদ রং-এর তোমার নেইল পলিশের উপর। মনে হলো তোমার দশটি আঙুল থেকে দশটা প্রজাপতি বের হলো। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়তে শুরু করলো। তোমার দুনিয়া থেকে নিমেষেই আমাকে নিয়ে এলো অন্য জগতে। সেখানে একটা মোমবাতি জ্বলছিলো। চারিপাশে কিছুই ছিল না। শুধু উড়ে বেরাচ্ছিল দশটি হলুদ প্রজাপতি। জীবনে অনেক বার অনেক রঙের প্রেমে পরেছি। কিন্তু হলুদ যে এত সুন্দর হতে পারে কখোনো কল্পনাও করিনি।

স্বপ্নটা শেষ হবার পর মনে হল যে ওটা বাস্তব ছিল না। ওটা ছিল একটা অলীক স্বপন। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় ৪টা বাঁজে। পাশের বাসার বাগান থেকে হাস্না হেনার ঘ্রান আসছে। এসি ছাড়ার মতো গরম এখোনো পরেনি, তাই জানালা খোলা। আমি বিছানা ছাড়লাম। ফ্রিজ থেকে ভীষন ঠান্ডা পানি পান করলাম। সিগারেট নিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। সিগারেটটা মাত্র জ্বালালাম, ওমনি কোত্থেকে একটা হলুদ প্রজাপতি বারান্দার গ্রীলে এসে বসল। স্থির হয়ে বসে রইল। মনে হল প্রজাপতির পাখনায় চেঁপে তোমার অলিন্দ আমার কাছে এসেছে। কানে কানে বলছে:
“আচ্ছা, আমি বিশ বছর আগে জন্মালে আর আপনার সাথে সম্ভাব্য জীবনে জড়ালে কি এমন ক্ষতি হতো। আমি জানি আপনাকে পাওয়া যাবে না, চাওয়াটাই বুঝি অন্যায়। আপনি কি বলতে পারেন এই অসম্ভব কাজটি করতে আমার কেন প্রায়ই ইচ্ছে করে। আপনার সাথে আমার জীবন চক্রটা এমন ভাবে মেলাতে ইচ্ছে করে যে খুব সহজেই আমরা আমাদের খুঁজে নিতাম ভালবাসার আচ্ছাদনে। প্রেমের মূর্ছনায় ভরে উঠতো লোকালয়। দু’জনে দু’জনার হাত ধরাধরি করে হাটতাম অজানা গন্তব্যের পথে। আচ্ছা বলেন তো, মানুষ কেন ভুল মানুষের প্রেমে পরে যায়? “

চিঠিটা একটু বড় হয়ে গেলো মনে হচ্ছে। আমার ইথার সুন্দরীকেতো আর হিসেব করে লেখা যায় না! আমারতো মনে হয়, লেখা এখোনো বাকী আছে। আমার এই নির্ঘুম রাতের একাকিত্বের কথা এখোনোতো কিছুই বলা হলো না। থাক, আজকে আর কিছু লিখবো না। তোমার মনের দেশে সুখের বৃষ্টি নামুক। তোমার আনন্দ নদীর মোহনায় ভাললাগার জোয়ার আসুক অহ:দিন অহ:রাত। তোমার মগজের নিউরণে নিউরণে দারুন ভাবে থাকুক আমার গীতি কবিতা।

বাপ্পী খান
রাত ২টা ১০মিনিট
১১/০৩/২০১৮ইং
কাজী অফিস লেন।
মগবাজার, ঢাকা।

৫,৭৬০ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।