একটি ফলস বার্থডের ইতিহাস

তখন আমরা ক্লাস এইটে পড়ি।বাইরে থেকে দেখতে সবাইকে নিরীহ মনে হলেও আসলে একেকটা ছিলো ভয়াবহ বিচ্ছু। তৌফিক যেমন প্রতিদিন তার প্লেটের সবজি পাশের সিটের সিদ্দিক ভাইয়ের প্লেটে রেখে নিতান্ত ভালো মানুষের মত দাড়িয়ে থাকতো,কিশোর তেমনি ভাইয়াদের টিজ করে ধরা খেয়ে এমন ভাব করে চোখ বড় বড় করে তাকাতো, “আমি?!!!! এ কিভাবে সম্ভব?!!”

সেরকমই এক সময়ে আমি আর তন্ময় ছিলাম টেবিলমেট। তন্ময় ছিল ভয়াবহ টাইপের চালু পিস।(এখনো আছে) । তো আমার আর তন্ময়ের প্রধান কাজ ছিল আমাদের টেবিলের ক্লাস সেভেনের ফারহান আর শাহাদাত এর ফল্ট খুজে বের করা আর পানিশমেন্ট দেয়া। ওইসময় কেন জানি ফারহানকে দেখলেই আমার পানিশমেন্ট দিতে ইচ্ছা করত। তার প্রধান কারণ ছিল আমাদের দুই জনকে পাশাপাশি দেখলে সবাই আমাকে ক্লাস সেভেন ভাবত আর ওকে ভাবত ক্লাস এইট। সে যে আমার জুনিয়র আর আমি যে তার বস এই কথাটা ভালভাবে তার মাথার মধ্যে গাথার জন্যই আমার ছিল এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

পানিশমেন্ট দেয়ার ক্ষেত্রে আমার আর তন্ময়ের কম্বিনেশন ছিল দারুন।সে তার উদ্ভাবনী প্রতিভার দ্বারা প্রতিদিন নিত্য নতুন পানিশমেন্ট আবিস্কার করতো ।আর মাছের চামড়া খাইতে না পারা সহ এরকম আরও ভয়াবহ অপরাধের শাস্তি স্বরূপ আমরা এগুলা প্রয়োগ করতাম।

ভালোই ছিলো আমাদের জুটি। কিন্তু বাগড়া বাধল আরেক জায়গায়। পুডিং আমার আর তন্ময় দুই জনেরই প্রিয় খাবার। তাই প্রতি শুক্রবার স্পেশাল ডিনারের সময় আশেপাশের টেবিলের আমাদের ক্লাসমেটদের কাছ থেকে পুডিং নিয়ে আসতাম। দুই তিনটা করে পিস খাওয়ার পরও আমার পেট ভরতো না। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাতাম টেবিলের অপর পাশে যেখানে তন্ময়ের প্লেট। তো কোন এক শুক্রবারে আমি তন্ময়ের দুই তিনটা পুডিং গপগপ করে খেয়ে ফেল্লাম।তন্ময় রাগে গজ গজ করতে বলল পরের শুক্রবারে সে আমারে একটা চরম বাঁশ দিবে। সো আমিও বিজয়ীর হাসি দিয়ে পুডিঙয়ের ঢেকুর তুলতে তুলতে ওর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। কিন্তু সে যে এত বড় বাটপার আমি তখনো বুঝতে পারি নাই।

পরের শুক্রবারে ডাইনিং হলে কোন কারণে একটু লেট করে ঢুকছিলাম। আমার টেবিলে গিয়ে আমার চোখ তখন রীতিমত ফুটবল।টেবিলে সারি সারি করে সাজানো পুডিং ।বাইশ তেইশ টা হবে। তন্ময় বদমাইশটা ষড়যন্ত্র করে আমাদের অনেকগুলা ক্লাসমেটদের কাছ থেকে পুডিং সংগ্রহ করে আমার সামনে রাখছে। কি করবো সেটা চিন্তা করার আগেই যমদূতের মত ডাইনিং এ ঢুকলেন আমাদের তৎকালীন জুনিয়র প্রিফেক্ট নীহার ভাই। আর আমি তখন ছিলাম উনারই টেবিলে । তার গরম দৃষ্টি আমার ওপর পরতেই কোনমতে বললাম, “ভাই আজ আমার জন্মদিন, তাই ফ্রেন্ডরা এগুলা দিছে”।ভাইয়া শুধু শান্ত সৌম্য কণ্ঠে একটা কথাই বললেন, “মনজুর, হাউসে গিয়ে দেখা করবা”।

আমার তখন ভয়ে জান যায় যায় অবস্থা। কারণ নীহার ভাইয়ের চড় ছিল তখন জগতবিখ্যাত। মনে মনে একরাশ মিথ্যা অজুহাত তৈরি করে উনার রুমের সামনে দাঁড়ালাম। উনি বললেন, “একটু দাড়াও”
পাঁচ মিনিট হয়ে যায় উনি আর বের হন না। মনে মনে চিন্তা করি উনি কি নিয়ে বের হবেন? হ্যাঙ্গার স্টিক? নাকি বেল্ট? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি একটা বই নিয়ে বের হলেন। বললেন। “এইটা নিয়ে রুমে যাও”।

আমি কোন ধন্যবাদ না দিয়েই রুমে চলে আসি, বইটা ছিল “নিউরনের অনুরনন” জাফর ইকবালের লেখা । বইয়ের ভেতরের প্রথম পাতায় সুন্দর করে লেখা, “মঞ্জুর,তুমি খুব ভালো ছেলে,আই লাইক ইউ, হ্যাপি বার্থডে”। লেখাটা দেখে কেমন কেমন যেন লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন ভাইয়ার সাথে একটা প্রতারণা করলাম।একবার ভাবলাম ভাইয়াকে আসল ঘটনাটা বলে দেই। কিন্তু তখন সে সাহস হয় নাই। গত নয় বছরে একবারও ভাইয়াকে এই ঘটনা বলতে পারি নাই।

নীহার ভাই,থাঙ্ক ইউ ফর দ্যাট গিফট অ্যান্ড আই আম সরি, আশা করি বিষয়টা আপনি বুঝতে পারছেন। তবে তন্ময় ফাজিলটা এই ঘটনায় খুব মজা নিয়েছিল। রসিয়ে রসিয়ে সবাইকে বলছিল এই কাহিনি। সেই বছর তাই আমার আসল জন্মদিনটা গোপনে পালন করছিলাম। এখনো সেই সময়গুলোর কথা মনে পরলে নিজের অজান্তে হেসে উঠি
::salute::

৩,৭৩৩ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “একটি ফলস বার্থডের ইতিহাস”

  1. তপু (৯৯-০৫/ককক)

    স্পেশাল ডিনার শুকরোবার কেনো?আম্রা ত ব্রিহস্পতিবার এ পাইতাম ।জাই হক দিনিং হল এর কথা মনে পরে গেল। এখন আমি অনেক ভাল ভাল রেস্তরাএ খাই কিন্তু আজ অ জিভে লেগে আছে স্পেশাল ডিনার। এটার সাদ তুলনাহিন।।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাকলায়েন (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।