আমার লেখালেখির অভ্যাস কোনদিনই ছিলনা। কিন্তু সেদিন কামরুল ভাই এর লেখা পড়ে অনেকটা দায়িত্ববোধ থেকেই লিখতে বসলাম। শুরুতে কামরুল ভাই কে লেখাটা দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি এখন আমাদের ব্যাচের প্রথম ব্যক্তি হিসাবে ব্লগে যোগ দিয়ে লেখাটা ব্যাচের সবার পক্ষ থেকে ওদের দুজনের জন্য উৎসর্গ করছি। হ্যা,আমি রেজা ইকবালের ব্যাচেরই একজন। অনেকেই আমাকে চিনবেন দুই জমজ ভাই এর একজন হিসাবে। এখানে আমি রেজা ইকবালের এক বন্ধু হিসাবেই লিখছি।
9/11 যেমন আমেরিকার ইতিহাসে স্মরনীয় একটা দিন হয়ে থাকবে তেমনি ক্যাডেট কলেজের ইতিহাসে 11/11 ও সেরকম একটি দিন হয়ে থাকবে। দিনটি ছিল শনিবার। ঠিক এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ আগের শনিবার ভোরে এথলেটিকস মাঠে প্র্যাকটিস এর সময় সুরমা হাউসের স্টাফকে দিয়ে ক্লাস সেভেন এর ক্যাডেটদের দিয়ে রোলার টানানো শুরু হয়। আমি সেদিন অসুস্থ থাকায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমার ভাই সহ ক্লাসমেটরা কিভাবে পাঁচ টন রোলার নিয়ে পুরো ৫০০ মিটার দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এরপর ঐ দিনই জ্বর নিয়ে আমি হাসপাতালে এডমিট হয়ে গেলাম। ক্লাস সেভেনে পড়ি। স্বভাবতই মন খারাপ হল এই ভেবে যে হাসপাতালে একা থাকতে হবে। তারপর আবার সাব্বিরও হাউসে থাকবে। কিন্তু হাসপাতালে কাপড় নিয়ে এসেই দেখি সেভেন এর একজন আগে থেকেই আছে।সে হচ্ছে রেজা!! তখন আমার খুশি আর দেখে কে। আমি আরো খুশি হলাম সে আমার ভাইএর রুমমেট শুনে। যাইহোক সেই থেকে রেজার সাথে আমার সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছিল। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। আমরা একসাথে পড়তাম আর সকালে একসাথে একাডেমিক ভবনে পরীক্ষা দিতে যেতাম। আর পরীক্ষা দিয়ে এসে ও বলতোঃআমার পরীক্ষাটা আজ চরম হইছে। পরে জানতে পেরেছিলাম ও দুইটা পরীক্ষা না দিয়েও মাত্র .৫ এর জন্য চতুর্থ হয়েছিল।
হাসপাতালে থাকায় বড়ভাইদের কাছে এরকম শুনেছি স্যাররা নাকি এই রোলার টানার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। আমাদের ব্যাচ এর কয়েকজন ক্যাম্পাসের ছেলে হওয়ায় স্যারদের কথা ঘুরিয়ে নেয়া হল। যে কারণে এই অমানবিক কাজ বন্ধ হয়নি। দেখতে দেখতে শুক্রবার এসে গেল। রেজা পুরোপুরি সুস্থ না হলেও হঠাৎ করেই ওকে ডিসচার্জ করে দেয়া হল। আমি একা হয়ে গেলাম। পরদিন শনিবার ছিল সমাজ পরীক্ষা। আমার প্রস্তুতি তত ভাল না নিয়েই শুয়ে পড়লাম। আমাদের হাসপাতালটা ছিল এথলেটিক্স মাঠের এককোণায় যার পাশের রাস্তা দিয়ে মাঠে যেতে হয়। ভোরেই ঘুম ভাঙ্গলো ডাকাডাকির শব্দ শুনে। আমি তাড়াতাড়ি বাইরে গেলাম। দেখি টুয়েলভ এর রুশো ভাই একজনকে কোলে করে নিয়ে হাসপাতালের দিকে দৌড়াচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি তখন আমাদের কলেজে কোন এম্বুলেন্স ছিলনা। অক্সিজেন এর অবস্থাও করুণ। তাই বাধ্য হয়ে পিকআপ আনা হল। পেছনে রেজাকে শুয়ে রাখা হয়েছে যেখানে আমরা পা দিয়ে সীটে বসি। আমি হাসপাতালের করিডোর থেকে শুধু রেজার রক্তমাখা পা দেখতে পাচ্ছিলাম।আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিলনা যে এই রেজার সাথেই আগের দিন হাসপাতালে ছিলাম। মৃত্যু তাকে এভাবে পরের দিনই টেনে নিয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। রেজা নিজেও কি ভেবেছিল?
রেজার সাথে আরেকজনও রোলারের নিচে পড়েছে। তখনো আমি জানিনা সেটা কে। আমার ভাই সাব্বির এর কথা মনে পড়লো।শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হলাম সেটা সাব্বির নয়,ওর পাশের রুমের ইকবাল। ইকবালের সাথে আমার একটা কথোপকথনের কথা এখনো মনে পড়ে। আমি একবার তিতুমীর হাউসে ওর রুমে গিয়েছিলাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল ও যদি আমার ফলোয়ার কে পানিশমেন্ট দেয় তাহলে আমি রাগ করবো কীনা। আমি জবাবে না বলেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও আর আমার ফলোয়ার পেলনা। তার আগেই পানিশমেন্ট এর হাত থেকে আমার ফলোয়ারকে নিশ্চিন্ত রেখে চিরবিদায় নিল।
ঘটনাটা ঘটবার সময় সাব্বির ছিল দড়ির সামনের ভাগে। ঐদিন পরীক্ষার জন্য ওরা বলেছিল যে আজ টানবেনা। কিন্তু স্টাফ এক চক্কর দেবার পরেই ছেড়ে দেবার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এরপর সবাই হই হই করে রোলার টানতে লাগলো। হঠাৎ দড়ির পেছন থেকে আওয়াজ আসলোঃ দাঁড়া,দাঁড়া। কিন্তু যখন দাঁড় করানো হল ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। গতির কারণে রোলার রেজার বুকের ওপর দিয়ে পার হয়ে ইকবালের বুক হয়ে মাথায় উঠে গিয়েছে। সাব্বির পরে আমাকে বলেছিল সে সামনে থেকেও ও সেই শব্দ শুনেছে। তারপর দুজনকেই সিলেট সি এম এইচ এ নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলোনা। যে দুজন গেল তাদের কেউই আর ফিরে আসলোনা। রেজার বাবা মা সকালেই চলে এসেছিলেন তাদের ছেলেকে দেখার জন্য। কিন্তু ইকবালের বাড়ি কিশোরগঞ্জ থাকায় তাদেরকে খবর দেয়া হল ইকবাল অসুস্থ এই বলে। আন্টি ইকবালের জন্য পিঠা নিয়ে রাতে কলেজে এসে পৌঁছান। তখন আরেক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে।
যাহোক পরদিন রাতেই আব্বু কলেজে এসে আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে গেল। বাসায় যাবার পর মা আমাদের দুইজনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়। আমি অবাক হলাম এই ভেবে তার তো দুই ছেলেই বেঁচে আছে। আমার তখনো সেই বোধ আসেনি যে আমাদের দুইজনকে ক্যাডেট কলেজে দিয়ে তিনি একান্ন জনেরই মা হয়ে গিয়েছেন। এখনো যখন বছর পেরিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় ঐ দিন আসে আমার মা সেই দিনটার মতই অশ্রুসিক্ত হন। একই ভাবে ছেলে হারিয়ে রেজা ইকবালের বাবা মা ও আমাদের মাঝে ওদেরকে খোঁজেন। কিন্তু নানা ব্যস্ততায় খুব কম সময়ই আমরা তাদের কথা সেভাবে ভেবে দেখি। তাই সিলেটে আমার ২৪তম ব্যাচের সকল ক্লাসমেটদের প্রতি অনুরোধ সময় করে তারা যেন রেজা ইকবালের বাবা মা কে মাঝে মাঝে দেখে আসে। যারা চলে গিয়েছে তারা আর ফিরবেনা। কিন্তু চলে যাওয়া মানুষ দুজনের স্মৃতি হাঁতড়ে যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের জন্য এতটুকু করা আমাদের সবারই দায়িত্ববোধ এর মধ্যে পড়ে।
দোয়া করি রেজা ইকবালের বাবা মাকে আল্লাহ ধৈর্য দান করুন। মাসুম হিসেবে তাদেরকেও জান্নাত দিক।
প্রিয় রেজা, ইকবাল,
আমাদের ছেড়ে অনেক উপরে না ফেরার দেশে তোরা দুজন চলে গেলেও নিচে থাকা আমরা তোদের ভুলিনি। ভুলবোওনা। দোস্ত, তোরা ভাল থাকিস… অনেক ভাল।
আবারো কাঁদলাম।
মর্মস্পর্শী লেখা...
আহারে....
"যারা চলে গিয়েছে তারা আর ফিরবেনা।কিন্তু চলে যাওয়া মানুষ দুজনের স্মৃতি হাঁতড়ে যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের জন্য এতটুকু করা আমাদের সবারই দায়িত্ববোধ এর মধ্যে পড়ে।"
সহমত। একই আহ্বান আমার কলেজের ক্যাডেটদের প্রতিও।
কিছু জানতাম না। কামরুল ভাই আর সামিরের ব্লগগুলো পড়ে স্তব্ধ হতে হল। মন ভেঙে যায় এসব শুনে।
আমাদের যা করার আছে তার মধ্যে প্রধানই হল, যারা চলে গেছে তাদের বাবা-মা'র খোঁজ-খবর নেয়া। অথচ অধিকাংশ সময়ই তা করা হয়ে উঠে না।
আসলে বাস্তব আরো ভয়াবহ, মর্মান্তিক। ঐ দিন এমন কেও ছিলোনা যে কঁদেনি। আজ আমি আমার মাকে বললাম আমি কডেটদের একটা ব্লগে রেজা, ইকবাল সম্পর্কে লেখা দিয়েছি। এই কথা শুনেই কান্না শুরু হয়ে গেছে বলে আর কিছু বলতে পারিনি। সবার মাঝে এখনো যেন ঐ দিনটি জীবন্ত হয়ে আছে।
ঘটনাটা আগে শুনেসিলাম তৈহিদ এর কাছে। ও তখন কলেজ প্রিফেক্ট ছিল। আরেকবার পরে আবারো কাদলাম
এই লেখা পড়ে কান্না আটকানো আসলেই দুরূহ । আপন সব কিছু ছেড়ে ক্যাডেট কলেজে পড়তে এসে এমন পরিণতি যেন আর কারো না হয়। রেজা আর ইকবালের রূহের মাগফেরাত কামনা করি...
আল্লাহ ওদের বেহেশ্ত ণসিব করূণ
আহারে আন্টি আবার পিঠা বানায় নিয়ে গেছলো! গিয়ে ছেলের লাশ দেখছেন! ...কি বলবো! খুব মন খারাপ হয়ে গেলো। তখন আমরা টুয়েল্ভে। যায় যায় দিনে এ নিয়ে একটা বিস্তারিত লেখা বের হইছিলো তখন। আমরা সব ক্লাসমেটরা এক ডর্মে জড়ো হয়ে ফীচার টা পরছিলাম। আমাদের মধ্যে একজন জোড়ে জোড়ে রিডিং পড়ছিলো। আর আমরা সব চুপ হয়ে শুনতেছিলাম। সবাই কাঁদতেছিলাম। খুব কান্না পাচ্ছিলো আবার সেই সাথে সিলেটের স্টাফ, কলেজ অথোরিটি সবার উপর আমাদের ভীষণ রাগ লাগতেছিলো। রেজা ইকবালের মা বাবা'র এই শূন্যতা বোধহয় আমরা কেউ কখনো ঠিক বুঝবোনা...
রেজা ইকবাল তোমরা ভাল আছো তো? তোমাদের কথা খুব মনে পড়ে ভাইয়া....
@সামিরঃ ধন্যবাদ এই লেখাটা লেখার জন্য!
priyo 24th batch er cadet ra..
reza-iqbal er kothata amader abar mone koriye dey ek jon cadet er ma ekjon na.. amra kotota bhaggoban, amader 51 jon MA. pls bhaiyara, tomra ektu koshto kore hole o at least 2/1 jon parle 2/3 mashe ekbar oder Ma-Babar shathe shomoy katiye esho. i know in reality its very tuf but tarporo..chesta korte dosh ki.Allah oder k behest nosib koruk, Ameen
vaia amra shob somoy chesta kori onader sathe jogajog rokkha korar. onader shunnota amra hoyto ba kokhonoi puron korte parbo na. tarporo amra chesta kori. 11th november amader onekei borisal giyechilo rezar kobor jiyarat korar jonno. oder baba ma amaderi baba ma.
sottikar orthei kanna ami atkate parlam na. thanks to Kamrul and Samir to write in memory of Reza and Iqbal.
আজকে প্রথম আলোর ১৩ পৃষ্ঠায় এই নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়লাম...তখনও পানি আটকাতে পারিনি, এই লেখা পড়েও পারলামনা...সেই সাথে বারবার আমাদের পলেনের কথা মনে পরে যাছ্ছিলো! আমাদের ব্যাচের মত দূর্ভাগ্য যাতে আর কোনো ব্যাচের সাথে না হয়! আল্লাহ ওদের সবাইকে শান্তি দিক।
এর চেয়ে sad ঘটনা আর হতে পারে না। দোষীদের শাস্তি আমরা দিতে পারি নাই। সত্যি আমাদের দায় শেষ হয় নাই।
শাস্তি??? x-( পলেন আপুর টার শাস্তি ওতো হয়নাই x-(
পলেনের ঘটনার জন্য কেউ দায়ী না...ওটা suicide case ছিল।
কাঁদলাম।
আল্লাহ ওদের বেহেসত নসিব করুন। আর মনে করতে চাইনা ওই ঘটনা। আর কখনো যেন কোন কলেজে এরকমের কোন ঘটনা না ঘটে এই প্রার্থনা করি।
যতোবার পড়ি এই ঘটনা তত বার চোখে পানি চলে আসে।
আপনাদের ব্যাচ এই আমার আম্মুর ফ্রেন্ড এর ছেলে পড়তো,রায়হান।বাসায় আসার পর ভাইয়া কে দেখেছি কেমন পাগল এর মত হয়ে গিয়েছিল।সেই ভয়ঙ্কর দিন টার কথা মনে করতেই উনি কেমন হয়ে যেতেন।
ghotonata jani....onekbar poresi...protibarer moto abaro kanna thamate pari ni....Iqbal Reza masum hisebe Jannate jabe ei duaa kori...kosto hoe beche thaka oder baba mar jonno...ki nie beche asen unara...Allah unader shok k shokti te porinoto korir toufik din..Ameen...
আগে কখনো ঘটনাটার এত স্পষ্ট বিবরণ পাইনি. কিন্তু কামরুল ভাই আর সামিরের ব্লগ দেখে ঘটনাটি আমার কাছে স্পষ্ট হযে উঠলো . সংবাদপত্রে এবং টিভিতে অনেক দুর্ঘটনার খবর পড়েছি ও দেখেছি. কিন্তু এত মর্মান্তিক এত ভয়ংকর ঘটনার খবর কখনো পড়িনি এবং দেখিনি. আমাদের ভাই দুটো এত অল্প বয়সে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল. তাও এত মর্মান্তিক ভাবে. মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ওদের কবরকে শান্তিতে ভরে দিন এবং ওদেরকে জান্নাতে দাখিল করুন. এবং ancle , aunti কে আল্লাহ সুব্হানাল্লাহু তা'আলা সবর করার তাওফিক দান করুন.
জানি সত্য নয়,শুধু কল্পনায়...ইচ্ছের ঘুড়ি আমরা ওড়াই...স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তারি অপেক্ষায়
সামির ভাই, ঐ ঘটনা related সব পোস্টের address দিলে সবকটাই পড়তে পারতাম। আপনার লেখা পইড়া মন খুব খারাপ হইয়া গেল।
Saleh
vaiya shotti kore ghotona ta details description koren je kivabe tader mrittu hotecilo?tader baba ma ke kivabe khobor deya hoyecilo?kivabe shantona deya hoyecilo tader baba make?