খুব সাধারণ পরিবারে অসাধারণভাবে জন্ম আমার। সাধারণ বলার কারণ আমার বাবা মফস্বল শহরের সরকারী ব্যাংকের একজন কেরানী। নাম মোহাম্মদ করিম। তিন নম্বর সন্তান হওয়ার সময় উনার স্ত্রী শেলী প্রায় মরনাপন্ন হয়ে পড়েন। ভাগ্যিস ঢাকা শহরে করিম সাহেবের একজন স্বচ্ছল আত্মীয় থাকতেন। সেই আত্মীয় আবার খানিকটা হোমড়া-চোমড়া ধরনের। শেলীকে উনি দ্রুত হলিফ্যামেলি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন।
অথবা একটি ঢিশুম ঢিশুম উপন্যাস (যারা প্রেম পছন্দ করে না তাদের জন্য)
পর্ব – একদম গোড়া থেকে
এক
সেই কবে ছোট্টবেলায় পড়েছিলাম সিন্ধাবাদের রোমাঞ্ছকর ভ্রমনের কাহিনী। এর মধ্যে চলে গেছে চল্লিশ বছর। আজকাল সিন্ধাবাদের কথা প্রায়ই মনে হয়। মনে হয় তার কাঁধে ভর করে থাকা সেই বুড়োর কথা। হয়তো কমবেশি সবাই অদৃশ্য এক বুড়ো কাঁধে নিয়ে এক একটা জীবন পার করে দেয়।
পর্ব – ২
হাকিম চত্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ১৯৮৬
রোকেয়া হল থেকে বেড়িয়ে একটু হাটলেই হাকিম চত্বর। দুপুরের পর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনায় এ জায়গাটা কোলাহলমুখর হয়ে উঠে। সকালের দিকটায় কিছুটা নিরিবিলি থাকে। দেশের রাজনীতির সাথে সাথে এই বছর গ্রীষ্মও খুব উতপ্ত। তবে সকালের রোদটায় তেতে উঠতে কিছুটা সময় নেয়। চারপাশে একটু মিষ্টি মিষ্টি আমেজ ছড়িয়ে আছে। বসে আছি প্রকাণ্ড কড়াই গাছটার নিচে।
জুনের প্রথম সপ্তাহেই একদম চাঁদি ফাটা গরম। চারপাশের পাহাড়ের সবুজ ঘাস জ্বলে শুকনো খড়ের মতো হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পরে পাহাড়গুলোর গায়ে একটুও সবুজ থাকবে না। খোলস বদলে হয়ে যাবে মেটে। ক্যালিফোর্নিয়াতে ম্যাপল গাছ আর পাহাড় এই দুটোর দিকে তাকিয়ে সাথে সাথেই বলে দেওয়া যায় এখন কী ঋতু চলছে। এ দেশে শীতকাল আর বর্ষাকাল একসাথে মিশে গেছে।
ইচ্ছে হচ্ছে জিজ্ঞেস করি, “কেমন আছ অনন্যা?” কিন্তু করলাম না। সেই দেখি উলটো জিজ্ঞেস করে বসলো। আমি খুব অবাক হলাম। কারণ এই অতি সাধারণ কৌতূহলী প্রশ্নটাকে সে কখনোই পছন্দ করত না। এখন সে নিজেই সে প্রশ্ন করে। কত বদলে গেছে সে! কোথায় যেন পড়েছিলাম, “মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেচে থাকলে বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়”।
[গল্পটা ক্যাডেট কলেজে থাকতে লেখা। তখন দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠেছি মাত্র। কলেজ বাংলা সাময়িকীতে প্রকাশও হয়েছিল। তবে সিসিবিতে দেবার সময় শুধু গল্পের মূল দুটো চরিত্রের নাম পালটে দিয়েছি। কারণ দ্বিতীয়বারের মত আর ঝাড়ি খেতে চাই না। ]
আরো একটি দিন শুরু হল আমার। সেই ছকবাঁধা গদবাঁধা জীবন।আর ভাল লাগে না এসব। কার ভাললাগে এই কোলাহলময় পৃথিবীতে চুপচাপ-নিঃশব্দ হয়ে পরে থাকতে, অন্যের করূণা হয়ে বেঁচে থাকতে।
লঞ্চ থেকে নামার সময় দেখি পুনম ঘুমাচ্ছে।ডেকে তুলে দিলাম।
ট্র্যাভেল এজেন্সির মাইক্রোতে করে আমাদেরকে আবার নিয়ে যাবার কথা। তাই করল তারা।আবার কলাতলি ফিরে এলাম। বাসের টিকেট করলাম। এবার দশটা টিকেট। বাস রাত সোয়া দশটায়।
আমরা খেয়ে নিলাম বৈশাখী রেস্টুরেন্টে। লিয়া আর পুনম ওয়েটিং রুমে বসল। আমরা বাইরে ঘুরতে বের হলাম।
সাড়ে সাতটার মত বাজে। এখনো অনেক সময় বাকি আছে। সবাই ভাবছি কি করা যায়।
খুব সকাল বেলা সবার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমার আরো ঘুমের দরকার ছিল। পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। না, ঘুম ধরে না আর। এত সোরগোলের মাঝে কি আর ঘুমানো যায় শান্তি মত!
সবার কথা হল- সূর্যডোবা দেখতে পারি নাই তো কি হয়েছে, সূর্যোদয় দেখবে। আমি বললাম যে আমি দেখব না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমাকে যেতেই হবে তাদের সাথে।
“আমি যাব” বলে বালিশ মাথার উপর দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি।
অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্র স্নান করে আমরা ফিরে আসি আমাদের রুমে।গোসল সেরে রেডী হই সবাই।উদ্দেশ্য দুপুরের খাবার,তারপর যাব হিমছড়ি।
বৈশাখী রেস্তোরায় ব্যাপক একটা খাওয়া দিলাম সবাই।রুপচাদা আর ভাত।জোশ খাবার।সবাই গলা পর্যন্ত খেলাম মনে হয়।তারপর সেখানে চা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম।এই সুযোগে আমি পুনমের কথা তুললাম।বললাম যে সে যা বলেছে তা সত্য।
তাতেও কোন কাজ হল না।কেউ তাকে রাখতে রাজি হল না।আমি আর কোন কথা বলতে চাইলাম না।চুপ মেরে গেলাম।
ছোট্ট একটা মফস্বল শহর।১৯৬৫ সাল।পূর্ব পাকিস্তানের নরসিংদী এলাকার শ্রীনগর।এলাকার মাঝামাঝি স্থানে পাশাপাশি দুটি বাড়ী।তার একটা জলিল সাহেবের অন্যটা রনজিত সাহার।ধর্মে ভিন্ন হলেও তাদের অন্যান্য কিছুতে তারা ভিন্ন নয়।দুজন একই অফিসে চাকরী করেন।গত আট বছর ধরে তারা পাশাপাশি বসবাস করে আসছেন।দু’ পরিবারে বেশ ভাব।যে কোন অনুষ্ঠান কিংবা পারিবারিক কাজে সবাই যেন পরস্পরের জন্য নিবেদিত প্রান।জলিল সাহেবের পরিবারে আছে তার স্ত্রী সহ দুই ছেলে।জলিল সাহেবের দুই ছেলের মাঝে একজন আমার বড় ভাই ফারুক অন্যজন আমি।রনজিত সাহার দুই মেয়ে,জয়িতা আর সুনন্দা।জয়িতার বিয়ে হয়েছে কলকাতার এক ব্যবসায়ীর সাথে।সুনন্দা আমার সাথে কলেজে পড়ে।সুনন্দাকে আমি সুনু বলেই ডাকি।অন্যান্য মেয়েদের চাইতে সুনু একটু আলাদা।তার মাঝে একটা অন্যরকম ভাব আছে যা অন্যদের মাঝে নেই।সুনুর সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিক হল সে হাসলে গালে টোল পড়ে।ওর মায়াভরা মুখটা আমার সবচেয়ে আপন লাগে।হাসির মধ্যে একটা শিশুসুলভ ভাব রয়েছে।যদিও ছোটবেলায় ও বেশ মোটা ছিল কিন্তু ও যেন দিনদিন আমার কাছে আলাদা রকম আকর্ষনীয় হয়ে উঠছে।জানিনা আমার আকর্ষন বোধটা অন্য মেয়েদের চেয়ে ওর প্রতি এতটা বেশী কেন।হয়তোবা ওর সেই অন্যরকম বৈশিষ্ট্যের জন্যই।আমরা আলাদা ধর্মের হলেও কখনও সুনু কিংবা আমি পরস্পরকে আলাদা ভাবিনি।মোটকথা সুনন্দাকে আমার বেশ ভাল লাগে।তবে ওকে নিয়ে আমি কখনও সেরকম ভাবনা ভাবিনা।সেরকম ভাবনা বলতে আমি ভালবাসা কিংবা প্রেম-টেম বোঝাচ্ছিনা,আমি বলতে চাইছি আকর্ষনের ব্যাপারটা।
কলেজে ক্লাশ টেন এ থাকা কালীন এটা লিখা শেষ করছিলাম।ইচ্ছা ছিল কোন একদিন সুযোগ হলে কারও কাছে সাবমিট করবো চলমান ছবি হিসেবে ফুটিয়ে তোলার জন্য।সেই স্বপ্নটা সত্যি হতে চলেছে শীঘ্রই ইনশাল্লাহ :-)যা হোক সিসিবি তে সবার সাথে ধারাবাহিক হিসেবে শেয়ার করার চেষ্টা করছি…( এটা একটা সত্য ঘটনা,চরিত্র গুলোর নাম অনেক গুলোই বাস্তব,ঘটনার কিছু কিছু অংশ শুধু লেখার জন্য একটু আলাদা করে ফুটিয়ে তোলা)
****************************
আমি এই মুহুর্তে কোথায় আছি সেটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি,বোধ হয় হাসপাতালে।আশেপাশের সবাই সম্ভবত আমাকে নিয়ে দারুন ব্যস্ত আর উৎকন্ঠিত।জানিনা কেন তাদের এত ব্যস্ততা আমার জন্য।হয়তো আমার প্রতি এ মুহুর্তে তাদের প্রচন্ড ভালবাসা জন্মে গেছে,সে ভালবাসা ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রকম,যা রঙ বদলায়।ভালবাসার কি আদৌ কোন নির্দিষ্ট রঙ আছে?ঠিক জানিনা।তবে আমি এটুকু বলতে পারি,প্রত্যেকের মাঝেই ভিন্ন ধরনের ভালবাসা আছে।আমি এমন কেউ নই যে এরা আমাকে নিয়ে এতটা উৎকন্ঠিত হবে,আমি আমার নিজের কাছে খুব সাধারন,হয়তোবা অন্যদের কাছে আলাদা।আমি এ মুহুর্তে আমার বুকের সব জায়গা জুড়ে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছি,এক ধরনের তীব্র যন্ত্রনায় আমার সর্বাঙ্গ ভরে যাচ্ছে।আমার মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেয়া হয়েছে।আমি শুধু চেয়ে চেয়ে সবার কাজ দেখছি।কেবল চেয়েই আছি,চোখ বুজতে ইচ্ছা করছেনা,কেমন যেন একটা অদৃশ্য ভয় আমাকে ছেয়ে আছে।সে ভয়ের জন্য আমি চোখ বুজতে পারছিনা,বুঝতে পারছিনা কি সে ভয়।সেটা কি মৃত্যু?আমার আশেপাশে যারা আছে তারা বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলছে তবে তাদের কথার বিষয়টা বুঝতে পারছিনা,হয়তোবা আমাকে নিয়েই কথা হচ্ছে এদের মাঝে।আমায় এখানে নিয়ে আসার আগে কি ঘটেছে আমার খেয়াল নেই।তবে,এটা মনে আছে যে কেউ একজন আমার হাতটা চেপে ধরে কেঁদেছিলো,কিন্তু কে কেঁদেছিলো?না,মনে পরছেনা।অনুভব করতে পারছি যে তার হৃদয়ে আমার জন্য ভালবাসার এতটুকু কমতি নেই।কিন্তু কে সে?আমি প্রচন্ড চেষ্টা করছি মনে করার;না মনে পরছেনা।আচ্ছা সবারই কি এমন হয়?যে মানুষটা তাকে ভালবাসে,প্রচন্ড রকম ভালবাসে অথচ তাকেই সে অনুভব করতে পারেনা কিংবা তার অস্তিত্বকে সহজে আবিষ্কার করতে পারেনা।কি জানি,তবে আমার মনে হচ্ছে আমি আবিষ্কার করতে পারবো।
***
চট্টগ্রামে বিআরটিসি স্ট্যাণ্ডে বাস থামে।বাস চেঞ্জ করতে হবে,তাই আমরা বাস থেকে নেমে পড়ি।খেয়াল করিনি মেয়েটি কই গেল।কে যেন বলল কিছুটা সময় লাগবে।সেজন্য ঠিক করলাম ব্রেকফাস্ট করে ফেলি।সবাই মিলে একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম।সকাল সকাল তেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না।ভাজি আর পরোটা খেলাম।সাথে চা।ততক্ষণে কেউ কছু বলল না মেয়েটিকে নিয়ে।যাক বাবা ভুলে গেছে সবাই,বাচলাম।
খেয়েদেয়ে আমরা ফিরলাম বাস কাউন্টারে।আমাদের জন্য বাস রেডি করা আছে।অনেকে নেমে গেছে এখানে।যাত্রী কম তাই একটু ছোট বাস দেয়া হয়েছে,তবে আগের টার চেয়ে বেশ জাকজমকপূর্ণ।এখানে আর সিট নিয়ে ঝামেলা হবে না।যে যার মত বসতে পারব।আমি এবার ঠক করলাম পিছনে গিয়ে বসব।গিয়ে বসলামও তাই।একা একা যাব।
সিফাত যেদিন প্রথম বুঝতে পারল, ও চৈতি-কে পছন্দ করে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাল চৈতি-কে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। চৈতি-র বাসার মহাগুরুজন গোছের যারা মানে- বড় চাচা, বড় ফুপি টাইপ পাবলিক (বাবা মা না হয় বাদই দিলাম)- তেনাদের মানসিকতার স্ট্যাটাস অতিমাত্রায় complicated আর কিছুটা মোঘলীয় হওয়ায় “Love Marriege” যে চৈতির ভাগ্যে নাই, তা ওর অজানা নাই। “Love Marriege” -এ Love-টা আগেই শেষ হয়ে যায়,
বাস রাত ১১ টায়।এখন বাজে ৯ টা।বাস ছাড়বে কলাবাগান থেকে।তার আগেই আমাদেরকে হল থেকে যেতে হবে।
আমি আরো অনেক আগে থেকেই রেডী হয়ে আছি।সুমন অবশ্য তার আগেও রেডী হয়ে বের হয়ে গেছে।আসাদ গেটে তার বউ আসবে।সেখান থেকে তাকে বাস কাউন্টারে নিয়ে আসার কথা।এতক্ষণে মনে হয় চলে এসেছে তারা।আমার নীলক্ষেত যেতে হবে তাই রেডী হয়েছি।আমার তো আর বউ নাই! একটা চিঠি কুরিয়ার করতে হবে।খুব প্রয়োজন,