ধারাবাহিক উপন্যাস – ২

(বানান ভুল ধরিয়ে দিলে কৃতার্থ হব।)

পর্ব- শুরু থেকে দুই

দুই

খুব সাধারণ পরিবারে অসাধারণভাবে জন্ম আমার। সাধারণ বলার কারণ আমার বাবা মফস্বল শহরের সরকারী ব্যাংকের একজন কেরানী। নাম মোহাম্মদ করিম। তিন নম্বর সন্তান হওয়ার সময় উনার স্ত্রী শেলী প্রায় মরনাপন্ন হয়ে পড়েন। ভাগ্যিস ঢাকা শহরে করিম সাহেবের একজন স্বচ্ছল আত্মীয় থাকতেন। সেই আত্মীয় আবার খানিকটা হোমড়া-চোমড়া ধরনের। শেলীকে উনি দ্রুত হলিফ্যামেলি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। সময়টা ষাটের দশকের প্রথম দিকে। সেসময় হাসপাতালে অনেক বিদেশী ডাক্তার কাজ করতো। তার একজন ডক্টর রবার্ট হিল। খুব তার নামডাক। চিকিৎসার হাতও খুব ভাল। সেদিন উনার ডিউটি ছিল না। তারপরও জটিল রোগী শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন। রাত তিনটা পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রমে অবশেষে মা ও সন্তানকে বাঁচাতে সমর্থ হন। সকালবেলা যখন শেলীর জ্ঞান ফিরে আসে তখন রবার্ট হিল নিজ হাতে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানকে তার কোলে তুলে দেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে শেলী তার সব অবসাদ ভুলে যায়। প্রসবকালীন সময়ের অসম্ভব যন্ত্রণা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেও শেলী একটি সুস্থ্ কন্যা সন্তান চেয়েছিলেন। আগের দুটি সন্তানই ছেলে। শেলী খুশী। ডক্টর রবার্ট হিল খুশি। সেই হোমড়া-চোমড়া আত্মীয়, যিনি সম্পর্কে শেলীর ভাসুর হন, তিনি এবং তার স্ত্রীও খুব খুশি। কারণ তাদেরও আগের দুটি সন্তান ছেলে। সে সময় শেলীর বাবা ঢাকা শহরে ছিলেন। একটি তাবলীগ পার্টির সাথে করাচী যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে শেলীকে দেখে গেলেন। শেলী যখন ডক্টর রবার্টের গুণগান গাচ্ছিলেন তখন তিনি শুধু আস্তে করে বললেন, ‘সবই আল্লাহর ইচ্ছা।’
জন্মের সময়কার এই কাহিনী আমাকে প্রায় প্রতিটা জন্মদিনেই শুনতে হতো। বিদেশি এক ডাক্তারের হাতে জন্ম নিয়েছি গল্পের এই অংশটা আমাকে বেশ অহংকারী করে তুলতো। নিজেকে রাজকন্যা গোছের কিছু একটা বলে মনে করতাম। নয়-দশ বছররের সময় যখন একটু একটু করে বাস্তবতা বুঝতে পারছিলাম তখন পাশের বাসার দিকে তাকালেই আমার রাজকন্যার ফানুশ ফুটো হয়ে পরতো।
সেসময়টায় আমরা ভাড়া থাকতাম দু কামরার এক বাসায়। কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগরের পাড়ে। এলাকায় বাড়িঘরগুলো খুব বেশি পিঠাপিঠি লাগোয়া ছিল না। দালানের সংখ্যা কম। অধিকাংশ বাড়ির মাথায় টিনের চাল। আর চারপাশে পুকুর আর খোলা মাঠ – দুটোই অগুনিত। আমাদের বাসার পাশেই ছিল খান মঞ্জিল। বিশাল অট্টালিকা। উচু পাঁচিল। সাদা রংয়ের। কালো গেট। তার উপর লাল বোগেনভেলিয়া ছেয়ে আছে। এ শহরের যে কোন জায়গা থেকে ধর্মসাগরের পাড়ে খান মঞ্জিল যাব বললে রিক্সাওয়ালা সোজা কালো গেটটার সামনে নামিয়ে দিত। সেই গেটের সামনে রাস্তার অপর পাশে একটা বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। রাস্তাটা তখনো পুরোপুরি পাকা হয়নি। কিছুদিন আগেও রাস্তাটা ছিল সলিঙ্গের। মানে মেঠোপথের উপর ভাজে ভাজে একস্তর ইট বিছানো হয়েছিল। খান বাড়ির লোকদের জোরে সেখানে এখন আলকাতরার প্রলেপ পরেছে। আমার ছোটদুটি চোখে ঝকঝকে চকচকে রাস্তাটাকে তখন কী বিশালই না মনে হতো! বাদবাকি পুরো এলাকাটা তখনো খুব খোলামেলা। গাছগাছালিতে ঘেরা। বাবলা, অশ্বত্থ, হিজল, শিমুল, পলাশ, শিশু, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু চারদিকে এরকম হরেকরকম গাছ। ঝাউতলায় একটা মহুয়া গাছ ছিল। সে গাছে যখন মহুয়া ফুল ফুটতো তখন সন্ধ্যাবেলায় চারদিকে সে ফুলের মৌ মৌ মাতাল সৌরভ ছড়িয়ে পড়তো। দাদামনুর পিছু পিছু হেটে গিয়ে আমিও অনেকবার সে ফুল দেখে এসেছিলাম। একসময় দাদামনু আর আমি নিয়ম করে পাড়া বেড়াতাম। পোলাচোর অর্থাৎ ছেলেধরার ভয় আমাদের থামিয়ে রাখতে পারতো না। চতুর্থ শ্রেণিতে উঠবার পর থেকেই আম্মা আর আগের মতো ঘরের বাইরে যেতে দেয় না। আর দাদামনুও তখন থেকে কেমন জানি বন্ধুর বদলে অভিভাবক হয়ে যেতে লাগলো। অথচ সে আমার থেকে মাত্র দুবছরের বড়। দাদামনু নিজের বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমি একা হয়ে যাই। সেসময় শিপ্রা আমার প্রিয় বান্ধবী হয়ে উঠে। আমার মতো শিপ্রার অতো ঘরের বাইরে যাবার বাঁধা নিষেধ ছিল না। শিপ্রাদের তখন ক্ষয়িষ্ণু পরিবার। বাড়িতে ওরা পাঁচবোন। কোন ভাই নেই। শিপ্রাকে মুদি দোকানের বাজারসদাই করতে হতো। ইচ্ছা হলেই সে আমাদের বাসায় যখন তখন চলে আসতো পারতো। আমরা দুবান্ধবী তখন ব্যস্ত হয়ে পড়তাম পুতুলের সংসার আর তাদের রান্নাবান্না নিয়ে। সেসময়টা ইটের একটা ছোট্ট টুকরো পাওয়ার জন্য ঘরের মেঝে, বাড়ির চারপাশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াতাম। যখন পেতাম তখন সেটাকে ঘষে ঘষে আমার রান্নাবাটি খেলার জন্য মরিচের গুড়ো বানাতাম। সেই শিপ্রাও বাসায় আসা বন্ধ করে দেয় সত্তরের শেষের দিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন উত্তাল। তারপরই তো আসে ঊনিশশো একাত্তর সাল। শুধু রাষ্ট্র নয়, ছোট্ট শৈশব মনেও প্রচণ্ড কালবৈশাখীর ঝড় তোলে।

খান মঞ্জিলের মতো এমন প্রাসাদোপম বাড়ির পাশে ছিল কাদের মোল্লার পর্ণ কুঠির। কাদের মোল্লা আমাদের বাড়িওয়ালা। মনে আছে ১৯৭১ সালে আমাদের বাড়িভাড়া ছিল সত্তুর টাকা। দু রুমের সেই বাড়িটায় কোনরকমভাবে আমাদের চার ভাইবোনের পরিবারটা এটে যেত। তাও ভাইয়া ক্যাডেট কলেজে থাকাতে রক্ষে। বাড়ির মাথার উপরে টিনের চাল। মেঝে ছিল সলিংএর। শুধু সিমেন্টের গাঁথুনীতে ইট বিছিয়ে কোনরকমভাবে মেঝে করা। একস্তর সিমেন্টের ঠালাই দিলেই ভদ্রস্থ মেঝে হয়ে যেত। বাড়িওয়ালা তার আর দরকার মনে করেনি। শহরে তখন বাড়িঘর কম। কিন্তু ওদিকে আবার একটু একটু করে চাকরিজীবীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই এরকম বাড়ি ভাড়া নেবার জন্যই ভাড়াটিয়াদের লাইন পড়ে যেতো। বাড়িটার পেছনে পড়েনি কোন সিমেন্টের পলেস্তরা। সেখানে নগ্নইটদের দাঁতচাঁপা নিস্তবদ্ধতা।
মনে আছে রাতের বেলা শৌচাগারে যাওয়ার কথা মনে হলে খুব ভয় করতো। তখন আম্মাকেও আমার সাথে থাকতে হতো।
বাথরুম বলতে গোছলখানা আর টয়লেটের জন্য দুটো আলাদা আলাদা খুপরীর মতো পাকা ঘর পাশাপাশি লাগানো। সেখানে কলের পানির কোন সুবিধা ছিল না। বিশাল ড্রামে তোলা পানিতে কাজ সারতে হতো। মনে আছে সে সময় আমরা ল্যাট্রিন বলতাম না। টয়লেট, পয়নিষ্কাশনাগার, শৌচাগার এসব বাহারী শব্দের সাথেও পরিচিত ছিলাম না। সহজ বাংলায় বলতাম পায়খানা। কী কুৎসিত নামরে বাবা! আর রান্নাঘরকে বলতাম পাকঘর। দাদামনু খুব মজা করে বলতো, ’পায়খানার নাম হওয়া উচিত ছিল যায়খানা। আর আসল পায়খানা তো পাকঘর। মানুষ তো এখানেই খাওয়া পায়।’
তা সেই আমাদের বিখ্যাত যায়খানাটি ছিল প্রাচিলঘেষা। খান মঞ্জিল আর কাদের মোল্লার জমির সীমানা নির্ধারণী প্রাচীল। সে প্রাচীলের এপাশটা রংচটা। শ্যাওলা ধরা। খান মঞ্জিলের দিকটা কেমন তা একবার মাত্র দেখার সুযোগ হয়েছিল। মনে আছে তা ছিল উজ্জ্বল সাদা রংয়ের। ভেতরে বাইরে দুদিকেই খান মঞ্জিলের দেয়ালের রং সাদা। ধবধবে সাদা। তবে এ শহরের কোন দেওয়ালই কলংকমুক্ত থাকতে পারতো না। যতবারই দেওয়ালের উপর রং চড়ানো হোত না কেন, রাতের বেলা কেউ না কেউ এসে সেখানে কিছু লিখে যেতই। সেসময় সারাদেশের উন্মাতাল রাজনৈতিকতার ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী হয়ে খান মঞ্জিলের সাদা প্রাচীলের উপর লেখা ছিল ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।’ অনেক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শুনেছিলাম এ ধরনের লেখাকে চিকা মারা বলা হয়। ষাটের দশকে পাকিস্থানী স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে ছিল। তখন রাতের অন্ধকারে প্রায়ই দেওয়াল লিখন চলতো। তখনকার বিখ্যাত বামপনহী ছাত্রনেতা হায়দার আকবর খান রনো একবার কয়েকজনসহ দেওয়াল লিখতে গিয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে দেওয়াল লেখার সময় সেবার তাদের সত্যি সত্যিই চিকা মারতে হয়েছিল। এরপর থেকে এর সংকেতী নাম হয়ে গেছে চিকা মারা। সেসময় খান মঞ্জিলে যারা চিকা মেরেছিল তারাও কম শৌখিন ছিল না। চিকার রং কালো। গেটের রং এর সাথে মিলে গিয়েছিল।
কাদের মোল্লার ভাড়াটিয়া আর খান মঞ্জিলের বাসিন্দাদের মধ্যে তেমন সখ্যতা হবার কারণ ছিল না। তারপরও দুবাড়িকে আড়াল করা সে বিশাল প্রাচীরের মধ্যে একটা ছোটখাট লোহার গেট বসানো ছিল। কী জানি আগে যারা বাড়ি বানাতেন তারা বোধহয় পড়শীর সাথে তেমন আড়ি আড়ি সম্পর্কের কথা ভাবতে পারতেন না। সে গেটের হুরকে কোন তালা ঝুলানো ছিল না। অব্যবহারে সেখানে মরচে ধরে গিয়েছিল। কেউ বলে দেয়নি, তারপরও আমরা জেনে গিয়েছিলাম ও গেট খুলবার নয়। আসলে আমরা খুলতে সাহস পেতাম না। আর ওরা খুলতো না। এভাবে খুব ছোটবেলাতেই আমরা শ্রেনীবৈষম্যের অদৃশ্য রেখাগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে পড়ি। এইসব অদৃশ্য রেখাগুলো ধীরে ধীরে আমাদের সুখদুঃখগুলোকেও নিয়ন্ত্রিত করতে করতে থাকে। আমরা নিজেদের সুখী ভাবি তুলনামূলক বিচারে।

ছোটগেটটা একটা উপকার করতো। বষার্কালে খান মঞ্জিলের বাগানের হাস্নাহেনার গন্ধ এদিকটায় ভূড় ভুর করে চলে আসতো। এসময়টাতে আম্মাকে বলতে শুনতাম, ’ভালোই তো। হাস্নাহেনার কারণে আমাদের ভিনাইল কম খরচ হচ্ছে।’ আবার ওদিকে ঠিকই ভয় পেয়ে ছোট গেটটার কাছে কার্বলিক এসিড ছড়িয়ে দিতেন। হাস্নাহেনার গন্ধে নাকি সাপ আসে।
আম্মার ধরনটাই এরকম। খুব রোমান্টিক। আবার বাস্তববাদী। আব্বার বেতন সর্বসাকূল্যে সোয়া তিনশ টাকা। চার ভাইবোনের সংসারে খুব টানাটানি হওয়ার কথা। আমাদের স্বভাব কখনও অভাবীদের মতো ছিল না। আম্মা নিজে খুব বড় ঘরের মেয়ে ছিলেন। ফরিদপুর শহরে নানার অনেক জমিজমা, ব্যবসাবানিজ্য। নানা হঠাৎ করেই তাবলীকি হয়ে পড়েন। তাবলীক জামাতীর সাথে আফ্রিকার মাদাগাস্কার পর্যন্ত ঘুরে এসেছিলেন। আম্মারা পাঁচবোন, তিন ভাই। আগেই দু বোনের বিয়ে হয়েগিয়েছিল। তাবলীকি শুরু করার পর নানার সংসারে থাকা হয়েছিল কম। বছরের অধিকাংশ সময়ই উধাও থাকতেন। হঠাৎ হঠাৎ এসে বাকী তিনবোনের তড়িঘড়ি করে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের সময় খালুরা সবাই ভাল ভাল চাকরি করতেন। একমাত্র আব্বাই আম্মার সাথে বিয়ের সময় বেকার ছিলেন। অথচ বোনদের মধ্যে আম্মাই নাকি সবচেয়ে সুন্দরী আর গুনী ছিলেন। বিয়ের সময় আব্বা উনার বড় ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। আমরা উনাকে জেঠা বলে ডাকি। জেঠাই হচ্ছে আমার জন্মের সময়কায় হোমড়াচোমড়া আত্মীয়। জেঠা একটা কেমিক্যাল কোম্পানির প্রধান কেমিস্ট। সে কোম্পানির মালিক এক পাঞ্জাবী।
নানাবাড়ির লোকজন বলতে ছোটমামা আর ছোটখালার সাথে বেশি যোগাযোগ হয়। আর সবাই তো বাংলাদেশের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছোটখালার কাছে শুনেছিলাম আম্মা নাকি খুব ভাল গান করতেন। নানা তাবলীকি হওয়ার পর বাসার হারমোনিয়াম ভেঙ্গে ফেলা হয়। এখন আম্মা আমাকে গান শিখতে খুব চাপ দেন। কিন্তু আম্মাকে কোনদিন গাইতে দেখেনি। তবে আম্মার সাহিত্যের প্রতি ভালবাসাটা বুঝতে পারতাম। আম্মার খুব গল্পের বইয়ের নেশা। আমাদের একটা বুকশেলফে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, মুজতবা আলী, বিমল মিত্র, নিহাররঞ্জন গুপ্ত,সমরেশ বসু, ফাল্গুনীর বই থরে থরে সাজানো। আম্মার আরো অনেক গুণ আছে। মর্ডাণ স্কুলে পড়ার সময় আমাকে নজরুল গীতির সাথে নাচ তুলে দিতেন। আমাদের দুইবোনের জামা সবসময় নিজ হাতে বানাতেন। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম ছোট হয়ে গেলে আমার কাপড়গুলোকেই যত্ন করে তুলে রাখা হতো। ওগুলোই পরে ছোটবোনকে পড়ানো হতো। ঠিক একইভাবে ভাইয়ার ছোট হয়ে যাওয়া জামা পড়তো দাদামনু।
ছোটবোনের নাম কেয়া। পুরো নাম সুরভী কেয়া। আমার আট বছরের ছোট। আমার পুরো নাম রিমঝিম দেয়া। ভাইয়ার ডাকনাম আপন আর দাদামনুর ভালো। মনে আছে আমাদের কাব্যিক কাব্যিক নাম আর ধোপদুরস্থ পোশাক-আসাক দেখে স্কুলের সবাই মনে করতো আমরা খুব বড়লোক। বান্ধবীরা আমার বাসায় আসতে চাইলে গেট পর্যন্ত নিয়ে আসতাম। ভেতরে ঢুকতে দিতাম না। কাদের মোল্লা বাড়িটা কোন রকম ভাবে বানালেও মূল ফটকটা বানাতে কোন কার্পন্য করেননি। পাশের খান মঞ্জিলের ফটকের সাথে দিব্যি তা পাল্লা দিতে পারতো। প্রবেশদ্বার ইট সিমেন্ট দিয়ে গড়া গম্বুজাকৃতি। সেই প্রবেশদ্বারের উপরের দিকে সাদা মার্বেল পাথরের একটা নামফলক বসানো ছিল। সেখানে বড় বড় করে বাংলায় ’মোল্লা হাবেলী’ লেখা ছিল। তার উপরে আরবীতে লেখা ছিল বিলমিল্লাহর রাহমানির রাহিম। বাংলার নীচে উর্দুতে আবারো মোল্লা হাবেলী কথাটা লেখা হয়েছিল। সেই সাথে বাড়ির মালিকের নাম, প্রতিষ্ঠা সাল – এসব তথ্যও উর্দুতে লেখা ছিল।
সত্তুর সালের নির্বাচনে যেখানে পূর্ব বাংলার সবাই দলে দলে আওয়ামী লীগে ভোট দিচ্ছিল, সেসময়টাতে নাকি কাদের মোল্লা এসে আব্বাকে জামাতে ইসলামের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য বলে গিয়েছিলেন। বিষয়টা বেশ বুঝে গিয়েছিলাম যে বাড়িওয়ালাকে আম্মা দু চোখে দেখতে না পারতেন না। তারপরো বাসায় আসলে তাকে খুব ভালো ভাবে আপ্যয়ন করতেন। এজন্য নাকি আমাদের বাড়িভাড়া একটাকাও বাড়তো না।
আমি তখন বড় হচ্ছিলাম। আম্মা আমার আদর্শ। পুতুল খেলার সময় আম্মার সব কথোপকথন আমার মা-পুতুলের সংলাপ হয়ে যেত। মা পুতুলের নাম দিয়েছিলাম রহিমা বেগম। কাদের মোল্লার মতো করে রমজান আলি নামে একটা মোটাসোটা পুতুল বানিয়েছিলাম। রহিমা বেগম রমজান আলিকে খুব অপছন্দ করতো। তারপরও দেখা হলে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করতো, ‘কী সৌভাগ্য আমাদের। গরিবের বাড়িতে হাতির পা।‘
আজ এতোদিন পরে মনে হচ্ছে ওটা তো আসলে হাতিরই বাড়ি ছিল। তাহলে আম্মা ওই কথা বলতেন কেন?

প্রতিবছর নিয়ম করে গ্রীষ্ম আর বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে খান মঞ্জিল কোলাহলমুখর হয়ে উঠতো। ও বাড়ির নাতি-নাতনিরা তখন তাদের বাবা-মায়ের সাথে বেড়াতে আসতো। শুনতে পেতাম ওদের হই হল্লা করে খেলাধূলায় মেতে উঠা আনন্দ উচ্ছ্বাসের শব্দ। ওদের অনেকে হয়তো দাদামনু বা আমার বয়সীই হবে। সেসময় খুব ছোট গেটটার হুড়কো খুলে ওপাশে যেতে ইচ্ছে করতো। তবে ইচ্ছেটা ইচ্ছে হয়েই থাকতো। ইটের প্রাচীল ডিঙ্গোনো যায়, লোহার গরাদ ভেংগে ফেলা যায়। কিন্তু অদৃশ্য শ্রেনীবৈষম্যের সীমারেখা কী অতো সহজে অতিক্রম করা যায়?
যায় না বলেই ছোট গেটটার গরাদের ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খান মঞ্জিলের ছেলেমেয়েদের সাতচারা খেলা দেখতাম। একবার আমাদের দেয়ালের ভেতরে ওদের টেনিস বলটা চলে এসেছিলো। সে বলটা ফেরত নিতে আসলো একটা ছেলে। বয়সে দাদামনুর থেকে হয়তো একটু বড় হবে। ছেলেটি আমাকে বিস্মায়াভূত করে দিল। ঠাকুরমার ঝুলির রাজপুত্ররা বোধহয় এরকম হয় দেখতে! গায়ের রং খুব ফর্সা, চুলগুলো বাদামী আর চোখদুটোর মনি মার্বেল পাথরের মতো। একটু সবুজাভ তার মধ্যেখানে ছোট্ট একরত্তি কালো বিন্দু সূর্যের মতো প্রখর হয়ে আছে। পথে ঘাটে এরকম চোখ দেখলে বিড়ালচোখা বলে সবাই তাকে ক্ষেপাতে শুরু করে। কিন্তু সেদিন ও চোখদুটি আমাকে বুঝিয়ে দিল এ ধরনের ক্ষেপানো খুব অন্যায়। আমি তখন এক ঘুটেকুড়ুনী হঠাৎ আসা বলটি রাজপুত্রের হাতে তুলে দিয়ে মহাকৃতার্থ।
এভাবেই সেই হিরণ নামের মানুষটির সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল।
মেঘাকে যখন বললাম আমাদের প্রথম দেখার কাহিনী, তখন সে প্রশ্ন করলো, ‘তখন তোমার বয়স কতো ছিল?’
‘আট কি নয়?’
‘নয় বছরের একটা মেয়ে এতো সূক্ষ্মভাবে সব খেয়াল করতে পারে?’
আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। হয়তো প্রথম দেখায় নয়, মানুষটাকে খেয়াল করেছিলাম ধীরে ধীরে। অতীত স্মৃতিরাও যে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে তাও নয়, শুধু হিরণ প্রসঙ্গে এলেই সবকিছু থেমে যায়। আমার পুরোটা অতীত যেন একটা স্থির বিন্দু হয়ে যায়।
‘তুমি আগে কোন বছর কি ঘটলো তা মনে করার চেষ্ঠা করো। তারপর যে কোন একটা বছর থেকে সামনে এগুতে শুরু করো।’ মাঝে মধ্যে মনে হয় আমার এই লেখাটা নিয়ে মেঘা আমার থেকেও বেশি আগ্রহী। প্রায় প্রায়ই উপদেশ দিচ্ছে। আর একমাস পর মেঘা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। এতোদিন আমি অপেক্ষায় ছিলাম ওর পাখা মেলে উড়ে চলে যাবার দৃশ্য দেখার জন্য। অথচ ও নিজেই চাচ্ছে আমিও পাখা মেলি। এক জায়গায় স্থির না থেকে আরো দুরন্ত উড়ে চলি।
হ্যা উড়তে আমাকে হবেই। আর তাই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ডুব দিই ১৯৭১ সালে। ডুব সাঁতারেই একটু একটু করে শান বাঁধানো বর্তমানে ফিরে আসতে থাকবো। তারপর মনের সুখে পাখা মেলে উড়তে শুরু করবো।

(চলবে)

২,১৯০ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “ধারাবাহিক উপন্যাস – ২”

  1. রাব্বী (৯২-৯৮)

    আমার চোখে বানানগুলো ধরা পড়লো 🙂

    অবশাদ > অবসাদ
    রুগী > রোগী (রুগী সঠিক, পরেরটাই ভাল লাগে)
    অসম্বভব > অসম্ভব
    দুকামড়ার > দু-কামরার
    উচু > উঁচু
    কৃষ-চূড়া > কৃষ্ণচূড়া
    চতূর্থ > চতুর্থ
    ক্ষয়িষনু > ক্ষয়িষ্ণু
    একাত্তুর > একাত্তর
    সত্তুর > সত্তর
    ঠালাই > ঢালাই
    প্রাচিলঘেষা > প্রাচীরঘেঁষা
    বামপনহী > বামপন্থী
    ঘুটেকুড়ুনী > ঘুঁটেকুড়ুনি

    [আমার ব্লগে বানান শুদ্ধ করে দিলে আমিও কৃতার্থ হবো।]


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    মরনাপন্ন>মরণাপন্ন
    স্বচ্ছল>সচ্ছল
    সুস্থ্য>সুস্থ্
    গুনগান>গুণগান
    বছররের>বছরের
    প্রাচীল>পাঁচিল
    বাদবাকী>বাদবাকি
    গাছগাছালীতে>গাছগাছালিতে
    অশত্থ>অশ্বত্থ
    শ্রেনীতে>শ্রেণিতে
    ঊনিশশ>ঊনিশশো
    এটে>এঁটে
    গাঁথুনীতে>গাঁথুনিতে
    পলেস্তরা>পলেস্তারা
    নিস্তবদ্ধতা>নিস্তব্ধতা
    খুপরীর>খুপরির
    বাহারী>বাহারি
    প্রাচিলঘেষা> পাঁচিলঘেষা
    হোত>হতো
    রাজনৈতিকতার> রাজনৈতিক/রাজনীতির (একটু চেক করেন, শব্দটা কেমন বেমানান মনে হচ্ছে বাক্যে) 🙁
    পাকিস্থানী>পাকিস্তানী
    সংকেতী> সাংকেতিক (সংকেতী শব্দটা বোধহয় হয় না, শিউর না)
    পড়শীর>পড়শির
    শ্রেনীবৈষম্যের>শ্রেণিবৈষম্যের
    বষার্কালে>বর্ষাকালে
    ভূড়ভুর> ভুর ভুর
    সর্বসাকূল্যে>সর্বসাকুল্যে
    ব্যবসাবানিজ্য>ব্যবসা-বাণিজ্য
    তাবলীকি> তাবলীগি
    তাবলীক> তাবলীগ
    গুনী>গুণী
    সময়কায়> সময়কার
    মর্ডাণ>মডার্ন
    ধোপদুরস্থ>ধোপদুরস্ত
    পোষাক-আসাক> পোষাক-আশাক
    কার্পন্য>কার্পণ্য
    আরবীতে>আরবিতে
    আপ্যয়ন>আপ্যায়ন
    এতোদিন>এতদিন
    খেলাধূলায়>খেলাধুলায়
    চেষ্ঠা>চেষ্টা
    হ্যা>হ্যাঁ

    (অনেকগুলো বানানে দীর্ঘ-ঈ'কার (ী) এর বদলে হ্রস্ব-ই'কার (ি) এসেছে প্রমিত বাংলা একাডেমির অভিধান অনুসারে)


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

    খুবই সাবলীল ভাবে এগুচ্ছে । তবে ভবিষ্যতের পর্বগুলি লিখতে অনেক " হিম্মতের" প্রয়োজন পরবে মনে হচ্ছে । আশা করি আছে?
    (আমার নেই বলে জীবনের 'জার্মানি অবস্তানের যৌবনকাল' এড়িয়ে যাচ্ছি আপাততঃ ) হা হা হা......। Best of luck!
    শুভেচ্ছা রইলো।


    Smile n live, help let others do!

    জবাব দিন
  4. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    হিম্মত যাতে থাকে তার জন্য দোয়া কইরেন ভাই।
    ‘জার্মানি অবস্তানের যৌবনকাল’ - এটাও নিশ্চয় আপনার কোন লেখা?


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  5. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আপু, বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার অভ্র এর সর্বশেষ ভার্সনের সাথে 'অভ্র স্পেল চেকার' ও আছে, সেটা ব্যবহার করে দেখতে পারেন, ভালই কাজ দেয়।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  6. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    শান্তা,

    খুব সুন্দর হচ্ছে। সুক্ষভাবে দেখার ক্ষমতা দেখে ঝুম্পার লেখার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।

    "আমরা নিজেদের সুখী ভাবি তুলনামূলক বিচারে।" - কি ব্যস্তব কথা।

    ভাল থাকো।

    জবাব দিন
  7. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    শান্তা, খুব ডিটেইলে কাজ করছো। ভালো লাগছে। এখনকার উপন্যাসে স্থান-কাল-পাত্রের এতো বিস্তারিত বর্ণনা থাকে না।

    বইয়ের বাজারের খবর পেলাম কয়েকদিন আগে "প্রথমা"র কাছ থেকে। কবিতার বই এমনকি বড় লেখকদেরও ৩০০ কপি শেষ হতে বছরের বেশি লেগে যায়। হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল ছাড়া বাকিদের গল্প-উপন্যাসের বিক্রি কবিতার চেয়ে কিছুটা ভালো। তবে উৎসাহব্যঞ্জক নয়। প্রবন্ধের বই, বিশেষ করে রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালোই চলে। ২/৩ হাজারও বিক্রি হয় বছরে।

    পড়ার অভ্যাস কি উঠে যাচ্ছে দেশ থেকে?


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      সানা ভাই বই বিক্রি নিয়ে আমি এতটুকুও চিন্তিত নই। বাংলা বই লিখে পয়সা করব এইটা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবি না। পড়ার অভ্যাস দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে না। আমার বাপের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির বিশাল সংখ্যক মহিলাকূল (কিছু সংখ্যক আগ্রহী পুরুষেরাও) আমার পরবর্তী বইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। প্লাস ব্লগীয় উৎসাহ তো আছেই। দেশে-বিদেশের বন্ধু-বান্ধবরাও পড়তে চাচ্ছে। তারা এবং আমি নিজেও মনে করছি যেগুলো লিখছি তার লেখার দরকার রয়েছে। এর ব্যাখ্যা পরে কোন এক সময় করবো। আমার আগের বই শেষ হয়ে গেছে। যদিও পরিচিতদেরকে গিফট করেছি - তাদের কিনতে দেয়নি।
      আমি লিখছি কিছুটা বড় পরিকল্পনা করে। এই যেমন ধরেন কেউ একজন বাংলা সিনেমা বানাতে চাচ্ছে কিন্তু হাতের কাছে কিছু নেই। বইয়ের মধ্যে তাই সিনেমাটিক উপকরণ রাখছি যাতে দেলওয়ার জাহান ঝন্টু সাহেবও উপকৃত হতে পারেন - আদৌ যদি তিনি তা মনে করেন।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।