এই বিশ্বকাপে ব্রাজিল এর নম্বর টেন নেইমার এর ফলস ডাইভ বা অতি ডাইভের এর অতি প্রবণতা আজকাল অনেকেরই বিরক্তির কারণ হচ্ছে (এমনকি বেশির ভাগ সময় সামান্য ট্যাকেলও তিনি নিজের ভারসাম্যও রক্ষা করতে পারছেন না)। দলের ম্যানেজমেন্ট থেকেও এ ব্যাপারে তেমন কোন নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছেনা। এবং নেইমার ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরার ইংগিত দিলেও অতি ডাইভ দেয়াটা মাঝেই মাঝেই প্রয়োগ করছেন। অনেক সমালোচনাও হচ্ছে (আমি নিজেও বিরক্ত, তবে সেটা ভিন্ন আলোচনা)।
আসুন একটু চেষ্টা করি দলের ম্যানেজমেন্ট থেকে এ ব্যাপারে তেমন কোন নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া না দেখানো বা নেইমারের এই এক্সট্রা ডাইভ দেয়া কনটিনিউ করার কোন ফুটবলীয় ব্যাখ্যা আছে কিনা? আপনার অবশ্য ভিন্ন মত থাকতেই পারে।
তবে বোঝার সুবিধার্থে আগে VAR- Video Assistant Referees নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। এই প্রথম বিশ্বকাপ এ VAR- Video Assistant Referees প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। মূলত ৩টি মূল এবং ১টি এডমিনিষ্ট্রিটিভ কারণে এটি ব্যবহার করা যায়। (১) গোল নিশ্চিত বা বাতিল করতে, (২) পেনাল্টি নিশ্চিত বা বাতিল করতে, (৩) সরাসরি লাল কার্ড এর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে (৪)এডমিনিষ্ট্রিটিভঃ হলুদ কার্ডের ব্যাপারে রেফারি নিশ্চিত না হলে বা ভুল খেলোয়াড় কে হলুদ কার্ড দেয়া হয়েছে বলে তার নিজের মনে হলে।
VAR- Video Assistant Referees এর আবার একটা সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। যদি অন-ফিল্ড রেফারী (লাইন্সম্যান বা সহকারী রেফারীর সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না) নিজে মনে করেন যে তার নিজের সিদ্বান্ত রিভিউ করার দরকার আছে অথবা VAR টীম যদি অন-ফিল্ড রেফারীকে পরামর্শ দেন যে তার VAR রিভিউ নেয়া উচিত (তবে নিবেন কিনা সেটা একান্তই অন-ফিল্ড রেফারীর সিদ্বান্ত) তখন তিনি চাইলে রিভিউ নিতে পারেন। তবে রিভিউ নিলেও অন-ফিল্ড রেফারী ই নিজেই রিভিউ করবেন এবং তিনি নিজেই চূড়ান্ত সিদ্বান্ত নিবেন।
আরেকটা নিয়ম হচ্ছে যে কোন খেলোয়াড়, ম্যানেজার বা কর্মকর্তা প্রকাশ্যে VAR এর সাঈন দেখালে সেটা punishable offence এবং চাইলে রেফারী তাকে হলুদ কার্ড দেখাতে পারবেন।তবে এখন পর্যন্ত রেফারীরা কাউকে এ নিয়ে হলুদ কার্ড দেখাননি। এর একটা বড় কারণ অবশ্য যেহেতু প্রযুক্তির ব্যবহারটা এই টুর্নামেন্টে নতুন এবং সবার অভ্যস্ত হতে সময় প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বিশ্বকাপের শেষের দিকে এসে হয়তো রেফারীরা এ ব্যাপারে কঠোর হওয়া শুরু করতে পারেন।
সারমর্ম হচ্ছে যে ডি বক্সের বাইরে VAR এর ব্যবহার এর সম্ভাবনা কম।এটা কাজে লাগাচ্ছেন হাফ ফীট নেইমার। নেইমারের মতন দ্রুতগতির খেলোয়াড় এর সাথে কমপক্ষে দুইজন মার্কার থাকেন, অনেক সময় তিনজনও থাকেন। এদের কাজই হচ্ছে স্বাভাবিক খেলা খেলতে না দেয়া। এর মাঝে সামান্য টাচ (কিংবা টাচ না লাগলেও) লাগলেই ডাইভ দিয়ে মার্কার কে চাপে ফেলা এবং বাস্তবিক এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাথে প্রথমবার বা ২য় বার না হলেও অন্তত ৩য় বারের ক্ষেত্রে রেফারীর পকেট থেকে একটা হলুদ কার্ড বের করানো (সেটা ভূল হলেও)। আর এটাই মার্কারকে আরো চাপে ফেলে দেয়। সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ বরং উল্টো চাপে পড়েন। কারণ এরপর একই খেলোয়াড়ের আরেকটি হার্ড ট্যাকেল ২য় হলুদ কার্ডের কারণ হতে পারে। ম্যানেজার তখন দুটো পথে হাঁটেন। হয় ঝুঁকি নেয়া বা অন্য কোন মার্কার কে এসাইন করা। ২০১৪ আর ২০১৮ এর ব্রাজিল এক নয়। ২০১৪ তে ব্রাজিল পুরোপুরি নেইমার নির্ভর ছিলো। ২০১৮ এর ব্রাজিল দলে নেইমার কোন কারণে না থাকলে সেটা পুরোপুরি না হলেও ৭৫% কাভার দেয়ার মতন সামর্থ্য রাখে দলের অন্য খেলোয়াড়রা ( কারণ এই পজিশনে দলে একই মানের আরো খেলোয়াড় আছে)। নেইমার হাফ-ফিট এবং বল নিয়ে দৌড়ানোর ক্ষেত্রে তিনি তার স্বাভাবিক গতি এখনও পুরোপুরি ফিরে পান নি। ৪ মাস ইনজুরির বিরতি দিয়ে বিশ্বকাপের আগে পুরো ৯০ মিনিট ম্যাচ প্র্যাকটিস তার মাত্র একটি। আর তাই ১ম দুই ম্যাচে তিনি ডিফেন্ডারের সাথে গতিতে পেরে উঠেন নি বহুবার। তার সামনে তখন দুটি পথ খোলা। মার্কার কে অতি ডাইভ বা ফলস ডাইভ দিয়ে চাপে ফেলা। সেই সাথে নিজের কাছে ডিফেন্ডার এর ভীড় জমানো (এমন কি স্কিল দিয়ে তাদের পরাস্ত করতে না পারলেও) অব্যাহত রাখা। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। কৌতিনহো বা জেসুস এর জন্য জায়গা বের করা। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়রা যাতে তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর সেই ফাকে বাকিরা স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারেন। ২০১৪ এর মতন টীম হলে সেটা অবশ্য তিনি করতেন না। কারণ তখন তাকেই খেলাটা তৈরী করতে হতো। কিন্তু তিনি খেলতে না পারলেও বা বলের যোগান দিতে না পারলেও তার বড় দায়িত্ব বাকীদের জন্য কাজটা সহজ করা।
যারা যারা বলছেন নেইমার ব্রাজিল এর খেলা নষ্ট করছেন বা তাকে বাদ দিলে ব্রাজিল ভালো খেলতো, তারা ভাবছেন না যে নেইমার না খেললে ডিফেন্ডারদের পুরো ফোকাস টা গিয়ে পড়বে কৌতিনহো বা জেসুস এর উপর। তখন কৌতিনহো বা জেসুস এই এডভান্টেজ টা মিস করবেন। তার মানে নেইমার যা করছেন, সেটা পার্ট অফ টীম ষ্ট্রেটেজি এবং এটা ততদিন পর্যন্ত চলবে যতদিন না তিনি পুরো ফিট হয়ে উঠছেন বা পুরোপুরি গতি ফিরে পাচ্ছেন। এখন এটা Values হিসাবে ভালো না মন্দ সে ব্যাপারে আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, সমালোচনা বা ট্রল করতেই পারেন। তবে ফুটবল আসলে ক্রিকেট এর মতন জেন্টেলম্যান গেইম নয়। তাছাড়া এক হিসাবে সুয়ারেজ বা রোবেন এর মতন তুখোড় না হলেও (মানে যেহেতু ধরা খেয়ে যাচ্ছেন), নেইমার এই ব্যাপারে পুরোপুরি সফল। প্রতিটি ম্যাচে তার মার্কাররা হলুদ কার্ড পেয়েছেন, উল্টো চাপে পড়েছেন। তার মানে হলো টীমের চাহিদার জন্যই তার এমন ভূমিকা নেয়া। বাস্তবতাই তার কাছে এমন দাবী করছে আর তিনি সেটা সমালোচনা স্বত্তেও মেটাচ্ছেন।
আপনি আমি নেইমার কে নিয়ে অনেক চিন্তিত হলেও আমার ধারণা নেইমার কে নিয়ে তিতে একদম ই চিন্তিত নন। একদম ই নন। মিসর এর মোহাম্মদ সালাহ (লিভারপুল) বা নেইমার এর মতন খেলোয়াড় হাফ ফীট এমনকি যদি সেলফিস ও হোন, তারা দলে একটা বড় ভূমিকা রাখেন। আগেই বলেছি তাদের আশেপাশে ডিফেন্ডাররা ভীড় করেন যেটা বাকীদের জন্য জায়গা বের করে। হয়ত তারা অনেক গোল মিস করতে পারেন, তবে তাদের পজিশনে তারা পারফেক্ট।
তিতে বরং চিন্তিত ২১ বছর বয়সী কুশলী নম্ব্র নাইন ষ্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল জেসুস এর গোল না পাওয়া নিয়ে, কিংবা অলিম্পিক ফুটবল এ জেসুস আর নেইমারের মাঝে যে ওয়ান টু ওয়ান আন্ডারষ্ট্যান্ডিং ছিলো, সেটা এখনো দেখতে না পাওয়া নিয়ে।
তিতে এজন্য জেসুস কে পুরো ৯০ মিনিট খেলাচ্ছেন যাতে করে তিনি দ্রুত ছন্দ ফিরে পান।
দানি আলভেজ না থাকাতে লেফট উইং এ সেরকম ঝড় দেখা যাচ্ছেনা। উইঙ্গার উইলিয়ান আছেন তবে চেলসির উইলিয়ান কে খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা। চেলসির সেই ছন্দ এখনো ফিরে পান নি। মার্সেলো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে থাকাতে দলের সাথে তার বোঝাপড়া ঠিক মতন ঝালাই হয়নি। তার ক্রস গুলো রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়রা যেভাবে পড়তে পারতেন, ব্রাজিল ফরোয়ার্ডরা সেভাবে পড়তে পারছেন না। তবে টীম কম্বিনেশনে উন্নতি পরিস্কার। তবে এটাও পরিস্কার উন্নতির গতি স্লো। এখন দেখা যাক রাউন্ড অফ সিক্সটিন এর নক-আউট পর্বে কি দাঁড়ায়। সাম্বা ছন্দ কি জেগে উঠবে?
লেখাঃ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
তারিখঃ ২৮ জুন ২০১৮, রাত ১১:২০ ঘটিকা (বাংলাদেশ সময়)
ইমেইল: a.shaon@gmail.com
VAR এর তথ্যসূত্রঃ https://football-technology.fifa.com/en/media-tiles/video-assistant-referee-var/
লেখাটি আরো প্রকাশিত হয়েছেঃ
১) http://www.somewhereinblog.net/blog/shaon1016/30245204
২) http://www.cadetcollegeblog.com/shaon/60962