কোথায় পাবো তাদের – ৩

১.

বহুদিন পর আমাদের কলেজে একজন ম্যাডাম আসলেন। তাও আবার রীতিমতো অবিবাহিতা।
শোয়েব আখতারের বলে টেনডুলকার ছক্কা মারলে ভারতের সাপোর্টাররা যেরকম খুশি হয় আমরা সবাই ওরকম খুশি হয়ে উঠলাম। মনের ঘরে চান্দের আলো চুইয়া চুইয়া পড়তে শুরু করল। আমরা যারা মকরা পার্টি ছিলাম, সেভ না করার জন্য ডেইলি জোড়ায় জোড়ায় ই.ডি. খাইতাম তারাও সকাল বিকাল সেভ করতে করতে গাল সবুজ করে ফেললাম কখন ম্যাডামের সাথে দেখা হয়ে যায় এই আশায়।
অবশেষে একদিন শরতের সুন্দর সকালে, লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে ম্যাডাম আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতে আসলেন আর আমরা হাত দিয়ে আমাদের কপালের ঠিক উপরে যার যেটুকু চুল আছে তা ঠিক করতে লাগলাম।
রিনঝিন গলায় ম্যাডাম আমাদের বললেন
-আমি তোমাদের ‘আ মাদার ইন মেনভিল’ পড়াব।
মনে মনে আমরা কিছুতেই ‘আ মাদার ইন মেনভিল’ পড়তে চাইছিলাম না। একটা অনাথ ছেলে এক বুড়ি মহিলার জন্য কাঠ কাটছে আর বলছে সাইজ ডাসণ্ট মেটার চোপিং উড। এই গল্প পড়ানোর জন্য ‘বোতল’ স্যার ‘বাম্পার’ স্যাররাইতো আছে। আমরা প্রাণপণে চাইছিলাম ম্যাডাম আমাদের ‘গিফ্ট অব মেজাই’ পড়াবেন। ডেলা যে জিম কে কতটা ভালোবাসে এইটা যদি ম্যাডাম আমাদেরকে ব্যাখ্যা করে না বুঝান তাহলে আমরা তো পাসই করতে পারব না। কিন্তু ম্যাডাম আমাদের দুঃখ বুঝলেন না। ক্যাডেট ছাড়া আসলে এই দুনিয়ায় ক্যাডেট দের দুঃখ অন্য কেউ কোনদিন বুঝবে না।
একবারও আমাদের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে ম্যাডাম ‘আ মাদার ইন মেনভিল’ পড়াতে লাগলেন। আর আমরা যে যার ডেষ্কে বসে মাথা উঁচু করে যতো ভাবে পারা যায় ম্যাডাম কে দেখতে লাগলাম।

২.

বায়োলজি ম্যাডাম হাঁটতেন অনেক জোরে জোরে। কলেজের সবচেয়ে তরতাজা স্যারও উনার সাথে হেঁটে পারতেন না।
স্যারদের মধ্যে সবচেয়ে জোরে হাঁটতেন ইংরেজির আতিক স্যার। উনার ডায়াবেটিস ছিল। বিকালে গেমস টাইমে অন্য স্যাররা যখন ভলিবল খেলতেন আতিক স্যার তখন মাঠের চারপাশে চরকির মতো চক্কর দিতেন। বায়োলজি ম্যাডাম আসার পর দেখা গেল আতিক স্যারও উনার সাথে হেঁটে পারছেন না।

ম্যাডাম ক্লাস শেষ করে দরজা দিয়ে বের হতেন, আমরা জানালা দিয়ে উঁকি দিতাম পেছন থেকে ম্যাডাম কে দেখার জন্য। দেখতাম ম্যাডাম ডিপার্টমেন্টের কাছে চলে গেছেন। পিছন থেকে ম্যাডামকে দেখার শখ আমাদের কোনদিন পূরণ হয়নি।

বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সময় আমাদের একটা ইভেণ্ট ছিল তিন হাউসের স্যারদের মধ্যে ৪*১০০ মিটার রিলে। এটার পয়েন্ট হাউসের পয়েন্টের সাথে যোগ হতো। তো আমাদের সুরমা হাউসে সব বয়স্ক স্যার। অনেক কষ্টে দৌড় দেবার মতো ৩ জন পাওয়া গেল। আর একজন কিছুতেই হয় না। শেষ পর্যন্ত উপায় না দেখে আমরা কয়জন ফাজিল বায়োলজি ম্যাডামের কাছে গেলাম।

-ম্যাডাম আমরা তো স্যারদের রিলেতে লাস্ট হয়ে যাব। দৌড় দেওয়ার কেউ নাই।
-হুম, কি করা যায় বলোতো।
-না মানে ম্যাডাম, বলছিলাম যে আপনি তো অনেক জোরে জোরে হাঁটেন।
-হুম, তো?
– ম্যাডাম কষ্ট কইরা যদি আপনি একটা দৌড় দিতে রাজি হন তাইলেই আমরা চ্যাম্পিয়ন।
-বেআদব …..

হাতের কাছে কি যেন ছিল। ম্যাডাম ঐটা ছুড়ে মারলেন। আমরা উল্টা ঘুরে দৌড় দিলাম।

সেবারও স্যারদের রিলেতে সুরমা হাউস লাস্ট।

৩.

ভূগোলের এক ম্যাডাম ছিলেন। সব সময় সিল্কের শাড়ি পড়তেন বলে তাকে আমরা ডাকতাম ‘সিল্কি’।

বাংলার এক স্যার একবার ‘সোনার তরী’ কবিতা মুখস্ত করতে দিলেন। যারা যারা মুখস্ত করে উনাকে শুনাতে পারবে পাক্ষিক পরীক্ষায় তাদের কে অতিরিক্ত ৫ নম্বর দিবেন। সবাই মুখস্ত করে ফেলল । আমার তখনও বাকি। ফরমে বসে বসে জোরে জোরে ‘সোনারতরী’ মুখস্ত করছি.. গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা। ‘সিল্কি’ ম্যাডাম ফর্মের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার ডেস্কও ছিল জানালার পাশে। ম্যাডাম জানালার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনলেন আমি বলছি ‘ ওগো তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে, বারেক ভেড়াও তরী কুলেতে এসে।’
কপাল খারাপ ম্যাডাম ভাবলেন উনাকে বলছি। হাউস মাস্টারের কাছে বিচার দিলেন
-স্যার, কামরুল আমকে খারাপ কথা বলেছে।
হাউস মাস্টার রেগে গিয়ে ডেকে পাঠালেন। আমি যতই বুঝাই স্যার আমি খারাপ কথা বলি নাই। যেইটা বলছি সেইটা রবীন্দ্রনাথের কথা, স্যার ততই রেগে যান
– বেআদব ছেলে। রবীন্দ্রনাথ কে খারাপ বলে। বেশি যুবক হইয়া গেছ, না? বেশি যৌবন চইলা আসছে শরীরে? ম্যাডামের সঙ্গে খারাপ আচরণ কর।

হাউস অফিসের অন্য সব স্যাররাও একসাথে স্বীকার করলেন আমি একটা অসভ্য।

টানা তিনটা ই.ডি খাইলাম।

৪,৫৬৭ বার দেখা হয়েছে

৩৯ টি মন্তব্য : “কোথায় পাবো তাদের – ৩”

  1. আমি আর তপু (কামরুলতপু) কথা বলার সময় প্রায়ই এমন হয় যে একই কথা দুজন দুপাশ থেকে টাইপ করেছি। তখন আমরা একই সাথে লিখি- GMTA (Great Men Think Alike). ক্যাডেট কলেজের ম্যাডামদের সম্পর্কে সকল ক্যাডেটরা যে GMTA এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

    লেখাটা জটিল হইসে। অনেক হাসলাম।

    শামস
    ১৭তম ইনটেক (১৯৯৬-২০০২)
    ককক

    জবাব দিন
  2. আমাদের সেই ইংরেজীর ম্যাডামের প্রথম ক্লাস শেষ হলে আমাদের কিছু পোলাপাইন আবেগ সামলাতে না পেরে ব্যাড
    সাউন্ড করে বসলো।পরের ক্লাস ছিলো আমাদের হাউস মাস্টারের,ফলাফল পরা এক পিরিয়ড ব্যান্ড পজিশন হয়ে থাকতে হইসে...

    জবাব দিন
  3. :>
    সবই ঠিক আছে।
    কিন্তু কোনো স্যার আইসা যদি কোনদিন এই লেখা গুলি পরে আমারে কিন্তু কলেজ আউট কইরা দিবে।
    আমাদের মিশেল রে কলেজ থেকে বের হয়ে আসার পর কলেজ আউট করছিল।

    জবাব দিন
  4. সাব্বির (৯৫-০১)

    আহা সিলেটে কত ম্যাডাম আসিল, কত মজার কাহিনী। আর আমগো বরিশালে কোন ম্যাডামই ২/১ মাসের বেশী থাকতনা। যাও একটা শেষে আসিল ওইটারে আমরা ম্যাডাম না বলে স্যার ডাকতাম যাতে ম্যাডাম নামের অবমাননা না হয় সেই জন্য।

    জবাব দিন
  5. হা হা হা
    বেশ মজাদার কাহিনী। আমাদের কলেজে ছিলেন শারমিন রড্রিক্স। আংরেজীর ম্যাডাম। এবং অতিঅবশ্যই অবিবাহিতা। তাঁর কথা মনে পড়ে গেলো। বারান্দা ধরে হেঁটে গেলেই প্রতিটা ক্লাস খালি হয়ে জানালায় এসে ভর করতো। বারান্দা থেকে জানালার দিকে তাকালে নজরে পড়তো কেবল চোখ আর চোখ!

    ছিলেম মৃধা ম্যাডাম। অর্থনীতির। স্বভাবতই তিনি আমাদের ফ্লোরে উঠতেন না। তাঁকে দেখার একমাত্র উপায় ছিলো নিচ তলায় টিচার্স রুমের সামনে ঘুরঘুর করা অথবা ফিজিক্স ল্যাবে যাওয়ার সময়। একদিন ক্লাসের ব্রেকে ক্যান্টিনে যাওয়ার পথে তাঁর হাতে (স্কুলের ছাত্রীরা যেমন করে বুকের সাথে বই জাপ্টে ধরে রাখে, তেমনি করে) দেখেছিলাম "ধণবিজ্ঞানের কথা" নামক একটি বই। আমি একবার ম্যাডামের মুখের দিকে তাকাই আবার বইটার দিকে। কয়েকবার করতেই ম্যাডাম এমন করে আমার দিকে তাকালেন যে এতো বছর পরেও সেই দৃষ্টিটা আমার স্মৃতিতে আজও অম্লান-ভাস্বর!

    মারলিন ম্যাডাম। বাংলা পড়াতেন আমাদের গ্রুপেই। তাঁকেই কেবল পেয়েছি সবেধন নীলমণি হিসেবে। প্রমীলা ম্যাডামও ছিলেন বাংলায়। কিন্তু ঐযে, না পাওয়ার দিকে আগ্রহ থাকে বেশি। না জানার দিকে ঝোঁক থাকে অফুরন্ত। সেই ঝোঁক থেকেই আজও মৃধা ম্যাডামের "ধণবিজ্ঞান" ক্লাসে হাজির না থাকতে পারার যাতনা কিংবা শারমিন ম্যাডামকে কোন পাপিষ্ঠ বিয়ে করলো, সেই চিন্তা এখনও মাঝে মধ্যেই তাড়িয়ে বেড়ায় তেরো বছর আগের আমাকে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।