কোথায় পাবো তাদের-১

১.
আলেকজান্ডার দি গ্রেট নাকি এরিষ্টটলের ছাত্র ছিলেন। আমি অবশ্য শিওর না, তবে কলেজ লাইব্রেরিতে ইতিহাসের এক বইয়ে একবার একটা ছবি দেখেছিলাম, হাতে আঁকা, এরিষ্টটল নেংটো হয়ে বসে আছেন। তার সামনে নেংটা হয়ে বসে আলেকজান্ডার দি গ্রেট মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছেন।
ফিজিক্সের আসাদুজ্জামান স্যার অবশ্য এরিষ্টটলের মতো এতো অশ্লীল ছিলেন না। স্যারের শুধু প্যান্টের জিপারটা খোলা থাকতো মাঝেমাঝে। স্যার সরল দোলক পড়াতেন। পড়াতে পড়াতে হাঁটু দুইটা একটু ব্যান্ড করে কোমরটা পিছনের দিকে একটু বাঁকা করতেন। জিপারটা আর একটু ফাঁক হতো। আমরা সেই ফাঁক দিয়ে স্যারের রঙধনু রঙের আন্ডারঅয়ারের ভিতরে সরল দোলকের দুলুনিটা বুঝার চেষ্টা করতাম। “দোলকের কার্যকর দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দিলে অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর মান কমে যায়” এই কথাটা স্যার শুদ্ধ করে বলতে পারতেন না। পাবনা কিংবা কুষ্টিয়ার দিকে বাড়ি ছিল বলে স্যার বলতেন “কার্যকর দৈর্ঘ্য বাড়া দিলি পরে……।” আমরা বাড়া দেওয়ার কথা শুনে হাসতাম। প্যান্টের জিপার খোলা রেখে কেও যদি বাড়া দেওয়ার কথা বলে তাহলে হাসি আসতেই পারে। গতি,বেগ,ত্বরণ,মন্দন,ভেক্টর সমাকলন পড়তে পড়তে একদিন শুনলাম স্যার বিয়ে করেছেন। ম্যাডামের নাম “সোমা”। বিয়ের পর ক্লাসে এসে স্যার আর ভেক্টর সমাকলন বলতে পারেন না। বলেন ভেক্টর “সোমা”কলন। তারপর একদিন, ওয়ান ফাইন ডে মর্নিং, গতিবিদ্যার ক্লাস নিতে এসে স্যার আমদের self study দিয়ে পিছনে বসে “নবজাতকের সুন্দর নাম” বইটা পরতে লাগলেন। আর আমরা প্রাণপণে “সোমা”কলনের সূত্র বুঝার চেষ্টা করতে থাকলাম।

২.
ক্লাস এইট-নাইনে আমদের ভূগোল ক্লাস নিতেন মকবুল হোসেন স্যার। স্যারের অভ্যাস ছিল কথায় কথায় “আর কি” বলা। “কালকে পরীক্ষা হবে আরকি”, ‘পিটাইয়া পিঠের চামড়া তুলে ফেলবো আরকি’ এই টাইপ। শুনতে শুনতে সবাই স্যারের নাম দিল আরকিমিডিস। একদিন গেমস টাইমে ভলিবল মাঠে স্যাররা দুই ভাগ হয়ে ভলিবল খেলছেন। ফিজিক্সের আলমগীর স্যারের heavy smash গিয়ে লাগল মকবুল হোসেন স্যারের দুই উরুর মাঝখানে সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গায়। ব্যথায় স্যার তাজা কই মাছের মতো লাফাতে লাগলেন। ওইপাশ থেকে আলমগীর স্যার জিজ্ঞেস করলেন ‘মকবুল ভাই ব্যথা পাইছেন নাকি?’
‘এই একটু লেগেছে আরকি’

৩.
মকবুল স্যারের মতো প্রাণিবিদ্যার জাহাঙ্গীর আলম স্যারেরও একটা মুদ্রাদোষ ছিল। কথায় কথায় স্যার ‘হচ্ছে হল’ বলতেন। আমরা ক্লাসে বসে গুনতাম স্যার কয়বার ‘হচ্ছে হল’ বলছেন। মাঝে মাঝে হাতে গুণে কুলানো যেতো না, কেলকুলেটর লাগত। ‘হোপ ছেলে তুমি হচ্ছে হল ঘুমাচ্ছ কেন? আমি হচ্ছে হল তোমাকে হচ্ছে হল নি-ডাউন হচ্ছে হল করিয়ে রাখবো।’
তবে স্যারের নিকনেম কিন্ত ‘হচ্ছে হল’ ছিলনা। স্যার ‘য়ু’ উচ্চারন করতেন ‘ও’ এর মতো। ‘বায়ু’ বলতে পারতেন না বলতেন ‘বাও’। ‘আয়ু’ না বলে বলতেন ‘আও’। একদিন ক্লাসে একজন পেট থেকে গ্যাস ছাড়ল। দুর্গন্ধে পুরা ক্লাসে হাসাহাসি শুরু হল। স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘হোপ ছেলেরা তোমরা হচ্ছে হল হাসাহাসি হচ্ছে হল করছ কেন?’
‘স্যার কে যেন হচ্ছে হল পাও দিয়ে হচ্ছে হল বাও ছেড়েছে।’

৪.
পাক্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট ঘোষনা করতে এসেছেন ফর্ম মাস্টার পি. কে. রায় স্যার। আমরা অপেক্ষা করছি সেই পরিচিত ডাইলগটি শোনার জন্য। আমদের ‘এ’ ফর্মের রেজাল্ট সব সময়ই খারাপ। খারাপ মানে যেই রকম খারাপ হইলে ফর্ম মাস্টারের মান-সম্মান নিয়া টানাটানি পরে সেই টাইপ খারাপ। সেই জন্য স্যার প্রতি বার রেজাল্ট দেওয়ার সময় এই ডাইলগটা দেন, এবং তারপর জোরে হাততালি পরে।
স্যার তৌহিদ কে ডাকলেন। এইটা আমদের খুব পরিচিত দৃশ্য। তৌহিদ আমদের ফার্স্ট বয়। দুই ফর্ম মিলে ও সব সময় ফার্স্ট হয়। এবারও হইছে তাতে কোনও সন্দেহ নাই।
‘দুই ফর্ম মিলাইয়া তৌহিদ আবারও ফার্স্ট।’ স্যার আস্তে আস্তে ঘোষনা করলেন। কেও হাত তালি দিল না। স্যার মাথা নিচু করলেন। তারপর চিৎকার করে বললেন,
‘ফর্মের মুখে চুন আমর মুখে কালি মারিয়া আবারও ২২ জন ফেল।’
এইবার জোরে হাত তালি পরলো।

৫.
ইংরেজির সুরেশ রঞ্জন বসাক স্যারকে যারা পেয়েছে তাদের সবাইকে যদি ক্যাডেট কলেজের প্রিয় শিক্ষকের নাম বলতে বলা হয় বেশির ভাগই যে বসাক স্যারের নাম বলবে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। আমারও খুব প্রিয় ছিলেন তিনি। খুব পান খেতেন। ক্লাস নিতে আসলে মিষ্টি পানের ঘ্রাণে ক্লাসরুম ভরে যেতো। আমদের খুব ভালো লাগতো। স্যার কখনো কারো গায়ে হাত তুলতেন না। বড়জোর কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা পর্যন্ত। ইংরেজি কবিতা পড়াতেন একই সাথে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন আবৃত্তি করে শুনাতেন চমৎকার ভাবে। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনে যেতাম। সেই বসাক স্যার একদিন খুব রেগে গেলেন।
শাহরিয়ার গান গাইতে গাইতে গোসল করছিল হাউস অফিসের সবচেয়ে কাছের বাথরুম টাতে। স্যার ছিলেন ডিওটি মাস্টার। হঠাৎ শুনলেন বাথরুমে কে যেন জোরে জোরে গান গাইছে। ‘পিয়া তু আব তো আ যা…. মণিকা ও মাই ডারলিং.. মণিকা ও মাই ডারলিং।’ স্যার দাঁড়িয়ে থাকলেন বাথরুম থেকে কে বের হয় দেখার জন্য। শাহরিয়ার বের হলো। টাউয়াল পরা অবস্থায় হাউস অফিসের সামনে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন অনেকক্ষন।
স্যারের কি দোষ স্যার তো আর জানতেন না সিনেমায় নায়িকার নামই মণিকা।
শাহরিয়ারেরই বা কি দোষ। ও তো আর জানতো না স্যারের মেয়ের নাম মণিকা।

আমি জানতাম। কিভাবে জানতাম সেই গল্প অন্য একদিন।

পুনশ্চঃ ক্যাডেট কলেজের ১৯৯৪-২০০০ ব্যাচের , মানে আমদের ব্যাচের আজ বর্ষপূর্তি। আজ ১২ই মে, তাই সকাল থেকে জন্মদিনের তোড়া তোড়া ফুল।

৩,৬২৫ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “কোথায় পাবো তাদের-১”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    লেখা পড়ে হাসতে হাসতে অস্থির। এম্নিতেই রাত সাড়ে চারটায় পড়া বাদ দিয়া ব্লগে বসে আছি।মনে হয় ঐ ২২ জনের মত কপাল পরশু রেফ্রিজারেশন পরীক্ষায় আমার ভাগ্যেও জুটতে যাচ্ছে। 😀

    হ্যাপি বার্থডে টু ৯৪ ইনটেক (তালি)


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  2. হাসান ভাই ,হচ্ছে হল গিয়ে আপনার লেখা পড়ে খুব্বি মজা পাইলাম,লেখালেখি বাড়া দেন...নইলে খবর আছে আর কি.....
    রায়হান,২৩,এস.সি.সি(কামরুল ভাইয়ার ভাই না বললে আবার কেউ চিনে না।।)

    জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    কামরুল, তোর লেখা পড়ে খুব মজা পেলাম। তোর গল্প বলার ক্ষমতা নিয়ে না হয় নাই বললাম! এখানে নিয়মিত লেখালেখি চালিয়ে যা!

    শুভ জন্মদিন আমাদের ব্যাচ এর সবাইকে।

    জবাব দিন
  4. রায়হান

    আমার ক্যাডেট নাম হচ্ছে হল গিয়ে কামরুল। সুরমা হচ্ছে হল গিয়ে হাউস। ‘হাসান ভাই’ না বলে হচ্ছে হল ‘কামরুল ভাই’ বললে ভালো লাগবে আরকি। কারণ আমাদের ব্যাচে হচ্ছে হল গিয়ে ‘হাসান’ নামে হচ্ছে হল অন্য একজন ছিল।
    অবশ্য আমাদের ব্যাচে হচ্ছে হল তিতুমীর হাউসেও হচ্ছে হল একজন কামরুল ছিল। কিন্তু সে হচ্ছে হল আমার মতো হচ্ছে হল বিখ্যাত ছিল না আরকি।

    ‘কামরুলের ভাই’ না বললেও আমি হচ্ছে হল তোমাকে চিনব আরকি। তুমি হচ্ছে হল নিজ নামেই পরিচিত আরকি।

    ভালো হচ্ছে হল থেকো আরকি।

    জবাব দিন
  5. @কামরুল ভাই
    ভুল হয়ে গেছে...কামরুল হাসান লিখা তো তাই বুঝতেসিলাম না যে এইটা হাসান ভাই নাকি কামরুল ভাই.......ভাইয়া সরি।
    ভালো থাকবেন ভাইয়া।
    happy entrance day

    জবাব দিন
  6. তারেক (৯৪ - ০০)

    কামস,
    প্রথম পোস্টেই ফাটাইছিস একেবারে! আমি জিহাদরে আগেই বলছিলাম তোরে যেন ধইরা বাইনধা নিয়া আসে!

    মইন,
    তুই কি আমাগো মইনই তো নাকি? কইথথেইকা আইলি?


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন
  7. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    কামরুল ভাই, বহুত বিজি আর কি , তাও আপনাকে একটা কমেন্টাইবার জন্য লগইন করলাম আর কি। জটিল লেখছেন আর কি। আপনার নাটক বানানো কেমন চলতেছে? তবে ভাই আর কি বলা কিন্তু মকবুল স্যার ছেড়ে দিয়েছেন আর কি।
    বসাক স্যার কিন্তু আমাদের ক্লাসে একবার হঠাৎ করে ক্ষেপে গিয়ে স্টেইনলেস স্টিলের স্কেল দিয়ে এক ছেলেকে ব্যান্ড করিয়ে মনে হয় ১০টা বাড়ি দিছিল। সেই প্রথম এবং শেষ স্যারকে মারতে দেখছি।

    জবাব দিন
    • কামরুল

      নাটক বানানোর কাজ চলছে ভালোই। একটা ১৩ পর্বের সিরিয়াল করছি। ৯ পর্ব শুটিং শেষ। বাকিটা ২০মে থেকে শুরু করবো।

      তোমরা কেমন আছো?

      জবাব দিন
  8. নওরীন (৯৪-০০)

    " ‘দুই ফর্ম মিলাইয়া তৌহিদ আবারও ফার্স্ট।’ স্যার আস্তে আস্তে ঘোষনা করলেন। কেও হাত তালি দিল না। স্যার মাথা নিচু করলেন। তারপর চিৎকার করে বললেন,
    ‘ফর্মের মুখে চুন আমর মুখে কালি মারিয়া আবারও ২২ জন ফেল।’
    এইবার জোরে হাত তালি পরলো। "

    হো হো হো!!!!

    জবাব দিন
  9. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    আমারও মজা লাগল।

    স্যারের কি দোষ স্যার তো আর জানতেন না সিনেমায় নায়িকার নামই মণিকা।
    শাহরিয়ারেরই বা কি দোষ। ও তো আর জানতো না স্যারের মেয়ের নাম মণিকা।
    আমি জানতাম। কিভাবে জানতাম সেই গল্প অন্য একদিন।

    কিন্তু মণিকার নাম ক্যামনে জানতা?


    Life is Mad.

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।