মেজাজটা ব্যাপক খারাপ

গতকাল থেকে লস এঞ্জেলস এ বাংলাদেশীরা গ্রীষ্মমেলা উদযাপন করছে। মেলায় নানা ধরণের বাংলাদেশী সামগ্রীর পসরা নিয়ে বসেছে ২০/২৫টা ষ্টল। ভেন্যু shatto recreation center এর মাঠ।

দারুন ব্যস্ততার মধ্যেও গতকাল বিকেলে চলে গেলাম মেলায়। এক বাংলাদেশী ভাই আছেন যিনি সব অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী বাচ্চাদের জন্য চিত্রাংকন ও কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেই ভাইয়ের অনুরোধে তাকে সাহায্য করার জন্য বিকেল ৫টার দিকে পৌঁছলাম মেলা প্রাঙ্গনে। প্রায় ঘন্টা’দুয়েক ধরে পাশাপাশি চলল বাচ্চাদের চিত্রাংকন ও কবিতা আবৃত্তি। আমি চিত্রাংকন শেষে সব বাচ্চার হাতে এক এক করে একটা সার্টিফিকেট আর একটা গিফট তুলে দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে কে একজন বলে গেল যে আমাদের নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুস স্যার এসেছেন লস এঞ্জেলস এ। তিনি মেলাতে আসবেন দ্বিতীয় দিন, অর্থ্যাত আজকে সন্ধ্যায়। আমার সাথে ছিলো বন্ধুতুল্য দুই বাংলাদেশী ছেলে। ওরা কাছাকাছিই থাকে। আমাকে বলল রাতে ওদের বাসায় থেকে যেতে যেন আনলিমিটেড আড্ডা মারা যায়। পরদিন অর্থ্যাত আজ বিকেলে ডঃ ইউনূস স্যারের বক্তব্যও শোনা হবে। আমিও ভাবলাম, কি আর হবে, থেকেই যাই।

রাত দশটা থেকে ইভা রহমান আর শুভ্রদেবের গান শুরু হলো, চলল প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। কর্তৃপক্ষ লাইট নিভিয়ে দেওয়া শুরু করলে গান থামলো। গেলাম সেই ছেলেদের সাথে ওদের বাসায়। আড্ডা চলল অনেকক্ষন। একসময় ওরা ঘুমিয়ে পড়লে আমি নেটে ঢুকলাম। আমার দেশের একটা রিপোর্টে চোখ আটকে গেলো। গ্রামীন ব্যাংকের সেই সুফিয়া খাতুনকে নিয়ে, যাকে সারা বিশ্বের কাছে ডঃ ইউনুস স্যার পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ক্ষুদ্রঋনের মাধ্যমে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হওয়া এক সংগ্রামী নারী হিসেবে। রিপোর্টটার মূল বক্তব্যটা এখানে তুলে না দিয়ে পারলাম নাঃ

“সুফিয়া খাতুন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যান ১৯৯৮ সালে। গ্রামবাসী চাঁদা তুলে তার দাফনের ব্যবস্থা করে। সুফিয়ার পঞ্চাশোর্ধ্ব অসুস্থ দুই মেয়ে হালিমা ও নূর নাহারের এখন দিন কাটে অর্ধাহারে, অনাহারে। তবে অনেক অনুরোধের পর ডঃ ইউনূস তাদের একটি রিকশা দিয়েছেন।

১৯৭৪ সালে ‘জোবরা’ গ্রামের সিকদারপাড়ার অভাবী নারী সুফিয়া খাতুনের হাতে ঋণ হিসাবে প্রথম ২০ টাকা তুলে দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস। বেশি ঋণের আশ্বাস পেয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধ করেন সুফিয়া। নতুন করে ঋণ পান পাঁচশ টাকা। একসঙ্গে এত টাকা পাওয়ার আনন্দে সুফিয়া সেদিন তা সারা গ্রামে জানিয়ে দেন। এর অল্পদিনের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের আওতায় চলে আসে পুরো জোবরা গ্রাম। জোবরার ঘরে ঘরে তখন নগদ টাকার উৎসব। কিন্তু সেই আনন্দ মিলিয়ে যেতে বেশিদিন লাগেনি। সুদে-আসলে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, এলাকা ছেড়েছেন রহিমা ও সায়েরা খাতুনসহ অনেকেই।

আজও জোবরা গ্রামের মানুষদের আক্ষেপ- স্বাবলম্বী করার নামে ডঃ ইউনূসের ‘ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প’ তাদের গরিব থেকে আরো গরিব করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে তারা ‘আশা’র দ্বারস্থ হয়েছেন। আশার টাকা শোধ করতে আবার দ্বারস্থ হয়েছে ‘ব্র্যাক’-এর কাছে।

জোবরা গ্রামের অধিবাসী সাথী উদয় কুসুম বড়-য়া বলেন, ঋণ-বাণিজ্যের মাধ্যমে সহজ-সরল মানুষকে দারিদ্র্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেলে দেয়ার কারণে ডঃ ইউনূসের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।

এদিকে উন্নয়ন মডেল সুফিয়ার পরিবারে এখন প্রকট দারিদ্র্যের চিহ্ন। মাথা গোঁজার কুঁড়েঘরটি ভেঙে পড়ার অপেক্ষায়। গত বর্ষায় তারা অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখনই যদি ঘর মেরামতের ব্যবস্থা করা না যায় তাহলে এই বর্ষায়ও তাদের ভিজতে হবে। সুফিয়ার পরিবার অভিযোগ করে বলেন, বাড়ির যেখানে এমনই দশা সেখানে ডঃ ইউনূস প্রচার করছেন আমাদের নাকি পাকা বাড়ি আছে।

এ প্রসঙ্গে প্রতিবেশী রুকুনুজ্জামান বলেন, অনেকদিন ধরে দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় সুফিয়ার বাড়ির পাশের দোতলা বাড়িটি সুফিয়ার বাড়ি বলে দেখানো হচ্ছে। গ্রামবাসীর মতো ওই দোতলা বাড়ির মালিক দুবাই প্রবাসী জেবল হোসেনও এতে চরম ক্ষুব্ধ। গ্রামবাসীদের তিনি জানিয়েছেন বাড়ি নিয়ে প্রতারণার দায়ে ডঃ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করবেন।”

– প্রতিবেদক আলমগীর নিষাদ এই লেখাটি সাপ্তাহিক ২০০০ এর চলতি সংখ্যায় ‘সূফিয়ার কবর চাঁদার টাকায়/ইউনূসের হাতে নোবেল’ শিরোনামে আজাদ তালুকদারের সরেজমিনে তদন্ত করে লিখা একটা প্রতিবেদন অবলম্বন করে লিখেছেন। আমাদের সময়ের রিপোর্টটির লিঙ্ক (http://www.amadershomoy.com/content/2009/05/22/news0630.htm)

রিপোর্টটা পড়ে মেজাজ পুরাই খারাপ হয়ে গেলো। কিসের মেলা কিসের কি। এমনিতেই ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমার প্রবল হতাশা, তার উপর এমন নিউজ। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম সকালে উঠেই চলে আসবো আমার ডর্মে। মেলার আসল আকর্ষনগুলো আজ ছিলো, সেগুলো ফেলেই।

সকালে আরেক দেশী ভাই ফোন করে দুপুরের দাওয়াত দিলেন এবং বললেন যেতেই হবে, কি নাকি উপলক্ষ আছে। টোকিওতে পরিচয়, সেখানে পিএইচডি করছিলেন তিনি। গেলাম তার বাসায়। ব্যাপক খাবার আয়োজন। শুনলাম তার সিটিজেনশীপের শপথ সামনের সপ্তাহে। বেশ কয়েক ঘন্টা খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা হলো। বিকেল চারটার দিকে তিনি কাজে যাবেন। আমাকে বললেন যাওয়ার পথে তিনি আমাকে মেলায় নামিয়ে দিয়ে যাবেন। বললেন, আজ বিকেলে ডঃ ইউনূস স্যার বক্তৃতা দিবেন।

মেজাজ খারাপ হয়েই ছিলো। কিন্তু তাকে বললাম না কিছু। অনেক প্রবাসীকে দেখেছি ডঃ ইউনূস স্যারকে দেবতার মতো মনে করেন। তার সম্পর্কে তাই খুব হিসেব করে মন্তব্য করা লাগে। আমি বললাম, আমার অনেক পড়া আছে। তাই আমি আর মেলায় যাবো না, ডর্মে ফিরে যাবো। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে মেট্রো বাসে চড়ে ফিরে এলাম। এসেই একটা ঘুম। ইচ্ছে ছিলো ঘুম থেকে উঠে পড়ার। কিন্তু কিসের কি? মাথা থেকে যাচ্ছেই না ক্ষুদ্রঋণ, সুফিয়া খাতুন আর আমাদের দেবতুল্য ডঃ ইউনূস। নিশ্চয় তিনি লস এঞ্জেলসের বাংলাদেশীদেরকে আবার সেই পুরোনো কল্প-কাহিনী শুনিয়ে ব্যাপক হাততালি নিয়েছেন আর সামনের সারিতে বসে নানান মিডিয়ার ছবির জন্য পোজ দিয়েছেন।

আমি এখনো ডঃ ইউনূস স্যারের কোন বক্তৃতা সরাসরি শুনিনি। একটু খানিকটা আফসোস হচ্ছে এই ভেবে যে, প্রবাদতুল্য এই মহামানবের কল্পকাহিনী শোনার একটা দূর্লভ সুযোগ হাতছাড়া করে ফেললাম না তো? আফটারওল, তিনি সাত কোটি স্বদেশীকে ক্রমাগত চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রেখেও দারিদ্র্যকে ‘শীঘ্রই যাদুঘরে’ নিয়ে যাবার গল্প শোনান! আবার ভাবলাম, না থেকে ঠিকই করেছি। সত্যের মতো বদমাশ নয়, বরং আরামদায়ক মিথ্যাকেই বরণ করবে আজকের গ্রীষ্মমেলা। আমার আজ এমন আরামের প্রয়োজন নেই।

৪৮ টি মন্তব্য : “মেজাজটা ব্যাপক খারাপ”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    জয় হো জয় হো

    আমার কাছে ইউনুস সাবের একখান লেকচারের ভিডিও আছে, গুগলে দিছিল লেকচার খান, লইবা নাকি? সাইজ বড়ই।

    সাবে কিন্তুক মারাত্নক ইস্মার্ট আছে। সচলের মাহাবুব লীলেন কইছে, মধ্যপ্রাচ্যে জন্মাইলে নবী হবার চান্স আছিল।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    ডঃ ইউনূস সহ দারিদ্র নিয়ে বাণিজ্য করা সবার কৃতকর্ম একদিন নিশ্চয়ই নিরপেক্ষ আলোর মুখ দেখবে এটাই আশা করি।
    বস্ একটু মাথা ঠান্ডা করেন। আর বলেন, ইভা রহমানের গান কেমন 'দেখলেন' 😀 😉


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  3. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    কথায় আছে না, "প্রচারেই প্রসার"।

    আমাদের মহামানব ডঃ ইউনুস তার ব্যাতিক্রম নয়। আমি আগেও কথা গুলো শুনেছিলাম। ভাইয়া কথা গুলো আমাদের সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ.........।।

    জবাব দিন
  4. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    অনটপিক মন্তব্য করি এইবার। যাদেরকে আমি নাম জানি কিন্তু তারা আমারে চিনে না তাদেরকে আমি সন্দেহের তালিকায় রাখি। এমন লোকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখোশধারী হয়। শওকত ভাই সানা ভাইয়ের কাছে মাফ চাইয়া আরেকটা কথা কই প্রথম আলো যাদের নিয়া লাফায় কিংবা প্রথম আলোর সাথে থেকে যারা নাম করছে তাদেরকেও আমি সন্দেহের চোখে দেখি।
    ইউনুসের এই ব্যাপারগুলোকে বিশ্ব মিডিয়ার তুলে ধরা দরকার। ইদানিং যুগ হইছে ভন্ডামির। সব ঠগগুলোরে আমরা গাধা গরুর মত মহামানব ভাবি। আমাদের চোখ দাও খোদা........

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      চিন্তা কইরো না, মুখোশটা এখন আস্তে আস্তে খুলে পড়ছে। :grr: একাডেমিক আলোচনায় 'হতে-পাত্তেন-নবী' এখন খুবই কম যান। কারণ, মিডিয়ার ব্যাপক প্রচারণার প্রাথমিক আবেশ কেটে গেছে। এখন তৈলাক্ত বাঁশের বদলে বেশিরভাগ জায়গাতে বাঁশ 'উইদ স্যান্ডস' প্রদান করা হয়।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  5. তৌফিক

    এই বিষয়ে পড়াশুনা এতো কম, কিছুই কইতে পারি না। জানিও না ঘটনা-টটনা বিশেষ কিছু।

    তবে এইটুকু জানি, নোবেল পাইতে হইলে তদবির ফদবির করা লাগে। যোগ্য ব্যক্তিই সবসময় পায় বলে মনে হয় না। সঠিক তথ্য দিতে পারব না, তবে আমার মনে হয় কমুনিস্ট পদার্থবিদ, রসায়নবিদ (মানে যে সমস্ত বিদ্যার কোন মেরুকরণ নাই) নোবেল পায় নাই, পাইলেও কম পাইছে।

    জবাব দিন
  6. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ইউনুস সাহেব সম্পর্কে ডিটেইলস তেমন কিছু জানি না, তবে তাকে আমার সবসময় পিওর ব্যবসায়ী মনে হয়... তবে তার তার নোবেল পাওয়ার ঘটনায় বিশাল আনন্দ পেয়েছিলাম

    অফ.ট. ওনার ছোট মেয়ের কারনে অবশ্য ইন্টারনেটে একসময় একটু ঘাটাঘাটি করেছিলাম 😛


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  7. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    কমিটি ও কমিশন মেম্বারশীপ (জাতীয়)- ৯টি
    কমিটি ও কমিশন মেম্বারশীপ (আন্তর্জাতিক)- ২৯টি
    এডভাইজরী বোর্ড মেম্বারশীপ (আন্তর্জাতিক)- ২৭ টি
    পরিচালনা পর্ষদ মেম্বারশীপ (জাতীয়)- ২৫ টি
    পরিচালনা পর্ষদ মেম্বারশীপ (আন্তর্জাতিক)- ২০টি
    পুরস্কার (দেশেও বিদেশে) [নার্ভাস নাইনটি]- ৯৪ টি
    সম্মানসূচক ডিগ্রী (দেশে ও বিদেশে)- ৩৮ টি
    বিশেষ সম্মাননা (দেশে ও বিদেশে)- ৩৯ টি

    আসেন, আমরা সবাই তার সেঞ্চুরী+গিনেস বুকে নাম উঠানোর দাবীতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলি। :grr:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।