পৃথিবীতে মানুষের আগমন নিয়ে ধর্ম গ্রন্থের বয়ান আমরা কম বেশী সবাই জানি। ঈশ্বরের কঠোর নিষেধ সত্ত্বেও শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়ে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আসেন আদম । ঠিক কবে তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন তার সঠিক বর্ননা কোথাও নেই। বাইবেলে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আদম পৃথিবীতে এসেছিলেন প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী আদম ও ইব্রাহীম নবীর মাঝে বয়সের পার্থক্য উনিশশত আটচল্লিশ বছর। মূসা নবী আবির্ভূত হন যিশু খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় তেরো শত বছর আগে। সে হিসাবেও আদি পুরুষ আদম প্রায় ছয় হাজার বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন বলে মনে করা হয়।অন্য কিছু প্রাচীন তথ্য অনুযায়ী এই সময়টাকে অবশ্য ছয় হাজার বছরের চেয়েও বেশী বলে উল্লেখ করা হলেও কোনক্রমেই তা দশ হাজার বছরের বেশী নয়। পুরাকথা ও ধর্মগ্রন্থে আদম নামের যে আদি পুরুষকে আমরা পাই, তিনি কিন্তু অনেকটা আমাদের মতই আধুনিক মানুষ। নগ্নতায় লজ্জিত,প্রেয়সী ঈভের বিরহে কাতর,ন্যায়ে সন্তুষ্ট, অন্যায়ে সোচ্চার।আদম স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে এসেছিলেন এই ধারণার পিছনে বড় যুক্তি হচ্ছে, অন্যান প্রানীর চেয়ে মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা। বানর-শিম্পাঞ্জীকে মানুষের সমগোত্রীয় মনে করা হলেও বুদ্ধিমত্তা ও জীবন যাপনের পার্থক্য এতই প্রকট যে মানব জাতি মর্ত্য জাত নয় বরং স্বর্গ থেকে আগত এমনটি মনে হওয়া স্বাভাবিক।
অন্যদিকে বিজ্ঞান জানাচ্ছে, প্রায় সত্তর লক্ষ বছর আগে শিম্পাঞ্জী (বনোবো) ও মানুষ বিবর্তনের ধারায় একই সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যায়।আদি মানব হোমো এর আবির্ভাব ঘটে আফ্রিকায়, প্রায় চব্বিশ লক্ষ বছর আগে। সেখান থেকে ক্রমশঃ তারা অন্য মহাদেশ গুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।ফসিল গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে, আদি মানব হোমোর আবার গোত্র বিভাগ ছিল। ক্রম বিবর্তনে কোন গোত্রের আবির্ভাব ঘটেছে আগে কোনটার পরে। কোন কোন গোত্র আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কেউ টিকে থেকেছে নিকট অতীত পর্যন্ত। এই বিবর্তনের পথে হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষ মানুষের আবির্ভাব ঘটে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে, আফ্রিকায়। ততদিনে আফ্রিকা ও ইউরেশিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে হোমো ইরেক্টাস, ইউরোপ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে হোমো হাইডেলবার্গ, আফ্রিকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে হোমো হাবিলিস গোত্র সমূহ ।আমাদের পুর্বপুরুষ স্যাপিয়েন্স মানবের আবির্ভাবের সমসাময়িক কালে ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলে বসবাস করতো একটি ভিন্ন গোত্রের হোমো গোষ্ঠী, যাদের নাম হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস (নিয়ানডার্থাল মানব)। জীবাশ্ম-নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে জানা যায় প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে ঐ অঞ্চলে নিয়ানডার্থাল মানবের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং মাত্র পচিশ হাজার বছর আগ পর্যন্ত তারা বেঁচে ছিল। নিয়ানডার্থাল মানব বিলুপ্ত হবার পর হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স, অর্থাৎ আমরা ছাড়া হোমো গোত্রের আর কেউ অবশিষ্ট থাকেনি।
ধর্ম ও বিজ্ঞান দুটো আলাদা বিষয় হলেও সময়ের অঙ্কে, নিয়ানডার্থাল মানবের বিলুপ্তির প্রায় পনেরো হাজার বছর পরে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক ধর্মগ্রন্থ থেকে আদমের আবির্ভাবের কথা জানা যায়। পুরাকালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ত্রিশ বছর। সে হিসেবে নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্ত হবার প্রায় পাঁচশো প্রজন্ম পর, যখন আশেপাশে সমমানের বুদ্ধি সম্পন্ন অন্য কোন কোন প্রাণী নেই, তখন মানুষের মাঝে প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্ম নেওয়াটাই স্বাভাবিক যে মানুষ মর্ত্য জাত নয় বরং স্বর্গ থেকে আগত । সে সময়ে মানুষের ভাষা পুর্ণাঙ্গ রূপে বিকশিত হয়নি, ইতিহাস বলতে গোছানো কোন তথ্য ছিল না। যা ছিল তা হলো পিতা প্রপিতামহের কাছে শোনা গল্প।ফলে পাঁচশো প্রজন্ম পরে রূপকথার নরখাদক রাক্ষস ছাড়া নিয়ানডার্থাল সম্পর্কিত কোন ইতিহাসই উত্তরাধিকার সূত্রে অবশিষ্ট থাকেনি। এখন আমরা নিয়ানডার্থালদের সম্পর্কে যা জানছি তার সবটাই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও ফসিল গবেষণার ফসল।
নিয়ানডার্থালদের আবির্ভাব ঘটেছিল শেষ তুষার যুগে।ফলে তাদের দৈহিক গঠন ও জীবন যাত্রা ছিল শীতল আবহাওয়ার উপযোগী। নিয়ানডার্থালদের বিলুপ্তির কারণ হিসেবে এ পর্যন্ত তিনটি প্রস্তাবিত তত্ত্ব রয়েছে। প্রথম তত্ত্ব, প্রায় পচিশ হাজার বছর আগে শেষ বরফ যুগের অবসান ও আবহাওয়া বিপর্যয় ঘটলে, পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্ত হয়ে যায়।দ্বিতীয় তত্ত্বটিকে অনেকে প্রাগৈতিহাসিক ট্রাজেডি বলে অভিহিত করেছেন। হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্সের আধুনিক প্রজন্মকে বলা হয় ক্রো-ম্যাগনন মানুষ, যারা ত্রিশ হাজার বছর আগে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় নতুন করে নিজেদের বসতি বিস্তার লাভে সক্ষম হয়। ধারণা করা হয়,আমাদের প্রত্যক্ষ পূর্ব পুরুষ এই ক্রো-ম্যাগননরা, বসতি বিস্তার ও খাদ্য সংকট মোকাবিলা করার মোক্ষম পন্থা হিসেবে প্রতিদ্বন্দী নিয়ানডার্থালদের মেরে ফেলেছিল। তৃতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, নিয়ানডার্থালরা আদৌ বিলুপ্ত হয়নি বরং অন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে তারা ক্রমাগত মিশে গিয়েছে ক্রো-ম্যাগনন মানুষ অর্থাৎ আমাদের সাথে।
এই তিন তত্ত্বের মধ্য আবহাওয়া বিপর্যয়কে অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। নিয়ানডার্থালদের প্রথম ফসিল পাওয়া যায় ১৮৫৬ সালে, জার্মানির নিয়ানডার উপত্যকায়। পরবর্তীতে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার নানা অঞ্চলে তাদের অনেক ফসিল আবিষ্কৃত হয়। মুসটিয়ের এলাকায় তাদের ব্যবহৃত পাথুরে অস্ত্রের সন্ধান প্রাপ্তির সূত্রে নিয়ানডার্থাল সংস্কৃতিকে মুসটিয়েরিয়ান সংস্কৃতি বলা হয়। নিয়ানডার্থালরা ছিল শিকারি জাতি। পুরুষের গড় উচ্চতা একশো পয়ষট্টি সেন্টিমিটার, হাড়ের শক্তিশালী গড়নের কারণে ভারী শরীর।দৈহিক দিকে দিয়ে ক্রো-ম্যাগনন মানুষের চেয়ে শক্তিশালী ছিল তারা, মস্তিষ্কের আয়তন মানুষের চেয়ে সামান্য বেশী থাকায় বুদ্ধির কমতি ছিল না। চোখের কোটরের আকার ছিল বড়, সম্ভবত দৃষ্টি শক্তিও প্রখর ছিল তাদের। মানুষের তুলনায় নাক বড় ছিল, ঠান্ডা বাতাস ফুসফুসে যাবার আগে বড় নাকের ভিতরে উষ্ণায়িত হতো। ঘ্রাণ শক্তিও মানুষের চেয়ে প্রখর ছিল বলে ধারণা করা হয়। বক্ষপিঞ্জর প্রশস্ত, নিতম্ব ও হাত-পায়ের হাড়গুলো ছিল মোটা, তবে দেহের অনুপাতে হাত-পায়ের দৈর্ঘ্য খাটো ছিল।এ ধরনের দৈহিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত শীতল আবহাওয়ায় শরীরে তাপ ধারণ করে টিকে থাকার জন্য উপযোগী।তবে সে জন্য প্রত্যহ প্রায় পাঁচ হাজার কিলো ক্যালরি পরিমান খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন হতো। এই পরিমান ক্যালোরির প্রয়োজনে ম্যামথ, বল্গা হরিণ বা পাহাড়ী ভালুকের মতো বড় প্রাণী শিকার করতো নিয়ানডার্থালরা। শেষ বরফ যুগের অবসানের সাথে সাথে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেলেও নিয়ান্ডার্থালরা তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে পারেনি। অপর দিকে মানুষের খাদ্যাভাসে বাছ বিচার তেমন ছিল না এবং প্রাত্যহিক ক্যালরির প্রয়োজনও ছিল কম। মানুষ লতা পাতা, ফল-মূল, মাছ, শামুক, মাংস সবই খেতে পারতো। ফলে নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে টিকে গিয়েছিল মানুষ।
নিয়েনডার্থালদের বিলুপ্তি সম্পর্কিত দ্বিতীয় তত্ত্বটি হচ্ছে নির্বিচার হত্যা যার জন্য দায়ী আমাদের পুর্ব প্রজন্ম, ক্রো-ম্যাগনন মানুষ। নিয়ান্ডার্থালদের তুলনায় ক্রো-ম্যাগননরা কম শক্তিশালী হলেও তাদের গড়ন ছিল অপেক্ষাকৃত হাল্কা যা তাদের দিয়েছিল ক্ষীপ্রতা ও গতি। অস্ত্রগুলো ছিল তুলনামূলক বিচারে উন্নত। খাদ্য তালিকা বহুমূখী হলেও নিয়ান্ডার্থালদের মত স্যাপিয়েন্সরাও ক্রমাগত শিকার নির্ভর হয়ে উঠেছিল। ফলে দুই জাতির মধ্য রক্তক্ষয়ী সংঘাত ছিল অনিবার্য, যার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে ফসিল গবেষণার মাধ্যমে।১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত স্পেনের সিড্রন গুহায় পাওয়া গেছে প্রায় পনেরোশো নিয়ানডার্থাল অস্থি খন্ড। এগুলো ছিলো পাঁচ প্রাপ্ত বয়স্ক, দুই কিশোর, এক বালক ও এক শিশুর। এর মধ্যে খুলির হাড়ে পাওয়া যায় অস্ত্রের আঘাত, যা মানুষের তৈরী অস্ত্রের সাথে মিলে যায়। শুধু আঘাত নয়, কিছু হাড় ধারালো অস্ত্র দিয়ে এমন ভাবে কাটা হয়েছে যা দেখে বোঝা যায় সেগুলোর সাথে যুক্ত মাংস ছাড়িয়ে নেয়া হয়েছিলো।
তৃতীয় তও্ব, নিয়ানডার্থাল এবং স্যাপিয়েন্সদের মধ্য অন্তঃপ্রজনন। নিয়ানডার্থাল ও মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য তেমন প্রকট ছিলনা।১৯৯৫ সালে স্লোভেনিয়ার ডিভেই বাবে গুহায় পাওয়া তেতাল্লিশ হাজার বছর আগেকার একটি বাঁশী যা নিয়ানডার্থালদের তৈরী বলে মনে করা হয়। অপর দিকে জার্মানীর হোল ফেলস গুহায় পাওয়া গিয়েছে পয়ত্রিশ হাজার বছর আগে আদি মানুষের তৈরী বাঁশী।এ থেকে বোঝা যায় সে কালে দুই প্রজাতীর মধ্যেই সুরের ধারণা ছিল।দুই জাতিই শিকার করার জন্য নানা ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করতো, জানতো আগুনের ব্যবহার। মৃতদের কবর দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইসরায়েলের কোবারা গুহায় প্রাপ্ত ফসিলের মাধ্যমে জানা গেছে, নিয়ানডার্থালদের গলার অস্থি ও বাগযন্ত্রের গড়ন ছিল অনেকটা মানুষের মতো। নিয়ানডার্থাল ডিএনএ নিয়ে গবেষণায় জানা গেছে, যে জিন এর কারণে মানুষ কথা বলতে পারে, ফক্সপি২ নামক সেই জিনটি তাদেরও রয়েছে। ফসিল ও জেনেটিক গবেষণা যত এগুচ্ছে মানুষ ও নিয়ানডার্থালদের পার্থক্য তত সংকুচিত হয়ে আসছে। সেই প্রেক্ষাপটে, এই দুই গোষ্ঠী দীর্ঘকাল কেবলই মারমারি করেছে একে অপরকে ভালবাসেনি,ভাবাটা কষ্টকর।১৯৯৮ সালে পর্তুগালের লাগার ভেলো গুহায় পাওয়া যায় একটি শিশুর ফসিল। প্রাথমিক ভাবে এটিকে চল্লিশ হাজার বছর পূর্বের মানুষ-নিয়ানডার্থাল শংকর শিশু বলে ধারণা করা হয়, যদিও পরবর্তী গবেষনায় তার সমর্থনে পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলেনি। এ পর্যন্ত ডি এন এ গবেষণার ফলাফলে, এই দুই প্রজাতির মধ্যে অন্তপ্রজনেনর স্বপক্ষে তেমন জোরালো প্রমাণ মেলেনি।অধিকাংশ নৃবিজ্ঞানর অভিমত, দুটি পৃথ শিকারী-সংগ্রহকারী প্রাণীর সহাবস্থান শান্তিপূর্ণ না হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।
নৃবিজ্ঞান গবেষণায় ফসিলের গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘদিন ধরে এই গবেষণা সীমাবদ্ধ ছিল ফসিলের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য, এক্স-রে, আইসোটপ বিশ্লেষণ বা নানা ধরণের স্ক্যানিং পদ্ধতির উপরে। বর্তমানে তার সাথে যুক্ত হয়েছে ডি এন এ বিশ্লেষন, বেরিয়ে আসছে অনেক অজানা তথ্য। এ বিষয়ে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন তাঁদের একজন স্ভ্যান্টে পাবো। ২০১০ সালের জুলাই মাসে বিশ্বখ্যাত সায়েন্স জার্নালে নিয়ানডার্থাল এর জিন বিশ্লেষণের বিষদ ফলাফল প্রকাশ করে পাবো ও তার গবেষক দল। এর মধ্যে নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে দুটি তথ্য। প্রথমত, আফ্রিকার বাইরে অর্থাৎ এশিয়া ও ইউরোপের বর্তমান মানুষদের শতকরা এক থেকে চার ভাগ জিন উত্তরাধিকার সূত্রে নিয়ানডার্থালদের কাছ থেকে পাওয়া। সময়ের হিসেবে প্রায় আশি হাজার বছর আগে নিয়ানডার্থাল মানবদের সাথে আদি স্যাপিয়েন্স মানুষদের অন্তঃপ্রজননের ফলে এই জিন প্রাপ্তি ঘটেছিল, যে কারণে আফ্রিকার মানুষের মাঝে এই জিন পাওয়া যায় নি। দ্বিতীয়ত, সেই অন্তঃপ্রজনন ছিল একমুখী, অর্থাৎ মানুষের একাংশের মাঝে নিয়ানডার্থালদের জিন পাওয়া গেলেও নিয়াডার্থালদের মাঝে মানুষের কোন নির্দিষ্ট জিন পাওয়া যায় নি।
নৃবিজ্ঞানীদের চমকে দেওয়া এই জিন বিশ্লেষণ ফলাফলের পটভূমি আর এক বার দেখে নেওয়া যাক।এক লক্ষ বছর আগে আমাদের আদি পুরুষ, অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স মানবদের একটি অংশ আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে পাড়ি জমায়।সে সময় মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে বাস করতো নিয়াডার্থাল মানবেরা। শান্তিপূর্ণ না হলেও স্যাপিয়েন্স ও নিয়াডার্থালদের সহাবস্থান কাল ছিল প্রায় পচাত্তর হাজার বছর। তার পর স্যাপিয়েন্সরা আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম ক্রো-ম্যাগনন মানুষে রূপান্তরিত হয়।সেই রূপান্তরের পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে দ্রুত বিলুপ্তি ঘটে নিয়াডার্থালদের। তথ্যগুলোয় ফাঁক রয়েছে, রয়েছে অনেকগুলো জলন্ত প্রশ্ন। প্রায় আশি হাজার বছর আগে নিয়ান্ডার্থালদের সাথে মানুষের অন্তঃপ্রজনন এক মুখী ছিল কেন? ফসিল রেকর্ডে স্যাপিয়েন্স-নিয়াডার্থাল শংকর প্রজাতি অনুপস্থিত কেন? লক্ষ বছরের পরিক্রমায় নিয়ান্ডার্থালদের বিবর্তন প্রক্রিয়া তরান্বিত হয়নি, তাহলে স্যাপিয়েন্সরা ক্রো-ম্যাগনন মানুষে রূপান্তরিত হলো কেন? জীবাশ্ম-নৃতাত্ত্বিক গবেষণা এখন পর্যন্ত এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি, তবে এ সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে প্রস্তাবিত একটি তত্ত্ব দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বোদ্ধাদের।
তত্ত্ব প্রস্তাবকের নাম ড্যানি ভেন্ড্রামিনি।অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী ভেন্ড্রামিনি প্রথিতযশা নৃবিজ্ঞানী নন, এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীও নেই তার। তবে নৃবিজ্ঞানে স্ব-শিক্ষিত তিনি এবং এ বিষয়ে প্রবন্ধ, বইও লিখেছেন। বইয়ের নাম, দেম প্লাস আস (তারা যোগ আমরা)। নানা তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে তিনি উপস্থাপন করেছেন, নিয়ানডার্থাল প্রেডেটর তত্ত্ব।তার তত্ত্ব অনুযায়ী নিয়ানডার্থালরা ছিল শিকারজীবি এবং তাদের জীবন যাত্রার সঙ্গে মিল ছিল বাঘ-সিংহ জাতীয় মাংসাশী শিকারী প্রাণীর। এসব প্রাণী অন্যান্য প্রাণীদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করার সাথে সাথে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে হিংস্র এবং আক্রমণাত্মক আচরণ প্রদর্শন করে।দীর্ঘ পচাত্তর হাজার বছর যাবত আদি মানুষের সাথে নিয়ানডার্থালদের আচরণ ছিল এরকম হিংস্র এবং আক্রমণাত্মক।
আদি মানুষের মাঝে শ্রমের শ্রেনিবিভাগ ছিল, যেমন শিশু ও মেয়েরা গুহায় থাকতো, শিকারে যেত পুরুষেরা। নিয়ানডার্থালদের এ রকম শ্রেণীবিভাগ ছিলনা।শিশু, মেয়ে, পুরুষ সবাই একসাথে শিকার করত, ফলে তাদের ভিতরে শিকারী প্রবৃত্তি ছিল প্রায় জন্মগত।প্রকৃতিতে শিকারী নিয়ানডার্থালদের অবস্থান ছিল ফুড চেইনের শীর্ষে, মানুষের অবস্থান তাদের নীচে। মানুষের চেয়ে দৈহিক দিকে দিয়ে অধিক শক্তিশালী, প্রখর দৃষ্টি ও ঘ্রাণশক্তি সম্পন্ন নিয়ানডার্থালরা নিজেদের বিবেচনা করতো খাদক এবং বাকী সব প্রাণী এমনকি মানুষকে মনে করতো তাদের খাবার। ভেন্ড্রামিনির মতে, প্রায় এক লক্ষ বছর আগে আদি মানুষ আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া-ইউরোপে এলে নিয়ানডার্থালদের হিংস্র আক্রমণের শিকার হয়। অনেককে মেরে, ক্ষেত্র বিশেষে খেয়ে ফেলা হয়। ভেন্ড্রামিনি ক্রোয়েশিয়া, ফ্রান্স ও স্পেনের একাধিক ফসিল সাইটের উল্লেখ করেছেন যেখানে নিয়ানডার্থালরা যে নরখাদক ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্রোয়েশিয়ার ভিন্ডিযা গুহা সহ অন্যান্য গুহায় প্রাপ্ত নিয়ানডার্থালদের হাড়ের কার্বন ও নাইট্রোজেন আইসোটোপ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে তাদের খাদ্যে শব্জির পরিমান ছিল প্রায় শূন্য। সে তূলনায় মানুষের খাদ্যের অর্ধেকটা ছিল উদ্ভিদ জাত।
মানুষকে আক্রমণ করার একটি বাড়তি কারণও ছিল নিয়ানডার্থালদের। তা হলো যৌন লিপ্সা। মানুষ ও নিয়ানডার্থেলদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কাঠামোগত কিছু পার্থক্য থাকলেও উভয়ই আদি হোমো গোত্রীয় হওয়ায়, মৌলিক মিল ছিল।শক্তিশালী নিয়ানডার্থাল পুরূষের কাছে দুর্বল মানব নারী ছিল লোভনীয় যৌন শিকার। নিয়ানডার্থাল নারীরা ছিল শিকারী এবং স্বাভাবিক ভাবেই শক্তিশালী। ফলে পুরুষের যৌন চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে তাদের উপরে জোর জবরদস্তি খুব একটা কার্যকর হবার কথা নয়। অন্য দিকে অপেক্ষাকৃত কম হিংস্র ও দুর্বল মানব নারীদের উপরে বলাৎকার করা সহজতর ছিল। প্রাণী জগতে মেয়েদের ডিম্বক্ষরনের সাথে হরমোন ও ফেরোমনের নিঃসরণ সম্পৃক্ত। এই ফেরোমেনের গন্ধ অনেক পুরুষ প্রাণীর নাকে মেয়েদের ডিম্ব ক্ষরন ও যৌন মিলনের সংকেত পৌঁছে দেয়, পুরুষদের মিলনোন্মুখ করে তোলে। প্রখর দৃষ্টি ও ঘ্রাণ শক্তি সম্পন্ন নিয়ানডার্থালরা অনেক দূর থেকেও মানুষের উপস্থিতি টের পেতো। সেই সাথে টের পেতো মেয়েদের ডিম্বক্ষরনের সময়ে নিসৃত ফেরোমনের গন্ধ, যা তাদের জৈবিক কারণেই উত্তেজিত করে তুলতো।
ভেন্ড্রামিনির তত্ত্ব অনুযায়ী, এক লক্ষ বছর আগে উত্তর আফ্রিকায় মরুকরণ শুরু হলে সেখানকার অনেক মানুষ প্রথমে লেভান্ট অঞ্চলে দেশান্তরিত হয়। লেভান্ট হচ্ছে আফ্রিকা ও ইউরোপকে সংযুক্তকারি মধ্যপ্রাচ্যের অঞ্চল, বর্তমানে যেখানে জর্ডান, ইসরাইল, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, তুরষ্ক রাষ্ট্রসমূহ অবস্থিত। এই অঞ্চল থেকে তুরষ্ক পেরিয়ে কৃষ্ণ সাগরের পুর্ব ও পশ্চিম পাড় ধরে আদি মানুষ সে সময়ে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া ঢুকেছিল। তবে নিয়ানডার্থালদের ক্রমাগত আক্রমণে হারিয়ে যেতে থাকে তারা। এমনকি লেভান্ট অঞ্চলেও মানব জনসংখ্যা আশংকাজনকভাবে হ্রাস পায়।ভেন্ড্রামিনি একে বলেছেন জনসংখ্যার “বটল নেক” (বোতলের সরু গলা) ক্রান্তি কাল। ফসিল গবেষকদের তথ্য অনু্যায়ী আশি হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যবর্তী সময়ে সবচেয়ে কম সংখ্যক মানব ফসিল পাওয়া গেছে লেভান্ট অঞ্চলে, যদিও একই সময়ে সেখানে পাওয়া গেছে নিয়ানডার্থালদের অনেক ফসিল। আগে আদি মানুষ ব্যবহার করতো পরে নিয়ানডার্থালরা ব্যবহার করেছে, এমন একাধিক গুহার সন্ধানও পাওয়া গেছে এ অঞ্চলে।
ফুড চেইন এ শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখতে শিকারী নিয়ানডার্থালরা নির্ভর করেছিলে দৈহিক শক্তি ও সামর্থ্যের উপর।অপরদিকে তাদের শিকার না হবার জন্য কৌশলের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষের। উত্তর আফ্রিকা তখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে ফেরার জায়গা নেই, কৌশলে টিকে না থাকতে পারলে মৃত্যু অবধারিত। ফলে, টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলিই প্রাকৃতিক ভাবে ক্রমাগত নির্বাচিত হতে থাকে মানুষের জেনেটিক কোড এ। ক্রো-ম্যাগনন মানব সেই ক্রমাগত রূপান্তরের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ।
ভেন্ড্রামিনির মতে, ক্রো-ম্যাগনন মানুষের অধিকাংশ শারীরিক ও সামাজিক পরিবর্তনই ঘটেছিল শিকারী নিয়ানডার্থালদের প্রতিরোধকল্পে। ক্রো-ম্যাগননদের হাত পায়ের হাড় নিয়ানডার্থালদের তুলনায় হালকা হলেও তাদের পেশী ছিল দ্রুত দেহ সঞ্চালনের উপযোগী,যেমন দ্রুত আঘাত করা বা দ্রুত দৌঁড়ে পালানো। নিয়ানডার্থালরা মূলত হাতে ধরা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে শিকারে অভ্যস্ত হলেও ক্রো-ম্যাগননরা বর্শা জাতীয় ছুঁড়ে মারার অস্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। আদি স্যাপিয়েন্স মানুষ মূলতঃ খাদ্য আহরণকারী হলেও ক্রো-ম্যাগননরা কালক্রমে শিকারে দক্ষত অর্জন করে। আক্রান্ত হলে পালিয়ে আত্মরক্ষা নয়,পাল্টা আক্রমণ করতে শেখে তারা। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জিততে বড় জোট তৈরী করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। আদি মানুষ বিশ পচিশ জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবার ভিত্তিক দলে বিভক্ত হলেও ক্রো-ম্যাগননদের ভিতরে সংস্কৃতি চর্চা যেমন সঙ্গীত এবং ধর্মীয় প্রথার প্রচলন শুরু হয়।এর ফলে পরিবারের বাইরে একই সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় পরিমন্ডলের মানুষকে স্বদলীয় ভাবা সহজতর হয়ে ওঠে এবং বড় দল গঠন করা সম্ভবপর হয়। নিয়ানডার্থালদের বিরুদ্ধে ক্রো-ম্যাগনন মানুষের আত্মরক্ষা বা আক্রমণ উভয়ই হয়ে ওঠে অধিক সম্মিলিত ও কৌশলী।তীব্র দৃষ্টি ও ঘ্রাণ শক্তির সাথে পাল্লা দিতে বুনো কুকুর বা নেকড়ে জাতীয় প্রাণীকে পোষ মানিয়ে ব্যবহার করা শুরু হয়।
পোষাক পরার প্রচলন চালু হয়। এর ফলে এক দিকে যেমন তীব্রে শীতে কম ক্যালরির খাদ্য গ্রহণ করে টিকে থাকা সহজতর হয়,অন্যদিকে তা ক্যামোফ্লেজ হিসেবে কাজ করে। পোষাক অর্থাৎ অন্য প্রাণীর চামড়া বা লতাপাতায় শরীর ঢাকার ফলে মেয়েদের শরীর থেকে নিঃসৃত ফেরোমনের গন্ধ লুকোনো সহজতর হয়। সেই সাথে শরীর ধোয়ার (স্নান)অভ্যাসও গড়ে ওঠে। এর ফলে গায়ের লোম কমে যেতে থাকে চমড়া হতে থাকে মসৃন।যৌন মিলন ও প্রজননের ক্ষেত্রে শিম্পাঞ্জী বা বনোবোদের ভিতরে বহুগামিতা পরিলক্ষিত হয়। আদি মানুষ বা নিয়ানডার্থালরাও ছিল বহুগামী। তবে মানব নারীদের দ্বারা প্ররোচিত নিয়ানডার্থালদের আক্রমণ এড়াতে ক্রো-ম্যাগনন মানুষের মাঝে একগামিতা গড়ে ওঠে । একজন নারী কেবল একজন পুরুষের সাথে যৌন মিলন ও প্রজনন ঘটাবে এই নিয়ম নারীদের জন্য অহেতুক আত্মপ্রদর্শনের অন্তরায় হয়ে ওঠে।আক্রান্ত হলে নির্দিষ্ট পুরুষ তাকে রক্ষা করবে, গড়ে ওঠে সেই নিয়ম।পারিবারিক উত্তরাধিকার প্রথা প্রচলিত হয় যার সাথে যুক্ত হয় শিশু হত্যা। অনাকাংখিত শিশু, বিশেষ করে নিয়ানডার্থাল-মানব শংকর শিশু জন্মালে তা হত্যা করা হয়।এত সব দৈহিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটিয়ে ক্রো-ম্যাগননরা বিজয়ী হতে শুরু করে নিয়ানডার্থালের সাথে প্রতিযোগিতায়। পুনর্বার ইউরোপ এশিয়া সহ সব মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে তারা।
অপর দিকে নিয়ানডার্থালদের যে নিজস্ব সমাজ কাঠামো, সংস্কৃতি বা ধর্ম ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে দীর্ঘকাল ফুড চেইনের শীর্ষে অবস্থান করার কারণে, বদলে যাবার বা বিরূপ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার চাপ কম ছিল। শেষের দিকে চাপে পড়ে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা তারাও করেছিল। জিব্রাল্টারের গোরহাম গুহা ও ভ্যানগার্ড গুহায় প্রাপ্ত ফসিল থেকে জানা গেছে চব্বিশ হাজার বছর আগে কেবল ম্যামথ বা বিশাল স্থলচারী প্রাণী নয়, ডলফিন ও সিল মাছ শিকার করতো নিয়ানডার্থালরা, ঝিনুক কুড়াতো সমুদ্রের তীরে। তবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সেই চেষ্টা বোধ হয় বেশী দেরীতে হয়েছিল কারণ ততদিনে ক্রো-ম্যাগননরা দলে দলে ছড়িয়ে পড়েছে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে।
ভেন্ড্রামিনি তত্ত্ব এখনো জীবাশ্ম-নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানীদের দ্বারা সার্বজনীন ভাবে স্বীকৃত নয়। তবে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত অন্যান্য গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে প্রস্তাবিত হওয়ার কারণে কেউ তা অস্বীকারও করতে পারছে না। “আশি হাজার বছর আগে নিয়ানডার্থালদের সাথে মানুষের একমুখী অন্তঃপ্রজনন ঘটেছিল” নৃবিজ্ঞানী পাবো ও তার দলের সদ্য প্রকাশিত ডিএনএ বিশ্লেষনের ফলাফল ভেন্ড্রামিনি তত্ত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ন।সেই প্রেক্ষাপটে বলা যায়,অতি আগ্রাসী জীবনই নিয়ানডার্থালদের বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং তাদের স্থান দখল করে নিয়েছিল ক্রো-ম্যাগনন মানুষ। তার পর ত্রিশ হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ক্রো-ম্যাগননদের উত্তরাধিকারী আধুনিক মানুষের আগ্রাসন কিন্তু এখনও কমে নি। যার ফলে আজ হারিয়ে গেছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ পৃথিবীর অনেক আদি সভ্যতা ও সংস্কৃতি।এই আগ্রাসন যদি অব্যহত থাকে তা হলে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মে গোটা মানুষ জাতিই যে নিয়ানডার্থালদের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে না,এমন গ্যারান্টি কিন্তু নেই।
তথ্যসূত্র:
Abrams, Peter A (2000): The Evolution of Predator-Prey Interactions: Theory and Evidence. Annual Review of Ecology and Systematics 31: 79-105.
Bar-Yosef (2002): The Upper Paleolithic Revolution. Annual Review of Anthropology, 31, Academic Research Library. 363–393.
Burbano HA, Hodges E,, Pääbo S et al (2010): Targeted Investigation of the Neandertal Genome by Array-Based Sequence Capture. Science 328(5979) 723 – 725.
Clark GA, and Lindly J (1989): Modern human origins in the Levant and Western Asia: the fossil and archeological evidence. Am Anthropol 91: 962–985.
Dan J: The Neanderthal within. New Scientist (March 2007).
Defleur A, Dutour O, Valladas H et al (1993). Cannibals among the Neanderthals? Nature. 1993, Mar 18;362(6417):214.
Doniger W, Webster M (1999) Merriam-Webster’s Encyclopedia of World Religions, Merriam-Webster Inc. ISBN 0-87779-044-2
Duarte C, Maurício J, Pettitt PB, Souto P et al(1999) The early Upper Paleolithic human skeleton from the Abrigo do Lagar Velho (Portugal) and modern human emergence in Iberia’, Proceedings of the National Academy of Sciences 96 (13): 7604–9.
Forster P (2004): Ice ages and the mitochondrial DNA chronology of human dispersals: a review. Phil. Trans. R. Soc. Lond. B 359, 255–264.
Franciscus RG, Trinkaus E (1988): The Neanderthal nose. American Journal of Physical Anthropology 75:209-210.
Green RE, Kraus J, Pääbo S et al (May 2010): A Draft Sequence of the Neandertal Genome. Science 328(5979) 710 – 722.
Hall SS: Last of the Neanderthals. National Geographic, October 2008.
http://www.britannica.com/EBchecked/topic/407406/Neanderthal.
http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_religions
http://en.wikipedia.org/wiki/Neanderthal.
Jared D (1992): The Third Chimpanzee: The Evolution and Future of the Human Animal. Harper Perennial, ISBN 0060984031.
Kate W: Twilight of the Neandertals. Scientific American Magazine, August 2009.
Mellars Paul (2004): Neanderthals and the modern human colonization of Europe. Review article. Nature, 432, 25th November. 461-465.
Richards MP, Pettitt PB, Trinkaus E et al (2000): Neanderthal diet at Vindija and Neanderthal predation: the evidence from stable isotopes. Proceedings of the National Academy of Sciences 97 (13): 7663–6.
Ross CF, Hall MI, Heesy CP (2006): Were basal primates nocturnal? Evidence of eye and orbit shape. In: Ravosa, M.J., Dagosto, M. (Eds.), Primate Origins: Adaptation and Evolution. Kluwer Academic/Plenum, Publishers, New York, 233-256.
Serre D, Langaney A, Pääbo S et al (2007): Early Modern Humans at the Moravian Gate; No Evidence of Neandertal mtDNA Contribution to Early Modern Humans. Chapter 17, Springer Vienna, ISBN978-3-211-23588-1.
Tattersall I, Schwartz JH (1999): Hominids and hybrids: the place of Neanderthals in human evolution. Proceedings of the National Academy of Sciences 96 (13): 7117–9.
Vendramini D (2009): Them and Us: How Neanderthal predation created modern humans. Kardoorair Press, ISBN 9780908244775
অসাধারণ।
নঈম, ধন্যবাদ।
অসাধারণ ভাইয়া..... 🙂
মিশেল, ধন্যবাদ।
আসাধারন একটা লেখা পড়লাম ভাইয়া। একদম মন থেকে বলছি। :boss:
এই লেখা পড়ার পড়ে আবারো সেই পুরোনো হাহাকারটা জেগে উঠলো ভাইয়া "আপনি লেখেন না মোটেই" 🙁
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ, ধন্যবাদ। লিখতে গেলে পড়তে হয়, যে সময় ইদানীং জীবিকার তাগিদে খুব কম পাই। তবে, চেষ্টা করবো।
জটিল একটি লেখা :boss:
নিয়ানডার্থালদের মাথা এবং কোমর বাকানো এপ ম্যান হিসেবে ধারণা করা হতো, আসলে তারা মানব বৈচিত্রের একটি অংশ ।
তানভীর, ধন্যবাদ।
লেখাটাকে অসাধারণ বললে কম বলা হয়। নিয়ানডার্থাল নিয়ে আগ্রহ থাকায় আগে থেকেই অনেক কিছু যেখানে যা পেয়েছি পড়ার চেষ্টা করেছি। প্রায় অনেক তথ্যই চমৎকারভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে লেখাটায়। দারুন।
সে সময়ে আমরা স্পেশাল, সব প্রাণী মরে গেলেও আমাদের কোনো মৃত্যু নেই, সবাইকে আমাদের খেদমতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এমন ধারণা হওয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু এখন আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এসেও কেন মানুষ এসব গালগল্পে বিশ্বাস করে সে সম্পর্কে আপনার কি মত। উত্তর দিতেই হবে এমন না, জাস্ট জিজ্ঞেস করলাম।
রায়হান আবীর, ধন্যবাদ।
< উত্তর দিতেই হবে এমন না>
ভাই অত্যন্ত আসাধারন একটা লেখা। :boss:
শার্লী, ধন্যবাদ।
অসাধারণ :boss:
ধর্মের সাথে মারামারি না করেও যে বিবর্তনবাদ নিয়ে আলাপ করা যায়, তা'র অনন্য এক উদাহরণ আপনার এই লেখা।
ফয়েজ ভাইয়ের মত আমারো আফসোস, "আপনি কেন যে আরো লেখেন না!"
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
ভাই ccb তে কমেন্ট কে লাইক দেওয়ার একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত :thumbup:
আমি এই কথাটাই লিখতে চাইছিলাম ... ধর্মরে গুতাইলে একটা ভালো লেখার পাঠক কমে এবং লেখাটার গ্রহণযোগ্যতাও কমে যায় ।
আলিম ভাই কে ::salute:: ::salute::
মাহমুদ, ধন্যবাদ। তোমার সুন্দর লেখাগুলো ফলো করছি।
ভাইয়া,
আরেকটা কথা। নিয়ান্ডারথাল নিয়ে বেশ খানিকটা আলোচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের দায়ভারটা আরেকটু পরিস্কার করে বললে ভালো লাগত (যদিও শেষ লাইনে হালকা ইঙ্গিত আছে এই বিষয়ে)।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আমাদের দায়ভার বলতে আসলে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, নিয়ান্ডার্থালদের বিলুপ্তির জন্য আমরাই হয়তো প্রকারান্তে দায়ী। তবে সেটা কোন পর্যায়ে, কেন ঘটেছিল সেটাও বিবেচ্য।
অসাধারণ, এরকম লেখাও যে আমজনতার জন্য লেখা যায়, তার প্রমাণ।
এরকম আরও লেখা চাই ভাইয়া!
সাকিব, ধন্যবাদ।
আমাদের কিছু সামাজিক আচরণের ব্যাখ্যা পেলাম। বিবর্তনবাদ নিয়ে আমি বেশি আগ্রহী না। তবুও ভাইয়ার লেখাটা চুম্বকের মতো আটকে রেখেছিল শেষ পর্যন্ত। অসাধারণ বললে কম বলা হয়। খুব ভালো লাগছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂
তৌফিক, ধন্যবাদ। আমিও আসলে নিজে জানার জন্য বিষয়টা নিয়ে পড়েছিলাম। পরে আরো ভাল করে বোঝার জন্য লিখে ফেলি ও শেয়ার করি।
আলীমুজ্জামান ভাই, ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। কিন্তু ভেনড্রামিনির এই প্রস্তাবটায় কিছু সমস্যা আছে।
গৌণ একটা ফিচার দিয়ে শুরু করি। ভেনড্রামিনির কল্পনায় যে নিয়ান্ডারটালকে দেখতে পাচ্ছি আমরা, সে গরিলাসদৃশ রোমশ এক কৃষ্ণবর্ণ দানব। অথচ নিয়ান্ডারটাল মানুষেরা একটা বিরাট সময় পার করেছে বরফ যুগের ভেতর দিয়ে, বেশ উচ্চ অক্ষাংশে। তাদের চামড়ায় ম্যালানিন রেসপন্সও সেরকম হবার কথা, অর্থাৎ ভিটামিন ডি তৈরির জন্যে চামড়ায় আলট্রাভায়োলেট ইনহিবিটর হিসেবে ম্যালানিন কম থাকার কথা, যাতে তুলনামূলকভাবে দুর্বল সূর্যরশ্মি ত্বকে প্রবেশ করতে পারে। ক্রো-ম্যানিয়োঁরা যেহেতু বিষুবীয় বা ক্রান্তীয় অঞ্চলে একটা লম্বা সময় কাটিয়ে তারপরে লেভান্টে ঢোকে, স্বাভাবিকভাবে তাদের গায়ের রং বরং নিয়ান্ডারটালদের তুলনায় গাঢ় হবার কথা, যেহেতু সেখানে সূর্যের প্রকোপ বেশি। কাজেই শুরুতেই দেখতে পাচ্ছি, ভেনড্রামিনি নিয়ান্ডারটালদের ওপর খামাখা চটা।
লোমের ব্যাপারটাও আসুন খতিয়ে দেখি। শীতপ্রবণ অঞ্চলে প্রাণীর গায়ে লোম বড় হবে, চামড়ার নিচে চর্বির পুরু স্তর থাকবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মানুষের সাথে অন্য প্রাণীদের পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে কেবল এই লোম আর চর্বির ওপর নির্ভর করতো না। প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে মানুষ জামাকাপড় পরা শুরু করেছে [এই সময়টা বার করা হয়েছে খুব ইন্টারেস্টিং উপায়ে, গরিলার গায়ের উকুন আর মানুষের মাথার উকুনের মধ্যে জেনেটিক ডিভাইড হিসাব করে], তাই তার গায়ের একটা বড় অংশের লোমই আকারে খুব ছোটো হয়ে গেছে [খালি চোখে দেখলে মনে হবে লোমই নেই]। শীতের প্রকোপে আক্রান্ত নিয়ান্ডারটালদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। অহেতুক বেচারাকে ভাল্লুকের মতো রোমশ হিসেবে কল্পনা করা দেখে আরো নিশ্চিত হওয়া যায়, ভেনড্রামিনি নিয়ান্ডারটালদের উপর চটা।
ফেরোমোনের ব্যাপারেও ভেনড্রামিনির তত্ত্বে কিছু পানি মেশানো আছে। সেটা হচ্ছে মানুষের ওভ্যুলেশন অন্য প্রাণীর মতো প্রকাশিত নয়। আমরা কি রাস্তাঘাটে কোনো মেয়েকে দেখে বুঝতে পারবো, সে এই মুহূর্তে উর্বর কি না? বোঝা সম্ভব না, কুত্তার মতো নাক থাকলেও না, কারণ মানুষ হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র ম্যামাল যেখানে স্ত্রীজাতি তার ওভ্যুলেশন গোপন করে রাখে। এটা নিয়ে জ্যারেড ডায়মন্ডের হোয়াই ইজ সেক্স ফান বইটিতে চমৎকার আলোচনা আছে, সুযোগ হলে পড়ে নেবার অনুরোধ করবো। মানুষের এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের পেছনে একটা ফ্যাক্টর কিন্তু আবার পলিঅ্যাণ্ড্রি। একটি রমণী একাধিক পুরুষের সাথে রমণ করতো, এবং ওভ্যুলেশন তার কাছে গোপন রাখতো বলেই সেই পুরুষটি নিশ্চিত হতে পারতো না, সন্তানটি তার কি না। ফলে একাধিক পুরুষ সেই নারীটির জন্যে গর্ভবতী অবস্থায় প্ররক্ষা আর রিসোর্স যোগাতো।
ফেরোমোনের দ্বিতীয় সমস্যাটা হচ্ছে, এটা একটা খুবই ফাইন টিউনড কেমিক্যাল। কুকুরের ফেরোমোন যেমন শিয়ালের নাকে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে না। একেবারেই ভিন্ন প্রজাতির মানুষের ফেরোমোন নিয়ান্ডারটালদের ওপর কাজ করার কথা নয়।
জামাকাপড় পরে নারীর আত্মপ্রদর্শনের রাস্তা বন্ধ করার ব্যাপারটাও খুব হাস্যকর শোনায় কিন্তু। বরফ যুগে নারী জামাকাপড় খুলে ঘুরেফিরে নিজেকে দেখাচ্ছে, এটা একটা বিরাট হাহাপগে প্রস্তাব। আর পৃথিবীর বহু জায়গায় কিন্তু নারী বেশ খোলামেলা থাকে, সেখানে যৌনসংসর্গের আহ্বানের ব্যাপারটা জামার আকারের হ্রস্বতার ওপর নির্ভর করে না।
লুলপুরুষ নিয়ান্ডারটাল তত্ত্বের এই দুর্বল দিকটা তো গেলো। দুই প্রজাতির মধ্যে কিছু ফিজিওলজিক্যাল ব্যারিয়ার ছিলো, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গর্ভকাল। নিয়ান্ডারটালদের গর্ভকাল ছিলো এগারো মাসের একটু বেশি, ক্রো-ম্যানিয়োঁদের নয়মাসের একটু বেশি। আরেকটি পার্থক্য হচ্ছে খুলির গড়নে। স্যাপিয়েন্স শিশুদের খুলি কিন্তু জন্মের সময় আস্ত থাকে না, বরং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হাড়ের কাঠামোতে থাকে, যাতে বার্থ ক্যানাল পার হবার সময় প্রেশারের বিপরীতে সেগুলো নড়াচড়া করতে পারে। অন্যদিকে নিয়ান্ডারটাল নারীর পেলভিক অঞ্চলও স্যাপিয়েন্স নারীর মতো ছিলো না, আর শিশুদের খুলি ছিলো একক ইউনিট, ফলে নিয়ান্ডারটাল নারীর গর্ভ থেকে স্যাপিয়েন্স শিশুর জন্ম নেয়াটা যতটা সহজ হতো, স্যাপিয়েন্স নারীর গর্ভ থেকে নিয়ান্ডারটাল শিশুর জন্ম নেয়াটা হতো ততটাই কঠিন। কোনো লুলপুরুষ নিয়ান্ডারটাল কোনো স্যাপিয়েন্স নারীকে গর্ভবতী করলে, সম্ভাবনা প্রবল যে সেই বেচারী শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে শিশুটিসহ মৃত্যবরণ করতো।
খুব সম্প্রতি একটা খবর পড়লাম, সেখানে নিয়ান্ডারটালদের একটা অফশুট প্রজাতি মানুষের সাথে সংমিশ্রিত হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। অর্থাৎ, পুরোপুরি নিয়ান্ডারটাল নয়, বরং কিছু নিয়ান্ডারটাল জিন বহন করে, এমন একটি হোমিনিড প্রজাতি স্যাপিয়েন্সদের সাথে মিশে গেছে।
নিয়ান্ডারটালদের বিলুপ্তির ব্যাপারটাকে একটা হঠাৎ ঘটনা হিসেবে দেখার চেষ্টা করলেই এরকম র্যাডিক্যাল তত্ত্ব আসা স্বাভাবিক। কল্পনা করুন, দু'টি প্রজাতি প্রায় চল্লিশ হাজার বছর ধরে একই হ্যাবিট্যাট শেয়ার করছে, তাদের মধ্যে একটি প্রজাতি একটু এগিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই অন্য প্রজাতিটি কোণঠাসা হয়ে পড়বে। নিয়ান্ডারটালদের ক্ষেত্রেও সেরকমই ঘটেছে।
কেন ক্রো-ম্যানিয়োঁরা এত অগ্রসর ছিলো, সে নিয়েও অনেক স্পেকুলেশন রয়েছে। এর একটি বড় কারণ ছিলো, আফ্রিকা ত্যাগের আগে ক্রো-ম্যানিয়োঁরা যে অঞ্চলে ছিলো, সে অঞ্চলের ক্লাইমেট। দেখা গেছে, আবিসিনিয়ার সেই উপত্যকাগুলি অত্যন্ত তীব্র জলবায়ু পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে সে সময়। এ বছর খরা তো পরের বছর অতিবৃষ্টি, এ পরিস্থিতি তখন ছিলো খুব স্বাভাবিক। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল জলবায়ুর ভেতর দিয়ে ক্রো-ম্যানিয়োঁদের পূর্বপুরুষ প্রতিবেশের সাথে অভিযোজনের ব্যাপারটি খুবই দক্ষতার সাথে আয়ত্বে আনে বলে ধারণা করা হয়। ভেনড্রামিনি যে গোষ্ঠীবদ্ধতার উদ্ভবের কথা বলেছেন, সেই গোষ্ঠীবদ্ধতা এ ধরনের বড় ক্লাইম্যাটিক চেইঞ্জের কারণেই ঘটেছে বলে মনে করেন অনেকে। টিকে থাকার জন্যে বিভিন্ন ধরনের স্ট্র্যাটেজি অবলম্বনের কৌশলও তারা এ সময় আয়ত্বে আনে। অন্যদিকে নিয়ান্ডারটালদের পৃথিবীটা ছিলো কখনও কম ঠাণ্ডা, কখনও বেশি ঠাণ্ডা, ফলে তাদের ঝুড়িতে খুব বেশি স্ট্র্যাটেজি ছিলো না। এটা তাদের পরবর্তী প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেয়।
আরেকটা বড় সমস্যা ছিলো নিয়ান্ডারটালদের শিকার পদ্ধতি। তারা ছিলো অ্যামবুশ হান্টার, ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে আচমকা বেরিয়ে গুতাগুতি করে শিকার মারতো। নিয়ান্ডারটালদের যতগুলো সম্পূর্ণ কঙ্কাল পাওয়া গেছে, দেখা গেছে প্রায় প্রতিটিতেই একটি হাত অপর হাতের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাদের হাতের প্রায় সব আঙুলই সমান মোটা আর শক্তিশালী ছিলো। এ থেকে ধারণা করা হয়, তাদের শিকার পদ্ধতি ছিলো মূলত থ্রাস্টনির্ভর। অপেক্ষাকৃত দুর্বল হাত দিয়ে বল্লম গাইড করা হতো, আর শক্তিশালী হাত থ্রাস্টে ব্যবহার করা হতো। নিয়ান্ডারটালদের বল্লম আর ফলা পরীক্ষা করেও দেখা গেছে, সেগুলো ঠিক অ্যারোডাইনামিক নয়, নিক্ষেপের জন্যে ব্যবহার করা হতো না। অন্যদিকে ক্রো-ম্যানিয়োঁরা ব্যবহার করতো হালকা শিং আর হাড়ের বল্লম, যেগুলো ছুঁড়ে মারার জন্য একটা বিশেষ বল্লম নিক্ষেপকও তারা ব্যবহার করতো। এগুলোর রেঞ্জ ছিলো অনেক বেশি, কার্যকারিতাও। ফলে তারা দূর থেকে শিকারের গায়ে বল্লম মেরে সেটাকে দুর্বল করে ফেলতে পারতো।
নিয়ান্ডারটালদের মাথায় প্রথম বাড়িটা মারে আবহাওয়া। ঝোপঝাড় কমে যাওয়ায় তাদের অ্যামবুশ টেকনিক মাঠে মারা যায়। খোলা প্রান্তরে শিকারের দক্ষতা তাদের ছিলো না। ফলে এখানে তারা ক্রো-ম্যানিয়োঁদের কাছে ধরা খায়।
দ্বিতীয় সমস্যাটা শারীরবৃত্তীয়। নিয়ান্ডারটালরা খুব আঁটসাঁট গড়নের। কোমর বলে তাদের কিছু ছিলো না, বিশাল রিব কেজের নিচেই পেলভিক এরিয়া। এই গড়নটা দৌড়ানোর জন্য উপযোগী নয়। অন্যদিকে স্যাপিয়েন্সের বিবর্তনের পেছনে দৌড়টাই একটা বিরাট প্রভাবক ছিলো। এর প্রমাণ আজও দেখা যায় আমাদের গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস, যাকে আমরা কাচা বাংলায় পাছা বলি, তাতে। এই বিরাট পেশী দৌড়ের সময় আমাদের শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখে। পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীর গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস শরীরের আকারের তুলনায় এত বড় নয়। দৌড়ে দক্ষ ক্রো-ম্যানিয়োঁরা তাই খোলা প্রান্তরের সুবিধা বেশি নিতে শুরু করে। বরফযুগের সবচে ভয়ঙ্কর সময়টায় যখন শিকারের অভাব দেখা দেয়, তখন নিয়ান্ডারটালরা পিছিয়ে পড়ে ক্রো-ম্যানিয়োঁদের তুলনায়।
কোনো একক ফ্যাক্টর নয়, বরং অনেকগুলো বিভিন্ন দিক থেকে বাড়ি খেয়ে পিছিয়ে পড়েছিলো নিয়ান্ডারটালরা, তাই স্যাপিয়েন্সের চেয়েও বড় মস্তিষ্ক নিয়েও তারা বিবর্তনের দৌড়ে টিকতে পারেনি। ভেনড্রামিনির প্রস্তাবনায় তাই যতটা নাটকীয়তা আছে, ততটা প্রমাণ-উপযোগিতা নেই।
আমার কথাগুলো টুপির নিচ থেকে বের করা নয়, জেমস শ্রিভসের দ্য নিয়ান্ডারটাল এনিগমা পাঠের স্মৃতি থেকে বললাম। বইটা উপভোগ্য, যদিও শুরুটা একটু মন্থর। আর নির্লজ্জের মতো একটু নিজের ঢোল বাজিয়ে যাই, নিয়ান্ডারটালদের নিয়ে একটা বিস্তৃত উপন্যাস লেখার ছক সাজিয়ে রেখেছি, আমরা সবাই বেঁচে থাকলে সেটা ২০১৪ নাগাদ দেখতে পাবো। আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলাম। ধন্যবাদ।
ওপরে মাহমুদের মন্তব্যের একটা জবাব দিয়ে যাই। বিজ্ঞানের আলোচনায় ধর্ম তার পেছনে একটা শক্ত লাত্থি খাবেই, এটা এড়ানো যায় না, এড়ানোর চেষ্টা করাটাও সুবিধাবাদিতার লক্ষণ। চাঁদের বুড়িকে না ঘাঁটিয়ে যেমন চাঁদে অ্যাস্ট্রোনট নামানো যায় না 🙂 ।
আলীমুজ্জামান ভাই, ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। কিন্তু ভেনড্রামিনির এই প্রস্তাবটায় কিছু সমস্যা আছে।
গৌণ একটা ফিচার দিয়ে শুরু করি। ভেনড্রামিনির কল্পনায় যে নিয়ান্ডারটালকে দেখতে পাচ্ছি আমরা, সে গরিলাসদৃশ রোমশ এক কৃষ্ণবর্ণ দানব। অথচ নিয়ান্ডারটাল মানুষেরা একটা বিরাট সময় পার করেছে বরফ যুগের ভেতর দিয়ে, বেশ উচ্চ অক্ষাংশে। তাদের চামড়ায় ম্যালানিন রেসপন্সও সেরকম হবার কথা, অর্থাৎ ভিটামিন ডি তৈরির জন্যে চামড়ায় আলট্রাভায়োলেট ইনহিবিটর হিসেবে ম্যালানিন কম থাকার কথা, যাতে তুলনামূলকভাবে দুর্বল সূর্যরশ্মি ত্বকে প্রবেশ করতে পারে। ক্রো-ম্যানিয়োঁরা যেহেতু বিষুবীয় বা ক্রান্তীয় অঞ্চলে একটা লম্বা সময় কাটিয়ে তারপরে লেভান্টে ঢোকে, স্বাভাবিকভাবে তাদের গায়ের রং বরং নিয়ান্ডারটালদের তুলনায় গাঢ় হবার কথা, যেহেতু সেখানে সূর্যের প্রকোপ বেশি। কাজেই শুরুতেই দেখতে পাচ্ছি, ভেনড্রামিনি নিয়ান্ডারটালদের ওপর খামাখা চটা।
লোমের ব্যাপারটাও আসুন খতিয়ে দেখি। শীতপ্রবণ অঞ্চলে প্রাণীর গায়ে লোম বড় হবে, চামড়ার নিচে চর্বির পুরু স্তর থাকবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মানুষের সাথে অন্য প্রাণীদের পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে কেবল এই লোম আর চর্বির ওপর নির্ভর করতো না। প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে মানুষ জামাকাপড় পরা শুরু করেছে [এই সময়টা বার করা হয়েছে খুব ইন্টারেস্টিং উপায়ে, গরিলার গায়ের উকুন আর মানুষের মাথার উকুনের মধ্যে জেনেটিক ডিভাইড হিসাব করে], তাই তার গায়ের একটা বড় অংশের লোমই আকারে খুব ছোটো হয়ে গেছে [খালি চোখে দেখলে মনে হবে লোমই নেই]। শীতের প্রকোপে আক্রান্ত নিয়ান্ডারটালদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। অহেতুক বেচারাকে ভাল্লুকের মতো রোমশ হিসেবে কল্পনা করা দেখে আরো নিশ্চিত হওয়া যায়, ভেনড্রামিনি নিয়ান্ডারটালদের উপর চটা।
ফেরোমোনের ব্যাপারেও ভেনড্রামিনির তত্ত্বে কিছু পানি মেশানো আছে। সেটা হচ্ছে মানুষের ওভ্যুলেশন অন্য প্রাণীর মতো প্রকাশিত নয়। আমরা কি রাস্তাঘাটে কোনো মেয়েকে দেখে বুঝতে পারবো, সে এই মুহূর্তে উর্বর কি না? বোঝা সম্ভব না, কুত্তার মতো নাক থাকলেও না, কারণ মানুষ হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র ম্যামাল যেখানে স্ত্রীজাতি তার ওভ্যুলেশন গোপন করে রাখে। এটা নিয়ে জ্যারেড ডায়মন্ডের হোয়াই ইজ সেক্স ফান বইটিতে চমৎকার আলোচনা আছে, সুযোগ হলে পড়ে নেবার অনুরোধ করবো। মানুষের এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের পেছনে একটা ফ্যাক্টর কিন্তু আবার পলিঅ্যাণ্ড্রি। একটি রমণী একাধিক পুরুষের সাথে রমণ করতো, এবং ওভ্যুলেশন তার কাছে গোপন রাখতো বলেই সেই পুরুষটি নিশ্চিত হতে পারতো না, সন্তানটি তার কি না। ফলে একাধিক পুরুষ সেই নারীটির জন্যে গর্ভবতী অবস্থায় প্ররক্ষা আর রিসোর্স যোগাতো।
ফেরোমোনের দ্বিতীয় সমস্যাটা হচ্ছে, এটা একটা খুবই ফাইন টিউনড কেমিক্যাল। কুকুরের ফেরোমোন যেমন শিয়ালের নাকে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে না। একেবারেই ভিন্ন প্রজাতির মানুষের ফেরোমোন নিয়ান্ডারটালদের ওপর কাজ করার কথা নয়।
জামাকাপড় পরে নারীর আত্মপ্রদর্শনের রাস্তা বন্ধ করার ব্যাপারটাও খুব হাস্যকর শোনায় কিন্তু। বরফ যুগে নারী জামাকাপড় খুলে ঘুরেফিরে নিজেকে দেখাচ্ছে, এটা একটা বিরাট হাহাপগে প্রস্তাব। আর পৃথিবীর বহু জায়গায় কিন্তু নারী বেশ খোলামেলা থাকে, সেখানে যৌনসংসর্গের আহ্বানের ব্যাপারটা জামার আকারের হ্রস্বতার ওপর নির্ভর করে না।
লুলপুরুষ নিয়ান্ডারটাল তত্ত্বের এই দুর্বল দিকটা তো গেলো। দুই প্রজাতির মধ্যে কিছু ফিজিওলজিক্যাল ব্যারিয়ার ছিলো, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গর্ভকাল। নিয়ান্ডারটালদের গর্ভকাল ছিলো এগারো মাসের একটু বেশি, ক্রো-ম্যানিয়োঁদের নয়মাসের একটু বেশি। আরেকটি পার্থক্য হচ্ছে খুলির গড়নে। স্যাপিয়েন্স শিশুদের খুলি কিন্তু জন্মের সময় আস্ত থাকে না, বরং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হাড়ের কাঠামোতে থাকে, যাতে বার্থ ক্যানাল পার হবার সময় প্রেশারের বিপরীতে সেগুলো নড়াচড়া করতে পারে। অন্যদিকে নিয়ান্ডারটাল নারীর পেলভিক অঞ্চলও স্যাপিয়েন্স নারীর মতো ছিলো না, আর শিশুদের খুলি ছিলো একক ইউনিট, ফলে নিয়ান্ডারটাল নারীর গর্ভ থেকে স্যাপিয়েন্স শিশুর জন্ম নেয়াটা যতটা সহজ হতো, স্যাপিয়েন্স নারীর গর্ভ থেকে নিয়ান্ডারটাল শিশুর জন্ম নেয়াটা হতো ততটাই কঠিন। কোনো লুলপুরুষ নিয়ান্ডারটাল কোনো স্যাপিয়েন্স নারীকে গর্ভবতী করলে, সম্ভাবনা প্রবল যে সেই বেচারী শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে শিশুটিসহ মৃত্যবরণ করতো।
খুব সম্প্রতি একটা খবর পড়লাম, সেখানে নিয়ান্ডারটালদের একটা অফশুট প্রজাতি মানুষের সাথে সংমিশ্রিত হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। অর্থাৎ, পুরোপুরি নিয়ান্ডারটাল নয়, বরং কিছু নিয়ান্ডারটাল জিন বহন করে, এমন একটি হোমিনিড প্রজাতি স্যাপিয়েন্সদের সাথে মিশে গেছে।
নিয়ান্ডারটালদের বিলুপ্তির ব্যাপারটাকে একটা হঠাৎ ঘটনা হিসেবে দেখার চেষ্টা করলেই এরকম র্যাডিক্যাল তত্ত্ব আসা স্বাভাবিক। কল্পনা করুন, দু’টি প্রজাতি প্রায় চল্লিশ হাজার বছর ধরে একই হ্যাবিট্যাট শেয়ার করছে, তাদের মধ্যে একটি প্রজাতি একটু এগিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই অন্য প্রজাতিটি কোণঠাসা হয়ে পড়বে। নিয়ান্ডারটালদের ক্ষেত্রেও সেরকমই ঘটেছে।
কেন ক্রো-ম্যানিয়োঁরা এত অগ্রসর ছিলো, সে নিয়েও অনেক স্পেকুলেশন রয়েছে। এর একটি বড় কারণ ছিলো, আফ্রিকা ত্যাগের আগে ক্রো-ম্যানিয়োঁরা যে অঞ্চলে ছিলো, সে অঞ্চলের ক্লাইমেট। দেখা গেছে, আবিসিনিয়ার সেই উপত্যকাগুলি অত্যন্ত তীব্র জলবায়ু পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে সে সময়। এ বছর খরা তো পরের বছর অতিবৃষ্টি, এ পরিস্থিতি তখন ছিলো খুব স্বাভাবিক। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল জলবায়ুর ভেতর দিয়ে ক্রো-ম্যানিয়োঁদের পূর্বপুরুষ প্রতিবেশের সাথে অভিযোজনের ব্যাপারটি খুবই দক্ষতার সাথে আয়ত্বে আনে বলে ধারণা করা হয়। ভেনড্রামিনি যে গোষ্ঠীবদ্ধতার উদ্ভবের কথা বলেছেন, সেই গোষ্ঠীবদ্ধতা এ ধরনের বড় ক্লাইম্যাটিক চেইঞ্জের কারণেই ঘটেছে বলে মনে করেন অনেকে। টিকে থাকার জন্যে বিভিন্ন ধরনের স্ট্র্যাটেজি অবলম্বনের কৌশলও তারা এ সময় আয়ত্বে আনে। অন্যদিকে নিয়ান্ডারটালদের পৃথিবীটা ছিলো কখনও কম ঠাণ্ডা, কখনও বেশি ঠাণ্ডা, ফলে তাদের ঝুড়িতে খুব বেশি স্ট্র্যাটেজি ছিলো না। এটা তাদের পরবর্তী প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেয়।
আরেকটা বড় সমস্যা ছিলো নিয়ান্ডারটালদের শিকার পদ্ধতি। তারা ছিলো অ্যামবুশ হান্টার, ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে আচমকা বেরিয়ে গুতাগুতি করে শিকার মারতো। নিয়ান্ডারটালদের যতগুলো সম্পূর্ণ কঙ্কাল পাওয়া গেছে, দেখা গেছে প্রায় প্রতিটিতেই একটি হাত অপর হাতের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাদের হাতের প্রায় সব আঙুলই সমান মোটা আর শক্তিশালী ছিলো। এ থেকে ধারণা করা হয়, তাদের শিকার পদ্ধতি ছিলো মূলত থ্রাস্টনির্ভর। অপেক্ষাকৃত দুর্বল হাত দিয়ে বল্লম গাইড করা হতো, আর শক্তিশালী হাত থ্রাস্টে ব্যবহার করা হতো। নিয়ান্ডারটালদের বল্লম আর ফলা পরীক্ষা করেও দেখা গেছে, সেগুলো ঠিক অ্যারোডাইনামিক নয়, নিক্ষেপের জন্যে ব্যবহার করা হতো না। অন্যদিকে ক্রো-ম্যানিয়োঁরা ব্যবহার করতো হালকা শিং আর হাড়ের বল্লম, যেগুলো ছুঁড়ে মারার জন্য একটা বিশেষ বল্লম নিক্ষেপকও তারা ব্যবহার করতো। এগুলোর রেঞ্জ ছিলো অনেক বেশি, কার্যকারিতাও। ফলে তারা দূর থেকে শিকারের গায়ে বল্লম মেরে সেটাকে দুর্বল করে ফেলতে পারতো।
নিয়ান্ডারটালদের মাথায় প্রথম বাড়িটা মারে আবহাওয়া। ঝোপঝাড় কমে যাওয়ায় তাদের অ্যামবুশ টেকনিক মাঠে মারা যায়। খোলা প্রান্তরে শিকারের দক্ষতা তাদের ছিলো না। ফলে এখানে তারা ক্রো-ম্যানিয়োঁদের কাছে ধরা খায়।
দ্বিতীয় সমস্যাটা শারীরবৃত্তীয়। নিয়ান্ডারটালরা খুব আঁটসাঁট গড়নের। কোমর বলে তাদের কিছু ছিলো না, বিশাল রিব কেজের নিচেই পেলভিক এরিয়া। এই গড়নটা দৌড়ানোর জন্য উপযোগী নয়। অন্যদিকে স্যাপিয়েন্সের বিবর্তনের পেছনে দৌড়টাই একটা বিরাট প্রভাবক ছিলো। এর প্রমাণ আজও দেখা যায় আমাদের গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস, যাকে আমরা কাচা বাংলায় পাছা বলি, তাতে। এই বিরাট পেশী দৌড়ের সময় আমাদের শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখে। পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীর গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস শরীরের আকারের তুলনায় এত বড় নয়। দৌড়ে দক্ষ ক্রো-ম্যানিয়োঁরা তাই খোলা প্রান্তরের সুবিধা বেশি নিতে শুরু করে। বরফযুগের সবচে ভয়ঙ্কর সময়টায় যখন শিকারের অভাব দেখা দেয়, তখন নিয়ান্ডারটালরা পিছিয়ে পড়ে ক্রো-ম্যানিয়োঁদের তুলনায়।
কোনো একক ফ্যাক্টর নয়, বরং অনেকগুলো বিভিন্ন দিক থেকে বাড়ি খেয়ে পিছিয়ে পড়েছিলো নিয়ান্ডারটালরা, তাই স্যাপিয়েন্সের চেয়েও বড় মস্তিষ্ক নিয়েও তারা বিবর্তনের দৌড়ে টিকতে পারেনি। ভেনড্রামিনির প্রস্তাবনায় তাই যতটা নাটকীয়তা আছে, ততটা প্রমাণ-উপযোগিতা নেই।
আমার কথাগুলো টুপির নিচ থেকে বের করা নয়, জেমস শ্রিভসের দ্য নিয়ান্ডারটাল এনিগমা পাঠের স্মৃতি থেকে বললাম। বইটা উপভোগ্য, যদিও শুরুটা একটু মন্থর। আর নির্লজ্জের মতো একটু নিজের ঢোল বাজিয়ে যাই, নিয়ান্ডারটালদের নিয়ে একটা বিস্তৃত উপন্যাস লেখার ছক সাজিয়ে রেখেছি, আমরা সবাই বেঁচে থাকলে সেটা ২০১৪ নাগাদ দেখতে পাবো। আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলাম। ধন্যবাদ।
ওপরে মাহমুদের মন্তব্যের একটা জবাব দিয়ে যাই। বিজ্ঞানের আলোচনায় ধর্ম তার পেছনে একটা শক্ত লাত্থি খাবেই, এটা এড়ানো যায় না, এড়ানোর চেষ্টা করাটাও সুবিধাবাদিতার লক্ষণ। চাঁদের বুড়িকে না ঘাঁটিয়ে যেমন চাঁদে অ্যাস্ট্রোনট নামানো যায় না 🙂 ।
হিমু,
বিশ্লেষণ ধর্মী, সুন্দর কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। ভেন্ড্রামিনি নিয়ান্ডার্থালদের যে কালো রোমশ অবয়ব দেখিয়েছে, সেটাকে আমার কাছেও খুব গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। আপনার উল্লিখিত মেলানিন ফ্যাক্টরটি বিবেচ্য বলে আমিও মনে করি।
নিয়ান্ডার্থালদের বিলুপ্তির কারণগুলো যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ ভাবেই উপস্থাপন করেছি। তবে ভেন্ড্রামিনি তত্ত্বটি আমার কাছে আকর্ষণীয় এবং কিছু অংশ ছাড়া, বেশ গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছ, সে কারণেই একটু বিশেষ ট্রিটমেন্ট দিয়েছি।
মাঝে মাঝে মনে হয় ভেন্ড্রামিনির তত্ত্ব অবলম্বনে, নিয়ান্ডার্থাল-মানব সংঘাত নিয়ে একটা দুর্দান্ত (ওয়েস্টার্ণ টাইপের ) ছবি হতে পারে। ঐ যে আছে না, স্যাপিয়েন্স হিরোর গার্ল ফ্রেন্ড কে কেড়ে নিয়ে গেল নিয়ান্ডার্থাল ভিলেন। তার পর----- ইত্যাদি, ইত্যাদি।
নিয়ান্ডার্থাদের নিয়ে আপনার উপন্যাসের অপেক্ষায় থাকলাম।
আর আমি থাকলাম আপনাদের দুজনের দুটো উপন্যাসের, যদি বেচে থাকি আরকি
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আরো বিস্তারিত লিখুন আলীম ভাই। ইতিহাসের এসব হিসেব নিকেশ আরো জানতে চাই।
নূপুর, ধন্যবাদ। তোমার কবিতাটি বরাবরের মতই, ভাল লাগলো।
গতকালকেই লেখাটা পড়েছিলাম। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং যেটা লেগেছে ইভ টিজিং এবং তার সাথে নগ্নতার সম্পর্কের একটা সামঞ্জস্য বের করতে পেরে। মানুষের সামাজিক করে তোলার পিছনে অন্য প্রজাতি অথবা প্রকৃতির চাপ ছিলো এই জিনিসটাই খুবই নতুন এবং চমকপ্রদ আমার কাছে। এই লেখাটিকে শুধু বিবর্তন বিষয়ক লেখা বলে আমি বিবেচনা করছি না। বরং এর মাঝে আরও চমৎকার ও ইন্টারেস্টিং ভাবনার খোরাক রয়েছে। পোস্টে পাঁচতারা আর পোস্ট প্রিয়তে।
আর অন্য সবার মত আমারও আলীম ভাইয়ের কাছে দাবী, আমাদের মত আম জনতা পাঠকের জন্য এমন জটিল বিষয় নিয়ে আরো অনেক সহজবোধ্য ব্লগ।
আমিন, ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো আরো লিখতে।
আমার কাছে নতুন একটা বিষয়, আপনার অদ্ভুত সাবলীল ও সহজপাঠ্য লেখা পড়তে গিয়ে মনে হল আমি এটা নিয়ে আরো পড়তে চাই। একটা অসাধারণ লেখার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।
রেশাদ, ধন্যবাদ।
টপিকের উপর আগে থেকে তেমন কোন আগ্রহ না থাকলেও আপনার এই লেখাটা একটানা পড়ে গেলাম। এক কথায় অসাধারন :hatsoff: :hatsoff: আপনার লেখা আরো পড়তে চাই...
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আহসান আকাশ, ধন্যবাদ। তোমার প্রোফাইলের ছবিটা কিন্তু চমৎকার।
আলীম ভাই, অসাধারণ লেখা। তবে আপনার শেষ কথাগুলো ভীষণ ভাবায়।
মানুষ এখন যেমন আগ্রাসী হয়ে উঠছে তাতে আপনার আশংকা অমূলক নয়।
ফেসবুকে আপনার লেখাটা শেয়ার করার পর যেসব মন্তব্য পেয়েছি তা এখানে তুলে দিলাম:
# Amin Shimul: asadharon bolle kom bola hoy.......
December 25 at 6:32pm
# Sajal Khaled: Great article
December 25 at 7:45pm
# Abdullah M Hafiz: Sana bhai, neanderthal-er upor kora BBC Horizon-er 5 porber ei documentary ta dekhtey paren. Ei chomotkar lekha ta porar por oder shomporkey ektu intuitive dharona nitey asha kori kharap lagbey na
http://www.youtube.com/watch?v=zIrgZqm693g
December 25 at 10:52pm
# Sanaullah Lablu: Thanks Hafiz 4 the ref.
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
প্রিয় সানা,
ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার জন্য। তোমার শেয়ার করার সূত্রে যারা লেখাটি পড়েছেন, সবাইকে আমার ধন্যবাদ জানিয়ে দিও। নিয়ান্ডার্থালদের নিয়ে বরাবরই কৌতূহল ছিল, তবে জুলাই মাসে সায়েন্স জার্নালে নিয়ানডার্থাল এর জিন বিশ্লেষণের প্রবন্ধটি পড়ে, বিষয়টি নিয়ে বিষদ ভাবে জানার প্রেরণা অনুভব করি। নিয়ান্ডার্থালরা কেন হারিয়ে গেল আর আমরা স্যাপিয়েন্সরা কেন মানুষ (?) হয়ে উঠলাম এই দুয়ের যোগসূত্রটি ঠিকমতো খুঁজে পাচ্ছিলাম না, যে কারণে এই লেখা। ধর্মগ্রন্থে মানুষকে বলা হয়েছে আশরাফুল মখলুকাত। সায়েন্সও সুর মিলিয়ে বলছে, প্রাণী জগতে মানুষই সবচেয়ে বুদ্ধিমান, যার অর্থ ঐ একই, নিজের ঢোল নিজে পেটানো। নিয়ান্ডার্থালদের প্রসংগটি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এক অস্বস্তিকর বিবেকীয় প্রশ্নের সামনে। বিবর্তনের সোপানে আজ আমরা শীর্ষ সিঁড়ির দাবী করছি, সেটা কি নিজের গুনে নাকি কাউকে ল্যাং মেরে নীচে ফেলে দিয়ে? ভেন্ড্রামিনির তত্ত্বটির শেষ (না বলা) কথাটি বোধ হয় এখানে। ল্যাং না মের উপায় ছিল না, নিজে বাঁচলে তবেই কি না বাপের নাম :grr: ।
আর হ্যাঁ এখন দেখার পালা, আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ল্যাং মারি কি না 😀 !!! (সম্পাদিত)
আজ প্রথম আলোয় পড়লাম, নিয়ানডার্থালরা নাকি শাকসব্জীও খেত, অর্থাৎ তারা শুধুমাত্র মাংসাশী ছিল না।
উইথ ডিউ রেসপেক্ট, প্রথম আলোকে এইসব ব্যাপারে রেফার কইরেন না মুস্তাকিম ভাই। তাহারা যেকোন ওয়েবসাইট থেকে লাইন টু লাইন অনুবাদ করে দিয়ে দেয়, তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজন বোধ করে না। ইংরেজি একটা ফুটবল ওয়েবসাইটের এপ্রিল ফুল আর্টিকেল ছাপায়ে তাহারা নিজেরাই ফুল হইয়া গিয়া পরের দিন মৃদু দুঃখপ্রকাশ করছিল। একটাই হতাশা লাগে, আমি নিজে ক্লাস থ্রি অথবা ফোর থেকে পেপার পড়তাম। অনেক কিছু শিখছি পেপার পড়ে। আমার মতো অনেক দশ বছর বয়েসী বালকেরা ভুল জিনিস শিখতেছে।
যাহোক, হিস্টরি চ্যানেলের একটা ডকু অনুসারে, নিয়ানডার্থালদের ডায়েটের ৮৫ ভাগ ছিল মাংস। বাকি ১৫ ভাগ কি ছিল সেইটা বলে নাই। মামুরা চিপায় পড়লে ক্যানিবালও হইয়া যাইত বলে ধারণা করা হয়। একটা নিয়ানডার্থাল হাড্ডি পাওয়া গেছে যেটার গায়ে অস্ত্রের আঘাত, হাড্ডি থেকে মাংস ছাড়ানোর সময় যেরকম হয় সেইরকম।
চামে আবারো আলীম ভাইকে ধন্যবাদ জানায়ে যাই। গত কয়েকদিন এইগুলা নিয়া হালকা পড়াশোনা করছি। মানুষের সাথেই আরেকটা মানুষ প্রজাতি এই পৃথিবীতে বাস করছে... ভাবলেই আগ্রহ জাইগা ওঠে।
মুস্তাকিম, তৌফিক,
আলাদা আলাদা ভাবে জবাব লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু জবাব দিন- ক্লিক করলে এখানেই চলে আসছে বার বার (কম্পিউটার বিষয়ে এই হচ্ছে আমার পান্ডিত্যের দৌড়)!
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আমার কিন্তু একটা পালটা প্রশ্ন আছে। মাংসাশী প্রাণী কি মাঝে মাঝে একটু আধটু শাকসব্জী খেতে পারে না (বামুনের ছেলের মাঝে মাঝে একটু আধটু পেয়াঁজ খাবার মতো আর কি 😀 )? এখানে একটা খবর পড়লাম, বাঘেও নাকি মাঝে মাঝে ঘাস খায়!!!
জানিনা প্রথমআলোতে কি লিখেছিল; তবে বি.বি.সি. অনলাইনে আসা ২৭ তারিখে ছাপানো একটা লেখার কথা এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, যা কিনা মুস্তাকিমের উপোরোক্ত মন্তব্যকে সমর্থন করে।এ-ব্যাপারে আমি ২টি লিঙ্ক দিচ্ছি, আগ্রহী পাঠকরা একটু পড়ে দেখতে পারেন।
http://www.bbc.co.uk/news/science-environment-12071424
http://www.pasthorizons.com/index.php/archives/12/2010/neanderthals-ate-a-well-balanced-diet
চমৎকার একটি লেখার জন্য ধন্যবাদ আলীম ভাই। (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)
হাফিজ,
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। তোমার লিংক ২টি দেখলাম। মুস্তাকিমকে লেখা জবাবটিও দেখো।
এটি কারো মন্তব্যের উত্তর নয়, বলা যায়, আমার স্বশব্দ ভাবনা।
প্রথম আলো লিখেছে,
। জানি না, তারা ঠিক কি ভাবে রান্না করতো, তবে এই তথ্য সঠিক হলে অচিরেই ইউরোপের কিছু স্থানে হয়তো নিয়ান্ডার্থাল কুইজিন চালু হবে। সে সুবাদে বলা যায়, বাংলাদেশ ইদানীং বেশ দ্রুত এগোচ্ছে, ঢাকায় এখন অনেক দেশের খাবারই জনপ্রিয়। স্বশব্দ ভাবনা হলো- এ সময়ে ঢাকায় একটি সাঁওতাল রেস্টুরেন্ট (পানীয় তালিকায়, ধেনো ও গ্যাঁজানো তালের রস সহ) চালু করা হলে (কুক কে অবশ্যই নেটিভ সাঁওতাল হতে হবে) তা জনপ্রিয় হতেও পারে। সাইন বোর্ডে (ব্রাকেটে) লিখে দেওয়া যেতে পারে- এখানে তিন প্রহরের বিল দেখিবার সুব্যবস্থা আছে 😛 ।
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
পেপার (সায়ন্টেফিক, সংবাদপত্র না) দেখে বুঝলাম আলুকলামিস্ট ঠিকই লিখছে। এই পেপার অনুসারে তারা শাকসব্জি খাইত। পুরা পেপারটা এখনো জোগাড় করতে পারি নাই।
ব্যাপক তথ্যনির্ভর একটা লেখা। কিন্তু পড়লাম পুরা থ্রিলারের আবহ নিয়ে!
হিমু সহ কয়েকজনের কমেন্ট, আলীমুজ্জামান ভাইয়ের উইট মিশানো রিপ্লাইগুলো পুরো জিনিসটাকে আরো আগ্রহোদ্দীপক করে তুললো। ::salute::
সম্ভবতঃ এই টপিকেই আমরা আলীমুজ্জামান ভাইয়ের আরও একটি লেখা পেতে যাচ্ছি 😀 আটকে দিলাম নাকি বস্ ;))
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
কাইয়ূম,
ধন্যবাদ, লেখার চেষ্টা করবো......।
নববর্ষের শুভেচ্ছা।