যাত্রা হলো শুরুঃ লিটিল বাংলাদেশ

গতকাল ১৫ই জানুয়ারী, ২০১১ বিকেলটা আমেরিকায় একটা খুব ছোট্ট কিন্তু আমেরিকার বাংলাদেশী কম্যুনিটির ইতিহাসের এযাবৎকালের সবথেকে বড় ঘটনাটা ঘটে গেলঃ আমেরিকার বুকে সর্বপ্রথম একটা এলাকা বাংলাদেশের সাথে মিলিয়ে ‘লিটিল বাংলাদেশ’ হিসেবে অফিসিয়ালী অভিষিক্ত হলো। এলাকাটা আয়তনে খুবই ছোট। লস এঞ্জেলস শহরে কোরিয়া টাউন নামে পরিচিত এলাকার একপাশে ভার্মন্ট এভিনিউ আর নর্মান্ডি এভিনিউ এর মধ্যবর্তী ৩নং সড়কের দুইধার। সিটি মেয়র এবং বাংলাদেশ দুতাবাসের কর্মকর্তা মিলে সাইনবোর্ড টানিয়ে এলাকা চিহ্নিত করে দিলেন।

দুইপাশে দুই কাউন্সিলম্যান আর মাঝে বাংলাদেশ দুতাবাসের বড় কর্মকর্তা

আমেরিকায় সবথেকে বেশি বাংলাদেশীর বাস নিউইয়র্ক শহরে, সরকারী হিসেবে ৩ লাখের মত, আর বেসরকারী হিসেবে ৫ লাখেরও বেশি। সেখানে জ্যাকসন হাইট আর কুইন্স নাকি একেবারে গিজগিজ করে বাংলাদেশীদের ভিড়ে। সেই তুলনায় লস এঞ্জেলসে বাংলাদেশীদের সংখ্যা খুবই কম, মাত্র ২০ হাজারের মত। আর পুরো ক্যালিফোর্নিয়া রাষ্ট্রে সাকুল্যে ৩৫/৪০ হাজারের মতো [ক্যালিফোর্নিয়া আয়তনে বাংলাদেশের থেকে তিনগুণেরও বেশি!]। সংখ্যায় কম হওয়া সত্বেও লস এঞ্জেলসের বাংলাদেশীরা নিজেদের নামে একটা এলাকা চিহ্নিত করে নিতে পারল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ন, বিশেষ করে এখানকার বাংলাদেশীদের জন্য। বাংলাদেশী ব্যবসায়ী, কম্যুনিটি-নের্তৃবর্গসহ স্থানীয়দের ধারণা, এই স্বীকৃতি বাংলাদেশীদের এখানে আসতে উৎসাহিত করবে। ফলে এখানে দ্রুত বাংলাদেশী কম্যুনিটি গড়ে উঠবে যা’ নতুন অভিবাসীদের জীবন-সংগ্রাম শুরু করার জন্য অপরিহার্য।

আমেরিকা হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ উন্নত জীবন গড়ার আশায় অসংখ্য বাধা-বিপত্তি ঠেলে আমেরিকায় পাড়ি জমায়। এর শুরু কলম্বাসের আগমনের পর থেকেই। প্রথমে ইউরোপের মানুষ, তারপর ক্রমান্বয়ে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার সাদা-কালো-বাদামী সকল রঙের মানুষ আমেরিকায় থিতু হয়। সবার আগে এসে পড়ায় ইউরোপের সাদা মানুষেরা সংখ্যায় বেশি, সম্পদের ধনী, ক্ষমতায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার পত্তন ১৭৭৬ এ হলেও জাতি হিসেবে আমেরিকার জন্ম হয় আরো প্রায় একশ বছর পর। অবাক হলেন? তাহলে বলছি, শুনুনঃ

আধূনিক অর্থে, রাষ্ট্র (state) হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক কাঠামো যা’র মধ্যে একটা সরকার সার্বভৌমিক ক্ষমতার অধিকারী, আর এর মধ্যে বসবাসকারী সকল ব্যক্তি হচ্ছে নাগরিক (citizen)। এইসব নাগরিকের রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে তাদের নাগরিকত্ব। এর পাশাপাশি তাদের সংস্কৃতিক পরিচয়ও থাকে; এটাকে বলে জাতীয়তা (nationality)। ১৫শতক থেকে ১৮শতক জুড়ে ইউরোপে জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে প্রথমে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠিত হয়। আর সেই রাষ্ট্রের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সেখানে ক্রমশঃ দানা বাঁধে জাতীয়তা বা সাংস্কৃতিক পরিচয়। সেখান থেকে সারা ইউরোপ জুড়ে একে একে উদ্ভব ঘটে নানান জাতিরাষ্ট্রের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কলোনীয়াল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়লে বাকী বিশ্বও নানা জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে জন্ম দিয়েছে আজকের বিশ্ব-মানচিত্রের।

আমেরিকা রাষ্ট্রের জন্মের প্রায় একশ’ বছর পর এখানকার জাতীয়তা-প্রশ্ন সর্বপ্রথম নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে উঠে আসে। ১৮৪৮-৪৯ এ ক্যালিফোর্নিয়ায় Gold-rush এর সময় প্রায় ২০/২৫ হাজার চীনা শ্রমিক পশ্চিম উপকূলে পাড়ি জমায়। খনিতে স্বর্ণ নিঃশেষ হলে এই চীনা শ্রমিকরা আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলপথ স্থাপনের কাজে যোগ দেয়। প্রায় এক দশক ধরে এই শ্রমিকরা সারা পশ্চিমাঞ্চলে রেলপথের জাল বিছিয়ে দেয়। এরপর ১৮৬০ এর দশকে রেলপথের কাজ শেষ হয়, আর আমেরিকাতে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। এই অবস্থায় এখানকার সাদা-শ্রমিকরা চীনাদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ইংরেজী জ্ঞান না-থাকায় সমাজের মূল ধারার সাথে চীনাদের যোগাযোগ ছিল খুবই সীমিত। পাশাপাশি সাংস্কৃতিকভাবেও চীনারা ইউরোপীয়দের থেকে অনেক আলাদা। সেই সাথে চেহারার বৈশাদৃশ্য ত আছেই। সব মিলিয়ে আমেরিকার সমাজে চীনারা হয়ে পড়ে অবাঞ্ছিত। এই পরিস্থিতিতে ১৮৮২ সালে জাতীয় কংগ্রেসে Chinese Exclussion আইন পাশ হয়। এই আইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা হয় যে চীনারা সাংস্কৃতিক ভাবে আমেরিকান হওয়ার যোগ্য নয়। এটাই আমেরিকার সর্বপ্রথম অভিবাসী আইন। আর এই আইন প্রয়োগের জন্যই গঠিত হয় আমেরিকার ইমিগ্রেশন অথরিটি। এই আইনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যে, সাংস্কৃতিক ভাবে আমেরিকান হতে হবে শুধুমাত্র সাদা+মূলতঃইউরোপীয়+(প্রটেষ্ট্যান্ট) খ্রীষ্টানরা, যা’ আজও সরকারী নীতি+জনমনে প্রচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান।

চীনাদের বিরুদ্ধে এই আইন বলবৎ ছিল ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত। এই সময় আমেরিকায় চীনাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম- এক লাখেরও নিচে- এবং প্রায় সবাই ছিল পুরুষ। আমেরিকার রাষ্ট্রের এই যে বিমাতাসূলভ নীতির ফলে চীনারা নিজেদের আত্ম্ররক্ষার জন্য গড়ে তোলে “চায়না টাউন”। সকল চীনা অভিবাসী আমেরিকায় এসে অবস্থান নেয় এইসব চায়না টাউনে। মাথা গোঁজার ঠাঁই আর জীবিকার জন্য ‘কাজ’ জোটাতেও অত্যন্ত দরকারী চায়না টাউন। মূলতঃ চায়না টাউনে আশ্রয় নেওয়ার মাধ্যমেই চীনা অভিবাসীরা আমেরিকায় শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও টিকতে পেরেছে। ১৯৬৫ সালে আমেরিকার অভিবাসী আইন সংশোধন করা হলে দলে দলে চীনারা আরেরিকায় আসে। বর্তমানে আমেরিকায় যত চীনা অভিবাসী আছে, তাদের অর্ধেকেরও বেশি এই সময়ের পর আগত প্রথম প্রজন্ম।

বাংলাদেশীরা চীনাদের তুলনায় অনেক ভাগ্যবান। তাদেরকে পুরোনো সেইসব কঠোর অভিবাসী আইনের মোকাবেলা করতে হয়না। প্রায় শুরু থেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আসতে পারে। প্রায় যেকোন অংশে গিয়ে থিতু হতে পারে। কিন্তু এরপরেও নতুন আগত অভিবাসীদের জন্য চায়না টাউনের আদলে গড়ে ওঠা ‘এথনিক এনক্লেভ’- বাংলায় যাকে বলা যায় “নিজেদের পাড়া”- খুব গুরুত্বপূর্ণ। নতুন অভিবাসীদের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য এইসব ‘পাড়া’র ভূমিকা নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক গবেষণা হয়েছে। প্রায় সকল গবেষণায় দেখা গেছে যে, এইসব ‘পাড়া’ অভিবাসী এবং এখানকার মূলধারা সমাজের জন্য বিভিন্নভাবে পজিটিভ ভূমিকা রাখে। একারণে, বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া রাষ্ট্রে অভিবাসীদেরকে নিজ নিজ পাড়া গড়তে বেশ উৎসাহিত করা হয় যা’ আমেরিকার অন্যান্য রাষ্ট্রের থেকে ক্যালিফোর্নিয়াকে আলাদা হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে।

লস এঞ্জেলসের বাংলাদেশী পাড়ায় একটা ছোট গবেষণা করেছিলাম গত বছর। এখানকার বাংলাদেশী পাড়া খুবই নবীন, বলা যায় এটি ২০০০ সালের পর থেকে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ২০০০ সালের আদমশুমারি’তে এখানে মাত্র ১৭০০ বাংলাদেশী পাওয়া যায়। বর্তমানে এই সংখ্যা প্রায় ১৫,০০০ ছাড়িয়েছে। এর সাথে আছে আরো ৪/৫ হাজার অবৈধ অভিবাসী। আমার গবেষণায় দেখেছিলাম নিজেদের মধ্যকার নেটওয়ার্ক আবাস এবং ‘কাজ’ পাওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সকলেই অন্য কোন বাংলাদেশীর মাধ্যমেই বাসা+কাজ খূঁজে পায়। পাশাপাশি তারা নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপলক্ষে নিজেদের মধ্যে যাতায়াতের মাধ্যেম দৈনন্দিন জীবনের নানান চাহিদা পূরণ করে থাকে। এক কথায়, বাংলাদেশী পাড়া এখানকার অভিবাসীদের জীবনে প্রধান ভরসার আশ্রয়স্থল। একারণেই, নিজেদের এলাকার সরকারী স্বীকৃতি এখানকার বাংলাদেশীদের কাছে বিশেষ কিছু। মেয়রের হাতে লিটিল বাংলাদেশ সাইনবোর্ড উঠতে দেখে তাই এখানকার এক বাংলাদেশী দোকান ‘এশিয়ান মার্ট’ এর মালিক আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন, ‘হিস্ট্রি ইজ ইন দ্য মেকিং’।

২,২৪৮ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “যাত্রা হলো শুরুঃ লিটিল বাংলাদেশ”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    লিটিল বাংলাদেশ এবং এর বাসিন্দাদের অভিনন্দন 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    @ সানা ভাই, তানভীর, গুলশান, আহসান, রেশাদ,

    যাই, 'দেশী'তে গিয়ে আপনাদের শুভেচ্ছা দিয়ে আসি আর 'মিষ্টি+চা' খেয়ে আসি 😀


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
      রকি বীচ কি আসলেই আছে?

      রকি পর্বতমালা আছে, আর আছে এর তীর-ঘেঁষে বেশ কিছু ছোট ছোট বীচ, যেমন- ভেনিস, সান্টা মনিকা, রেডন্ডো, লংবীচ, ম্যালিব্যু, ইত্যাদি। কিন্তু রকি বীচ বলে আসলেই কিছু নাই 😛


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  3. রাব্বী (৯২-৯৮)

    বাহ! বেশ একটা খবর।

    জ্যাকসন হাইটসে রাস্তার উপ্রে সামারে নিয়ামুল কোরান, সিদ্দিকা কবীর, রাশিচক্র এবং বাংলা জোকসের বই বিক্রি হয়। কিছু কিছু মোড় ঢাকার মতো লাগে 🙂


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।