……….ব্যতিক্রমী বিদায়ী ভাষণ……..

[গল্পটা স্থান-কাল-পাত্রভেদে কাল্পনিক।এটা নিছকই ব্লগারের কল্পনাপ্রসূত।তবে এর প্রেক্ষাপট বাস্তবিক হলেও হতে পারে।কোন ব্যক্তিবিশেষের সাথে বিষয়বস্তু বা বর্ণনার বিন্দুমাত্র মিল থাকলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র।এর জন্য ব্লগার দায়ী নন]

*************************

বেলা প্রায় দুপুর ১২টা।৫ম সেমিস্টারের ক্লাসও দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল।সময় যে কিভাবে কাটে টেরই পাওয়া যায় না।ক্লাস শেষে অ্যাটেন্ডেন্স নিয়ে স্যার বেরিয়ে গেলেন।সবাই যার যার মত ব্যাগ গুছিয়ে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে,মনটা সবারই ফুরফুরে।কারণ,আরো একটা সেমিস্টার শেষ + কয়েকদিনের বিরতি + বিশ্রামের সুযোগ…ইত্যাদি…।কিন্তু একটা ছেলে স্যারের পিছনে পিছনে গিয়ে, স্যার বেরিয়ে যাবার পর দরজা বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে।কাছাকাছি যারা ছিল,ব্যাপারটা তারা খেয়াল করল।জিজ্ঞাসা করার আগেই ছেলেটা ঘোষণা করল, ‘সবার সাথে আমার কিছু কথা আছে।কাইন্ডলি আমি দশ-পনেরো মিনিট সময় চাচ্ছি।’ গলাটা তার নিজের কাছেই অপরিচিত লাগল।কেমন ভাঙ্গা ভাঙ্গা,দৃঢ়তাহীন,নার্ভাস!তারপরও মানসিকভাবে সে শক্ত।অনিচ্ছাস্বত্তেও ছেলেটার সিরিয়াস ভঙ্গি দেখে সবাই যার যার জায়গায় ফিরে গেল।

শ্যামবর্ণ ছেলেটার উচ্চতা পৌনে ছ’ ফুটের কাছাকাছি।গাঢ় ছাইরঙ্গা জিন্স,কফি রঙের শর্ট শার্ট,পায়ে কেডস,হাতে হাতঘড়ি আর সোনালী ফ্রেমের প্রায় রিমলেস চশমা পড়েছে সে।সেমিস্টারের শেষ ক্লাসেও ভাব মারার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি।যদিও স্বাস্থ্য ভালো হলেও আজকে তাকে ফিট মনে হচ্ছে না।হতচ্ছাড়া সর্দি-কাশিটা কয়েকদিন থেকেই মহাজ্বালাতন আরম্ভ করেছে।বাধ্য হয়েই গতকাল চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিল সে।

যাই হোক,আজকে তার সবার সামনে কিছু একটা বলার কথা।আগেও সে ক্লাসের সবার সামনে নানা বিষয়ে কথা বলেছে।কখনো প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশন,কখনো সবাই মিলে কোন কিছু করার আইডিয়া,কখনো কোন উদযাপনের উপস্থাপনা ইত্যাদি।সে সামনে যাওয়া মানেই কিছু হাসি-ঠাট্টা,আনন্দ এবং উদযাপনের পূর্বাভাস।তাই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে তার বেগ পেতে হলো না।কিন্তু সে আজ সম্মিলিত উদযাপনের কোন আইডিয়া উপস্থাপন করতে আসেনি,শুধু নিজের কথা বলতে এসেছে।আজ হয়ত সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে,সবার মন হয়ত প্রফুল্ল,কিন্তু তার মন নয়।সময় নিয়ে গুছিয়ে কথা বলা কঠিন,তাই কি বলবে তা একটা কাগজে লিখেও নিয়ে এসেছে…….

ধীরে ধীরে পকেট থেকে কাগজটা বের করল সে।একবার মাথা তুলে দেখল, ছেলে মেয়ে সকলে তার দিকে তাকিয়ে আছে।অনেকে ফিসফিস গুঞ্জন করছে নিজেদের মধ্যে।সে জানে,পড়া শুরু করলেই সবাই শুনবে।তারপরও ভাব-গাম্ভীর্য বজায় রাখতে সে তার উপস্থিতি জানান দিল।সর্দিতে বসে যাওয়া গলায় সর্বশক্তি ঢেলে বলল, ‘বন্ধু-বান্ধবীরা,আমি আজকে তোমাদের সাথে শুধুই নিজের কথা শেয়ার করতে চাই।আমাকে দেখে বুঝতেই পারছ,আজকে আমি উৎফুল্ল নই।তাই আমি আশা করব,আমি যতক্ষণ কথা বলব ধৈর্যসহকারে আমার কথাগুলো সবাই শুনবে।কেননা,আমার মনে হয়না আর কখনো তোমাদের সামনে আমি কথা বলতে পারব।’

এমন কথা শুনে প্রায় সকলেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।একটা সর্বসময় চঞ্চল ছেলে আজ কেন এতটা সিরিয়াস,কেউ বুঝল না।যাই হোক,মনোযোগ কাড়তে পেরে ছেলেটা কাগজ থেকে পড়া শুরু করল………

‘আমার প্রিয় বন্ধু-বান্ধবীরা,আমি ভাবিনি কখনো আমাকে এইভাবে তোমাদের সামনে ভাষণ আকারে কথা বলতে হবে।কিন্তু কারো চোখে চোখ রেখে আজকের কথাগুলো বলার মত মানসিক শক্তি আমার আছে কিনা এই দ্বিধায় পড়ে আমি কথাগুলো কাগজে লিখেছি।অনেক ভেবেছি,বলা উচিত হবে কিনা,বললে কিভাবে বুঝিয়ে বলব,শক্ত থাকতে পারব কিনা শেষ পর্যন্ত ইত্যাদি।তারপরও নিজের মানসিক শক্তির উপর ভরসা করে আজকে তোমাদের সামনে আমার জীবনে চরম এবং সম্ভবত শেষ সত্যটুকু বলার জন্য হাজির হলাম।

তোমাদের সাথে আমি কয়েকটা বছর পার করলাম।এর মধ্যে আবার কারো কারো সাথে আমার অনেকদিনের পরিচয়।যতক্ষণ আমি তোমাদের মাঝে থাকতাম,মনে হত জীবনের অর্জিত সম্পদ ছিল এইসব বন্ধুদের অপরিসীম ভালোবাসা-ভ্রাতৃত্ব-বন্ধুত্ব।অনেক মজা করেছি,অনেক দুষ্টামি করেছি যা অনেক ক্ষেত্রেই মনোমালিন্য সৃষ্টি করেছে আমার সাথে অনেকের।সত্যি কথা হলো,কারো মনে কষ্ট দিয়ে মজা করাটাকে আমি পছন্দ করি না,সীমা লঙ্ঘন করে ফেলতাম কখনো কখনো না বুঝে,এইজন্যই যা সমস্যা হওয়ার হত।যদিও কারো কারো সাথে কথা কদাচিৎ হয় এক ক্লাসে পড়েও,তারপরও তাকে ভালো বন্ধু হিসেবেই জেনেছি,কারণ মানুষের সাথে মিশতে আমার ভালো লাগে।নিজের ক্ষতি না করে যদি মানুষের কাজে আসতে পারি,তাহলে নিজেকে নিজের কাছেই অনেক বড় মনে হয়। যাই হোক,কথা হচ্ছে,আমার কোন কাজ,আচরণ,চলাফেরা,কথাবার্তা যদি কখনো কোনভাবে কারো কাছে অসৎ,অসংলগ্ন,উদ্ধত ও দৃষ্টিকটূ মনে হয়েছিল এবং বিরক্তির উদ্রেক করেছিল,তবে আজ এইমুহূর্তে আমি সকলের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।অতীত কাল ব্যবহার করলাম,কারণ ভবিষ্যতে আমি কারো বিরক্তির কারণ চাইলেও হতে পারব না……”

ছেলেটা সত্যি সত্যি হাতজোড় করল।সামনের সারিতে বসা একটা মেয়ে অধৈর্য হয়ে তার নাম সম্বোধন করে বলল, ‘প্লিজ তাড়াতাড়ি বল,কি হয়েছে তোমার?এরকম কথা কেন বলছ তুমি?টার্ম ড্রপ দিবে?ক্লাস করলে এতদিন,পরীক্ষা দিবে না?এত ইমোশনাল কথা বলছ কেন?’ছেলেটা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল।মেয়েটা চুপ করে গেল।পিছনদিকে কয়েকটা ছেলে বক্রহাসি হাসল।ছেলেটা পাত্তা দিল না,আবার পড়া শুরু করল……

‘বন্ধুরা,আজ এটাই তোমাদের সাথে আমার শেষ ক্লাস করা।আমি এরপর আর পড়াশুনা করতে চাই না।চাই না,কথাটা ঠিক না,শারীরিকভাবেই আমার পক্ষে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না।আজকের পর আমি আর এখানে ফিরে আসছিনা।তাই তোমাদের সাথে এটাই আমার শেষ দেখা।কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও আমাকে পাবে না,আমি কারো সাথে কথা বলতে পারব না।আমাকে তোমরা ক্ষমা করো,প্লিজ……”

শেষ প্যারাটুকু পড়তে পারল না সে।তার আগেই জোর গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল ক্লাসের মধ্যে।ছেলেমেয়ে একসাথে সবাই একেকটা প্রশ্ন করতে থাকল, ‘কি বলছিস এসব?….অই তর কি মাথা ঠিক আছে?….ক্ষমাঠমা বাদ দে,আসল কাহিনী বল।…..কি রে,বিদেশ যাবি?স্কলারশীপ পাইছস?……দোস্ত,তুই ভালো আছিস?অসুখ-বিসুখ কিছু না তো?…….’ সীট থেকে উঠে এল অনেকে।ছেলেটা অনেক ‘বলছি,একটু সময় দে’ বলে সবাইকে ফেরত পাঠাল।এই সময় দ্বিতীয় সারিতে বসা অনিন্দ্যসুন্দরী একটা মেয়ের দিকে তার চোখ গেল।মেয়েটার চোখ টলটল করছে।মেয়েটা দ্বিধান্বিত,সন্ত্রস্ত।ছেলেটার দিকে চোখে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সে।ইতস্তত নড়াচড়া করছে।যেন কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না…..

ছেলেটা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিল,শেষ প্যারা পড়ার আগে সে মেয়েটার উদ্দেশ্যে কিছু বলবে।বলাটা জরুরী,না বললে এই বিদায় অপূর্ণই থেকে যাবে,আর কিছু হয়ত বলা হবে না কোনদিন….সবার সামনেই বলবে সে।আজ তার মনে কোন লজ্জাবোধ নেই,কোন সমালোচিত হওয়ার ভয় নেই,কোন পিছুটানও নেই,তাই আজ তার বলতে বাঁধাও নেই।একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সে বলল,
‘…

‘……..সালমা,আজ সবার সামনে আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।’

অনেকদিন পর একটা অনাকাঙ্খিত কন্ঠে নিজের নাম শুনে এতক্ষণ অধোবদনে থাকা সালমা নামের মেয়েটা চমকে ছেলেটার দিকে তাকাল।কিঞ্চিৎ রোমান্সের স্বাদ পেয়ে বাকি ছেলেমেয়েগুলোও নড়েচড়ে বসল।কারণ,বিগত বছরদুয়েকের মধ্যে এই ছেলে ও মেয়ের পরস্পরের সাথে কথা বলাবলি বন্ধ।তাই সবাই হয়ত ভাবল,আজ হঠাৎ এই সম্ভাব্য বিদায় পূর্ববর্তী লগ্নে তাদের কথোপকথন অনেকটাই সিনেমাটিক হতে পারে।ছেলেটা বলল….

‘সালমা,আজ প্রায় দু বছর হয়ে গেল আমি তোমার সাথে বা তুমি আমার সাথে কোন কথা বল না।এর কারণ,আমাদের অ্যাফেয়ার এর সমাপ্তি,এটা সকলেই জানে।কিন্তু তুমি জানো না,তোমার পিছনে বসে একটার পর একটা ক্লাস করে যেতে আমার কতটা কষ্ট হয়।তুমি জানো না,ক্লাস শেষে যখন তুমি বেরিয়ে যাও তখন তোমাকে নিয়ে বসে থাকতে মন কতটা আনচান করে।তুমি জানো না,প্রতিদিন স্যার-ম্যাডাম তোমার রোল কল করার সময় আমি বারবার চমকে তাকাই,প্রতিটা পরীক্ষার মার্ক দেয়ার সময় আমি তোমার মার্কটাও নিজেরটার সাথে টুকে রাখি।তুমি জানো না,তুমি কখন কি কর,কোথায় যাও,ভালো আছ কি নেই তার খবর আমি রাখি তোমার বান্ধবীদের কাছ থেকে।তুমি জানো না,প্রতিটা রাতে যখন সবাই প্রেমিকার সাথে ফোনালাপে মেতে উঠে,আমার কতটা ইচ্ছে করে তোমাকে ফোন দিতে……কিন্তু আমি এসবের কিছুই পারি না।আমার একগুঁয়েমি,আমার অবুঝ ব্যক্তিত্ব,আমার যুক্তিভক্ত সত্ত্বা প্রতিনিয়ত তোমার জন্য আমার ব্যাকুলতার সাথে যুদ্ধে জয়ী হয়।আমি আর পারি না তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে।কারণ,আমি পুরুষ!আমি ভেবেচিন্তেই আমাদের সম্পর্কের ইতি টেনেছিলাম,কেননা আমি জানি তুমি আমার মন-মানসিকতার সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে না।পরিবারের অসম্মতিতে আমার সাথে সংসারও করতে পারবে না,শেষে যেদিন বাবার পছন্দ করা পাত্রকেই বিয়ে করবে,আমাকে হয়ত বলতে, ‘সরি,আমি পারলাম না,বাবার কথা অমান্য করতে।’আমার এতদিনের ভালোবাসাকে জলাঞ্জলী দিয়ে তুমি তাই করতে,আমি জানতাম।কারণ,যে কয়টা দিন তোমার সাথে ছিলাম,তোমার প্রতিটা কথা ও অনুভূতির প্রকাশ আমি ভেবেছি।যাই হোক,আজ শুধু এটুকুই বলব,জীবনে প্রথম তোমাকেই ভালোবেসেছিলাম,এখনও ভালোবাসি,যতদিন আছি ততদিনও বাসব,কেননা খুব বেশিদিন হয়ত থাকব না।আমার ঘনিষ্ট বন্ধুরা জানে,আমি তোমাকে ভালোবাসি,ওরা আমাকে অনেকবার বলেছে,তোমাকে আবার ফিরিয়ে আনতে,আমি না করেছি,কারণ আমি জানি তুমি আমাকে ছাড়াই ভালো আছ।তোমার উপর আমার কোন ক্ষোভ বা অভিমান নেই,তুমিও আমার উপর রাগ করে থেক না।শেষ কয়েকটা দিন আমি সুখস্মৃতি নিয়েই বাঁচতে চাই।’’

এত কথা ছেলেটা কিভাবে বলে ফেলল সে নিজেই বুঝল না।হয়তবা এতদিনের পুঞ্জীভুত হাহাকার আজ কথার প্লাবনে ভেসে গেল!মেয়েটার চোখ থেকে অপলক অবিরত পানি পড়ছে,ছেলেটা তা দেখেও না দেখার ভান করল,কেননা তাকে দুর্বল হলে চলবে না।সে সমাপ্তির দিকে চলে এসেছে।তার সামনে যে অস্থির,বিমূঢ় সহপাঠীরা বসে আছে,তাদের সত্যটা বলে দেয়ার সময় চলে এসেছে।ছেলেটা শেষ প্যারা পড়া শুরু করল।।…..

‘….বন্ধুরা গত দুই সপ্তাহ থেকেই আমার সর্দি-কাশি লেগেই আছে।শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে,শক্তি পাচ্ছি না।কোনকিছুতেই কাজ হচ্ছে না।ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম,আমাকে একগাদা টেস্ট দিয়েছিলেন।কালকে সেই টেস্টরিপোর্ট হাতে পেলাম।রিপোর্টে কোন ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন নেই,কোন দুর্বলতা নেই,শুধু এইচ আই ভি পজিটিভ রেজাল্ট এসেছে………।’

মনে হল পুরো ক্লাসের সবাই একসাথে ভূত দেখতে পেল।‘হোয়াট’,’ওহ!শীট’ ।“কী!!’’ এই জাতীয় শব্দে ক্লাস মুখরিত হয়ে গেল।ছেলেটা আবার বলল, ‘প্লিজ শোনো সবাই,এটা আজ হোক কাল হোক,তোমরা জানতেই,তাই আমি আজই জানিয়ে দিতে চাইলাম।কারণ আমাকে নিয়ে বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা হোক,আমি তা চাই না।ব্যক্তিগতভাবে কোন মেয়ের সাথেই আমি মেলামেশা করিনি,এটা আমার ঘনিষ্ট সকলেই জানে।রিপোর্টে কোন এস.টি.ডি. রেজাল্ট আসেনি।তাই,সেক্সুয়াল কারণে আমি ইনফেক্টেড হইনি।কিভাবে হলাম ,তা বলছি।অর্থ দিয়ে কিংবা সমাজসেবার মাধ্যমে মানুষের উপকার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।তাই রক্ত দিয়ে যতটুকু সম্ভব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি।কয়েক মাস আগে একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানোর জন্য রক্ত দিয়েছিলাম।সম্ভবত সেখান থেকেই আমি ইনফেক্টেড হই।হয়ত আমার কিছুই হত না,জীবাণু নিয়েই বাঁচতাম।কিন্তু স্বয়ং বিধাতাই যেখানে কলকাঠি নাড়ছেন,আমি কি করব?সব জায়গায় নতুন ব্লাড ব্যাগ ব্যবহার করা হয়,সেদিন রোগীর আর্থিক অবস্থার দৈন্যদশার কারণে পুরোনো ব্যাগেই আমার রক্ত নেয়া হয়।কে জানত,এতে এইডস এর জীবাণু আছে!কাউকে দোষারোপ করব না।মন থেকে চাইছি,আমার মত হতভাগ্য কেউ যেন না হয়।রক্তদানের সময় যেন অবশ্যই নতুন ব্লাড ব্যাগ ব্যবহৃত হয়।ডাক্তার বলেছেন,আমার শরীরে ইনফেকশন শুরু হয়ে গেছে।দেহের প্রতিরোধতন্ত্র ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।এখন বেডরেস্টে যাওয়াই ভালো।আমি শুধু একটা প্রশ্ন করব,কি দোষ ছিল আমার যে আমাকেই বলির পাঁঠা হতে হবে?তাও আবার মানুষের উপকার করতে গিয়ে?

আমি বাবা-মা কে কিছু বলিনি।আজ বাসায় চলে যাচ্ছি।সব বলব,তারা শুধু দুঃখই পাবেন।তাদের আশা-ভরসার প্রতিদান আমি দিতে পারলাম না।তোমরা আমাকে ভুল বুঝ না।লোকে অনেক কথা বলবে জানি।কিন্তু তোমরা জানবে,আমি যাওয়ার আগে সত্যটা বলে গিয়েছিলাম।হয়ত তোমরা আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাবে,কিন্তু আমি কারও সাথে যোগাযোগ করতে চাই না।আমি নিভৃতে,নীরবে সবাইকে ছেড়ে যেতে চাই।আমাকে মাফ করে দিও।এটা তোমাদের কাছে আমার শেষ অনুরোধ,শেষ চাওয়া।কোন মানুষের উপর নয়।শুধু অদৃষ্টের উপর অভিমান করে আমি চলে যাচ্ছি।সবাই সুখী হও,ভালো থেকো।” ……

………।।এই বলে ছেলেটা কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।কয়েকটা ছেলে মেয়ে ডাকল,সে শুনল না।সে শুনল না,সালমা নামের মেয়েটা ডুকরে কেঁদে উঠল তার জন্য।সে জানল না,সহপাঠী-সহপাঠিনীরা সবার চোখ থেকে পানি পড়ছিল তার জন্য।সে চলে গেল………সব প্রেম-ভালোবাসা-বন্ধুত্বের জাল ছিন্ন করে সে চলে গেল……অদৃষ্টের হাতে অসহায় আত্মসমর্পণের জন্য………
*******************************************************

রক্তদান একটা মহৎ কাজ।আমরা অনেকেই স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে থাকি।মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এর থেকে সহজ উপায় আমার জানা নেই।আমিও কয়েকবার রক্ত দিয়েছি।অনেকে ভয়ে রক্ত দিতে চান না।কিন্তু ভেবে দেখুন,আপনার প্রিয়জনের বিপদে যখন কেউ অনুরোধ করলেও রক্ত দিতে চাইবে না তখন আপনার কি মনে হবে?তাই,নিজে যতটুকু পারুন,রক্ত দিন,মানুষ বাঁচান।

একবার রক্ত দিয়ে এসে ঘুমে এরকম একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম।তাতেই সাহিত্যের মাল-মশল্লা ছিটিয়ে পরিবেশন করলাম।জানিনা,এটা কতটা ভোজনের উপযুক্ত হয়েছে।ভালো না লাগলে ফেলে দিবেন,লাগলে খাবেন।বাস্তবে এরকম ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম হলেও উড়িয়ে দেয়ার মত নয়,যদিও এটা নিছকই একটা গল্প।

সিরিয়াস পোস্টের শেষে একটা হার্ডজোক্স করিঃ

সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ “এইডস কী?বাঁচতে হলে জানতে হবে।”
“লাগবা বাজি???!!!!…….”
———–গণসচেতনতায় ক্যাডেট কলেজ ব্লগ

৪৫,৬৭৩ বার দেখা হয়েছে

৮৪ টি মন্তব্য : “……….ব্যতিক্রমী বিদায়ী ভাষণ……..”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আছিব,

    গল্পটা ভালো লেগেছে, বিশেষ করে মানুষকে সচেতন করার ম্যাসেজটা। সবশেষের জোকটাও ভালো।

    শিরোনামে মনে হয় বানান ভুল আছে। চেক করে নিও।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    ওহ আসল কথাই বলা হয় নাই,; গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটা ভালো লেগেছে। তবে একটু বেশি নাটকীয় হয়ে গেলো মনে হয়। 😛


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. ইয়ে মানে আছিব মানে দোস্ত মানে তুই তো একটা সিরিয়াস নাটক লিখে ফেললি।শিরোনাম দেখে ভাবছিলাম তুই যখন লিখছিস,এটা নিশ্চয় থ্রি ইডিয়টের ভাষণ টাইপ হবে। 😛 😀
    গল্পের থিম আর মেসেজ টা প্রশংসনীয় :boss: :boss:
    নায়কের রোমান্টিক ডায়লগ গুলো একদম সেইরকম 🙂

    জবাব দিন
  4. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    পুরোপুরি অফ টপিক ----
    রক্ত দেয়া নিয়ে বুয়েটে একটা কাহিনী শুনেছিলাম, সত্যি কিনা কে জানে। একবার কোন একছেলেকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রক্ত দেবার জন্যে রাজি করানো হলো। রক্ত দিতে গিয়ে হাস্পাতালে পৌছে দেখে সেদিন আর লাগবে, কিন্তু পরের দিন লাগবে। তারপরে ওই ছেলে হলে পৌছে ব্যাগ গোছানো শুরু করলো। তার রুমমেট জিজ্ঞেস করলো - ভাই কই যান??
    ওই ছেলেটা জবাব দিলো --- বাড়ি যাচ্ছি, কদিন পরে ফিরবো। রক্তের জন্যে কেউ খোজ করলে বলবা, আমার ব্লাড গ্রুপ চেঞ্জ হয়ে গেসে, তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি ......

    জবাব দিন
    • আছিব (২০০০-২০০৬)

      ভাই,ঘটনা সত্য হওয়াটাই স্বাভাবিক।
      কি আর বলব,অনেক স্বাস্থ্যবান,নীরোগ,স্মার্ট ছেলেপেলে রক্ত দিবার কথা শুনলে ভয়ে পাংশু হয়ে যায়।কত জরুরী ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন হয়,অনেকে কত বিপদে পড়ে এদেরকে অনুরোধ করে,তারপরও এরা রাজী হয়না।আমি অবাক হই আর ভাবি,একটা মানুষ এত যন্ত্রণার মধ্যে থাকে,জীবন-মৃত্যুর সন্দিক্ষণে থাকে,আর এরা সামান্য একটা সুঁই এর গুঁতা খেতে ভয় পায়!!এরা কি নির্দয়,পাষাণ নাকি কাপুরুষ!!
      গত বছর আমার আম্মুর একটা অপারেশনে চার ব্যাগ রক্ত লেগেছিল।আমি রক্তের খোঁজ করতে গিয়ে এরকম কিছু কাপুরুষ দেখেছি।তখন যদি টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা না পিছাত এক সপ্তাহের জন্য,জানি না স্বেচ্ছায় রক্ত দিবে আশেপাশে এমন কেউ থাকত কিনা।আমার চার বন্ধু রক্ত দিয়েছিল,অনেক সময় কষ্ট করে......তাদেরকে ধন্যবাদ।

      জবাব দিন
  5. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    আমার পরথম রক্তদানের কাহিনী মনে পইড়া গেল রে পিন্টু-নসুর রক্তদান কর্মসূচীর পাশ দিয়া যাওনের সময় এক অপরূপাকে(লাল সেলোয়ার পরিহিতা) রোগীর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সব দ্বিধা ভুইলা বেলাড দিছিলাম-বেলাদ দেওনের সুমায় ওই অপরূপা আমার হাতের নাড়ি টিপাটুইপাও দেখছিলো...এর পর থিকা আমি নিয়মিত রক্তদাতা :shy: তাছাড়া রক্ত দেওনের পর কেক,আইস্কিরিম আর স্পিরুলিনা জুস খাইতে সুপার্ব লাগে।জোশিলা লিখছোস রে পিন্টু!

    অফ টপিক-রক্ত দিন,জীবন বাঁচান

    জবাব দিন
    • আছিব (২০০০-২০০৬)

      ভাই,কষ্ট করে পাস্ট-এ এসে গল্পটা পড়ে আমাকে ধন্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। :salute:

      আপনার মত প্রথম রক্তদানের অভিজ্ঞতা থাকলে তো আল্লাহর রহমতে কন্টিনিউয়াস রক্ত সরবরাহ করতাম 😉
      ইয়ে বস, সত্য কথা হল, আমি তৃতীয় বার ব্লাড দিতে গেছি ডিএমসি এর ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডে।ওইখানকার যে পরিবেশ,তা দেখেই আমার চোখে পানি এসে গেছে।পুরা মানবেতর অবস্থা।যাদের পয়সা নাই,তাদের আসলেই কেউ নাই ভাই।
      রক্ত দিছি তিনবারই কোন না কোন দুঃস্থ মানুষ কে,এত কিছু খাওয়ানোর আগেই চলে আসছি।অযথা আমার জন্য টাকা খরচ করতে দেইনি ভাই 🙂

      জবাব দিন
  6. অরূপ (৮১-৮৭)

    কোন ব্যাচের একটা ছেলে যেন রক্তদান জনিত জটিলতায় মারা গেছে। পড়েছিলাম নামটা মনে করতে পারছি না।
    লেখাটা পড়ে মনে পড়ল। লেখাটা ভালো হয়েছে। :thumbup: :thumbup:


    নিজে কানা পথ চেনে না
    পরকে ডাকে বার বার

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।