ফাউ প্যাচাল-২

আমি ঘুরে ফিরে আবার ফাউ প্যাঁচাল পাড়তে আসলাম। কারণ আমার বখিল কাব্যচর্চায় ঘোর অমানিশা, কলম ছন্দ খুঁজতেছে আকুল হয়ে। তাই বলতে পারেন, এই প্যাঁচাল আমার কপিতা ক্ষেতে বেগুন ফলানো। তাছাড়াও অধিকাংশ ব্লগারই সিনিয়র যেনারা সমালোচনা কখনই করেন না, বরং উৎসাহ দ্যান। তাহলে আজকের গল্প শুরু করি………………
গল্প ৩-
এই গল্প আমার বেশ প্রিয় একজন স্যার কে নিয়ে। স্যার পড়াতেন বোটানি, ছিলেন বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের হেড। স্যারের ছিলো এক অদ্ভুতুড়ে গোঁফ এবং…………স্যার কথা কইতেন আনুনাসিক স্বরে। কেমন আনুনাসিক স্বরে??
বঁয়েঁজ, তোঁমরাঁ ছঁবিঁ আঁকোঁ। এঁতেঁ ভাঁলোঁ নঁম্বঁর পাঁবেঁ। বাঁয়ঁলঁজিঁ শুঁধুঁ পঁড়াঁ নঁয়, ছঁবিঁ আঁকাঁও বঁটেঁ……………।
এই কারণে ক্লাস সেভেনে স্যারের প্রথম ক্লাস করার পর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম, গভীর রাতে আমি অজানা কারণে শশ্মানঘাটে গেছি এবং পথে আমারে দেখতে পায়ে এলাকার পেত্নীসকল আমারে দিয়ে ডিনার খাইবার পরিকল্পনা আঁটতেছে । বলাইবাহুল্য উনারা নিজেদের মধ্যে আনুনাসিক স্বরে কথাবার্তা কইতেছিলো। স্বপ্নের এক পর্যায়ে আমি উনাদেরকে আগামী বায়োলজি পরীক্ষায় ডজনখানেক ছবি আঁকার প্রতিশ্রুতি দিলে উনারা খুশি হয়ে মরিচপোড়া ও শুঁটকিভর্তা দিয়া আমাকে খাওয়ার অযাচিত পরিকল্পনা বাতিল করেন।
যতদুর মনে পড়ে স্বপ্নে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করে আমি ওই টার্মের বায়োলজিতে হায়েস্ট মার্কের কাছাকাছি পায়েছিলাম। তবে আসল গল্প এসব নিয়া নয়, স্যারের বৃক্ষপ্রেম নিয়া। স্যরের বৃক্ষপ্রেম ছিলো কিংবদন্তিতুল্য। উনি বিরল প্রজাতির সব বৃক্ষ যোগাড় করতেন এবং সোৎসাহে সেইগুলা রোপণ করতেন। আমাদের হাউস গার্ডেনে ছিলো এমনি এক বিরল প্রজাতির গাছ। অইটার বৈজ্ঞানিক নাম শোনার আধা সেকেন্ডের মধ্যে আমি ভুলে গেছিলাম(এখনও মনে নাই!)। তো গার্ডেনিং কম্পিটিশন আগায়ে আসতেছে, সব জুনিয়র ব্যাচরে হাউস গার্ডেনে নামানো হইছে কাজ করার জন্য। চুপচাপ কাজ চলতেছে। হঠাৎ………
এক অমানুষিক আনুনাসিক আর্তনাদ।
আঁমাঁর গাঁ-আঁ-আঁ-আঁ-আঁ-আঁ-ছ!!!
আমরা আতঙ্কে বাইর হয়ে এসে দেখি স্যার মহা ক্রোধে এক ক্লাস সেভেন এর প্রাণনাশের উপক্রম করতেছেন। কমবখতের দোষ এই যে সে মহা উৎসাহে সেই বিরল প্রজাতির গাছরে আগাছা মনে করে তারে উপড়াইয়ে ফেলছে। উপস্থিত অন্যান্য শিক্ষকরাও বৃক্ষের মূলোৎপাটনের অপরাধে বেচারা জুনিয়রের প্রাণোৎপাটনের পাঁয়তারা কষতে লাগলেন। তবে আমাদের হস্তক্ষেপে এবং অনুরোধে ওই ক্লাস সেভেন কে ছেড়ে দেওয়া হয়।
অতঃপর আমরা স্যারদেরকে খুশি করার প্রয়াসে আমরা ওই জুনিয়ররে তীব্র ভর্ৎসনা এবং বৃক্ষপ্রেমের উপর এক নাতিদীর্ঘ লেকচার দিলাম। এই ঘটনার পর থেকে আমাদের ব্যাচ স্যারের কাছে বৃক্ষপ্রেমিক ব্যাচ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ওবং এই কারণেই পরবর্তী ঘটনার গুরুত্ব অনেক বেশি।
———————————————–
ডিনার শেষে টয়লেটের সামনে বিশাল লাইন, বিশাল মানে ২ খানা টয়লেট ব্যবহার করে শতাধিক ক্যাডেট। আমরা সব্বাই ব্লাডারের চাপে কাহিল এবং বিভিন্ন ভাষায় ক্যাডেট কলেজ সিস্টেমের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতেছি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যাচের নক্ষত্র “খাগাবাবা”-র মাথায় এক বৈল্পবিক আইডিয়া আসলো। তিনি গভীর ভাবনাচিন্তা শেষে বায়োলজি ল্যাবের সামনের একটা টবে জলত্যাগ করা শুরু করলেন। অইটা দেখে আমরা বাকি সবাই অন্যান্য টবগুলাতে ব্লাডারের চাপমুক্তির প্রয়াস চালায়ে দিলাম। আমি চিরকালই ধীর একজন বালক, তাই দোতলায় আর কোনো টব ফাঁকা না পায়ে তিনতলার সিঁড়ির এক “বিরল প্রজাতির” ক্যাকটাসে জলদান করে আসলাম।
অল্পবিদ্যা ভয়ংকারী এবং কেমেস্ট্রি পড়ায় আমাদের সকলেরই ধারণ ছিলো মূত্রে NH3 থাকে এবং এর সাথে ইউরিয়ার রাসায়নিকগত মিল বিদ্যমান। তাই আমরা হৃষ্টচিত্তে এই ভেবে ফর্মে ফিরে আসলাম যে গাছগুলারে আমরা খালি জলদানই নয় বরং উপযুক্ত পরিমাণে সারও প্রদান করেছি। না বললেই নয় এতে আমরা কিঞ্চিৎ গর্বিতও বোধ করতেছিলাম। অতঃপর আমরা কলেজের আর কোন কোন বৃক্ষে জলত্যাগ করে তার উপকারসাধন করব তা নিয়া গভীর আলোচনায় মশগুল হয়ে পড়লাম। কিন্তু হায়! আমাদের বালকচিত্তে এই কথা ঘুর্ণাক্ষরেও আসে নাই যে মূত্রের আধিক্য ওই গাছগুলোর উপর বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
তাই পরদিন সকালে আমরা যখন এক সুদীর্ঘ গগনবিদারী আনুনাসিক আর্তনাদ শুনতে পেলাম তখন আতংকিত হবার পাশাপাশি আমরা কিঞ্চিত আশ্চর্যও হয়েছিলাম। স্যারের বিলাপ অনুসরণ করে গিয়ে আমরা দেখি টবের সকল বৃক্ষ মৃতপ্রায় কিংবা মৃত্যুবরণ করেছে। না বললেই নয় ওইখানেই আমাদের বৃক্ষে জলত্যাগের দেশব্যাপি কর্মসূচীর পরিকল্পনার অপমৃত্যু ঘটে।
তো এই ঘটনা থেকে আমি কি শিক্ষা লাভ করেছিলাম??
এই যে ক্যাকটাসের জীবন শক্তি প্রখর। যেইখানে অন্যান্য বৃক্ষ মারাত্মক প্রতিকুলতার মুখে মৃত্যুবরণ করে সেইখানে ক্যাকটাস কিভাবে জানি বেঁচে থাকে।

প্রিয় বৃক্ষকূলের অকালমৃত্যুর শোকেই হউক কিংবা স্ত্রীর চাপেই হউক, স্যার একবার হুট করে উনার বিরল গুম্ফরাজি কর্তন করে ক্লাস নিতে উপস্থিত হলেন। স্যারের গুম্ফবিহীন চেহারা আমাদের মনে বিরাট আমোদের সৃষ্টি করল। উনার নতুন চেহারা এতটাই আনন্দদায়ক ছিলো যে এস.এস.সি পরীক্ষার পড়ার চাপে আমাদের যখন মন খারাপ থাকত তখন আমরা একে অন্যকে স্যারের গুম্ফবিহীন চেহারা মনে করায়ে দিতাম এবং আমাদের মন আনন্দরসে পূর্ণ হয়ে উঠত। যা কিছু সুন্দর ও আনন্দদায়ক তাতে আমাদের বিশ্বাস ফিরে আসতো। এরপর আমরা আবার প্রফুল্লচিত্তে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতাম।
তাই স্বীকার করতে দ্বিধা নাই যে আমাদের ব্যাচের এস.এস.সি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের পেছনে স্যারে কর্তিত গুম্ফরাজির বিরাট অবদান আছে।

আর আমার পূর্ববর্তী পোষ্ট ফাউ প্যাচাল-১ পড়তে চাইলে

৯,০৯৪ বার দেখা হয়েছে

১০৭ টি মন্তব্য : “ফাউ প্যাচাল-২”

  1. আন্দালিব (৯৬-০২)

    ব্যাপক মজার লেখা। বিশেষ করে বৃক্ষের কথা শুনতে বড়ো মধুর লাগে! :clap:

    তবে পরীক্ষার খাতার মতো, সাধু-চলিতে মিশিয়ে ফেলেছো অনেক। এরকম রম্য সাধুতে দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। তোমার লেখাটা পুরোপুরি সাধুতে নিয়ে আসতে পারতে, অন্তত ক্রিয়াপদগুলো আনলেই লেখাটা আরো ভালো হয়ে উঠবে! চালায়ে যাও...!

    জবাব দিন
  2. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    আচ্ছা........আমার যদি ভুল হয়ে না থাকে তবে স্যারকে আমরাও পেয়েছি। আর রাজশাহীতে তিনি এটাই প্রথমবার নন 😛 🙂 🙂 😛 । স্যারকে গোঁফ ছাড়া কল্পনা করতে আমারও কেমন যেন বুগবুগ হাসি উঠতেছে 😀 😀 ।

    রিজওয়ান, অসাধারণ। সিসিবিত এই ধরণের লেখাগুলোই আমার বেশি ভাল লাগে :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  3. আরাফাত (২০০০-০৬)
    তো এই ঘটনা থেকে আমি কি শিক্ষা লাভ করেছিলাম??

    প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে জোক্স করতে হয় না 😛
    এবং তোমার জিনিস এ প্রচুর সার আছে তাই তোমার ক্যাকটাসটা মরে নাই। :duel:

    জবাব দিন
  4. খ্যাক খ্যাক খ্যাক,
    লেখা পুরাই কোপানি হইছে রে।

    মূত্র নিয়া বোধহয় সব ক্যাডেটেরই কিছু না কিছু কাহিনী আছে। আমি আর ইসলাম একবার পৃথিবীব্যাপী জ্বালানি সমস্যার সমাধান কল্পে মূত্রের অবদান বিষয়ে অল্পের জন্য নোবেল প্রাইজ মিস করছিলাম। পইড়া দেখতে পারিস।

    পিসিসি তে আমাদের ব্যাচের কে যেন মূত্রত্যাগকালে বৈদ্যুতিক শক প্রাপ্ত হইয়াছিল যেই কাহিনী থ্রি ইডিয়টস ছবিতে মারছে।

    আরো বেশি কইরা ফাউ প্যাঁচাল পড়তে ও পাড়তে মন চায়। পাঁচ তারা দাগাইলাম।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।