বিয়ে বিচ্ছেদ, বিশেষজ্ঞ মতামত ও আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা-১

সম্প্রতি বাংলাদেশে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিয়ে বিচ্ছেদ মহামারী আকার ধারণ করেছে যা কয়েকমাস আগে মিডিয়াতে এসেছিল। অনেকগুলো পত্রিকা এবিষয়ে সাম্প্রতিক তথ্য ও উপাত্তের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেইসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আমি এই উপসংহারে পৌঁছেছি যে, বিয়ে বিচ্ছেদকে রোধ করার জন্য বাংলাদেশকে তালেবানী আফগানিস্তান বানাতে হবে। পাশাপাশি, সমাজবিজ্ঞান এমন একটি বিষয়, যেখানে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য সামজবিজ্ঞান না পড়লেও চলে। কিভাবে এইসব অনুসিদ্ধান্তে আসলাম, সেই কথা বলি-

গত মার্চের ১৪ তারিখে সময়ের কণ্ঠস্বর পত্রিকায় প্রকাশ- গত ছয় বছরে ঢাকা সিটিতে প্রায় ৩১ হাজার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে (বেড়েই চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদ )। আর চট্টগ্রামে ২০১৫ ও ২০১৬ এই দুই বছরে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে ৭৪৪৭ যার মধ্যে ৭০% এরও অধিক আবেদনকারী ছিল নারী। কারণ হিসেবে আবেদনকারীরা দায়িত্ব পালনে অনীহা ও অবহেলা, পারস্পারিক আস্থাহীনতা এবং পরকীয়ার কথা উল্লেখ করেছে। আর চট্টগ্রাম সিটির ম্যাজিস্ট্রেটের মত অনুসারে এর কারণ ইন্টারনেট ও মোবাইলের মাধ্যমে অবাধ মেলামেশার সুযোগ। একই তথ্য নিয়ে একই দিনে ভয়েস বাংলা নামের পত্রিকাতেও প্রতিবেদন এসেছে যার শিরোনামেই এর কারণ হিসেবে আস্থাহীনতা এবং পরকীয়া উল্লেখ করা হয়েছে (আস্থাহীনতার কারণে বেড়েই চলেছে বিয়ে বিচ্ছেদ )।

দৈনিক সমকাল এপ্রিলের ২৯ তারিখে বিয়ে বিচ্ছেদের উপরে একটা বেশ বড় কলেবরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে (বাড়ছে বিয়ে বিচ্ছেদ )। এখানে ঢাকা সিটির তথ্যগুলো আরও বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায়। এখান থেকে জানা যায় যে, গত ছয় বছরে বিয়ে বিচ্ছেদের ৩৬৩৭১টি আবেদনের মধ্যে ২৪৮০৩টি, অর্থ্যাৎ ৬৮% ক্ষেত্রে আবেদনকারী হচ্ছে নারী। এইখানে কারণ হিসেবে ৮৭% বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পরকীয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও উল্লেখ করা হয়েছে পারিবারিক কলহ, যৌন অক্ষমতা, মতের অমিল এবং তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার।

এই বিষয়ে মে মাসের ২১ তারিখে “তালাকের টর্নেডো” শিরোনামে সবথেকে চমক জাগানো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক মানবজমিন (তালাকের টর্নেডো )। এখানে বিয়ে বিচ্ছেদের পেছনে উপরে উল্লিখিত কারণগুলোর কথাই রয়েছে। তবে এখানে সিটি কর্পোরেশনের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলা হয়েছে যে, বিয়ে বিচ্ছেদর আবেদনে নারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা।

দৈনিক আজাদী পত্রিকার ৬ মে সংখ্যার একটা নিবন্ধ উল্লেখ করেছে যে, চট্টগ্রামের মেয়র পরিবারে মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাকে মেয়েদের অধিক হারে তালাকের আবেদনের কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন (বিবাহ বিচ্ছেদকে বিদায় )।

বিয়ে বিচ্ছেদ বিষয়ে সংখ্যাগত উপাত্তের পাশাপাশি উপরের এইসব প্রতিবেদনে সংসার ভাঙ্গার যে কারণগুলো দেখলাম, এগুলো চিহ্নিত করেছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্টরা।

বিয়ে ও পরিবার সমাজের মূল ভিত্তি। আর এই বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মতামতই বিশেষজ্ঞ মতামত। কাজেই, উল্লিখিত প্রতিবেদনগুলো সমাজবিজ্ঞানীদের মতামতও সংযুক্ত করেছে এই সমস্যার কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে। দেখি, এই বিশেষজ্ঞরা বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ ও ফলাফল নিয়ে কি বলেছেন।

মানবজমিনের প্রতিবেদনে ঢাবির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদা রশীদ চৌধুরী বলেছেন, মেয়েরা আগের থেকে বেশি সামাজিক ও আর্থিক অধিকার পেয়েছে বলে তালাক দিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। পাশাপাশি তিনি উপরে উল্লিখিত কারণগুলোর কথাও বলেছেন। সমকালের প্রতিবেদনে ঢাবির সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সালমা আক্তার বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মেয়েদের শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার বৃদ্ধির কথা। একই প্রতিবেদনে ঢাবির সমাজবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নেহাল করীম বিয়ে বিচ্ছেদের পেছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের উল্লিখিত কারণগুলো পুণরাবৃতি করেছেন।

সময়ের কণ্ঠস্বর পত্রিকার প্রতিবেদনে একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অনুপম সেনের কাছ থেকে জানা গেছে যে, গ্রাম সমাজ দ্রুত ভেঙ্গে নাগরিক সমাজে পরিণত হচ্ছে যেখানে মানুষ নাগরিক সুবিধা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। পাশাপাশি নৈকট্য ও যোগাযোগের সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিয়ে বিচ্ছেদের হার বাড়ছে। দৈনিক আজাদীর প্রতিবেদনে অধ্যাপক অনুপম সেনের উদ্ধৃতি দিয়ে নারীদের আর্থিক স্বাধীনতাকে তালাকের হার বৃদ্ধির কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে যে, বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা আর সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ দারুণ মিল- দুইপক্ষই কারণ হিসেবে পরকীয়া ও তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের পাশাপাশি পারিবারিক বোঝাপড়ার অভাব, দায়িত্বে অবহেলা, ইত্যাদির উল্লেখ করেছে। এমনকি নারীদের অধিক হারে তালাকের আবেদনের কারণ হিসেবেও দুই পক্ষই নারীর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উল্লেখ করেছে!

আমি অবাক হয়েছি দুইটা কারণে। এক, সমাজবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের অধ্যাপকরা যেভাবে বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ বিশ্লেষণ করলেন, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারাও একই বিশ্লেষণ করলেন। প্রকৃতপক্ষে, মোটামুটি সাধারণজ্ঞান সম্পন্ন যেকোন ব্যক্তিকে বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ জিজ্ঞেস করলেও একই রকম উত্তর পাবো বলে আমার ধারণা। তাহলে কি ধরে নিবো যে, সমাজবিজ্ঞান আর সাধারণজ্ঞানের মধ্যে কোন ফারাক নাই?- ফারাক অবশ্যই আছে। অর্থাৎ, বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, এগুলো সাধারণজ্ঞানপ্রসূত, কোন প্রকার বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নয়।

দুই, নারীর আর্থিক স্বাধীনতার বৃদ্ধিই যদি তাদের অধিক হারে তালাকের জন্য আবেদন করার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ত এটাই সত্য যে, নারী বিয়ের মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয় নিজেদের আর্থিক স্বাধীনতার অভাবে। এক্ষেত্রে তসলিমা নাসরীন ত ঠিকই বলেছিল যে, “বিয়ে হলো নারীর জন্য শৃংখলস্বরূপ। এই শৃংখল ভাঙতে হবে” (নির্বাচিত কলাম, সাপ্তাহিক যায়যায়দিন, সন তারিখ মনে নাই)।

উল্লিখিত প্রতিবেদনগুলো সমাজবিজ্ঞানে অ-বিশেষজ্ঞদের বরাতে কোন সমাধান জানাচ্ছে না। সমাধানের জন্য তারা স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের কাছেই গেছে। বিয়ে বিচ্ছেদ রোধের জন্য এই বিশেষজ্ঞরা সামাজিক দায়বদ্ধতা, পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা আর পারস্পারিক বিশ্বাস বৃদ্ধি, পারিবারিক সম্মানবোধ, এবং আত্মসচেতনতার উল্লেখ করেছেন।

এখন দেখা যাক, বিশেষজ্ঞদের অনুসরণ করে কিভাবে দেশে আশংকাজনক হারে বর্ধিষ্ণু বিয়ে বিচ্ছেদের সমস্যার সমাধান করা যাবে।

আমরা জানি, যেকোন সমস্যার সমাধানের জন্য সবার আগে দরকার তার কারণ নির্ণয় করা, এরপর সেই কারণকে দূর করার মাধ্যমে সমস্যা নির্মূল করা। যেমন, চিকনগুনিয়ার জন্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এক প্রজাতির মশার কামড়কে। আর তাই প্রতিকার হিসেবে সেই মশাকে নির্বংশ করতে হচ্ছে, ভাইরাস জ্বর হলে সেই ভাইরাসকে মেরে জ্বর সাড়ানো হচ্ছে, ইত্যাদি। উল্লিখিত প্রতিবেদনগুলোতে বিয়ে বিচ্ছেদের যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোকে মোটাদাগে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। এক, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন তথা তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার এবং এর মাধ্যমে পরকীয়া; দুই, পারিবারিক সমঝোতার অভাব, দায়িত্বে অবহেলা ও অনীহা; এবং তিন, নারীর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং ফলস্বরূপ আত্মনির্ভরশীলতা। যুক্তিসঙ্গতভাবেই, বিয়ে বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য আমাদেরকে এর কারণগুলো দূর করতে হবে। অর্থ্যাৎ, আমাদেরকে যে যে ব্যবস্থা নিতে হবে, সেগুলো হলো- এক, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরকীয়ার সুযোগ বন্ধ করা; দুই, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে পারিবারিক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা; এবং, নারীর স্বাধীনতা সীমিত করার মাধ্যমে তাদেরকে পুরুষ/স্বামীর উপর নির্ভরশীল করে তোলা।

পাঠক, বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবনা অনুসরণ করে বিয়ে বিচ্ছেদ ঠেকানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে দেশের কি হাল হবে, অনুমান করতে পারছেন? ইন্টেরনেট ও মোবাইল ফোনের উপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে, ধর্মীয় ও সামাজিক নীতি শিক্ষার উপর ব্যাপক জোড় দিতে হবে, এবং মেয়েদেরকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে হবে। সেই দেশের চেহারাটা কেমন হবে? তালেবানী আফগানিস্তানের মতো, ঠিক?

আমরা নিশ্চয়ই পেছনে ফিরে যেতে চাইনা, তালেবানী আফগানিস্তানে ত আলবৎ না। তাহলে কি ক্রমবর্ধমান বিয়ে বিচ্ছেদের মধ্যে বাস করাই বাংলাদেশের নগর সমাজের অমোঘ নিয়তি?

প্রকৃতপক্ষে, বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ ও প্রতিকার নির্ণয়ে আমাদের বাংলাদেশের মিডিয়া এবং সমাজবিজ্ঞানীরা যে ধারণা পোষণ করছে, সেগুলো না বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, আর না সঠিক বিশ্লেষণ। তাহলে এই সমস্যার সঠিক বিশ্লেষণ কি, এর সমাধানই বা কোন পথে?

এই বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হবে আপনাদেরই একজন, ডঃ হাসান মাহমুদ। তার সাথে কথা বলার আগে একটা বিরতি নিচ্ছি 🙂

৭ টি মন্তব্য : “বিয়ে বিচ্ছেদ, বিশেষজ্ঞ মতামত ও আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা-১”

  1. কৌশিক(২০০৪-২০১০)
    সমাজবিজ্ঞান এমন একটি বিষয়, যেখানে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য সামজবিজ্ঞান না পড়লেও চলে।

    অসুখের কথা শুনলেই এদেশে আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী সবাই প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেয়। তাই বিবাহবিচ্ছেদ বিষয়ে মহামূল্যবান মতামত যে দেবে তা তো বলাই বাহুল্য!
    সমাজবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ জানার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      হুম, ঠিকই ধরেছ। তবে এইটা দ্বিতীয় পর্ব আর প্রথম পর্বেরও কিছুটা নিয়ে আমজনতার জন্য লিখেছি। মনে হলো, বিষয়টা বর্তমানের প্রেক্ষিতে জনগুরুত্বপূর্ন। সরাসরি পত্রিকাতেই পাঠিয়েছি। এতে প্নেকে পড়তে পেরেছে। আর পত্রিকাওয়ালাও বলেছিল অন্যত্র ছাপলে তারা আগ্রহি হবে না। কি রা করা......


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।