শেকড়ের সন্ধানেঃ বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়-২

পর্ব-১

বৃটিশদের সময় ১৮৭২ সালে সর্বপ্রথম সরকারিভাবে বাংলার জনসংখ্যা গণনা করা হয়। তৎকালীন বাংলার রাজনীতি, শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক এবং সেখানে ছিল হিন্দুদের প্রধান্য; অপরদিকে মুসলমানরা ইংরেজপূর্ব শাসনকেন্দ্র মুর্শিদাবাদ এবং উত্তরবঙ্গে কিছুটা প্রভাবশালী। তুলনামূলকভাবে অনুন্নত দক্ষিনবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গকে কলিকাতাকেন্দ্রিক বাংলার পশ্চাতভূমি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এসব এলাকার জনগোষ্ঠী সম্পর্কেও খুব একটা আগ্রহ দেখা যেতো না। এদেরকে ধরে নেওয়া হতো নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং অন্যান্য স্থানীয় আদিবাসী হিসেবে। কিন্তু জনসংখ্যার পরিসংখ্যান সকলকে অবাক করে দেয়। এ প্রসঙ্গে বাংলায় দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ইংরেজ কর্মকর্তা জেমস ওয়াইজ লিখেছেন “১৮৭২ সালের সেনশাসে সবথেকে বেশি ইন্টেরেস্টিং আবিষ্কার ছিল মুসলমানদের পুরোনো রাজধানীর বদলে নিম্নবঙ্গের পাললিক ভূমিতে বিশাল মুসলিম জনসংখ্যা।”

১৮৭২ সালের জনসংখ্যা সেনশাসে দেখা গেল চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, পাবনা ও রাজশাহী জেলায় মুসলমানের সংখ্যা শতকরা ৭০ জনের বেশি, এই হার বগুড়াতে শতকরা ৮০ জনেরও উপরে। এখানে উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের শাসনকেন্দ্র মুর্শিদাবাদে মুসলমানের সংখ্যা শতকরা ৫০ জনের কম ছিল। নিচের ম্যাপে সেসময়কার জেলাভিত্তিক মুসলমানদের বিন্যাস দেখানো হলোঃ

১৮৭২ সালের জনসংখ্যা গণনা অনুযায়ী বাংলার মুসলিম জনসংখ্যার ভৌগলিক মানচিত্র

১৮৭২ সালের জনসংখ্যা গণনা অনুযায়ী বাংলার মুসলিম জনসংখ্যার ভৌগলিক মানচিত্র

দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গের এই বিশাল মুসলমান জনগোষ্ঠী কোথা হতে এলো? কখন এলো? আর কিভাবেই বা এলো? এইসব প্রশ্ন একটা ব্যাপক বিতর্কের সূত্রপাত করল যা’ আজ পর্যন্ত আমাদের মাঝে জারি আছে। এই বিতর্কে সর্বপ্রথম অংশ নেন আলোচ্য সেনশাসের মূল গণনাকারী হেনরি বেভারলি নিজেই। বাংলায় মুসলমানদের শাসনকেন্দ্রের বাইরে কিভাবে এতো মুসলমান আসল তা’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেভারলি বলেন,”মুঘল রক্ত নয়, বরং নিম্নবর্ণের অধিবাসীরা হিন্দুধর্মের কঠোর বর্ণপ্রথা থেকে ইসলামধর্মে কনভার্ট করেছে।” অর্থ্যাৎ, বেভারলি মাইগ্রেশন তত্ত্বকে বাতিল করে বর্ণপ্রথা থেকে ধর্মান্তরের মাধ্যমে সামাজিক মুক্তির তত্ত্ব প্রস্তাব করেন।

কিন্তু মুসলমানরা এই তত্ত্ব চ্যালেঞ্জ করে বসে। যেমন, আবু এ, গজনবী নামের ময়মনসিংহের এক মুসলমান দাবী করেন যে, বাংলার মুসলমানরা চণ্ডাল ও কৈবর্তদের মতো নিচু জাত থেকে ধর্মান্তরিত হয়নি, বরং তারা মুসলমান শাসকদের সাথে বাংলার বাইরে থেকে এসেছে। তার দাবীর পক্ষে গজনবী উল্লেখ করেন সুলতান হোসেন শাহ কর্তৃক বহিরাগত মুসলমানদেরকে জমিদান, দিল্লীতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার যুগে পরাজিত আফগানদের বাংলায় ছড়িয়ে পড়া, এবং মুসলমানদের মধ্যে বিধবা বিবাহ, বহুবিবাহ ও চিরকুমার না-থাকার জন্য ধর্মীয় চাপ ইত্যাদি কারণে উচ্চ জন্মহার। উপরন্তু, গজনবী উল্লেখ করেন যে, স্বল্পমাত্রায় হিন্দুধর্ম থেকে ইসলামে কনভার্সন হয়েছে, কিন্তু সেটা হয়েছে উচ্চবর্ণের মধ্যে, নিচুবর্ণ থেকে নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি খড়গপুরের (মেদিনীপুর) রাজা, হয়বৎনগর ও জঙ্গলবাড়ির (ময়মনসিংহ) জমিদার, সিলেটের মজুমদার এবং বিক্রমপুরের গাঙ্গুলিদের উল্লেখ করেন। অর্থাৎ, বাংলার মুসলমানরা বেশিরভাগই বাইরে থেকে মাইগ্রেট করে এসেছে এবং তাদের সাথে কিছু সংখ্যক উচ্চবর্ণের হিন্দু ধর্মান্তরিত হয়ে মিশে গেছে। মোটকথা, মুসলমানরা নিচুজাত থেকে উদয় হয়নি।

ইংরেজরা হিন্দুধর্মের নিম্নবর্ণ থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরের তত্ত্বকে ক্রমশঃ আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। জেমস ওয়াইজ ১৮৯২ সালের একটা আর্টিকেলে বাইরে থেকে মুসলমানদের আসার তত্ত্বকে নাকচ করেন দুই যুক্তিতে। এক, উত্তর ভারত থেকে মুসলমাদের ব্যাপকহারে বাংলায় মাইগ্রেশনের কোন ঐতিহাসিক তথ্য নেই; দুই, মুঘল আমলে বাংলাকে উত্তর ভারতের লোকেরা বসবাসের অযোগ্য স্থান মনে করত (বাংলাকে বলা হতো “সম্পদে পূর্ণ দোজখ”), এখানে কোন রাজকর্মচারিকে বদলি করলে তা’ শাস্তিমূলক বলে গণ্য হতো। এই মাইগ্রেশন তত্ত্বের বদলে ওয়াইজ প্রদান করেন সামাজিক মুক্তি তত্ত্ব, অর্থ্যাৎ নিম্নবর্ণের হিন্দুরা উচ্চবর্ণের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে সাম্যবাদী ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। তার আর্টিকেলে এই তত্ত্বের সকল পূর্বানুমান বিস্তারিত ভাবে উপস্থাপন করেন; যেমন- একটা বিদ্যমান বর্ণভিত্তিক হিন্দু সমাজ, নিচু পর্যায়ের কায়িক পরিশ্রমে জড়িত ও শোষিত অস্পৃশ্য বর্ণ, শোষক ব্রাহ্মণ শ্রেণী এবং সাম্যবাদের ধর্ম হিসেবে ইসলাম। বাংলায় বিশাল মুসলমান জনসংখ্যার অভ্যুদয়ের এই তত্ত্ব ইংরেজ সমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।

১৯০১ সালের সেনসাস নগরবাসী উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের মাইগ্রেশন তত্ত্বকে আরও জোড়ালোভাবে বাতিল করে এই থেকে যে, বাংলার মুসলমান কৃষকদের প্রতি দশজনে নয়জনই নিজেদেরকে ‘শেখ’ বলে পরিচয় দিয়েছিল যাদের মূল বাংলাতেই, বাইরের অন্য কোন অঞ্চল নয়। এই সেনসাসের কর্মকর্তা ই, এ, গাইট উল্লেখ করেন যে, উত্তরবঙ্গের মুসলিমদের পূর্বসুরি ছিল রাজবংশী ও কোচ জনগোষ্ঠী এবং পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের পূর্বসুরী চণ্ডাল ও অন্যান্য অনার্য জনগোষ্ঠী। একইভাবে, সেসময়কার সবথেকে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র Bengal District Gazetteers-এও মুসলিমদেরকে স্থানীয় অনার্য আদিবাসীদের উত্তরসূরি হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, ১৯১১ সালের নোয়াখালী District Gazetteer উল্লেখ করেছে যে, জেলার মুসলিম ‘শেখ’ (অর্থাৎ, কৃষকশ্রেণী) এবং নিম্নশ্রেণীর অন্যান্যরা এসেছে এখানকার আদিবাসী (aboriginal races), থেকে, প্রধানত চণ্ডাল জনগোষ্ঠী থেকে। একইভাবে, ১৯৩০ সালের পাবনা ও বগুড়া জেলার সেটলমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী এই জেলা দূটোর মুসলমানরা এসেছে উত্তরবঙ্গের আদিবাসী তথা কোচ জনগোষ্ঠী থেকে। ১৯৩০ এর দশকে তিনটি নৃতাত্ত্বিক গবেষণা হয়, যেগুলো বাংলার মুসলমানদের সাথে বহিরাগত উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের নৃতাত্ত্বিক মিল খুঁজে পায়নি, পেয়েছে স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে। কিছুকাল পর ১৯৬০ সালে করা মজুমদার ও রাও এর গবেষণা পূর্ববঙ্গের মুসলিম ও অমুসলিম উভয়কে এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের থেকেও নৃতাত্ত্বিকভাবে পৃথক হিসেবে সনাক্ত করেছে। অর্থ্যাৎ, বাংলায় উত্তরভারত বা আর কোথাও থেকে মাইগ্রেশন ত’ হয়ই নাই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ থেকেও মাইগ্রেশন হয়নি।

এক্ষণে একথা বলা যায় যে, দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গের, তথা বর্তমান বাংলাদেশের এই মুসলমানরা আরব, মধ্য এশিয়া বা উত্তত ভারত থেকে আসেনি, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ থেকেও নয়। তাহলে এরা কোথা থেকে এলো? কখন এলো? কিভাবে এলো?

বাংলাদেশের মুসলমানদের উৎপত্তি নিয়ে ইংরেজ আমলে শুরু হওয়া একাডেমিক বিতর্কে যতগুলো তত্ত্ব উপরে পর্যালোচনা করলাম, তার কোনটিই পুরোপুরি তথ্যভিত্তিক নয়। এসব তত্ত্বের আলোচকরা কোন একটা বিশেষ তথ্য নিয়ে তার উপর নিজেদের অনুমান চাপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। উপরের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, এসব তত্ত্ব কি কি কারণে অগ্রহণযোগ্য। তথ্যের অভাব ছাড়াও আরেকটা বিষয় লক্ষ্যনীয় এসব তত্বে- এগুলোর কোনটাই ঠিক কোন সময়ে এবং কিভাবে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ট কৃষিজীবী মুসলমান জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল তা’ আলোচনা করেনা।

অনেক সময় আমরা শুনে থাকি যে, বাংলায় ইসলামের আবির্ভাব এবং প্রসার ঘটেছে আরব বণিকদের মাধ্যমে। এমনকি বখতিয়ারেরও দু’শ বছর আগে আরবদের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলাম চলে আসে এবং ক্রমশঃ সেখানে থেকে আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ঈটন এই মতকে নাকচ করেছেন। কারণ, আবর বণিকরা ছিল সুন্নিদের মধ্যে শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী। ফলে তাদের মাধ্যমে যেসব অঞ্চলে ইসলাম প্রসার লাভ করেছে, সেখানেও শাফেয়ী মাজহাবের মুসলমান দেখা যায়; যেমন, দক্ষিন ভারতের মালাবার উপকুল, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানরা শাফেয়ী নয়, হানাফি মাজহাবের অনুসারী, যাদের উৎপত্তি এবং প্রসার হয়েছে মধ্য এশিয়া এবং উত্তর ভারতে। অতএব, বাংলাদেশের ইসলাম সমুদ্রপথে আরব থেকে আসেনি, এসেছে স্থলপথে উত্তর ভারত হয়ে। কিন্তু আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি যে, এসব মুসলমান মাইগ্রেট করে আসেনি। তাহলে কিভাবে এলো? এই প্রশ্নটা আপাততঃ তোলা থাক, পরে এই প্রসঙ্গে ফিরে আসব। তার আগে ঠিক কোন সময়ে বাংলাদেশে কৃষিজীবী এই মুসলমান সমাজের অভ্যুদয় হয়েছিল ঐতিহাসিক তথ্যের আলোকে সেইটা দেখা যাক।

১৩৪৫ সালে ইবনে বতুতা বাংলায় এসেছিলেন এবং সিলেটে হয়রত শাহজালালের (রঃ) সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেসময় সিলেটের উঁচুভূমিতে বসবাসকারীদের তিনি মুসলমান এবং সমতলের কৃষিজীবিদেরকে হিন্দু বলে উল্লেখ করেছেন। তার প্রায় ১০০ বছর পর ১৪৩৩ সালে চৈনিক পরিব্রাজক মা হুয়ান বাংলায় এসেছিলেন রাজা গণেশের ধর্মান্তরিত পুত্র জালালুদ্দীন মুহম্মদের শাসনকালে। তিনি তৎকালীন রাজধানী পান্ডুয়া, চট্টগ্রাম এবং সোনারগাঁও এ ব্যাপক মুসলমানের উপস্থিতি উল্লেখ করেছেন যারা ছিল বহিরাগত এবং নগরবাসী।

১৪৯৮ সালে ভাস্কো দ্য গামা বারতবর্ষে আসার পরপরই ইউরোপীয়রা বাংলায় আসতে শুরু করে। লুদোভিকো ডি ভারথেমা (Ludovico di Varthema) ১৫০৩ ও ১৫০৮ সালের মধ্যে বাংলায় ভ্রমণ করেন। তিনি গৌড়ে ২ লাখ মুসলমান সৈন্যের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। ১৫১২ থেক ১৫১৫ সালের মধ্যে বণিকদের প্রদত্ত বর্ণনার উপর ভিত্তি করে টম পিরেস (Tome Pires) এবং তার সমসাময়িক ডুয়ার্টে বারবোসা (Duarte Barbosa) গৌড়কে একটা সমৃদ্ধশালী নগর এবং এর শাসককে মুসলিম হিসেবে বর্ণনা করেন। তারা উভয়ই নগরে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের ব্যাপক উপস্থিতি উল্লেখ করেন।

অর্থাৎ, ১২০৪ সালে বখতিয়ারের বঙ্গবিজয়ের পর থেকে ১৫০০ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিদেশী পর্যটকদের বিবরণীতে বাংলায় যে মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়, তা’ মূলত নগরভিত্তিক, উচ্চ ও মধ্যশ্রেণী। কোন পর্যটকই গ্রামীণ কৃষিজীবি মুসলমান জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেননি।

কিন্তু মুঘলদের বাংলা বিজয়ের সময় থেকে অবস্থা পাল্টাতে থাকে। ভেনিসিয় পর্যটক সিজার ফেদেরিচি (Cesare Federici) ১৫৬৭ সালে সন্দীপ ভ্রমণ করে সেখানে মুসলমান শাসক, জনগোষ্ঠী এবং সমৃদ্ধ কৃষির উল্লেখ করেন। এর অল্পকাল পরে ১৫৯৯ সালে ফ্রান্সিস ফারনান্ডেজ (Francis Fernandez) নামের এক খ্রিষ্টান মিশনারি নৌকাযোগে মেঘনানদী ধরে উত্তর দিকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ভ্রমণ করেন এই আশায় যে, কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে যদি পাওয়া যায় খ্রিষ্টানধর্মে কনভার্ট করার জন্য। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, নদীর দুই তীরের সকল জনগোষ্ঠীই মুসলমান। পাদ্রি ফারনান্ডেজের বিবরণকে রিচার্ড ঈটন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ট উপস্থিতির সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক দলীল বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

১৭ শতকেও বেশ কিছু ইউরোপীয় পর্যটক একইভাবে গ্রামবাংলায় মুসলমানদের উল্লেখ করেছেন। যেমন, ১৬২৯ সালে সেবাস্টিয়ান ম্যানরিক (Sebastião Manrique) মন্তব্য করেন যে, মুঘলপূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী ছিল ধর্মহীন (heathen), যারা সকলে মুঘল শাসনাধীনে এসে মুসলমান হয়ে গেছে। একইভাবে ১৬৬৬ সালে জঁ ডি থেভেন (Jean de Thevenot) প্রাক-মুঘল বাংলার জনগোষ্ঠীকে অ-মুসলিম এবং মুঘল যুগের বাংলার জনগোষ্ঠীকে মুসলিম বলে চিহ্নিত করেছেন।

উল্লিখিত পর্যটকদের ভ্রমণ বিবরণীর ভিত্তিতে, বিশেষ করে ফারনান্ডেজ ও ম্যানরিকের বর্নণামতে, এই দাবী করা যায় যে বাংলায় মুঘল আমলেই ইসলামাইজেশন হয়েছিল, তার আগে নয়।

সমসাময়িক অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রও মুঘলদের সময় বাংলার গ্রামীণ জনপদে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয়। যেমন, ১৬৩৮ সালে বাংলার মুঘল সুবেদার ইসলাম খান নোয়াখালী জেলায় পর্তুগীজ জলদস্যুদের লুটতরাজের ব্যাপারে আরাকানের রাজার কাছে চিঠিতে স্থানীয় জনগণকে মুসলিম বলে উল্লেখ করেন। আরেকটা সূত্র ‘আলমগীরনামা’ ১৬৬০ এর দশকে ঘোড়াঘাট (বর্তমানে রংপুর) এলাকার জনপদকে মুসলমান বলে উল্লেখ করেছে।

এসব ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, মুঘল আমলে বাংলায় গ্রামীণ জনপদ ছিল প্রধানতঃ কৃষিজীবী মুসলমান। কিন্তু এটা ছিল শুধুমাত্র দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে এবং সেই সাথে উত্তরবঙ্গের একটা অংশে। পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে জানা যায় সম্পূর্ণ উল্টো। যেমন, পাদ্রি ফ্রান্সিস ফারনান্ডেজ যখন ঢাকা জেলায় গ্রামীণ মুসলমান জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করেন, তার ঠিক ১০০ বছর পরে আরেক পাদ্রি ফাদার মার্টিন (Father Martin, S. J.) ১৬৯৯ সালে হুগলী জেলা ভ্রমণ করে লিখেন যে, পুরো অঞ্চলের মানুষ মুর্তিপুজক, অর্থ্যাৎ হিন্দু।

তারমানে, মুঘল আমলে পূর্ববঙ্গে ইসলামাইজেশন হয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গ এই প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে গেছে। কিন্তু কিভাবে? আর একই মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থেকেও কেন শুধু পূর্ববঙ্গেই ইসলামাইজেশন হল, অথচ পশ্চিমবঙ্গে হলো না?
সেইসময় তাহলে পূর্ববঙ্গে কি হয়েছিল?

১৫ টি মন্তব্য : “শেকড়ের সন্ধানেঃ বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়-২”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    ধর্ম টিকে থাকার একটা শক্ত অনুষঙ্গ হলো যাবতিয় ধর্মিয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতিপালন।
    আমার জানা মতে ততকালিন পুর্ববঙ্গ ধর্মিয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বরাবরই পশ্চাতপদ ছিল।
    মুনতাসির মামুনের এক লিখায় উল্লেখ দেখেছিলাম, দু'শো বছর আগেও এই ভুখন্ডে "ঈদ" কতটা অবহেলিত একটা উপলক্ষ ছিল, সেটার।
    তাছাড়া এখনকার হিন্দু ধর্মাবলম্বিরা যে সব আচার পালন করেন, তারও বেশিরভাগই মূলত আমদানিকৃত।
    যেটা বলতে চাচ্ছি, তা হলো, আমরা যদি এমন একটা জনগোষ্ঠির কথা চিন্তা করি, যারা ইনহ্যারেন্টলি শিথিল ধর্মিয় বন্ধনে ছিল, তাহলে নাগরিক তথা রাজ সুবিধা পেতে তাদের জন্য মাস কনভার্শন খুব অসম্ভব কিছু বলে আমার মনেহয় না।

    আরেকটা ব্যাপার উল্লেখ করতে চাই।
    কিছুদিন আগে দেখলাম, ইহুদি পরিচয় নিশ্চিত হতে ওয়াই ক্রোমোজমে একটি জিন নাকি আইডেন্টিফাই করা গেছে।
    আফ্রিকার কেন্দ্রে ঘোর কৃষ্ণাঙ্গ বা মিজোরামের আদিবাসি মিজো ইহুদিদের মধ্যেও ঐ জিনটার উপস্থিতি থেকে তাদের পূর্বপুরুষের ইহুদি থাকাটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
    এটা বলার উদ্দেশ্য হলো, স্থানিয়দের পিসফুল মাস কনভার্শান যদি ঘটে থাকে, তাহলে এখনকার পাশাপাশি থাকা হিন্দু ধর্মাবলম্বি ও মুসলমানদের মধ্যে ওয়াই ক্রোমজমে সেইরকমের কোনো একটি কমন জিনের অস্তিত্ব পাওয়া অসম্ভব না।
    কত পার্সেন্ট মুসলমানের সেই জিন নাই, সেটা থেকেও কনক্লুড করা যাবে, বহিরাগতের পার্সেন্টেজটা কিরকম।
    তবে পুরো প্রজেক্টটা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এটাতে ফান্ডিং-এর জন্য কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনেহয় না।
    সেটাই একটা বিরাট সমস্যা!!!


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    পারভেজ ভাই,
    অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্য এবং পাঠ প্রতিক্রিয়া পেয়ে। আর ইতোমধ্যেই ২০৯ বার দেখা এবং ১৪ বার শেয়ার হওয়া পোস্টের মন্তব্যে প্রথম হওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন 🙂

    অন টপিকে আসা যাক,

    ধর্ম টিকে থাকার একটা শক্ত অনুষঙ্গ হলো যাবতিয় ধর্মিয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতিপালন।

    আপনার সাথে পুরো একমত। তবে এই পোস্টে আমার মূল ফোকাস হলো পূর্ববঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীর ধর্ম হিসেবে ইসলামের অভ্যুদয়। এটা প্রসারিত হবে নাকি সংকুচিত হবে, অর্থ্যাৎ ইসলামের টিকে থাকাটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

    আর জেনেটিক কমোনালিটি পাওয়া গেলে ত বেশ ভালোই হতো। কিন্তু এটা ছাড়াও বিদ্যমান তথ্যের ব্যবহার করেই আমরা নিজেদের শেকড় চিনে নেয়ার চেষ্টা করতে পারি। এখানে সেই চেষ্টাই করবো খানিকটা।

    সাথে থেকে, প্রশ্ন করে, বিকল্প অনুমান প্রস্তাব করে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। (সম্পাদিত)


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    খুবই ইন্টারেস্টিং লেখা। একটু সময় নিয়েই পড়লাম। দীর্ঘ দিনের প্রচলিত মতকে বেশ শক্তভাবেই নাড়া দিচ্ছো। ধন্যবাদ মাহমুদ। অনেক তথ্যই জানছি, শিখছি।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      ভাইয়া,
      ধন্যবাদ।

      প্রচলিত মতগুলো বেশ নড়বড়ে, বিশেষ করে ঐতিহাসিক তথ্য ও গবেষণার আলোকে বিচার করলে এগুলো যে কিভাবে এতদিন ধরে টিকে আছে সেটাই আমার বোধে আসেনা। পুরো ন্যারাটিভটা ৩ কি ৪ পর্বে শেষ করা হলে প্রচলিত মত কিভাবে গোড়ে উঠেছে এবং টিকে রয়েছে সেই দিকেও খানিকটা আলাপ করার ইচ্ছে থাকল। 🙂

      অনেক তথ্যই জানছি, শিখছি।

      ব্যাপক উৎসাহ পেলাম। 🙂


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  4. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    গত বেশ ক'দিন নানাবিধ ঝড়-ঝঞ্জার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এক রকম বিরামহীন ভাবে। পিসি আর সেলফোনে লেখাটা খোলাই ছিলো গত ৫/৬ দিন ধরে। পড়াটা আর হয়ে ওঠেনি।
    অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের।

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
      অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের।

      পারিবারিক ঝামেলা আর পেশাগত ব্যস্ততায় একটু ছেদ পড়েছিল। আগামী সপ্তাহান্ত নাগাদ পরের পর্ব চলে আসবে, আশা করি।

      সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  5. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    খুবই মূল্যবান লেখা। ে বিশয়ে আমার পড়াশোনা নেই, একবার ইসলামিক স্টাডিজের এক অধ্যাপকের সাথে কিছু আলাপ হয়েছিল। উনার বক্তব্য আমার কাছে তেমন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। যাক, বঙ্কিমচন্দ্রের একটা দারুন ইন্টারেস্টিং লেখা আছে বাঙ্গালীর জাতি পরিচয় নিয়ে।

    জবাব দিন
  6. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য দিয়ে অনুপ্রাণিত করায় ধন্যবাদ, মাহবুব ভাই।

    বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাটার রেফারেন্স থাকলে দিবেন, পড়ার ইচ্ছে থাকল।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।