১
প্রখ্যাত লেখক+গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে লন্ডনে বিবিসিতে কর্মরত ডঃ গোলাম মুরশিদ যে বইটার জন্য বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চায় চিরস্থায়ী আসন অর্জন করেছেন, তা হল “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি” (২০০৫)। বই আকারে প্রকাশের আগে এর বেশ কয়েকটা অধ্যায় প্রথম আলো এবং ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেসময় বাংলা সাহিত্যের উপর লেখা অধ্যায়টি পড়ে পুরো বই সম্পর্কে বেশ আগ্রহ জেগেছিল। প্রথম আলো বইটিকে পুরস্কৃত করলে সেই আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। কিন্তু সেমসয় ঢাবি’র পাঠ চুকিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো+বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা+ক্যাডেট বন্ধুদের সাথে “মেস-বাড়ি”র জীবনে মেতে থাকায় এই বইটার জন্য আগ্রহটা চাপা পড়ে যায়। মাস কয়েক আগে এক ছোটভাই ইমেইলে পাঠালো “আমার বই ডট কম” থেকে নামানো একটা কপি। প্রবল আগ্রহ নিয়ে পড়েও ফেললাম একটানে। পুরোটাই। জানলাম অনেক অজানা তথ্য। তবে মনে হলো বইটাতে ইতিহাস খানিকটা কম, ইতিহাসের গল্প বেশি।
বইটার প্রত্যেকটি অধ্যায় আগ্রহী পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে রাখে। এইখানেই অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের সবথেকে বড় সাফল্য। আরেকটা হলো তথ্যসূত্রের ব্যাপকতা। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে তিনি ঐতিহাসিক গবেষণা গ্রন্থ+প্রবন্ধ, সংবাদপত্র, নাটক, লোককথা, স্থাপত্যকলা, প্রভৃতির থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এ’ই তথ্যের প্রাচুর্যই সম্ভবতঃ তার জন্য সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যা’ তিনি অতিক্রম করতে অনেক ক্ষেত্রে অসফল হয়েছেন।
“হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি” বইটার অনেক সাফল্য আছে, গত দশ বছরে সেগুলো নিয়ে আলাপও হয়েছে বিস্তর। কাজেই, আমি আর সেদিকে যাচ্ছি না। এই ব্লগে বইটার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি কতোটা সঠিক ভাবে পাঠ করা যায়, আমি সেই দিকটার একটা নির্মোহ একাডেমিক আলাপ করতে চাই।
২
বই বা প্রবন্ধ যেটাই হোক, তা শুরু হয় একটা সুস্পষ্ট প্রশ্ন ধরে। তারপর সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে আলোচ্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে তত্ত্ব (theory) এবং প্রপঞ্চ (concept) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তত্ত্ব আলোচ্য বিষয়ে বিদ্যমান জ্ঞানকে সংক্ষেপে পরিবেশন করে, এবং এর মাধ্যমে আমাদের জানাশোনার ঘাটতির দিশা দেয়। পাশাপাশি, এটি উত্তর খোঁজার পথও বাতলে দেয়। আর প্রপঞ্চ (এর পর থেকে কনসেপ্ট লিখবো, ঐটাই শুনতে+পড়তে বেশি পরিচিত লাগে) তত্ত্বকে সাহায্য করে বিশদ জ্ঞান সংক্ষেপে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে। (কি, খুব নিরস লাগছে? একাডেমিক গবেষণার কাজই হলো চিপে চিপে ছোবড়া ফেলে দিয়ে নির্যাসটুকু বের করে নেওয়া। কাজেই, কি আর করা… তবে আমি চেষ্টা করবো যথাসাধ্য সহজ করে লেখার)।
বইয়ের সূচনাতে মুরশিদ বলেছেন যে, তিনি বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে লিখবেন। “বাঙালির সংস্কৃতি” হচ্ছে এখানে মূল কনসেপ্ট, যার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিয়ে শুরু করা জরুরী। এইটা মেনে নিয়েও মুরশিদ কোন সংজ্ঞা না দিয়ে পাঠককে আশ্বস্ত করেছেন যে, তিনি সংস্কৃতি বলতে কি বুঝিয়েছেন তা বই পাঠের ভিতর দিয়ে বোঝা যাবে। আর এই বুঝে নেয়ার ব্যাপারটা পাঠকের জন্য সহজ করতে গিয়ে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যথা- বাঙালি সংস্কৃতি কোন খন্ডে খণ্ডে বিদ্যমান, ক্রমবিকাশমান এবং এটি বাংলা ভাষাভাষীদের। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখলাম মুরশিদ বাঙালি সংস্কৃতির যে আবছা ধারণা সূচনাতে দিয়েছেন, তা থেকে বারেবারে সড়ে গেছেন, কিছু কিছু জায়গায় নিজের কথাই বাতিল করেছেন বা সন্দেহ পোষণ করেছেন। ফলে, আবছা সেই ধারণাটা পরিষ্কার হওয়ার বদলে আরও ঝাপসা হয়েছে। শুরু করি নামকরণ থেকে- বাংলা ভাষাকে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক হিসেবে নিয়ে এর উন্মেষকালকে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির শুরু বলে গ্রহণ করেছেন। আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, ভৌগলিক সীমানায় বাংলা, জাতি হিসেবে বাঙালি আর তাদের ভাষা হিসেবে বাংলার উদ্ভব হয়েছে ১৫ শতক থেকে ১৮ শতকের মধ্যে। কিন্তু তারপরেও তিনি বাঙালি সংস্কৃতির বয়স হিসেবে এক হাজার বছর ধরে নিয়েছেন “সমস্ত বিতর্ক বাদ দিয়ে একটি পূর্ণ সংখ্যার খাতিরে” (পৃ-১৮)!
দ্বিতীয় অধ্যায়ে মুরশিদ দেখিয়েছেন যে, মুসলিম সুলতানরা রাজ্যে ক্ষমতার শীর্ষে থাকলেও “সতিক্যার অর্থে দেশ চলতে থাকে পুরনো হিন্দু রাজাদের প্রত্যক্ষ শাসনে” (পৃ-২৭)। আরও উল্লেখ করেছেন যে, সেসব মুসলিমরা “নিজেদের অবস্থা ফেরানোর জন্যই সুদূর বংগদেশ পর্যন্ত এসেছিলেন। ধর্মপ্রচার করে পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য তারা কেউ এদেশে আসেননি” (পৃ-২৯)। কিন্তু দুই পৃষ্ঠা পরেই তিনি আবার উল্লেখ করেছেন যে বাংলায় “মুসলিম শাসনের প্রথম শতাব্দীর ইতিহাস তরবারি দিয়ে দেশ শাসনের ইতিহাস” এবং এরপর জাফর খান কর্তৃক ত্রিবেণীতে মন্দিরের পাথর দিয়ে মসজিদ ও মাজার তৈরিকে উল্লেখ করেছেন “তরবারী দিয়ে ধর্ম প্রচারের একটা উল্লেখযোগ্য নজির” হিসেবে (পৃ-২৯)। দুটো অনুমান পারস্পরিক সাংঘর্ষিক- হয় বাংলা হিন্দু রাজাদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল, নতুবা তরবারি হাতে উদ্যত মুসলমান বিজেতাদের পদতলে ছিল যারা শাসনকার্যের পাশাপাশি ইসলামও প্রচার করতো। যেসব তথ্য তিনি উল্লেখ করেছেন, উপরে উল্লিখিতটি বাদে আর সবগুলোই আবার প্রথমটি, তথা দেশ হিন্দু রাজাদের অধীনে ছিল এই অনুমানকে সমর্থন করে। যেমন, পরের প্যারাতেই তিনি আবার উল্লেখ করেছেন যে, তাদের নামে এই স্থানীয় (হিন্দু) রাজা ও জমিদারেরাই দেশ শাসন করতেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলে এই স্থানীয় হিন্দু রাজাদের ভূমিকা আগের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে (পৃ-৩৭)। এমনকি তরবারি দিয়ে ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত করার অনুমানে তিনি নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছেন (পৃ-৬৪)।
এখানে তিনি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন যে, বহিরাগত সেসব মুসলমান সুলতানরা প্রথম দুইশতক নামেমাত্র দিল্লীর সুলতানের অধীনতা স্বীকার করলেও প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবেই রাজ্য শাসন করতেন। আর এরা ভাগ্যান্বেষণে বাংলায় এসেছিলেন বলে এখানেই স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে (জোর করে অথবা আর্থিক প্রলোভনের মাধ্যমে; কিন্তু তথ্যসূত্র নেই) স্থায়ী হয়ে গেছেন। ফলে দুই-তিন পুরুষের মধ্যেই এরা স্থানীয়দের সাথে মিশে যেতেন; অবশ্য তারা আভিজাত্য ধরে রাখার জন্য আলাদা ভাষা ব্যবহার করতেন। ১৪ শতকে সুলতান ইলিয়াস শাহের মাধ্যমে বাংলায় যে স্বাধীন সুলতানি আমল শুরু হয়, সেসময় বহিরাগত শাসকশ্রেণী এদেশীয়দের সাথে আরও মিশে যায়, দেশীয় রাজা+জমিদারদের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি পায়, এমনকি সুলতানরা বাংলা ভাষাকেও পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। এজন্য মুরশিদ মুঘল শাসন শুরুর পূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে মুসলমান যুগ না বলে বহিরাগত মুসলমান আর স্থানীয় হিন্দু শাসকদের সম্মিলিত “ইন্দো-মুসলিম” আমল বলেছেন। তবে মুঘল আমলে এসে মুসলমান শাসকরা আবার নিজেদেরকে দেশীয়দের থেকে আলাদা করে ফেলে বলে এসময়কে মুরশিদ বাংলায় উপনিবেশিক শাসনের শুরু বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়- মুসলমানরা স্পষ্টতঃই বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল। কিন্তু হিন্দুরা কোথা থেকে? হিন্দুদেরকে মুরশিদ স্থানীয় বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু হিন্দুদের সবথেকে শক্তিশালী এবং সর্বশেষ রাজবংশ সেনরা ত’ নিজেরাই দাবী করত যে তারা কর্ণাটক থেকে, তথা বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল। মুসলমানরা যাদের হাত থেকে শাসনক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, তারা কি উপায়ে স্থানীয় হয়েছিল? তাদের আগে বাংলার বাইরে থেকে আগত বৌদ্ধরা শাসনক্ষমতায় ছিল কয়েক শতাব্দী, তারাই বা কি উপায়ে স্থানীয় হলো? অথবা বাংলা থেকে বিতাড়িত হলো বা হারিয়ে গেল? পরবর্তী অধ্যায়ে মুরশিদ প্রাচীন বাংলার সমাজ ও ধর্মের ইতিহাস আলোচনার মধ্যে দিয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন।
বাংলার সমাজ ও ধর্মের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে মুরশিদ যে বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন তাকে এককথায় বলা যায় বহিরাগতদের সাথে বাংলার আদিবাসীদের সমন্বয়। বহিরাগত আর্য এবং তাদের বৈদিক ধর্ম+কৃষি+বর্ণপ্রথা, বৌদ্ধ ধর্ম ও তাদের সমাজব্যবস্থা, মুসলমান ও তাদের ধর্ম প্রায় এক হাজার বছর ধরে ক্রমাগত একে অপরের সাথে মিলেমিশে জন্ম দিয়েছে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির। কিন্তু তিনি আলোচনায় যতগুলো তথ্য ব্যবহার করেছেন, তার সবগুলোই হয় বৌদ্ধ থেকে হিন্দু ধর্মে (মৌর্য থেকে গুপ্ত যুগে) বা হিন্দু থেকে বৌদ্ধ ধর্মে (পাল যুগে), আবার হিন্দু ধর্মে (সেন যুগে) এবং সর্বশেষে ইসলাম ধর্মে (সুলতানি যুগে) পরিবর্তনের কথা। এখানে আদি যারা ছিল, তাদের কি অবস্থা? নাকি আদৌ কোন জাতিগোষ্ঠী ছিলই না, লোকেরা বাইরে থেকে বিরান বাংলায় এসে বসতি গেড়েছিল?
বৌদ্ধ ধর্ম থেকে ঠিক কি উপায়ে হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মুরশিদ তা ব্যাখ্যা করেছেন এই দুইয়ের সমন্বয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল মুরশিদ সেটা বলেননি। অথচ, হিউয়েন সাঙের বরাতে উল্লেখ করেছেন যে হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিতাড়িত করার কথা (পৃ-৫২)। বৌদ্ধ আর হিন্দু ধর্মের সমন্বয়ের বর্ণনায় হিন্দু শাসকদের জোরজবরদস্তির কথা চেপে গিয়ে আর মুসলমান শাসকদের সময়ে সেগুলোর উল্লেখের মাধ্যমে মনে হয় মুরশিদ একটা অনুমান প্রস্তাব করেছেন যে, বাংলায় ইসলামধর্মের বিস্তার ছিল জবরদস্তিমূলক, যা’ আবার তারই পূর্বের অনুমানের (তথা মুসলমানরা বাংলায় ইসলাম প্রচারের জন্য আসেনি) বিরোধিতা করে।
বাঙালি সংস্কৃতির শুরু হিসেবে মুরশিদ সেনযুগকে ধরেছেন (পৃ-৫৮)। কিন্তু কেন? তিনিই ত উল্লেখ করেছেন যে, সেনরা দক্ষিণ ভারত থেকে আগত এবং বাংলায় তারা সেখানকার বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থাকেই বাংলায় প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া সেন রাজারা বাংলা নয়, বরং সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিল (পৃ-৫৯)। অর্থ্যাৎ, বাঙালি সংস্কৃতির সূচনা সেসময় হয়নি। আর আগে ত’ অবশ্যই নয়। তাহলে ঠিক কোন সময়কে আমরা বাঙালি সংস্কৃতির সূচনা বলে গ্রহণ করবো?
এই অধ্যায়ে সবথেকে বিভ্রান্তিকর বিষয় হলো ইসলামের আগমন নিয়ে মুরশিদের বয়ান। বিভ্রান্তিকর বলছি কারণ তার বয়ান স্ববিরোধীতায় পূর্ণ। যেমন, শুরুতে মুসলমান সুলতানরা বাংলায় ইসলাম প্রচার করতে আসেননি উল্লেখ করেছেন, হিন্দু মন্দিরের জন্য জমিদান করার কথা বলেছেন, বৌদ্ধবিহার ও মন্দির ধ্বংসের রাজনৈতিক+আর্থিক লাভের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এসবের সমর্থনে তিনি রিচার্ড ঈটন আর অসীম রায়ের মতো ঐতিহাসিকের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। তারপরেও বলেছেন যে, “মুসলমান রাজত্ব স্থাপনের বাইপ্রোডাক্ট হিশেবে বাংলার ধর্মবিশ্বাসের উপর এমন প্রচণ্ড একটা ঢেউ এসে আঘাত করেছিলো, তার আগেকার হাজার বছরের মধ্যে যার কোন তুলনা ছিল না” (পৃ-৬২)। আবার বলেছেন, মুসলমানদের আগমন আর্য বা সেনদের মতো নিঃশব্দে বা ধীরে হয়নি। কিন্তু পরের প্যারাতেই ইসলামের আগমন উপ-অধ্যায় শেষ করেছেন এই সিদ্ধান্ত টেনে যে, “ইসলাম ধর্ম তড়িৎ গতিতে নয়, পূর্ববঙ্গ-সহ বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে (পৃ-৬৩)।
স্ববিরোধীটার সমস্যা আরও দেখি বঙ্গে ইসলাম ধর্ম প্রসারের কারণ আলোচনায়। মুরশিদ প্রথমে বাংলায় ইসলাম প্রসারের চারটি মতবাদের কথা উল্লেখ করেছেন- রাজশক্তির জোরে জবরদস্তির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর, ইসলামের সামাজিক সাম্য তথা বর্ণভেদ না-থাকায় নিম্নবর্ণের লোকেদের দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, বাইরে থেকে মুসলমানদের দলে দলে বাংলায় আগমন, এবং পীর দরবেশদের মাধ্যমে ব্যাপক ধর্মান্তর। তিনি সুনির্দিষ্ট সূত্র উল্লেখ করেননি, কিন্তু এই চারটিই বিস্তারিতভাবে এবং সুবিন্যস্তভাবে আলোচনার মাধ্যমে বাতিল করেছেন রিচার্ড ঈটন (১৯৯৩), যার কথা মুরশিদ এই বইয়ের এখানে সেখানে কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। অসীম রায়ও এগুলো আলোচনা করে এগুলোকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন। তাদেরকে উল্লেখ না-করে মুরশিদ নিজের মত করে এই মতবাদগুলো আলোচনা করেছেন এবং বাতিল করেছেন। আর এই করতে গিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে মুসলমান শাসকদেরকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে হিন্দু-নিপীড়ক হিসেবে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন, তিনি জবরদস্তিমূলক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর মতবাদের আলোচনায় অধিকৃত এলাকায় মন্দির তৈরি না-হওয়াকে সুলতানদের মুর্তিপূজা বিরোধিতার প্রমাণ হিসেবে অনুমান করেছেন (পৃ-৬৪), পরাজিত রাজা/জমিদারকে ইসলামগ্রহনের শর্তে মুক্তিদান বা দাক্ষিণ্য বিতরণের নামে হিন্দুদের ধর্মান্তর (পৃ-৬৮), স্থানীয় মেয়েদেরকে ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক বিয়ে (পৃ-৬৯), যেগুলো আদতে বিজয়ী শাসককর্তৃক জোরপূর্বক ধর্মান্তরেরই নামান্তর। তারমানে, মুরশিদ কি একই সাথে ‘রাজশক্তির জোরে জবরদস্তির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর’ মতবাদকে গ্রহণ ও বর্জন করছেন?
এই অংশে আমার সবথেকে বড় অস্বস্তি হলো- পীর ও দরবেশদের প্রচারের মাধ্যমে বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাখ্যাটা মুরশিদ নিশ্চিত ভাবেই রিচার্ড ঈটনের the Rise of Islam and the Bengal Frontier (১৯৯৩) বই থেকে নিয়েছেন। ঈটনের বই পড়েছে এমন যেকেউই ব্যাপারটা বুঝবে। কিন্তু মুরশিদ সেটা স্পষ্ট করে কোথাও উল্লেখ করেননি, যা’ গবেষণা প্রকাশনায় একটা স্বীকৃত রীতি। ঈটনের বইটার মূল ফোকাসই হল বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা কিভাবে বেড়ে গিয়েছিল তা’ ব্যাখ্যা করা এবং তিনি ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটা উত্তর প্রদান করার কাজটিই করেছেন। কিন্তু মুরশিদ সেই অংশকে বাদ দিয়েছেন, কেন তার কোন কৈফিয়ত না-দিয়েই। স্পটতঃই তিনি ঈটনের বই পড়েছেন। কিন্তু তার বক্তব্যকে মুরশিদ কিসের ভিত্তিতে খণ্ডন করেছেন এবং ফলশ্রুতিতে নিজে আরেকটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা’র কোন আলোচনা উপস্থাপন করেননি।
আমার মনে হয়, মুরশিদ তার বইয়ে বাংলাকে অখণ্ড এবং আবহমান কাল ধরে রূপান্তরের ধারায় চিত্রিত করতে চেয়েছেন বলেই তিনি ঈটন প্রদত্ত বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান সমাজের উদ্ভবের প্রক্রিয়াটা ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেছেন। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ মুরশিদ যখন বাংলার রেনেসাঁ, বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ এবং দেশবিভাগের আলোচনা করেন, সেখানে মূলতঃ পশ্চিম বাংলা এবং কলিকাতাকে দেখি, পূর্ববঙ্গ আসে কেবলমাত্র আলোচলার অনুষঙ্গ হয়ে, মূল ফোকাসে নয়। বাঙালির প্রণয়, পরিণয় ও পরিবারের আলোচনায়ও প্রধানত কলিকাতাভিত্তিক মধ্যবিত্তের আলোচনা দেখি। সম্ভবতঃ একই কারণে পূর্ববাংলার মুসলমানের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাকে মুরশিদ “বাংলা সংস্কৃতি দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার ভিত্তি” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন (পৃ-১৮৯)! অথচ তিনি নিজেই নানারকম তথ্য দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিরাই পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরকে বাঙালি বলে স্বীকার করত না। শুধু হিন্দুরাই নয়, এমনকি নের্তৃস্থানীয় মুসলমানরাও পূর্ববঙ্গের সাধারণ মুসলমানদেরকে বাঙালি মনে করতো না। একইভাবে, বিদেশী পর্যটকরাও নানা সময়ে বাংলার যে বিররণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন, সেখানে বাঙালি হিন্দু এবং অভিজাত মুসলমানদের থেকে আলাদা করে উল্লেখ করে গেছেন। কেন এরা সকলেই পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরকে বাঙালি বলে মনে করেনি? আর মুরশিদই বা কেন এই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে দুই বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদেরকে এক অখণ্ড বাঙালি জাতি হিসেবে উপস্থাপন করলেন? কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এমন করলেন তার কোন ব্যাখ্যা তিনি বইয়ের কোথাও দেননি।
৩
রিভিউ ইতোমধ্যেই অনেক বড় হয়ে গেছে। কাজেই, উপসংহারে আসি। সর্বশেষ অধ্যায়ে মুরশিদ সংক্ষেপে বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গুলো উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য বলেছেন এই সংস্কৃতির সমন্বয়ধর্মিতা (পৃ- ৫০২)। কিন্তু কিছুদূর পরে তিনিই আবার উল্লেখ করেছেন শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসা বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিয়ের অগ্রহণযোগ্যতা, ভিন্ন ভিন্ন শব্দের ব্যবহার, আত্মীয়-সম্বোধন ইত্যাদি (পৃ-৫১৬)। তাহলে সমন্বয়ধর্মিতা মানে কি শুধুই পাশাপাশি বাস করা?
সামাজিক বিজ্ঞানে সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে, সেই সাথে আছে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য যা’ থেকে কোন একটা সংস্কৃতিকে সতন্ত্র্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মুরশিদ শুরু করেছেন এই অনুমান দিয়ে যে, সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান দুরূহ। তাই তিনি সেদিকে না গিয়ে বলেছেন যে, পাঠের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি কি তা’ পাঠকের উপলব্ধিতে আসবে। কিন্তু তার আলোচনায় স্ববিরোধীতার জন্য সেই উপলব্ধি স্পষ্ট হওয়ার বদলে আরও ঝাপসা হয়ে আসে। তাছাড়া মুরশিদ বইয়ের অধ্যায়গুলোতে সংক্ষিপ্ত উপসংহার যোগ না-করায় একেকটা অধ্যায়ে তিনি কি বক্তব্য উপস্থাপন করলেন তাও বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, সময় সময় মুসলমান শাসকদেরকে অনাবশ্যক স্থানীয় হিন্দুদের উপর বহিরাগত আক্রমণকারী উল্লেখ করাও তার মূল বক্তব্যকে (অর্থ্যাৎ, সমন্বয়ের সংস্কৃতির ধারণা) দূর্বল করে দিয়েছে। তিনি সর্বশেষ অধ্যায়ে যে উপসংহার টেনেছেন, তা হওয়ার কথা পূর্বের সমস্ত অধ্যায়ের একটা সারসংক্ষেপ, কিন্তু সেখানে দেখি অধিকাংশই নতুন আলোচনা যার সাথে পূর্বের অধ্যায়গুলোর কোন সম্পর্কই নেই। সর্বোপরি, আমার মনে হয়েছে মুরশিদের মধ্যে সংস্কৃতি পাঠের ব্যাপারে একাডেমিক বোঝাপড়ার ঘাটতি আছে, বিশেষ করে কি কি সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একাধিক সংস্কৃতি মিলেমিশে একটা একটা নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেয়, সেই সংস্কৃতি কিভাবে সময়ের আবর্তে অন্য সংস্কৃতি থেকে গ্রহন/বর্জন করে, সামাজিক সচলতা কিভাবে সামাজিক শ্রেণীদ্বারা প্রভাবিত হয়, এবং জাতীয়তাবাদের উদ্ভবে শাসক এবং শাসিত শ্রেণীর ভূমিকা কি। বিদ্যমান আলোচনার প্রেক্ষিতে এইসব আবশ্যিক বিষয়ের তত্ত্ব ও কনসেপ্টকে আলোচনায় না নেওয়ার ফলেই সম্ভবতঃ মুরশিদ এই বইয়ে তার বয়ানের স্ববিরোধীতাগুলো চিহ্নিত করতে পারেননি এবং বাঙালি সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশের একটা তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
মোটের উপর, বাঙালি সংস্কৃতিকে জানার ক্ষেত্রে এই বইটাকে আমার কাছে অসম্পূর্ণ এবং অপরিপক্ব মনে হয়েছে। আর তাই বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস হিসেবে এই বইকে আমি নির্ভরযোগ্য মনে করি না। তবে এখানে উল্লিখিত তথ্যসূত্রগুলো বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস জানার পথে খুব গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় হবে নিঃসন্দেহে।
রিভিউটির জন্য সাধুবাদ। মূল বই, আলোচ্য প্রসংগ এবং তাকে ঘিরে ব্যবচ্ছেদমূলক আলোচনা এ ব্লগে পোস্ট করে আমাদের জানা ও মতবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ধন্যবাদ।
তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত করবার পর্যবেক্ষণটি যথার্থ। সেই সাথে তত্ত্ব ও প্রপঞ্চ প্রসঙ্গটি। তবে দুটো ক্ষেত্রে আমার দুটি সুক্ষ্ম প্রতিপর্যবেক্ষণ আছে। নীচে একে একে উল্লেখ করছি তা।
তুমি লিখেছো -
দ্বিতীয় অধ্যায়ে মুরশিদ দেখিয়েছেন যে, মুসলিম সুলতানরা রাজ্যে ক্ষমতার শীর্ষে থাকলেও “সতিক্যার অর্থে দেশ চলতে থাকে পুরনো হিন্দু রাজাদের প্রত্যক্ষ শাসনে” (পৃ-২৭)। আরও উল্লেখ করেছেন যে, সেসব মুসলিমরা “নিজেদের অবস্থা ফেরানোর জন্যই সুদূর বংগদেশ পর্যন্ত এসেছিলেন। ধর্মপ্রচার করে পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য তারা কেউ এদেশে আসেননি” (পৃ-২৯)। কিন্তু দুই পৃষ্ঠা পরেই তিনি আবার উল্লেখ করেছেন যে বাংলায় “মুসলিম শাসনের প্রথম শতাব্দীর ইতিহাস তরবারি দিয়ে দেশ শাসনের ইতিহাস” এবং এরপর জাফর খান কর্তৃক ত্রিবেণীতে মন্দিরের পাথর দিয়ে মসজিদ ও মাজার তৈরিকে উল্লেখ করেছেন “তরবারী দিয়ে ধর্ম প্রচারের একটা উল্লেখযোগ্য নজির” হিসেবে (পৃ-২৯)। দুটো অনুমান পারস্পরিক সাংঘর্ষিক- হয় বাংলা হিন্দু রাজাদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল, নতুবা তরবারি হাতে উদ্যত মুসলমান বিজেতাদের পদতলে ছিল যারা শাসনকার্যের পাশাপাশি ইসলামও প্রচার করতো। যেসব তথ্য তিনি উল্লেখ করেছেন, উপরে উল্লিখিতটি বাদে আর সবগুলোই আবার প্রথমটি, তথা দেশ হিন্দু রাজাদের অধীনে ছিল এই অনুমানকে সমর্থন করে। যেমন, পরের প্যারাতেই তিনি আবার উল্লেখ করেছেন যে, তাদের নামে এই স্থানীয় (হিন্দু) রাজা ও জমিদারেরাই দেশ শাসন করতেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলে এই স্থানীয় হিন্দু রাজাদের ভূমিকা আগের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে (পৃ-৩৭)। এমনকি তরবারি দিয়ে ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত করার অনুমানে তিনি নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছেন (পৃ-৬৪)।
- এখানে সম্ভবত বইটির বক্তব্য সারমর্ম হচ্ছে যে, মুসলমানরা তরবারী দিয়ে মসনদ দখল করে সুলতান হয়েছে। কিন্তু হিন্দু রাজা ও জমিদারদের বশ্যতা আর উপঢৌকন গ্রহন করে তাদের উপরই বিভিন্ন রাজ্যের শাসনভার ন্যাস্ত রেখে নির্ভার ও আমোদমত্ত থেকেছে।
- আবার প্রয়োজন যখন দাঁড়িয়েছে তরবারীর হুমকীতে রাজা ও জমিদারদের বশ্যতা বজায় থাকাকে নিশ্চিত করেছে।
এমনটাই বোঝাতে চেয়েছেন।
তবে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে আমি বলবো যে, মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন বংশের সময়ে যতোটা পূর্ববর্তীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা নিশ্চিহ্ন করবার প্রয়াস ছিলো। মুসলিম সুলতানী আমলে তার চেয়ে কম ছিলো। সেই সুবাদে এবং হিন্দু রাজা ও জমিদারদের অবস্থান অটুট থাকায় সুবিধাভোগী শাসকশ্রেণীর ভাগ্যের বিশেষ কোনো পরিবর্তন না ঘটায় ধর্ম ভিত্তিক শ্রেণীবৈষম্যের ক্ষেত্রটি সমাজে সেই ভাবে ক্রিয়াশীল ছিল না।
কিন্তু ধীরে ধীরে বৈষম্য তৈরী হতে থাকে যতোটা না শাসনতান্ত্রিক কারিণে তার চেয়ে বেশী সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ও ধর্মভিত্তিক সংস্কার-কুসংস্কারের আবর্তকে ঘিরে। সেই অর্থে তার ব্যাখ্যাটি সর্বত সঠিক না হলেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং যুগলভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি একটা বিভেদের দেয়ালও ঠিক ঠিক গড়ে উঠতে থাকে। যা অধিকাংশ সময়ই আপাত দৃশ্যমান ছিল না।
পরের আর একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। তুমি লিখেছো -
“মুসলমান রাজত্ব স্থাপনের বাইপ্রোডাক্ট হিশেবে বাংলার ধর্মবিশ্বাসের উপর এমন প্রচণ্ড একটা ঢেউ এসে আঘাত করেছিলো, তার আগেকার হাজার বছরের মধ্যে যার কোন তুলনা ছিল না” (পৃ-৬২)। আবার বলেছেন, মুসলমানদের আগমন আর্য বা সেনদের মতো নিঃশব্দে বা ধীরে হয়নি। কিন্তু পরের প্যারাতেই ইসলামের আগমন উপ-অধ্যায় শেষ করেছেন এই সিদ্ধান্ত টেনে যে, “ইসলাম ধর্ম তড়িৎ গতিতে নয়, পূর্ববঙ্গ-সহ বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে (পৃ-৬৩)।
- এ প্রসঙ্গ আবার সেই একই ব্যাখ্যার দৈন্যতায় পড়েছে। ইসলামের পূর্ববর্তী ধর্ম, বিশ্বাস, রীতি, উপাসনালয়, প্রার্থনার ঢঙ - সব বিচারে যতোটা না ভিন্নতর ছিলো এক একটি ধর্ম অন্য আর একটি ধর্মের চাইতে। ইসলাম ধর্ম তেমনটা নয় বরঞ্চ অধিকতর ভিন্ন ধঁাচের ছিল।
আর ইসলাম এসেছিলো তরবারির ঝনঝনানির সরব উপস্থিতির জানান দিয়ে। আর পূর্ববর্তী সকল ধর্ম বিশ্বাসের চেয়ে ভিন্নতর হওয়ায় ধর্ম বিশ্বাসের ভিত ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
আবার মুসলিম সুলতানেরা যেহেতু হিন্দু রাজা ও জমিদারদের কর্তিত্ব বজায় রেখেছিলো বশ্যতা স্বীকার ও কর প্রদানের শর্তে। তাই শাসকের দাপটে সরাসরি ধর্মান্তরিত হবার বিষয়টি সেভাবে ক্রিয়াশীল ছিল না যা অন্য সময় ছিল। সেহেতু ধর্ম বিস্তার ঘটেছে ইসলামের ধীর গতিতে।
ঈটন যথাযথ ভাবেই মুসলিম শাসক হটিয়ে দেশ দখল করা ইংরেজদের মুসলিম বিদ্বেশী মনোভাবটিই ভেতরে ভেতরে ধারণ করেছেন বলে আমার মনে হয়।
সেই সাথে কলকাতা ও তৎকালীন হিন্দুরাই শাসক ও প্রশাসনের নিকটবর্তী জনগোষ্ঠী হিসেবে বিদ্যমান ছিল, যারা ইতিহাস ও সাহিত্য রচনায় সংখ্যায় ভারী ছিল। সংগত কারণেই তাদের কথা ও তাদের প্রাধান্য বিদ্যমান ছিল তাদের সব লেখায়।
আমি তোমার সাথে এ বইয়ের সার্বিক মূল্যায়নে একমত যে, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ও সঠিক ইতিহাস নির্মানের সহযোগী হয়ে উঠতে পারেনি বইটি সেভাবে। তত্ব ও প্রপঞ্চ সময়ে সময়ে স্ববিরোধী বা ভুল ব্যাখ্যায় দৃশ্যমান হয়েছে।
ভাইয়া, এটা আপনার আনুমিত ব্যাখ্যা, মুরশিদেরটা কই? তারটা ত' থাকার দরকার তার বইয়ে।
এটাও আপনার, তথা পাঠকের, বইয়ের লেখক মুরশিদের নয়।
আপনিও ঠিকই ধরেছেন যে, 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' বইটাতে তথ্য প্রচুর থাকলেও তার বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা নাই। এজন্য মুরশিদ কি বলতে চেয়েছেন, তা'ও বোঝার এবং তার বক্তব্যকে পর্যালোচনা করার উপায় নাই।
এই বইয়ে অন্যান্য আরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে যেগুলো উল্লেখ না-করলেও চলে, এবং উল্লেখ না-করাই সমীচীন 😉
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আমার তো মনেহয়, "বাঙ্গালী সংস্কৃতি" নামক বিষয়টার অনেক কিছুই এখনো বেশ ভেইগ।
আমরা যা যা বাঙ্গালি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসাবে ভাবি, তার বেশির ভাগেরই উতপত্তি আসলে অন্যত্র, অন্য সংস্কৃতিতে।
তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলাইয় সাহিত্য চর্চা ও লিখালিখিও তেমন একটা ব্যাপকতা পায় নাই।
তাই তথ্য দিয়ে "হাজার বছর"-এর বাঙ্গালী সংস্কৃতি খোজাটা পন্ডশ্রম না হয়ে যায়ই না।
আর হয়েছেও তাই।
এই ধরনের তথ্যহীনতায় উপায় একটাই আর তা হলো অপিনিয়ন এর উপর নির্ভর করা ও তা দিয়ে হাইপোথিসিস তৈরী করা।
এন্ড রেজাল্ট যেহেতু একটা আছে, কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায়ই তা অর্জিত হয়েছে।
তথ্যের অপ্রতুলতায় অনুমান করে এগুনো ছাড়া উপায় কি।
তবে অনুমানের রিস্ক হলো, অন্যে এসে কোনো না কোনো অজুহাতে সেগুলা বাতিল করে দিতে পারে।
এই বাতিল করনে আমার আপত্তি ততক্ষন নাই, যতক্ষন তিনি নতুন কোনো প্রপঞ্চ প্রস্তাব করছেন।
গোল বাধে তখনই যখন দেখি বাতিলকারি সব বাদ দিয়ে দিচ্ছে নতুন কিছু প্রস্তাব করা ছাড়াই। তখন প্রশ্ন তো উঠবেই, "কিছু যখন কারন না, তখন এন্ড রেজাল্টটা এলো কোত্থেকে? নাকি ওটা হয় নাই।" অনেকটা "নো ওয়ান কিলড জেসিকা" টাইপের সিচুয়েশন আর কি।
বেশ অল্প সময়ে এই ভুখন্ডে মুসলমানদের ব্যাপক সংখ্যা বৃদ্ধির চারটি সম্ভাব্য মতবাদই যখন বাদ দেয়া হলো, কলমের এক খোচায়, আমরা কি তাহলে বলবো যে মুসলমানদের দ্রুত বৃদ্ধি একটা গুজব?
সেটা আসলে ঘটেই নাই?
😀 😀 😀
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
পারভেজ ভাই,
তথ্য আছে, কিন্তু দেখার সামর্থ অথবা ইচ্ছে নাই, অথবা দুটোই নেই যারা শুধুমাত্র অনুমান নির্ভর কথাবার্তা বলে।
ভাইয়া,
আপাততঃ চলতি অনুমানগুলো বাতিলের আলোচনায় সাথে থাকেন।
এই বাতিল পর্বে শেষে তথ্যের ভিত্তিতে নতুন প্রপঞ্চ+তত্ত্বও এসে যাবে 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
১) "তথ্য আছে, কিন্তু দেখার সামর্থ অথবা ইচ্ছে নাই, অথবা দুটোই নেই যারা শুধুমাত্র অনুমান নির্ভর কথাবার্তা বলে।"
তথ্য থাকলে, সেটা দেখার সামর্থ বা ইচ্ছা কারোরই থাকবে না - বিশ্বাস করা কঠিন।
আবার "অনুমান নির্ভর কথাবার্তা" - কথাটা এমনভাবে বললা, যা শুনে মনে হলো, অনুমান করা খুবই গর্হিত একটা কাজ।
একটু খোজ নিলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ বড় বড় আবিষ্কার এমনকি পিওর সায়েন্সের তত্বও কিন্তু শুরু হয়েছে একটা অনুমানে ভর করেই।
আইনেস্টাইনের জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি, ডারউইনের থিওরি অব ইভলুশনের মত যুগান্তর ঘটানো তত্ত্বগুলোর সুচনাও কিন্তু ঘটেছিল অনুমান থেকেই। তাই অনুমাঙ্কে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।
এটা বললাম কারণ আমার সহকর্মিদের অনেককেও দেখি, কোয়ালিটেটিভ রিসার্চের কথা শুনলে নাক শিটকায়।
অথচ আইডিয়া ও প্রবাবল অপশন জেনারেশনের জন্য, কোয়ালিটেটিভ রিসার্চের আর কি কোনো বিকল্প আছে?
মনেহয় না।
তথ্যই শেষ কথা না।
তথ্যের অনুপস্থিতিতে তো বটেই, অনেক সময় তথ্যের উপস্থিতি তে তা বিশ্লেষনেও এক্সপার্ট অপিনিয়ন তথ্যের চেয়ে যে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠতে পারে, সেটাও মাথায় রাখার দরকার আছে বলেই আমার মনেহয়।
২) "এই বাতিল পর্বে শেষে তথ্যের ভিত্তিতে নতুন প্রপঞ্চ+তত্ত্বও এসে যাবে" - অপেক্ষায় থাকলাম।। তবে সেগুলা আবার না একই যুক্তিতে, কলমের এক খোচায় অন্য কেউ বাতিলযোগ্য বলে ঘোষনা করে বসে, সেই অপেক্ষাও না আবার করতে হয় - ভাবছি.........
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
পারভেজ ভাই,
কথাটা আপনাকে উদেশ্য করে বলিনি, বলেছিলাম যারা সেসব অনুমান নির্ভর ব্যাখ্যাকে নিজেদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান বলে চালায়ে দেয় তাদেরকে (যেমন, গোলাম মুরশিদ)। আপনি যেমন তাদের ব্যাখ্যাগুলো মেনে নিতেন, আমিও, অন্যরাও। যদি আমার আগের মন্তব্যে আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে জানবেন ওটা বোঝার ভুল, অথবা আমারই বোঝানোর ব্যর্থতা।
তথ্য শেষ কথা নয়, এবিষয়ে আপনার সাথে পূর্ণ সহমত। তথ্যের বিশ্লেষণে এক্সপার্ট ওপিনিয়ন বিষয়েও একমত। কিন্তু বটম লাইন হলো তথ্যের উপস্থিতি। তথ্য না-থাকলে এক্সপার্টও অপারগ।
আমার অভিজ্ঞতা আপনার থেকে আলাদা। সামর্থের কথা বলেছি এজন্য যে, সকলের সব বিষয়ে সামর্থ থাকেনা। যেমন, আমি ইকোনোমেট্রিক্স বিশ্লেষণে বকলম। আবার কেউ হয়তো আর্কাইভ গবেষণায় অসমর্থ । আর ইচ্ছের কথা বলেছি এজন্য যে, অনেকেই আলোচ্য বিষয়ে আগ্রহী নাও হতে পারে, নানান কারণে।
আশা করি, আমার অবস্থান পরিষ্কার করতে পেরেছি। 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
১) "যারা সেসব অনুমান নির্ভর ব্যাখ্যাকে নিজেদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান বলে চালায়ে দেয় তাদেরকে..."
এই প্রেক্ষাপটেই বলেছিলাম যে, একটি স্টাডির শুরুতে অনুমান নির্ভর অপিনিয়নকে অবজ্ঞা করাটা ঠিক না।
কারন অনুমান নির্ভর অপিনিয়ন সামারাইজ করে যেটা দাঁড়ায়, সেটা হতে পারে একখানা "কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ ফাইন্ডিং"। আর তা যখন হয়, সেটাকেও তখন "গবেষণালব্ধ জ্ঞান" বলা যেতেই পারে।
২) "তথ্য না-থাকলে এক্সপার্টও অপারগ।" এইটাও পুরাপুরি ঠিক না।
ওয়েভ কি ভাবে যায়, সেটা ব্যাখ্যা করতে কোনো তথ্য ছাড়াই মার্কোনি ধরে নিলেন "ইথার নামের একটা মিডিয়ার অস্তিত্ব"। কেউ কেউ সেটা প্রমানও করলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর টিকলো না।
একইভাবে সব গ্রহ নিউটনের ল মেনে চললেও বুধ কেন তা মানে না, এটা ব্যাখ্যা করতে কোন তথ্য ছাড়াই আইনেস্টাইন ধরে নিলেন, ভরের কারনে তলের বক্রতা ঘটার কথা। অনেকে ভিন্ন প্রমানাদি নিয়ে এলো। শুনে উনিও এক পর্যায়ে একটা কনস্ট্যাট ইউজ করতে চাইলেন। পরে দেখা গেল তার কোনো দরকার নাই। শুরুতে উনি যে অনুমানটা করেছিলেন, সেটাই আসলে ঠিক।
তথ্যের উপর ভিত্তি করে অপিনিয়ন তো দেয়াই যায়। কিন্তু তথ্যের অনুপস্থিতিতে অনুমানের উপরে ভর করেও এগুনোর সুযোগ আছে। প্র্যাকটিসও আছে।
এগুতে গিয়ে তথ্য জেনারেট করে কোনো কোনো অনুমান বাদ দেয়ার আবার কোনো কোনো অনুমান থেকে তত্বে উত্তরোনেরও প্রচুর উদাহরন আছে।
৩) "সকলের সব বিষয়ে সামর্থ থাকেনা। যেমন, আমি ইকোনোমেট্রিক্স বিশ্লেষণে বকলম। আবার কেউ হয়তো আর্কাইভ গবেষণায় অসমর্থ..." - আজকাল এগুলো খুব বড় সমস্যা কি? আমার মনেহয় না।
আজকাল কাজটাজ যা হয়, তার বেশির ভাগই তো দেখি কোলাবোরেটিভ ওয়ার্ক। সেখানে, মেইন রিচার্চারের এটুকু জানাই যথেষ্ট যে তার কাজে কোনো ইকনোমেট্রিক মডেল লাগবে নাকি লাগবে না। যদি লাগে, বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তে কাউকে না কাউকে পাওয়া যায়ই যিনি স্ট্যাডির ঐ অংশটা করে দিতে প্রস্তুত।
আমি আসলে সেই প্রেক্ষাপটেই বলেছিলাম যে - সামর্থ না থাকাটা বিশ্বাস করা কঠিন। অন্য কিছু না।
৪) "যদি আমার আগের মন্তব্যে আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে জানবেন ওটা বোঝার ভুল, অথবা আমারই বোঝানোর ব্যর্থতা।" - করছি তো কলমবাজী, এখানে নাথিং পারসোনাল।
তাই আঘাত পাবার কিছু আছে বলে মনে হয় না।
তুমি, আমি, দুজনেই কিছু একটা বের করতে চাচ্ছি। আর তা করতে গিয়ে বাক্য বিনিময় হচ্ছে। এতে লাভটা কোনো অংশেই কম হচ্ছে বলে আমার তো মনে হচ্ছে না।
তাই না???
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
ভাইয়া,
জেনে আনন্দিত হলাম।
এইখানে দ্বিমত। আমি নিজে কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ করি এবং সেগুলোতে অনুমানের ভিত্তিক জ্ঞানের কোন স্থান নেই। কোয়ালিটেটিভ রিসার্চে, বিশেষ কয়রে এথনোগ্রাফির, একটা প্রাথমিক পাঠ হচ্ছে গবেষণার ফোকাস হতে হবে "ব্যক্তি কি করে (practice), কি অনুমান করে (opinion) নয়"। এজন্য ওপিনিইন স্টাডিকে প্রায়শঃই সামাজিক বিজ্ঞানে জ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে অনির্ভরযোগ্য মনে করা হয়। তবে ব্যতিক্রমও আছে কিছু কিছু।
এবিষয়ে দ্বিমত। তবে আপাততঃ এ' নিয়ে আর এগুতে চাইনা। অন্য কোন সময় গবেষণা বিষয়ে আপনার সাথে আরও আলাপের ইচ্ছা রইল। বাঙালি মুসলমানের জন্ম ইতিহাস বেশ সময় এবং মনোযোগ নিয়ে নিচ্ছে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
সুন্দর আলোচনা ।
ফেসবুকের মেসেজ বক্স প্রায় উপচে পড়ছে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছায়! বেশ ক'টি শুভেচ্ছা বার্তা থেকে 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি'র কথাটা মনে পড়ে গেল। সেই সূত্রে আরও মনে পড়ল গোলাম মুরশিদের রচিত 'হাজার বছরেরে বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস' নামক বই এবং এই অধমের পর্যালোচনা 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
খুব সুন্দর বিশ্লেষণ, পড়ে উপকৃত হলাম। মূল বইটা কিনে রেখেছি প্রায় বারো বছর আগে, এখনও পড়া হয়ে উঠেনি, তারপরও বিশেষ আগ্রহ নিয়ে এই পাঠ প্রতিক্রিয়াটা পড়লাম। অশেষ ধন্যবাদ মাহমুদকে।