১
সম্প্রতি সিসিবিতে বেশ কিছু ব্লগ এসেছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বিষয়ক, অন্যান্য কিছু ব্লগে আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় মন্তব্যেও এসেছে এ’ বিষয়টি। ক্যাডেটরা এতে ক্রমশঃ আগ্রহী হয়ে উঠছে, এটা আমার কাছে খুব উৎসাহ-জাগানীয়া। কারণ, দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানের সেরা ছাত্রছাত্রীদের একটা দল আমাদের চারপাশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় উদাসীন থাকবে- এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। আফটারঅল, আমাদের সকলের প্রতি বাংলাদেশ নামের দেশটি অনেক অর্থ, সম্পদ, লোকবল, ইত্যাদি ব্যয় করেছে ক্যাডেট কলেজে পড়াতে গিয়ে। ক্যাডেট হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আমাদের এই ঋণ আমরা সকলেই স্বীকারও করি। এই কারণে আমার মনে হয় জাতীয়তাবাদ, জাতীয় স্বার্থ, স্বদেশপ্রেম, ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের আগ্রহ এবং আলোচনায় অংশগ্রহন স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু ব্লগ এবং মন্তব্যের মূল বক্তব্য থেকে আমার মনে হচ্ছে আমরা অধিকাংশই জাতীয়তাবাদ নিয়ে খুব একটা সিরিয়াসলি চিন্তাভাবনা করি না। বিশেষ করে, আমাদের জাতীয়তাবাদের চেতনায় ধর্মের- নির্দিষ্ট করে বললে, ইসলামের- ভূমিকা নিয়ে আমাদের ধারণা অস্পষ্ট। নানাজনের কাছে আমাদের জাতীয় পরিচয় নানান অর্থবোধক হওয়ায় সিসিবিতে অনাকাংখিত পরিস্থিতির জন্ম হচ্ছে। আমার ক্ষীণ আশা এই যে, জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম বিষয়ে আমার ভাবনা হয়তো এই জাতীয় মতবিরোধগুলোকে সামান্য মাত্রায় হলেও কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে। তাহলে চলুন আলাপ শুরু করি।-
সিসিবিতে (এবং সেইসাথে অন্যান্য বাংলা ব্লগেও) জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্কের মাঝে মোটাদাগে দুটো ধারা লক্ষ্যনীয় (আমার মতে, বেশিরভাগ সিসিবি সদস্যের অবস্থান এই দুইয়ের কোনটাতে নয়, বরং মাঝামাঝি কোথাও): একটা ধারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠির ধর্ম ইসলামকে আশ্রয় করে নিজেদের আলাদা পরিচয় নির্মাণে ব্রত, যে পরিচয় তাদেরকে আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী ভারত থেকে পৃথক করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে সহায়তা করা সত্বেও অসংখ্য বাস্তব এবং যৌক্তিক কারণ রয়েছে ভারতের প্রতি বাংলাদেশীদের বিদ্বেষ পোষণ করার। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মকে দলগত পরিচয়ের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে নেওয়ায় এই ধারাটি কমপক্ষে দুটো সমস্যার মুখে পড়েঃ এক, একই ধর্মাবলম্বী হিসেবে পাকিস্তান এবং এর প্রতি সহানুভূতিশীলরাও একই দলের ঢুকে পড়ে, যারা ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশীদের শত্রুদলে থাকার কথা। দুই, ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য সকল ধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশে একই সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের অংশ হওয়া সত্বেও দলের বাইরে পড়ে যায়, যারা কয়েক শতবছর (হাজার না হলেও) ধরে বড় ধরণের কোনরকম সংঘাত ছাড়াই পাশাপাশি সহাবস্থান করে আসছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলাদেশী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের কথা, যাদেরকে এই ধারার জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের মধ্যে গ্রহন করেনা এবং সর্বদা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। এরা স্বদেশী এসব ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর থেকে বরং ভিন্ন দেশের, ভিন্ন জাতির মুসলমানদেরকে বেশি আপন মনে করে। যেমন, বাংলাদেশের অধিবাসী ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দুঃখ-দুর্দশা তেমন একটা না কাঁদলেও রোহিঙ্গা, কি প্যালেষ্টাইনী, কি বসনিয়ার মুসলমানদের জন্য সহানুভূতির ঘাটতি থাকে না। শুধুমাত্র ধর্মের পার্থক্যের কারণে একই এথনিক দলের হয়েও অমুসলিম বাংলাদেশীদের এরা নিজ দলের বাইরে রাখে। ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছেয় হোক, সচেতনে হোক আর অবচেতনে হোক, এদের কাছে অমুসলিমরা ঊনমানুষই রয়ে যায়। আর দেশের মধ্যে যেসব ক্ষুদ্র জাতিসত্বার লোকজন আছে যারা না-বাঙ্গালি না মুসলিম, তারা ত’ গোনারই বাইরে। সার্বজনীন মানবতার বদলে সার্বজনীন মুসলিম ভ্রাতৃত্ব এদের কাছে বড়। এ কারণে, এই মতাদর্শিক অবস্থানকে আমি মনে করি অমানবিক, এবং কাজে কাজেই, অগ্রহনযোগ্য।
দ্বিতীয় আরেকটা ধারা লক্ষ্যণীয় যা’ ধর্মকে বাদ দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ‘বাঙালিত্বের’ ভিত্তিতে নিজেদের আলাদা পরিচয় নির্মাণে সচেষ্ট। এই ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে যেখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান মর্যাদা পাবে। এই ধারা সচেতন ভাবে ইসলামকে আত্মপরিচয়ের বিচার থেকে সড়িয়ে রাখার প্রয়াস পায়। এই চেষ্টা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তবসঙ্গত এই কারণে যে, পাকিস্থান রাষ্ট্র আমাদেরকে ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে সর্বপ্রকার নির্যাতন এবং নিপীড়ণ করেছে। কাজেই, পাকিস্তানের সাথে সাথে ইসলামও আমাদের জাতীয় শত্রু। পাশাপাশি ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে বলে এরা ভারতের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন। এদের কাছে বাংলায় কথা বলা আর বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করাই জাতীয় পরিচয়ের একমাত্র মাপকাঠি। অন্যদিকে, কেউ বাঙালি হয়েও যদি পাঞ্জাবী+টুপি পড়ে, দাড়ি রাখে, নিয়মিত মসজিদে যায়, সে অবশ্যম্ভাবীরূপেই মুসলিম মৌলবাদী এবং পাকিস্থানের দোসর+জাতীয় শত্রু। অতএব, মাদ্রাসায় পড়া অভাবী+অনন্যোপায় বাংলাদেশী মুসলিমদেরকে স্বজাতির জন্য স্বভাবসূলভ সহানুভূতি দিয়ে মূলস্রোতে নিয়ে আসার বদলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়াই এদের কাছে শ্রেয়। একইভাবে, মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে আক্রান্ত অসহায় মানুষগুলো শেষ আশ্রয় হিসেবে প্রতিবেশী বাংলাদেশের দিকে আসতে চাইলে এদের কারো কারো শুধুমাত্র মধ্যে মুসলমান বলেই তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে চরম অনীহা। ইসলামের সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে এই ধারাও কমপক্ষে দুইটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েঃ এক, দেশের বেশিরভাগ মানুষই ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং তারা নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দেখে না। তাদের প্রাত্যহিক ও সামাজিক জীবনযাত্রায় ধর্ম ওতোপ্রতোভাবে মিশে আছে- ব্যক্তির নামকরণ থেকে শুরু করে বিয়ে, পরিবার, ব্যবসা-বানিজ্য, আচার-অনুষ্ঠান, বিচার-সালিশ, সর্বত্র; এবং এটা বাংলাদেশে সকল ধর্মেই প্রায় সমানভাবে দৃশ্যমান। এই ধারার জন্য চ্যালেঞ্জটা আরো কঠিন হয়ে ওঠে এইজন্য যে, যে ইসলাম ধর্মের (তথা উগ্র ইসলামী মৌলবাদ) বিরুদ্ধে এরা নিজেদের স্থাপন করে, তা’ বাঙালি মুসলমানের ধর্ম নয়। তাদের ইসলাম ধর্ম অন্য ধর্মের সাথে আপোষ করে একত্রে সহাবস্থান করে, একে অপরের আচার-অনুষ্ঠান গ্রহন করে, সহ্যও করে, কিন্তু নিগৃহ করে না। একারণেই আমরা পীরপূজা, কি পৌষপার্বণ, কি নববর্ষ বরণ, সর্বত্র সকলের সাগ্রহ অংশগ্রহন দেখতে পাই। ইসলামকে সড়াতে গিয়ে এই অবস্থান বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির আত্মিক সমর্থন হারিয়ে ফেলে। দুই, শুধুমাত্র বাঙ্গালিত্বকে জাতীয় পরিচয়ের মাপকাঠি হিসেবে নিলে বাংলাদেশের বাইরে (প্রধানতঃ ভারতে) বসবাসকারী আরো কয়েক কোটি বাঙ্গালিও একই দলের মধ্যে চলে আসে, যারা নিজেদেরকে জাতীয়তায় বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেয় না, দেওয়ার সঙ্গত কোন কারণও নেই (যথা, ভারতীয় বাঙ্গালিরা)। তাহলে এই ধারার সংকটটি হচ্ছে এই যে, এটি নিজ দেশের একটা বড় অংশকে শুধুমাত্র ইসলামের কারণে পর করে দেয়, আবার অন্যদেশের কিছু মানুষকে শুধুমাত্র এথনিক মিলের কারণে আপন করতে চায়। এই মতাদর্শের কাছে সার্বজনীন মানবতার চেয়ে সার্বজনীন বাঙ্গালিত্ব বেশি বড়। একারণে, এই অবস্থানকেও আমি আগেরটার মত একই ভাবে অমানবিক এবং অগ্রহনযোগ্য মনে করি।
আমার মতে জাতীয়তাবাদ বা আমাদের জাতীয় পরিচয় নিয়ে এই যে মোটাদাগে একটা বিভাজন দেখা যায়, এর প্রধান কারণ এতে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে আমাদের মতানৈক্য। জনগোষ্ঠির পরিচয়ের মাপকাঠি হিসেবে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব এবং বিকাশের প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করলে আশা করি বিষয়টা খানিকটা খোলাসা হবে।-
২
ঢাবিতে পড়ার সময় পায়ে হেটে প্রচুর ঘোরাঘুরি করতাম ক্যাম্পাসের এদিক সেদিক। এক ছুটির দিন সকালে প্রেসক্লাবের সামনে দেখি বিশাল সাইজের সব ঘোড়ার পিঠে নবাবী যুগের বেশধারী কিছু লোকজনসহ একটা শোভাযাত্রা। একটা ঘোড়ার পিঠে নাট্যাভিনেতা আরিফুল ইসলামকে দেখে কৌতুহল বেড়ে গেলে আরো কাছে গিয়ে দেখলাম যে, তারা বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের n-তম বর্ষ উৎযাপন করছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, বখতিয়ারের বংগবিজয় উৎযাপনের মাজেজা কি?- বলল, বখতিয়ার বঙ্গের তৎকালীন বঙ্গের হিন্দু রাজা লক্ষণসেনকে পরাজিত করে ইসলামী শাসন কায়েম করে এই দেশে ইসলামী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছেন (১২০০ বা ১২০৪ সালে)। বটে! এছাড়া বাংলায় মুসলিম জাতীয়তাবাদের আরেকটা শুরু হিসেবে অনেকে পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) কথা বলেন। এই দুয়ের যেটাকেই শুরু হিসেবে ধরি না কেন, হিসাবে গড়মিল থেকেই যায়। কারণ, যে সময়কালে এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে, তখন পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর আলোই দেখেনি! সেসময় ইউরোপে প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের রাজা/সম্রাটগণ, ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাটদের পড়তি অবস্থার সুযোগে স্থানীয় ভাবে উঠে আসছে স্থানীয় রাজা-নবাব-নিজাম প্রমুখ। এই প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদ ছিল অজানা, ফলে নাগরিকতাও অদেখা। মানুষ দেখতো অমুক রাজা/সম্রাট/নবাবের ছেলে (ক্ষেত্রবিশেষ অন্য বংশধর) পরবর্তী রাজা/সম্রাট/নবাব; আর জানতো যে সকল সাধারণ মানুষ তাদের প্রজা, হুকুমের দাস, ব্যক্তিগত সম্পত্তি-প্রায়।
জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ইউরোপেই; শুরু ১৭ শতকে হলেও পরিপূর্ণ বিকশিত হতে লেগেছে প্রায় ১৯ শতকের শেষ অব্দি। পার্লামেন্ট, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সংঘ, শ্রমিক সংঘ, পার্শ্ববর্তী রাজ্য, ইত্যাদি আভ্যন্তরীণ+বহিরাগত শক্তির সাথে ধারাবাহিক দ্বন্দ্বের ফলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের রাজার নিরংকুশ ক্ষমতা ক্রমাগত ক্ষয়ে যেতে যেতে এক পর্যায়ে সাম্রাজ্যের ভিত্তি ভেঙ্গে পড়ে। ১৭৮৯ এর ফরাসী বিপ্লব এই ধারারই চুড়ান্ত পরিণতি, যেখানে সাম্রাজ্যের প্রজা থেকে প্রথম বারের মত জনগণ জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, শাসক আর শাসিতের মধ্যে স্থাপিত হয় ‘সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ যেখানে ‘শাসকের প্রতি আনুগত্যের’ বিনিময়ে জনগন পায় ‘নাগরিক অধিকার’।
সাম্রাজ্যে শাসকের প্রতি প্রজার আনুগত্য শর্তহীন, প্রজা হিসেবে জন্ম হয়েছে বলেই তাকে রাজার আনুগত্য করতে হবে। আর এই দর্শনকে জাষ্টিফাই করতে ব্যবহার করা হতো ধর্ম বা ঐশী বাণী যা’ শাসককে প্রজাদের থেকে উন্নত বৈশিষ্ট্যের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতো। বৃহদাকার রাজনৈতিক সংগঠনের (রাজ্য, সাম্রাজ্য) শুরু থেকেই ধর্মের এইরূপ ব্যবহারের অজস্র দৃষ্টান্ত আছে। ফরাসী বিপ্লবের ফলস্বরূপ সাম্রাজ্যের স্থলে যে জাতিরাষ্ট্র দেখি, সেখানে প্রজার এই আনুগত্য শর্তাধীন। অর্থ্যাৎ, শাসক যতদিন নাগরিক অধিকার দিবে, ততদিন নাগরিকদের আনুগত্য পাবে, আর নাগরিকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে না পারলে তাদের আনুগত্য এবং শাসনক্ষমতা দুইই হারাবে। একারণে একে বলা হয় গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন। আর যেহেতু প্রজার আনুগত্য লাভের জন্য ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল, তাই জাতিরাষ্ট্রে ধর্মের ভূমিকাও খর্ব হলো। উপরন্ত, ধর্মকে রাজার প্রতি প্রজার নিঃশর্ত আনুগত্য আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো বলে একে সচেতনভাবে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করা হলো যেন শাসক আর কখনো ধর্মের আশ্রয় নিয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে নিঃশর্ত আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা করতে না পারে।
দক্ষিণ এশিয়ায় জাতীয়তাবাদের সূচনা হয় ইংরেজদের আমলে, সুনির্দিষ্ট করে আধূনিক (আদতে কলোনিয়াল) শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলনের পর। এই শিক্ষব্যবস্থা প্রচলনে যদিও ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল একটা ছাপোষা শ্রেণী তৈরী করা যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের কলোনিয়াল শাসন পরিচালনায় সহায়তা করবে, এদের মধ্যে কেউ কেউ সেসময় বিলেত/প্যারিস পড়তে গিয়ে জাতীয়তাবাদের ধারণার সাথে পরিচিত হয়ে ফিরে এসে ইংরেজ শাসনেরই বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল প্রধানতঃ কলকাতা, তথা বাংলা। কিন্তু ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র ধর্মের প্রসঙ্গে যে পথে হেটেছে, ভারতবর্ষে জাতিরাষ্ট্র একেবারে উলটো দিকে যাত্রা করে। অর্থ্যাৎ, ধর্মকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করার বদলে ধর্মকে আরো ভালোভাবে আঁকড়ে ধরে, ধর্মের ভিত্তিতে দুইটা আলাদা জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দেয়। আমার মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদের এই উলটো-যাত্রার সামাজিক পটভূমি আছে যা’ ইউরোপের থেকে আলাদা। সেটা কেমন?-
ইউরোপের ইতিহাসে খ্রীষ্ট ধর্মের একক আধিপত্য দেখা যায়। সুদীর্ঘকাল খ্রীষ্টধর্ম রাজা/সম্রাটদের দ্বারা রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে, সাম্রাজ্যের পতনের পর জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব হলে জনগণ খ্রীষ্টধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে সেক্যুলার হয়েছে। কিন্তু বাংলায় সাধারণ জনতা শাসকের (এবং সেই সাথে শাসকের ধর্মেরও) নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে। যেমন- সেনদের কুলীন-ব্রাম্মণ্যবাদ থেকে রেহাই পেতে তারা ইসলামে কনভার্ট করেছে। হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলামে এই যে কনভার্সন, এটা প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক। এটা বোঝা যায় বাংলার মুসলমানদের মন-মানসিকতা এবং আচার-আচরণে ইসলামের প্রভাব বিচার করলে। আহমদ ছফা এই বিষয়ে একটা দূর্দান্ত প্রবন্ধ লিখেছেন “বাঙ্গালী মুসলমানের মন” শিরোনামে (আমার পড়া অন্যতম সেরা বাংলা প্রবন্ধ)। সেখানে তিনি সাধারণ মুসলমানদের হাতে গড়া পুঁথি সাহিত্য থেকে উদাহরণ নিয়ে বিশদভাবে বর্ণনা দেখিয়েছেন কিভাবে বাংলার কনভার্টেড মুসলমানরা ব্রাহ্মণ্যবাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হযরত আলীর কল্পিত পুত্র আবু হানিফার চরিত্র এঁকেছে যে কিনা এমনকি আরবের মরুভূমিতেও হিন্দু ব্রাহ্মণদের খুঁজে হত্যা করে, তাদের অসংখ্য কুমারী কন্যার পাণিপীড়ণ করে, মৃত হোসেনের ছিন্নমস্তকের সামনে কালেমা পড়ে ধার্মিক ব্রাহ্মণও সপরিবারে মুসলমান হয়, ইত্যাদি। এখানে কোথাও ডকট্রিনাল বা খাঁটি ইসলাম যথা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, কি আল্লাহর শাসন কায়েম, কোনটাই প্রধান হয়ে আসেনি। তবে আচার-অনুষ্ঠানে ইসলাম এসেছে। কিন্তু সেটা আবার শক্তিমানের ইসলাম না, সেটা দীন-দুঃখীর ইসলাম, পীর-ফকিরের ইসলাম, যা’ ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভেদ করে না, যা’ মসজিদে যায়, আবার মাজারেও যায়, ঈদগাহে যায়, আবার পূজামন্ডপেও যায়। [সম্ভবতঃ এই কারণেই বাংলার মুসলমানরা অন্যান্য দেশের মুসলমানদের চোখে ‘খাঁটি মুসলিম’ নয়। ইনফ্যাক্ট, আমাদের নিজেদের চোখেও নয়। এজন্যই ত’ আমাদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে যে, কেউ ধন-সম্পদ, সম্মান, খ্যাতি,ইত্যাদি অর্জন করলে চেষ্টা করে নিজেকে বহিরাগত মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিতে (বিশেষ করে সৈয়দ বা শেখ বংশের একজন হিসেবে)]। একারণে, বাংলার আম জনতার মাঝে যে ইসলাম, তা’ মূলতঃ হিন্দু কৌলিণ্য প্রথার নিষ্পেষণ থেকে প্রধানতঃ নিম্নবর্ণের আত্মরক্ষার একটা কৌশলগত আশ্রয়মাত্র। আর তাই এরা ধর্ম পরিবর্তন করলেও বংশ পরম্পরায় চর্চা করে আসা সংস্কৃতির (তথা লোকসংস্কৃতি, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, ইত্যাদি) অধিকাংশকেই আঁকড়ে ধরে থাকে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা’ ইসলামের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হলেও, যেমন মাজার সংস্কৃতি, বিয়ের নানান আচার-পদ্ধতি, ইত্যাদি।
আহমদ ছফার দৃষ্টিতে বাংলায় সাধারণ জনগণের ইসলাম ধর্মে কনভার্সনের এই দিকটা ধরা না পড়লেও তৎকালীন বাংলা, এবং সেই সাথে ভারতবর্ষে বৃটিশবিরোধী রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা সহজেই বোঝা যায়। বংগভংগ থেকে শুরু করে পরবর্তীতে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বাংলার মুসলিমদের হিন্দু-বিরোধী (নির্দিষ্ট করে বললে, হিন্দু নের্তৃত্ব বিরোধী) মনোভাব ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইসলামের আশ্রয়ে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এই যে রাজনৈতিক ভাবে আলাদা পরিচয় দানা বাঁধতে থাকে, তা’ ইসলামী শাসন কায়েমের উদ্দেশ্যে নয়, বরং প্রধানতঃ উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদার+শাসকদের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে। অর্থ্যাৎ, বাংলার কনভার্টেড এইসব মুসলিমরা ইসলামকে নিজেদের জন্য একটা স্বতন্ত্র্য পরিচয় নির্মাণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। আল্লাহ ভীতি, বেহেস্তের আশ্বাস বা ইসলাম ধর্মের নীতিবাক্য নয়, বরং বাস্তব প্রয়োজনেই বাংলার মুসলিম জনতা ইসলাম গ্রহন করেছে। তবে ইসলামের যেটুকু গ্রহন করলে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে, শুধু সেইটুকুই। পাশাপাশি, আগের ধর্মের সেইটুকু ত্যাগ করেছে যেটুকু না করলেই নয়। এজন্য বাস্তব জীবনাচরণে বাংলায় আমজনতার মাঝে হিন্দু/মুসলিম/বৌদ্ধের পার্থক্য সামান্য।
অতএব, বাংলায় ইসলামকে আশ্রয় করে সে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ দেখি, তা’ আসলে ডক্ট্রিনাল ইসলামের পূণর্জাগরণ নয়, কোন ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যেও পরিচালিত নয়। এর উদ্ভবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলার প্রধানতঃ নিম্নবর্গের হিন্দু+বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শাসন থেকে মুক্তির আশায় প্রথমে ইসলামে কনভার্ট হয়েছে। পরবর্তীতে একই কারণে অর্থ্যাৎ, কংগ্রেসের নের্তৃত্বে গঠিত ভারতে গিয়ে আবার হিন্দু-নের্তৃত্বের অধীনে যাওয়ার বদলে মুসলিম লীগের অধীনতাকে শ্রেয় মনে করেছে। কিন্তু মুসলিম লীগের নের্তৃত্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রেও নির্যাতন অব্যাহত থাকলে সেই তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে বের হয়ে আসতেও দ্বিধ্বা করেনি। অর্থ্যাৎ, বাংলার মুসলমান যে ইসলামী চেতনার আশ্রয়ে নিজেদের জাতীয় পরিচয় নির্মাণ করে, সেটা আদতে ধর্মতাত্ত্বিক নয়, বরং রাজনৈতিক, এবং মূলতঃ সেক্যুলার, যে অর্থে ইউরোপীয় জাতীয়বাদ খ্রীষ্টধর্মকে রাজনীতি থেকে বাদ দিয়ে সেক্যুলার।
৩
এখন আশা যাক বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ এবং ইসলাম প্রসঙ্গে বিদ্যমান বিতর্কে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে সেক্যুলার আদর্শের ভিত্তিতে সংঘটিত হয়েছে, তা’ প্রকৃতপক্ষে ‘বাঙালি মুসলমানের ইসলাম’ বিরোধী নয়। আর ডক্ট্রিনাল ইসলাম ত’ বাংলার মুসলিম জনতার বিবেচ্যই নয়। তারা অতীতে ইসলামকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে নিজেদের জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তির জন্য। মুসলিম লীগের নের্তৃত্বে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলো, সেখানে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে তারা সেই রাষ্ট্রকেও ভেঙ্গে স্বাধীন হলো। বর্তমানে কোন কোন বুদ্ধিজীবি বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান থেকে এই স্বাধীনতাকে ‘ঘরে ফেরা’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তারা আবার ইসলাম থেকে কনভার্ট হয়ে গেল বা ইসলামপূর্ব যুগে ফিরে গেল। আওয়ামী লীগ এবং এই ঘরাণার চেতনাজীবিরা মনে করে যে, ১৯৭১ এ বাংলার মুসলমান ইসলামের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেছে, ইউরোপীয়দের মতো ধর্মকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠিয়ে সেক্যুলার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলিমরা ত’ শুরু থেকেই সেক্যুলার, মুসলিম নাম নিয়েই। কারণ, তারা শুধুমাত্র আলাদা পরিচয়ের জন্যই নামমাত্র মুসলমান হয়েছিল, ইসলামী শাসন, বা আল্লহভীতি, বা বেহেস্তের লোভে নয়। কাজেই, উল্লিখিত মতাদর্শে মৌলবাদী ইসলামের যে ভয়, তা’ বাংলার মুসলমানদের মধ্যে নেই, তা’ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চাপিয়ে দেওয়া। আমাদের রাজনীতিতে একটা ধারা অবশ্যই আছে যা’ মৌলবাদী ইসলামকে ধারণ করে। কিন্তু সেটা কখনোই মূলধারা নয়, একেবারে ক্ষীণ একটা ধারা।
যেহেতু বাংলার মুসলমান স্বাধীনতার পর তাদের মুসলিম পরিচয় ছুড়ে ফেলেনি, তাই ইসলামকে জাতীয় পরিচয় থেকে মুছে দিতে চাইলে তারা প্রতিবাদ করে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলো ক্ষুব্ধ জনতাকে নিজেদের দলে ভিড়াতে চেষ্টা করে এই বলে যে, আওয়ামী লীগের হাতে তাদের মুসলিম পরিচয় নিরাপর নয়। উপরন্তু, আওয়ামী-শিবিরে ইসলাম থেকে দূরত্ব তৈরী করার সচেতন প্রচেষ্টাগুলোকে তারা ব্যাখ্যা করে এই হিসেবে যে, এগুলো পুণরায় হিন্দুত্বে ফিরে যাওয়ায় লক্ষণ যেখান থেকে তারা একবার বের হয়ে এসেছে। অতএব, হিন্দুদের থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র্য পরিচয় রক্ষা করতে হলে ইসলামী-আশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলোই ভরসা। এতে জনগণ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে বিএনপির দিকে যায়, কিন্তু জামায়াতের দিকে নয়। আমাদের সৌভাগ্য যে, মুক্তিযুদ্ধে জামাত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিল। ফলে বাংলাদেশের মূলধারা তথা সেক্যুলার মুসলিমদের কাছে জামাত তথা মৌলবাদী ইসলাম সর্বদাই ত্যাজ্য। কিন্তু মূলতঃ সেক্যুলার এই জনতা বিএনপির সাথে গিয়ে মৌলবাদী ইসলামী দলগুলোর সাথে তাদের মাখামাখি, প্রতিবেশী অমুসলমানদের বদলে ভিনদেশী মুসলমানদের প্রতি এদের বেশি দরদ দেখে হতবাক হয়, ক্ষুব্ধ হয়। ফলে ইসলামভিত্তিক যে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটাতে চায় বিএনপি এবং এর সহযোগীরা, তা’ বাঙালি মুসলিম জনতার কাছে আবেদন হারায়। আবার আওয়ামী লীগের কাছে আসলে যখন দেখে তারা মুসলমান পরিচয়কে মুছে দিয়ে শুধুমাত্র বাঙালি পরিচয়ের ভিত্তিতে আরেক জাতীয়তাবাদের অনুসরণ করে, তখনও হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয়। ফলে এই ধারাও বাঙালি মুসলিম জনতার কাছে আবেদন হারায়।
এই দুইধারার বাইরে সবথেকে বেশি সম্ভাবনাময় হিসেবে স্বাধীনতার পর আমাদের মাঝে ছিল শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতাবাদ- এর ছিল বিশাল মেধাবী ছাত্র সংগঠন এবং তৃণমূল গণভিত্তি। কিন্তু ধর্মপ্রশ্নে এটিও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মনোভাবকে বুঝতে ব্যর্থ হয়- ইউরোপের অনুসরণ করে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠানোর জন্য এটিও বাংলাদেশে মুসলিম জনতার কাছে আবেদন হারায়। ফলে, অমিত সম্ভাবনাময় এই ধারা কখনোই বিকশিত হতে পারেনি।
দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশের মানুষ এদের প্রতি ক্রমশঃই আস্থাহীন হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় কেউ কেউ আশংকা করেন যে, বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলো আবার গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠবে এবং বাংলাদেশ ইসলামী মৌলবাদের ক্ষেত্রে পরিণত হবে [কেউ কেউ ত’ বাংলাদেশকে পরবর্তী আফগানিস্তানই বলে ফেলেছে]। কিন্তু আমার মতে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠির কাছে মৌলবাদী ইসলামের কোন আবেদন নেই। তারা মুসলমান শুধুমাত্র একটা স্বতন্ত্র্য পরিচয়ের জন্য, মুসলিম খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। ফলে কেউ যদি তাদেরকে দিয়ে সেটা করাতে চায়, তা’ হবে সীমা লংঘন এবং সেভাবেই বাঙালি মুসলমান তাদেরকে ত্যাগ করবে। আবার কেউ যদি তাদেরকে ইসলাম বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বাঙালি এথনিসিটির ভিত্তিতে তাদেরকে পরিচিত করতে চায়, তাদেরকেও তারা একইভাবে প্রত্যাখ্যান করবে।
কাজেই, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ থেকে এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় ৮০%) জনতার পরিচয় ইসলামকে বাদ দেওয়া অসম্ভব, একই ভাবে অসম্ভব তাদেরকে মৌলবাদী ইসলামে টেনে নেওয়া। তারা মুসলিম পরিচয় নিয়েই একটা স্বতন্ত্র্য+সেক্যুলার জাতীয় পরিচয়ের প্রত্যাশী, যা’র সাথে অন্যান্য ধর্মের প্রতিবেশীর সম্পর্ক সহমর্মীতার, সমব্যাথীর, সহযাত্রার, কিন্তু শত্রুতার নয়।
চিন্তাভাবনা স্বচ্ছ থাকলে যা হয় - ঝকঝকে একটা লেখা বের হয়ে আসে প্রয়োজনীয় তথ্যের সহায়তায়।
পড়েও শান্তি।তোমার মতো সহজ করে বুঝতে, বোঝাতে পারলে আমাদের সমস্যার বেশিরভাগই মিটে যেতো।
নূপুর ভাই,
আমার বক্তব্য বুঝতে পেরেছেন দেখে খুব ভালো লাগল।
আশা করি আরো কেউ কেউ বুঝতে পারবে। আর না পারলে, বা দ্বিমত থাকলে এখানে আলাপের সুযোগ ত আছেই 🙂
সহমত+দ্বিমত+ভিন্নমত সবগুলোকেই স্বাগতম... 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
:thumbup: :thumbup: সেইরাম ল্যাহা, একটানে পইড়া ফালাইলাম 😀 ।আমরা বাঙ্গালিরা পুরাপুরিই কনভার্টেড, জাতি ও শংকর, ধর্মও শংকর।
আমাদের দেশে আমরা ধর্মকে স্রেফ একটা পোষাকে পরিণত করেছি। পুরোপুরি এটাকে মানি ও না, আবার একে ফেলেও দিতে পারি না। কারণ যদি ভালভাবে মানি তাহলে আমাদের ফটকাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে, এক্সট্রিম পয়েন্টের ১ মিলিমিটার উপরে প্যান্ট পড়ে ঘুরতে পারবো না, তখন ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে, কত বাইন্ডিংস। আবার ফেলে দিতে পারি না তার মূল কারণ, আমাদের বাপ-দাদা ১৪ পুরুষের ধর্ম। কিন্তু ফেলে দিলে যে একদিন আমাদের জবাব্দিহি করতে হবে সেটার চিন্তা কিন্তু মাথায় নেই, ফেলে দেয়ার আগে চিন্তা করি পরিবারকে কি বলব।
MH
ধন্যবাদ মাজহার, চমৎকার একটা সারাংশ লেখার জন্য 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
চমৎকার লেখা!!!
আমার 'চেতনার সংকট' লেখাটিতে আমি এই বিষয়ে কিছু টাচ দিয়েছিলাম।
রমিত ভাই,
আমি সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। ইনফ্যাক্ট, আমি আরো কয়েকজনকে দেখেছি যারা মাঝেমধ্যে কথায় বার্তায় ইসলামী জাতীয়তাবাদের সমর্থন করলেও কিছুক্ষণ আলাপ চালিয়ে গেলে দেখা যায় যে, তাদের অবস্থানও আসলে আমার উল্লিখিত তথাকথিত 'মডারেট মুসলিম' দলে, যারা মূলতঃ আলাদা পরিচয়ের জন্য নামে মুসলমানে, কিন্তু আচারে বাঙালি। কিন্তু জাতীয়তা প্রশ্নে বিদ্যমান বাইনারী ডিসকোর্সে (হয় খাঁটি মুসলমান, নাহলে খাঁটি বাঙালি) নিজেদের সঠিক জায়গা খুঁজে পায় না।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
ধন্যবাদ মাহমুদ। তুমি মূল্যবান কথা বলেছ।
বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডটির জনগণ মূলত সুবিধাবাদী।
যখন মুসলমান হইলে সুবিধা, তখন তারা তাই।
যখন বাঙালি হইলে সুবিধা, তখন তারা তাই।
যখন বাংলাদেশি হইলে সুবিধা, তখন তারা তাই।
খুশবন্ত সিং এর একটা লেখা পড়েছিলাম এরশাদের সময় বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র করা হইলে তিনি এদেশে আসেন, ৩১ ডিসেম্বর রাত উদযাপনের কথা লেখেন ঢাকা ক্লাবের।
না পড়লে বলিস। শেয়ার করে দিবো তোর সাথে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
@রাজীব,
দোস্ত,
তোর সাথে অনেকাংশেই একমত। তবে বিষয়টা আমি উলটো করে দেখিঃ আমাদের সুবিধা হবে বলেই একবার নিম্নবর্ণের হিন্দু/বৌদ্ধ থেকে মুসলমান হয়েছি, তারপর বাঙালি হলে সুবিধা হবে বলে তা'ই হয়েছি, শেষে বাংলাদেশও তৈরী করেছি সুবিধা হবে বলেই। কেউ দয়া করে এইসব দিয়ে যায়নি, অথবা পেছন-দরজা দিয়ে এইসব পাইনি, আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে রীতিমত সংগ্রাম করে এইসব অর্জন করতে হয়েছে। কাজেই, এর মধ্যে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, বরং গর্বিত হওয়ার আছে অনেক কিছু...
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আমার একটা ব্যক্তিগত মতামত আছে, সেটা হল আমরা খুবই অলস এবং পরশ্রীকাতর। কারণটা ভৌগলিক। এজন্য ধর্মকে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করতে চাই। ফেসবুকের বিভিন্ন লাইক ভিক্ষা করে বেড়ানো পেজের কর্মকান্ড একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে ধর্মের কলের অবস্থা।
ধন্যবাদ মাহমুদ ভাইয়া। অনেক কিছু জানার আর ভাবার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
ভিন্নমত 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
অনেক পরিশ্রমী লেখা, মাহমুদ, যেমনটা আশা করেছিলাম। জাতীয়তাবাদের ক্লাসিক্যাল ঐতিহাসিক রুট ধরে লেখাটা দাঁড় করিয়েছো লক্ষ্য করেছি। পরবর্তী কোনো পর্বে আরও কয়েকটি বিষয়ে তোমার লেখার মাধ্যমে আরও কিছু বিষয় পড়বার আগ্রহ অনুভব করছি:
(১) 'জাতি' কথাটার মানে আসলে কি। ঔপনিবেশোত্তর পৃথিবীতে কিভাবে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি মোকাবিলা করা হয়েছে;
(২) কিংবা বহুজাতিক (মোটা দাগে বলছি) সমাজে জাতীয়তাবাদের ধারণাটি কিভাবে বিকশিত এবং প্রযুক্ত হচ্ছে;
(৩) সংখ্যালঘুত্ব এবং জাতীয়তাবাদ;
(৪) অমর্ত্য সেন বা অরুন্ধতী রায়রা যখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আলোকে বিভিন্ন চিন্তাগুলোর সমালোচনা করেন তখন তাতে যুক্তিযুক্ততা কতটুকু?
(৫) কোনো নির্দিষ্ট ভূখন্ডের জাতীয়তাবাদ প্রশ্নের মিমাংসায় অন্যান্য দেশের পরিপ্রেক্ষিত আসলে ঠিক কতখানি প্রযোজ্য।
এগুলো ঠিক প্রশ্ন হিসেবে না নিয়ে ব্রেনস্টর্মিং হিসেবে নিতে পারো, বা আমার দিক থেকে তোমার লেখাটা পড়ে তাৎক্ষণিক কিছু পয়েন্টে "থিন্কিং এলাউড" হিসেবেও নিতে পারো। উত্তরগুলো আমারও আসলে জানা নেই, তাই ভাবছিলাম তোমার এবং বাকিদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে কিছু চিন্তার ক্লু পাওয়া যায় কি না। বিষয়গুলো আসলেই খুব ভালভাবে বুঝতে চাই, বোঝা দরকারও।
পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
রায়হান আমার লেখা 'চেতনার সংকট' আর্টিকেলটি পড়ে দেখতে পার। সেখানে দু'একটি প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাবে।
http://www.somewhereinblog.net/blog/ramit/29323004
এই ব্লগেও লেখাটি আছে।
অনেক ধন্যবাদ রমিত আজাদ ভাই। লেখাটা পড়ছি 🙂
'ফ্যাসিবাদ' খারাপ, যার অর্থ হলো নিজের জাতির প্রতি ভালোবাসা ও অপরাপর জাতিসমুহের প্রতি ঘৃণাবোধ। এই ঘৃণাবোধ একসময় নিজের জাতির জন্যই অমঙ্গল বয়ে আনে। জাতীয়তাবাদ কিছুটা ভালো, যার অর্থ হলো নিজের জাতির প্রতি ভালোবাসা ও অপরাপর জাতিসমুহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। এই বোধ নিজের জাতির জন্য কাজ করতে উদ্ধুদ্ধ করে। এর ফলে যেমন নিজের জাতি, তেমনি নিজেও উপকৃত হই। মানব সমাজও উপকৃত হয়। জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকতাবাদেরও প্রয়োজন আছে। এই পৃথিবীতে এমন কোন জাতি নেই, যে আইসোলেটেড হয়ে টিকে থাকতে পারে। দু'একটি জাতি এমন চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এই পৃথিবীর প্রতিটি জাতির একে অপরের হাত ধরে চলতে হবে, পারস্পরিক প্রয়োজনেই। একে অপরের দিকে অস্ত্র তাক করার ভয়াবহতা আমরা দেখেছি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চাইনা।
খুবই একমত।
রায়হান ভাই, বছরখানেক আগে একটা লেখা দিয়েছিলাম এখানেই- স্বাধীনতা তুমি
সেখানে আমার নিজস্ব চিন্তা থেকে জাতি শব্দের অর্থ নিরূপণ করার চেষ্টা করেছিলাম। আমার ভাবনায় মূল বিষয়টি ছিল- "ন্যায়বিচার" বা justice। এভাবে দেখলে- জাতি তারাই যারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের একটা গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞায় ঐক্যবদ্ধ(সংবিধান যার লিখিত রূপ), জাতির অন্যদের প্রতি ঐ ন্যায়বিচার রক্ষার্থে অঙ্গীকারবদ্ধ, অন্যদের কাছ থেকেও একই রকম ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে।
গুলশান,
জাতির সংজ্ঞা বিষয়ে তোমার চিন্তাধারা ভালো লেগেছে। কিন্তু এটি অলরেডী জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক পরিচয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত এবং সামাজিক বিজ্ঞানসমূহে বহুলভাবে ব্যবহৃত 🙂 (সম্পাদিত)
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
জেনে খুবই ভাল লাগল ভাইয়া। আমার এই চিন্তাটা অবশ্য মূলত দেশ/রাষ্ট্র নিয়ে ছিল (যেটাকে গোষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিচয় বলা যেতে পারে), তবে জাতি আর রাষ্ট্র মিশিয়ে ফেলেছিলাম। তবে ন্যায়বিচার বা অধিকার বলতে কী বোঝায়, তাতে ঐক্যমতে আসাটা ভিন্ন ভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর কিছুটা কঠিন হতে পারে।
গুলশান,
ঠিকই ধরতে পেরেছো যে, সাংস্কৃতিক পার্থক্য 'ন্যায়বিচার' বা 'অধিকার' এর তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক ধারণাকে যথেষ্ট জটিল করে ফেলে, যা' বিবেচনায় না রাখলে সমস্যা শুধু বেড়েই চলে। এক্ষেত্রে 'মাল্টিকালচারালিজম' একটা মোটামুটিও গ্রহণযোগ্য উপায় হিসেবে বেশ কিছু রাষ্ট্রে চর্চা করা হচ্ছে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
এই "মাল্টিকালচারালিজম" মানে কি ন্যায়বিচার ও অধিকারের "মাল্টিপল অফিসিয়াল স্ট্যান্ডার্ড" বজায় রাখা ধরণের কিছু? সেটা কতটুকু সম্ভব?
'মাল্টিকালচারালিজম' - লিখবার মতো আরেকটা বিষয় হতে পারে।
@গুলশান,
নানান মন্তব্যের মধ্যে তোমার এই প্রশ্নটা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
'মাল্টিকালচারালিজম' শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়- কোন দেশ/শহর/স্থান/লোকালয়ে বিভিন্ন কালচারের সহাবস্থান (প্রধানতঃ হরেক রকম খাবার) থেকে শুরু করে ব্যক্তি+সমাজের মতাদর্শিক পর্যায়ে ভিন্ন কালচারের প্রতি সহনশীলতা এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ছোটবড় সকল নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির মৌলিক অধিকারসমূহের স্বীকৃতি+সংরক্ষণ। সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনায় মাল্টিকালচারালিজম মূলতঃ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা+কার্যক্রমের প্রতি ফোকাস করে। যেমন- বৃহৎ+ক্ষুদ্র সকল গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংস্থান করা, কিছু কিছু আইন+বিধি-নিষেধ শিথীল করা যা' ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তাগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ, মেজরিটি+মাইনরিটির সুস্থ্য সহাবস্থান নিশ্চিত করতে বর্ণবাদ বিরোধী আইন প্রনয়ণ করা এবং এফার্মেটিভ একশন (কোটা সংরক্ষণ, ইত্যাদি) গ্রহন করা, ইত্যাদি।
@ রায়হান ভাই,
ঠিকই বলেছেন যে, মাল্টিকালচারালিজম আলোচনার বিষয় হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে ধর্মীয়+নৃতাত্ত্বিক মাইনরিটি গোষ্ঠিগুলোকে যেভাবে ট্রিট করে, তা' রীতিমত বর্ণবাদী!
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
গুলশান,
ধন্যবাদ লিন্কটির জন্য। ন্যায়বিচারের আঙ্গিক থেকে বিষয়টা ইন্টারেস্টিং।
রায়হান ভাই,
প্রশ্নগুলো বেশ ইন্টারেষ্টিং; আর জাতীয়বাদের আলাপে প্রয়োজনীয়ও।
'জাতি' কনসেপ্টটা নিয়ে আমরা সাধারণভাবে যতটা স্বচ্ছ ধারণা রাখি মনে করি, প্রকৃতপক্ষে সেটা ততটাই অস্বচ্ছ। কারণ, আমরা জাতিকে 'নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি'র সমার্থক ধরি। জাতি হচ্ছে একটা রাজনৈতিক কনসেপ্ট, যা' একই জাতিরাষ্ট্রের মধ্যকার জনগোষ্ঠি কে নির্দেশ করে, আর নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি হচ্ছে একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কনসেপ্ট, যা' একই সামাজিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠিকে নির্দেশ করে।
কোন জাতিরাষ্ট্রকে একটা নির্দিষ্ট নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি যখন নিজেদের বলে দাবী করে, এবং সেই দাবী প্রতিষ্ঠা করতে যায়, ঝামেলাটা শুরু হয় তখনই- জাতিরাষ্ট্রের অন্তর্গত একাধিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির মধ্যে ক্ষমতাবান (সাধারণতঃ সংখ্যাগরিষ্ট) গোষ্ঠি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিগুলোর উপর নিজেদের সিদ্ধান্ত, আইন, ভাষা-সংস্কৃতি, ইত্যাদি চাপিয়ে দেয় বা দেওয়ার চেষ্টা করে এমনমাত্রায় যে তাদের স্বতন্ত্র্য অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। ক্ষমতাবান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি তাদের এইসকল কাজকে জাষ্টিফাই করে একই রাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে, কিন্তু তাদের আলাদা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়কে অস্বীকার করেই। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠিক এই ঘটনাই ঘটছে- বাঙ্গালিরা ক্ষমতায় এবং সংখ্যায় বেশি বলে বাংলাদেশ নামের জাতিরাষ্ট্রকে (নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি হিসেবে) নিজেদের বলে দাবী করে এ'ই বলে যে, বাংলাদেশ হচ্ছে বাঙ্গালিদের রাষ্ট্র। আসলে এটা ঘটে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি আর রাজনৈতিক গোষ্ঠির ধারণাকে একই হিসেবে বিবেচনা করায়, যা' প্রকৃতপক্ষে মৌলিকভাবেই আলাদা।
বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ট বাঙ্গালিদের দ্বারা অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি্র স্বতন্ত্র্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়কে অস্বীকার করার এই প্রবণতা জাতিরাষ্ট্রের বিকাশের শুরুর দিকের একটা সাধারণ প্রবণতা যা' প্রায় সকল জাতিরাষ্টের মধ্যেই দেখা যায়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। অধূনা এই প্রবণতাকে উন্নত বিশ্বে বেশির ভাগ দেশ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে 'মাল্টিকালচারালিজম' অনুসরণ করার মাধ্যমে- এটি একই রাজনৈতিক পরিচয় তথা জাতীয়তার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু উপনিবেশ-পরবর্তী যুগে এসে সারা বিশ্ব অনেকগুলো নতুন জাতিরাষ্টে বিভক্ত হয়ে গেলে এসবের মধ্যকার নানান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি রাষ্ট্র-ক্ষমতার জন্য পারস্পরিক বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, এবং কেউ ক্ষমতা পেয়ে গেলে সেটা নিষ্ককণ্টক করার জন্য বা নিজেদের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিগুলোকে অস্বীকার করে।
বর্তমানের উদীয়মান 'বহুজাতিক' সমাজের ধারণা জাতীয়বাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ, জাতীয়তাবাদের আধার হচ্ছে জাতিরাষ্ট্র, বহুজাতিক সমাজ যা'কে অতিক্রম করে যায়। অর্থ্যাৎ, রাজনৈতিক পরিচয়ে রাষ্ট্রের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে বিশ্ব বা এইধরণের কিছু যা' জাতিরাষ্ট্র থেকে বড়।
অমর্ত্যসেন বা অরুন্ধতির আলোচনা সনপর্কে আমি কিছুই জানিনা। তাই এই বিষয়ে মন্তব্য করতে পারলাম না।
জাতিরাষ্ট্র যেহেতু একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিজেদের স্বার্বভৌমত্ব দাবী করে, সেই কারণে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রেক্ষিত অবিচ্ছেদ্য। (সম্পাদিত)
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ
যথার্থ বলেছো। কিছু কিছু কনসেপ্টকে আমরা অনেকটা taken for granted ধরে নিই, 'জাতি' ধারণাটাও মনে হয় সেগুলোরই একটা। এমনই আরেকটা ধারণার মুখোমুখি হয়েছি সম্প্রতি, আর সেটা হল স্বচ্ছতা বা "ট্রান্সপ্যারেন্সি"। একেক সামাজিক গ্রুপের কাছে এই শব্দগুলো একেক মানে নিয়ে ধরা দেয়। আর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের মানুষের কাছে অর্থ এবং পারসেপশনের ভিন্নতা সম্ভবত তাদের অবস্থান এবং কাজকেও প্রভাবিত করে। এই আলোচনাটা খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে 🙂
অমর্ত্য সেনের একটা ইনট্ারেস্টিং আলোচনা ছিল, যদিও অতি বেশী সংক্ষিপ্ত, ইকনমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে ছাপানো হয়েছিল, যদি ঠিক মনে করতে পারি। দাঁড়াও লেখাটা খুঁজে পাই কি না, পেলেই ইমেইল করে দেবো।
মাহমুদ,
তোমার একটা জিনিস বুঝি না। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দাও, বলিউডের হিরো-হিরোইন। আর এখানে এসে কলম ধরো সাধু-সন্তের মতো।
টোকিওতে তোমার সাথে আড্ডা গুলো খুবই এনজয় করেছি। প্রফেসর ইউনুসের ব্যাপারে একটা লেখা দাও না। তোমার কথাগুলো একেবারে হার্টে গেথে গেছে।
প্রবাসী প্রোগ্রামটি কিন্তু করছি। ডিসেম্বরে। তোমার রেমিট্যান্স রিসার্চ বিষয়ক কিছু কথা শোনার জন্য একটা সেশন করবো ভাবছি। এসো কিন্তু।
বিশাল লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
আলীম ভাই,
আমার ফেসবুকের প্রোফাইল আপাততঃ বউয়ের দখলে। কাজেই, সেখানে আরো বলিউডি ছবিটবি দেখতে পারেন ভবিষ্যতে 🙂
টোকিওতে আপনার সাথে আড্ডায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি যা' প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিষয়ে আমার ধারণাকে আরো স্পষ্ট করতে সাহায্য করছে। আরো কয়েকটা দিন আপনার সাথে বসতে পারলে খুব ভালো হতো।
ভাইয়া, এখন মিডিয়াতে ডঃ ইউনূসকে নিয়ে লিখলে সেটা শেখ হাসিনার পক্ষে নেওয়া মনে করে লোকে ভুল বুঝবে বা ব্যাখ্যা করবে। আপাততঃ এই মিডিয়া-হাইপ থামুক, তখন দেখা যাবে। ভালো লাগল জেনে যে, আপনি তাকে নিয়ে আমার কথাগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
আগামী ডিসেম্বরে মনে হয় দেশে যাওয়া কঠিন হবে। তবে চেষ্ট করবো। প্রবাসী প্রোগ্রামে থাকতে পারলে ত' আমার রিসার্চেরও অনেক কাজ এগিয়ে যাবে। (সম্পাদিত)
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
:thumbup: :thumbup:
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
এইটা খারাপ বলিস নাই ইউনুস রে নিয়া
আমি আজকেই একজনের স্ট্যাটাসে নিচের উত্তর দিয়েছি।
তার স্ট্যাটাস ছিলো
আমার উত্তর, অবশ্য আরো কথা হইছে।
মনে হইতেছে আমাদের অপসন তিনটা
ক হাসিনা প্লাস এরশাদ প্লাস বাম
খ খালেদা প্লাস জামাত প্লাস জামাত
গ ইউনুস প্লাস তার বিদেশী বন্ধু
তা ইউনুসের যোগ্যতার মাপকাঠি কি?
তার শান্তিতে নোবেল?
তার গ্রামীণ ব্যাংক
তার বিদেশী বন্ধু?
গেলোবার বদরুদ্দোজাও জিততে পারে নাই।
কামাল হোসেন তো প্রতিবার হারে।
সালমান এফ রহমান ৯৬ এ টাকা দিয়াও জিততে পারে নাই।
তা ইউনুস মিয়া ক্ষমতায় আসতে চায় কি করে?
তার ৩০০ আসনে প্রার্থী আছে?
সে নিজে জিতবে ইলেকশনে?
তাইলে?
তার লড়তে হবে ঐ নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল না হয় দাড়ি পাল্লা নিয়া।
তার এতো তেজ কিসের?
বিদেশী বন্ধুরা তারে পাওয়ার ইঞ্জেক্ট কইরা দিছে!
এক ব্যাংক বানাইছে তার তেজে দুনিয়া ছারখার।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যাবসা সফল ব্যাংক হইলো ইসলামী ব্যাংক।
তাইলে ওগো এম ডি রে দেশ চালানোর ভার দেয়া হোক!
এরশাদের সবচেয়ে বেশি খাতির ছিলো মধ্যপ্রাচ্যের সাথে। তারে আবার বসানো হোক ক্ষমতায়।
গ্রামীণ ব্যাংক আর ইউনুস যেনো এক সূত্রে গাঁথা।
স্টিভ জবস মারা যাওয়ায় আপেল তো মাঠে বইসা গেছে!
মাইক্রোসফট ভাগ করায় তো মানুষ আজ আর মাইক্রোসফট ব্যাবহার করে না।
তাইলে এক ইউনুস চইলা গেলে ক্যান গ্রামীণ ব্যাঙ্কের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়?
কার সার্থ দেখেন তিনি ঐ পদে বসে?
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ভালো লিখছো মাহমুদ। একদম পরিস্কার বিশ্লেষন।
রায়হান ভাইয়ের মত আমিও জানতে চাই, "জাতি" আসলে কি? "কালচার" ইবা কি?
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ ভাই,
ধন্যবাদ।
রায়হান ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরগুলো দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
পড়লাম। চমৎকার ব্যাখ্যা।
কিছু ধোয়াশা কাটছে। বাকী রয়ে গেছে অনেক। 🙂
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ ভাই,
আবারো ধন্যবাদ।
ধোঁয়াশা আমারও খানিকটা আছে। তারপরেও প্রশ্ন করেন, আলোচনা করি, আরো খানিকটা ধোঁয়াশা কেটে যাক 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
প্রশ্ন আকারে তো দিতে পারবো না। তবে আমার মনে হয়, যেভাবে চর্চিত হচ্ছে জাতি বা কালচার গুলো আদতে তা আসলে সেই অর্থ বহন করে কিনা। যেমন ধর জাতীয়তাবাদ, আমরা একহতে পারি না কেন? আমরা কেন ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্থান সমর্থন করি এত প্রবল ভাবে? পাকি-রাজাকার ভারত-রাজাকার ভাগ হয় কিভাবে? এত প্রবল ভাবে অন্যদেশের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় কিভাবে? যে আমরা যুদ্ধাপরাধ এর বিচার করি, সেই আমরাই পাহাড়ে রক্ত ঝরাতে কার্পন্য করি না, নীতিতেও বাধে না। সমস্যাটা আসলে কই?
স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়েও প্রশ্ন আছে, এটাকে অনেকে ধর্ম যুদ্ধর মত করে দেখে। মুসলমানের পরাজয় আর বাম ঘরনার জয়। আমি নিশ্চিত, মুক্তিযুদ্ধের সময় একেক নেতা ভিন্ন-ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল। তাই সেখানে এত গুলো পক্ষ তৈরী হয়েছিল। প্রাথমিক উদ্দেশ্য হাসিলের পর তারা সবাই নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিলে মত্ত হয়েছিল। এবং তাই এই ভয়াবহ পরিনতি এখন আমাদের। আমার ধারনা এটা অবধারিত ছিল কারন বঙ্গবন্ধু সবাইকে এককাতারে আনতে পারেননি বা আনতে চাননি। (তাই কি?)। জাতি-জাতীয়তাবোধ তিনি নিশ্চয় ভালোই বুঝতেন। কি উদ্দেশ্য তিনি বাংগালীদের পাকি থেকে আলাদা করলেন আর কি কারনে বা পাহাড়ীদের বাংগালী হতে বললেন? আমার কাছে তাই তিনিও কাঠগোড়ায়।
আরও একটা বড় সমস্যা চোখে পড়ে মোটা দাগে, সংখ্যাগরিস্ট মুসলমানদের কালচার নিয়ে এত সমালোচনা হয় বাংলাদেশে, কিন্তু সংখ্যালঘিস্ট হিন্দু কালচার নিয়ে সমালোচনা হয় না কেন? ভারতে কি এর উল্টাটা হয় নাকি? তুমি জানো কিছু? এটা কি সংখ্যালঘিস্ট দের জন্য দয়া বা করুনা টাইপ কিছু। ধর্মীয় বাংগালী কালচার কিন্তু অনেকটা কাছাকাছি, ঈদ-পুজা-বিয়ে-নবীনবরন-বিদায় । পার্থক্য বলতে কোনটা হয়তো মসজিদে কোনটা বা মন্দিরে, কোথাও আরবী কোথাও বা সংস্কৃত। আদি ধর্ম (মুসলমানদের ব্যাপারটায় আমি নিশ্চিত) খুব বেশী একটা নেই। তবে কেন দুইপক্ষ জাত গেল জাত গেল রব উঠায়। না যেনে নাকি, ইচ্ছা করে। (ব্লগে যেমন হিট পাওয়া একটা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে)।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার একটা সমস্যা আছে। আমি হচ্ছি কর্পোরেট ভাষায় "প্র্যাকটিসিং মুসলিম"। তাই আমাকে অগনিত প্রশ্ন গিলে ফেলতে হয়, কারন আমি কিছু বললে অনেকেই, (এমনকি তুমিও) অনেকটা "প্রি-ডিফাইন্ড" অর্থ বের করে ফেল। মূলটা হারিয়ে যায় তখন।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আমার মনে হয় তোমার এই পর্যবেক্ষণটি ভীষণভাবে ঠিক।সংখ্যালঘুদের নিয়ে আলোচনা করতে আমরা ভয় পাই, তাদের ধর্মীয় অন্ধত্ব কুসংস্কারকে দেখেও না দেখার ভান করি।ভারতেও এটা দেখেছি -মুসলমানদের গোঁড়ামি নিয়ে কোন কথাই সেখানে বলা যাবেনা, বললেই তুমি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রোমোট করছো। রাজনৈতিক ভাবেও ব্যাপারগুলো স্পর্শকাতর, কেউ সেগুলো নাড়াতে চায়না।
বাংলাদেশেও হিন্দু বিবাহ/সম্পত্তি এসব নিয়ে অনেক আইনী ঘাপলা আছে।সম্প্রদায় প্রতিভু নেতারা এসব নিয়ে কোন কথা তো বলবেইনা, যদি সরকার বা রাজনৈতিক কোন পক্ষ বলে তখন তো গেল - সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে টানাটানি লেগে যাবে।কাজেই রাষ্ট্রকে যথেষ্ট শক্তিশালী হতে হয় যেখানে ন্যায় অন্যায়ের বিচার করার জন্য প্রচলিত আইনই যথেষ্ট হতে হবে, ধর্মের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবেনা সিস্টেমকে।
তাছাড়া সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী প্রবল হীনমন্যতার শিকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই।
তার মন পাওয়া এবং বোঝা সহজ নয়।
ফয়েজ ভাই,
আপনার মন্তব্যের উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল বলে দুঃখিত।
প্রথমে আপনার উত্থাপিত প্রশ্নগুলো নিয়ে আলাপ করা যাক-
জাতীয়তা প্রশ্নে আমরা একই হতে পারিনা কারণ আমরা মনে করি বাংলাদেশ শুধুমাত্র 'বাঙ্গালিদের' রাষ্ট্র, সে'ই কারণে। এখানে যে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আরো কিছু ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি আছে, তাদেরকে আমরা গোণায়ই ধরিনা।
কৃকেটের কথা বলেছেন, সেটা কিন্তু ভারত বা পাকিস্থান জাতি/রাষ্ট্র/দেশকে সমর্থন করার জন্য না, সেটা আসে তাদের জাতীয় কৃকেট দলের খেলায় যে শিল্পমান, সেটার জন্য। খেলাধূলা, সঙ্গীত, সাহিত্য, অভিনয়, ইত্যাদি দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করে বলেই সারা পৃথিবীর মানুষ এসবকে ভালোবাসে। [ নূসরাত ফতেহ আলী, বা রাহাত ফতেহ আলী, বা মেহেদী হাসানরা সবাই ত' ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানের নাগরিক, কিন্ত তাদের লাখ লাখ ভক্ত আছে ভারতে। তাহলে সেসব ভারতীয়রা কি পাকিস্তান-প্রেমী?]
পাহাড়ে আমাদের সরকারী নীতি আর আম-বাঙ্গালির জাতীয়তাবাদের ধারণা একই (অর্থ্যাৎ, বাংলাদেশ হচ্ছে বাঙালি জাতির রাষ্ট্র, এখানে অন্যরা সকলেই বহিরাগত; তারা হয় নিকট অতীতে, অথবা সুদূর অতীতে এইখানে 'অনুপ্রবেশ' করেছে!)। এই জন্য পাহাড়ে মানুষ মেরে কচুকাটা করলেও আম-বাংগালির গায়ে লাগে না, কারণ বাঙালি ছাড়া বাদবাকি সকলেই এই রাষ্ট্রে 'অনাহূত', ফলে অবাঞ্ছিত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কখনোই 'ধর্মযুদ্ধ' ছিলনা। ঐতিহাসিক উপকরণসমূহ (ইতিহাস বললাম না, কারণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি, যা' আছে সেটা উপকরণই) ভালো করে দেখলে কোথাও পাবেন না যে, মুক্তিযুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে বা পক্ষে হয়েছে; ইসলাম প্রসংগটাই ছিল অপ্রাসঙ্গিক। এটা এসেছে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক কারণে- যেহেতু ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তানের জন্য হয়েছি ইসলামের ভিত্তিতে, এবং যেহেতু ভারতের সক্রিয় অংশগ্রহনে বাং
লাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাই ভারত এটাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তথা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের বিজয় হিসেবে দেখে। ভারতের পরম মিত্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারও তাই একে এভাবেই দেখে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ত' এভাবে দেখে না- তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে জয়ী দেখে ঠিকই, কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। এই কারণে পাকিস্তানের সাথে ইসলামকেও স্বাধীন বাংলাদেশের শত্রু-তালিকায় জুড়ে দিলে জনতা সেটা প্রত্যাখ্যান করে। ভারতের সাথে তাল মিলিয়ে যারা (তথা যেসব রাজনৈতিক নেতা/দল) স্বাধীন বাংলাদেশ আর ইসলামকে শত্রুজ্ঞান করে, তাদেরকে পরিত্যাগ করে বিকল্প খুঁজে। স্বাধীনতা লাভের মাত্র ২/৩ বছরের মধ্যেই আওয়ামীলীগের মতো, শেখ মুজিবের মতো তুমুল জনপ্রিয় দল ও নেতার জনপ্রিয়তায় ধ্বসের এটাই প্রধান কারণ। তাদেরকে 'ভারতপ্রেমী' বলে 'গালি' দেওয়ারও এটাই প্রধান কারণ। এখান থেকেই জনতা আওয়ামীলীগের বিকল্প খঁজে, যারা ইসলামকে বাঙ্গালির শত্রুজ্ঞান করে না। দৃশ্যপটে আসে বিএনপি। কিন্তু আওয়ামীলীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আসে বলে স্বভাবতঃই তারা ভারতের বন্ধুত্ব থেকে বঞ্চিত। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বন্ধু/সাহায্যকারী খুঁজতে গিয়ে তারা প্রধানতঃ মুসলিম দেশেসমূহের (যেমন, ওআইসি) দারস্থ হয়। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম একটা নিয়ামক হয়ে ওঠে। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফলশ্রুতিতে ইসলাম আমাদের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটা পক্ষ হয়ে দাঁড়ায়, আর রাজনৈতিক দল এবং এদের বিদেশী মিত্ররা ইসলামকে 'ব্যবহার' করে তাদের পক্ষে-বিপক্ষে। সুতরাং, স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামের রাজনীতিকরণ মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায় নয়, এর পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায়। [এইজন্য ইসলামকে কষে কয়েকটা গালি দিয়ে "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লাভ" পুরোটাই অসার]।
সংখ্যাগরিষ্টের সমালোচনা হলেও সংখ্যালঘুর সামান্য সমালোচনা কেন হয়না সেটা নূপুর ভাই বলে দিয়েছেন, আমি তার সাথে একমত।
আমিও দিনে ৪/৫ ওয়াক্ত নামায পড়ি; এতে সমস্যা কি? অবশ্য আপনার সমস্যা হতে পারে- বাংলাদেশে থাকেন, যদি লম্বা দাড়ি আর পাঞ্জাবী পড়ে মসজিদে যান, তাহলে দেশপ্রেমে ঘাটতি দেখা যেতেই পারে 😛
ভবিষ্যতে আমি আপনাকে প্রিডিফাইন্ড ক্যাটাগরীতে ফেললে বলবেন, আলাপ করে শোধরাবো নিজেকে 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
এই দুইধারার বাইরে সবথেকে বেশি সম্ভাবনাময় হিসেবে স্বাধীনতার পর আমাদের মাঝে ছিল শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতাবাদ- এর ছিল বিশাল মেধাবী ছাত্র সংগঠন এবং তৃণমূল গণভিত্তি। কিন্তু ধর্মপ্রশ্নে এটিও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মনোভাবকে বুঝতে ব্যর্থ হয়- ইউরোপের অনুসরণ করে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠানোর জন্য এটিও বাংলাদেশে মুসলিম জনতার কাছে আবেদন হারায়। ফলে, অমিত সম্ভাবনাময় এই ধারা কখনোই বিকশিত হতে পারেনি।
সহমত।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
মাহমুদ ভাই,
humanistsaiful at জিমেইল ডটকমে একটা মেইল করতে পারবেন কি? 🙂
আসস্লামু আলাইকুম
ধন্যবাদ আপনার লেখা খুবই ভাল লেগেছে। আসলে সোজা ভাষায় বখতিয়ার খলজি, শাহজালাল প্রমুখ আমাদের দেশে এসেছেন তলোয়ার হাতে নিয়ে। তারা দাওয়া ও জিহাদকে কখনো আলাদা করেননি। তাদের দাওয়া ও জিহাদের জন্যয় আমরা মুসলিম হয়েছি, অবশ্যই হিদায়াহ আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। রাসুল (সাঃ)এর মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ইসলাম প্রায় অর্ধ পৃথিবী শাসন করেছে।
তাই দাওয়া আর তলোয়ারের সাহায্যে আবার মানুষের বানানো গনতন্ত্র হটিয়ে ইসলামের স্বাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের পুর্বপুরুষের ইসলামকে আরও দূরে পৌছে দেয়া আমাদের দ্বায়িত্ব। এজন্য আমাদের যাবতিয় দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে সামরিক শিক্ষা।
ভাই হারুন,
ঠিকই বলেছেন। সামরিক শিক্ষা খানিকটা ছিল। কিন্তু তলোয়ারের শিক্ষা ত' পাই নাই। আমি কি আপনার দলে শরীক হইতে পারুম?
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
=)) =)) =)) =)) =))
:grr: :grr: :grr:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
মাহমুদ ভাই@ একটা গুরুতর প্রশ্ন একদিন আমার এক বন্ধু করেছিল-"ইসলামের চেয়ে যদি ভাল কোন ধর্ম থাকত, তবে মুসলিমরা সাধারনত হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করে নয়া কেন?" অল্প বয়সে সোজা যে উত্তরটা মাথায় এসেছিল তাই বলেছিলাম- "কারন ইসলামে জাত পাতের ভেদ নেই।" আপনার লেখায় বিশদ ভাবে আলোচনাটা এসেছে। এবার আসি প্রসংগে। আমার মনে হয় বাংগালী জাতীয়তাবাদ বা ইসলামী জাতীয়বাদ দুইটি চেতনাই নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টায় লিপ্ত। আর এর বাড়াবাড়ি কৃত্রিম, সর্বসাধারনের কাছে যা বিরক্তিকর। আমার বরাবর মনে হয় ধর্মজাত মহিমা আর বাংগালীত্বের চেতনায় উদ্দীপ্ত জাতীয়বাদই একদিন এদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। অসামান্য একটা লেখা লিখেছেন। O:-)
ধন্যবাদ আসিফ।
আমি ধর্মে ভূমিকা নিয়ে খানিকটা সংশয়ে আছি। কিন্তু বর্তমানে দেশপ্রেমের যে চেতনার কথা ব্লগস্ফিয়ারে দেখি, সেটা অমিত সম্ভাবনা দিয়ে শুরু করলেও আজাইরা ইসলামবিরোধীতা এবং অপ্রয়োজনীয় দলবাজী কারণে দেউলিয়ার পথে। বাঙ্গালী এথনিসিটির ভূমিকা আগামীতে বড় হয়ে উঠবে বলে আমার মনে হয়, যদিও এতে রিস্ক আছে আরেক ধরণের মৌলবাদের। তবে সেটা অবশ্যই চেতনাজীবিদের মৌলবাদ থেকে আলাদা হবে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
তবে বখতিয়ার খিলজী দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন এ সত্য এতদিন কীভাবে অজানা থেকে গেল? :chup: এরকম হিংস্র ও যুদ্ধবাজদের দাওয়াতে ধর্মের প্রচার মেনে নিতে হলে সত্যিকার অর্থেই ধর্মকে আমাদের সমীহ করা উচিত ( অন্ততঃ প্রান বাচানোর জন্য! 😉 )
মাহমুদ ভাই
এই লেখাটি একটি গভীর ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ। আপনার জ্ঞানতাত্ত্বিক ও নির্মোহ বিশ্লেষণ গভীর মনযোগ দাবি করে। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত চলমান ডিসকোর্সে এই লেখাটি বহুল প্রচারিত ও পঠিত হওয়া উচিত। ভাষাগত কিছু পরিমার্জনা ও প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য নির্দশ সাপেক্ষে লেখাটি কোনো বহুল প্রচারিত জার্নালে বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে দেশ উপকৃত হবে। সেই দাবি রইল।
আর, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংযোগ আরেকটু বাড়ালে লেখাটি আরো শক্তিশালী হবে বলে আমি মনে করি।