দুইদিন আগে আমি একটা পোস্ট দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম দেশের উন্নয়ণে কার কি ভাবনা, মানে কি কি ভাবে বাংলাদেশের উন্নতির চেষ্টা সফলভাবে করা যায়। সবাই বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশের জন্য কাজ করার, অনেকেই বেশ কিছু মূল্যবান কথাও বলেছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে সমস্যার সমাধানটা ঠিকমত উঠে আসছে না। জুলহাস ভাইয়ের পোষ্ট ত দারুন জমিয়ে ফেলেছে এই আলোচনাটা। কিন্তু আমার উপলব্ধি একই, সমস্যার সমাধানটা ঠিক কিভাবে করা যাবে তা’ স্পষ্ট হচ্ছেনা।-
এই বিষয়টা আমাকে অনেক দিন ধরেই ভাবায়, বলা যায় ঢাবি’র সেই শুরুর দিনগুলো থেকেই।- সদ্য ক্যাডেট কলেজ থেকে আসা, দু’চোখ ভরা স্বপ্ন আর বুক ভরা আবেগ নিয়ে ক্লাস, ক্লাস থেকে লাইব্রেরী, বিকেলে ডাকসু ক্যাফে’র পাশে প্রগতিশীল ছাত্র-সংগঠনে আড্ডা, তারপর……আরো কতো জায়গায় ঘুরাঘুরি, কতো লোকের সাথে কতো বিষয়ে কতো কথা। চারদিকে শুধুই স্বপ্নের ছড়াছড়ি। ক্যাডেট কলেজে থাকার কারনে দেশের সম্পর্কে খুব বেশি জানার সুযোগ ছিলো না, সেই অভাবটা মেটাতে চেয়েছি খুব। জেনেছি পূঁজিবাদী শোষণের কবলে দেশ বন্দী। জেনেছি কলোনিয়াল আমলাতন্ত্রের ছোবলে প্রশাসন স্থবির, নপুংশক। জেনেছি করপোরেট পূঁজির অদম্য আগ্রাসন আর তাদের দেশীয় চামচাদের নৈতিক স্খলন আর সীমাহীন দূরাচার। সাথে সাথে নিজের মধ্যে ফুসে উঠেছে এক ‘বিদ্রোহী’, যে সব কিছু ভেঙ্গে দিতে চায়। দেখেছি আধূনিকতার সীমানা, শুনতে পেয়েছি উত্তরাধূনিক সংগ্রামের ডাক। আর তাই দেরী না করে ঝাপিয়েও পড়েছি। চেয়েছি সবকিছু ভেঙ্গে পড়ুক। ‘কিন্তু তারপর?’ এই প্রশ্নটা করার ফুরসত হয়নি। তার আগেই ঝাপ দিয়েছিলাম ‘বৃত্ত ভাঙ্গা’র দলে। আজ দূর থেকে চেয়ে দেখি, যাদের ভাংবো বলে নিজেকেও ভেঙ্গেছিলাম (সে কারণেই কি না- বরুণা বলতো- আমি কোনো মেয়েরই যোগ্য নই), আজ দেখি সেই পূঁজির দাস, নষ্ট আমলাতন্ত্র, লোভী কর্পোরেট আর তা’র বেশরম দেশীয় চামচাদের ঊদ্বাহু নৃত্তের তালে তালে অদ্ভুত উটের পিঠে এক চলেছে স্বদেশ।
এখন মাঝে মাঝেই ভাবি, এতো যে স্বপ্ন, এতো যে আবেগ, এতো সংগ্রামের ডাক, এত তারুণ্যের স্রোত, তবুও কেনো যুগ বদলের বদলে আবার সেই পুরনো বৃত্তের মাঝেই ফিরে ফিরে আসা? এটা কি পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় সারাদিন দেওয়াল ঠেলে ঠেলে শুধুই ক্লান্ত হওয়া? যতোই ভাবি, সমাজকাঠামোই দায়ী সবকিছুর জন্য, ততোই একরাশ হতাশা এসে গ্রাস করে নেয় সব স্বপ্ন, দিন বদলের সব প্রয়াস। তবে কি হেরেই যাবো? এই আক্ষেপ থেকেই আবার শুরু করি নতুন করে নতুন পথ খোঁজা, যে পথ চলা শেষে আমি দেখতে পাবো আমার স্বপ্নের-আবেগের-প্রয়াসের প্রাপ্তি, তা সে যতো ক্ষুদ্রই হোক।
এখন উপলব্ধি করি, সে সময়কার উত্তরাধূনিক প্রতিক্রিয়ায় ভাঙ্গার গান’টাই বেশি বেজেছিলো, কিন্তু গড়ার জায়গা’টা ছিল শূণ্যতায় ভরা। সেসময় শুধু মনে হয়েছে বিদ্যমান সমাজকাঠামো’টা ভাংতে পারলেই মুক্তি আসবে। রোমান্টিক ভাবালুতা ঢেকে নিয়েছিল যুক্তির ধার। কিন্তু ভাঙ্গাই তো গল্পের শেষ নয়, বরং শুরু। তার মানে, শুধু ভাংলেই চলবে না, গড়াও চাই, একই সাথে। কারণ, শূণ্যতায় কোন প্রাপ্তি নেই।নতুন সমাজ পেতে হলে তো পুরনো’কে ভেঙ্গে গড়তে হবে, হবেই। কিন্তু নতুন করে গড়ার জন্য চাই নতুন কর্মপরিকল্পনা, পুরনো স্বপ্ন আর আবেগের সাথে জড়াজড়ি করে।
আমি এখনো চাই ভাংতে, কিন্তু তা আর শুধু উত্তরাধূনিক রোমান্টিকতায় ‘ভাঙ্গার জন্য ভাঙ্গা নয়, বরং গড়ার জন্য ভাঙ্গা’। তার জন্য আমাদের শুরু করতে হবে ‘কি কি সম্পদ-সম্ভাবনা-শক্তি আছে’ দিয়ে, কি কি সমস্যা আমাদের আটকে রেখেছে এবং রাখছে তা’ দিয়ে নয়।কারণ, আমাদের সম্পদ,শক্তি আপাতদৃষ্টিতে স্থির, নির্দিষ্ট, কিন্তু সমস্যা ও তার সমাধান পরিবেশ, পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তনশীল। যা স্থির, তাকেই ধরা যায়। যা সতত বদলায়, সে তো মরিচিকা!
যেকোন কাজ করতে গেলে আমি লক্ষ্য করেছি, আমরা সকলেই হাতের কাছে যা যা আছে, সেটা দিয়ে কাজটা শুরু করি। কাজের প্রকৃয়ায় সমস্যার উদ্ভব হয়, সেসবের সমাধানও করে ফেলি কাজের মধ্যেই, সম্পদের অপ্রতুলতা থাকা সত্তেও। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি যে, কোন কাজ বাস্তবিকই সমাধা করতে চাইলে আমাদেরকে ভাবনা শুরু করতে হবে কি কি সম্পদ আছে যা দিয়ে চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সম্ভাব্য একাধিক সমাধান থেকে পরিস্থিতির বিবেচনায় সেরাটা করে ফেলা যাবে সেখান থেকে। সময়ের সাথে সাথে সমাজ বদলে যাবে, প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গায় থেকে নীতি-বিবেক অনুযায়ী কাজ করলেই উন্নতি হবে, পূর্ণ গণতন্ত্র আসলেই ইপ্সিত পরিবর্তন চলে আসবে- এসবই আশার কথা, স্বপ্নের নির্যাস। দেশ নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখে, এসব তাদেরই মনের কথা। কিন্তু এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কর্তা অনুপস্থিত।
সমাজকাঠামো একা একাই গড়ে ওঠে না। হাজার হাজার মানুষের কর্মপ্রচেষ্টার যুক্ত ফলই হলো বিদ্যমান সমাজকাঠাম। যেহেতু মানুষই এই সমাজের নির্মাতা, তাই মানুষের হাতেই রয়েছে এই সমাজ ভেঙ্গেচুরে নতুন সমাজ গড়ার চাবিকাঠি। কাজেই রক্তমাংসে গড়া মানুষই এই ‘দিন বদলের কারিগর’। কাজে কাজেই আমরাই পারি এই দিন বদলে দিতে। আমরাই নতুন দিনের কর্তা, যে কর্তা’কে আমরা খুঁজে ফিরি আমাদের দিন বদলের স্বপ্নে, আকাঙ্ক্ষায়। এই কর্তা’র ভাবনাগুলো কি রকম? আসুন ক্যাডেট কলেজের অভিজ্ঞতার আলোকে তা’ই দেখি।-
মনে করুন, আপনি একজন হাউস প্রিফেক্ট। কোনো এক দিন লাঞ্চের পর যথারীতি সব ব্যাচের শেষে হাউসে গিয়ে দেখলেন ক্লাস এইট/নাইনের পোলাপাইন বিরাট ঝামেলা পাকাইছে যা’র জন্য সাথে সাথেই মকরাগুলারে ‘টাইট’ দেওয়া ফরয। ধরেন, আপনি ঠিক করলেন (মানে আমি করতাম আর কি ;;; ) যে সবগুলারে এক জায়গায় লাইনে দাড় করায়ে ভালোমত সাইজ করা লাগবে। তখন কিন্তু দিয়ে পিটানো উচিত, কোন ধরণের দন্ড ব্যবহার করা উচিত এসব না ভেবে হাতের কাছে যা আছে সেইটাকে বিবেচনা করেন। আসল কথা হল ‘সাইজ’ করা, তা সে ক্রসবেল্টই হোক, আর কাঠের স্কেলই হোক। আপনি কিন্তু এটা ভেবে বসে থাকেন না যে একটা ব্যাটন হলে আরো ভালো হতো, অথবা অন্য কেউ এসে মহৎ দায়িত্বটা পালন করে দিয়ে যেতো।
আবার ধরা যাক, গার্ডেনিং এর কথা। প্রতিযোগিতার আগের দিন দেখলেন অন্য হাউস ব্যাপক সংখ্যক ‘গাছ’ লাগায়ে ফেলছে। কি করা যায়, আরো ‘গাছ’ কোথায় পাওয়া যায়, কেনো আরো ‘গাছ’ নেই, কিভাবে প্লান করলে আগে থেকেই ‘গাছে’র স্বল্পতায় পড়তে হতো না, এসব বিষয়ে গবেষণা শুরু না করে হাতের কাছে যেসব ‘গাছ’ আছে, তা’ই লাগিয়ে দেন রাতের আধাঁরে এমন ভাবে যেনো বিচারক মনে করে ওগুলো আগে থেকেই ছিল।
উপরের দুটো উদাহরণেই দেখা যায় যে, দায়িত্ববান একজন হাউস প্রিফেক্ট (আমার মত ;;; ) কোনো কাজ সমাধা করার সময় হাতের কাছে যা কিছু পায়, তা’ই নিয়ে নিজেই ঝাপিয়ে পড়ে।সে কারো জন্য অথবা কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করে না। একই ভাবে, একজন সফল কৃষক সরকারের ভর্তুকির আশায় বসে না থেকে নিজের যা আছে তা’ই নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে, একজন সফল ব্যবসায়ী কবে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে সেই আশায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে তার যা যা আছে তা’ই নিয়ে ব্যাবসায় নেমে পড়ে, একজন সফল চাকুরে কবে বড়সাহেব হুকুম দিবে সেই ভরসায় বসে না থেকে নিজেই নিজের জন্য নির্ধারিত কাজ শুরু করে দেয়। তারমানে তো তাহলে এ’ই দাড়ালো যে, যার যার জায়গা থেকে নীতি-বিবেক অনুযায়ী নিজ নিজ কাজটা ঠিকমতো করে গেলেই তো পরিবর্তন, তথা উন্নয়ণ এসে যাবে। এ তো সবাই জানে, বলেছেও।
আসলে আমি যা বলতে চাইছি তা হলো যে, আমাদের মধ্যে উদ্যম বা ন্যায়বোধের অভাবের জন্য আমরা ‘বৃত্ত ভেঙ্গে’ বাইরে আসতে পারছিনা, সেটা ঠিক নয়। এটাও ঠিক নয় যে আমাদের কর্মী বা সম্পদের অভাব। আমাদের যা’র অভাব তা হলো একদল কর্তা যাদের কে মুসলিম উগ্রপন্থিরা বলে জিহাদী, আর বামপন্থিরা বলে ভ্যানগার্ড। এরা শুধু ভাংতেই চাইবে না, সাথে সাথে গড়বেও। এরা প্রশ্ন দিয়ে, সমালোচনা দিয়ে কর্মযজ্ঞে নামবে না, এরা কাজে নেমে সমস্যার মুকাবেলা করবে। এরা মাস্ফ্যু’র মতো চ্যালেঞ্জ নিবে। এরা চলার পথে কোন বাধা আসলে বন্য’র মতো ডাইরেক্ট পাওয়ার কিকে তা উড়িয়ে দিবে। এরা বিদ্যমান ঘূণে ধরা সমাজের ধবংসস্তুপের উপর নতুন সমাজ গড়বে। এদের নেতৃত্বেই আসবে নতুন দিন, আমাদের স্বপ্নের ঠিকানা।
সানাউল্লাহ ভাই, একটা সংগঠন কি দাড় করাতে পারি আমরা?
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আমার দাবীও এইটা।
বস,
কইয়েন, যুক্তি ঠিকমত চলছে কি না।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আপনার লেখাগুলা এতো গোছানো। আর্গুমেন্ট কি সুন্দর ডেভলপ করেন, মনে হয় ইকুয়েশন পড়তেছি। সরাসরি প্রিয়তে। 🙂
অপটপিকঃ জেসিসির গার্ডেনিং প্রতিযোগিতায় কি হইত, জানতে বড় মন চায়। 😀
এইটা জেসিসি না তো, রংপুর
কি আর হইব, আমরা সাহারা মরুভুমিরে এক রাইতে বলধা গার্ডেন বানাই দিতাম। অন্যদিকে কলেজ গার্ডেনর বলধা সাহারা হই যাইত।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
:khekz: :khekz:
ধন্যবাদ তৌফিক।
জুলহাস ভাইয়ের লেখা ও এ'তে মন্তব্যগুলো পড়েই এসব মনে হলো, লিখেও ফেললাম।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
খুবই গোছানো একটা লেখা। :clap: :clap:
কৃষি নিয়ে তোমার ধারণাগুলো আরো বিস্তারিত লিখ। উন্নয়ণের আলোচনায় এ'দিকটায় অনেক কিছু জানার আছে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আচ্ছা ভাই। আমি অবশ্যই লিখবো।
হুম
উন্নয়ন ভাবনা কি আসলে একটি মিথ নয়?? কার জন্য কে ভাবছে? আবার কি সেই power-এর প্রশ্নটি এসে যাচ্ছেনা???
ঐ, কচুপাতা কেডা রে......
"ফল আউট" :grr: 😡 😡
পুলাপাইন কলেজের নাম+সময় কিছুই লেখে না।
কত্তবড় আইলস্যা! x-(
(জুনিয়র জেনেই ঝাড়িটা দিলাম। তবে একটা কথা কই, তোমার মতের সাথে আমার মতের মিল আছে মনে হচ্ছে 😛 )
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
হ' ভাই এটটু আইলস্যা 😛 সবাই কয়... তাইতো সবসময় :frontroll: :frontroll: :frontroll: খাই আর :bash: :bash:
ভস আপনার লিখা কিনতু সেরাম :boss: ... সময় পাই না বেশি, আপনার সাথে মতের মিল আছে বলেই আমারো অনুমান। আমিই আপনাকে খুজে নিব।
নিম্নবর্গীয় :salute:
গোস্তাখি মাফ করবেন বস,
উনি কে ??
দেহ দেহি কান্ড!
পুলাপাইন নজর এহন ভালা হইল না। :grr:
(তবে কাহিনী সত্য 😛 )
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx