সিসিবি’তে ধর্ম-বিষয়ক বিতর্ক আমাকে আত্ম-পরিচয় নিয়ে দুদিন ধরে বেশ ভাবাচ্ছে।-
একজন বিশেষ একটা ধর্মের পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করিয়ে তৃপ্তি পেতে চায়, আরেকজন সেই ধর্মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, নিজেকে ধর্ম-ভিত্তিক পরিচিতিমূলক গন্ডির বাইরে আনার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। একদল যেই পরিমাণ সবেগে আত্মপ্রকাশ করে, আরেকদল সেই পরিমাণ গতিতে প্রতিকৃয়া ব্যক্ত করে। কিন্তু কেন এই বিতর্ক? ধর্মই বা কেন এই বিতর্কের কেন্দ্রে? আত্ম-পরিচয়ের আর কোন সাধারণ ‘প্যারামিটার’ আছে কি? থাকলে তা’র মাধ্যমে আমাদের আত্ম-পরিচয় নিয়ে বিভেদ-সৃষ্টিকারী ‘আপাত-লিষ্ফল’ এই বিতর্কের অবসানের কোন সম্ভাবনা আছে কি?
সাধারণ দর্শণ আর সমাজদর্শণ বিষয়ে দীর্ঘদিন (আনুমানিক ১৯৯৪ সাল থেকে) কৌতুহল থাকার কারণে+বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার সুবাদে আত্ম-পরিচয় বিষয়ে আমার কিছু ধারণা জন্মেছে। আমার কাছে মনে হয়, মানব সমাজে ধর্ম আত্ম-পরিচয়ের একটা ‘প্যারামিটার’ (আলোচনার সুবিধার্থে ‘মাধ্যম’ হিসেবে অনুবাদ করা যায়, কিন্তু তা’তে এর পুরো অর্থটা আসেনা বলে মনে হয়) বেশ কিছু শতাব্দী ব্যবহার হয়ে আসছে।
বস্তুবাদী ইতিহাসের আলোকে বলা হয়, মানব সভ্যতার শুরুতে ব্যক্তির আত্ম-পরিচয় নির্ণীত হতো তার গোষ্ঠীগত পরিচয়ের মধ্যে। সেখান থেকে ক্রমশঃ ক্ষুদ্র পরিসরে নগর-রাষ্ট্র হয়ে বিশাল সাম্রাজ্য, সেখান থেকে আবার বিভক্ত হয়ে আধূনিক জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে এখন ব্যক্তির পরিচয় নির্ণয় করা হয়। এই সূদীর্ঘ কয়েক হাজার বছরের পরিক্রমায় সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি ক্রমাগত সংশ্লেষ্ণণ-বিভাজনের প্রকৃয়ায় গোষ্ঠীগত ক্ষমতা বা রাজনীতি ও ধর্ম পাশাপাশি থেকে ব্যক্তির আত্ম-পরিচয় দিয়েছে। বর্তমানকালে এদের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে (এবং হচ্ছে) আরো নানা ‘প্যারামিটার’, যেমন- গায়ের বর্ণ, জাতি-স্বত্তা, লিংগ, যৌণতা, ইত্যাদি।
উপরে যেসব ‘প্যারামিটার’ এর কথা বললাম সেগুলো বৃহত্তর পরিসরে একাই ব্যক্তির আত্ম-পরিচয় নির্ধারণে সক্ষম। এখান থেকে ক্রমশঃ স্বল্প পরিসরে ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারিত হয় আরও একাধিক ‘প্যারামিটার’ এর সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, আমি একজন পুরুষ, বাদামী (পশ্চিমা’রা এভাবেই বলে), মুসলিম, বাংলাদেশী-বাঙ্গালী। এরপরেও আরো কিছু ‘প্যারামিটার’ এসে যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার সাময়িক পরিচিতির নির্ধারক হিসেবে, যেমন, সুশ্রী-সুঠাম দেহের অবিবাহিত ( :shy: ), ভদ্রলোক, আমেরিকায় পিএইচডি অধ্যয়ণরত ( B-) ), বড়দের প্রতি বিনয়ী আর ছোটোদের প্রতি স্নেহময়, (নিজের গুনের কথা কি গুণে শেষ করা যায়?) ইত্যাদি।
ব্যক্তির আত্ম-পরিচয় প্রকৃতপক্ষে নিয়ত পরিবর্তনশীল, যদিও ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বৃহত্তর পরিসরে তা ক্রমশঃ ধীর। আমরা সর্বদা আমাদের আত্ম-পরিচয় নির্মাণ ও বিনির্মাণে রত। আর এই ‘আত্ম-পরিচয় নির্মাণ ও বিনির্মাণ প্রক্রিয়া’র প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে আমাদের কাছে পারস্পরিক সহনশীলতার বিষয়টা সহজ হয়ে ধরা দেয়।
আমাদের ‘পারস্পরিক সহনশীলতা’ মূলত জন্ম নেয় আত্ম-পরিচয় নিয়ে আমাদের আংশিক উপলব্ধির কারণে, যা থেকে উদ্ভূত দন্দ্ব, সংঘাত, দলাদলি থেকে ইদানিংকার সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে যুদ্ধ। আমরা কখন ‘পারস্পরিক সহনশীলতা’ হারিয়ে হিংসাত্বক হই?- যখন দেখি আমাদের আত্ম-পরিচয়ে আঘাত আসে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি আমাকে সাম্রাজ্যবাদী বলে, বা মৌলবাদী বলে, বা রাজাকার বলে, বা চরিত্রহীন বলে, তাহলে আমি সাথে সাথেই তা প্রতিহত করার চেষ্টা করি (খেয়াল করুন, পরিচয়ের পরিসর বড় থেকে ছোট)।নিজের কার্যকলাপের নানা তথ্য যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে উপস্থাপনপূর্বক আমি আমার একটা গ্রহনযোগ্য পরিচিতি প্রমাণের চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে সফল হলে তো সমস্যা মিটে গেল। কিন্তু যদি ব্যর্থ হই, তাহলে যথাসাধ্য বল-প্রয়োগ-পূর্বক তা অর্জন করার চেস্টা করি। এখানে এসেই শুরু হয় সংঘাত।
(চলবে)
রংপুর ট্যাগ দাও,
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ব্যাপারটা এখানেই। সহমত।
কেউ আমার উপর 'বিশেষণ' আরোপ করলেই আমি প্রতিবাদী/প্রতিক্রিয়াশীল/অধৈর্য/আত্মরক্ষক হয়ে উঠি, অন্যথায় আমরা সবাই মিলে হাসি-খুশি আয়নিক বন্ধন।
হুম, বুজলাম। :-B :-B
লাবলু ভাই, নতুন অ্যান্টেনা কিনুম ট্যাকা দ্যান। 😀 😀
সিরিকাস:
এই কথাটাই বাকিটা বলে দেয়, সেজন্য পার্সোনালি আমি এই সব আড্ডায় অংশ নেয়া এক্কেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছি।
ডার্ক নাইটের একটা ডায়লগ মনে আসতেছে, "what happens if an unstoppable force meats an immovable object?"
এটা একটা উদাহরণ, আমার প্রকৃত অবস্থান নয়।তাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পয়লা ক্লাস থেকেই মারামারি শুরু করে দিতাম...। 😛
হাঁসের ছানা, তুমি নির্ভয়ে আমার সাথে আলোচনায় অংশ নিতে পার।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
সরাসরি প্রিয়তে। প্রথমে ভাবছিলাম আপনার সাবজেক্ট বোধহয় সাইকোলজি, এখন দেখি সমাজবিজ্ঞান। সিসির বৈচিত্র বাড়ছেই। খুব ভালো লাগছে, পরেরগুলার জন্য অপেক্ষায় রইলাম। 🙂
অফটপিকঃ আমাদের ইউনিভার্সিটিতে সিলেটের একজন ৮৮ সালে বের হওয়া ভাইয়া ছিল। রসায়নে পি এইচ ডি করতেন। উনি বিয়ে করছে ২০০৮ সালে। সুতরাং চিন্তা কইরেন না। ক্যাডেটদের বউয়ের অভাব হয় না। 😛
নিয়মিত পড়ব। বিষয়টাই খুব পছন্দের। আত্ম পরিচয় সন্ধান এবং সেই পরিচয় রক্ষা করার কাজটাই মানুষ সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে করে, সহমত।
তবে আমি সমাজবিজ্ঞানের চেয়ে দর্শনের উপর বেশী আগ্রহী। কারণ সমাজবিজ্ঞান আমাকে একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে ফেলে দিয়ে একেবারে টিপিক্যাল করে দেয়। আর দর্শন আমাকে স্পেশাল করার চেষ্টা চালায়। আত্মপরিচয় সন্ধানের জন্য তাই দর্শনের বিকল্প নেই। সমাজবিজ্ঞান দিয়ে বোধহয় কেবল, কে কিভাবে সন্ধানটা করছে তা জানা যায়। তাও সবারটা জানা যায় না। কারণ, সমাজবিজ্ঞানের সাবজেক্ট হল একটা গোষ্ঠী বা সমাজ। কিন্তু সেই গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যতিক্রম থাকেই। ব্যতিক্রমটা সমাজবিজ্ঞানের বিষয় না মনে হয়।
অর্থাৎ আমি সমাজবিজ্ঞানের জন্য একটি সাবজেক্ট (গবেষণার বস্তু), আর দর্শন আমার জন্য একটি সাবজেক্ট।
কিন্তু সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ আছে। দর্শনের পরেই। বিশেষত নৃবিজ্ঞানের উপর খুব আগ্রহী ছিলাম। নৃবিজ্ঞান আমার অন্যতম প্রিয় বিষয়। যদিও জানি কখনও এসব বিষয়ে পড়তে পারব না, কারণ বড় হয়ে মিস্ত্রি হতে হবে। আপনাকে হিংসা হচ্ছে ভাই! 🙂
"কারণ সমাজবিজ্ঞান আমাকে একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে ফেলে দিয়ে একেবারে টিপিক্যাল করে দেয়। আর দর্শন আমাকে স্পেশাল করার চেষ্টা চালায়। আত্মপরিচয় সন্ধানের জন্য তাই দর্শনের বিকল্প নেই।"-
কঠিন অবকারভেশন। পুরাটার সাথে একমত।
আমি আপাদমস্তক 'জ্ঞানের কম্পার্টমেন্টালাইজেশনে'র বিরূদ্ধে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
অবজারভেশন :bash:
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আমি সমাজ বা দর্শনের ছাত্র না। কিন্তু আমার নিজের একটা দর্শন আছে। আর তার প্রেক্ষিতে বলছি। দর্শন হলো মানুষের দেখা বিষয় গুলু পারসিভ করা।( পারসেপ্সনের বাংলা অর্থ জানিনা) আমার মতে সবচেয়ে আগে আসে আমরা মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব এই আত্নপরিচয় এরপর আশে শেকড় অর্থাৎ বাবা মা।বাকীগুলু প্রয়োজনের তাগিদে আস্তে পারে কিন্তু কখনই প্রধান হতে পারেনা।
সারোয়ার ভাই,
আপনার সাথে আমিও একমত যে, সবার আগে আমরা 'মানুষ'। এই অনুমান'টা ধরে নিয়েই আমার তর্কেই অবতারনা।
'মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব'- সবাই এখান থেকেই শুরু করে। কিন্তু এর পরেই শুরু হয় 'আত্ম-পরিচয়ের রাজনীতি' যেখানে মানূষ নতুন নতুন 'প্যারামিটার' উদ্ভাবন করে নিজেকে বিশিষ্ট করে তোলার চেষ্টায় রত হয়।
“বাকীগুলু প্রয়োজনের তাগিদে আস্তে পারে কিন্তু কখনই প্রধান হতে পারেনা।”-
বস, আমার বোধ ঠিক উলটা, বাকিগুলাই প্রধান……
কেন, তা পরের কিস্তিতে বলার চেষ্টা করব।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
ভালো ভাবনা। আমি বলি নিজেকে খোঁজা, খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। এই সন্ধান আমাদের চলতেই থাকে। আমৃত্যু।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
হ ভাইয়া, ঠিকই কইছেন। এরিষ্টটল বসেও এই কথাই কয়া গেছে 'নিজেরে জানো'।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
know thyself.
আমাদের ফর্মে লেখা থাকতো । মাহমুদ ভাই এর লাখা ভাল লেগেছে । আমরা সবাই মনে হয় নিজেকে খুঁজে ফিরি । আমার ব্যক্তিগত ধারনা হচ্ছে আমরা সবাই একটা বিশাল ল্যাব এর টেস্ট সাবজেক্ট । আপনার লেখা অবশ্যই আমাকে অনেক চিনতার বিষয় দিবে । পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় ।
ওই মাহমুদ, তুমি কি সমাজ বিজ্ঞানী নাকি? খাইছে আমারে। তুমি আমাগো অই পিচ্চি মাহমুদ না।
লেখাটা কালকে একবার পড়েছিলাম, কমেন্ট করার মত কিছু পাইনি, আজকে আবার ঢুকে দেখি বস বস পাব্লিক কমেন্ট করছে মেলা, আমিও কমেন্ট করতে চাইছি, কিন্তু তুমি "চলবে" লিখছ দেখে চেপে গেলাম। তোমার কথা তো শেষ হয় নাই......... কি কমু B-)
তয় এ পর্যন্ত যা কইছ ভালই কইছ।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
:thumbup: ভাল লাগছে, চলুক আলোচনা