দ্রষ্টব্যঃ এই পোষ্টটি আমার আগের একটি পোষ্টের ফলো-আপ। এখানে আমি ঐ পোষ্টের মূল বক্তব্যের সাথে পাঠকের কমেণ্ট থেকে কিছু সংযোজন করে আমার বক্তব্যকে আরো স্পষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছি। আশা করি সবার ভালো লাগবে।
বিশেষজ্ঞ জ্ঞান সম্পর্কে মিশেল ফুকো’র (Foucault) ‘Disciplne and Punish’ চিন্তার জগতে একটা আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই। ফুকো’র মূল কথাটা কি ছিলো?- ফুকো আধূনিক ইউরোপে বিচারব্যবস্থার মানবিকীকরণের (যেমন, মৃত্যুদন্ডের তুলনায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড)প্রক্রিয়ায় জেলখানার ভিতরে এবং সেখান থেকে সমাজজীবনে ক্ষমতার রুপান্তরের বিশ্লেষণ মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের স্বরূপ উৎঘাটন করেছেন।
ফুকো’র আলোচনার শুরুটা ছিলো নিতান্তই নিরীহ একটা প্রশ্ন দিয়ে যে, জেলখানা যদি অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে, তাহলে জেলখানার প্রকৃত কাজ হবে ক্রমাগতভাবে অপরাধ কমিয়ে ফেলা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ঘটে ঠিক এর উলটো, অর্থ্যাৎ জেলখানার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে অপরাধ আইন ও অপরাধীর সংখ্যা, কাজেই আরো বাড়ে জেলখানার সংখ্যা, আরো আইন, আরো জেলখানা।- এভাবে চক্রাকারে চলতে থাকে এই প্রক্রিয়া। এখানে থেকে ফুকো নতুন এক প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, অপরাধ দমনে জেলখানার এই অনন্ত ব্যর্থতার পরেও কেনো জেলখানার এই রূপ/কাঠামো না বদলিয়ে আরো বেশি বেশি করে একই রকম জেলখানা তৈরী করা হয়? জেলখানা বা শাস্তির প্রক্রিয়া ভালো না খারাপ সেদিকে না গিয়ে ফুকো জানতে চাইলেন জেলখানার এই ক্রমাগত ব্যর্থতার বাস্তব (empirical) ফলাফলটা কি? ফুকো তার এই বইটাতে ইউরোপের আধূনিক জেলখানা’র (panopticon) গঠনের সাথে Disciplinary control এর যোগসূত্র দেখেছেন।এই জেলখানার প্রধান গঠনগত বৈশিষ্ট্য হলো- এর কুঠুরিগুলো ধাপে ধাপে নিচ থেকে উপরে অবস্থান করে। আর সবার উপরে থাকে ওয়াচ-টাওয়ার, সেখান থেকে পাহাড়াদাররা কয়েদীদের উপর নজরদারি করে। কোনো কয়েদী সামান্য এদিক-সেদিক করলেই সে ধরা পড়ে, এবং অবধারিতভাবেই তার জন্য বরাদ্দ হয় কঠোর শাস্তি। কাজে কাজেই, সকল কয়েদীর মধ্যেই এই ধারণা জন্মে যে, তারা সর্বদা নজরদারিতে থাকে। কয়েদীদের মনে এই যে ধারণা, এর থেকেই উৎসারিত হয় ক্ষমতার নতুন এক রূপ। ওয়াচ-টাওয়ারে পাহাড়াদার থাকুক আর নাই থাকুক, কয়েদীরা নিজ দায়িত্বে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রন করা শুরু করে। সম্ভাব্য শাস্তির ভয়ে কয়েদীদের এই যে আত্ম-নিয়ন্ত্রন, তা কোনো ব্যক্তি-বিশেষের ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পন নয়, তা’ হলো নতুন এক ধরণের ক্ষমতার কাছে যা’র নিয়ন্তা সমাজের একটা বিশেষ প্রতিষ্ঠান (জেলখানা)।
ক্ষমতাসীনরা দেখল যে, এ তো ভারী সুবিধাজনক। অল্প খরচে, স্বল্প লোকবলের সাহায্যে মোটামুটি নির্বিঘ্নে অনেক সংখ্যক মানুষকে নিয়ন্ত্রন করা যায় এই ‘ডিসিপ্লিনারী কন্ট্রোল’ সিস্টেমে। এখান থেকেই শুরু অপরাধ দমনের বদলে অপরাধী নিয়ন্ত্রনের কৌশলের। কিন্তু শুরুতে জেলখানার কাঠামো মূখ্য ভূমিকা রাখলেও এরপর প্রধান হয়ে দাড়ায় অপরাধ আইন, আইনী প্রক্রিয়া, আদালত, পুলিশ, ইত্যাদি। এসব কিছু মিলেই গড়ে ওঠে ‘পেনাল সিস্টেম’ যা সমাজের সমস্ত মানুষের মধ্যে নির্দিষ্ট আইনের আওতায় বিশেষ বিশেষ কাজকে অপরাধ বলে গণ্য+মান্য করতে বাধ্য করে। নতুন নতুন আইন ও এর প্রয়োগের প্রতি সাধারণ মানুষের এই যে বশ্যতা, তা আপাতঃদৃষ্টিতে সর্বসম্মতিক্রমে দেখা গেলেও আদতে তা জোরপূর্বক আদায় করা হয়। তবে এই জোর ব্যক্তির শারিরীক শক্তি থেকে আসে না, আসে বিশেষজ্ঞের মুখ থেকে উচ্চারিত ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ এর তকমা নিয়ে। বিশেষজ্ঞ জ্ঞানকে “বিশেষ” হয়ে ওঠার জন্য কিছু নীতি-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে নেওয়া হয়; যেমন, জ্ঞান উৎপাদন (generate) ও মূল্যায়নের কিছু সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ, জ্ঞান উৎপাদনের পদ্ধতিসমূহের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যাক্তিকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকর্তিক আনুষ্ঠানিকভাবে বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি দান, এবং এই বিশেষ জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত কিছু নির্দিষ্ট চর্চা (practice) কে সমাজে বৈধ হিসেবে প্রচলন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ডাক্তারের কথা।
কিছু নির্দিষ্ট নিয়ন-কানূনের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তারি বিদ্যা উৎপাদন করা হয় যা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। মেডিক্যাল কলেজে নানা আনুষ্ঠানিকতার শেষে কিছু ব্যক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে আসে, এবং তারা রোগীর দেহে তাদের ইচ্ছেমতো কাটাছেঁড়া করতে পারে, এমনকি তা রোগী এবং অন্যদের কাছে আপাতঃদৃষ্টিতে অনর্থক মনে হলেও। তারপরেও আমরা এটা মেনে নেই, কারণ ডাক্তার সেই বিষয়টা’তে সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি জানেন বলে স্বীকৃত। পাশাপাশি এটাও ধরে নেই যে, ডাক্তার যা করছেন, তা রোগীর ভালোর জন্যই (কারণ, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মানবিক!)। এভাবে ডাক্তার হয়ে ওঠেন রোগীদেহের উপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এই ক্ষমতা আসছে ডাক্তারের বিশেষ জ্ঞান হতে। একারণে ফুকো এই একে বলেছেন “পাওয়ার/নলেজ”, যেখানে পাওয়ার ও নলেজ একে অপরকে signify করে।
জ্ঞান চর্চার এই আধূনিক প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবার মধ্যে দিয়ে সূত্রপাত হয় জ্ঞানের বিশেষায়নের, যা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের জন্ম দেয়, যেমন আইনবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, ইত্যাদি। একই সাথে এই প্রক্রিয়া আরেকটা কাজ করে, তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান চর্চার পরিধির বাইরে যাবতীয় জ্ঞান কে অবৈজ্ঞানিক, কাজে কাজেই পরিত্যাজ্য ঘোষণা করে। এখানেই শুরু হয় বিশেষজ্ঞ তথা বুদ্ধিজীবির আত্ম-পরিচয়ের রাজনীতি, যেখানে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ দল নিজ নিজ বয়ান (narrative) নিয়ে হাজির হয়+তা’র স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে তাদের বয়ানের যথার্থতা প্রমাণে ব্রতী হয়। নিজ নিজ দলের জ্ঞানের তাৎপর্য ছাড়াও এর উৎপাদন পদ্ধতি, প্রাতিষ্ঠনিক মর্যাদা, অন্যদের স্বীকৃতি, ইত্যাদি বিষয়ে নানান বিতর্ক শেষে কোন এক দলের বয়ান, তথা জ্ঞান গ্রহনযোগ্য বলে গৃহীত হয় (enters the Discourse), বাকিরা marginalized হয়ে সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, মিথ ইত্যাদি নাম নিয়ে জ্ঞানের জগত থেকে বিতারিত হয়।
এই যে জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি, তা কিন্তু শুধুই জ্ঞানের গভীরতার দ্বারা নির্ণীত নয়। এখানে অনিবার্য ভাবেই এসে যায় ক্ষমতা। এই ক্ষমতাও কোনো ব্যক্তি হতে নয়, আসে কিছু নৈর্ব্যক্তিক উৎস থেকে, যেমন, রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয়, চার্চ, প্রভাবশালীদের সংঘ, ইত্যাদি ত্থেকে। এইসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেয়। বিনিময়ে এই বিশেষ জ্ঞান সেইসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বকে সমুন্নত করে। এভাবে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা হাতে হাত ধরে চলে। ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান যেমন বিশেষজ্ঞের জ্ঞানকে ব্যবহার করে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখে, তেমনি সেইসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞও হয়ে ওঠে ক্ষমতাবান। এই ক্ষমতাও প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার মতো নৈর্ব্যক্তিক। এটা আসে কতিপয় বিশেষজ্ঞের একটা নির্দিষ্ট দলের সমন্বিত প্রয়াসে। আর এই ক্ষমতার উৎস হল বিশেষজ্ঞের দিক থেকে a generalized will to pwoer, যা’ মূর্ত হয় সমন্বিতভাবে তাদের সকলের ‘ability and/or possibility of being able to speak the truth’-এই দাবিতে।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, এই পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ তার মতামতকে আর জ্ঞান বলেন না, বলেন সত্য। কিছু নির্ধারিত রীতিনীতি+ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় ও প্রশ্রয়+শাসনযন্ত্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় একটা বিশেষ দলের একটা বিশেষ সময় ও প্রেক্ষিতে কোন বিশেষ বিষয়ের “”বিশেষ জ্ঞান”” হয়ে ওঠে “সাধারন জ্ঞান”।
ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় তারা এই সাধারণ জ্ঞানকেই সত্য বলে চালিয়ে দেয়, চাপিয়ে দেয় সকলের উপর। পাঠশালা আর পাঠ্যক্রমের যাতাকলের মাঝ দিয়ে শুধু বের হয়ে আসে কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সনদধারি কতিপয় বিশেষজ্ঞ, যারা কোন ডিসিপ্লিনের একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে স্পেশালাইজেশন করে আসলেও বনে যান সেই ডিসিপ্লিনের সামগ্রিক জ্ঞানের গ্রহনযোগ্য একমাত্র মুখপাত্র। অন্যদিকে সেই ডিসিপ্লিনেরই কোন কোন বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা সত্বেও শুধু প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের সনদ না থাকায় বাকিরা হয়ে থাকেন অশিক্ষিত, কাজে কাজেই অপাংক্তেয়।
২০০০ সালের দিকে বাউল করীম শাহের বক্তৃতা শুনেছিলাম ঢাবি’র এক ছোট্ট প্রোগ্রামে। এখনো মাঝে মাঝে মনে হয় জ্ঞানের
পথ ও পাথেয় নিয়ে তেমন গভীর আর কোন বক্তৃতা শোনা হয়নি। নানা জায়গায় নানা পাঠ্যক্রম আর আলোচনার মাঝে কবেই হারিয়ে গেছে করীম শাহের সেই সব কথা। কিন্তু অধ্যাপক আমিনুলের গাইডবই-গোত্রীয় পাশ্চাত্যের দর্শন বিষয়ক বইটা এখন জ্ঞানের আধারই বটে। লালন এবং অন্যান্য বাউলরা প্রতিনিয়ত দর্শনের মূল ধরে নাড়া দিয়ে গেলেও তা সনদের অভাবে জ্ঞান হয়ে উঠতে পারে না, লোকায়ত সংস্কৃতির পরিচয়ে আড়ালে থেকে যায়। বিশেষজ্ঞের জ্ঞানের সত্য হয়ে ওঠার প্রয়াস এক পর্যায়ে এতোটাই জোড়ালো হয়ে ওঠে যে, তা সাধারন মানুষের নিজেদের সম্পর্কে জানার থেকেও বেশি জ্ঞান দাবি করে বসে (as if the specialists know people better than the people themselves)। এই পর্যায়েই বিশেষ জ্ঞানের সাম্রাজ্যবাদ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। যেমন, ডাক্তার দাবি করেন যে তিনি রোগীর অনুভব রোগীর থেকেও বেশি বোঝেন, সাইকিয়াট্রিস্ট মনোঃবৈকল্যের রোগীর সমস্যা তার থেকেও বেশি জানেন, বা সমাজ সংস্কারক সেমসেক্স বিষয়ে সেমসেক্স কাপলদের থেকেও বেশি জানেন।
এডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইয়ে ফূকোর এই তত্ত্বের প্রয়োগ করে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কিভাবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে একটা বিশেষ ধরণের জ্ঞান উৎপাদন করে যা অধিকৃত বিশ্বের উপর পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদকে স্বাভাবিক হিসেবে বৈধতা দেয়, ঠিক যেভাবে ডাক্তারী জ্ঞান রোগীর শরীরের উপর ডাক্তারের ক্ষমতার বৈধতা দেয়। ডাক্তারের মতোই ওরিয়েন্টালিজম জাস্টিফাই করে যে প্রাচ্যের ভালোর জন্যই পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদ! সাঈদ সুনির্দিষ্ট করে দেখিয়েছেন কি কি প্রাতিষ্ঠানিক রীতি, কোন কোন প্রতিষ্ঠান, কোন কোন বিশেষজ্ঞ, আর কি কি ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে “ওরিয়েন্টালিজম” জন্ম+বিকাশ লাভ করেছে। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একটা বিশেষ ধরনের সিস্টেমের মধ্য দিয়ে প্রাচ্য-বিষয়ে এখানকার লোকেদের থেকে পাশ্চাত্যের বিশেষজ্ঞ বেশি জানেন বলে দাবি প্রতিষ্ঠা করেন, কিভাবে আধূনিক শিক্ষা আর মনবতাবাদি খোলসের আড়ালে থেকে প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞরা পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদকেই বৈধতা দিয়েই চলেছে।
যে জ্ঞান মানুষ বিনা বাক্যে/প্রশ্নে মেনে নেয়/গ্রহন করে/অনুসরণ করে (অর্থ্যাৎ,সাধারণ জ্ঞান) তা’কে তত্ত্বীয় পরিমন্ডলে বলা হয় “হেজেমনি”। গ্রামসি মার্ক্সের শ্রেণী-সংঘাতের তত্ত্ব থেকে এই কনসেপ্ট নির্মাণ করেছেন। এর দ্বারা গ্রামসি এমন জ্ঞানকে বুঝিয়েছেন, যা মানুষ বিনা প্রশ্নে সত্য/সঠিক/স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়। ফুকো যেখানে এই জ্ঞানকে ব্যক্তি+প্রতিষ্ঠানের একটা সামগ্রিক প্রেক্ষিতে দেখেছেন, গ্রামসি সেখানে এটি শ্রেনী-মতাদর্শের আলোকে বিচার করেছেন। বিশেষ কোন মতাদর্শকে এই পর্যায়ে আসতে হলে তা’কে অনিবার্য ভাবেই শ্রেণী-বিভাজিত সমাজের বিদ্যমান জ্ঞান-কাঠামো’র (Discourse) মধ্যে প্রচলিত অন্যান্য মতাদর্শের সাথে সংগ্রাম করে তবেই আসতে হয়। যেমন, ইউরোপে জাতীয়তাবাদকে প্রায় তিনশ বছরের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ধর্মের আশ্রয়ে থাকা সামন্তবাদকে পরাজিত করে আসতে হয়েছে। আবার জাতীয়তাবাদের নানা ধারাও একে অপরকে পরাজিত করেই এগিয়ে চলে। যেমন, পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ থেকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। আর, যখন যে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, সমাজের সকলে সেটাকে সাধারণ জ্ঞান হিসেবে বরণ করে নেয়। কিন্তু অন্য মতাদর্শের সাথে সংগ্রামে জয়ী হতে না পারলে তা আর সাধারন জ্ঞানের স্তরে আসতে পারেনা। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের জাতীয়তাবাদকে আমরা পাত্তা দেই না, কারণ তা’ পর্যাপ্ত ক্ষমতার অভাবে এখনো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মোকাবেলায় নিজের স্বকীয়তা প্রমান করতে পারেনি।
গ্রামসির মতে, ক্ষমতায় থাকা শ্রেণী তাদের মতাদর্শকে সাধারণ জ্ঞানের স্তরে নিয়ে আসার জন্য দুই ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার আশ্রয় নেয়; এক, রাজনৈতিক (Political) প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন আর্মি, পুলিস, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি যাদের লক্ষ্য সরাসরি দমন (Domination)। এইসব প্রতিষ্ঠান শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের বশ্যতা (compliance) আদায় করে এবং এই শক্তি প্রয়োগ ঘটে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই (যদিও এরা বাস্তবে প্রায়শঃই সংবিধান লংঘন করে)। দুই, নাগরিক (Civil) প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন বিদ্যালয়, পরিবার, সংগঠন, ইত্যাদি যারা জনগণের সম্মতি (consent) আদায় করে ঘুর পথে, সাধারণ জ্ঞানকে একটা নির্দিষ্ট দিকে চালিত করার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সরাসরি শক্তি প্রয়োগ না করে জনগণের চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে তাদের মতামতকে নির্দিষ্ট পথে চালিত করে। যেমন- আমাদের দেশে রাজনৈতিক মিছিল নিয়ন্ত্রণ পুলিশ-বিডিআর রাস্তায় সরাসরি শক্তি প্রয়োগ করে যা’কে নাগরিকদের দ্বিমত করার অধিকারকে ক্ষুন্ন করে, কিন্তু তা সত্বেও আমরা মেনে নিই কারণ তা আইনের মারপ্যাচের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যথার্থ হিসেবে দেখাতে পারে। আবার সরকার শত শত নাগরিককে কর্মচ্যুত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানার শিল্প প্রতিষ্ঠান বেচে দেওয়ায় অসংখ্য পরিবার পথে বসলেও আমরা তা মেনে নিই, কারণ নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলো (পাঠ্য-পুস্তক, মিডিয়া, ইত্যাদি) ‘সরকারী মালিকানা ক্ষতিকর’ এই ধারণাটা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সরাসরি কোন শক্তি প্রয়োগ করে না, শুধু আমাদের চিন্তাধারাকে একটা বিশেষ দিকে চালিত করে।
তৌফিক (১৯৯৬-২০০২)ঃ ক্ষুদ্রঋণ কিভাবে আমাদের সাধারণ জ্ঞানের অংশ হয়ে ওঠেছে? এখানে ক্ষমতার রূপটাই বা কি?
উত্তরঃ খুবই প্রাসঙ্গিক বিষয়। গ্রামীন ক্ষুদ্রঋণ এখন শুধু আমাদের দেশে নয়, বরং প্রায় সারা বিশ্বেই মানুষের সাধারণ জ্ঞানের অংশ হয়ে উঠেছে। অর্থ্যাৎ সকলেই বিশ্বাস করে যে ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র মানুষকে ‘বিনা জামানতে’ ছোট কিন্তু কার্যকরী ঋণ প্রদান করে যা’র মাধ্যমে তারা দারিদ্র্যমুক্ত হয়। এই জ্ঞান এতোটাই স্বাভাবিক হিসেবে গৃহীত যে কেউ জানতেও চায় না ক্ষুদ্রঋণের প্রকৃত শর্তগুলো কি কি, সুদের হার কতো, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা কি কি কাজে ঋণের অর্থ ব্যয় করে, কি উপায়ে ঋণের কিস্তি প্রদান করে, ঋণ পরিশোধের পর তাদের আর্থিক অবস্থা কেমন হয়, ইত্যাদি যা’র সবগুলোই ক্ষুদ্রঋণের ফলাফল অনুধাবনে অত্যাবশ্যক।
এখানে প্রশ্ন এসে যায় যে, কিভাবে ক্ষুদ্রঋণ আমাদের মনে এইরূপ সত্যজ্ঞান হিসেবে জায়গা করে নিল যে আমরা যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই তা’ বিশ্বাস করি? এটি সম্ভব হয়েছে মূলতঃ নাগরিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্রমাগত প্রচারে, সেই সাথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রত্যক্ষ সমর্থনে। এই বিষয়টা বোঝার জন্য আমাদের লক্ষ্য করতে হবে কোন সময়ের প্রেক্ষিতে ক্ষুদ্রঋণের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের অবাধ প্রসার শুরু হয়। সেই সময় ১৯৯১/৯২ সালে মিডিয়াতে বাংলাদেশকে ‘ইমার্জিং টাইগার’ হিসেবে ব্যাপক প্রচার দেওয়া হয় এই বলে যে, বাংলাদেশ মুক্তবাজার ব্যবস্থা অনুসরণ করলে অচিরেই পূর্ব-এশিয়ায় দেশগুলোর মতো উন্নত হবে! ফ্রী-ফ্লোটিং মুদ্রানীতি, শেয়ার বাজার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারী মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া, শিক্ষা-স্বাস্থ সহ অন্যান্য সামাজিক খাতে রাষ্ট্রের সহযোগিতা হ্রাস, ইত্যাদি তথা আইএমএফ+বিশ্বব্যাংক+এডিবি’র অর্থনৈতিক কাঠামোগত সংস্কারের প্যাকেজ চাপিয়ে দেওয়া হয় উন্নয়নের আশ্বাসে। এই সময় আমাদের নাগরিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তথা পরিবার, বিদ্যালয়, মিডিয়া, সংগঠন ইত্যাদিতেও উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন আসে। সেগুলোর কতগুলো নিম্নরূপঃ
১। যৌথ পরিবাবের স্থলে একক পরিবারের ব্যাপক বিস্তার এবং মহিলাদের আয় উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি। একক পরিবারকে নারী-স্বাধীনতার জন্য সহায়ক এবং নারীর উপার্জনকে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অপরিহার্য হিসেবে গ্রহন করা।
২। বিদ্যালয়ের সংগঠন, পাঠ্যক্রম, পরিচালনা, ইত্যাদিতে মৌলিক পরিবর্তন, যেমন- মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে নারী শিক্ষা, অভিভাবকদের ভোটের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদ গঠন, ছাত্রছাত্রীদের উপর শিক্ষকদের আচরণে নিয়ন্ত্রন ইত্যাদি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে পাঠ্যক্রমে- সামষ্টিক মূল্যবোধের জায়গায় নিয়ে আসা হয় ব্যক্তি-অধিকার, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তি-মালিকানা ইত্যাদি। ফলে ‘একতাই বল’, ‘দশের লাঠি একের বোঝা’, ‘সোনার হরফে লেখা নাম’, ‘টাকার মেশিন’, ‘পন্ডিত মশাই’ ইত্যাদি গল্প পাঠ্যক্রম থেকে হারিয়ে যায়।
৩। মিডিয়াতে ব্যক্তিগত সাফল্যের সাড়ম্বর প্রচারের পাশাপাশি সরকারী প্রতিষ্ঠানের দূর্নীতি+অদক্ষতা, সরকারী প্রতিষ্ঠানের দূর্বলতাগুলো পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের সাফল্য+সম্ভাবনার দিকটা প্রচার করা।
৪। জাতীয় সমবায় আন্দোলনে ভাটা পড়ে, আর সেই শূন্যস্থানে গড়ে ওঠে শত শত এনজিও প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বিনামূল্যে সমাজসেবার জায়গায় আসে স্বল্পমূল্যের এনজিও সেবা কর্মসূচী।
-এইরূপ সামাজিক প্রেক্ষিতে নাগরিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে আমাদের সাধারণ জ্ঞানকে এমন অবস্থানে নিয়ে আসা হয় যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী শিক্ষা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ইত্যাদি উন্নয়ন তথা আধূনিকতার সমার্থক হয়ে দেখে দেয়। আর এইসবের বিকাশে সরকারী বা সমবায়ভিত্তিক যৌথ উদ্যোগের স্থলে এনজিও পরিচালিত (Guided, not directed) ব্যক্তিগত উদ্যোগকে যথার্থ+অপরিহার্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি হল একটা সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যখন ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে সাধারণ জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত হয়। এই বিষয়টি আরো পরিস্কার হয় ক্ষুদ্রঋণের ইতিহাসের দিকে তাকালে।
ক্ষুদ্রঋণ আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের কাবুলিওয়ালাও ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা করতো। তার আগে পরে আরো অনেকেই ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা করেছে যাদেরকে বলা হয় ‘মহাজন’ আর তাদের এই ব্যবসাকে বলা হয় ‘দাদন’। তারা সেটা করেছে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং সরকারের বিরোধীতার মুখে (দাদন ব্যবসা আইনত দন্ডনীয়)। কিন্তু এখন সেই একই ব্যবসা এনজিওদের জন্য আইনসিদ্ধ (গ্রামীন অধ্যাদেশ, ১৯৮৪)! উল্লেখ্য, এই আইন এসেছে স্বৈরশাসকের কাছ থেকে, কোন গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে নয়।
এই বিষয়টা আবারো পরিস্কার হয় ক্ষুদ্রঋণ এবং এই মডেলের প্রবক্তা ডঃ ইউনূসের প্রাপ্ত পুরস্কারসমূহের সময়কাল এবং পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থাগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে। ফিলিপাইনের ম্যানিলাভিত্তিক ম্যাগসেসে পুরস্কার থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকায় অবস্থিত জাতিসংঘের নানা সংস্থার পুরস্কারগুলো আসা শুরু হয়েছে ১৯৯০-এর কাছাকাছি (আগে+পরে) সময় থেকে। সবথেকে লক্ষ্যনীয় হল, সমাজতান্ত্রিক ব্লক থেকে ক্ষুদ্রঋণের স্বীকৃতি+পুরস্কারের ঘাটতি! অথচ পুঁজিবাদের তুলনায় গরীবের জন্য দরদ/সহানুভূতি সমাজতান্ত্রিকদেরই বেশি হওয়ার কথা।
কোন বিশেষ জ্ঞান সাধারণ জ্ঞানের অংশ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার ভূমিকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয় পর্যায়েই লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রচার করা হয় ক্ষুদ্রঋণের ‘দারিদ্র্যনাশিনী’ ভূমিকার কথা। বিবিধ ডিগ্রীধারী (কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন) এইসব বিশেষজ্ঞের বক্তব্যের বিপরীতে ডিগ্রীহীন (কিন্তু ভূক্তভোগী) ঋণগ্রহীতার বক্তব্য স্বভাবতঃই বিজ্ঞানভিত্তিক তথা গ্রহনযোগ্য জ্ঞান হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। বিশেষজ্ঞের ডিগ্রী হতে আসে একধরণের ক্ষমতা যা’ তার বক্তব্যকে জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে দেয়, আর ঐরূপ ডিগ্রীর অভাবে ঋণগ্রহীতাদের বক্তব্য পরিত্যক্ত হয়। আর প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে রাষ্ট্র ও বৈদেশিক পুঁজির সরাসরি সমর্থনে স্কুল+মিডিয়া+গবেষণা সংস্থাসহ নানা প্রতিষ্ঠান অবিরাম ক্ষুদ্রঋণের সুফল প্রচার করে, আর পাশাপাশি বিরূদ্ধ মতের কন্ঠরোধ করে। যেমন, এই গত মাসে সাপ্তাহিক ২০০০ ছেপেছিল গ্রামীনের হাড়ির খবরের খানিকটা। পরের কিস্তিতেই আবার সম্পাদক শর্তহীন ক্ষমা চেয়েছে গ্রামীনের কাছে। (ক্ষুদ্রঋণের গ্রামসিয়ান বিশ্লেষনের জন্য করীম (২০০৮) একটা দারুন আর্টিক্যাল)।
কামরুল (১৯৯৪-২০০০)ঃ কোন বিশেষ জ্ঞানের সাধারণ জ্ঞান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ‘প্রচারের’ ভূমিকা কি? বিজ্ঞান প্রচার বিমুখ আমার কিন্তু মনে হয় না। বরং বিজ্ঞান প্রচার বিমুখ হলে নতুন নতুন প্রযুক্তি’র উদ্ভাবন ,প্রচার ও প্রসার ঘটছে কি করে?
উত্তরঃ উদ্ভাবন, প্রচার আর প্রসার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া। বেশির ভাগ বৈজ্ঞানিক ‘উদ্ভাবন’ হয়েছে আকস্মিক, টার্গেট করে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিস্কার হয়েছে কি? আর্কিমিডিসের চৌবাচ্চায় নামা, নিউটনের সামনে আপেলের পতন- এসবই দৈব ঘটনা। কিন্তু ‘প্রচার’ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখী; আর এই প্রচারকর্মের সাফল্যই হল ‘প্রসার’। কাজেই জ্ঞান উৎপাদনে প্রচারের ভূমিকা নেই, তবে জ্ঞান প্রসারে আছে। কোন বিশেষ জ্ঞান সাধারণ জ্ঞানের অংশ হয়ে উঠতে প্রচার কার্যের সাফল্য অবশ্যক। একারণেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উদ্ভাবন তথা জ্ঞান উৎপাদনে প্রচারের কোন ভূমিকা নেই।
মুহাম্মদ (১৯৯৯-২০০৫)ঃ কিন্তু প্রচারের মাধ্যমে যারা জ্ঞান প্রচারে নিয়োজিত হয়, তাদের নিজেদের জ্ঞান কি ঝালাই করে নেওয়া হয় না?
উত্তরঃ না। জ্ঞান প্রচারের পর্যায়ে গেলে তা’ মতবাদ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ধারন করে। কারণ, প্রচারযজ্ঞে জ্ঞান উৎপাদনের পূর্বশত ‘পর্যালোচনামূলক উপলব্ধি’ (critical appreciation) অনুপস্থিত। ফলে প্রচার কার্যের মধ্যে নিজের জ্ঞান অন্যদের সাথে শেয়ার করার মাধ্যমে তা’ ঝালাই করে নেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর শেয়ার করলেই জ্ঞান ঝালিয়ে নেওয়া যায় না। এর জন্য অপরপক্ষকেও যথেষ্ট (বেশি, সমান, বা কাছাকাছি, কিন্তু কম নয় একেবারেই) জ্ঞান রাখতে হয়। কিন্তু সব মানুষের যোগ্যতা তো এক রকম নয়, বিশেষ করে আমজনতার। আর জ্ঞান প্রচারের শুরু যে অনুমানের ভিত্তিতে তা হল, জনগণ বিষয়টা জানেনা। তাহলে জনগনের মাঝে প্রচারের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানের শেয়ার, কাজে কাজেই ঝালিয়ে নেওয়া হবে কি করে? কিন্তু প্রচারে কিছু তো হয়ই, সেটা কি? সেটা হলো জন-সাধারনের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি আদায় যে, “বিশেষজ্ঞ যা জানে তোমরা তা জানোনা”।- কিন্তু এটা প্রত্যক্ষে নয়, ঘটে পরোক্ষে। আর জনগণের মাঝে যখন প্রচার হয়ে যায় যে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, তখন তারা
সেই বিশেষজ্ঞের কথা বিনা বাক্যে সঠিক বলে ধরে নেয়, তা’ তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার বিপরীত হলেও। যেমন লালন শাহ সম্পর্কে ডঃ আহমদ শরীফের করা উক্তি যে, ‘লালন ফকির যদি শিক্ষিত হতেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ কবি হতেন।’
– ডঃ আহমদ শরীফ বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত। আর তাই তার করা উক্তিও আমরা অনেকেই কোন প্রকার চিন্তাভাবনা ছাড়াই সঠিক বলে ধরে নিই। এটা ঘটে আমাদের এই ধারণা থেকে যে, ডঃ শরীফ আমাদের থেকে বেশি জ্ঞানী। কাজেই তার পর্যবেক্ষন সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আমাদের পর্যবেক্ষণের চেয়ে বেশি। কিন্তু একটু ভালো করে ভেবে দেখলেই এই উক্তির অসারত্ব প্রতীয়মান হয়। যেমন, রবীন্দ্রনাথকে শিক্ষিত বলা হয়েছে। কিন্তু তার কি কোন ডিগ্রী ছিলো? যদি ডিগ্রী ছাড়াই রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত হিসেবে স্বীকৃত পেয়ে যান, তাহলে ডিগ্রীহীন লালনকে শিক্ষিত বলা হলো না কেন? রবীন্দ্রনাথ আর লালনের মধ্যে পার্থক্য আসলে তাদের ব্যক্তিগত জ্ঞানে নয়, পার্থক্য হচ্ছে ‘কারা+কোথায়’ তাদের ধ্যান-ধারণাগুলোর চর্চা করছে সেইখানে। রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-ধারণা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল ধারার জ্ঞান হিসেবে ব্যাপকভাবে পঠিত, কিন্তু লালনের চর্চা সেই তুলনায় নগণ্য। পাঠ্যবই, সভা-সমিতি, আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্র-স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার বলয়ে সর্বদা উপস্থিত। আর তাই তার ধ্যান-জ্ঞান চর্চা করলে শিক্ষিত হিসেবে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। অন্যদিকে লালনের চর্চা হয় মাঠে-ঘাটে, গাছ তলায়, মুখ্য-সুখ্য মানুষের মাঝে। আর এসবের থেকে কোন সার্টিফিকেটও মিলে না, বড়জোর মিলে ‘বাউল’ উপাধী যা’র মানে সংসারত্যাগী বা অসামাজিক। ফলে লালনের ধ্যান-ধারণায় যথেষ্ট বুৎপত্তি লাভ করলেও কেউ শিক্ষিত হিসেবে স্বীকৃতি পায়না। ফলে অশিক্ষিতের মাঝে থেকে থেকে লালনের ধ্যান-ধারণা এবং লালন নিজেও ‘অশিক্ষিত’ই থেকে যান!
রবীন্দ্রনাথ ও লালনের মাঝে এবং সেই সাথে তাদের ধ্যন-ধারণা চর্চাকারীদের মাঝে এই যে শিক্ষিত/অশিক্ষিতের পার্থক্য, তা আলোচ্য ব্যক্তি বা তাদের থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের কারণে ঘটেনা, ঘটে “প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা”র (Disciplinary Control System) মাধ্যমে যা’র ক্ষমতাই নির্ধারণ করে কোনটা স্বীকৃত জ্ঞান আর কোনটা নয়। এই পার্থক্যকারী ব্যবস্থায় একক ভাবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয় বরং এই দুইয়ের অবিচ্ছেদ্যভাবে সমন্বিত ক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় একধরণের ক্ষমতা যা’কে ফুকো বলেছেন power/knowledge । জ্ঞান প্রচারের মাধ্যমে অনিবার্যভাবে এই power/knowledge এর ব্যাপ্তি+প্রসার ঘটে। ফলে প্রকৃত জ্ঞানচর্চার পথ সঙ্কুচিত হয়ে যা থাকে তা’ এক ধরণের বিশেষ জ্ঞানের আলোচনা যেখানে জ্ঞান উৎপাদনের থেকে অলরেডী উৎপাদিত জ্ঞানের প্রসারই মূল লক্ষ্য হয়ে পড়ে।
কামরুল (১৯৯৪-২০০০)ঃ “এহেন যে নড়বড়ে যে ভাষার গাঁথুনি, তার মাধ্যমে পাওয়া জ্ঞানের কথার আসল অর্থ কতোটা অবিকৃত ভাবে আমরা পাবার আশা করতে পারি? তা’ই নিয়ে কতোটা আত্মবিশ্বাসের সাথে বিতর্কে নামতে পারি?”- দর্শন , সমাজবিজ্ঞান বা সাহিত্যের বেলায় এটা হয়তো সত্যি (তাও আমি নিশ্চিত না), কিন্তু খাটি বিজ্ঞানের বেলায়ও কি? ধরুন নিউটনের তিনটা সুত্র , এ নিয়েও কি আমি আত্ম-বিশ্বাসের সাথে তর্ক করতে পারবো না? নাকি এটাও নড়বড়ে ভাষার গাঁথুনি’র মাধমে পাওয়া জ্ঞান বলে গন্য হবে?
উত্তরঃ খাঁটি বিজ্ঞান আর ভেজাল-বিজ্ঞান (দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য) এর পার্থক্য বইয়ে লেখা থাকে না। কারণ, বইয়ের লেখার মধ্যে অর্থ থাকে না। অর্থ তৈরী হয় পাঠকের মনে/উপলব্ধিতে। এর কারণ, ভাষার সীমাবদ্ধতা। লেখার অক্ষর কেবলমাত্র তখনই অর্থময় হয়ে ওঠে যখন সেই অক্ষরগুলো কোন “মানুষ” পড়ে। ভাষার মাধ্যমে লেনদেনকৃত অর্থ/ভাব আসলে পাঠকেরই সৃষ্টি, ভাষার কোন অবদান নয়। ভাষা কেবলমাত্র মানুষের ভাবের বাহন, অর্থ-উৎপাদনে সক্ষম কোন সিষ্টেম নয়। এই কারণে ‘নিউটনের তিনটা সূত্র’ একই ভাষায় একই রকম অক্ষরে লিখে দেখানো হলেও যেব্যক্তি কোনদিন বিজ্ঞান পড়ে নাই তা’র কাছে সেগুলো অর্থহীন, আর বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে সেগুলো অর্থময় বৈজ্ঞানিক সূত্র।
তবে হ্যাঁ, আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে আলোচনায় নামতেই পারি, কিন্তু তা’ ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তুর জন্য বিভিন্ন মাত্রায় হবে, খাঁটি-বিজ্ঞান/ভেজাল-বিজ্ঞান ভেদে নয় (আসলে বিজ্ঞানে এমন কোন পার্থক্য আমি মানিওনা, বিজ্ঞান শুধুই বিজ্ঞান, তা কাউকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাক বা না-যাক [বিজ্ঞানের সংগা দ্রষ্টব্য])। খুবই পরিচিত (familiar)+দ্ব্যার্থহীন (non-controvarsial) বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে আমরা বেশ উচ্চমাত্রায় আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে পারি, যেমন- ‘কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র তৈরী হয়’। এই বাক্য সবার কাছেই অর্থপূর্ণ। কিন্তু যদি বলি যে, ‘হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিলে পানি উৎপন্ন হয়’, তাহলে তা’ বেশিরভাগের কাছেই অর্থহীন, আজগুবি মনে হবে। এই বাক্যকে অর্থপূর্ণ করতে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক, ল্যাবরেটরীতে ল্যাব এসিষ্টেন্ট আর বাড়িতে প্রাইভেট টিউটরের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় (যারা সকলেই মানুষ); বাক্য নিজে নিজেই অর্থময় হতে পারে না। তারমানে কি দাঁড়ালো?- ভাষার মাধ্যমে যে ভাবের লেনাদেনা, তা’তে ভাষা শুধুই একটা নির্জীব মাধ্যম, এর বেশি কিছু নয়; যা’ কিছু কর্মময়তা (Action) তা’র সবই মানুষের। এই কারণে শ্রোতা ভাষা বা বক্তব্যের বিষয়বস্তুর দিয়ে নয়, প্রভাবিত হয় বক্তা/ব্যাখ্যাকারীর মাধ্যমে। বিষয়বস্তু খাঁটি-বিজ্ঞান বা ভেজাল-বিজ্ঞান তা’তে কিছু যায়-আসে না। ভাষার মধ্যস্থিত গ্যাপের কারণে একই বাক্যের সম্ভাব্য নানা অর্থের মধ্য থেকে শ্রোতারা কোন অর্থটা গ্রহন করবে তা’ নির্ধারিত হয় শ্রোতাদের মাঝে বক্তার সাধারণ পরিচয়ে। এই কারণে উক্তির কিভাবে মূল্যায়ন হবে তা’র বিচারে অনিবার্যভাবেই এসে যায় কে/কারা সেই উক্তি করেছে, কাদের উদ্দেশ্যে করছে, আর বক্তা ও শ্রোতাদের মাঝে সম্পর্কের স্বরূপটাই বা কি। আলোচ্য উক্তির বিষয়বস্তু সেখানে গৌণ, বক্তার পরিচয় এবং শ্রোতার সাথে বক্তার/ব্যাখ্যাকারীর সম্পর্ক মূখ্য।
ব্লগ থেকেই উদাহরণ দেই। (কেউ মাইন্ড করবেন না, প্লিজ। এই নামগুলো উল্লেখ করে আমি ভাষার অক্ষমতাকে আরো স্পষ্ট করার চেষ্টা করছি মাত্র)।- মুহম্মদের সাথে প্রচার+ক্ষমতার আলোচনায় আমার মতের অমিল থেকেই আমি লিখেছিলাম ‘মুহম্মদের প্রশ্নের উত্তরে জ্ঞান, জনপ্রিয় জ্ঞান ও ক্ষমতা নিয়ে আমার ভাবনা’ এই লেখাটি। এখানে লক্ষ্যনীয় যে আমার লেখার মূল বিষয়টা ছিল মুহম্মদের ধারণা অনুযায়ী ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’, সাধারণভাবে বিজ্ঞান আর সুনির্দিষ্ট ভাবে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নয়। কিন্তু মুহম্মদ নিজে, সানাউল্লাহ ভাই, কামরুল আর সোহেল ভাই আমার লেখায় বিজ্ঞান (বা বিবর্তনবাদ) খুঁজলেন। কেন? আমার লেখায় কোথাও ত বিজ্ঞান বা বিবর্তনবাদ আসার কথা নয়। আর ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’ মানে ত বিজ্ঞান বা বিবর্তনবাদ নয় যে ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’ বিষয়ক যেকোন আলোচনা মানেই তা’কে বিজ্ঞানের বা বিবর্তনবাদের আলোচনা ধরে নিতে হবে। তাইলে?- এটা ঘটেছে এই কারণে যে, মুহম্মদ বিবর্তনবাদের একজন একনিষ্ট সমর্থক+আলোচক হিসেবে সিসিবি’তে (সচলায়তনেও) সবার মাঝে ‘বিজ্ঞানমনষ্ক’ বলে পরিচিত। কাজেই ওর ধারণার বিপরীতে যেকোন ধারণাই পাঠকের মধ্যে বিজ্ঞানবিরোধী হিসেবে ‘ধরে-নেওয়া’র প্রবণতা তৈরী হয়ে আছে যা’ অবস্থান ভাষার মধ্যে নয়, বরং ভাষার বাইরে আমাদের পারস্পারিক সম্পর্কের মধ্যে। আবার মুহম্মদকে কেউ কেউ সাধারণভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে জিহাদে সক্রিয় হিসেবে জানেন, যেমন ফয়েজ ভাই। আর তাই তিনি (এবং সম্ভবতঃ তার মতো অন্যান্যরাও) মুহম্মদের সাথে আমার আলোচনার কেন্দ্রে ধর্মকে দেখতে চাইলেন। আবার হোসেন মন্তব্য শুরুই করেছে আমার সাথে দ্বিমতের ঘোষনা দিয়ে যে, ‘খাঁটি বিজ্ঞান’ ক্ষমতামুখী নয়! কিন্তু আমার আলোচনায় ত খাঁটি বিজ্ঞান নাই, ছিল ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’। এহসান ভাই শেষ কমেন্টটায় পুরো বিষয়টা সুন্দরভাবে পরিস্কার করে বলেছেন যে, আমার পোষ্টের শিরোনামটাই ছিল ‘মিস লিডিং’!- তাই কি? আমি ত শিরোনামে যা লিখেছি, তারই আলোচনা করেছি। তাইলে?
আশা করি, ভাষার সাথে শব্দ/বাক্যের অর্থময়তার সম্পর্কে এখন এই দাবী করা যায় যে, শব্দ/বাক্যের অর্থের অবস্থান ভাষার মধ্যে নয়, ভাষায় বাইরে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের জালে (অর্থ্যাৎ, সমাজে)। এই কারণে বাক্যের অর্থ নির্ধারিত হয় আলোচনার বিষয়বস্তু দ্বারা যা আবার আলোচনায়রত ব্যক্তিবর্গের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্ক অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
প্রশ্নঃ বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আর ভাষার এই সীমাব্ধতার সাথে ক্ষমতার কি সম্পর্ক?
উত্তরঃ বিশেষজ্ঞ জ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সত্যিকার অর্থেই সুপিরিয়র জ্ঞান যা’র উপর নির্ভর করা যায়। কিন্তু বাস্তবতার কারণেই সকল মানুষের পক্ষে সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভব নয়। অর্থ্যাৎ, আমাদেরকে নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞের উপর নির্ভর করতেই হয়। এই নির্ভরতা থেকে বিশেষজ্ঞের হাতে এই ধরণের ক্ষমতা চলে আসে যা’কে বলা যায় বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা। আর ভাষার সীমাবদ্ধতা এই বুদ্ধিজীবির এই ক্ষমতাকে তার অনুসারিদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়, অর্থ্যাৎ বিশেষজ্ঞ না হয়েও তা’র নামে অ-বিশেষজ্ঞরাও সেই জ্ঞান থেকে উৎসারিত ক্ষমতা চর্চা করতে পারে, যেমন কোন বৈজ্ঞানিকের বা দার্শনিকের মতের অনুসারিদের বিজ্ঞানমনস্কতার দাবী, এবং সেখান থেকে তাদের সামাজিক কর্মসূচীর বৈজ্ঞানিক ভিত্তির দাবী। আবার কোন কোন বিশেষজ্ঞ নিজের স্পেশালাইজেশনের বাইরে অন্য বিষয়েও পান্ডিত্যের দাবী, যেমন ডঃ জাফর ইকবালের ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ রচনা!
Karim, Lamia 2008 “Demystifying Micro Credit: The Grameen Bank, NGOs, and Neoliberalism in Bangladesh” in Cultural Dynamics 20(1):5-29.
প্রথম হইলাম :grr: :grr: :grr:
তুমি না পড়ে প্রথম...
আমি অর্ধেক পড়লাম।
এখন ঘুমাবো, সকালে ফ্রেশ মাথা নিয়ে আবার পড়া শুরু করতে হবে...
মাথা ক্যামন জানি ভোঁ ভোঁ করতাসে :-/
বস। ভালো লাগলো পড়ে। আরো বার দুয়েক পড়ে নেই। :boss:
কোন কোন বিশেষজ্ঞ নিজের স্পেশালাইজেশনের বাইরে অন্য বিষয়েও পান্ডিত্যের দাবী, যেমন ডঃ জাফর ইকবালের ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ রচনা!
:thumbup: :thumbup:
সঠিক কথা।
ভাই, পুরা লেখা পড়ার পর মাথা কেমুন যেন করে 🙁 🙁 🙁
এই জাতীয় জিনিস কেম্নে লিখে ?? 😮 😮 😮
মাহমুদ ভাই, অসংখ্য ধন্যবাদ এই লেখাটা দেয়ার জন্য। একবার পুরোটা পড়লাম, আরো কয়েকবার পড়তে হবে। নিজের দৃষ্টিভংগিগুলোকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। কাজ আছে বলে এখন আর পড়তে পারছি না, ভালোভাবে অনুধাবন করার পর আলোচনায় অংশ নেয়ার চেষ্টা করবো।
আর একটা কথা, মাহমুদ ভাই, কমেন্ট কম পড়েছে বা হিট কম হয়েছে দেখে নিরুৎসাহিত হবেন না। এই পোস্টটা অনেকের চিন্তাভাবনার জগতে অনেক পরিবর্তন আনবে।
না, সেই সম্ভাবনা নেই।
আমি জানি যে আমার লেখা সকলের পছন্দ হবে না। আর সবাই ত আর এই রকম সিরিয়াস লেখা পড়ার জন্যও সিসিবি'তে আসে না। আমার এইসব সিরিয়াস পোষ্টে তাই হিট বা কমেন্ট কম হবে- এটাই স্বাভাবিক।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
ভাইয়া কমেন্ট না পড়ার কারণ বোধহয় অনাগ্রহ না, কারণ এপোষ্টে পাঠক সমাগম হচ্ছে তা উপরের পঠিত সংখ্যাই প্রমাণ করছে।
পোষ্ট সম্পর্কে একটা লাইন বলি, আমার ভাল লাগছে কারণ বেশ কঠিন রসকষহীন বিষয়কে আপনি চমৎকার সহজবোধ্য ভাবে পেশ করেছেন। চলুক :thumbup: :thumbup:
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
:tuski: :tuski:
তোমার পুরা লেখাটা পড়ছি। নিজেই নিজেরে বাহাবা দিতে ইচ্ছা করতেছে। :thumbup: (এইটা তোমারে না কিন্তু, আমার নিজেরে)
১। তুমি এত ভারী ভারী চিন্তা কর কেমনে, মাথা ব্যাথা করে না তোমার?
২। ফুকো দেখি একটা মাল।
৩। আমার তো এইসব সিস্টেমের উপরে হিসু করে দিতে ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে। আমি অবশ্য ফুকো, ইউনুস, এডওয়ার্ড কাউরেই চিনি না তেমন, তবে উন্নত বিশ্ব আর সুসাশন জিনিস্টা খুব মজার মনে হয়। ;))
৪। সহজ কোন সল্যুশন নাই তোমার কাছে? জীবন নিয়া? এত ভারী জিনিস নিতে চাই না, মরতে তো একদিন হইবোই। 🙁
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ ভাই, অবিশ্বাসী মন আমার কোন বান্দার কথাতেই (পড়ুন তত্ত্বে) বিনাবাক্যে ঈমান আনতে সায় দেয়না। তাই প্রশ্ন করেই চলি যতক্ষন না সব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পাই। কোন প্রশ্নের উত্তর না পেলেই বরং মাথা ব্যাথা শুরু হয়।
যা জানতে চাই, নিজের বুদ্ধিতে জেনে-বুঝেই জানতে চাই, পূর্ণ-ঈমান বা নিখাদ বিশ্বাস দিয়ে নয়।
জীবন আসলেও খুব একটা ভারী জিনিস নয়। আর যেহেতু একটা মাথা আছে চিন্তা করার, ওটা সামান্য খাটালেই অনেক কিছু জানা যায়।
"জ্ঞানী আর মূর্খ কি এক হতে পারে? কক্ষনো নয়" (আল-কুরআন) -
মূর্খ থাকতে আর মন চায়না।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আমার মনে হয় এটাই সব না, তুমি নিশ্চয় এটা উপভোগ কর খুব। তানা হলে এত গভীরে কেউ শুধু মাত্র "জানার জন্য" যায় না। দরকার পরে না আরকি।
ব্লগের দু'জন লোকের জীবন আমি খুব কাছে থেকে জানতে চাই, জীবনের বাঁকে বাঁকে তার সিদ্ধান্ত গুলো সে কিভাবে নেয়, নিজেকে কতখানি বদলায়, কতখানি সরে আসে আগের দর্শন থেকে। এই দুজনের একজন হলে তুমি, আরেক জন হল রায়হান আবীর।
অবশ্য এজন্য আমাদের তিনজনকে অনেকদিন বেঁচে থাকতে হবে, আর মরে গেলেও অসুবিধা নেই, জানাটা হবে না আরকি।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
শরম দেন ক্যান?! আপনের কি ক্ষতি করছি?- :((
সেটাই।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
প্রথম দিকে কিছুদুর পড়েছি। পরে পুরোটা পড়ব। প্রথম দিকে পড়েই বিষয়টা ভালো লেগেছে।
মাহমুদ ভাই, একবার পড়লাম মনযোগ দিয়ে। আরও কয়েকবার পড়ব।
তবে, ফুকোর দৃষ্টিভঙ্গী খুব ভালো লেগেছে।
ভালো লেগেছে বলে ধন্যবাদ।
ফুকো আসলেই একটা 'বস পাব্লিক'। বিশেষ করে তার ক্ষমতা-বিষয়ক তত্ত্ব ত disciplinary knowledge আর specialist-দের এক্কেবারে ল্যাংটা করে ছেড়েছে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
spcialist বলা হয় একটি বিষয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রীধারীকে। একজন পোস্টগ্র্যাড যদি পড়াশুনা করেই পোস্টগ্র্যাড হলো তাহলে তাকে ন্যাংটা করে ছাড়াটা মানে যে কি কিছুই বুঝলাম না।
মাহমুদ ভাই, আমি সংশয়ীর দৃষ্টিতেই আপনার লেখাটি পড়েছি।
যেসব বিষয়ে একমত সেগুলো তো লেখার প্রয়োজন নেই। অনেক বিষয়ে দ্বিমত করারও কোন কারণ নেই, কারণ সেগুলো সম্পর্কে আমি নিজেই তেমন কিছু জানি না। দুটি বিষয় খুব চোখে লেগেছে। এখানে সাধারণীকরণ দোষ আছে বলে মনে হয়েছে।
১
এটা ঠিক না। আমি যতদূর বুঝেছি পৃথিবীর সিংহভাগ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে দীর্ঘদিনের সাধনার ফলে হয়েছে। কিন্তু সেগুলোকে আর্কিমিডিসের চৌবাচ্চা আর নিউটনের আপেল বানিয়ে মুখরোচক করা হয়েছে। এটা জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বড় কুফলগুলোর একটি। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের সাথে প্রকৃতপক্ষে আপেল পড়ার কোন সম্পর্কই নেই। এ বিষয়ে অধিকাংশ তথ্যই ভুয়া। অনেক আগে থেকে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক উপায়ে গবেষণা করেই নিউটন তার সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছেন। আর্কিমিডিসও অনেক আগে থেকে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন। আসলে বিজ্ঞানীদের অমানুষিক সাধনাকে এরকম হেঁয়ালিপূর্ণ অ্যানেকডোটের মাধ্যমে প্রকাশ করে জনপ্রিয়তা আদায় করা হয়। এ বিষয়টি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করছি। নিউটন, প্লাংক, আইনস্টাইন সবাই পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সবকিছু আবিষ্কার করেছেন। এক করতে গিয়ে ভুলে আরেকটি করে ফেলেননি। এভাবে আবিষ্কারকে আকস্মিক বলা মানে বিজ্ঞানের পদ্ধতিকেই অস্বীকার করা:
প্রকল্প -> তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা -> প্রকল্প সংশোধন -> তত্ত্ব
এখানে এক করতে গিয়ে আরেক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এমনটি খুব কমই হয়েছে। ডঃ গিলবার্টের স্থির-বিদ্যুৎ আবিষ্কার এমন একটি আকস্মিক ঘটনা, যা খুবই বিরল।
২
এবার লালন প্রসঙ্গে আসি। আমার মনে হয়েছে, আপনি লালন ভক্ত হওয়ার কারণে আহমদ শরীফের কথা শুনেই জ্বলে উঠেছেন। বিষয়টা একটু অন্যভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেননি। আপনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা হয়ত সত্য, কিন্তু বিকল্প ব্যাখ্যাও তো সত্য হতে পারে! যেমন, আহমদ শরীফকে সমাজ স্বীকৃত বুদ্ধিজীবী (!?) মনে না করে কেবলই একজন সাহিত্য সমালোচক মনে করুন। লালন হয়ত রবী ঠাকুরের চেয়ে অনেক জ্ঞানী, ঠাকুরের চেয়ে অনেক বড় দার্শনিক, তাই বলে কি তিনি বড় কবি হবেন? কবিতা মানে ভাষার খেলায় চেতন-অবচেতন ফুটিয়ে তোলা। যার ভাষা জ্ঞান যত বেশি সে এই কাজে তত বেশি দক্ষ হবে এটাই তো স্বাভাবিক। লালন হয়ত অনেক বড় বড় দার্শনিক কথা শুনিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোতে শব্দের খেলা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে খারাপ হতেই পারে। এটা আপনি মেনে নিতে পারছেন না কেন? আমি নিজে যতদূর পড়েছি সে অনুসারে, লালনের শব্দ-খেলার চেয়ে রবী ঠাকুরের শব্দ-খেলা অনেক বেশি বস। তাই বলে রবী ঠাকুর বেশি বস এটা তো আমি বলছি না। আমি দর্শন ও চিন্তাধারার দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের তুলনায় লালনকে বেশি বস মানি। আমার অবশ্যই মনে হয়েছে লালনের অনন্যসাধারণ চেতনা রবী ঠাকুরের অনন্যসাধারণ ভাষাবোধের ছায়ায় বড় হলে আরও অসাধারণ হয়ে উঠত।
আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে যা বুঝেছি তা হল, লোকসাহিত্যে অনেক বড় বড় চেতনা থাকলেও ভাষার সৌন্দর্য্যবোধের অভাবে তা যথেষ্ট সুন্দর হয়ে উঠতে পারেনি। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত, অবশ্যই কয়েকজন সমালোচকের লেখা থেকে সাহায্য নিয়েছি।
৩
এবার আমার প্রসঙ্গে আসি। আপনার পূর্ববর্তী লেখায় আমি এমন কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেছিলাম যেগুলোকে অপরিপক্কতার দোষে দুষ্ট বলা যায়। সেগুলো লেখার আগে যথেষ্ট ভাবিনি। লেখা পড়ে আমার সম্পর্কে আপনার যে ধারণা হয়েছে তা সর্বাংশেই সত্য। কিন্তু মানুষের পরিবর্তন ঘটে। বিবর্তন এবং ধর্ম বিষয়ে আমার অবস্থান আরও পরিপক্ক হচ্ছে। বর্তমান অবস্থানটা তাই সবার জ্ঞাতার্থে জানিয়েই দিতে চাই:
- বিবর্তনকে একজন জীববিজ্ঞানী (নির্দিষ্ট কোন জীববিজ্ঞানী মহল না কিন্তু!) যতটুকু সঠিক মনে করেন আমিও ঠিক ততটুকুই সঠিক মনে করি, এর বেশি বা কম না। বিবর্তনের সকল সীমাবদ্ধতাকে আমি সত্য মানি এবং বিবর্তন বিষয়ক নতুন নতুন তথ্য জানার চেষ্টা করি। বিজ্ঞানী হতে হলে সংশয়ী হতে হবে, এখানে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বিজ্ঞান যতটুকু বের করতে পারে ততটুকুই আমার সম্পদ।
- আমি ধর্ম না মানলেও ধর্মবিরোধী নই। একজন মানবতাবাদী হিসেবে ধর্মের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন আমার দৃষ্টিভঙ্গি সেরকমই।
৪
লেখার প্রশংসা নতুন করে করার কিছু নেই। বাকি পুরোটাই খুব ভাল লেগেছে। সমালোচনাটুকু লিখলাম কারণ এখন আমিও মনে করি, বিজ্ঞানমুখী লেখার প্রশংসার চেয়ে সমালোচনা হওয়া বেশি দরকার। কারণ সমালোচনার চেয়ে প্রশংসার দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বেশি।
মুহাম্মদ,
বেশ উপভোগ করলাম তোমার দ্বিমতগুলো।
তোমার পয়েন্টগুলো নিয়ে কিছু কথা বলিঃ
১। তোমার মতের সাথে আমি পুরোই একমত।
তবে আমার এই লেখার উদ্দেশ্য খানিকটা সফল এই কারণে যে, তুমি দেখতে শুরু করেছো "জনপ্রিয় বিজ্ঞান" প্রকৃত বিজ্ঞানের কি অবস্থা করে। এজন্যই আমি প্রচারে নেই।
২। শুধু ডঃ আহমদ শরীফ না, হুমায়ুন আজাদের প্রতিও আমার বেশ এলার্জি আছে। তারা সেইসব বিশেষজ্ঞের মতো, যারা নিজ নিজ বিষয়ের বাইরেও অযথা পন্ডিতি করতে গিয়েছেন প্রায়ই, আর তা' করতে গিয়ে উল্টাপাল্টা বকেছেনে।
লালনের সাথে রবীন্দ্রনাথের তুলনা হয় কি করে? লালন কি কবিতা লিখেছেন? আর সাহিত্যের কথা কি বলবো, বাংলা সাহিত্য ত পরজীবি শহুরে মধ্যবিত্তের ড্রয়িং রুমে ঢুকতে না পারলে তা' সাহিত্যই হয়ে ওঠে না। আর তাই ড্রয়িং রুমের বাইরে যা' কিছু আছে, তা'কেই অসাহিত্য, না-সাহিত্য, কুসাহিত্য ইত্যাদি নাম দিয়ে নিজেদের সাহিত্যের বাহাদুরী দেখানোটাই রীতি। ডঃ আহমদ শরীফের আর কি দোষ, তিনি ত শিক্ষিত! আর 'শিক্ষিত' মানে হচ্ছে বিশেষ একটা ধারায় চিন্তা-ভাবনা করতে অভ্যস্ত যে ব্যক্তি। (শিক্ষিত আর জ্ঞানী কিন্তু এক নয়)।
লোক সাহিত্যে সৌন্দর্যবোধের ঘাটতি নেই মোটেই। এই সৌন্দর্যবোধটা বুঝতে হলে সাহিত্যের প্রচলিত সব আজাইরা মাপকাঠির বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে হবে যা'র দাড়োয়ান ডঃ আহমদ শরীফরা। সৈয়দ শামসুল হকের 'খেলারাম খেলে যা' বা আব্দুল মান্নান সৈয়দের 'পুরষ সুন্দর' বা হুমায়ুন আজাদের 'কবি অথবা দন্ডীত অপুরুষ' এর থেকে বেহুলার উপাখ্যান, কাজল রেখা, বীরঙ্গনা সখিনা, খাইরুন সুন্দরী, এগুলোর সাহিত্য মূল্য কি হিসেবে কম? এসবের একমাত্র দূর্বলতা, এইসব সাহিত্য মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর জন্য নয়, প্রান্তজনের। আর তাই, তাদের ঘটনার প্লট, বর্ণনাভঙ্গী, উপমা ইত্যাদি আমাদের সাহিত্যের সার্টিফিকেট-প্রদানকারীদের পড়ে-আসা জ্ঞানের সাথে মিলে না বলেই তারা এগুলোকে সাহিত্যের পর্যায়ে ফেলে না।
৩। এই পয়েন্টটা মনে হচ্ছে ব্যক্তিগত ভাবে নিয়েছো। আমি সেভাবে বলিনি। আর মানুষ সব সময়ই বদলায়। আমি নিজেও প্রবল ভাবে বিশ্বাসী থেকে সংশয়ের আবর্তে পড়ে গেছি।
বিবর্তনবাদের সাথে আমার বিবাদ নেই মোটেই। কিন্তু এটাকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অন্যান্য যেসকল "সামাজিক কর্মসূচী" গড়ে ওঠে, আমি সেগুলোর বিরুদ্ধে, যেমন 'বিজ্ঞানমনস্কতার সাথে ধর্মের দ্বন্দ্ব', বা 'মানবতাবাদী বিজ্ঞান', ইত্যাদি।
৪। সমালোচনা সবসময়ই উপভোগ্য, সেটা তোমার থেকে হলে ত আরো বেশি। সেই জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ ভাই, আমি কিন্তু নিউটনের আপেল টাইপ জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ে সবসময়ই সচেতন ছিলাম, আপনার পোস্ট পড়ার পর সতর্ক হইনি। আবার কার্ল সেগান এবং স্টিফেন হকিং এর বিজ্ঞান সাহিত্য, আবদুল্লাহ আল মুতীর বিজ্ঞান সাহিত্য এখনও ভাল লাগে, আপনার পোস্ট পড়ে কিন্তু তাতে কোন পরিবর্তন আসেনি।
আপনি বিজ্ঞান সাহিত্যের বিষয়টা আরেকবার ভেবে দেখবেন আশাকরি। প্রবন্ধ সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়েই আছে বিজ্ঞান সাহিত্য।
দুইন্নাডা পচুর কডিন...
মুহাম্মদ এর কমেন্ট, মাহমুদ ভাইয়ের পোস্ট...
আর 'অটোম্যাটা থিওরি' এর প্রবলেম সলভ করা পরীক্ষার জন্য...... সবই কঠিন লাগতেছে......
মাহমুদ ভাই আপনি একটা খারাপ কাজ করছেন । আমার এখন আই টি বাদ দিয়ে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে । দুনিয়া জুড়ে এত গ্যানজাম না হলে এখনি মাস্টার্সে ভর্তি হতাম । তবে আশা ছাড়ি নাই । আর আপনার বিচার-বিশ্লেষন আমাকে আরো skeptical করে তুলবে মনে হচ্ছে । তবে আপনার চিন্তাধারা আমাকে মানসিক ভাবে আরো পরিপক্ক হতে সাহায্য করবে । এধরনের লেখা আরো লিখুন । তারা দেয়ায় আমি বিশ্বাসী না, তাই প্রিয়তে রাখলাম ।
মাহমুদ ভাই, সারাদিনে এই নিয়া তৃতূয়বারের মত কমেন্টাইতে ঢুকলাম। কারেন্ট আর পিসির যন্ত্রণায় ব্লগিং করা কঠিন হয়া যাইতেসে। তবে আমি সব পোস্টই পড়ি। আপনার এই পোস্ট পড়েও মুগ্ধভাবে কিছু না বলেই চলে যেতে চাচ্ছিলাম। তারপরেও কিছু বলতে এলাম।
পোস্টের কিছু বিষয়ে আমি একমত আর কিছু বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব। তবে মুহম্মদ যে পয়েন্ট টা ধরল সেটা আমিও বলবো, বিজ্ঞানের আবিষ্কার দৈব ক্রমে হয় না। জোসেফ প্রিস্টলীর স্থিরবায়ু আবিষ্কারের মত কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াতেই হয়েছে। আপেল চৌবাচ্চা ঘটনা গুলো এসব বিষয় কিংবা আবিষ্কারকে কাহিনীরূপে মানুষের কাছে চিত্তাকর্ষক হিসাবে পৌছানোর একটা উপায়। এর পিছনেও ক্ষমতার ব্যাপারটা আসছে মনে হয় (যদি আপনার লেখা আমি ঠিক বুঝে থাকি)। যেমনভাবে আমাদের পাঠ্যবইয়ে আওরঙ্গজেব আকবরদের কাহিনী কবিতারূপে মইথ্যার ফ্লেভার দিয়ে এসেছে।
আর বস, লালনের চর্চা পথে ঘাটে অশিক্ষিতদের মাঝে হয় কথাটা মনে হয় পুরোপুরি ঠিক নয়। আমার মায়ের পিএইচ ডির বিষয় ছিল বাংলা সাহিত্যে লোকজ অনুষঙ্গ। সেখানে এই জাতীয় সাহিত্য রচনার পিছনকার দর্শন গুলো খুঁজে আনার প্রয়াস ছিল। এছাড়াও লালন দর্শনের অনেক বই তো আমি দেখেছি যা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য।
আপনার পোস্ট গুলো কমেন্ট করার আগে আমি কয়েকবার পড়ি। তারপরেও পড়ার তাগিদ এই পোস্ট টাতে আছে। তাই প্রিয়তে সংগ্রহ করে রাখলাম। আর পোস্টে পাঁচ তারা।
মানছি। কিন্তু সেখানে সমস্যা আছে। দেখি, বোঝাতে পারি কিনা...
পিএইচডি করার প্রকৃয়াটা কি?- কয়েকজন গাইড (প্রখ্যাত পন্ডিত) কিছু নির্দিষ্ট তত্ত্ব+পদ্ধতির আলোকে শিক্ষার্থীকে একটা নির্দিষ্ট ধারায় বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষন করতে উৎসাহিত করেন। এখানে লক্ষ্যনীয় যে, শিক্ষার্থীকে উক্ত ডিসিপ্লিনে 'পূর্বথেকে চলে আসা রীতি' অনুসরণ করতে হয়। সেখানে লালনের অবস্থা কি রকম? - একজন ব্যর্থ কবি, অথবা লোকসাহিত্যিক! কিন্তু লালন না ছিলেন সাহিত্যিক, না কবি। আমি যতদূর জানি, লালনের যাবতীয় আলোচনার মূলে ছিল কিছু দার্শনিক প্রশ্ন। তাইলে সাহিত্যের মাপকাঠিতে লালনের বিচার হবে কি করে? আর একই কারণে সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে গেলে লালনের দর্শনকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা ষোল আনা। তার দর্শন বুঝতে হলে তাই দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে আসতেই হবে, যা আমাদের দেশে একাডেমিক পরিমন্ডলে এখনো তেমনটি চোখে পড়ে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যে অন্তর্ভূক্ত হতে হলে বইকে বিশেষ ধারার অন্তর্গত হতে হয়। যেকোন বই সিলেবাসে ঢুকতে পারেনা, নির্বাচিত বইগুলোই শুধু ঢুকে। কাজেই, পাঠ্য শুধুমাত্র ক্ষমতাবানদের গ্রহনযোগ্যতার মাপকাঠিই হতে পারে, প্রকৃত জ্ঞানের নয়। একই কারণে, উক্ত সিলেবাস সম্পন্ন করে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট শিক্ষার সনদ ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানের পরিচায়ক নয়।
আন্টিকে তার বিষয়বস্তুর জন্য অভিনন্দন। আশা থাকল সুযোগ করে একবার তার সাথে দেখা করার।
অফটপিকঃ লালনের দর্শন নিয়ে কিছু চমৎকার লেখা পড়েছিলাম সামুতে 'ভূ-পর্যটক' এর পোষ্টে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
খুব সম্ভবত আপনার বক্তব্যটা ধরতে পেরেছি। লালন চর্চা কারী বলতে আপনি খুব সম্ভবত লালনের দর্শনকে জীবন আচরিতে পরিণত করার কথা বলেছেন। এইবার তাহলে ঠিক আছে। আর আপনার বক্তব্যের মূল সুরটা( এই বিষয়ে) লেখার মধ্যে ধরতে অসুবিধা হচ্ছিল। এখন মোটামুটি পরিষ্কার। আপনার লেখার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে আমাদের আশেপাশে প্রতিনিয়ত দেখে যাওয়া ঘটনাকে পেছন থেকে দেখা যাবার সুযোগ করে দেয়া। হুমায়ুন আজাদের ব্যাপারে আপনার এলার্জির দিকগুলো জানতে পারলে ভালো লাগতো। তার দর্শনে আমি কিছুটা প্রভাবিত বলেই এই আগ্রহটা বোধ করলাম।
জাফরের নামটা লেখায় না আনলেও হত। এই ব্যাটা অদ্ভুত রকম জনপ্রিয়তা প্রেমী। তিনি বিজ্ঞানের কোন মেলায় গিয়ে বাচ্চাদের সাহিত্য নিয়ে বিরাট জ্ঞান প্রদর্শন করে মাথা ওয়াশ দেন আর সাহিত্য বিষয়ক আলোচনায় অহেতুক আইটি নিয়ে ভ্যাজর ভ্যাজর করেণ। তার মাঝেকার দর্শন অবশ্যি আপনার লেখা থেকে অনুমান করা গেলো।
সমস্যা হইতেসে আমার মায়ের পিএইচ ডি শেষ করা হয়নি। আর তাঁর দুই বছরের কাজ গুলোও প্রকাশইত হয়নি কারণ তিনি কিছুই লেখেননি বিষয়গুলো নিয়ে স্টাডি করেছেন। আর লেখার সুযোগও অবশ্যি নেই। গত বছরের অক্টোবরে তিনি পৃথিবী ছেড়ে গেছেন।
আমি খুবই দঃখিত না-জেনে এমন বিষয় টেনে আনার জন্য! তার আত্মা শান্তি পাক। শিঘ্রই দেশে যাবো। আশা করি তোমার সাথে দেখা হবে কোন এক সন্ধ্যায়।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আরে বস, এইটা কী? দুঃখিত হতে হবে কেন? আমি কমেন্টে কথাটা লেখার আগেও অনেকক্ষণ ভেবেছি নতুন পাঠকের কাছে লেখার ফোকাস যাতে আমার কমেন্টের জন্য নষ্ট না হয়। শেষ বিবেচনায় মনে হলো বলা যায় তাই বললাম।
হুমায়ুন আজাদের ব্যাপারটা জানার অপেক্ষায় রইলাম। আর দেশে আসলে আপনার সাথে দেখা হবার প্রত্যাশা রইলো।
হুমায়ুন আহমেদের 'কবি' উপন্যাস প্রকাশিত হলে তার সমালোচনায় হুমায়ুন আজাদ একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, সেই কবি উপন্যাসের প্রথম বাক্যেই নাকি গ্রামার ভুল! তারপর তিনিও লিখে ফেললেন 'কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ' নামের একখান উপন্যাস। সেটা কি হয়েছে তা' না পড়লে বোঝা মুশকিল।
আর প্রায় সব বিষয়ের সমালোচনাতেই তার পরিমিতি বোধের ব্যাপক ঘাটতি আছে যা প্রায়শঃই বিরক্তি উদ্রেককারী।
তবে হুমায়ুন আজাদের 'লাল নীল দীপাবলী' অদ্ভুত সুন্দর।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
একশভাগ সহমত। তিনি কোন সমালোচনায় কিছু বললে তার মাঝে দিয়ে তার আত্মম্ভিরতা ফুটে উঠে এই কথাটা অস্বীকার করতে পারলাম না। তবে তিনি সস্তা চটকদার সমালোচনার বদলে খুব ধাঁরালো সাহসী যুক্তি নির্ভর কথা বলেন এইটাই আমাকে বেশি টানে।
"কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ" উপন্যাসটার শেষেরটুকু বাদে পড়তে আমার কাছে খারাপ লাগেনি। ছোট বাচ্চাদের জন্য তাঁর কিছু রচনা আছে, আমি মনে করি সেই বই ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেয়া অভিভাবকদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাতে অন্তত হুমায়ুন আর জাফরের বাজারী সাহিত্যের চক্র থেকে আমাদের মুক্তি মেলার সম্ভাবনা হবে।
আর তাঁর " আমার অবিশ্বাস " বইটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছিলো, তার নিজের জীবন দর্শনের একটা ছাপ সেখানে পাওয়া যায়। এইটা বইটা কিছু কিছু কথা আমাকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছিলো, তার মাঝে একটা উল্লেখ করলাম,
" অবিশ্বাসে আলো , বিশ্বাসে অন্ধকার।"
খুব ধারালো, সাহসী সমালোচনায় আমার সমস্যা নেই। কিন্তু এজাতীয় সমালোচনা প্রায়শঃই যুক্তি হারিয়ে ফেলে, সমস্যাটা সেখানেই।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
হুম বুঝলাম আপনার সমস্যার জায়গাটা।পরে আবার কথা হবে। বাংলাদেশে এখন রাত ৩:৩০। ঘুমাতে যেতে হবে। ভালো থাকবেন।
হুম,
তুমিও ভালো থেকো।
আমার এখানে দুপুর! 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
বস
একেবারে অপ্রাসংগিক একটা কথা বলি।
আহমেদ সাহেব 'হুমায়ূন' লিখেন। (দীর্ঘ ঊ-কার)
আজাদ সাহেব লিখেন 'হুমায়ুন'। (হ্রস্ব উ-কার)
এই নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে, শিল্পী মুর্তজা বশীরের আত্মজীবনীতে পড়েছিলাম। অনুমতি দিলে সেই গল্পটা পরে একসময় বলবো।
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
ভালো বলেছো।
দুইজনেরই বেশ কিছু লেখা আমার প্রিয়র তালিকায়। কিন্তু নামটা সেভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখিনি কখনো।
শুধরে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আরে এই বিষয়টা তো আমিও খেয়াল করিনি..... 🙂 🙂 🙂
ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে শিল্পী মুর্তজা বশীর প্রথমে তার নামের বানান লিখতেন 'মূর্তজা বশীর' (দীর্ঘ ঊ-কার)। এটা দেখে ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাকে একদিন ডেকে বললেন 'একমাত্র মূর্খদের নামের বানানে 'দীর্ঘ ঊ-কার' থাকে। আমি তো তোমাকে বুদ্ধিমান বলেই জানতাম।'
এরপর থেকে মুর্তজা বশীর আর কোনদিন 'দীর্ঘ ঊ-কার' দিয়ে উনার নাম লিখেন নি। 😀
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আসলেই জ্ঞানী লোক ছিলেন :salute:
কি বলেন কাইয়ূম ভাই... ;)) :frontroll: :frontroll:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
কথোপকথনের আগের অংশটা পড়লাম। মাথা আউলায়ে যাবে এই ভয়ে কথোপকথন পড়ার আগেই কমেন্ট দিয়ে দিচ্ছি। জ্ঞান নিয়ে এইভাবে চিন্তা করি নাই কখনো। আমি নিজে এই সিস্টেমের অংশ হয়ে গেছি। নিজের চিন্তাধারার সাথে সরাসরি সংঘাত না হলে কখনো বিশেষজ্ঞদের কথায় দ্বিমত করি না।
বিশ্ববিদ্যালয় মন্ডলে একটা কথা চালু আছে- পাবলিশ অর পেরিশ। কারো গবেষণালদ্ধ জ্ঞান যতো সত্যই হোক, জার্নাল-ফার্নালে প্রকাশিত না হলে জ্ঞান হিসাবে স্বীকৃতি পায় না। জার্নালে প্রকাশিত হলেই হবে না, আরো লোকজন যদি এই জ্ঞানকে রেফার করে পরবর্তী গবেষণা করে তবে আরো ভালো। বই, জার্নাল আর্টিকেল,এমন কি ক্লাস নোটে যার কথা বেশি, সে ততো বড় বিশেষজ্ঞ। গবেষণালদ্ধ ফাইন্ডিংসের জ্ঞান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা জানতাম, কিন্তু এতো গভীরভাবে চিন্তা করে দেখিনি।
প্রতিষ্ঠান আর ব্যক্তির পারস্পরিক পিঠ চুলকে দেয়ার এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় নাই?
মাহমুদ ভাই, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমাকে যে আর্টিকেলটা পাঠিয়েছিলেন ওইটা হারিয়ে ফেলেছি। মেইল ইনবক্স পরিষ্কার করতে গিয়ে ঐ মেইলটাও ডিলিট করে দিয়েছি। এখানে আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক কিভা (বা ওইরকম একটা কিছু)-কে টাকা দেন ক্ষুদ্রঋণ দেয়ার জন্য। ডঃ ইউনুসকে মোটামুটি বিরাট ধরনের জ্ঞানী লোক হিসাবে ভাবেন- বিশেষ করে তার নোবেল পাওয়ার পর থেকে। তার সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে আমি যখন বলেছিলাম ইউনুস কন্ট্রোভার্সিয়াল, উনি কারণ জানতে চেয়েছিলেন। আপনার পাঠানো আর্টিকেলটা থাকলে ভালো হতো। কষ্ট করে লিংকটা আবার দিবেন?
মাহমুদ : উদ্ধৃত অংশটার জবাব দিই প্রথমে। তোমার ওই পোস্টে আমার করা মন্তব্যটা নিচে তুলে দিলাম। দেখো তো এখানে কোথাও কি আমি তোমার লেখায় বিজ্ঞান বা বিবর্তনবাদ খুঁজেছি? দয়া করে আবার দেখো। তোমার লেখায় আমার প্রসঙ্গ টানায় আমি কিন্তু মাইন্ড করিনি। অতটুকু উদারতা না থাকলে চলবো কি করে? কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তুমি নিজে এমন ধারণা তৈরি করেছ যে মুহাম্মদের চিন্তাভাবনা অনেকটা আমার সঙ্গে যায় বলে আমি তোমার বিরুদ্ধাচারণ করি। আমি যদি তোমার কোনো লেখায় কোনো কিছুর সমালোচনা করে থাকি সেটা আমার ভাবনা থেকেই করেছি। তুমি মুহাম্মদের সমালোচনা করছো বলে আমি ওর পক্ষ নিচ্ছি এমন ভাবাটা খুবই সরল হয়ে যায়!
এই প্রসঙ্গ শেষ। এবার তোমার বর্তমান পোস্ট নিয়ে আসি। লেখাটা যথারীতি নাড়া দেওয়ার মতো হয়েছে। বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নিয়ে ফুকোর বিশ্লেষন ভালো লাগলো। কিন্তু সংশয়বাদীর মতো আমারও মনে হচ্ছে, ফুকোর বিশ্লেষণ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া দিয়ে আমি নিজেও কি প্রভাবিত হচ্ছি? আমি বরং সব স্কুল বা ধারার চিন্তাভাবনা জানতে চাই, বুঝতে চাই। তারপর কোনটা কতটুকু নেব সে সিদ্ধান্ত আমার।
প্রচারণা পাশ্চাত্যের প্রধান অস্ত্র। তারা তাদের ধারণা বা তথ্য এমন মোড়কে প্রচার করে যে তা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে এবং আমাদের গেলাতে চায়। যেমন তুমি ওরিয়েন্টালিজম সম্পর্কে লিখেছো। এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে কোনো ভিন্নমত নেই। সাঈদ, চোমস্কি বা অরুন্ধতি পাশ্চাত্যের তথ্য-বিশ্লেষণ কাটাছেড়া করে ওদের অসার প্রমাণ করেন।
তবে আমি বিনীতভাবেই বলতে চাই, তোমার মধ্যে আমি একধরণের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গী দেখতে পাচ্ছি। যেটা তোমার ধারণা অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব। যে কোনো মতের-পথের বিরোধীতা থাকতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক। মানুষ কোনো কিছু বিনা প্রশ্নে কেন মেনে নেবে? কিন্তু তুমি যদি বেছে বেছে শুধু তোমার মতের পক্ষে যেটা যায়, সেটাকেই সত্য প্রমাণের চেষ্টা করো, তাহলে আমি এটাকে একপেশে বলতেই পারি।
ড. ইউনূস সম্পর্কে আমার অনেক সমালোচনা আছে, তবু আমি এখনো ক্ষুদ্রঋণের পক্ষে। ক্ষুদ্রঋণের শর্ত, সুদের হার ইত্যাদি না জেনে লাখো-কোটি মানুষ এই ঋণ নিচ্ছে বা এর পক্ষ নিচ্ছে? এটা বেশি সরলীকরণ হয়ে গেল না? এটাকে এক কথায় "নব্য কাবুলিওয়ালা" বা "দারিদ্র্য নিয়ে ব্যবসা" বলে দেওয়া সহজ। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা কি ইউনূসের পকেটে যাচ্ছে?
হত দরিদ্র মানুষের কাছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্থ পৌঁছানোর এই পথটি ইউনূস বের করেন। ইউনূস এর সাফল্য বেশি দাবি করেন। তবে এটা ব্যর্থ হয়ে গেছে এমন বলার সময় বোধ হয় এখনো আসেনি। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য দু'জায়গার গবেষকরাই ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য ও ব্যর্থতার জায়গাগুলো খুঁজে দেখছেন। একে আরো কিভাবে কার্যকর করা যায়, তার পথও নিশ্চয়ই আমরা পাবো। গ্রাম ও শহরের হত দরিদ্ররা, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণে যাদের কোনোরকম প্রবেশাধিকার ছিল না; তাদের কাছে অর্থ তো পৌঁছাতে হবে। নাকি ভিজিএফ, ভিজিডি, কাবিখা দিয়ে তাদের এক ধরণের ত্রাণনির্ভর করে রাখাটা যথার্থ হবে? দারিদ্র থেকে তাদের বের করার আরো ভালো পথ পাওয়া গেলে আমরা সেটার পক্ষেই থাকবো।
ভালো বলেছো। আমার অভিজ্ঞতা বলে, পুঁজিবাদীরা তাদের শোষনটাকে সহনীয় রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে। সমাজতন্ত্রীরা করে দারিদ্র্যের প্রতিযোগিতা! দরিদ্রদের তারা দেখে তার বিপ্লবের হাতিয়ার হিসাবে। ইউনূস তো পুঁজিবাদের অস্ত্র। তিনি ওই দরিদ্রদের বিপ্লব থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাকে কেন সমাজতন্ত্রীরা পুরস্কার দেবে?
তোমার এই পর্যবেক্ষণকেও আমি একপেশে বলবো। বেশি ব্যাখ্যায় যাবো না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের (বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, ওরিয়ন গ্রুপ ইত্যাদি) দুর্নীতিও মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পাচ্ছে। সম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতাল যে অনেক দক্ষভাবে চলছে সেটাও মিডিয়াই প্রচার করছে। এবিসিতে মাস দুয়েক আগে আমরা বলেছিলাম ওই হাসপাতাল থেকে একজন মাকে সন্তান প্রসবের জন্য মাত্র পাঁচশ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে এটা অকল্পনীয়। সেখানে খাবারের মান বেড়েছে। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা হাসপাতালেই হচ্ছে। কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়, কারণ সরকারি অপ্রতুল বরাদ্দ। মাত্র একজন পরিচালক সেনা কর্মকর্তা গত কয়েকমাসে এই পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু তিনি না থাকলে এটা টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ!
বুঝলাম না। জাফর ইকবাল ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ রচনা করে কি ঠিক করেননি? এটা করা কি অন্যায় হয়েছে? তিনি কি নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের পন্ডিত বলে নিজেকে দাবি করেছেন? জাফর ইকবালের ব্যাপারে আমার কোনো পক্ষপাত নেই। অনেক বিষয়ে তার ভাবনা-চিন্তা একপেশে-একরোখা। তবু কেউ যদি ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ লিখতে চায় সেটাকেও সমালোচনা করতে হবে?
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
খুব ভালো লাগল আপনার দীর্ঘ মতামত পেয়ে।
সানা ভাই, ভুল বুঝেছেন খানিকটা।
আমার মত ত একপেশেই, বলে কয়েই আমি লিখেছি যে, 'এটা আমার মত'। আমি ত বলিনি যে এটাই সার্বজনীন, কাজেই সবাইকে এটা সঠিক বলে মেনে নিতে হবে। আর আমি সব সময়ই এই কথা মাথায় রেখে লিখি যে, অনেকের অনেক মত থাকবে। সেই কারণে আমার সব লেখায় দেখবেন 'আমার ভাবনা', 'আমার উপলব্ধি' 'আমার মত' ইত্যাদি কথাগুলো শিরোমানেই দিয়ে থাকি এই কারণে যে, পাঠক যেন বোঝে যে লেখার মূল বক্তব্য শুধুই আমার নিজস্ব মত। তা' যুক্তিতে টিকলে কেউ গ্রহন করবে, না হলে উপেক্ষা করবে। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করি যেন পাঠক মনে না করে যে আমি আমার মত চাপিয়ে দিচ্ছি।
আর আমি ত নতুন কিছু বলছি না। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, আমাদের 'জানা' বিষয়গুলোর অনেকগুলোই একপেশে, একটা পাশ অজানা। আমি সেই অজানা পাশটা তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। আর তা করতে গিয়ে আমার বক্তব্যগুলোও একপেশে হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা আমি জেনেশুনেই করছি।
ক্ষুদ্রঋণের বিষয়ে আমার অবস্থানে আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়েই লিখেছি, একেবারে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে। শুধু এটুকুই বলি, এটা কাঠালের আমসত্বের মতো। তারপরেও যদি কথা থাকে,- দেশে যাচ্ছি- আশা করি আরো কথা হবে।
জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে পারেন না। কারণ, তিনি বিশেষজ্ঞ অন্য বিষয়ে। ইতিহাস চর্চার যেসব পদ্ধতি আছে, তার কোনটাই তিনি ভালো ভাবে জানেন না (এর প্রমাণ তিনি ইতোমধ্যেই দিয়েছেন)। তাকে লিখতে দিলে যদু-মধু সবাই লিখতে শুরু করবে, মনের মাধূরী দিয়ে। সেক্ষেত্রে আর ইতিহাস বিশেষজ্ঞের প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। এবং অনিবার্য ভাবেই, ইতিহাসও আর ইতিহাস থাকবে না।
সবশেষে, মনে হলো ভাষা-প্রচার-ক্ষমতা বিষয়ে আমার বক্তব্যটা ঠিক মতো বোঝাতে পারিনি।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ ভাই, এখানে স্ববিরোধিতা আছে। আপনি নিজেই লেখায় ডিগ্রির মাধ্যমে সবকিছু বিচার করাকে সমালোচনা করেছেন। এখন লোকসাহিত্য নিয়ে আহমদ শরীফের করা উক্তিকে বলছেন তার সাবজেক্টের বাইরে। এটা কি ঠিক হল? আমি ফিল্মে পিএইচডি করিনি, তাই বলে কি আমি সিনেমা নিয়ে দুই এক কথা বলতে পারব না। আর এমনিতে তো জানতাম, আহমদ শরীফ মধ্যযুগীয় লোকসাহিত্য নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তার বাইরে কিভাবে গেলেন বুঝতে পারলাম না। আহমদ শরীফের লোকসাহিত্যে পিএইচডি নেই বলে কি তিনি লোকসাহিত্য নিয়ে কথা বলতে পারবেন না? আহমদ শরীফকে শহুরে সংস্কৃতির দাড়োয়ান বলেও অতি সরলীকরণ করেছেন। আমার এটা মনে হয় না।
আপনার এই কথাটা পুরোপুরিই সরলীকৃত এবং আপনার ডিগ্রি-সমালোচনার বিরোধী।
আমি ডিগ্রীর সমালোচনা করি তখনই যখন দেখি কেউ এক বিষয়ে স্পেশালাইজেশন করে পন্ডিতি করে অন্যান্য বিষয়েও, তার নিজের স্পেশালাইজেশনের বেলায় আমি বরং আগ্রহ নিয়েই পড়ি+শুনি।
ডঃ আহমদ শরীফ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ সেটা আমিও জানি, লোক সাহিত্যে তার অনেক দখল সেটাও জানি। কিন্তু তার এইসব পাণ্ডিত্যের খ্যাতি লালনকে নিয়ে করা তার উক্তির অসারত্ব ঢাকতে ব্যর্থ। এটা এজন্যই হয়েছে যে, তিনি লালনকে মধ্যযুগীয় লোক-সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করেছেন যা' সঠিক নয়। একজন মূলতঃ দার্শনিককে 'লোক-সাহিত্যিক' বানানোর বিফল চেষ্টাকে আমি সমালোচনা করেছি, ডঃ আহমদ শরীফের সমগ্র পান্ডিত্যকে নয়, কখনোই না। তার কিছু বইকে আমি বাংলা সাহিত্যের পাঠে যথেষ্ট মূল্যবান মনে করি।
আর আমি ত ভাবাবেগসম্পন্ন মানুষ। স্বভাবতঃই আমারও পছন্দ-অপছন্দ আছে। আর সেটা আমার কথায়-বার্থায় থাকবেও। কাজেই, আমার বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে সরলীকৃত হতে পারে। আশা করি তোমার মতো অন্যরাও ধরিয়ে দিবে সেসব।- একটা কথা না বললেই নয়, আমি 'ভ্যালুফ্রী নলেজ' এর ধারণায় বিশ্বাসী না।