রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শিল্পায়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নঃ পূর্ব-এশীয় অভিজ্ঞতা

নিও-লিবারেল ডিসকোর্সে জাতীয় উন্নয়নে রাষ্ট্রের অংশগ্রহনকে ক্ষতিকর হিসেবে দেখা হয়। কারণ, এতে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনাকাংখিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি দেখা দেয় যা’ শিল্পায়ন ও ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। বাস্তবতা হচ্ছে, যে কয়টি দেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে, তারা সবাই জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্পে রাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহনের মাধ্যমেই হয়েছে, যেমন জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং ও সিঙ্গাপুর। এইসব পূর্ব-এশীয় দেশসমূহের উন্নয়নের পথটা তাহলে কি ছিলো? শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি, প্রযুক্তি, কাঁচামাল, বাজার, অভিজ্ঞতা এসবের কোনটাই না থাকা সত্বেও এই দেশগুলো ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশকে শিল্পক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করে সরাসরি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে।

Chalmer Johnson সর্বপ্রথম তার বিখ্যাত MITI and the Japanesd Miracle: the Growth of Industrial Policy (১৯৮২) গ্রন্থে জাপানের শিল্পায়নের আলোচনার মাধ্যমে Developmental State ধারণার সূত্রপাত করেন। এই ডেভেলপমেন্টাল ষ্টেট এর মূল বৈশিষ্ট্য হল এর আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটা বিশেষ সংস্থা থাকে যা’ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এই সংস্থার আমলারা নিজেদের মধ্যে সুসংঘবদ্ধ, অন্যান্য সংস্থার আমলাদের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এবং পাশাপাশি শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর সাথেও সম্পর্কিত। এরা আমলাতন্ত্রের আন্তঃসম্পর্কের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষমতা+চাহিদার সাথে দেশীয়+আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থার অবস্থা বিবেচনাপূর্বক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এবং রাষ্ট্রের সকল সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের মাঝে করণীয় নির্দেশ জারী করে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়।

জনসনের বর্ণিত জাপানের এই সরকারী সংস্থা হল Ministery of International Trade and Industry (MITI) যা সরকারের যাবতীয় অর্থিনৈতিক নীতি নির্ধারনী কার্যক্রম (কর, ঋণ, বিনিয়োগ, আমদানী-রপ্তানী নীতি, ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রন করতো। সরকারী আমলাতন্ত্রের মধ্যে MITI-র বৈশিষ্ট্য হল এর প্রায় সব আমলাই জাপানের সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবথেকে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন আইন বিভাগের গ্র্যাজুয়েট এবং এলামনাই সম্পর্কের দ্বারা নিজেদের মধ্যে খুবই সুসংগঠিত (Coherent)। আর পেশাগত অবস্থানের কারণে এরা সমাজের মধ্যে স্বতন্ত্র্য এবং উচ্চ মর্যাদার কারণে সমাজের আর সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন (অনেকটা আমাদের দেশের বিচারকদের মতো)। আবার এদের মধ্যে যাদেরকে সময়মতো MITI-তে পদন্নোতি দেওয়া যেতো না, তাদেরকে বেসরকারী শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো (একে জাপানীজে বলে ‘আমাকুদারি’)। ফলে MITI-র সাথে ব্যবসা ও শিল্পক্ষেত্রেরও একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা MITI-র উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এই ডেভেলপমেন্টাল ষ্টেট এর ধারণাকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন Peter Evance তার Embedded Autonomy (1995) গ্রন্থে। এখানে ইভান্স রাষ্ট্র (নির্দিষ্ট করে সরকারের একটা বিশেষ সংস্থা) এবং সমাজের (নির্দিষ্ট করে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা) মধ্যকার সম্পর্ককে একটা মডেলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন যা’কে তিনি নাম দিয়েছেন Embedded Autonomy। Autonomy বা স্বাতন্ত্র্য বলতে তিনি বুঝিয়েছেন একদিকে রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের মধ্যে সুসমন্বয়, অন্যদিকে সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠি/শ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্নতা। Embedded বলতে তিনি বুঝিয়েছেন আমলাতন্ত্রের সাথে সমাজের বিশেষ অংশের (সিলেক্টেড কিছু ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা) সম্পর্ক যারা সরকারের প্রণীত উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুসরণ করতে আগ্রহী এবং প্রস্তুত। আমলাতন্ত্র ও উদ্যোক্তাদের মধ্যকার এই সম্পর্ক একটা ব্যাল্যান্সড পর্যায়ে থাকাটা উন্নয়ন পরিকল্পনার সাফল্যের জন্য অপরিহার্য, যা’ ইভান্সের মতে কোরিয়ায় ছিল, কিন্তু ভারত আর ব্রাজিলে ছিলনা।

কোরিয়ার উন্নয়ন পরিকল্পনাকারী আমলারা মূলতঃ দেশের সবথেকে মর্যাদাসম্পন্ন কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ছিলো। তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বিত কিন্তু সমাজের অন্যান্য শ্রেণী থেকে আলাদা, অন্যান্য আমলাদের সাথে এবং সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাশ্রেণীর সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ছিল। ফলে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে এবং বাজারের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য নিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছে। ভারতেও পরিকল্পনাকারী আমলারা মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বতন্ত্র (autonomous) এবং নিজেদের মধ্যে সমন্বিত (coherent) ছিল। কিন্তু তারা সরকারের অন্যান্য সংস্থা এবং উদ্যোক্তাশ্রেণীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে বাজারের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের অন্যান্য সংস্থার মধ্যে কর্মসূচীর প্রয়োজনমত সমন্বয় সাধন করতে ব্যর্থ হয়। আবার ব্রাজিলে আমলাতন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য ও সমন্বয় কোনটাই ছিলোনা, কিন্তু তারা সমাজের সাথে, বিশেষ করে ভূমিভিত্তিক অভিজাতশ্রেণীর সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ছিল। ফলে সেখানে আমলারা রাষ্ট্রের স্বার্থের উপরে অভিজাতদের স্বার্থকে স্থান দিতে বাধ্য হয়। আমলাতন্ত্র ও উদ্যোক্তাদের এইরূপ ইমব্যাল্যান্সড সম্পর্কের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারত ও ব্রাজিলের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

জাপান, কোরিয়া এবং তাইওয়ানে রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ভাবে আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটা বিশেষায়িত সংস্থা গড়ে তুলেছিল যা’ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে (কর নীতি, মুদ্রানীতি, শিল্প ও বানিজ্যনীতি, আমদানী-রপ্তানী, বিনিয়োগ, ইত্যাদি) নিউক্লিয়াসের ভূমিকা পালন করেছে। এই সংস্থাকে যাবতীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপমুক্ত রাখতে সরকারের মূল নেতৃত্ব প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক আমলা Robert Wade তার বিখ্যাত গ্রন্থ Governing the Market (১৯৯০) এ তাইওয়ানের উন্নয়নের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। ওয়েড দেখিয়েছেন যে, চিয়াং কাইশেকের MKT-র অধীনে তাইওয়ানের একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় Industrial Development Bureau (IDB) জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এই সংস্থার আমলারা ছিল প্রধানতঃ প্রকৌশলে গ্র্যাজুয়েট (১৮০ জনের মধ্যে ১৩০ জন), তারপরেই ফিন্যান্স ও মার্কেটিং এ (৩০ জন), আর মাত্র ৩ জন অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েট। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রনালয়সমূহের মন্ত্রী ও সিনিয়র আমলাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন প্রকৌশলী অথবা বিজ্ঞানী। IDB পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্বের পাশাপাশি তা’ বাস্তবায়নের জন্য পূর্ণ ক্ষমতা চর্চা করে।

তাইওয়ানে সরকারের তিনটি ভূমিকাকে চিহ্নিত করা যায় যা তাইওয়ানের শিল্পায়নের মূল ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছেঃ

১। মূল্য নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ‘বিনিয়োগের সামাজিক কাঠামো’ গড়ে তোলা- সরকারী ভর্তুকি দিয়ে কৃষিপণ্যের স্বল্পমূল্য নির্ধারন করা এবং শিল্পপণ্যের উচ্চমূল্য নির্ধারন করে দেওয়া যাতে লোকে শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহী হয়; ভূমি-সংস্কারের মাধ্যমে ভূমিভিত্তিক বৃহৎ-মালিকানা ভেঙ্গে ফেলা এবং ভূমিতে বিনিয়োগ অলাভজনক করা; অর্থব্যব্যস্থা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করা যা’তে money-lending এর মাধ্যমে কোন গোষ্ঠির কাছে অর্থ-সম্পদ পুঞ্জিভূত না হতে পারে।

২। (কৃষককে পর্যাপ্ত ভর্তুকীদানপূর্বক) ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে কৃষিপণ্যের স্বল্পমূল্য ধরে রাখে যা’ শিল্পক্ষেত্রে শ্রমের মজুরী কমিয়ে দেয়। ফলে শিল্পে বর্ধিত মুনাফার সুযোগ এবং সেই সাথে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। সরকার শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে স্বল্প মজুরী বহাল রাখে, কিছু কিছু দেশীয় শিল্প-পণ্যের বাজার সংরক্ষণের মাধ্যমে সেসবে মুনাফা বৃদ্ধি করে। সরকার আর্থিক প্রনোদনা (incentive) এবং সুবিধাজনক শর্তে ঋণ (concessional credit) মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় ও ঝুঁকি কমিয়ে প্রথমে ভারী ও কেমিক্যাল শিল্পে, এবং তারপরে ইলেক্ট্রনিকস ও মেশিনারীজ শিল্পে বিনিয়োগ প্রবাহিত করে। পাশাপাশি এইসব শিল্পের জন্য এক্সপোর্ট-সাবসিডি, শুল্ক মওকুফ, ইত্যাদির মাধ্যমে রপ্তানীকে উৎসাহিত করে।

৩। পাবলিক এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে সরাসরি শিল্পে বিনিয়োগ, ইনকামিং ও আউটগোয়িং বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রন, এবং বৈদেশিক বিনিময় নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে সরকার সরাসরি শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগকে প্রভাবিত করে।

কিছু কিছু সামান্য পার্থক্য বাদে প্রায় একই ধারায় উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে জাপান, কোরিয়া এবং অন্যান্য পূর্ব-এশীয় দেশগুলো তাদের শিল্পক্ষেত্রকে বিকশিত করেছে যেখানে সরকারের একটা বিশেষ সংস্থা- জাপানে MITI, কোরিয়ায় Economic Planning Board (EPB), তাইওয়ানে IDB – নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছে।

রাষ্ট্রকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত+নির্দেশিত এই শিল্পায়নের মডেলে অংশগ্রহনকারী তিনটি দল লক্ষ্যনীয়- সরকার, আমলাতন্ত্রের একটা বিশেষ সংস্থা, এবং উদ্যোক্তাশ্রেণী। এইসব সরকার, আমলাতন্ত্র বা উদ্যোক্তাশ্রেণী কেন জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্পে একে অপরকে সহযোগিতা করেছিলো? দেশপ্রেমের কারণে? নাকি অন্য কোন কারণে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা জাপানের সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন করে যা’র মাধ্যমে জাপানের সামরিক কর্মসূচী পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, এবং কলোনীগুলো হাতছাড়া হয়ে পড়ে। পাশাপাশি আমেরিকা জাপানীজ পণ্যের জন্য নিজের বাজার উন্মুক্ত করে দেয়। জাপান সরকারও এই সুযোগে তার সমস্ত রিসোর্স (পুঁজি, মার্কেটিং চ্যানেল, অভিজ্ঞতা, ইত্যাদি) কাজে লাগিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এর পেছনে আরেকটা কারণ ছিল,- যুদ্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া (জনসন, ১৯৮২)। তাইওয়ান এবং কোরিয়ার সরকার উন্নয়নে আগ্রহী হয় প্রধানতঃ আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাপের কারণে। এই দুই দেশেই ছিল স্বৈরতন্ত্র (কোরিয়ায় সামরিক শাসন এবং তাইওয়ানে একদলীয় শাসন) যা’ আর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতার স্বীকৃতি আদায় করতে সচেষ্ট ছিল। আর দুই সরকারই আর্থিক ভাবে বৈদেশিক (বিশেষ করে আমেরিকার) অনুদান+ঋণের উপর নির্ভরশীল ছিল যা’ ১৯৬০-এর দশকের শেষ থেকে ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় সরকারকে রপ্তানীমূখী শিল্পায়নের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহনে বাধ্য করে (ওয়েড,১৯৯০; চিব্বের,২০০৬)।

আমলাতন্ত্রের বিশেষ সংস্থা সরকারের পলিসির মাধ্যমে গড়ে ওঠে যেখানে উক্ত দেশের দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক ঐতিহ্য (মর্যাদাপূর্ণ উচ্চশিক্ষা, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, উচ্চ নৈতিকতা, ইত্যাদি) সংশ্লিষ্ট আমলাদেরকে সরকারের নির্দেশিত পথে নীতি নির্ধারন ও বাস্তবায়নে চালিত করে। আমলাদের উপর সরকারী এবং সমাজিক চাপ তাদেরকে সঠিক পথে থাকতে বাধ্য করেছে। যেমন, জাপানে কোন আমলার দূর্নীতি প্রমাণিত হলে সরকারী ব্যবস্থা ছাড়াও ব্যাপক সামাজিক চাপের মুখে অনেকেই এমনকি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। কোরিয়া এবং তাইওয়ানে শিল্পায়নের শুরুতে (১৯৭০এর দশকে) সরকার কঠোর হস্তে আমলাদের দূর্নীতি দমন করেছে (ওয়েড, ১৯৯০)। তবে সঠিক পথে চললে আমলাদের জন্য প্রাপ্তিও ছিল অনেক- অর্থে, সম্মানে, মর্যাদায়, ক্ষমতায়, নিরাপত্তায়।

রাষ্ট্র উদ্যোক্তাশ্রেণীকে চাপ+উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে নির্দেশিত পথে শিল্পায়ন কর্মসূচীতে অন্তর্ভূক্ত করেছে। এক্ষেত্রে সরকার দেশের অবাধ্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদেরকে জেলহাজতে নিয়ে নির্যাতন, ব্যক্তিগত শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ, ইত্যাদির মাধ্যমে শায়েস্তা করেছে। আর যারা সরকারের নির্দেশিত পথে চলতে স্বীকৃত হয়েছে, তাদের জন্য সুবিধাজনক শর্তে ঋণ, যন্ত্রাংশ আমদানীতে বিশেষ সুবিধা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে বৈদেশিক বাজারে প্রবেশ, রপ্তানীতে ভর্তুকি, ইত্যাদির মাধ্যমে উৎসাহ যুগিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রে উদ্যোক্তা শ্রেণী না থাকলে সরকার নিজস্ব কর্মসূচীর মাধ্যমে তাদের গড়ে তুলেছে, যেমন- তাইওয়ান (ওয়েড, ১৯৯০)।

সরকার ও উদ্যোক্তাশ্রেণীর এ দ্বন্দ্বকে কোরিয়া আর ভারতে প্রেক্ষিতে আলোচনা করেছেন Vivek Chibber তার Locked in Place: State Building and Late Industrialization in India (২০০৬) গ্রন্থে। এখানে তিনি দেখিয়েছেন যে, ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে কোরিয়া আর ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল। কিন্তু কোরিয়া যেখানে একটি শক্তিশালী পরিকল্পনাকারী সংস্থা (EPB) গড়ে তুলতে পেরেছিলো, ভারত সেখানে ব্যর্থ হয়েছিল। এর কারণ হিসেবে চিব্বের স্বাধীনতা পরবর্তী কোরিয়ার দূর্বল আর ভারতের তুলনামূলক শক্তিশালী উদ্যোক্তাশ্রেণীর উল্লেখ করেছেন।

স্বাধীনতার পূর্বে কোরিয়া দীর্ঘদিন জাপানের কলোনী হিসেবে ছিল যেসময় সেখানকার শিল্প-বানিজ্য প্রায় সমস্তই জাপানীজরা সরাসরি নিজেরা নিয়ন্ত্রন করতো। ফলে কোরিয়ার নিজস্ব শিল্প-উদ্যোক্তাশ্রেণী যথাযথ বিকাশ লাভ করতে পারেনি। এর ফলে কোরিয়ার সরকার সহজেই একটা শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা গড়ে তুলতে পেরেছিলো, যেখানে কোরিয় শিল্পপতিরা সহায়তা করেছিল। অন্যদিকে ভারতের শিল্পপতিরা সরকারকে সেই রকম একটা সংস্থা গড়ে তুলতে বাঁধা দেয়। কিন্তু কোরিয়ান শিল্পপতিরা যেখানে সরকারকে সহায়তা করে, ভারতীয় শিল্পপতিরা সেখানে বাঁধা দেয় কেন?

কোরিয়ার শিল্পপতিরা ঋণ/পুঁজি, আভ্যন্তরীণ বাজার সংরক্ষণ, আমদানী-রপ্তানীতে ভর্তুকী, ইত্যাদি নানাবিধ সরকারী সুবিধার উপর অনেকখানি নির্ভরশীল ছিল। ফলে তারা সরকারের নির্দেশ শুনতে বাধ্য ছিল। এরফলে নিজেদের স্বার্থেই তারা সরকারকে EPB গড়ে তুলতে সহযোগিতা করে। কিন্তু ভারতে অবস্থা ছিল ভিন্ন। ভারতের ছিল বিশাল আভ্যন্তরীণ বাজার। এই বাজারে বিদেশী শিল্পের সাথে প্রতযোগিতার মুখে পড়ে এখানকার শিল্পপতিরাও বাজার সংরক্ষণ, সরকারী ভর্তুকী, অনুদান, ইত্যাদির জন্য সরকারের কাছে দাবী জানায় একটা পরিকল্পনাকারী সংস্থা গড়ে তোলার (নির্দিষ্ট করে ১৯৪১-৪৪ সালে)। কিন্তু ১৯৪৭ এ স্বাধীনতার পর বিদেশী পুঁজির অধিকাংশই ভারত থেকে চলে যায়। এতে ভারতের তাদের পরিত্যাক্ত অবকাঠামো আর আভ্যন্তরীণ বাজারের পুরোটাই দেশীয় শিল্পপতিদের দখলে চলে আসে। ফলে তারা সরকারের কাছ থেকে আভ্যন্তরীণ বাজারের সংরক্ষণ দাবী করলেও অন্যান্য সুবিধার জন্য আর সরকারের মুখাপেক্ষি থাকেনি। একারণে তারা সরকারের মধ্যে তাদের উপর খবরদারী করবে এমন সংস্থা গড়ায় প্রবল বাঁধা তৈরী করে। ফলে ভারতের পরিকল্পনাকারী সংস্থা CACI (Central Advisory Coulcil for Industrialization) ও EDC (Economic development Coulcil) দূর্বল কাঠামোর উপর গড়ে ওঠে। এর ফলে কোরিয়ার EPB যেখানে আমলাতন্ত্রের সকল সংস্থাকে একটা সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে নিয়ে আসতে এবং শিল্পপতিদেরকে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা অনুসরণ করতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিলো, ভারতে CACI তা’তে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

EPB আর CACI এর তুলনামূলক ক্ষমতা এবং দেশীয় শিল্পপতিদের ভূমিকা আরেকবার প্রকাশিত হয় ১৯৭০এর দশকের শুরুতে যখন কোরিয়া এবং ভারত উভয়ই রাষ্ট্রই রপ্তানীমূখী শিল্পায়নের দিকে জোর দিতে শুরু করে। কোরিয়ার প্রধান পুঁজির উৎস আমেরিকার অনুদান দ্রুত কমে আসা শুরু করে ১৯৬০ এর দশকের শেষ দিক থেকে। ফলে সরকার বাধ্য হয় রপ্তানীমূখী শিল্পায়নের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের পরিকল্পনা করে সেই অনুযায়ী শিল্পপতিদের নির্দেশ দেয়। কিন্তু তারা সরকারের সেই আদেশ অমান্য করা শুরু করে। এতে সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। ১৯৬১-৬৪ সময়ে একারণে কোরিয়ায় অস্থিরতা দেখা দেয়। ঠিক এসময়ই জাপানী শিল্পপতিরা টেক্সটাইলসহ আরো কিছু ম্যানুফেকচারিং থেকে নিজেদের সড়িয়ে নিয়ে অটোমোবাইল আর ইলেক্ট্রনিকসে জোর দেয়। এর কারণ ছিল, এইসব শিল্পে অধিক মুনাফা এবং জাপানের আভ্যন্তরীণ শ্রম বাজারে মজুরী বৃদ্ধি। এই অবস্থায় জাপানী শিল্পপতিরা কম মজুরীর দেশে ম্যানুফেকচারিং কারখানা গড়ার সুযোগ খোঁজে। পূর্বের কলোনীয়াল সম্পর্কের কারণে স্বভাবতঃই তারা বিনিয়োগের জন্য কোরিয়া বেছে নেয়। এদিকে কোরিয়ার শিল্পপতিরা দেখে যে জাপানীজদের সাথে যোগ দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের পুঁজি+প্রযুক্তি+মার্কেটিং চ্যানেলের সহায়তা পাওয়া যাবে। এই প্রেক্ষিতে কোরিয়ার শিল্পপতিরা সরকারের রপ্তানীমূখী শিল্প-পরিকল্পনায় সায় দেয়। ফলশ্রূতিতে ১৯৭০এর দশকে কোরিয়ায় রপ্তানীমূখী শিল্পে বিপ্লব ঘটে।

একই সময় ভারতেও সরকার রপ্তানীমূখী শিল্পায়নের পরিকল্পনা গ্রহন করে এবং শিল্পপতিদেরকে তা’ অনুসরণ করতে বলে। কিন্তু এখানে কোন বৈদেশিক পুঁজি রপ্তানীমূখী শিল্পে বিনিয়োগে রাজী ছিলো না, তারা সবাই ভারতের আভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য শিল্প-উৎপাদনে আগ্রহ প্রকাশ করে। ফলে ভারতীয় শিল্পপতিরা বৈদেশিক পুঁজির প্রবেশে বিরোধীতা করে এবং সরকারকে প্রভাবিত করে বৈদেশিক পুঁজি হতে দেশীয় শিল্প ও আভ্যন্তরীণ বাজার সংরক্ষণ করতে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের মতো যথেষ্ঠ পুঁজি, মানসম্মত প্রযুক্তি এবং মার্কেটিং চ্যানেল না থাকায় ভারতীয় শিল্পপতিরা রপ্তানীমূখী শিল্পে আগ্রহী হয়নি, দেশীয় বাজারের নিশ্চিত মুনাফায় সন্তুষ্ট থাকে। দূর্বল CACI-র পক্ষেও তাদেরকে রপ্তানীমূখী শিল্পায়নে বিনিয়োগে বাধ্য করা যায়নি। ফলে ভারতে কোরিয়ার অনুরূপ শিল্প-বিপ্লব ঘটেনি।

জাপান, কোরিয়া আর তাইওয়ানের শিল্পায়নের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে, শিল্প-বিপ্লব কোন সরকার, আমলাতন্ত্র বা পুঁজিপতি শ্রেণীর দেশপ্রেমের ফল নয়, বরং তা প্রত্যেক গোষ্ঠির বস্তুগত স্বার্থের সমন্বিত ফল যা’ উক্ত দেশের আভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং বহির্বিশ্বের সাথে (বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশের সাথে) সম্পর্কের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত।

৩,১০১ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শিল্পায়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নঃ পূর্ব-এশীয় অভিজ্ঞতা”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    আমারো মনে হয় সরাসরি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধান ছাড়া উন্নয়ন অনেক কঠিন, হয়তোবা অসম্ভব।

    বাংলাদেশে 'আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটা বিশেষ সংস্থা ' গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন কি, যেখানে সরকার শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী দের কাছে বলতে গেলে এক ধরণের জিম্মি অবস্থায় আছে?

    আমাদের দেশেও কিন্তু আমলারা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই আসে, উচ্চশিক্ষা, বা অভিজ্ঞতায় তারা হয়তো খুব পিছিনে নেই, কিন্তু নিশ্চিতভাবে পিছিয়ে আছে নৈতিকতায়। ফলে জাপানের যেই উদাহরন দিলেন, (কোন আমলার দূর্নীতি প্রমাণিত হলে সরকারী ব্যবস্থা ছাড়াও ব্যাপক সামাজিক চাপের মুখে অনেকেই এমনকি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় ) সেটা আমাদের এখানে রুপকথার গল্প হয়ে থাকবে আরো অনেকদিন।

    রাষ্ট্র উদ্যোক্তাশ্রেণীকে চাপ+উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে নির্দেশিত পথে শিল্পায়ন কর্মসূচীতে অন্তর্ভূক্ত করেছে। এক্ষেত্রে সরকার দেশের অবাধ্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদেরকে জেলহাজতে নিয়ে নির্যাতন, ব্যক্তিগত শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ, ইত্যাদির মাধ্যমে শায়েস্তা করেছে। আর যারা সরকারের নির্দেশিত পথে চলতে স্বীকৃত হয়েছে, তাদের জন্য সুবিধাজনক শর্তে ঋণ, যন্ত্রাংশ আমদানীতে বিশেষ সুবিধা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে বৈদেশিক বাজারে প্রবেশ, রপ্তানীতে ভর্তুকি, ইত্যাদির মাধ্যমে উৎসাহ যুগিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রে উদ্যোক্তা শ্রেণী না থাকলে সরকার নিজস্ব কর্মসূচীর মাধ্যমে তাদের গড়ে তুলেছে, যেমন- তাইওয়ান (ওয়েড, ১৯৯০)

    এই পদ্ধতিটা পছন্দ হয়েছে, হয়তো সদিচ্ছা থাকলে এই ধরনের কিছু করা আমাদের এখানেও সম্ভব।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
      আমারো মনে হয় সরাসরি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধান ছাড়া উন্নয়ন অনেক কঠিন, হয়তোবা অসম্ভব।

      ঠিকই ধরেছো। আসলেই অসম্ভব, এ' যাবতকালের বিশ্বের ইতিহাস তা'ই বলে।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  2. তানভীর (৯৪-০০)

    খুব ভালো লাগছে সিরিজটা।
    আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন মাথায় আসলঃ
    ১. আমাদের আমলারা কি দলীয়/রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত?
    ২. দলীয়/রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে কি শক্তিশালী একটা সংস্থা গড়ে তোলা সম্ভব?
    ৩. আমাদের দেশের সরকার কি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের হাতে জিম্মি? নাকি উল্টাটা?
    ৪. সত্যিকারের দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা কি আমাদের কোন সরকার করেছে? দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া তো এ ধরণের কোন উন্নয়ন সম্ভব না! তাহলে আমরা কিভাবে এই সঙ্কটের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাব?

    মাহমুদ ভাই, অনেক প্রশ্ন করে ফেললাম। পরের পর্বে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় বিষয়গুলোর দিকে আলোকপাত করলে খুশী হতাম। 🙂

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      তানভীর,
      ধন্যবাদ ভালো লেগেছে বলে।

      পরের পর্বে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় বিষয়গুলোর দিকে আলোকপাত করলে খুশী হতাম।

      আমি এখনো জানিনা আসলে কিভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব। তবে পরের পরের পর্বে এই বিষয়ে আমার প্রাথমিক+ঝাপসা ধারণাগুলো থাকবে।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  3. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    আরেকটা বিশ্লেষনাত্মক পোস্ট । বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা খাপো খাপো(ক.রা. মাস্ফু) না করলে আমাদেরও একটা ভাল অবস্থানে থাকার কথা ছিল । বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্লেষনাত্মক পোস্ট আশা করছি মাহমুদ ভাই ।

    জবাব দিন
  4. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)
    আমলাতন্ত্রের বিশেষ সংস্থা সরকারের পলিসির মাধ্যমে গড়ে ওঠে যেখানে উক্ত দেশের দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক ঐতিহ্য (মর্যাদাপূর্ণ উচ্চশিক্ষা, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, উচ্চ নৈতিকতা, ইত্যাদি) সংশ্লিষ্ট আমলাদেরকে সরকারের নির্দেশিত পথে নীতি নির্ধারন ও বাস্তবায়নে চালিত করে। আমলাদের উপর সরকারী এবং সমাজিক চাপ তাদেরকে সঠিক পথে থাকতে বাধ্য করেছে। যেমন, জাপানে কোন আমলার দূর্নীতি প্রমাণিত হলে সরকারী ব্যবস্থা ছাড়াও ব্যাপক সামাজিক চাপের মুখে অনেকেই এমনকি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। কোরিয়া এবং তাইওয়ানে শিল্পায়নের শুরুতে (১৯৭০এর দশকে) সরকার কঠোর হস্তে আমলাদের দূর্নীতি দমন করেছে (ওয়েড, ১৯৯০)। তবে সঠিক পথে চললে আমলাদের জন্য প্রাপ্তিও ছিল অনেক- অর্থে, সম্মানে, মর্যাদায়, ক্ষমতায়, নিরাপত্তায়।

    কবে আমাদের দেশেও এমন হবে ............ ???

    জবাব দিন
  5. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ও আরেকটা কথা, মাহমুদ ভাই, বেশি কষ্ট না হলে প্রাসংগিক বইগুলির লিংক সংগে দিয়ে দিতে পারেন। আগ্রহীদের উপকারে আসবে।
    আপনি খুশি হবেন, আমি Locked in Place: State Building and Late Industrialization in India বইটা খুঁজে বের করেছি পড়ার জন্যে এখান থেকে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  6. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আমি বেশ বিভ্রান্ত মাহমুদ তোমার এই দুটি লেখা পড়ে। তুমি কি বলতে চাইছো? নাকি শুধুই এটা একটা এক্সারসাইজ?

    আমার পড়াশুনা ও পর্যবেক্ষন থেকে বলতে পারি, শিল্পায়ন বা উন্নয়নে একেক দেশের অভিজ্ঞতা একেক রকম। কোনো নির্দিষ্ট মডেল ধরে উন্নয়ন হয়না। জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর........... পরের ধাপে মালয়েশিয়া, চীন.......... এখন ভিয়েতনাম- এসব দেশই নিজস্ব পথে এগিয়েছে। আর এটা করতে কোনো সহজ সরল পথ ছিলনা। এর জন্য সেসব দেশের মানুষকে প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছে। সেটা ছিল ষাট, সত্তুর, আশি বা নব্বইয়ের দশক। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর পাশ্চাত্যের আর্থিক ও আদর্শিক সমর্থন পেয়েছে পুরোপুরি।

    পরবর্তী ধাপে মালয়েশিয়া, চীন.......... এখন ভিয়েতনাম আশি ও নব্বইয়ের দশকে যেভাবে এগিয়েছে, তাদের মডেলটা ভিন্ন। পাশ্চাত্যের সমর্থন-সহযোগিতা না পেলেও একদিকে রাষ্ট্রের সর্বাত্মক সহায়তা, অন্যদিকে বিদেশি বাণিজ্য পুঁজির প্রবাহ এদের শিল্পায়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।

    নব্বই পরবর্তী ভারত এক ভিন্ন দেশ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে প্রবল উৎসাহ দেওয়া, অভ্যন্তরীন বাজারের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া, বিদেশি পুঁজিকে স্বাগত জানালেও পুঁজি পাচারকে নিরুৎসাহিত করা- এমন সব নীতি ভারতে গত এক দশকে ৭ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে। ভারতের বড় শক্তি তার নিজের বাজার। আর তাদের আছে শক্তিশালী আমলা শ্রেণী। ফলে আমি মনে করি আগামী ১০ বছরে ভারত বর্তমানের অনেক উন্নত দেশকে ছাড়িয়ে যাবে।

    উপরের দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের পার্থক্য হলো, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম উন্নয়নের পর্যায়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রমিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিপীড়ন চালিয়ে শিল্পায়ন ও উন্নয়নকে নিশ্চিত করেছে। আর ভারত গত ৬ দশক ধরে বহুমতের চর্চা করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত করে উন্নয়নের পথে যাচ্ছে। ফলে তার উন্নয়ন অনেক বেশি টেকসই ও মানবিক হচ্ছে ও হবে।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      সানা ভাই, ৯৯০ কিন্তু হয়ে গেছে... কাউন্ট ডাউন এখন সিঙ্গেল ডিজিটে 😀


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
    • মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

      কৌতুহলের বশে বলছি সানা ভাই ----------

      জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম উন্নয়নের পর্যায়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রমিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিপীড়ন চালিয়ে শিল্পায়ন ও উন্নয়নকে নিশ্চিত করেছে।

      এই ব্যাপারে দুয়েকটা রেফারেন্স দেবেন কি ?? :just: পড়ার জন্যে।

      জবাব দিন
      • সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

        মইনুল, আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তে গিয়ে উন্নয়ন পাঠে এসব পড়েছিলাম। পরে নব্বই দশকে রাজনীতি করতে গিয়ে সমাজতন্ত্র-পুঁজিবাদ নিয়ে যা পড়াশুনা আর বর্তমানের পর্যবেক্ষন নিয়ে এসব মন্তব্য আমার। সুনির্দিষ্ট করে কোনো বইয়ের কথা বলতে পারবো না। তবু খোঁজ নিয়ে আশা করি জানাতে পারবো।


        "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

        জবাব দিন
        • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

          সানা ভাই,
          কিছু মনে কইরেন না, একটা ব্যাপার খোলাসা করি।

          আমি বেশ বিভ্রান্ত মাহমুদ তোমার এই দুটি লেখা পড়ে। তুমি কি বলতে চাইছো? নাকি শুধুই এটা একটা এক্সারসাইজ?

          পরে বলেছেন

          আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তে গিয়ে উন্নয়ন পাঠে এসব পড়েছিলাম। পরে নব্বই দশকে রাজনীতি করতে গিয়ে সমাজতন্ত্র-পুঁজিবাদ নিয়ে যা পড়াশুনা আর বর্তমানের পর্যবেক্ষন নিয়ে এসব মন্তব্য আমার।

          আমার এই সিরিজের মূল বিষয় "Developmental State"। এই ধারণাটা মূলতঃ ১৯৯০-এর দশকে একাডেমীতে প্রচলিত হয়েছে(আমার রেফারেন্সগুলোর দিকে দেখলেই এটা বোঝা যাবে)। বেসিক আইডিয়াটা একটাই- রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে শিল্পায়নের মাধ্যমে উন্নয়ন; তবে পথ ভিন্ন ভিন্ন যা আপনিও বলেছেন 🙂 ।

          ভাইয়া, একটু কষ্ট করে বলবেন কি কোন কোন পয়েন্টে আপনি বিভ্রান্ত বোধ করছেন। তেমন কিছু থাকলে নিজের ধারণাটা শুধরে নিই।


          There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

          জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      সানা ভাই,

      আপনারেই আশা করছিলাম 😀 । খুবই ভালো লাগল সাধারণ মানুষের জন্য আপনার ভাবনার কথা জেনে। ওটাও আসবে।

      আমার পড়াশুনা ও পর্যবেক্ষন থেকে বলতে পারি, শিল্পায়ন বা উন্নয়নে একেক দেশের অভিজ্ঞতা একেক রকম। কোনো নির্দিষ্ট মডেল ধরে উন্নয়ন হয়না। জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর……….. পরের ধাপে মালয়েশিয়া, চীন………. এখন ভিয়েতনাম- এসব দেশই নিজস্ব পথে এগিয়েছে। আর এটা করতে কোনো সহজ সরল পথ

      আমি আসলে জানতে চাই সেই "নিজস্ব পথগুলো", সেই চেষ্টারই অংশ বলতে পারেন এই আলোচনাটা। বিশ্বব্যাংক+আইএমএফের পোষা অর্থনীতিবিদদের মুখে কল্পকাহিনী শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।

      ভারতের উন্নয়নের 'কথিত' কাহিনী অতি সম্প্রতিকালের, আর আমার এই লেখার বিষয়বস্তু মূলতঃ আরেকটু আগের, মানে ১৯৭০+১৯৮০র দশকের।

      পরের পর্বে আশা করি আরো খোলাসা হবে আমার বক্তব্য।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।